📘 আকাবিরদের জ্ঞান সাধনার গল্প > 📄 সময়ই জীবন এবং সময় স্বর্ণের চেয়েও দামি

📄 সময়ই জীবন এবং সময় স্বর্ণের চেয়েও দামি


বিখ্যাত বিচক্ষণ আদর্শিক নেতা ড. হাসানুল বান্না 'সময়টাই জীবন' শিরোনামের একটি প্রবন্ধে বলেন—

বলা হয় সময়টাই টাকা! বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এটা সঠিক তাদের জন্যে, যারা জাগতিক সবকিছুকে বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে থাকেন। কিন্তু যারা এর চেয়েও গভীর দৃষ্টি রাখেন তাদের দৃষ্টিতে মূলত সময়টাই জীবন।

হে মানুষ! এ বিশ্বে জন্ম ও মৃত্যুর মাঝে যে সময়টা অতিক্রান্ত হয় সেটা ছাড়া তোমার জীবন বলতে আর কিছু আছে কি? টাকা একসময় ফুরিয়ে যায়। কিন্তু এর চেয়েও দ্বিগুণ তিনগুণ তুমি আরেক সময় অর্জন করতে সক্ষম হও। কিন্তু যে সময়টা চলে যায় সেটা কি তুমি কখনো ফিরিয়ে আনতে পারবে? কস্মিনকালেও না। সুতরাং সময়টা টাকার চেয়েও অনেক দামি, হীরার চেয়েও অনেক দামি, সব ধরনের জওহর ও দামি পাথরের চেয়েও অনেক দামি। কেননা এটাই তো আসলে জীবন।

সফলতা শুধু সূক্ষ্ম পরিকল্পনা ও অনুকূল পরিবেশের ওপর নির্ভর করে না। বরং নির্ভর করে উপযুক্ত মুহূর্তের ওপরেও। আগেকার লোকেরা অন্তঃসারশূন্য মতামত ও অসময়ে গৃহীত অভিমত পরিহার করে চলত। উপযুক্ত সময়ে কার্য সম্পাদন হওয়াকেই তাওফিক বলে।

وَاللَّهُ يُقَدِّرُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ
আল্লাহই দিন-রাত নির্ধারণ করেন। -সুরা মুজ্জাম্মিল: ২০

এ জন্যেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সেই গাফেলরাই, যাদের ব্যাপারে আল-কোরআনে বলা হয়েছে :
وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيرًا مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ لَهُمْ قُلُوبٌ لَا يَفْقَهُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لَا يُبْصِرُونَ بِهَا وَلَهُمْ آذَانٌ لَا يَسْمَعُونَ بِهَا أُولَئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُولَئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ

আমি জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি অনেক মানুষ ও জিনকে। তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দ্বারা বোঝে না। তাদের চোখ আছে কিন্তু তা দ্বারা দেখে না। তাদের শ্রবণশক্তি আছে কিন্তু তা দ্বারা তারা শোনে না। তারা পশুর মতো, বরং তার চেয়েও অধম। তারাই গাফেল, শৈথিল্যপরায়ণ।-সুরা আরাফ : ১৭৯

নবি করিম সা. সময়ের মূল্য বোঝানোর এক চমৎকার দৃশ্যের অবতারণা করেছেন এভাবে-
لَيْسَ مِنْ يَوْمٍ يَأْتِي عَلَى ابْنِ آدَمَ إِلَّا يُنَادَى فِيهِ يَا ابْنَ آدَمَ أَنَا خَلْقَ جَدِيدٌ وَأَنَا فِيمَا تَعْمَلُ عَلَيْكَ غَدًا شَهِيدٌ فَاعْمَلْ فِي خَيْرًا أَشْهَدُ لَكَ بِهِ غَدًا فَإِنِّي لَوْ قَدْ مَضَيْتُ لَمْ تَرَنِي أَبَدًا قَالَ : "

প্রতিটি দিন ভোরের আলো ফুটার সাথে সাথে ঘোষণা করে, হে আদমসন্তান! আমি এক নতুন সৃষ্টি, আমি তোমার আমলের সাক্ষী, কাজেই আমার কাছ থেকে পাথেয় সংগ্রহ করো, যা আমি আগামী দিনে তোমার সাক্ষী হব, আমি চলে গেলে আর আমাকে ফিরে পাবে না। -হিলইয়াতুল আওলিয়া : ২/৩০৩

সুতরাং সময়ের চেয়ে দামি কোনো জিনিস এ ধরণিতে নেই। আবার সময়ের মধ্যেও তারতম্য আছে। একটি মুহূর্তের বরকত আরেকটি থেকে বেশি হয়। একটি দিন আল্লাহর কাছে আরেকটি দিন থেকে উত্তম হয়। একটি মাস আরেকটি মাস থেকে উত্তম হয়।

কবি বলেন—
নয়ন আরেক নয়ন থেকে হয় উত্তম
কেন দিন আরেক দিনের চেয়ে হয় উত্তম

রাসুল সা. অনেক হাদিসে আমাদেরকে সময়ের মূল্য বোঝার ও সময় দ্বারা উপকৃত হওয়ার দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন :
فَإِنَّ الْمُؤْمِنَ بَيْنَ مَخَافَتَيْنِ بَيْنَ عَاجَلٍ قَدْ مَضَى لَا يَدْرِي مَا اللَّهُ صَانَع فِيهِ، وَبَيْنَ أَجَلٍ قَدْ بَقِيَ لَا يَدْرِي مَا اللَّهُ قَاضَ فِيهِ

মুমিন দুটি ভয়ের মাঝে আছে: নগদ যা চলে গেছে, সে জানে না এর মধ্যে আল্লাহ কী করবেন, অপরটি অনাগত যা বাকি রয়েছে, সে জানে না আল্লাহ তাতে কী করবেন। -শুআবুল ইমান লিল-বায়হাকি

সুতরাং বান্দার উচিত নিজের থেকে নিজের জন্য গ্রহণ করা। তার দুনিয়া থেকে আখেরাতের জন্য গ্রহণ করা। বৃদ্ধ হওয়ার আগেই তারুণ্য থেকে উপকৃত হওয়া। জীবন থেকে মৃত্যুর পূর্বেই উপকৃত হওয়া।

প্রিয় বন্ধু! সময়কে গনিমত মনে করো। সময়টা তরবারির ন্যায়। শিথিলতা পরিহার করো। এর চেয়ে অধিক ক্ষতিকর আর কিছু নেই। মকবুল আমল ও মূল্যবান সময়ের জন্য আল্লাহর কাছে তাওফিক প্রার্থনা করো।

📘 আকাবিরদের জ্ঞান সাধনার গল্প > 📄 সময়টা নগদ সম্পদ, সময়টা কর্তনকারী তরবারি

📄 সময়টা নগদ সম্পদ, সময়টা কর্তনকারী তরবারি


বর্ষীয়ান প্রাজ্ঞ আলেম সাইয়েদ আহমদ হাশেমি স্বরচিত কিতাব 'দিওয়ানুর ইনশা'তে তার একটি প্রবন্ধে বলেছেন, সময় একটি মহা সম্পদ। একটি মহৎ নির্ভুল দর্শন আমাদেরকে জানিয়ে দেয় যে, সময় অত্যন্ত দামি ও গুরুত্বপূর্ণ বস্তু। সময়ের হেফাজত করা অত্যন্ত জরুরি। যেন খেলাধুলা ও অহেতুক কাজে নষ্ট না হয়। বরং উপকারী কাজ ও মেহনতে, উন্নত মর্যাদা অর্জনে, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে যেন ব্যয় হয়। প্রকৃত বুদ্ধিমান সেই যে নিজ বয়সটাকে ভালো কাজে ও অমর কীর্তি অর্জনে ব্যয় করে। যা তাকে সুনাম ও সুযশ এনে দেয়।

আমার জীবনের শপথ! সময় অবশ্যই দামি। এর চেয়ে আরও বেশি দামি তার মধ্যে ভালো কাজ হওয়া, জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জিত হওয়া, শিক্ষাদান ও গ্রহণের কাজ হওয়া, ব্যবসার প্রসার ঘটা, যেন মুনাফা অর্জিত হয়, শিল্পের উন্নতি হওয়া, কিতাবাদি লিখিত হওয়া, নতুন জিনিস আবিষ্কার করা, বিভিন্ন মহৎ কর্ম সম্পন্ন হওয়া ও গর্ব, সম্মান ও গৌরবময় ঐতিহ্যের ময়দানে সৎকর্মশীলদের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হওয়া।

সময়ের হেফাজত সততা, আমানতদারি, প্রতিশ্রুতি পালন, ইচ্ছার দৃঢ়তা ও মনোবলের দৃঢ়তার পরিচায়ক। কারণ, অলস ব্যক্তি দুর্বলকর্মা। দুর্বলচেতা ব্যক্তি স্বীয় উদাসীনতা ও আলস্যের দ্বারা নিজের ও অন্যের ক্ষতি করে। নিজ সময়কে অনর্থক নষ্ট করে। বড়োদের কাছে তার মর্যাদা হ্রাস পায় এবং অনুসারীরা তাকে অপছন্দ করে। লোকেরা তাকে ধুরন্ধর কাপুরুষ নিকৃষ্ট মনের অধিকারী অলস মনে করে। তার জীবন হয় শুষ্ক সংকীর্ণ; প্রশস্ত নয়। তাকে তুমি দেখবে সে সদা কষ্টকর জীবনযাপন করছে। পক্ষান্তরে যে নিজের সময় হেফাজত করে, সে উদ্যমী, সৌভাগ্যবান ও উৎফুল্ল থাকে। তার জীবন হয় সুখময়।

তিনি তার প্রবন্ধে আরও বলেছেন, সময় তরবারির মতো। যদি তুমি তাকে না কাটো তাহলে সে তোমাকে কেটে দেবে।

কবি বলেন—
অলসতায় আজকের কাজ রাখি না আগামীর জন্যে, নিশ্চয় আজটি মূলত কাল
হয় অক্ষম-অলসদের জন্যে।

জি হ্যাঁ, নিশ্চয় সময় এক ঘাতক তরবারি ও বঝলমলে বিদ্যুৎ। সুযোগ লুফে নেওয়া ও হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাযুক্ত বিষয়ে

অবহেলা না করা সতর্কতার প্রমাণ।

কবি বলেছেন—
সুযোগ লুফে নাও, অন্যথায়
সেটা হবে কাঁটা তোমার গলায়।

সবচেয়ে বড়ো বিপদ হলো, অনর্থক সময় কেটে যাওয়া। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন—
وَأَنْفِقُوا مِنَا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِي أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْلَا أَخَرْتَنِي إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ فَأَصَّدَّقَ وَأَكُنْ مِنَ الصَّالِحِينَ

তোমরা আমার দেওয়া রিজিক থেকে দান করো তোমাদের মৃত্যু আসার আগেই। মৃত্যু আসার পর এ কথা বললে কোনো লাভ হবে না যে, হে পরোয়ারদেগার, আমাকে কেন আরেকটু সময় দিলেন না? -সুরা আল-মুনাফিকুন : ১০

জনৈক দার্শনিক বলেছেন, সন্ধ্যা হওয়ার আগে শুভ্র দিবসটাকে মহাসুযোগ মনে করো।

জনৈক কবি বলেছেন—
বস্তুর শুরুটা যদি তুমি করে দাও ধ্বংস,
তাহলে শেষটাও অবশ্যই হবে ধ্বংস।

জীবন স্বল্পমেয়াদি, সময়ের বিন্যাস তাকে দীর্ঘ করে। মানুষ চক্ষুষ্মান, কিন্তু সময়ের মূল্য অনুধাবনে অন্ধ।

কবি বলেছেন—
মানুষকে করে খুশি সময়ের গমন
সময়ের গমন মূলত তারই গমন।

সুতরাং যে ব্যক্তি সচেতনতাকে প্রদীপ হিসেবে গ্রহণ করে, সুযোগের সদ্ব্যবহারকে মূল ভিত্তি হিসেবে মেনে নেয়, জটিল বিষয়গুলোও তার জন্য সহজ হয়ে যায়, মানুষের হৃদয়ে তার শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পায়, কঠিন বিষয়ের বোঝা তার জন্য হাল্কা হয়ে যায়। খুলে যায় তার জন্য কল্যাণের সকল দরজা। পক্ষান্তরে নে ব্যক্তি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে না, নিঃসন্দেহে সুযোগটা তার জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়, সে দিশা পায় না কীভাবে কাজ করবে। কেননা, সে তো সুযোগ হারিয়ে ফেলেছে। অতীত তো আর ফিরে আসবে না। ভবিষ্যৎ তো তার হাতে নেই।

কবি বলেছেন—
সুযোগ হারিয়ে ফেলে দুর্বলমনারা
কোনো জিনিস যখন হয় তার হাতছাড়া
নাই তার উপায়, কপালকে দোষারোপ ছাড়া।

যে সময়টা মানুষের কোনো উপকার বা মুনাফা অর্জন ছাড়াই চলে যায়, সেটাকে বিবেকমান মানুষ তার জীবনের অংশ মনে করে না। পক্ষান্তরে, মূর্খরা সেটাকে সৌভাগ্য ও কল্যাণ ভাবে।

কবি বলেছেন—
ইলম অর্জন, সৎকর্ম উপার্জন ছাড়া যদি একটি দিন গত হয়, আমি মনে করি
সেটা আমার বয়সের অন্তর্ভুক্ত নয়।

জনৈক দার্শনিক বলেছেন, কোনো কাজকে নিজ সময় থেকে বিলম্বিত করো না। কেননা, বিলম্ব করে যে সময়ের দিকে ঠেলে দেবে সে সময়ের জন্য তো অন্য কাজ রয়েছে। তখন একাধিক কাজের চাপ তুমি সহ্য করতে পারবে না। কেননা কাজের ভিড়ে ত্রুটি হওয়া স্বাভাবিক।

মোটকথা হলো, সময় নষ্ট করার মতো ক্ষতিকর আর কিছু নেই। তা যত দামিই হোক না কেন। তুমি যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নষ্ট করে ফেলো বা কোনো দামি উপহারসামগ্রী নষ্ট করে ফেলো, তাহলে কোনো না কোনো কৌশল অবলম্বন করে সেটা আবার অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু যদি তুমি তোমার জীবনের কোনো মুহূর্ত নিয়ে অবহেলা করো এবং সেটা নষ্ট করে ফেলো কোনো কল্যাণ বা সুনাম অর্জন ছাড়াই, তাহলে সেটা তুমি আদৌ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে না। যদিও তুমি দুনিয়া ভরা স্বর্ণ ব্যয় করো তা ফিরিয়ে আনার জন্য। সুতরাং সময়টা নিশ্চয় স্বর্ণ ও দামি জওহর অপেক্ষা অধিক দামي এবং সব ধরনের দামি বস্তু অপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

📘 আকাবিরদের জ্ঞান সাধনার গল্প > 📄 সময়ের সদ্ব্যবহার ও কাল থেকে শিক্ষা গ্রহণ সম্পর্কে ড. মুহাম্মদ গাজালির অমূল্য বাণী

📄 সময়ের সদ্ব্যবহার ও কাল থেকে শিক্ষা গ্রহণ সম্পর্কে ড. মুহাম্মদ গাজালির অমূল্য বাণী


আল্লামা মুহাম্মদ গাজালি সময়ের মূল্য অনুধাবন, সময় দ্বারা উপকৃত হওয়ার আগ্রহ ও সময় নষ্ট করার ব্যাপারে সতর্ক করা সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের মাধ্যমে তার রচিত 'খুলুকুল মুসলিম' নামক কিতাবটি সমাপ্ত করেছেন। নিম্নে তা থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ পেশ করা হলো :

তিনি বলেন—

সময় দ্বারা উপকৃত হওয়া ও
সময় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা।

হারিয়ে যাওয়া সব বস্তুই তুমি ফিরে পেতে পারো। কিন্ত সময় এর ব্যতিক্রম। সেটা নষ্ট হয়ে গেলে আর ফিরে পাওয়ার কোনো আশা থাকে না। তাই সময়টা হলো মানুষের সবচেয়ে দামি সম্পদ। বুদ্ধিমান মানুষের উচিত তার দিনগুলোকে চমৎকার সম্পদের কৃপণ মালিকের মতো স্বাগত জানানো। অধিক তো দূরের কথা, সামান্য সময়ের হেফাজতেও অবহেলা না করা। এবং প্রতিটি জিনিসকে উপযুক্ত স্থানে রাখা, তা যত কম গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন।

নিশ্চয় প্রকৃত মুসলিম সময় সম্পর্কে অতিরিক্ত সচেতন হয়। কেননা, সময়টাই তার জীবন। যদি সে সময়টাকে নষ্ট হতে দেয় এবং হিংস্র প্রাণীদেরকে সুযোগ দেয় সময়টাকে ছিনিয়ে নিতে তাহলে সেটা হবে তার আত্মহত্যার নামান্তর।

মানুষ নিরন্তর দ্রুত আল্লাহর দিকে অগ্রসরমান। পৃথিবীর প্রতিটি আবর্তন একটি নতুন প্রত্যুষ নিয়ে আসে। পৃথিবীর প্রতিটি আবর্তন পান্থপথের একটি স্তর, যার মধ্যে কোনো থেমে থাকা নেই। এই সত্যটা অনুধাবন করা, তাকে নখদর্পণে রাখা এবং তার আগপাছ ভেবে দেখা কি প্রতিটি মানুষের জন্য বুদ্ধিমানের পরিচায়ক নয়?

কাল নিজ গতিতে সফররত, এমতাবস্থায় কোনো ব্যক্তির নিজেকে থেমে আছে বলে মনে করা আত্মপ্রতারণার শামিল। এটা দৃষ্টির ভ্রম, যেমন রেলের আরোহীর কাছে মনে হয় সব জিনিস চলছে; কিন্তু সে নিজে বসে আছে। অথচ বাস্তবতা হলো কাল মানুষকে নিয়ে যাচ্ছে তার চূড়ান্ত পরিণতির দিকে।

ইসলাম এমন একটি ধর্ম যা সময়ের মূল্য বুঝে। সময়ের গুরুত্ব নির্ধারণ করে। ইসলাম এই অমূল্য বাণীটিকে সমর্থন করে, 'সময় তরবারির মতো। তুমি যদি তাকে না কাটো তাহলে সে তোমাকে কেটে দেবে।' এই বাস্তবতাটা অনুধাবন করা ও এর নির্দেশনা মোতাবেক চলাকে ইমানের প্রমাণ ও তাকওয়ার নিদর্শন মনে করে।

ইসলাম তার বড়ো বড়ো ইবাদতগুলোকে দিনের বিভিন্ন অংশে ও বছরের বিভিন্ন মৌসুমে ভাগ করে দিয়েছে। পাঁচটি নামাজ পুরো দিনটাকে ঘিরে রাখে। নামাজের সময়গুলো দিনের গতির সাথে আবর্তিত হয়। শরিয়তে নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত আছে যে, জিবরাইল আ. আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতরণ করেছেন নামাজের সময়ের শুরু ও শেষ নির্ধারণ করার জন্য। যেন একটি সূক্ষ্ম মজবুত ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। যা ইসলামি জীবনকে বিন্যস্ত করবে ও মিনিট দ্বারা পরিমাপ করবে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত।

ঘূর্ণায়মান আকাশের গতির সাথে দিনের পর রাত আছে এবং রাতের পর দিন আসে। রাব্বুল আলামিন এটাকে অনর্থক সৃষ্টি করেননি। মানুষের জন্য এটা অত্যন্ত নিকৃষ্ট বিষয় যে, তারা এই বিন্যস্ত পৃথিবীতে তাদের জীবনটাকে বেকার মনে করবে। বস্তুত এটা এক দীর্ঘ প্রতিযোগিতার ময়দান। যে প্রতিযোগিতায় কেবল সেই বিজয়ী হবে, যে তার রবকে চিনে। তার অধিকারকে স্মরণ করে, তার নিয়ামতের শুকর করে, যে মহা আরাম লাভের জন্য বছরসমূহের বিরতিহীন আবর্তন-বিবর্তনের সাথে সাথে বিরতিহীন মেহনত ও কষ্টের ধারা অব্যাহত রাখে।

তোমার বয়সটা তোমার অনেক বড়ো পুঁজি। তোমাকে অনতিবিলম্বে এর খরচ ও ব্যয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। রাসুল সা. বলেছেন:
لَنْ تَزُولَ قَدَمَا عَبْدٍ بَيْنَ يَدَيْ رَبِّهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يُسْأَلَ عَن اربع خِصَالٍ عَنْ عُمْرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ، وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلَاهُ، وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أَيْنَ أَصَابَهُ وَفِيهَا أَنْفَقَهُ وَمَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ »

চারটি প্রশ্ন না করা পর্যন্ত কিয়ামতের দিন কোনো বান্দার পা দুটো সরাতে পারবে না। তার বয়স সম্পর্কে কোথায় সে ব্যয় করেছে? তার তারুণ্য সম্পর্কে কোথায় সে কাজে লাগিয়েছে? তার সম্পদ সম্পর্কে কোথেকে সে উপার্জন করেছে এবং কোথায় ব্যয় করেছে? তার ইলম সম্পর্কে সে কী আমল করেছে? -তিরমিজি শরিফ

📘 আকাবিরদের জ্ঞান সাধনার গল্প > 📄 সময়ের তুলনায় কাজ অনেক বেশি। সময় নিরপেক্ষ হয়ে বসে থাকে না। সে হয়তো খাঁটি বন্ধু নয়তো ভয়ানক শত্রু

📄 সময়ের তুলনায় কাজ অনেক বেশি। সময় নিরপেক্ষ হয়ে বসে থাকে না। সে হয়তো খাঁটি বন্ধু নয়তো ভয়ানক শত্রু


ইসলাম তার অনেক নির্দেশাবলি ও নিষেধাজ্ঞাসমূহে সময়ের মূল্যের প্রতি লক্ষ রেখেছে। ইসলাম যখন অনর্থক কাজ থেকে বিরত থাকাকে ইমানের নিদর্শন সাব্যস্ত করেছে, তখন বেকার ও উদাসীন লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণায়ও বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে। যারা একে অপরকে ডাকে আর বলে, এসো বিনোদনের মাধ্যমে সময় কাটাই। অথচ এই বোকাগুলো জানে না যে, এটা হলো জীবন নিয়ে খেলা করা। এভাবে সময় কাটানো ব্যক্তিকে ধ্বংস করার নামান্তর এবং সমাজকে নষ্ট করার উপায়। একটি প্রাজ্ঞ কথা যা মানুষের হৃদয় থেকে উধাও হয়ে যায় তা হলো:

সময়ের তুলনায় কাজ অনেক বেশি। সময় নিরপেক্ষ হয়ে বসে থাকে না। সে হয়তো খাঁটি বন্ধু নয়তো ভয়ানক শত্রু।

হাসান বসরি রহ.-এর একটি অন্যতম বাণী হলো, প্রতিদিন সুবহে সাদেক হওয়ার সাথে সাথে আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ঘোষক ঘোষণা দেয়, হে আদমসন্তান! আমি এক নবীন সৃষ্টি। আমি তোমার আমলের সাক্ষী। কাজেই আমার থেকে সৎকর্মের মাধ্যমে পাথেয় সংগ্রহ করে নাও। কারণ, আমি কিয়ামত পর্যন্ত আর ফিরে আসব না।

এই প্রাজ্ঞ বাণীসমূহ ইসলামের অন্তর্নিহিত উৎস থেকে নির্গত। এবং ইহজীবন থেকে (পরকালের) বৃহৎ জীবনে জন্য উপকার লাভ করার ব্যাপারে ইসলামের মহান শিক্ষা হৃদয়ঙ্গম করা থেকে উৎসারিত। বান্দার অন্তরে তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগানোর ও এক প্রচেষ্টা থেকে আরেক প্রচেষ্টার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করার ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া আল্লাহর বিশেষ দান ও তার তাওফিকের প্রমাণ।

এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, সাধারণ মানুষ তাদের সময়গুলো বেকার নষ্ট করতে দ্বিধাবোধ করে না। এবং এই অপরাধের সাথে আরেকটি অপরাধ করে থাকে। তা হলো, অন্যের সময়ের ওপর আক্রমণ করে সেগুলোকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। তারা কর্মপ্রিয় লোকদের কাছে তাদের একান্ত কাজের সময়ে ঢুকে যায় তাদেরকে মূল্যহীন কাজে জড়িয়ে দেওয়ার জন্য।

লিঙ্ক শেয়ার করুন
close

লিঙ্ক কপি করুন