📄 তৃতীয় মূলনীতি: আল্লাহ তা'আলার নামসমূহ যদি এমন গুণের নির্দেশকারী হয় যা মাখলুককেও স্পর্শকারী, তবে তিনটি বিষয়কে শামিল করবে
তৃতীয় মূলনীতি: আল্লাহ তা'আলার নামসমূহ যদি এমন গুণের নির্দেশকারী হয় যা মাখলুককেও স্পর্শকারী, তবে তিনটি বিষয়কে শামিল করবে:
প্রথমত: ওই নামটি আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত হওয়া।
দ্বিতীয়ত: নামটি যে গুণকে শামিল করে আছে তা আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত হওয়া।
তৃতীয়ত: উক্ত গুণের যে হুকুম ও দাবি রয়েছে তা প্রমাণিত হওয়া।
এ কারনেই ডাকাতরা যদি তাওবা করে তবে তাদের বেলায় শরীয়তের বিধিবদ্ধ শাস্তি 'হদ' মওকুফ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মুজতাহিদ আলিমগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন এবং দলিল হিসেবে তারা নিম্নোক্ত আয়াতটি পেশ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে:
﴿إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِن قَبْلِ أَن تَقْدِرُوا عَلَيْهِمْ فَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ ﴾ [المائدة: ٣٤]
কিন্তু হ্যাঁ তোমরা তাদেরকে গ্রেফতার করার পূর্বে যারা তাওবা করে নেয়, তবে জেনে রাখো যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। (আল মায়েদা: ৫: ৩৪)
কেননা এ দুটি নাম (ক্ষমাশীল ও অতি দয়ালু) এর দাবি হলো, আল্লাহ তা'আলা নিশ্চয় তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং হদ রহিত করে তাদের প্রতি করুণ করেছেন।
এর উদাহরণ: السميع 'সর্বশ্রোতা' এটি একদিকে 'আস-সামী'উ' নামটি আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করছে। অন্যটি তা السمع 'শ্রবণশক্তি' কে আল্লাহর গুণ হিসেবে সাব্যস্ত করছে। এবং শ্রবণের যে হুকুম ও দাবি তা আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করছে। যেমন আল্লাহ তা'আলা গোপন কথা ও নিভৃতে পরিচালিত কথাও শোনেন। ইরশাদ হয়েছে:
﴿وَاللَّهُ يَسْمَعُ تَحَاوُرَكُمَا إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ ﴾ [المجادلة: ١]
আল্লাহ তোমাদের কথোপকথন শোনেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (আল মুজাদালা: ১)
আর যদি আল্লাহর নাম এমন গুণকে নির্দেশকারী হয় যা আল্লাহ তা'আলার সত্তায় সীমিত থাকে, তবে তা দুটি বিষয়কে শামিল করে:
প্রথমত: ওই নামটি আল্লাহর জন্য প্রমাণিত হওয়া।
দ্বিতীয়ত: ওই নামটি যে গুণকে ধারণ করে আছে তা আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত হওয়া।
এর উদাহরণ: الحي 'চিরঞ্জীব' এটি একদিকে 'আল হাইউ' শব্দটিকে আল্লাহর নাম হিসেবে সাব্যস্ত করছে। অন্যদিকে 'আল হায়াত' তথা 'জীবন'- কে আল্লাহ তা'আলার একটি গুণ হিসেবে সাব্যস্ত করছে।
📄 চতুর্থ মূলনীতি: আল্লাহ তা'আলার নামসমূহ তাঁর নাম ও গুণাবলিকে সরাসরি বুঝায়, অন্তর্ভুক্তি হিসেবে বুঝায় এবং দাবি হিসেবেও বুঝায়
চতুর্থ মূলনীতি: আল্লাহ তা'আলার নামসমূহ তাঁর সত্তা ও গুণাবলির উপর (তিনভাবে প্রমাণবহ) সর্বদিক থেকে প্রমাণ করে, অন্তর্ভুক্তি হিসেবে প্রমাণ করে এবং দাবি হিসেবেও প্রমাণ করে:
এর উদাহরণ: الخالق 'স্রষ্টা' নামটি আল্লাহ তা'আলার সত্তা এবং সৃষ্টি করার গুণকে সরাসরি বুঝাচ্ছে। আর শুধু আল্লাহর সত্তা এবং শুধু সৃষ্টি করার গুণ (এ দুয়ের যে কোনো একটি) কে অন্তর্ভুক্তি হিসেবে বুঝায়। অর্থাৎ খালিক শব্দটি দুটি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে আছে। একটি আল্লাহর নাম, অপরটি আল্লাহর গুণ। অতএব যেকোনো একটিকে অন্তর্ভুক্তি হিসেবে বুঝায়। এর পাশাপাশি খালিক শব্দটি দাবি হিসেবে 'ইলম' ও 'কুদরত' এ দুটি গুণকে সাব্যস্ত করছে।
এ কারনেই আল্লাহ তা'আলা যখন আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টির কথা উল্লেখ করেছেন, তিনি বলেছেন:
﴿لِتَعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ وَأَنَّ اللَّهَ قَدْ أَحَاطَ بِكُلِّ شَيْءٍ عِلْمًا ﴾ [الطلاق: ١٢]
যেন তোমরা জানতে পার যে, আল্লাহ সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান এবং আল্লাহর জ্ঞানতো সব কিছুকে বেষ্টন করে আছে। (সূরা আত-তালাক:১২)
শব্দের দাবিগত অর্থ উদ্ধারের প্রক্রিয়া শরীয়তের জ্ঞান অন্বেষণকারীদের জন্য খুবই উপকারী। তারা যদি শব্দের অর্থ উদ্ধারে মনোনিবেশ করে এবং দাবিগত অর্থ কিভাবে উদ্ধার করতে হয় তা বুঝার জন্য আল্লাহ তা'আলা তাওফীক দান করেন তবে একটি মাত্র দলিল থেকে বহু মাসআলা বের করতে তারা সক্ষম হবে।
জেনে রাখা ভালো যে, আল্লাহ তা'আলার কথা এবং আল্লাহর রাসূলের কথার দাবিগত অর্থ, যদি তা শুদ্ধ দাবিগত অর্থ হয়, তবে তা হক ও সত্য। কেননা আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসূলের কথা হক, অতএব যা হকের দাবি তাও হক। উপরন্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথার যে দাবিগত অর্থ হতে পারে সে ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলা সুপরিজ্ঞাত। অতএব তা উদ্দিষ্ট।
আর আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের কথা ব্যতীত অন্য কারো কথার দাবিগত অর্থের অবস্থা তিনটি:
প্রথমত: বক্তাকে বলা হবে যে আপনার কথার দাবিগত অর্থ হলো এই এবং বক্তাও তা মেনে নেবে। উদাহরণত যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার কর্মগত গুণসমূহ অস্বীকার করে সে যদি এ প্রকৃতির গুণ আল্লাহর জন্য সাব্যস্তকারীকে উদ্দেশ্য করে বলে: আপনি যে আল্লাহ তা'আলার কর্মগত গুণ সাব্যস্ত করছেন এর দাবি হলো যে আল্লাহ তা'আলার কিছু কর্ম অনাদি নয় বরং তা নতুন। এর উত্তরে কর্মগত গুণ সাব্যস্তকারী বলবে: হ্যাঁ, আমি এ বিষয়টি স্বীকার করি; কারণ আল্লাহ তা'আলা যা ইচ্ছা তাই করেন। তাঁর কথা ও কর্ম শেষ হয়ে যাওয়ার মতো কোনো বিষয় নয়। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেছেন:
﴿قُل لَّوْ كَانَ الْبَحْرُ مِدَادًا لِكَلِمَاتِ رَبِّي لَنَفِدَ الْبَحْرُ قَبْلَ أَن تنفَدَ كَلِمَتُ رَبِّي وَلَوْ جِئْنَا بِمِثْلِهِ، مَدَدًا ﴾ [الكهف: ١٠٩]
বল, 'আমার রবের কথা লেখার জন্য সমুদ্র যদি কালি হয়ে যায় তবে সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যাবে আমার রবের কথা শেষ হওয়ার আগেই। যদিও এর সাহায্যার্থে অনুরূপ আরো সমুদ্র নিয়ে আসি'। (সূরা আল কাহাফ: ১৮: ১০৯)
অন্যত্র তিনি বলেছেন: وَلَوْ أَنَّمَا فِي الْأَرْضِ مِن شَجَرَةٍ أَقْلَامُ وَالْبَحْرُ يَمُدُّهُ مِنْ بَعْدِهِ سَبْعَةُ أَبْحُرٍ مَّا نَفِدَتْ كَلِمَاتُ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ )) [لقمان: ٢٧]
আর জমিনে যত গাছ আছে তা যদি কলম হয়, আর সমুদ্র (হয় কালি), তার সাথে কালিতে পরিণত হয় আরো সাত সমুদ্র, তবুও আল্লাহর বাণীসমূহ শেষ হবে না। নিশ্চয় আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (সূরা লুকমান: ৩১: ২৭)
অতএব বিশেষ বিশেষ নব কর্ম যদি আল্লাহ তা'আলা সম্পাদনা করেন তবে এর দ্বারা তাঁর কোনো ত্রুটি প্রমাণিত হয় না।
দ্বিতীয় অবস্থা: বক্তাকে তার কথার দাবিগত অর্থের কথা বলা হবে, কিন্তু সে এ দাবিগত অর্থ অস্বীকার করবে। যেমন আল্লাহর গুণসমূহ অস্বীকারকারী গুণসমূহ সাব্যস্তকারীকে লক্ষ্য করে বলবে: আপনি যে আল্লাহর গুণসমূহ সাব্যস্ত করছেন এর দাবি হলো- আল্লাহ তা'আলা তার গুণসমূহের ক্ষেত্রে মাখলুক সদৃশ। এর উত্তরে গুণসমূহ সাব্যস্তকারী বলবে: না, দাবিগতভাবে তা প্রমাণিত হয় না। কেননা সৃষ্টিকর্তার গুণসমূহ সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে উল্লিখিত। সম্পৃক্তি ছাড়া সাধারণভাবে তা উল্লেখ করা হয়নি। সাধারণভাবে উল্লেখ করলে আপনার কথা মেনে নিতাম। অতএব আল্লাহর গুণসমূহ কেবল আল্লাহর জন্যই তাঁর শান অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট। উপরন্তু আমি আপনাকে বলব যে আপনি আল্লাহর গুণসমূহ অস্বীকার করা সত্ত্বেও তিনি যে একজন 'সত্তা' তা মেনে নেন, অর্থাৎ তাঁর জন্য যাত তথা সত্তা হওয়াকে সাব্যস্ত করেন এবং বলেন যে আল্লাহর সত্তা কোনো মাখলুকের সত্তা সদৃশ নয়। তাহলে যাত ও সিফাত তথা সত্তা ও গুণের মধ্যে পার্থক্য করার কারণ কি?
উল্লিখিত দুই অবস্থায় দাবিগত অর্থের বিষয়টি পরিষ্কার।
তৃতীয় অবস্থা: দাবিগত অর্থের ব্যাপারটি অব্যক্তভাবে আছে। কথাতে সেটার স্বীকারও নেই, আবার অস্বীকারও নেই। এ অবস্থার হুকুম হলো- দাবিগত অর্থটি বক্তার কথার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হবে না; কেননা এ ক্ষেত্রে এ সম্ভাবনা রয়েছে যে, যদি বক্তার সম্মুখে তা উল্লেখ করা হয়, তবে সে তা মেনে নেবে অথবা দাবীগত অর্থটি অস্বীকার করবে। এক্ষেত্রে এটারও সম্ভাবনা রয়েছে যে যদি তার সম্মুখে দাবিগত অর্থের কথা উল্লেখ করা হয়, তখন সে দাবীগত অর্থটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে এবং সেটার অসারতা বুঝতে পেরে তার কথা থেকে ফিরে আসবে। কারণ, যে অর্থ দাঁড়ালে সমস্যা অবধারিত হয় সে অর্থটি অগ্রহণযোগ্য হওয়াটি অবধারিত।
এ দুটি সম্ভাবনা থাকার কারণে বলা যাবে না যে, কোনো কথার দাবিগত ভাবও কথা হিসেবে ধর্তব্য।
যদি প্রশ্ন করে বলা হয় যে, যদি বক্তার কথার দাবি থেকে বিষয়টি ওঠে আসে, তবে এটিও বক্তার কথা হিসেবে ধরে নেওয়া হবে। কারণ এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক; বিশেষ করে কথা ও তার দাবির মধ্যে যদি কাছাকাছি সম্পর্ক থাকে।
উত্তরে বলব: এ প্রশ্নটি এ হিসেবে অবান্তর যে, মানুষ তো মানুষই। মানুষের অন্তর্গত ও বহির্গত নানা অবস্থা রয়েছে, যার কারণে তার কথার দাবিগত অর্থ কি দাঁড়াচ্ছে তা হয়ত তার অন্তর থেকে হারিয়ে যায়, সে হয়ত উদাসীন হয়ে পড়ে, অথবা ভুল করে, অথবা সে দিশেহারা হয়ে পড়ে, অথবা সে তর্কের চাপে দাবিগত অর্থে চিন্তা করা ব্যতীতই কোনো কথা বলে ফেলে ইত্যাদি।
📄 পঞ্চম মূলনীতি: আল্লাহর নামসমূহ কুরআন-সুন্নাহ নির্ভর, এ ক্ষেত্রে মানুষের বুদ্ধিবিবেচনার কোনো দখল নেই
পঞ্চম নীতিমালা: আল্লাহর নামসমূহ কুরআন-সুন্নাহ নির্ভর, এ ক্ষেত্রে মানুষের বুদ্ধিবিবেচনার কোনো দখল নেই।
অতএব কুরআন ও সুন্নায় আল্লাহর নামসমূহের ব্যাপারে যতটুকু পাওয়া যায় ততটুকুই আমাদের গ্রহণ করতে হবে, এর ওপর কোনো কিছু বাড়ানোও যাবে না, কমানও যাবে না; কেননা আল্লাহ তা'আলা যা কিছুর উপযোগী মানুষের আকল-বুদ্ধি দ্বারা তা আয়ত্ব করা সম্ভব নয়। অতএব কুরআন-সুন্নাহর টেক্সট তথা ভাষ্যের সীমানায় আমাদের সীমিত হয়ে যেতে হবে। কারণ আল্লাহ তা'আলা বলেছেন:
﴿ وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُوْلَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا ﴾ [الاسراء: ٣٦]
যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই সেই বিষয়ে অনুমান দ্বারা পরিচালিত হয়ো না; নিশ্চিত কর্ন, চক্ষু, হৃদয় ওদের প্রত্যেকের নিকট কৈফিয়ত তলব করা হবে। [আল ইসরা: ১৭: ৩৬]
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে:
﴿ قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا bṭَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَن تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَن تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ ﴾ [الاعراف: ۳۳]
বল, 'আমার রব তো হারাম করেছেন অশ্লীল কাজ- যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে, আর পাপ ও অন্যায়ভাবে সীমালঙ্ঘন এবং আল্লাহর সাথে তোমাদের শরীক করা, যে ব্যাপারে আল্লাহ কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর উপরে এমন কিছু বলা যা তোমরা জান না'। (আল আরাফ: ৭: ৩৩)
উপরন্তু আল্লাহ তা'আলার ওপর এমন নাম আরোপ করা যা তিনি নিজেকে দেননি, অথবা তিনি নিজেকে যে নাম দিয়েছেন তা অস্বীকার করা আল্লাহর বিরুদ্ধে স্পর্ধা প্রদর্শন বই অন্যকিছু নয়। অতএব এ ব্যাপারে আদব রক্ষা করতে হবে এবং কুরআন-সুন্নাহর পাঠে যা কিছু আছে সেখানেই সীমিত হয়ে যেতে হবে।
📄 ষষ্ঠ মূলনীতি: আল্লাহর নামসমূহ সুনির্দিষ্ট সংখ্যায় সীমিত নয়
ষষ্ঠ নীতিমালা: আল্লাহর নামসমূহ সুনির্দিষ্ট সংখ্যায় সীমিত নয়
কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রসিদ্ধ একটি হাদীসে বলেছেন:
«أسألك بكل اسم هو لك سميت به نفسك، أو أنزلته في كتابك، أو علمته أحداً من خلقك، أو استأثرت به في علم الغيب عندك»
‘হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে প্রত্যেক ওই নাম দ্বারা প্রার্থনা করছি যা আপনার, যে নাম আপনি নিজেকে দিয়েছেন, অথবা আপনি আপনার কিতাবে নাযিল করেছেন, অথবা আপনি আপনার সৃষ্টিজীবের কাউকে শিখিয়েছেন, অথবা যে নাম আপনি আপনার কাছে, আপনার গায়েবী ইলমে একান্তভাবে রেখে দিয়েছেন।’ হাদীসটি ইমাম আহমদ, ইবনে হিববান এবং ইমাম হাকেম বর্ণনা করেছেন আর হাদীসটি সহীহ।’
বলার অপেক্ষা রাখে না যে আল্লাহ তা'আলা তার গায়েবী ইলমে যা একান্তভাবে রেখে দিয়েছেন তা কারও পক্ষেই হিসেব করে দেখা অথবা তা আয়ত্বে আনা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়।
আর যে হাদীসটিতে আল্লাহ তা'আলার নিরানব্বই নামের কথা এসেছে অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী:
«إن الله تسعة وتسعين اسماً، مائة إلا واحداً، من أحصاها دخل الجنة»
'নিশ্চয় আল্লাহ তা'আলার নিরানব্বইটি, একটি বাদে একশটি, এমন নাম রয়েছে, যে ব্যক্তি তা ইহসা' (তথা যথাযথভাবে কার্যে পরিণত) করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।" এ হাদীসটি নিরানব্বই সংখ্যায় আল্লাহর নাম সীমিত হওয়াকে বুঝাচ্ছে না। যদি সীমিত হওয়া বুঝাত তবে হাদীসের ভাষ্য এমন হত: 'নিশ্চয় আল্লাহর নাম নিরানব্বইটি, যে তা ইহসা করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে' অথবা এ জাতীয় কোনো ভাষ্য।
তাহলে হাদীসের অর্থ হলো: এ সংখ্যার বাস্তবতা, যে ব্যক্তি এই সংখ্যায় আল্লাহর নামগুলোর বাস্তব অর্থ কাজে লাগাবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। অতএব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা 'যে ব্যক্তি তা ইহসা (যথার্থভাবে কার্যে পরিণত) করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে' এর পূর্ববর্তী বাক্যের পরিপূরক বাক্য। এটি কোনো স্বনির্ভর আলাদা বাক্য নয়।
এর উদাহরণ হলো আপনি যদি বলেন: আমার কাছে একশ' টাকা আছে যা আমি দান করার জন্য গণনা করে রেখেছি, তাহলে এ কথার অর্থ এটা নয় যে আপনার কাছে এ ছাড়া অন্য কোনো টাকা নেই। বরং এর অর্থ হলো আপনার কাছে আরো টাকা আছে, তবে দান করার জন্য একশ' টাকা গণনা করে রেখেছেন।
এ নামগুলো কোন্ কোন্ নাম তা নির্ণয় করে সহীহ কোনো হাদীস বর্ণিত হয়নি। এ ক্ষেত্রে নাম নির্দিষ্ট করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যে হাদীসটি এসেছে তা দুর্বল।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া র. 'আল ফাতাওয়া' গ্রন্থে বলেন, 'এই নামগুলো সুনির্দিষ্ট করণের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে কোনো বাণী উল্লিখিত হয়নি। এ ব্যাপারে হাদীস বিশেষজ্ঞদের ঐক্যমত্য রয়েছে।' ইমাম ইবনে তাইমিয়া এর পূর্বে বলেছেন, (নিরানব্বইটি নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে যে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে) তা আল ওয়ালীদ নামক এক বর্ণনাকারী তার শামদেশীয় একজন শাইখের বরাত দিয়ে উল্লেখ করেছেন। ইমাম ইবনে হাজার তার গ্রন্থ 'ফাতহুল বারী'- তে ব্যাখ্যা করে বলেন যে, ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম ওয়ালীদ কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটিকে পরিত্যাগ করেছেন। এ পরিত্যাগ করার কারণ শুধু এটা নয় যে, এ হাদীসটি ওয়ালীদ এককভাবে বর্ণনা করেছেন, বরং হাদীসটিতে মতদ্বৈততা ও অসঙ্গতি রয়েছে, হাদীসটিতে তাদলীস ও অন্য কারও বক্তব্য তাতে অনুপ্রবিষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।'১০
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুনির্দিষ্ট কোনো হাদীসে যেহেতু এ নিরানব্বইটি নাম উল্লেখ করেননি, তাই সালাফদের মধ্যে এ নামগুলো সুনির্দিষ্ট করার ক্ষেত্রে মতানৈক্য হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের থেকে নানামুখী বর্ণনা উল্লিখিত হয়েছে। যাই হোক, আমি কুরআন হাদীস ঘেঁটে আল্লাহ তা'আলার নিরানব্বইটি নাম এখানে একত্র করেছি। নামগুলো আমি দু'ভাগে ভাগ করেছি। প্রথম ভাগ হলো কুরআন থেকে এবং দ্বিতীয় ভাগ হলো সুন্নাহ থেকে।
প্রথমত: কুরআন থেকে:
| الإله | الأكرم | الأعلى | الأحد |
|---|---|---|---|
| উপাস্য | অনেক সম্মানিত | অনেক উপরে | একক |
الآخر الظاهر الباطن البارئ
সবার উপরে, সর্বশেষ সঠিকভাবে সর্বনিকটে সৃষ্টিকারী প্রকাশিত অপ্রকাশিত
البصير التواب الجبار الحافظ
সর্ববিষয় দর্শনকারী তাওবা কবুলকারী দুর্নিবার রক্ষাকারী
الحفيظ الحفي الحق المبين
সংরক্ষণকারী পুরোপরি অবহিত পরম সত্য সুস্পষ্ট
الحليم الحميد الحي القيوم
অত্যন্ত ধৈর্যলীল সকল প্রশংসার চিরঞ্জীব সবকিছুর ধারক ও সংরক্ষণকারী অধিকারী
الخالق
সৃষ্টিকর্তা
الخلاق
সর্বস্রষ্টা
الرءوف
পরম স্নেহশীল
الرحمن
পরম দয়ালু
الرزاق
রিযকদাতা
الرقيب
তত্বাবধায়ক
السلام
শান্তি দানকারী
السميع
সর্বশ্রোতা
الشكور
গুণগ্রাহী
الشهيد
সর্বজ্ঞ সাক্ষী
الصمد
সর্ববিষয়ে পূর্ণতাপ্রাপ্ত
العالم
জ্ঞানী
العظيم
সর্বোচ্চ- মর্যাদাশীল
العليم
সর্বজ্ঞ
العلي
উচ্চ মর্যাদাশীল
الغفار
পরম ক্ষমাশীল
الغني
الفتاح
القادر
القاهر
পরাক্রমশালী মহা ক্ষমতাবান বিজয় দানকারী অমুখাপেক্ষী
القهار القوى القريب القدير
কঠোর পরম শক্তির অধিকারী অতি নিকটবর্তী প্রবল ক্ষমতাধর
المتعالي المؤمن اللطيف الكريم
সৃষ্টির গুনাবলীর উর্দ্ধে নিরাপত্তা ও ঈমান দানকারী সুক্ষ্মদর্শী, কৌশলী সুমহান দাতা
المحي المجيد المجيب المتين
জীবন দানকারী মর্যাদার অধিকার জবাব দানকারী সুদৃঢ়
المليك সর্বকর্তৃত্বময় ।।। المقتدر
মালিক জীবনোপকরণ নিরঙ্কুশ সিদ্বান্তের দানকারী অধিকারী
الوارث উত্তরাধিকারী
الواحد এক ও অদ্বিতীয়
সাহায্যকারী النصير
المهيمن রক্ষণাবেক্ষণকারী
মহাদাতা الوهاب
الولي অবিভাবক
الوكيل কর্ম সম্পাদনকারী
الودود সদয়
দ্বিতীয়ত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ থেকে:
الرفيق দয়াবান
الرب প্রভু
الحي চিরঞ্জীব
الحكم মহাবিচারক
الباسط প্রশস্তকারী
القابض সংকীর্ণকারী
الطيب উত্তম, পবিত্র
الشافي আরোগ্যদান কারী
المحسن
المعطي
المنان
الوتر, বেজোড় একক
মহাদাতা
অনুগ্রহকারী
দানশীল
এ নামগুলো যথার্থভাবে ঘেঁটে নির্বাচন করেছি। কুরআনে কারীম থেকে ৮১টি আর সুন্নাতে রাসূল থেকে বাকী ১৮টি গ্রহণ করেছি। যদিও আমি ‘আল-হাফীয়্য’ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে দ্বিধান্বিত। কারণ এ নামটি এককভাবে আসেনি, বরং ইবরাহীম আলাইহিস সালাম থেকে শর্তযুক্ত ভাবে এসেছে। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহ সম্পর্কে বলেছেন,
إِنَّهُ كَانَ بِي حَفِيًّا ﴾ [مريم: ٤٧]
“নিশ্চয় তিনি আমার প্রতি খুবই অনুগ্রহশীল”। [সূরা মারইয়াম: ৪৭] অনুরূপভাবে 'আল-মুহসিন' নামটিও। কারণ তাবারানীতে বর্ণিত এ নামটির বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে আমি অবগত হতে পারি নি। তবে শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ এটিকে আল্লাহর নাম হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
তাছাড়া আল্লাহর নামসমূহের কিছু রয়েছে অন্য শব্দের সাথে সন্ধন্ধযুক্ত হয়ে। যেমন, 'মালিকাল মুলকি' 'যিল-জালালি ওয়াল ইকরামি'।
টিকাঃ
* - বর্ণনায় আহমদ (১/৩৯১, ৪৫২); ইবনে হিববান হাদীস নং (২৩৭২); হাকেম (১/৫০৯), আলবানী এটিকে 'আল আহাদীসুস্সাহীহা'- তে উল্লেখ করেছেন।
* - নামগুলোকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর অর্থ এ নামগুলোর শব্দমালা মুখস্ত করা, তার অর্থ বোঝা এবং তার দাবি অনুযায়ী আমল করা (লেখক)
৮ - বর্ণনায় বুখারী, তাওহীদী অধ্যায়, অনুচ্ছেদ: নিশ্চয় আল্লাহ তাআলার একটি কম একশটি নাম রয়েছে, হাদীস নং (৭৩৯২); মুসলিম, যিকির অধ্যায়, অনুচ্ছেদ: আল্লাহর নাম এবং যে তা গুণবে তার মর্যাদা, (২৬৭৭)।
* - মাজমুউল ফাতাওয়া, খন্ড ৬, পৃষ্ঠা ৩৮৩
১০ - ইবনে হাজার আল আসকালানী, ফাতহুল বারী, খন্ড১১, পৃ. ২১৫