সুনানে ইবনে মাজাহ > হজ্জ > রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)ের হজ্জ

৩০৭৪

থেকে বর্নিতঃ

আমরা জাবির বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) এর নিকট গেলাম। আমরা তার নিকট উপস্থিত হলে তিনি সাক্ষাতপ্রার্থীদের পরিচয় জানতে চান। আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে আমি বলি যে, আমি ইবনুল হুসাইনের পুত্র মুহাম্মাদ। অতএব তিনি (স্নেহভরে) আমার দিকে তার হাত বাড়ালেন এবং তা আমার মাথার উপর রাখলেন। তিনি প্রথমে আমার পরিচ্ছদের উপর দিকের বোতাম, অতঃপর নিচের বোতাম খুললেন, অতঃপর তার হাত আমার বুকের উপর রাখলেন। আমি তখন উঠতি বয়সের যুবক। তিনি বলেন, তোমাকে মোবারকবাদ জানাই। তুমি যা জানতে চাও জিজ্ঞেস করো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এ সময় তিনি (বাধ্যর্কজনিত কারণে) দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। ইতোমধ্যে সলাতের ওয়াক্ত হলো। তিনি নিজেকে একটি চাদরে আবৃত করে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি যখনই চাদরের প্রান্তভাগ নিজের কাঁধের উপর রাখতেন, তা (আকারে) ছোট হওয়ার কারণে নিচে পড়ে যেতো। তার আরেকটি বড় চাদর তার পাশেই আলনায় রাখা ছিল। তিনি আমাদের নিয়ে সলাত আদায় করলেন। অতঃপর আমি বললাম, আপনি আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর (বিদায়) হাজ্জ্ সম্পর্কে অবহিত করুন। জাবির (রাঃ) স্বহস্তে (৯) সংখ্যার প্রতি ইংগিত করে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নয় বছর (মদীনায়) অবস্থান করেন এবং (এ সময়কালের মধ্যে) হজ্জ করেননি। অতঃপর ১০ম বর্ষে লোকেরদের মধ্যে ঘোষণা করালেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) (এ বছর) হজ্জে যাবেন। সুতরাং মদীনায় অসংখ্য লোকের সমাগম হলো। তাদের প্রত্যেকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অনুসরণ করতে এবং তাঁর অনুরূপ আমল করতে আগ্রহী। অতএবং তিনি রওয়ানা হলেন এবং আমরাও তাঁর সাথে রওয়ানা হলাম। আমরা যুল-হুলাইফা নামক স্থানে পৌঁছলে আসমা বিনতু উমাইস (রাঃ) মুহাম্মাদ বিন আবূ বাকরকে প্রসব করলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট লোক পাঠিয়ে জানতে চাইলেন, এমন অবস্থায় আমি কী করবো? তিনি বলেনঃ তুমি গোসল করো, এক খণ্ড কাপড় দিয়ে পট্টি বাঁধো এবং ইহরামের পোশাক পরিধান করো। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - মসজিদে (ইহরামের দু’রাক’আত) সলাত আদায় করলেন, অতঃপর ‘কাসওয়া’ নামক উষ্ট্রীতে আরোহণ করলেন। অবশেষে ‘বায়দা’ নামক স্থানে তাঁর উষ্ট্রী যখন তাঁকে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, তখন আমি (জাবির) সামনের দিকে যতদূর দৃষ্টিযায় তাকিয়ে দেখলাম, লোকে লোকারণ্য, কতক সওয়ারীতে এবং কতক পদব্রজে অগ্রসর হচ্ছে। ডান দিকে, বাঁ দিকে এবং পেছনেও একই দৃশ্য। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের মাঝখানে ছিলেন এবং তাঁর উপর কুরআন নাযিল হচ্ছিল। একমাত্র তিনিই এর আসল তাৎপর্য জানেন এবং তিনি যা করতেন আমরাও তাই করতাম। তিনি আল্লাহর তাওহীদ সম্বলিত এই তালবিয়া পাঠ করলেনঃ লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইকা ইন্নাল-হামদা ওয়ান-নিয়’মাতা লাকা ওয়াল-মুলকা লা শারীকা লাকা” (আমি তোমার দরবারে হাজির আছি যে আল্লাহ, আমি তোমার দরবারে হাজির, আমি তোমার দরবারে হাজির। তোমার কোন শরীক নাই, আমি তোমার দরবারে উপস্থিত। নিশ্চিত সমস্ত প্রশংসা, সমস্ত নিয়ামত তোমারই এবং রাজত্বও, তোমার কোন শরীক নাই)। লোকেরাও উপরোক্ত তালবিয়া পাঠ করলো যা (আজকাল) পাঠ করা হয়। লোকেরা তাঁর তালবিয়ার সাথে কিছু শব্দ বাড়িয়ে বলেন, কিন্তু তিনি তাদের বাধা দেননি। আর রাসূলূল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপরোক্ত তালবিয়াই পাঠ করেন। জাবির (রাঃ) বলেন, আমরা হজ্জ ছাড়া অন্য কিছুর নিয়াত করিনি, আমরা উমরার কথা জানতাম না। অবশেষ আমরা তাঁর সাথে বাইতুল্লাহ শরীফে পৌঁছলে তিনি রুকন (হাজরে আসওয়াদ) চুম্বন করলেন, অতঃপর (সাতবর কাবা ঘর) তাওয়াফ করলেন, (প্রথম) তিনবার দ্রুত গতিতে এবং চারবার স্বাভাবিক গতিতে। অতঃপর তিনি মাকামে ইবরাহীমে পৌঁছে তিলাওয়াত করলেনঃ “তোমরা ইবরাহীমের দাঁড়াবার স্থানকে সলাতের স্থানরূপে গ্রহণ করো” (সূরা বাকারাঃ ১২৫) তিনি মাকামে ইবরাহীমকে তাঁর ও বাইতুল্লাহর মাঝখানে রেখে (দুই রাক’আত সলাত আদায় করলেন)। (জা’ফর বলেন) আমার পিতা (মুহাম্মাদ) বলতেন, আমি যতদূর জানি, তিনি (জাবির) বরং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণনা করেছেনঃ তিনি দু’ রাক্‌আত নামাযে সূরা কাফিরূন ও সূরা ইখলাস পড়েছেন। অতঃপর মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাইতুল্লাহ ফিরে এলেন এবং হাজরে আসওয়াদে চুমা দিলেন। অতঃপর তিনি দরজা দিয়ে সাফা পাহাড়ের দিকে বের হলেন এবং সাফার নিকটবর্তী হয়ে তিলাওয়াত করলেনঃ “নিশ্চয় সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয় আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্যতম” (সূরা বাকারাঃ ১৫৮) এবং (আরও বললেন) আল্লাহ তা’আলা যা দিয়ে আরম্ভ করেছেন আমরাও তা দিয়ে আরম্ভ করবো। অতএব তিনি সাফা পাহাড় থেকে শুরু করলে এবং তার এতোটা উপরে আরোহন করলেন যে, বাইতুল্লাহ শরীফ দেখতে পেলেন। তিনি (কিবলামুখী হয়ে) আল্লাহর একত্ব ও মহত্ব ঘোষণা করলেন এবং এ দুআ’ পড়েন : “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্‌দাহু লা শারীকা লাহু লাহুল-মুলক ওয়া লাহুল-হামদু ইউহ্‌যী ওয়া ইউমীতু ওয়া হুওয়া আলা কুল্লি শাইয়েন কাদীর। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্‌দাহু লা-শারীকা লাহু আনজাযা ওয়াদাহু ওয়অ নাসারা আবদাহু ওয়আ হাযামাল আহযাবা ওয়াহ্‌দাহু” (আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই, তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নাই, তাঁর জন্য রাজত্ব এবং তাঁর জন্য সমস্ত প্রশংসা, তিনি প্রতিটি জিনিসের উপর শক্তিমান। আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই, তিনি এক, তিনি নিজের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন, নিজের বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং একাই সমস্ত সম্মিলিত শক্তিকে পরাভূত করেছেন)। তিনি এ দুআ’ তিনবার পড়লেন এবং মাঝখানে অনুরূপ আরো কিছু দুআ’ পড়লেন। অতঃপর তিনি নেমে মারওয়া পাহাড়ের দিকে অ্গ্রসর হলেন, যাবত না তাঁর পা মোবারক উপত্যকার সমতল ভূমিতে গিয়ে ঠেকলো। তিনি দৌড়ে চললেন যাবত না উপত্যকার মধ্যভাগ অতিক্রম করলে। মারওয়া পাহাড়ে উঠার সময় হেঁটে উঠলেন, অতঃপর এখানেও তাই করলেন, যা তিনি সাফা পাহাড়ে করেছিলেন। শেষ তাওয়াফে তিনি মারওয়া পাহাড়ে পৌঁছে (লোকেদের সম্বোধন করে) বললেনঃ যদি আমি আগে বুঝতে পারতাম যে, আমার কী করা উচিত তাহলে আমি সাথে করে কোরবানীর পশু আনতাম না এবং (হজ্জের) ইহরামকে উমরায় পরিবর্তিত করতাম। অতএব তোমাদের মধ্যে যার সাথে কোরবানীর পশু নাই, সে যেন ইহরাম খুলে ফেলে এবং একে উমরায় পরিণত করে। তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং যাদের সাথে কোরবানীর পশু ছিল তারা ব্যতীত সকলেই ইহরাম খুলে ফেলেন এবং চুল ছোট করলেন। এ সময় সুরাকা বিন মালিক বিন জুশুম (রাঃ) দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ ব্যবস্থা কি আমাদের এ বছরের জন্য, না সর্বকালের জন্য? রাসূলূল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজ হাতের আংগুলগুলো পরস্পরের ফাঁকে ঢুকিয়ে দু’বার বললেনঃ উমরা হজ্জের মধ্যে প্রবেশ করলো, না, বরং সর্বকালের জন্য। এ সময় আলী (রাঃ) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর জন্য কোরবানীর পশু নিয়ে এলেন এবং যারা ইহরাম খুলে ফেলেছে, ফাতিমা (রাঃ) কেও তাদের অন্তুর্ভুক্ত দেখতে পেলেন। তিনি রঙ্গীন কাপড় পরিহিত ছিলেন এবং চোখে সুরমা দিয়েছিলেন। আলী (রাঃ) তা অপছন্দ করলেন। ফাতিমা (রাঃ) বললেন, আমার পিতা আমাকে এরূপ করার নির্দেশ দিয়েছেন। (রাবী বলেন) এরপর আলী (রাঃ) ইরাকে অবস্থানকালে বলতেন, তখন আমি রাসূলুল্লহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর নিকট উপস্থিত হলাম ফাতিমার উপর অসন্তুষ্ট অবস্থায়, সে যা করেছে সে সম্পর্কে মাসআলা জানার জন্য। আমি তাঁকে বললাম যে, আমি তার এ কাজ অপছন্দ করেছি। রাসূলূল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ফাতিমা ঠিকই করেছে, ঠিকই বলেছে! তুমি হজ্জের ইহরাম বাঁধার সময় কী বলেছিলে? আলী (রাঃ) বলেন, আমি বলেছিলাম, হে আল্লাহ! আমি ইহরাম বাঁধলাম যে নিয়াতে ইহরাম বেঁধেছেন আপনার রাসূল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ আমার সাথে কোরবানীর পশু আছে, অতএব তুমি (আলী) ইহরাম খুলো না। জাবির (রাঃ) বলেন, ‘আলী (রাঃ) ইয়ামেন থেকে যে পশুপাল নিয়ে আসেন এবং নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের সাথে করে যে পশুগুলো নিয়ে এসেছিলেন এর সর্বমোট সংখ্যা দাঁড়ায় একশত। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং যাদের সাথে কোরবানীর পশু ছিল তারা ব্যতীত আর সকলেই ইহরাম খুলে ফেলেন এবং চুল ছোট করে। অতঃপর তারবিয়ার দিন (৮ যিলহজ্জ) শুরু হলে লোকেরা পুনরায় ইহরাম বাঁধলো এবং মিনার দিকে রওয়ানা হলো। আর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সওয়ার হয়ে গেলেন এবং তথায় যোহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ফজরের সলাত আদায় করলেন। অতঃপর তিনি সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত তথায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন এবং তাঁর জন্য নামিরা নামক স্থানে গিয়ে তাঁবু টানানোর জন্য নির্দেশ দিলেন, অতঃপর নিজেও রওয়ানা হয়ে গেলেন। কুরাইশগণ নিশ্চিত ছিল যে, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাশআরুল হারাম নামক স্থানে অবস্থান করবেন, যেমন কুরাইশগণ জাহিলী যুগে এখানে অবস্থান করতো (মানহানি হওয়ার আশঙ্কায় তারা সাধারনের সাথে একত্রে আরাফাতে অবস্থান করতো না)। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামনে অগ্রসর হতে থাকলেন যাবত না আরাফাতে পৌঁছলেন। তিনি দেখতে পেলেন, নামিরায় তাঁর জন্য তাঁবু খাটানো হয়েছে। তিনি এখানে অবতরণ করলেন। অবমেষ সূর্য (পশ্চিমাকাশে) ঢলে পড়লে তিনি তাঁর কাসওয়া নামক উষ্ট্রী সাজানোর জন্য নির্দেশ দিলে তা সাজানো হলো। অতঃপর তিনি উপত্যকার মাঝখানে আসেন এবং লোকেদের উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেনঃ “তোমাদের জীবন ও সম্পদ তোমাদের পরস্পরের জন্য হারাম, যেভাবে এই দিনে, এই মাসে এবং এই শহরে হারাম”। “সাবধান! জাহিলী যুগের সকল জিনিস (অপ-সংষ্কৃতি) রহিত হলো। আমাদের (বংশের) রক্তের দাবির মধ্যে সর্বপ্রথম আমি রবীআ ইবনুল হারিসের রক্তের দাবি রহিত করলাম”। সে সাদ গোত্রে শিশু অবস্থায় লালিত-পালিত হওয়াকালীন হুযাইল গোত্রের লোকেরা তাকে হত্যা করেছিল। “জাহিলী যুগের সূদও রহিত করা হলো। আমাদের বংশের প্রাপ্য সূদের মধ্যে সর্ব প্রথম আমি আবদুল মুত্তালিবের পুত্র আব্বাস (রাঃ) -র প্রাপ্য সমুদয় সূদ রহিত করলাম”। “তোমরা স্ত্রীলোকদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করবে। তোমরা তাদেরকে আল্লাহর জামানতে গ্রহণ করেছো এবং আল্লাহর কালামের মাধ্যমে তাদের লজ্জাস্থান নিজেদের জন্য হালাল করেছো। তাদের উপর তোমাদের অধিকার এই যে, তারা যেন তোমাদের অন্দর মহলে এমন কোন লোককে যেতে না দেয় যাকে তোমরা অপছন্দ করো। যদি তারা অনুরূপ কাজ করে তবে তাদেরকে হাল্কাভাবে মারপিট করবে। আর তোমাদের উপর তাদের অধিকার এই যে, তোমরা ন্যয়সঙ্গতভাবে তাদের পোশাক ও ভরণপোষণের ব্যবস্থা করবে”। “আমি তোমাদের মাঝে এমন এক জিনিস রেখে যাচ্ছি যা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব”। “তোমাদেরকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে, তখন তোমরা কী বলবে? উপস্থিত জনতা বললো, আমরা সাক্ষ্য দিবো যে, আপনি (আল্লাহর বাণী) পৌঁছে দিয়েছেন, আপনার কর্তব্য পালন করেছেন এবং সদুপদেশ দিয়েছেন”। অতঃপর তিনি নিজের তর্জনী (শাহাদাত আঙ্গুল) আকাশের দিকে উত্তোলন করেন এবং জনতার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেনঃ হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন, হে আল্লাহ, আপনি সাক্ষী থাকুন (তিনবার) অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাসওয়ার উপর সওয়ার হয়ে আল মাওকিফ (অবস্থানস্থল) এ এলেন, নিজের কাসওয়া নামক উষ্ট্রীর পেট পাথরের স্তুপের দিকে করে দিলেন এবং পায়ে হাঁটার পথ নিজের সামনে রেখে কিবলামুখী হয়ে দাঁড়ালেন। সূর্য গোলক সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেল। তিনি উসামা (রাঃ) -কে তাঁর বাহনের পেছন দিকে বসালেন এবং কাসওয়ার নাসারন্ধ্রের দড়ি সজোরে টান দিলেন, ফলে এর মাথা জিনপোষ স্পর্শ করলো (এবং তা অগ্রযাত্রা শুরু করলো)। তিনি তাঁর ডান হাতের ইশারায় বলেনঃ “হে জনমণ্ডলী! শান্তভাবে, শান্তভাবে (ধীরে সুস্থে মধ্যম গতিতে) অগ্রসর হও”। তখনই তিনি বালুর স্তূপের নিকট পৌঁছতেন, কাসওয়ার নাসারন্ধ্রের দড়ি কিছুটা ঢিল দিতেন, যাতে তা উপর দিকে উঠতে পারে। এভাবে তিনি মুযদালিফায় পৌঁছলেন এবং এখানে এক আযানে ও দু’ ইকামতে মাগরিব ও ইশার সলাত আদায় করলেন। এই দু’ সলাতের মাঝখানে অন্য কোন সলাত আদায় করেননি। অতপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুয়ে ঘুমালেন যাবত না ফজরের ওয়াক্ত হলো। অতঃপর ঊষা পরিস্কার হয়ে গেলে তিনি আযান ও ইকামাতসহ ফজরের সলাত আদায় করলেন। অতঃপর কাসওয়ার পিঠে আরোহন করে ‘মাশআরুল-হারাম’ নামক স্থানে আসেন। এখানে তিনি (কিবলামুখী হয়ে) আল্লাহর প্রশংসা করলেন, তাঁর মহত্ব বর্ণনা করলেন, কলেমা তাওহীদ পড়লেন এবং তাঁর একত্ব ঘোষণা করলেন। আকাশ যথেষ্ট পরিস্কার না হওয়া পর্যন্ত তিনি দাঁড়িয়ে এরূপ করতে থাকলেন। সূর্য উদয়ের পূর্বে তিনি আবার রওয়ানা হলেন এবং ফাযল বিন আব্বাসকে সওয়ারীতে তাঁর পিছনে বসালেন। সে ছিল সুদর্শন যুবক এং তার মাথার চুল ছিল অত্যন্ত সুন্দর। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন অগ্রসর হলেন তখন (পাশাপাশি) একদল মহিলাও যাচ্ছিল। ফাযল তাদের দিকে তাকাতে লাগলো। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের হাত অন্যদিক থেকে ফাযলের চেহারার উপর রাখলেন। সে আবার অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো। এভাবে তিনি ‘বাতনে মুহাসসির’ নামক স্থানে পৌঁছলেন এবং সাওয়ারীর গতি কিছুটা দ্রুততর করলে। তিনি মধ্যপথ দিয়ে অগ্রসর হলেন যা জামরাতুল কুবরায় গিয়ে পৌঁছেছে। তিনি বৃক্ষের নিকটের জামরায় এলেন এবং নিচের খালি জায়গায় দাঁড়িয়ে এখানে সাতটি কাঁকর নিক্ষেপ করলে এবং নিজ হাতে তেষট্টিটি পশু যবেহ করলেন। অতঃপর যে কয়টি অবশিষ্ট ছিল তা আলী (রাঃ) কে যবেহ করতে বললেন এবং তিনি তা কোরবানী করলেন। তিনি নিজ পশুতে ‘আলীকেও শরীক করলেন। অতঃপর তিনি প্রতিটি পশুর কিছু অংশ নিয়ে একত্রে রান্না করার নির্দেশ দিলে। অতএব তাই করা হলো। তাঁরা উভয়ে এই গোশত থেকে আহার করলেন এবং ঝোল পান করলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সওয়ার হয়ে বাইতুল্লাহর দিকে রওয়ানা হলেন এবং মক্বায় পৌঁছে যোহরের সলাত আদায় করলেন। অতঃপর তিনি (নিজ গোত্র) বনূ আবদুল মুত্তালিবে এলেন। তারা লোকেদের যমযমের পানি পান করাচ্ছিল। তিনি বললেনঃ হে আবদুল্ মুত্তালিবের বংশধর! পানি তোলো। আমি যদি আশঙ্কা না করতাম যে, পানি পান করানোর ব্যাপারে লোকেরা তোমাদের পরাভূত করবে, তাহলে আমি নিজেও তোমাদের সাথে পানি তুলতাম। তারা তাঁকে এক বালতি পানি দিলো এবং তিনি তা থেকে কিছু পান করলেন। [৩০৭৪] তাহকীক আলবানীঃ সহীহ।

[৩০৭৪] বুখারী ১৫৫৭, ১৫৬৮, ১৫৭০, ১৬৫১, ১৭৮৫, ২৫০৬, ৪৩৫২, ৭২৩০, ৭৩৬৭, মুসলীম ১২১৩, ১২১৫, ১২১৬/১-৫, ১২১৮/১-৩, ১২৬৩/১-২, ১২৭৩, ১২৭৯, ১২৯৯, তিরমিযি ৮১৭, ৮৫৬-৫৭, ৮৬২, ৮৬৯, ৮৮৬, ৮৯৭, ৯৪৭, ২৯৬৭, ৩৭৮৬, নাসাঈ ২১৪, ২৯১, ৩৯২, ৪২৯, ৬০৪, ২৭১২, ২৭৪০, ২৭৪৩-৪৪, ২৭৫৬, ২৭৬১-৬৩, ২৭৯৮, ২৮০৫, ২৮৭২, ২৯৩৯, ২৯৪৪, ২৯৬১, ২৯৬২-৬৩, ২৯৬৯-৭৫, ২৯৮১-৮৫, ২৯৯৪, ৩০২১-২২, ৩০৫৩-৫৪, ৩০৭৪-৭৬, ৪১১৯, আবু দাউদ ১৭৮৫, ১৭৮৭-৮৯, ১৮১২, ১৮৮০, ১৮৯৫, ১৯০৫-৭, ১৯৪৪, ৩৯৬৯, আহমাদ ১৩৭০২, ১৩৮০১, ১৩৮২৬, ১৩৮৬৭, ১৪০০৯, ১৪০৩১, ১৪১৬১, ১৪২৫০, ১৪৪৮৪, ১৪৫২৫, ১৪৫৮৯, ১৪৬২১, ১৪৬৬৭, ১৪৭৩৫, ১৪৮২১, ১৪৮৫১, মুয়াত্তা মালিক ৮১৬, ৮৩৫-৩৬, ৮৪০, দারিমী ১৮০৫, ১৮৪০, ১৮৫০, ১৮৯৯, ইরওয়া ১১২০, সহীহ আবু দাউদ ১৬৬৩। তাহকীক আলবানীঃ সহীহ।

৩০৭৬

সুফিয়ান সাওরী (রহঃ) থেকে বর্নিতঃ

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনবার হজ্জ করেছেনঃ হিজরতের পূর্বে দু’বার এবং হিজরতের পর মদীনা থেকে একবার (যা বিদায় হজ্জ নামে প্রসিদ্ধ)। শেষোক্তটি তিনি কিরান হজ্জ করেছেন অর্থাৎ একত্রে হজ্জ ও উমরার ইহরাম বাঁধেন। এ হজ্জে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যতোটি কোরবানীর পশু এনেছিলেন এবং আলী (রাঃ) যতোটি পশু এনেছিলেন তার মোট সংখ্যা ছিল একশত। এর মধ্যে একটি উট ছিল আবূ জাহলের, যার নাসারন্ধ্রে রূপার লাগাম আঁটা ছিল। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বহস্তে ৬৩টি এবং ‘আলী (রাঃ) অবশিষ্টগুলি কোরবানী করেন। সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসা করা হলো, এ হাদীস কে তার নিকট বর্ণনা করেছেন? তিনি বলেন, জাফর সাদিক, তিনি তার পিতার সূত্রে, তিনি জাবির (রাঃ) -র সূত্রে। অন্যদিকে বিন আবূ লাইলা, তিনি আল-হাকামের সূত্রে, তিনি মিকসামের সূত্রে, তিনি বিন আব্বাস (রাঃ) এর সূত্রে। তাহকীক আলবানীঃ সহীহ।

[৩০৭৬] বুখারী ১৫৫৭, ১৫৬৮, ১৫৭০, ১৬৫১, ১৭৮৫, ২৫০৬, ৪৩৫২, ৭২৩০, ৭৩৬৭, মুসলীম ১২১৩, ১২১৫, ১২১৬/১-৫, ১২১৮/১-৩, ১২৬৩/১-২, ১২৭৩, ১২৭৯, ১২৯৯, তিরমিযি ৮১৭, ৮৫৬-৫৭, ৮৬২, ৮৬৯, ৮৮৬, ৮৯৭, ৯৪৭, ২৯৬৭, ৩৭৮৬, নাসাঈ ২১৪, ২৯১, ৩৯২, ৪২৯, ৬০৪, ২৭১২, ২৭৪০, ২৭৪৩-৪৪, ২৭৫৬, ২৭৬১-৬৩, ২৭৯৮, ২৮০৫, ২৮৭২, ২৯৩৯, ২৯৪৪, ২৯৬১, ২৯৬২-৬৩, ২৯৬৯-৭৫, ২৯৮১-৮৫, ২৯৯৪, ৩০২১-২২, ৩০৫৩-৫৪, ৩০৭৪-৭৬, ৪১১৯, আবু দাউদ ১৭৮৫, ১৭৮৭-৮৯, ১৮১২, ১৮৮০, ১৮৯৫, ১৯০৫-৭, ১৯৪৪, ৩৯৬৯, আহমাদ ১৩৭০২, ১৩৮০১, ১৩৮২৬, ১৩৮৬৭, ১৪০০৯, ১৪০৩১, ১৪১৬১, ১৪২৫০, ১৪৪৮৪, ১৪৫২৫, ১৪৫৮৯, ১৪৬২১, ১৪৬৬৭, ১৪৭৩৫, ১৪৮২১, ১৪৮৫১, মুয়াত্তা মালিক ৮১৬, ৮৩৫-৩৬, ৮৪০, দারিমী ১৮০৫, ১৮৪০, ১৮৫০, ১৮৯৯, হুজ্জাতুন নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ৬৭-৮৩। তাহকীক আলবানীঃ সহীহ।

৩০৭৫

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্নিতঃ

আমরা রাসূলু্ল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর সাথে তিন পর্যায়ে বিভক্ত হয়ে হজ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আমাদের কতক একসাথে হজ্জ ও উমরার ইহরাম বাঁধে কতক শুধু বেঁধেছিল তাদের জন্য হজ্জের অনুষ্ঠানাদি শেষ না করা পর্যন্ত (ইহরামের ফলে) কোন (সাময়িক) নিষিদ্ধ জিনিস হালাল হয়নি। অনুরূপ যারা শুধুমাত্র হজ্জের ইহরাম বেঁধেছিল তাদের জন্যও হজ্জের অনুষ্ঠানাদি শেষ না করা পর্যন্ত (ইহরামের ফলে) কোন (সাময়িক) নিষিদ্ধ জিনিস হালাল হয়নি। আর যারা শুধু উমরার ইহরাম বেঁধেছিল, তাদের জন্য বাইতুল্লাহ তাওয়াফ ও সাফা-মারওয়ার মাঝখানে সাঈ করার পর (ইহরামের কারণে) যা কিছু হারাম ছিল তা হালাল হয়ে গেল, হাজের ইহরাম বাঁধার পূর্ব পর্যন্ত [৩০৭৫] তাহকীক আলবানীঃ সানাদটি হাসান।

[৩০৭৫] সহীহুল বুখারী ২৯৪, ৩০৫, ৩১৬, ৩১৭, ৩১৯, ১৫১৮, ১৫৫৬, ১৫৬০, ১৫৬১, ১৫৬২, ১৬৩৮, ১৬৪৩, ১৬৫০, ১৭০৯, ১৭২০, ১৭৬২, ১৭৮৩, ১৭৮৬, ১৭৮৭, ১৭৮৮, ২৩১৭, ২৯৫২, ২৯৮৪, ৪৩৯৫, ৪৪০৮, ৫৫৪৮, ৫৫৫৯, ৭২২৯, ১২১১, ১২১২, ১২২৮, ১২৭৭, তিরমিযী ৯৩৪, ৯৪৫, ২৯৬৫, নাসায়ী ২৪২, ২৯০, ২৪৮, ২৬৫০, ২৭১৭, ২৭১৮, ২৭৪১, ২৭৬৩, ২৭৬৪, ২৮০৩, ২৮০৪, ২৯৯০, ২৯৯১, আবূ দাউদ ৭৫০, ১৭৭৮, ১৭৭৯, ১৭৮১, ১৭৮২, আহমাদ ২৩৫৫৬, ২৩৫৭৩, ২৩৫৮৯, ২৪০৪৪, ২৪৩৫৫, ২৪৩৮৫, ২৪৭৭৯, ২৪৭৮৮, ২৪৯১৩, ২৫০৫০, ২৫৩১০, ২৫৫৩৪, ২৫৫৫৪, ২৭৬৫৪, ২৫৮১২, মুয়াত্তা মালেক ৭৪৬, ৮৯৬, ৯৪০, ৯৪১, দারেমী ১৪৬, ১৯০৪। তাহকীক আলবানীঃ হাসান। উক্ত হাদিসের রাবী আবু আমর বিন মুহাম্মাদ বিন আমর বিন হুরায়স সম্পর্কে ইবনু হিব্বান বলেন, তিনি সিকাহ তবে ইমাম যাহাবী বলেন, তার পরিচয় সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। আবু হাতিম বিন হিব্বান বলেন, তিনি হাদিস বর্ণনায় ভুল করেন। ইবরাহীম বিন ইয়াকুব আল-জাওযুজানী বলেন, তিনি হাদিসের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য নয়। ইবনু হাজার আল-আসকালানী বলেন, তিনি সত্যবাদী তবে হাদিস বর্ণনায় সন্দেহ করেন। ইমাম দারাকুতনী তাকে দুর্বল বলেছেন। (তাহযীবুল কামালঃ রাবী নং ৫৫১৩, ২৬/২১২ নং পৃষ্ঠা)

লিঙ্ক শেয়ার করুন
close

লিঙ্ক কপি করুন