📄 সফরের প্রবল আগ্রহ অসম্ভবকে সম্ভব করেছে
মুহাম্মদ ইবনে কাসিম১০ সতেরো বছরের যুবক। এখনকার সময়ের সতেরো বছরের কোনো যুবককে যদি ঘরের দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়, তাহলে সে হয়তো তা ঠিকমতো পালন করতে পারবে না, অথচ সতেরো বছরের যুবক মুহাম্মদ ইবনে কাসিম ছিলেন প্রধান সেনাপতি।
আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, রাজা দাহিরের মতো প্রতাপশালী শাসকের বিরুদ্ধে তিনি সৈন্যসামন্ত নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। আমি সিন্ধু এলাকায় সেই স্থান দেখেছি যেখানে মুহাম্মদ ইবনে কাসিম ও রাজা দাহির যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। যুদ্ধের ময়দান এতটাই বিস্তৃত যে, ময়দান দেখে আমি বিস্মিত হই। আমি চিন্তা করলাম, এ নওজোয়ান কীভাবে এখানে এসেছিলেন? তার সাথে তো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তেমন কোনো সৈন্যদলও ছিল না।
যখন হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ বললেন, এখন আমাদের সকল সৈন্যরা বিভিন্ন অভিযানে ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ আমার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে যে, আমাদের কিছুসংখ্যক মহিলা সমুদ্রপথে আসছিল। পথিমধ্যে রাজা দাহিরের জলদস্যুবাহিনী তাদের সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছে। তারা চিৎকার করে বলছিল, মুহাম্মদ ইবনে কাসিম 'আমাদের বাচাঁও', 'আমাদের বাচাঁও'-এ বাক্যগুলো শুনে "Cornernee lings"-এর নওজোয়ানদের একত্র করলেন। তারা যদিও যুদ্ধে পরিপক্ব ছিলেন না, কিন্তু ইমানি বলে বলীয়ান ছিলেন। তাই তারা ইমানের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বললেন, হে মুহাম্মদ ইবনে কাসিম! আমরা আপনার সঙ্গে আছি। আমরা যাব। ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে যে, মুসলিম বোনদের আকুতির এ বাক্যগুলো মুহাম্মদ ইবনে কাসিমের মাথায় এমনভাবে বিদ্ধ ছিল যে, তিনি হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার করে বলতেন—
لبيك يا اختى لبيك يا اختى
'আমার বোন! আমি উপস্থিত। আমার বোন! আমি উপস্থিত।'
একপর্যায়ে তিনি মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়ে রাজা দাহিরের এলাকায় পৌঁছেন এবং রাজা দাহিরের সুসজ্জিত সৈন্যদের ছিন্নভিন্ন করে দেন। তিনি রাজা দাহিরকে পরাস্ত করেই ক্ষান্ত হননি; বরং নিজের আস্থাভাজনকে সেখানকার স্থলাভিষিক্ত করে সামনে অগ্রসর হতে থাকেন। এমনকি তিনি সিন্ধু থেকে মুলতান পর্যন্ত ইসলামের বিজয়কেতন উড্ডীন করেন।
আজ আমাদের যুবকদের মধ্যে যদি এমন চেতনা বিরাজ করত, তাহলে পৃথিবীর কোনো অপশক্তিই আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস পেত না। সুতরাং আমাদের শ্রম ও মেহনতকে কাজে লাগাতে হবে। আরাম-আয়েশের জীবন মূলত সফলতার জীবন নয়; বরং সফল জীবন তো হলো চেষ্টা-মুজাহাদা ও কর্মময় জীবন।
টিকাঃ
১০. মুহাম্মদ ইবনে কাসিম ছিলেন সিন্ধু-বিজেতা। ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিকের ইন্তেকালের পর তিনি জুলুমের শিকার হন। এবং সুলাইমান ইবনে আবদুল মালিকের জমানায় তাঁকে শহিদ করে দেওয়া হয়। -তারিখে মিল্লাত: ১/৬৩৮।
📄 দরসের প্রতি আগ্রহের অনন্য দৃষ্টান্ত
হজরত মাওলানা খায়ের মুহাম্মদ জলন্ধরি রহ.১১ একবার হাদিসের দরসদানকালে এক ছাত্র প্রশ্ন করল। যে প্রশ্নের উত্তর তখন তার মাথায় আসছিল না। আমাদের যদি এমন অবস্থা হয়, তাহলে আমরা তো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। এখানে যে আসলেই সূক্ষ্ম কিছু বিষয় আছে তা ছাত্রদের বুঝতেই দিই না। তখন ছাত্ররা আর কী করবে?
কিন্তু তিনি ছিলেন কঠিন আমানতদার। তিনি মনে করতেন যে, ছাত্ররা যদি উস্তাদকে কোনো প্রশ্ন করে, আর সে প্রশ্নের সমাধান উস্তাদের মাথায় তখন না আসার কারণে তিনি যদি তা এড়িয়ে যান, তাহলে এটা খিয়ানতের নামান্তর। তাই তিনি খোলাখুলি বলে দিলেন, এ প্রশ্নের সঠিক সমাধান এখন আমার মাথায় আসছে না। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ছাত্ররা চুপ করে বসে থাকল। আর তিনি বারবার এটা পড়ছিলেন। কখনো পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছেন, কখনো পড়ছেন। কিন্তু সঠিক কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তখন তিনি বললেন, এ প্রশ্নের সমাধান এখন আমি দিতে পারছি না। আমি অমুক আলেমের কাছে গিয়ে এর সঠিক সমাধান জেনে নেবো। যার কথা তিনি তার ছাত্রদের সামনে বললেন, তিনি ছিলেন তারই প্রাক্তন ছাত্র। এ কথা শুনে এক ছাত্র সেই আলেমের কাছে দৌড়ে গিয়ে বলল, হুজুর আপনার কাছে এ ব্যাপারে আসছেন। মাওলানা সাহেব তৎক্ষণাৎ কিতাব বন্ধ করে হজরতের কাছে দৌড়ে গেলেন। বললেন, হজরত! আপনি কি আমায় স্মরণ করেছিলেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ! মাওলানা, এ সবক আমার বুঝে আসছে না। দেখো তো এর সমাধান কী? মাওলানা সাহেব পড়ে বুঝতে পারলেন। কিন্তু তিনি কথা ঘুরিয়ে বললেন, হজরত। আপনি যখন আমাদের পড়িয়েছিলেন তখন এভাবে বলেছিলেন।
দেখুন! তিনি কীভাবে ঘুরিয়ে কথা বললেন। নিজের দিকে নিসবত করে এটা বোঝাননি যে, আমার অনেক ইলম ও জ্ঞান আছে। আপনি আমার উস্তাদ হওয়া সত্ত্বেও আমার কাছে বুঝতে এসেছেন।
তাদের পক্ষে এমন মনোভাব দেখানো ছিল খুবই সহজ। কারণ, তারা ছিলেন সংস্রবপ্রাপ্ত। তরবিয়তপ্রাপ্ত। এটাকেই বলে তাসাউফ। এটাই হলো নিজেকে বিলীন করে দেওয়া।
টিকাঃ
১১. ১৩১২ হিজরি মুতাবিক ১৮৯৫ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৩৯০ হিজরি সনের ২০ শাবান মুতাবিক ১৯৭০ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন।
📄 নেতৃত্বের ভুল জাতির ধ্বংসের কারণ
ওলামায়ে কেরামের জন্য সতর্কতার সাথে জীবন-যাপন করা অপরিহার্য। হজরত হাসান বসরি রহ. বলেন, একবার ছোট্ট একটি মেয়ে আমাকে উপদেশ দিয়েছিল। কেউ বলল, কী সেই উপদেশ? তিনি বললেন, একবার আমি মসজিদে নামাজ পড়তে যাচ্ছিলাম। তখন ছিল বৃষ্টির মৌসুম। সতর্কতার সাথে না হাঁটলে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল। আমার পাশ দিয়ে এক বালিকা যাচ্ছিল। তখন আমি তাকে বললাম, বেটি! সাবধানে যেয়ো, দেখো যেন পা পিছলে না যায়। মেয়েটি বলল, জনাব! আমি তো সতর্কতা অবলম্বন করবই। তবে আপনি আরও বেশি সতর্ক থাকবেন। কেননা, আমি পিছলে পড়ে গেলে শুধু আমিই ক্ষতিগ্রস্ত হব। পক্ষান্তরে আপনি পড়ে গেলে গোটা উম্মত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আমাদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ। আপনারা দৃঢ়তার সাথে শরিয়ত ও সুন্নাতের ওপর আমল করবেন। আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মান দান করবেন।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ.-কে 'কুরআন সৃষ্ট কি না'-এ মাসআলার ক্ষেত্রে এমনভাবে বেত্রাঘাত করা হতো যে, সে বেত্রাঘাত যদি কোনো হাতির গায়ে করা হতো, তাহলে হাতিও লাফিয়ে উঠত। তার শরীরে যে জায়গায় বেত্রাঘাত করা হতো, সে স্থানটুকু অবশ হয়ে যেত। তারপর সে অংশের গোশত কেটে মলম ও পট্টি বেঁধে দেওয়া হতো। দীনের জন্য তিনি কী পরিমাণ দৃঢ়তা অবলম্বন করেছিলেন।
📄 হজরত আবু হুরায়রা রাদি. মুখস্থশক্তি কোথায় পেলেন?
হজরত আবু হুরায়রা রাদি, মুসলমান হওয়ার পর তার বৃদ্ধকাল শুরু হয়েছিল। অধিকাংশ সময় তিনি ভুলে যেতেন। কিছু মনে রাখতে পারতেন না।
একদিন তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হয়ে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার কিছু মনে থাকে না। আমি আপনার বাণী যা শুনি ভুলে যাই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার চাদরখানা মেলে ধরো। তিনি যখন চাদর মেলে ধরলেন, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনভাবে হাতের ইশারা করলেন, যেন তিনি হাত ভরে চাদরে কিছু রাখছেন। এরপর বললেন, আবু হুরায়রা! চাদর বেঁধে নাও। এরপর থেকে আল্লাহ তাআলা তাকে এমন ধী-শক্তিসম্পন্ন করলেন যে, তিনি আর কিছুই ভুলতেন না।
সুবহানাল্লাহ! তিনি ইলম অর্জনের জন্য অগ্রসর হয়েছেন। আর উস্তাদ দোয়া করে দিয়েছেন। অপরদিকে আল্লাহ তাআলা বরকত দান করলেন। ফলে তিনি এমন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন যে, তার ব্যাপারে মুফতি শফি রহ.১২ বলেন যে, আবু হুরায়রা রাদি. 'মৌলবি' ধরনের সাহাবি ছিলেন। কারণ, তিনি অধিকাংশ সময় হাদিস সংকলনের চিন্তায় গভীরভাবে নিমগ্ন থাকতেন। এ জন্যই তিনি সকল সাহাবির চেয়ে অধিক হাদিস বর্ণনা করতে সক্ষম হয়েছেন। সুবহানাল্লাহ!
টিকাঃ
১২. তিনি ১৩১৪ হিজরিতে দেওবন্দে জন্মগ্রহণ করেন। নয় বছর বয়সে পিতার সাথে তিনি হজরত থানবি রহ.-এর খেদমতে হাজির হন। ১৩৪৯ হিজরিতে তিনি খেলাফতপ্রাপ্ত হন। ১৩৯২ হিজরির শাওয়াল মাসে ৮৩ বছর বয়সে করাচিতে ইন্তেকাল করেন।بزم اشرف چراغ