📘 অপরের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রেখো > 📄 মানুষের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা

📄 মানুষের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা


নবিদের চারিত্রিক গুণাবলির মধ্যে অন্যতম হলো, মানুষের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা। যেমন আল্লাহ তাআলা তাঁর নবি ﷺ-কে বলেন :
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللَّهِ لِنتَ لَهُمْ ۖ وَلَوْ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ ۖ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ ۖ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ
‘আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন। পক্ষান্তরে আপনি যদি রূঢ় ও কঠিন হৃদয় হতেন, তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য মাগফিরাত কামনা করুন এবং কাজ-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোনো কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদের ভালোবাসেন।’২
আল-কাসিম ﷺ বলেন : (فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللَّهِ لِنتَ لَهُمْ) ‘আল্লাহর রহমতে আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন।’ অর্থাৎ সকল মুমিনের জন্য; যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন (بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ) : ‘মুমিনদের প্রতি তিনি স্নেহশীল দয়াময়।’৩
(وَلَوْ كُنتَ فَظًّا) ‘যদি আপনি রূঢ় হতেন।’ অর্থাৎ মন্দ চরিত্র ও শক্ত কথার অধিকারী হতেন। (غَلِيظَ الْقَلْبِ) ‘কঠিন হৃদয়ের অধিকারী’ অর্থাৎ শক্ত ও কঠিন হৃদয়ের অধিকারী। তাদের সাথে কঠোর রূঢ় আচরণ করা। (لَانفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ) তখন তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। (مِنْ حَوْلِكَ) ‘আপনার কাছ থেকে।’ ফলে আপনার কাছে প্রশান্তি পেত না। আর আপনার দায়িত্বও পূর্ণতা পেত না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা আপনাকে সহজ, সুমহান, কোমল, সুন্দর, দয়াবান, নেককার, স্নেহশীল ও দয়াময় হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। (فَاعْفُ عَنْهُمْ) ‘কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন।’ অর্থাৎ আপনার অধিকারের ক্ষেত্রে তারা যে সীমালঙ্ঘন করেছে, তা আপনি ক্ষমা করে দিন, যেমন আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করে দিয়েছেন। (وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ) ‘এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।’ তাদের প্রতি দয়ার পূর্ণতা প্রদান হিসেবে। (وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ) ‘এবং কাজ-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন।’ অর্থাৎ তাদের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে, তাদের অন্তরের প্রশান্তিস্বরূপ এবং তাদের মতামত প্রকাশ করার অধিকার দিয়ে আপনি তাদের সাথে যুদ্ধ ও অন্যান্য বিষয়ে পরামর্শ করুন... অনেক তাফসিরকারক বলেন, ‘আয়াতের ফলাফল হলো, উত্তম চরিত্রকে আঁকড়ে ধরা আবশ্যক।’৪
বিশেষ করে যারা আল্লাহর দ্বীনের দিকে দাওয়াত দেবে এবং সৎকাজের আদেশ করবে তাদের জন্য।’৫
ইমাম আস-সাদি ﷺ বলেন :
‘...দ্বীনি ক্ষেত্রে নেওয়ার উত্তম চরিত্র মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের দিকে আকৃষ্ট করে এবং বিশেষ ভালোবাসার সাথে তাদেরকে তার প্রতি অনুরাगित করে। আর দ্বীনি ক্ষেত্রে নেওয়ার মন্দ চরিত্র মানুষকে নিন্দা ও বিশেষ শাস্তির সাথে তার প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে দেয়। এই নিন্দার ব্যাপারে রাসুলের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলার প্রয়োজন বলেছেন। তাহলে অন্যদের ক্ষেত্রে কী হবে? এটি কি সবচেয়ে বড় আবশ্যকীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় যে, তাঁর মহান চরিত্রের অনুসরণ করা হবে? তিনি আল্লাহর আদেশের ওপর আমল করে এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট করতে মানুষের সাথে যে কোমল ভাষা ও উত্তম আচরণ করেছেন, সে অনুযায়ী তাদের সাথে আচরণ করা হবে?’৬
সকল নবির চারিত্রিক গুণাবলি আমাদের নবি ﷺ-এর অনুরূপই পাই। যেমন আল্লাহর নবি ইউসুফ ﷺ-এর ভাইদের ব্যাপারে তাঁর অবস্থান দেখতে পাই, যখন তারা নিজেদের অপরাধের স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেছিল :
تَاللَّهِ لَقَدْ آثَرَكَ اللَّهُ عَلَيْنَا وَإِن كُنَّا لَخَاطِئِينَ
‘আল্লাহর কসম, অবশ্যই আল্লাহ তোমাকে আমাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং নিশ্চয় আমরা অপরাধী ছিলাম।’৬
আল্লাহ তাআলা তাঁকে ক্ষমতা দান করার পর যখন তাঁর পরিবার তাঁর কাছে জড়ো হলো, তখন তিনি তাদের অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এবং খুব দ্রুত (এমন হয়েছে যে,) :
وَرَفَعَ أَبَوَيْهِ عَلَى الْعَرْشِ وَخَرُّوا لَهُ سُجَّدًا ۖ وَقَالَ يَا أَبَتِ هَٰذَا تَأْوِيلُ رُؤْيَايَ مِن قَبْلُ قَدْ جَعَلَهَا رَبِّي حَقًّا ۖ وَقَدْ أَحْسَنَ بِي إِذْ أَخْرَجَنِي مِنَ السِّجْنِ وَجَاءَ بِكُم مِّنَ الْبَدْوِ مِن بَعْدِ أَن نَّزَغَ الشَّيْطَانُ بَيْنِي وَبَيْنَ إِخْوَتِي ۚ إِنَّ رَبِّي لَطِيفٌ لِّمَا يَشَاءُ ۚ إِنَّهُ هُوَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ
‘আর তিনি তার পিতামাতাকে সিংহাসনের ওপর বসালেন এবং তারা সবাই তার সামনে সিজদাবনত হলো। তিনি বললেন, “পিতা, এ হচ্ছে আমার ইতিপূর্বেকার স্বপ্নের বর্ণনা, আমার পালনকর্তা একে সত্যে পরিণত করেছেন এবং তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আমাকে জেল থেকে বের করেছেন এবং আপনাদেরকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছেন, শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করে দেওয়ার পর। আমার পালনকর্তা যা ইচ্ছা করেন, তা সূক্ষ্ম উপায়ে বাস্তবায়ন করে থাকেন। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’৭
ইবনুল কায়্যিম ﷺ বলেন :
‘এখানে তিনি এ কথা বললেন না যে, আল্লাহ আমাকে কূপ থেকে বের করেছেন; এটি করেছেন ভাইদের প্রতি অনুগ্রহ করার জন্য এবং তাদের প্রতি এই ইহসান করার জন্য যে, তিনি কূপ নিক্ষেপের মাঝে যা হয়েছে, তার মাধ্যমে তাদের লজ্জিত করেননি। তিনি বলেন, (وَجَاءَ بِكُم مِّنَ الْبَدْوِ) “এবং আপনাদেরকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছেন।” তিনি তাদের প্রতি লক্ষ রেখে এ কথা বললেন না যে, ক্ষুধা ও প্রয়োজনের তীব্রতা তোমাদের নিয়ে এসেছে। তিনি এখানে যা ঘটেছে, তার কারণটি শয়তানের দিকে সম্পৃক্ত করেছেন, সরাসরি তাদের দিকে সম্পৃক্ত করেননি; যদিও সরাসরি ক্রিয়া সম্পাদনকারী কারণ হিসেবে উল্লেখ হওয়ার অধিক নিকটবর্তী। তিনি বললেন, (مِن بَعْدِ أَن نَّزَغَ الشَّيْطَانُ بَيْنِي وَبَيْنَ إِخْوَتِي) “শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করে দেওয়ার পর।” তিনি উদারতা, দয়া এবং তাদের হক আদায় করেছিলেন। এ ধরনের পরিপূর্ণ গুণ শুধু নবি-রাসুলগণই অর্জন করতে পারেন। আল্লাহ তাআলা তাঁদের ওপর শান্তি ও রহমত বর্ষণ করুন।’৮
ইমাম সাদি ﷺ বলেন :
‘এটি ইউসুফ ﷺ-এর উদারতা এবং সুন্দর সম্বোধনের অংশ যে, তিনি জেলের অবস্থা তুলে ধরেছেন; কিন্তু কূপে নিক্ষেপের অবস্থার কথা বলেননি। কারণ, তিনি তাঁর ভাইদের পরিপূর্ণ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তাই তিনি আর সে অপরাধের কথা আলোচনা করেননি। আর গ্রাম থেকে তোমাদের এখানে আসা আমার প্রতি আল্লাহর তাআলার করুণা। ফলে তিনি বলেননি, ক্ষুধা ও ক্লান্তি তোমাদের নিয়ে এসেছে। এ কথাও বললেন না যে, আমি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছি। বরং তিনি বলেছেন, (أَحْسَنَ بِي) “তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন।” অনুগ্রহ-দানকে তিনি আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করেছেন। কতই না মহান সে সত্তা, যিনি নিজ বান্দাদের থেকে যাকে চান, নিজের রহমতের মাধ্যমে বিশেষায়িত করেন। (مِن بَعْدِ أَن نَّزَغَ) তিনি এ কথা বললেন না যে, শয়তান আমার ভাইদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করে দেওয়ার পর।” তিনি এ কথা বললেন যে, শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করেছে। বরং তিনি অপরাধ ও অজ্ঞতাকে উভয় দিকেই সম্পৃক্ত করেছেন।’৯
সম্মানিতের ছেলে সম্মানিতর ছেলে সম্মানিতর ছেলে সম্মানিতর ছেলে এই মহান অবস্থানে আমাদের সামনে নবি-রাসুল এবং আল্লাহর বিশেষ নির্বাচিত বান্দাদের সম্মান চরিত্রের বিশালতা বর্ণনা করে দেয়। হে আল্লাহ, আমাদেরকে আপনার এ বান্দাদের অনুসরণের তাওফিক দান করুন :
أُولَٰئِكَ الَّذِينَ هَدَى اللَّهُ ۖ فَبِهُدَاهُمُ اقْتَدِهْ
‘এরাই তাঁরা, যাঁদেরকে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেছেন। সুতরাং তুমি তাঁদের পথনির্দেশনা অনুসরণ করো।’১০

টিকাঃ
২. সূরা আলি ইমরান, ৩ : ১৫৯।
৩. সূরা আত-তাওবা, ৯ : ১২৮।
৪. তাফসিরে কাসিম : ৪/২৭৬।
৫. তাফসিরে সাদি : ১৫৪।
৬. সূরা ইউসুফ, ১২ : ৯১।
৭. সূরা ইউসুফ, ১২ : ১০০।
৮. মাআরিজুস সালিকিন : ২/৩৮০-৮১ (ঈষৎ পরিবর্তিত)।
৯. তাফসিরে সাদি : ৪০৫।
১০. সূরা আল-আনআম, ৬ : ৯০।

📘 অপরের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রেখো > 📄 মানুষের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখার কিছু বাস্তব চিত্র

📄 মানুষের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখার কিছু বাস্তব চিত্র


ইসলাম মানুষের অনুভূতি, তাদের অবস্থা ও মানসিকতার হিফাজতকে অনেক গুরুত্ব দিয়েছে। নবিজি ﷺ-এর নিম্ন বর্ণিত সুন্নাহসমূহ এই গুরুত্বর বিষয়টি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে :

📘 অপরের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রেখো > 📄 প্রথমত, মজলিশে মুসলিমের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা

📄 প্রথমত, মজলিশে মুসলিমের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা


১. মজলিশে বসে চুপে চুপে আলাপকারী বা আলোচনাকারীদের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা
ইসলামি শিষ্টাচারসমূহের একটি হলো, যখন কোথাও দুই বা ততোধিক ব্যক্তি মিলে বসে আলোচনা করে, তখন সেখানে অন্য কেউ প্রবেশ করতে হলে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করবে; কারণ, আলোচনাকারীদের কোনো গোপন কথা থাকতে পারে, যা আগন্তুককে জানানো তাদের পছন্দনীয় নয় অথবা তার কারণে হয়তো তারা চুপ হয়ে যেতে বা কথার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে। ফলে তার অনুপ্রবেশ তাদের জন্য কষ্টকর হবে। এখানে প্রবেশের উপযুক্ত শিষ্টাচার হলো, অনুমতি চাওয়া; যাতে সে শান্ত লাভ করতে পারে এবং তার আগমনে আনন্দিত হয়।
সাইদ আল-মাকবুরি ﷺ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘ইবনে উমর ﷺ জনৈক লোকের সাথে কথা বলছিলেন। এমন সময় আমি তাঁদের মাঝে প্রবেশ করলাম। তখন তিনি আমার বুকে আঘাত করে বললেন, “তুমি কি জানো না যে, রাসুল ﷺ বলেছেন :
إِذَا تَنَاجَى اثْنَانِ فَلَا تَجْلِسْ إِلَيْهِمَا حَتَّى تَسْتَأْذِنَهُمَا
“যখন দুজন ব্যক্তি একান্তে কথা বলবে, তখন তাদের নিকট বসবে না; যতক্ষণ না তাদের অনুমতি নাও।”’১১
এর কাছাকাছি আরেকটি আদব হলো, পাশাপাশি উপবিষ্ট দুই ব্যক্তির মাঝে তাদের অনুমতি ব্যতীত পার্থক্য করবে না। আব্দুল্লাহ বিন উমর ﷺ থেকে বর্ণিত, নবিজি ﷺ বলেছেন :
لَا يَحِلُّ لِلرَّجُلِ أَنْ يُفَرِّقَ بَيْنَ اثْنَيْنِ إِلَّا بِإِذْنِهِمَا
‘ কারও জন্য দুই ব্যক্তির মাঝে তাদের অনুমতি ব্যতীত পার্থক্য করা বৈধ হবে না।’১২
(بَيْنَ اثْنَيْنِ) অর্থাৎ তাদের দুজনের মাঝে বসে পার্থক্য করবে না। (إِلَّا بِإِذْنِهِمَا) তাদের অনুমতি ব্যতীত; কারণ, অনেক সময় তাদের মাঝে মহব্বত ও হৃদ্যতা থাকতে পারে অথবা গোপন কোনো কথাবার্তা বা আমানতের সম্পর্ক থাকতে পারে। এখন ওই লোকের মাঝখানে বসে পড়ার কারণে তাদের জন্য বিষয়টি কঠিন হয়ে যাবে।১৩
২. গোপন আলোচনার ক্ষেত্রে উপস্থিত লোকের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা
ইসলাম একই মজলিশে দুজন পৃথক হয়ে অন্যজনকে ছেড়ে গোপন আলাপ করতে বারণ করেছে। যদিও এই আলোচনা কোনো কল্যাণকর বা নেক বিষয়ে হয়ে থাকে; কারণ, এতে তাদের সাথে যে লোকটিকে শরিক করা হয়নি, তাকে চিন্তায় ফেলে দেওয়া হয়। সে ধারণা করতে পারে যে, তারা দুজন তার এমন কোনো বিষয়ে আলোচনা করছে, যা আলোচনা করা তার পছন্দনীয় নয়। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ ﷺ থেকে বর্ণিত, রাসুল ﷺ বলেছেন :
إِذَا كُنْتُمْ ثَلَاثَةً فَلَا يَتَنَاجَى اثْنَانِ دُونَ الْآخَرِ حَتَّى تَخْتَلِطُوا بِالنَّاسِ مِنْ أَجْلِ أَنْ يُحْزِنَهُ
‘যখন তোমরা তিনজন (একত্র) হও, তখন দুজন ব্যক্তি অপরজনকে বাদ দিয়ে চুপিচুপি কথা বলবে না, যে পর্যন্ত না অন্য ব্যক্তিদের সঙ্গে মিশে যাও; এ কারণে যে, তাহলে তাকে দুঃখবানায় ফেলে দেবে।’১৪
ইমাম নববি ﷺ বলেন, ‘এই নিষেধাজ্ঞা হারামের নিষেধাজ্ঞা। সুতরাং দলের কোনো সদস্যকে বাদ দিয়ে অন্যদের চুপিচুপে আলাপ হারাম; যদি না ওই সদস্য এর অনুমতি দেয়।’১৫
ইবনে হাজার ﷺ বলেন, ‘(حَتَّى تَخْتَلِطُوا بِالنَّاسِ) “যে পর্যন্ত না অন্য ব্যক্তিদের সঙ্গে মিশে যাও;” অর্থাৎ এই তিনজন অন্যের সাথে মিলিত হয়। আর অন্য লোক একজনও হতে পারে অথবা একাধিকও হতে পারে। এ থেকে বোঝা যায় যে, যখন চারজন লোক একত্রিত হবে, তখন দুজনের গোপনে আলাপ নিষিদ্ধ নয়; কারণ, এখানে অন্য দুজন গোপনে আলাপ করার সুযোগ রয়েছে। আর এটি ইমাম বুখারির আল-আদাবুল মুফরাদ কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ইমাম দাউদও এটি স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন। ইবনে উমর ﷺ থেকে আর সালেহ ﷺ-এর সূত্রে ইবনে হিব্বান ﷺ হাদিসটিকে সহিহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
আলি সালেহ বলেন, “আমি বললাম, “যদি তারা চারজন হয়?” ইবনে উমর ﷺ বললেন, “কোনো সমস্যা নেই।”’
আব্দুল্লাহ বিন দিনার ﷺ থেকে ইমাম মালিক ﷺ বর্ণনা করেন :
“ইবনে উমর ﷺ যখন কোনো লোকের সাথে গোপনে আলোচনা করতে চাইতেন এবং তাঁরা তিনজন থাকতেন, তখন চতুর্থ একজনকে ডেকে আনতেন। তারপর তাদের দুজনকে বলতেন, “তোমরা সামান্য আরাম করো; কারণ, আমি শুনেছি...” তিনি হাদিসটি উল্লেখ করেন।”
(مِنْ أَجْلِ أَنْ يُحْزِنَهُ) “এ কারণে যে, তাহলে তাকে দুঃখবানায় ফেলে দেবে।” তিনি বলেন, তাকে দুঃখবানায় ফেলে দেবে। কারণ, সে ধারণা করবে যে, তাদের দুজনের গোপন আলাপ তার ব্যাপারে মন্দ কোনো বিষয়ে অথবা তার প্রতি বিদ্বেষবশত তাকে এড়িয়ে কথা বলা হচ্ছে।
এথেকে বোঝা যায় যে, যখন গোপন আলাপকারী আলাপের জন্য বিশেষ কাউকে নির্দিষ্ট করে নিলে অন্যায় দৃষ্টিতে পড়ে যাবে, তখন তা থেকে বিরত থাকতে হবে। যদি দ্বীনি জরুরি কোনো বিষয়ে হয়, তাহলে ভিন্ন কথা।
ইমাম মাজিরি ﷺ ও তার মতো আরও অনেকে বলেছেন, “একজনকে বাদ দিয়ে দুজনের কথা বলা বা একদল লোকের কথা বলার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।” ইমাম কুরতুবি ﷺ আরও বাড়িয়ে বলেছেন, “আর একজনকে বাদ দিয়ে আরও বেশি সংখ্যক লোকের গোপন আলাপ আরও কঠিন ও ভয়ানক। সুতরাং এখানে নিষেধের বিষয়টি আরও উত্তমভাবে প্রযোজ্য হবে। তবে হাদিসে তিনজনের আলোচনা করা হয়েছে; কারণ, সর্বপ্রথম যে সংখ্যায় উক্ত অর্থ (দুঃখবানায় পড়া) পাওয়া যাবে, সেটি হলো তিন। সুতরাং যেখানেই এই অর্থ পাওয়া যাবে, সেখানেই হুকুম প্রযোজ্য হবে।”
ইবানে বাত্তাল ﷺ বলেন, “একজনকে বাদ দিয়ে বাকিদের আলোচনার দল যত বড় হবে, পেরেশানির বিষয়টি তত বেশি হবে এবং তোমাদের উপস্থিত থাকতে এখানে আরও উত্তমভাবে হারামের বিষয়টি সংযুক্ত হবে।”১৬
ইমাম খাত্তাবি ﷺ বলেন, ‘(তার ধারণার কারণে) সেটি তাকে দুঃখবানায় ফেলে দেবে। আর এটি তাকে বাদ দিয়ে অন্যকে সম্মানের সাথে বিশেষায়িত করা হবে।’১৭
রিয়াযুস সালেহিন এবং ইবনে আল্লানের ব্যাখ্যাগ্রন্থে উল্লেখ আছে, ‘প্রয়োজন ছাড়া অনুমতিতে তৃতীয়জনকে ছেড়ে দুজনের গোপন আলাপ নিষেধের অধ্যায়। অবশ্য যদি প্রয়োজন থাকে, তাহলে বলা যাবে। কারণ, তখন তাদের দুজনের অনুযায়ী অকল্যাণের ওপর কল্যাণকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। তাদের দুজনের ভিন্ন ভাষায় কথা বলা—যা তৃতীয়জন বোঝে না—এটাও গোপন আলাপের অন্তর্ভুক্ত হবে।’১৮
৩. কেউ কোথাও বসার পর তাকে তার বসার স্থান থেকে সরিয়ে সেখানে না বসা; বরং তার অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা
যে যেখানে বসেছে, সে-ই সেখানে বসার ব্যাপারে অন্যদের তুলনায় অধিক হকদার। তাকে সেখান থেকে উঠিয়ে দেওয়ার অধিকার কারও নেই। এটি একটি ইসলামি আদব, যার লক্ষ্য হলো, আসনের মালিকের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা। সে আগে বসার কারণে সে-ই স্থানকার বেশি হকদার।
আর নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর হবে, যখন কেউ তাকে তার স্থান থেকে এই মনে করে সরিয়ে দেবে যে, ওই ব্যক্তির ওপর তার শ্রেষ্ঠত্ব বেশি।
এই হুকুম বিষয়টি ব্যাপকভাবে সব মজলিশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে ইবাদত ও আমলের মজলিশগুলোতে এটি বেশি অধিকারযোগ্য। কারণ, ইসলাম কল্যাণের কাজে দ্রুত ছুটে যাওয়া, সালাতে সবার আগে উপস্থিত হওয়া, একতাবদ্ধ হওয়া ও জামাতের প্রতি উৎসাহিত করেছে। সুতরাং কেউ যখন কোনো স্থানে অন্যদের আগে উপস্থিত হয়, তখন অন্য কারও জন্য তাকে উঠিয়ে দেওয়ার অধিকার নেই। তারপরেও তাকে উঠিয়ে দিয়ে সেখানে বসবে, সে যেন নষ্ট চেহারা ও নষ্ট পরিমাপযন্ত্র সংগ্রহ করেছে।’১৯
আবুল খাসিব থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি বসা ছিলাম। এমতাবস্থায় ইবনে উমর ﷺ আসলেন। মজলিশের এক লোক তাঁর জন্য উঠে গেলেন। কিন্তু ইবনে উমর ﷺ সেখানে না বসে অন্য এক স্থানে বসলেন। লোকটি বলল, “যদি আপনি এখানে আসতেন, তাহলে কী সমস্যা ছিল?” তিনি বললেন, “যা আমি রাসুল ﷺ-এর থেকে দেখেছি, তা দেখার পর আমি কোনো স্থান বা অন্য কারও স্থানে বসতে পারি না : এক লোক রাসুল ﷺ-এর নিকট অন্য লোকের জন্য তার স্থান হতে উঠে দাঁড়াল। সে সেখানে বসার জন্য যেতে থাকলে নবিজি ﷺ তাকে বারণ করলেন।”’২০
ইবনে উমর ﷺ থেকে বর্ণিত, নবিজি ﷺ বলেন :
لَا يُقِيمُ الرَّجُلُ الرَّجُلَ مِنْ مَقْعَدِهِ، ثُمَّ يَجْلِسُ فِيهِ وَلَكِنْ تَفَسَّحُوا وَتَوَسَّعُوا
‘কোনো ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে তার বসার স্থান থেকে উঠিয়ে দিয়ে সেখানে বসবে না। বরং তোমরা (অন্যের) প্রশস্ত করে দাও, জায়গা বিস্তার করে দাও।’
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে :
‘আমি বললাম, (فِي يَوْمِ الْجُمُعَةِ) “জুমার দিনে?” তিনি বললেন, (فِي يَوْمِ الْجُمُعَةِ وَغَيْرِهَا) “জুমার দিনে এবং অন্য দিনে।”’
ইবনে উমর ﷺ-এর জন্য কেউ যখন মজলিশ থেকে উঠে জায়গা করে দিত, তখন তিনি সেখানে বসতেন না।২১
আবু হুরাইরা ﷺ থেকে বর্ণিত, রাসুল ﷺ বলেন :
لَا يُقِيمُ الرَّجُلُ الرَّجُلَ مِنْ مَجْلِسِهِ، وَلَكِنِ افْسَحُوا يَفْسَحِ اللَّهُ لَكُمْ
‘কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তির জন্য তার বসার জায়গা থেকে দাঁড়াবে না। তবে তোমরা জায়গা প্রশস্ত করে দাও, আল্লাহ তোমাদের জন্য প্রশস্ত করে দেবেন।’২২
আলবানি ﷺ এই হাদিসের ব্যাপারে বলেন, ‘বাহ্যিকভাবে এটাই বোঝা যায় যে, এটি ইসলামি শিষ্টাচার নয় যে, কেউ তার বসার স্থান থেকে উঠে যাবে; যেন সেখানে অন্য কেউ বসতে পারে। মানুষ এমনটি করে সম্মান দেখিয়ে। এ ধরনের অবস্থা নবিজি ﷺ-এর নির্দেশনার বিপরীত। নবিজি ﷺ এ কথা থেকে সর্বনিম্ন মাকরুহ বোঝা যায় : (...) لَا يَقُومُ الرَّجُلُ لِلرَّجُلِ مِنْ مَجْلِسِهِ ‘ (কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তির জন্য তার বসার জায়গা থেকে দাঁড়াবে না।)’ কারণ, এটি নফি (নেতিবাচক)—নিষেধের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে মূল হলো হারাম, মাকরুহ নয়। তবে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক ভালো জানেন।২৩
৪. অধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তির অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা, যখন মজলিশে সে নিজের স্থানে ফিরে আসবে
ইসলাম অধিকারওয়ালাকে বর্ণনা দিয়ে তা তার প্রাপকের জন্য সংরক্ষণ করেছে। যেন মতানৈক্য সৃষ্টি না হয় এবং কেউ নিজের অনধিকার চর্চা না করে। আর এর ফলে কোনো হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি না হয়।
এ রকম একটি ব্যাপার হলো, জায়গার ব্যাপার। যখন কেউ কোনো সাধারণ স্থানে আগে এসে বসবে, তখন সে-ই স্থানের বেশি হকদার। তারপর যদি সে কোনো প্রয়োজনে সেখান থেকে উঠে যায় এবং পুনরায় সেখানে ফিরে আসে, তাহলে সে স্থানের ব্যাপারে সে-ই বেশি হকদার। যে স্থানে বসেছে, তার জন্য সেখান থেকে উঠে যাওয়া আবশ্যক।
তবে উত্তম হলো, সে স্থানে উপস্থিত ব্যক্তি সেখানে এমন কোনো প্রমাণ বা নিদর্শন রেখে যাবে যে, এটি তার আসন; যেন এর মাধ্যমে ঝগড়া বা বিবাদের পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়।
আবু হুরাইরা ﷺ থেকে বর্ণিত, নবিজি ﷺ বলেছেন :
إِذَا قَامَ أَحَدُكُمْ مِنْ مَجْلِسِهِ، ثُمَّ رَجَعَ إِلَيْهِ فَهُوَ أَحَقُّ بِهِ
‘যখন তোমাদের কেউ নিজের বসার স্থান থেকে উঠে যায়, তারপর সেখানে ফিরে আসে, তাহলে সে-ই সে স্থানের (বসার) অধিক হকদার।’২৪
এটি এমন একটি মাসআলা, যার ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষ উদাসীন; বিশেষ করে যখন সভার স্থান সংকীর্ণ হয় তখন।
৫. মজলিশে বড়দের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা এবং তাদের সম্মান ও কথা বলার ইত্যাদির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া
এটি ইসলামের একটি বড় শিষ্টাচার যে, বড়দের আগে ছোটরা কথা বলবে না। বরং ছোটরা যদি বড়দের কথা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করে, তাহলে এটিকে উত্তম আচরণ হিসেবে গণনা করা হয়।

টিকাঃ
১১. মুসনাদু আহমাদ : ৫৯৪৯।
১২. সুনানুত তিরমিজি : ২৭৫২।
১৩. আব্দুল মালেক : ১০/১০৩।
১৪. সহিহুল বুখারি : ৬২৯০, সহিহু মুসলিম : ২১৮৪।
১৫. শারহুন নববি আলা মুসলিম : ১৪/১৬৭।
১৬. ফাতহুল বারি : ১১/৮৬।
১৭. মাআলিমুস সুনান : ৪/১১৭ (ঈষৎ পরিবর্তিত)।
১৮. শারহু ইবনি আল্লান : ৮/১০৫।
১৯. আদাবুল কুবরা : ৩১৬ পৃ.।
২০. মুসনাদু আহমাদ : ৫৫৬৭, সুনানু আবি দাউদ : ৪৮২৮।
২১. সহিহু মুসলিম : ২১৭৭।
২২. মুসনাদু আহমাদ : ১০২৬৬।
২৩. মাজমুউ ফাতাওয়াল রাযি : ২২১ পৃ.।
২৪. সহিহু মুসলিম : ২১৭৯।

📘 অপরের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রেখো > 📄 দ্বিতীয়ত, মেহমানদারির ক্ষেত্রে মুসলিমদের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা

📄 দ্বিতীয়ত, মেহমানদারির ক্ষেত্রে মুসলিমদের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা


১. অতিথি মেহমানদারির জন্য ওজরখাহি করলে দাতার অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা
মেহমানের মেহমানদারি হলো তার জন্য সম্মান প্রদর্শন, তাকে অভ্যর্থনা জানানো এবং তার প্রতি ইহসান বা অনুগ্রহ করা। আর ইহসানের হক হলো অনুরূপ জিনিস দিয়ে তা পরিশোধ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন :
هَلْ جَزَاءُ الْإِحْسَانِ إِلَّا الْإِحْسَانُ
‘উত্তম কাজের প্রতিদান উত্তম ছাড়া আর কী হতে পারে?’৩৫
এটিই নীতি; যতক্ষণ না এখানে কোনো প্রতিবন্ধক থাকে। যেমন সেখানে শরয়ি কোনো সমস্যা থাকতে পারে অথবা বাস্তবিক কোনো সমস্যা থাকতে পারে অথবা এ ধরনের অন্য কোনো বিষয় থাকতে পারে। সুতরাং তার জন্য শরয়ি দিকটির প্রতি লক্ষ রাখতে হবে এবং তাকে তার মাখলুক ও নফসের ওপর অগ্রাধিকার দিতে হবে।৩৬ তবে তিনি নিজের ওজরের সংবাদ দেবেন খুব কোমলতার সাথে।
সব বিন জাসসামাহ আল-লাইসি থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুল ﷺ-কে আবওয়া বা ওয়াদ্দান নামক জায়গায় অবস্থান অবস্থায় একটি বন্য গাধা উপঢৌকন দিলে তিনি তা ফিরিয়ে দেন। এরপর নবিজি ﷺ তাঁর চেহারায় মনঃক্ষুণ্ণ ভাব দেখে বললেন, (إِنَّا لَمْ نَرُدَّهُ عَلَيْكَ إِلَّا أَنَّا حُرُمٌ) ‘ওটা আমি কখনো তোমাকে ফিরিয়ে দিতাম না, যদি না আমি মুহরিম হতাম।’৩৭
ইবনে হাজার ﷺ বলেন, ‘এতে প্রমাণ রয়েছে যে, কোনো কারণে হাদিয়া ফিরিয়ে দেওয়া জায়েজ। মুসান্নিফ (ইমাম বুখারি) ﷺ এর তরজমা করেছেন এভাবে : “যে কোনো কারণে হাদিয়া ফিরিয়ে দিয়েছে।” এতে হাদিয়া ফিরিয়ে দেওয়ার দ্বারা হাদিয়াদাতার অন্তরে প্রশান্তি জরুরি এবং হেবা বা দান কবুল করা ছাড়া মালিকানায় প্রবেশ করে না এবং মালিকানার ক্ষমতা থাকলেই কেউ মালিক হয়ে যায় না—এই ব্যাপারেও উল্লেখ রয়েছে। আর মুহরিম ব্যক্তির হাতে যদি তার জন্য শিকার নিষিদ্ধ এমন কোনো জিনিস চলে আসে, তাহলে সেটি তার জন্য ছেড়ে দেওয়া আবশ্যক—এটিও বুঝা যায়।’৩৮
ইবনুল মুলাক্কিন ﷺ বলেন, ‘আর হাদিসের কিছু ফায়দা হলো, যখন ফিরিয়ে দেওয়ার মতো কোনো প্রতিবন্ধক সৃষ্টি না হবে, তখন হাদিয়া দেওয়া ও গ্রহণ করা জায়েজ। আর যখন হাদিয়াদাতার হাদিয়া গ্রহণ করা না, তখন তার সামনে ওজরখাহি করবে। তাহলে ওজর নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার কারণে হাদিয়াদাতার অন্তর প্রশান্তি লাভ করবে। আবু আলি আন-নিশাপুরি ﷺ বলেন, “এটি ওজরখাহির ব্যাপারে বিশুদ্ধ হাদিস।”’৩৯
২. যখন মেজবান মেহমানকে সম্মান করার মতো কিছু না পান, তখন মেজবানের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা
অনেক সময় কোনো মুসলিম কোনো মেহমানের আগমনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। কারণ, মেহমান এমন অবস্থায় এসেছে, যখন সে খুব কঠিন অবস্থা পার করছে বা ব্যস্ত আছে অথবা তার ঘরে সে সংকীর্ণ হয়ে আছে বা তার হাত সংকীর্ণ হয়ে আছে।
এই সময় মেহমানের জন্য আদব হলো, মেজবানের সমস্যা দূর করা—কোমল ভাষার মাধ্যমে, যা তার দৃষ্টি ও পেরেশানি দূর করে দেবে এবং সে যে সমস্যায় নিপতিত হয়েছে, তা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে।
উত্তম হলো, কোনো মুসলিমের জীবনে সমস্যা পতিত হওয়ার আগেই এ ধরনের অবস্থান্তরের প্রতি খেয়াল রাখা।৪০
৩. মেহমানের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা
ইসলাম যে মেহমানদারির প্রতি উৎসাহিত করেছে, তার একটি আদব হলো, মেজবান ও তার পরিবারের লোকেরা মেহমানের খাওয়ার সময় তার অনুভূতির প্রতি খেয়াল রাখবে। তারা মেহমানকে এটা বুঝতে দেবে না যে, সে তাদের কষ্টে ফেলে দিয়েছে। তারা এমন কোনো কাজ করবে না, যার কারণে মেহমানের মনে হবে যে, সে তাদের সংকীর্ণতায় ফেলে দিয়েছে; যেমন : মেহমানের খাওয়া অবস্থায় তাদের দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করা অথবা তার উপস্থিতিতে তারা সকলে নীরবতা অবলম্বন করা, যা মেহমানের মাঝে সমস্যার অনুভূতি সৃষ্টি করে এবং সে তাড়াহুড়া করতে বাধ্য হয়।
বরং উচিত হলো, মেহমানের সামনে তাদের আনন্দ প্রকাশ করা এবং তার আগমনে তারা যে প্রফুল্ল এবং মেহমানদারির জন্য প্রয়োজনে তারা নিজেদের সবকিছু কুরবান করতে প্রস্তুত—এটি বোঝানো।
আবু হুরাইরা ﷺ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘জনৈক বেদুঈন রাসুল ﷺ-এর কাছে এসে বলল, “আমি চরম অনাহারে ভুগছি।” রাসুল ﷺ তাঁর এক স্ত্রীর নিকট লোক পাঠালে তিনি বললেন, “যে সত্তা আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন—তাঁর কসম, আমার নিকট পানি ব্যতীত আর কিছু নেই।” তিনি তাঁর অপর এক স্ত্রীর নিকট পাঠালে তিনিও অনুরূপ কথা বললেন। এভাবে তাঁরা সবাই একই কথা বললেন যে, “সে সত্তার কসম—যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন, আমার কাছে পানি ব্যতীত আর কিছুই নেই।” তখন তিনি বললেন, (مَنْ يُضِيفُ هَذَا اللَّيْلَةَ رَحِمَهُ اللَّهُ) “আজ এ রাতে কে লোকটির মেহমানদারি করবে? আল্লাহ তার ওপর দয়া করুন!” তখন এক আনসারি সাহাবি উঠে বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল, আমি।” অতঃপর লোকটিকে নিয়ে আনসারি সাহাবি নিজ বাড়িতে গেলেন এবং তার স্ত্রীকে বললেন, “তোমার নিকট কিছু আছে কি?” সে বলল, “না। তবে বাচ্চাদের জন্য অল্প কিছু খাবার আছে।” তিনি বললেন, “তুমি কিছু একটা দিয়ে তাদের ব্যস্ত রাখো। আর যখন খাওয়ার সময়) তখন তুমি বাতিটি নিভিয়ে দিয়ো। আর তাকে বোঝাবে যে, আমরাও খাচ্ছি। সে যখন খাওয়া আরম্ভ করবে, তখন তুমি আলোর পাশে গিয়ে সেটি নিভিয়ে দেবে।” রাবি বলেন, ‘তারা বসে থাকলেন এবং অতিথি খেতে শুরু করল। সকালে ওই আনসারি সাহাবি নবিজি ﷺ-এর কাছে আসলে তিনি বললেন : (قَدْ عَجِبَ اللَّهُ مِنْ صَنِيعِكُمَا بِضَيْفِكُمَا اللَّيْلَةَ) “রাতে অতিথির সঙ্গে তোমাদের উভয়ের ব্যবহারে আল্লাহ খুশি হয়েছেন।”’৪০
এটি নিষিদ্ধ কষ্ট স্বীকারের অন্তর্ভুক্ত নয়; কারণ, এই বেদুঈন ছিল অনাহারী; আর সে ছিল রাসুল ﷺ-এর মেহমান।
আর আনসারি নিজের কাছে যা আছে, তা দিয়েই তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
কিন্তু যদি মেজবান নিজের সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে কষ্ট স্বীকার করে বা কষ্টদায়ক কোনো ঋণ বা এ জাতীয় কিছু গ্রহণ করে, তাহলে এটি নিষিদ্ধ। রাসুল ﷺ বলেন :
لَا يَتَكَلَّفَنَّ أَحَدٌ لِضَيْفِهِ مَا لَا يَقْدِرُ عَلَيْهِ
‘কেউ যেন মেহমানের জন্য নিজের সাধ্যের বাইরে কষ্ট স্বীকার না করে।’৪১
আবু হুরাইরা ﷺ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুল ﷺ এবং আবু বকর ও উমর ﷺ বের হলেন। প্রচণ্ড ক্ষুধায় তাঁদের বের করেছে। তাঁরা জনৈক আনসারির কাছে আসলেন। কিন্তু তখন সে আনসারি বাড়িতে ছিলেন না। তার স্ত্রী তাঁদের দেখে বলল, “মারহাবান ওয়া আহলান!” রাসুল ﷺ তাকে বললেন, “অমুক কোথায়?” সে বলল, “আমাদের জন্য মিষ্টি পানি আনতে গেছেন।” ঠিক তখনই ওই আনসারি সাহাবি চলে এলেন। এরপর তিনি রাসুল ﷺ ও তাঁর সাথিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ, আজ মেহমানের দিক থেকে আমার চেয়ে অধিক সৌভাগ্যবান আর কেউ নেই।” তারপর তিনি গিয়ে খেজুরের ছড়া নিয়ে আসলেন—যাতে কাঁচা, পাঁকা ও শুকনো খেজুর ছিল। তিনি বললেন, “আপনারা এ ছড়া থেকে খান।” এরপর তিনি ছুরি নিলেন (বকরি জবাই করার জন্য)। তখন রাসুল ﷺ তাকে বললেন, “সাবধান, দুধেল বকরি জবাই করবে না।” এরপর তাদের জন্য বকরি জবাই করা হলো। তারা তার গোশত ও কাঁদির খেজুর খেলেন এবং পানি পান করলেন। যখন তারা সকলেই ক্ষুধা মিটিয়ে পরিতৃপ্ত হলেন। তখন রাসুল ﷺ আবু বকর ও উমর ﷺ-কে বললেন :
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لَتُسْأَلُنَّ عَنْ هَذَا النَّعِيمِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، أَخْرَجَكُمْ مِنْ بُيُوتِكُمُ الْجُوعُ، ثُمَّ لَمْ تَرْجِعُوا حَتَّى أَصَابَكُمْ هَذَا النَّعِيمُ
“যে সত্তার হাতে আমার জীবন—তাঁর কসম, কিয়ামতের দিন এই নিয়ামত সম্বন্ধে তোমাদের জিজ্ঞাসিত হবে। ক্ষুধা তোমাদের বাড়ি হতে বের করেছে; অথচ তোমরা এ নিয়ামত লাভ না করে ফেরত যাওনি।”’৪২
ইমাম নববি ﷺ বলেন, ‘সালাফের একদল মেহমানের কষ্টে নিপতিত হওয়াকে অপছন্দ করেছেন। তবে সেই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, যখন গৃহকর্তার জন্য মেহমানদারি করা বাহ্যিকভাবে কঠিন হবে; কারণ, এই অবস্থা ও মেহমানের আগমনে পরিপূর্ণ আনন্দ প্রকাশ প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় এর কিছু অংশ তার মাঝে প্রকাশও পেতে পারে। ফলে এর মাধ্যমে মেহমান কষ্ট পাবে। অনেক সময় সে মেহমানের জন্য এমন কোনো জিনিস উপস্থিত করতে পারে, যা থেকে মেহমান বুঝবে যে, সে তার জন্য কঠিন হয়ে গেছে এবং মেজবানের জন্য অনেক কষ্ট স্বীকার করছে। তার প্রতি দয়াবশত সে কষ্ট পাবে। আর এ সবই হলো রাসুল ﷺ-এর এই বাণীর বিপরীত :
مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ
“যে আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের প্রতি ইমান রাখে, সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে।”৪৩
কারণ, মেহমানের প্রতি সম্মান পূর্ণতা হবে, যদি তার মনকে তৃপ্তি দেওয়া হয় এবং তার কার্যাআনন্দ প্রকাশ করা হয়। আর ওই আনসারি সাহাবির কর্ম ও তাঁর বকরি জবাই তাঁর জন্য কোনো কঠিন ব্যাপার ছিল না। বরং যদি তিনি অনেকগুলো ভেড়া বা উটও জবাই করতেন এবং রাসুল ﷺ ও তাঁর দুই সাহাবি মেহমানদারিতে তা পেশ করতেন, তবুও তিনি এর মাধ্যমে আনন্দিত হতেন এবং এর মাধ্যমে সর্বাধিক সম্মানিত হতেন। আর আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত।’৪৪
৪. এমনভাবে মেহমানের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা যে, সে যেন ধারণা করতে না পারে, তারা তার জন্য কষ্ট স্বীকার করছে
অনেক সময় মেহমান অনুভব করতে পারে যে, গৃহকর্তা তার জন্য কষ্ট স্বীকার করছে। সুতরাং গৃহকর্তার জন্য মেহমানের এই অনুভূতি দূর করা আবশ্যক। বনু মুত্তাফিকের প্রতিনিধি লাকিত বিন সাবরাহ ﷺ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :
انْطَلَقْتُ أَنَا وَصَاحِبٌ لِي حَتَّى أَتَيْنَا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلَمْ نُصَادِفْهُ، فَوَجَدْنَا عَائِشَةَ أُمَّ الْمُؤْمِنِينَ قَائِمَةً تُصْلِحُ شَيْئًا مِنْ أَمْرِهَا، فَأَطْعَمَتْنَا تَمْرًا، وَعَصَدَتْ لَنَا عَصِيدَةً، إِذْ جَاءَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَقَلَّعُ فَقَالَ: «هَلْ أَطْعَمْتُمْ مِنْ شَيْءٍ؟» ، قُلْنَا: نَعَمْ يَا رَسُولَ اللَّهِ، فَبَيْنَا نَحْنُ كَذَلِكَ رَافِعٌ رَأْسِيَ الْغَنَمَ فِي الْمَرَاحِ عَلَى يَدِهِ سَخْلَةٌ، قَالَ: «هَلْ وَلَدَتْ؟» ، قَالَ: نَعَمْ، قَالَ: «فَاذْبَحْ لَنَا شَاةً» ، ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا فَقَالَ: «لَا تَحْسَبَنَّ - وَلَمْ يَقُلْ: لَا تَحْسَبَنِّنَا - إِنَّا ذَبَحْنَا الشَّاةَ مِنْ أَجْلِكُمَا، لَنَا غَنَمٌ مِائَةٌ لَا نُرِيدُ أَنْ نَزِيدَ عَلَيْهَا فَإِذَا وَلَّدَ الرَّاعِي بَهْمَةً أَمَرْنَاهُ بِذَبْحِ شَاةٍ»
‘আমি ও আমার এক সাথি রাসুল ﷺ-এর নিকট গেলাম। কিন্তু তাঁকে পেলাম না। আয়েশা ﷺ আমাদেরকে খেজুর খাওয়ালেন এবং আমাদের জন্য সারিদ তৈরি করলেন। ইত্যবসরে রাসুল ﷺ সেখানে মহল্লার গরিব আগমন করলেন। তিনি বললেন, “তোমরা কি কিছু খেয়েছ?” আমরা বললাম, “হ্যাঁ, ইয়া রাসুলাল্লাহ!” আমরা সাথে ছিলাম, এমতাবস্থায় এক মেষপালক রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর বকরির পাল চরিয়ে নিয়ে এল, তখন তার হাতে একটি ছাগলছানা ছিল। তিনি বললেন, “বাচ্চা জন্ম নিয়েছে?” সে বলল, “হ্যাঁ।” রাসুলুল্লাহ ﷺ জিজ্ঞেস করলেন, “আমাদের জন্য একটি বকরি জবাই করো।” এরপর তিনি আমাদের দিকে এসে বললেন, “মনে করো না যে, আমরা তোমাদের জন্য বকরি জবাই করছি; আমাদের একশটি ছাগল আছে। আমরা চাই না, তা একশর থেকে বেড়ে যাক। সে জন্যই রাখাল কোনো ছাগলছানার জন্ম জানালে আমরা তাকে একটি বকরি জবাই করতে আদেশ করি।”’৪৫
(لِذَبْحِ الشَّاةِ مِنْ أَجْلِكُمَا) ‘তোমাদের জন্য বকরি জবাই করেছি’—এর দ্বারা রাসুল ﷺ ইচ্ছা করেছেন যে, আমরা তোমাদের জন্য কষ্ট করছি না, তোমরা আমাদের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট হবে এবং মেহমানদারি দেখে বিস্মিত ও অবাক হবে।
(أَمَرْنَاهُ بِذَبْحِ شَاةٍ) ‘আমরা তাকে একটি বকরি জবাই করতে আদেশ করি।’ সুতরাং আমার আপনার ব্যাপারে ধারণা করো না যে, আমি তোমাদের জন্য কষ্ট করছি। এই কথা থেকে যা বোঝা যায়, যখন তাঁরা রাসুল ﷺ-এর জবাইয়ের আদেশ শুনলেন এবং বলা, ‘আমাদের জন্য আপনি নিজে কষ্ট করবেন না!’ তখন নবিজি ﷺ উত্তরে বললেন, ‘তোমরা ধারণা করো না যে, আমরা তোমাদের জন্য বকরি জবাই করছি।’ পূর্বের ঘটনা থেকে এটিই বুঝা আসে।৪৬
৫. সাফিদের মাঝে গৃহকর্তার ক্ষমতা ও ইমামতি রক্ষার মাধ্যমে তার অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা
আবু মাসউদ আল-আনসারি ﷺ থেকে বর্ণিত, নবিজি ﷺ বলেছেন :
يَؤُمُّ الْقَوْمَ أَقْرَؤُهُمْ لِكِتَابِ اللَّهِ، وَأَقْدَمُهُمْ قِرَاءَةً، فَإِنْ كَانَتْ قِرَاءَتُهُمْ سَوَاءً، فَلِيَؤُمَّهُمْ أَقْدَمُهُمْ هِجْرَةً، فَإِنْ كَانُوا فِي الْهِجْرَةِ سَوَاءً، فَلِيَؤُمَّهُمْ أَكْبَرُهُمْ سِنًّا
‘আল্লাহর কিতাব কুরআন মজিদের জ্ঞান যার সবচেয়ে বেশি এবং যে কুরআন তিলাওয়াতে সুন্দরভাবে করতে পারে, সে-ই সালাতে জামাতে ইমামতি করবে। সুন্দর কিরাআতের ব্যাপারে সবাই যদি সমকক্ষ হয়, তাহলে তাদের মধ্যে যে হিজরতের ব্যাপারে সবচেয়ে অগ্রগামী, সে-ই ইমামতি করবে। হিজরতের ব্যাপারেও যদি সবাই সমকক্ষ হয়, তাহলে তাদের মধ্যে যে বয়সে প্রবীণ, সে-ই ইমামতি করবে।’
গৃহকর্তা হলো তার ঘরের ক্ষমতার অধিকারী। আর ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তির সামনে কেউ অগ্রসর হবে না। আর ইমাম হলো মুসলিমদের মাঝে ক্ষমতার অধিকারী। সুতরাং গৃহকর্তার অনুমতি ব্যতীত কেউ ইমামতি করতে পারবে না। এ কারণেই নবিজি ﷺ পূর্বের হাদিসের শেষে উল্লেখ করেছেন :
وَلَا تَؤُمَّنَّ الرَّجُلَ فِي سُلْطَانِهِ، وَلَا فِي أَهْلِهِ، وَلَا تَجْلِسْ عَلَى تَكْرِمَتِهِ فِي بَيْتِهِ إِلَّا أَنْ يَأْذَنَ لَكَ، أَوْ بِإِذْنِهِ
‘কোনো ব্যক্তি যেন কারও নিজের বাড়িতে (বাড়ির কর্তাকে বাদ দিয়ে) কিংবা কারও ক্ষমতাধীন এলাকায় নিজে ইমামতি না করে। আর কেউ যেন কারও বাড়িতে গিয়ে অনুমতি ছাড়া তার বিছানায় না বসে।’৪৭
এই হাদিসের কাছাকাছি অর্থে আরেকটি হাদিস আছে, যেখানে বলা হয়েছে, বাহনের মালিকই বাহনের সামনে বসার ব্যাপারে অধিক হকদার। বুরাইদা ﷺ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :
بَيْنَمَا النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَمْشِي إِذْ جَاءَهُ رَجُلٌ وَمَعَهُ حِمَارٌ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، ارْكَبْ، وَتَأَخَّرَ الرَّجُلُ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا، أَنْتَ أَحَقُّ بِصَدْرِ دَابَّتِكَ مِنِّي إِلَّا أَنْ تَجْعَلَهُ لِي قَالَ: قَدْ جَعَلْتُهُ لَكَ، فَرَكِبَ
‘একদা নবিজি ﷺ পায়ে হাঁটছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি একটি গাধা নিয়ে এসে বলল, “হে আল্লাহর রাসুল, আরোহণ করুন।” এ বলে লোকটি পেছনে সরে গেল। রাসুল ﷺ বললেন, “না, আমার চেয়ে তুমিই তোমার দিকে বসার অধিক হকদার। অবশ্য তুমি আমার জন্য তা ছেড়ে দিলে ভিন্ন কথা।” সে বলল, “আমি তা আপনার জন্য ছেড়ে দিলাম।” অতঃপর তিনি তাতে আরোহণ করলেন।’৪৮
৬. গৃহকর্তাকে বিরক্ত না করার মাধ্যমে তার অনুভূতির প্রতি খেয়াল রাখা
আনাস বিন মালিক ﷺ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘যখন রাসুল ﷺ জয়নাব বিনতে জাহাশকে বিয়ে করেন, তখন তিনি লোকদের দাওয়াত করলেন। লোকেরা আহারের পর বসে কথাবার্তা বলতে লাগল। তিনি উঠে যেতে চাইলে উঠলেন। এ অবস্থা দেখে তিনি উঠে যাওয়ার পর যারা উঠবার তারা উঠে গেল। কিন্তু তিন ব্যক্তি বসেই থাকল। নবিজি ﷺ ঘরে প্রবেশের জন্য ফিরে এসে দেখেন, তারা তখনো বসেই আছে। অতঃপর তারাও উঠে গেল। আমি গিয়ে রাসুল ﷺ-কে তাদের চলে যাওয়ার সংবাদ দিলাম। তারপর তিনি এসে প্রবেশ করলেন। এরপর আমি প্রবেশ করতে চাইলে তিনি আমার ও তাঁর মাঝে পর্দা ঝুলিয়ে দিলেন। তখন আল্লাহ তাআলা এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَدْخُلُوا بُيُوتَ النَّبِيِّ إِلَّا أَن يُؤْذَنَ لَكُمْ إِلَىٰ طَعَامٍ غَيْرَ نَاظِرِينَ إِنَاهُ وَلَٰكِنْ إِذَا دُعِيتُمْ فَادْخُلُوا فَإِذَا طَعِمْتُمْ فَانتَشِرُوا وَلَا مُسْتَأْنِسِينَ لِحَدِيثٍ ۚ إِنَّ ذَٰلِكُمْ كَانَ يُؤْذِي النَّبِيَّ فَيَسْتَحْيِي مِنكُمْ ۖ وَاللَّهُ لَا يَسْتَحْيِي مِنَ الْحَقِّ ۚ وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِن وَرَاءِ حِجَابٍ ۚ ذَٰلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ ۚ وَمَا كَانَ لَكُمْ أَن تُؤْذُوا رَسُولَ اللَّهِ وَلَا أَن تَنكِحُوا أَزْوَاجَهُ مِن بَعْدِهِ أَبَدًا ۚ إِنَّ ذَٰلِكُمْ كَانَ عِندَ اللَّهِ عَظِيمًا
“হে ইমানদারগণ, তোমরা নবির ঘরে প্রবেশ করো না। অবশ্য তোমাদেরকে খাদ্য গ্রহণের জন্য অনুমতি দেওয়া হলে সেখানে প্রবেশ করতে পারো; তবে তা এত আগে নয় যে, খাবার খাওয়ার সময় হওয়ার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকবে। বরং তোমাদেরকে যখন ডাকা হবে, তখনই প্রবেশ করবে। এরপর যখন খাওয়া শেষ করবে, তখন বেরিয়ে পড়বে। কথাবার্তায় মশগুল হবে না। তাতে নবির কষ্ট হয়; কিন্তু তিনি তোমাদের (উঠিয়ে দিতে) সংকোচবোধ করেন। তবে আল্লাহ সত্যকথা বলতে সংকোচবোধ করেন না। আর তোমরা নবির স্ত্রীদের কাছে কোনো জিনিস চাইলে তা পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এটা তোমাদের অন্তর এবং তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ। আল্লাহর রাসুলকে কষ্ট দেওয়া এবং তাঁর পরে তাঁর স্ত্রীদেরকে কখনো বিয়ে করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়। তোমাদের এ রকম কাজ আল্লাহর কাছে একটা গুরুতর অপরাধ।”’৪৯,৫০
ইমাম বুখারি আরেকটি বর্ণনায় বিষয়টিকে এভাবে তুলে ধরে টাকায় সংযুক্ত করেছেন, ‘কিন্তু লোক রয়ে গেল এবং তারা আলাপ করতে লাগল। তিনি (আনাস ﷺ) বলেন, (وَجَعَلْتُ أَغْتَمُّ) “আমি বিরক্তিবোধ করছিলাম।”’৫১
ইবনে হাজার ﷺ বলেন, ‘(وَجَعَلْتُ أَغْتَمُّ) শব্দটি الغَم (পেরেশানি) শব্দ থেকে নির্গত। আর এর কারণ হলো, তিনি নবিজি ﷺ-এর লজ্জার ব্যাপারটি পেরেশানিতে পড়ছিলেন। যার ফলে নবিজি ﷺ তাদেরকে উঠে যাওয়ার ব্যাপারে আদেশ করেননি।’৫২
ইবানে বাত্তাল ﷺ বলেছেন, ‘এতে এ বিষয়টি বোঝা যায় যে, কারও জন্য অনুমতি ছাড়া অন্যের ঘরে প্রবেশ করা উচিত নয় এবং যে বিষয়ে তাকে অনুমতি প্রদান করা হয়েছে, তা পূর্ণ করার পর সেখানে দীর্ঘ সময় বসে থাকাও উচিত নয়; যেন গৃহকর্তাদের কষ্ট না হয় এবং তাদের জন্য প্রয়োজন পূরণে প্রতিবন্ধক না হয়। এতে আরও বোঝা যায় যে, গৃহকর্তা যদি তার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করবে এবং ওই লোকের অনুমতি ছাড়াই উঠে যাবে; যেন লোকটিও বুঝতে পারে। আর যদি গৃহকর্তা নিজে গৃহ থেকে বের হয়ে যায়, তাহলে যাকে প্রবেশের অনুমতি প্রদান করা হয়েছিল, সে নতুন অনুমতি ব্যতীত সেখানে অবস্থান করতে পারবে না। আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক জ্ঞাত।’৫৩
ইবনে হাজার ﷺ আরও বলেন :
‘ইবনে মারদাওয়াইহ ইবনে আব্বাস ﷺ-এর হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, “জনৈক লোক নবিজি ﷺ-এর নিকট প্রবেশ করল। সে নিজের অবস্থানে দীর্ঘ করল। ফলে নবিজি ﷺ তিনবার তার থেকে বের হলেন; যেন সে বের হয়ে যায়। কিন্তু লোকটি তা করল না। এরপর উমর ﷺ প্রবেশ করে রাসুল ﷺ-এর চেহারায় বিরক্তি দেখে বললেন। তখন তিনি লোকটিকে বললেন, “সম্ভবত তুমি নবিজি ﷺ-কে কষ্ট দিয়েছ।” নবিজি ﷺ বললেন, “আমি তোমার উদ্দেশ্যি; যেন সে আমার অনুসরণ করে। কিন্তু সে তা করেনি।”’৫৪ তখন উমর ﷺ বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল, যদি আপনি পর্দা ব্যবহার করতেন। কারণ, আপনার স্ত্রীগণ অন্য সব স্ত্রীর মতো নয়। পর্দা তাদের হৃদয়কে বেশি পবিত্র রাখবে।” তখন পর্দার আয়াত নাজিল হয়।’৫৫
আবু ওরাইহ আল-কারি ﷺ বলেন, রাসুল ﷺ বলেছেন :
مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ جَائِزَتَهُ يَوْمٌ وَلَيْلَةٌ، وَالضِّيَافَةُ ثَلَاثَةُ أَيَّامٍ، فَمَا بَعْدَ ذَلِكَ فَهُوَ صَدَقَةٌ، وَلَا يَحِلُّ لَهُ أَنْ يَثْوِيَ عِنْدَهُ حَتَّى يُحْرِجَهُ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে। মেহমানের প্রাপ্য হলো একদিন ও একরাত (ভালোভাবে মেহমানদারি করা)। আর তিন দিন সাধারণ মেহমানদারি। আর তার চেয়ে অধিক হলো তা হলো সদকা। মেজবানকে কষ্ট দিয়ে তার কাছে মেহমানের অবস্থান করা বৈধ নয়।’৫৬
ইবনে হাজার ﷺ বলেন :
‘(حَتَّى يُحْرِجَهُ) শব্দটি الحَرَج থেকে গঠিত হয়েছে, এর অর্থ হলো সংকীর্ণ অবস্থান করা। ইমাম খাত্তাবি ﷺ সহিহ মুসলিমের এক বর্ণনায় উল্লেখ করেন : (حَتَّى يُؤْثِمَهُ) অর্থাৎ তাকে গুনাহে পতিত করে; কারণ, তার দীর্ঘ অবস্থানের ফলে মেজবান তার গিবত করতে পারে বা তাকে কষ্ট দেবে এমন কোনো বিষয় তার সামনে নিয়ে আসতে পারে অথবা তার ব্যাপারে মেজবান মন্দ ধারণা করতে পারে। এ সবগুলো তখনই প্রযোজ্য হবে, যখন গৃহকর্তার অবস্থান ব্যাপারে অনুমতি না থাকবে; যে ক্ষেত্রে আগন্তুক বেশি অবস্থানের চেয়ে নেয়া বা তার ধারণায় প্রবল হবে যে, মেজবান এটি অপছন্দ করবে না, সেটি ভিন্ন বিষয়। আর এটি বোঝা যায় এ কথা থেকে : (حَتَّى يُخْرِجَهُ) “যতক্ষণ না তাকে কষ্ট ফেলে দেয়।” কারণ, এ থেকে বোঝা যায় যে, যখন সমস্যা কেটে যাবে, তখন অবস্থান জায়েজ হবে। ইবনে বাত্তাল ﷺ বলেন, “তার (মেহমানের) জন্য তিন দিন অবস্থানের পর থাকাটি অপছন্দনীয় করা হয়েছে; যেন প্রতিদান পাওয়ার পর সে মেজবানকে কষ্ট না দেয় এবং তাকে গুনাহে লিপ্ত না করে।”’৫৭

টিকাঃ
৩৫. সূরা আর-রহমান, ৫৫ : ৬০।
৩৬. আল-ইলাম লি ইবনিল মুলাক্কিন : ৬/৪২০।
৩৭. সহিহুল বুখারি : ১৮২৫।
৩৮. ফাতহুল বারি : ৪/৩৪।
৩৯. আল-ইলাম লি ইবনিল মুলাক্কিন : ৬/৪১৯।
৪০. সহিহুল বুখারি : ৩৭৬৮, সহিহু মুসলিম : ২০৫৪।
৪১. শুআবুল ইমান : ৯১৫৪।
৪২. সহিহু মুসলিম : ২০৩৮।
৪৩. সহিহুল বুখারি : ৬১৩৮।
৪৪. শারহুন নববি আলা মুসলিম : ১৩/২১৩-২১৫।
৪৫. মুসনাদু আহমাদ : ১৬৩৮৪।
৪৬. আবদুল মালেক : ১/১৬৪ (ঈষৎ পরিবর্তিত)।
৪৭. মুসনাদু আহমাদ : ৯৭৯৩, সুনানু আবি দাউদ : ৪৯৩১।
৪৮. ফাতহুল বারি : ১১/৮৫।
৪৯. আল-মুগনি আন হামলিল আসফার : ৫৩২১।
৫০. সহিহুল বুখারি : ৫১৬৪, সহিহু মুসলিম : ১৪২৮।
৫১. সহিহুল বুখারি : ৫১৬৩।
৫২. ফাতহুল বারি : ৯/২২৮।
৫৩. ফাতহুল বারি : ১১/৮৫।
৫৪. আল-মুজামুল আওসাত : ৬৬২১।
৫৫. ফাতহুল বারি : ৯/৩৪১।
৫৬. সহিহুল বুখারি : ৬১৩৫।
৫৭. ফাতহুল বারি : ১০/৫৫০।

লিঙ্ক শেয়ার করুন
close

লিঙ্ক কপি করুন