📄 ভূমিকা
আলহামদু লিল্লাহি রব্বিল আলামিন, ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আলা আশরাফিল আম্বিয়ায়ে ওয়াল মুরসালিন, নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদ ওয়ালা আলিহি ওয়া সাহবিহি আজমাইন।
ইসলাম মানুষের সাথে ভালো আচরণ এবং তাদের সাথে কোমলতার সাথে общения করে। ইসলামের সুমহান নীতি ও আদর্শ মানুষের অনুভূতি ও চিন্তাধারার প্রতি লক্ষ রাখার কথা বলে। এ কারণেই তো প্রতিটি সদস্যের মাঝে সামগ্রিক সম্পর্কের ব্যাপারে ইসলাম গুরুত্ব দিয়েছে এবং তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো স্পষ্ট করে দিয়েছে। উত্তম আচরণ ও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে উত্তম ভাষা নির্বাচনের আদেশ করেছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا
‘আর মানুষের সাথে ভালো কথা বলবে।’১
আল্লাহ তাআলা এটিকে সেই হিকমতের অন্তর্ভুক্ত করেছেন—যাকে তা দেওয়া হয়েছে, তাকে অনেক কল্যাণ দান করা হয়েছে। পক্ষান্তরে কঠোরতা ও রূঢ়তা এবং অন্যদের কষ্ট প্রদানের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।
এই কিতাব কিতাবুল্লাহ, রাসুল ﷺ-এর সুন্নাহ ও সালাফে সালেহিন থেকে বর্ণিত কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে উপকারী ইলম, নেক আমল এবং তাঁর পছন্দনীয় ও সন্তুষ্টিজনক বিষয়ে তাওফিক প্রার্থনা করছি। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক তাঁর বান্দা ও রাসুল আমাদের প্রিয় নবি মুহাম্মাদ ﷺ-এর ওপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সঙ্গী-সাথিদের ওপর।
- শাইখ মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ
টিকাঃ
১. সূরা আল-বাকারাহ, ২ : ৮৩।
📄 মানুষের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা
নবিদের চারিত্রিক গুণাবলির মধ্যে অন্যতম হলো, মানুষের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা। যেমন আল্লাহ তাআলা তাঁর নবি ﷺ-কে বলেন :
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللَّهِ لِنتَ لَهُمْ ۖ وَلَوْ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ ۖ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ ۖ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ
‘আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন। পক্ষান্তরে আপনি যদি রূঢ় ও কঠিন হৃদয় হতেন, তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য মাগফিরাত কামনা করুন এবং কাজ-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোনো কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদের ভালোবাসেন।’২
আল-কাসিম ﷺ বলেন : (فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللَّهِ لِنتَ لَهُمْ) ‘আল্লাহর রহমতে আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন।’ অর্থাৎ সকল মুমিনের জন্য; যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন (بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ) : ‘মুমিনদের প্রতি তিনি স্নেহশীল দয়াময়।’৩
(وَلَوْ كُنتَ فَظًّا) ‘যদি আপনি রূঢ় হতেন।’ অর্থাৎ মন্দ চরিত্র ও শক্ত কথার অধিকারী হতেন। (غَلِيظَ الْقَلْبِ) ‘কঠিন হৃদয়ের অধিকারী’ অর্থাৎ শক্ত ও কঠিন হৃদয়ের অধিকারী। তাদের সাথে কঠোর রূঢ় আচরণ করা। (لَانفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ) তখন তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। (مِنْ حَوْلِكَ) ‘আপনার কাছ থেকে।’ ফলে আপনার কাছে প্রশান্তি পেত না। আর আপনার দায়িত্বও পূর্ণতা পেত না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা আপনাকে সহজ, সুমহান, কোমল, সুন্দর, দয়াবান, নেককার, স্নেহশীল ও দয়াময় হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। (فَاعْفُ عَنْهُمْ) ‘কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন।’ অর্থাৎ আপনার অধিকারের ক্ষেত্রে তারা যে সীমালঙ্ঘন করেছে, তা আপনি ক্ষমা করে দিন, যেমন আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করে দিয়েছেন। (وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ) ‘এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।’ তাদের প্রতি দয়ার পূর্ণতা প্রদান হিসেবে। (وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ) ‘এবং কাজ-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন।’ অর্থাৎ তাদের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে, তাদের অন্তরের প্রশান্তিস্বরূপ এবং তাদের মতামত প্রকাশ করার অধিকার দিয়ে আপনি তাদের সাথে যুদ্ধ ও অন্যান্য বিষয়ে পরামর্শ করুন... অনেক তাফসিরকারক বলেন, ‘আয়াতের ফলাফল হলো, উত্তম চরিত্রকে আঁকড়ে ধরা আবশ্যক।’৪
বিশেষ করে যারা আল্লাহর দ্বীনের দিকে দাওয়াত দেবে এবং সৎকাজের আদেশ করবে তাদের জন্য।’৫
ইমাম আস-সাদি ﷺ বলেন :
‘...দ্বীনি ক্ষেত্রে নেওয়ার উত্তম চরিত্র মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের দিকে আকৃষ্ট করে এবং বিশেষ ভালোবাসার সাথে তাদেরকে তার প্রতি অনুরাगित করে। আর দ্বীনি ক্ষেত্রে নেওয়ার মন্দ চরিত্র মানুষকে নিন্দা ও বিশেষ শাস্তির সাথে তার প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে দেয়। এই নিন্দার ব্যাপারে রাসুলের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলার প্রয়োজন বলেছেন। তাহলে অন্যদের ক্ষেত্রে কী হবে? এটি কি সবচেয়ে বড় আবশ্যকীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় যে, তাঁর মহান চরিত্রের অনুসরণ করা হবে? তিনি আল্লাহর আদেশের ওপর আমল করে এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট করতে মানুষের সাথে যে কোমল ভাষা ও উত্তম আচরণ করেছেন, সে অনুযায়ী তাদের সাথে আচরণ করা হবে?’৬
সকল নবির চারিত্রিক গুণাবলি আমাদের নবি ﷺ-এর অনুরূপই পাই। যেমন আল্লাহর নবি ইউসুফ ﷺ-এর ভাইদের ব্যাপারে তাঁর অবস্থান দেখতে পাই, যখন তারা নিজেদের অপরাধের স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেছিল :
تَاللَّهِ لَقَدْ آثَرَكَ اللَّهُ عَلَيْنَا وَإِن كُنَّا لَخَاطِئِينَ
‘আল্লাহর কসম, অবশ্যই আল্লাহ তোমাকে আমাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং নিশ্চয় আমরা অপরাধী ছিলাম।’৬
আল্লাহ তাআলা তাঁকে ক্ষমতা দান করার পর যখন তাঁর পরিবার তাঁর কাছে জড়ো হলো, তখন তিনি তাদের অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এবং খুব দ্রুত (এমন হয়েছে যে,) :
وَرَفَعَ أَبَوَيْهِ عَلَى الْعَرْشِ وَخَرُّوا لَهُ سُجَّدًا ۖ وَقَالَ يَا أَبَتِ هَٰذَا تَأْوِيلُ رُؤْيَايَ مِن قَبْلُ قَدْ جَعَلَهَا رَبِّي حَقًّا ۖ وَقَدْ أَحْسَنَ بِي إِذْ أَخْرَجَنِي مِنَ السِّجْنِ وَجَاءَ بِكُم مِّنَ الْبَدْوِ مِن بَعْدِ أَن نَّزَغَ الشَّيْطَانُ بَيْنِي وَبَيْنَ إِخْوَتِي ۚ إِنَّ رَبِّي لَطِيفٌ لِّمَا يَشَاءُ ۚ إِنَّهُ هُوَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ
‘আর তিনি তার পিতামাতাকে সিংহাসনের ওপর বসালেন এবং তারা সবাই তার সামনে সিজদাবনত হলো। তিনি বললেন, “পিতা, এ হচ্ছে আমার ইতিপূর্বেকার স্বপ্নের বর্ণনা, আমার পালনকর্তা একে সত্যে পরিণত করেছেন এবং তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আমাকে জেল থেকে বের করেছেন এবং আপনাদেরকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছেন, শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করে দেওয়ার পর। আমার পালনকর্তা যা ইচ্ছা করেন, তা সূক্ষ্ম উপায়ে বাস্তবায়ন করে থাকেন। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’৭
ইবনুল কায়্যিম ﷺ বলেন :
‘এখানে তিনি এ কথা বললেন না যে, আল্লাহ আমাকে কূপ থেকে বের করেছেন; এটি করেছেন ভাইদের প্রতি অনুগ্রহ করার জন্য এবং তাদের প্রতি এই ইহসান করার জন্য যে, তিনি কূপ নিক্ষেপের মাঝে যা হয়েছে, তার মাধ্যমে তাদের লজ্জিত করেননি। তিনি বলেন, (وَجَاءَ بِكُم مِّنَ الْبَدْوِ) “এবং আপনাদেরকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছেন।” তিনি তাদের প্রতি লক্ষ রেখে এ কথা বললেন না যে, ক্ষুধা ও প্রয়োজনের তীব্রতা তোমাদের নিয়ে এসেছে। তিনি এখানে যা ঘটেছে, তার কারণটি শয়তানের দিকে সম্পৃক্ত করেছেন, সরাসরি তাদের দিকে সম্পৃক্ত করেননি; যদিও সরাসরি ক্রিয়া সম্পাদনকারী কারণ হিসেবে উল্লেখ হওয়ার অধিক নিকটবর্তী। তিনি বললেন, (مِن بَعْدِ أَن نَّزَغَ الشَّيْطَانُ بَيْنِي وَبَيْنَ إِخْوَتِي) “শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করে দেওয়ার পর।” তিনি উদারতা, দয়া এবং তাদের হক আদায় করেছিলেন। এ ধরনের পরিপূর্ণ গুণ শুধু নবি-রাসুলগণই অর্জন করতে পারেন। আল্লাহ তাআলা তাঁদের ওপর শান্তি ও রহমত বর্ষণ করুন।’৮
ইমাম সাদি ﷺ বলেন :
‘এটি ইউসুফ ﷺ-এর উদারতা এবং সুন্দর সম্বোধনের অংশ যে, তিনি জেলের অবস্থা তুলে ধরেছেন; কিন্তু কূপে নিক্ষেপের অবস্থার কথা বলেননি। কারণ, তিনি তাঁর ভাইদের পরিপূর্ণ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তাই তিনি আর সে অপরাধের কথা আলোচনা করেননি। আর গ্রাম থেকে তোমাদের এখানে আসা আমার প্রতি আল্লাহর তাআলার করুণা। ফলে তিনি বলেননি, ক্ষুধা ও ক্লান্তি তোমাদের নিয়ে এসেছে। এ কথাও বললেন না যে, আমি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছি। বরং তিনি বলেছেন, (أَحْسَنَ بِي) “তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন।” অনুগ্রহ-দানকে তিনি আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করেছেন। কতই না মহান সে সত্তা, যিনি নিজ বান্দাদের থেকে যাকে চান, নিজের রহমতের মাধ্যমে বিশেষায়িত করেন। (مِن بَعْدِ أَن نَّزَغَ) তিনি এ কথা বললেন না যে, শয়তান আমার ভাইদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করে দেওয়ার পর।” তিনি এ কথা বললেন যে, শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করেছে। বরং তিনি অপরাধ ও অজ্ঞতাকে উভয় দিকেই সম্পৃক্ত করেছেন।’৯
সম্মানিতের ছেলে সম্মানিতর ছেলে সম্মানিতর ছেলে সম্মানিতর ছেলে এই মহান অবস্থানে আমাদের সামনে নবি-রাসুল এবং আল্লাহর বিশেষ নির্বাচিত বান্দাদের সম্মান চরিত্রের বিশালতা বর্ণনা করে দেয়। হে আল্লাহ, আমাদেরকে আপনার এ বান্দাদের অনুসরণের তাওফিক দান করুন :
أُولَٰئِكَ الَّذِينَ هَدَى اللَّهُ ۖ فَبِهُدَاهُمُ اقْتَدِهْ
‘এরাই তাঁরা, যাঁদেরকে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেছেন। সুতরাং তুমি তাঁদের পথনির্দেশনা অনুসরণ করো।’১০
টিকাঃ
২. সূরা আলি ইমরান, ৩ : ১৫৯।
৩. সূরা আত-তাওবা, ৯ : ১২৮।
৪. তাফসিরে কাসিম : ৪/২৭৬।
৫. তাফসিরে সাদি : ১৫৪।
৬. সূরা ইউসুফ, ১২ : ৯১।
৭. সূরা ইউসুফ, ১২ : ১০০।
৮. মাআরিজুস সালিকিন : ২/৩৮০-৮১ (ঈষৎ পরিবর্তিত)।
৯. তাফসিরে সাদি : ৪০৫।
১০. সূরা আল-আনআম, ৬ : ৯০।
📄 মানুষের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখার কিছু বাস্তব চিত্র
ইসলাম মানুষের অনুভূতি, তাদের অবস্থা ও মানসিকতার হিফাজতকে অনেক গুরুত্ব দিয়েছে। নবিজি ﷺ-এর নিম্ন বর্ণিত সুন্নাহসমূহ এই গুরুত্বর বিষয়টি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে :
📄 প্রথমত, মজলিশে মুসলিমের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা
১. মজলিশে বসে চুপে চুপে আলাপকারী বা আলোচনাকারীদের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা
ইসলামি শিষ্টাচারসমূহের একটি হলো, যখন কোথাও দুই বা ততোধিক ব্যক্তি মিলে বসে আলোচনা করে, তখন সেখানে অন্য কেউ প্রবেশ করতে হলে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করবে; কারণ, আলোচনাকারীদের কোনো গোপন কথা থাকতে পারে, যা আগন্তুককে জানানো তাদের পছন্দনীয় নয় অথবা তার কারণে হয়তো তারা চুপ হয়ে যেতে বা কথার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে। ফলে তার অনুপ্রবেশ তাদের জন্য কষ্টকর হবে। এখানে প্রবেশের উপযুক্ত শিষ্টাচার হলো, অনুমতি চাওয়া; যাতে সে শান্ত লাভ করতে পারে এবং তার আগমনে আনন্দিত হয়।
সাইদ আল-মাকবুরি ﷺ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘ইবনে উমর ﷺ জনৈক লোকের সাথে কথা বলছিলেন। এমন সময় আমি তাঁদের মাঝে প্রবেশ করলাম। তখন তিনি আমার বুকে আঘাত করে বললেন, “তুমি কি জানো না যে, রাসুল ﷺ বলেছেন :
إِذَا تَنَاجَى اثْنَانِ فَلَا تَجْلِسْ إِلَيْهِمَا حَتَّى تَسْتَأْذِنَهُمَا
“যখন দুজন ব্যক্তি একান্তে কথা বলবে, তখন তাদের নিকট বসবে না; যতক্ষণ না তাদের অনুমতি নাও।”’১১
এর কাছাকাছি আরেকটি আদব হলো, পাশাপাশি উপবিষ্ট দুই ব্যক্তির মাঝে তাদের অনুমতি ব্যতীত পার্থক্য করবে না। আব্দুল্লাহ বিন উমর ﷺ থেকে বর্ণিত, নবিজি ﷺ বলেছেন :
لَا يَحِلُّ لِلرَّجُلِ أَنْ يُفَرِّقَ بَيْنَ اثْنَيْنِ إِلَّا بِإِذْنِهِمَا
‘ কারও জন্য দুই ব্যক্তির মাঝে তাদের অনুমতি ব্যতীত পার্থক্য করা বৈধ হবে না।’১২
(بَيْنَ اثْنَيْنِ) অর্থাৎ তাদের দুজনের মাঝে বসে পার্থক্য করবে না। (إِلَّا بِإِذْنِهِمَا) তাদের অনুমতি ব্যতীত; কারণ, অনেক সময় তাদের মাঝে মহব্বত ও হৃদ্যতা থাকতে পারে অথবা গোপন কোনো কথাবার্তা বা আমানতের সম্পর্ক থাকতে পারে। এখন ওই লোকের মাঝখানে বসে পড়ার কারণে তাদের জন্য বিষয়টি কঠিন হয়ে যাবে।১৩
২. গোপন আলোচনার ক্ষেত্রে উপস্থিত লোকের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা
ইসলাম একই মজলিশে দুজন পৃথক হয়ে অন্যজনকে ছেড়ে গোপন আলাপ করতে বারণ করেছে। যদিও এই আলোচনা কোনো কল্যাণকর বা নেক বিষয়ে হয়ে থাকে; কারণ, এতে তাদের সাথে যে লোকটিকে শরিক করা হয়নি, তাকে চিন্তায় ফেলে দেওয়া হয়। সে ধারণা করতে পারে যে, তারা দুজন তার এমন কোনো বিষয়ে আলোচনা করছে, যা আলোচনা করা তার পছন্দনীয় নয়। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ ﷺ থেকে বর্ণিত, রাসুল ﷺ বলেছেন :
إِذَا كُنْتُمْ ثَلَاثَةً فَلَا يَتَنَاجَى اثْنَانِ دُونَ الْآخَرِ حَتَّى تَخْتَلِطُوا بِالنَّاسِ مِنْ أَجْلِ أَنْ يُحْزِنَهُ
‘যখন তোমরা তিনজন (একত্র) হও, তখন দুজন ব্যক্তি অপরজনকে বাদ দিয়ে চুপিচুপি কথা বলবে না, যে পর্যন্ত না অন্য ব্যক্তিদের সঙ্গে মিশে যাও; এ কারণে যে, তাহলে তাকে দুঃখবানায় ফেলে দেবে।’১৪
ইমাম নববি ﷺ বলেন, ‘এই নিষেধাজ্ঞা হারামের নিষেধাজ্ঞা। সুতরাং দলের কোনো সদস্যকে বাদ দিয়ে অন্যদের চুপিচুপে আলাপ হারাম; যদি না ওই সদস্য এর অনুমতি দেয়।’১৫
ইবনে হাজার ﷺ বলেন, ‘(حَتَّى تَخْتَلِطُوا بِالنَّاسِ) “যে পর্যন্ত না অন্য ব্যক্তিদের সঙ্গে মিশে যাও;” অর্থাৎ এই তিনজন অন্যের সাথে মিলিত হয়। আর অন্য লোক একজনও হতে পারে অথবা একাধিকও হতে পারে। এ থেকে বোঝা যায় যে, যখন চারজন লোক একত্রিত হবে, তখন দুজনের গোপনে আলাপ নিষিদ্ধ নয়; কারণ, এখানে অন্য দুজন গোপনে আলাপ করার সুযোগ রয়েছে। আর এটি ইমাম বুখারির আল-আদাবুল মুফরাদ কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ইমাম দাউদও এটি স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন। ইবনে উমর ﷺ থেকে আর সালেহ ﷺ-এর সূত্রে ইবনে হিব্বান ﷺ হাদিসটিকে সহিহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
আলি সালেহ বলেন, “আমি বললাম, “যদি তারা চারজন হয়?” ইবনে উমর ﷺ বললেন, “কোনো সমস্যা নেই।”’
আব্দুল্লাহ বিন দিনার ﷺ থেকে ইমাম মালিক ﷺ বর্ণনা করেন :
“ইবনে উমর ﷺ যখন কোনো লোকের সাথে গোপনে আলোচনা করতে চাইতেন এবং তাঁরা তিনজন থাকতেন, তখন চতুর্থ একজনকে ডেকে আনতেন। তারপর তাদের দুজনকে বলতেন, “তোমরা সামান্য আরাম করো; কারণ, আমি শুনেছি...” তিনি হাদিসটি উল্লেখ করেন।”
(مِنْ أَجْلِ أَنْ يُحْزِنَهُ) “এ কারণে যে, তাহলে তাকে দুঃখবানায় ফেলে দেবে।” তিনি বলেন, তাকে দুঃখবানায় ফেলে দেবে। কারণ, সে ধারণা করবে যে, তাদের দুজনের গোপন আলাপ তার ব্যাপারে মন্দ কোনো বিষয়ে অথবা তার প্রতি বিদ্বেষবশত তাকে এড়িয়ে কথা বলা হচ্ছে।
এথেকে বোঝা যায় যে, যখন গোপন আলাপকারী আলাপের জন্য বিশেষ কাউকে নির্দিষ্ট করে নিলে অন্যায় দৃষ্টিতে পড়ে যাবে, তখন তা থেকে বিরত থাকতে হবে। যদি দ্বীনি জরুরি কোনো বিষয়ে হয়, তাহলে ভিন্ন কথা।
ইমাম মাজিরি ﷺ ও তার মতো আরও অনেকে বলেছেন, “একজনকে বাদ দিয়ে দুজনের কথা বলা বা একদল লোকের কথা বলার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।” ইমাম কুরতুবি ﷺ আরও বাড়িয়ে বলেছেন, “আর একজনকে বাদ দিয়ে আরও বেশি সংখ্যক লোকের গোপন আলাপ আরও কঠিন ও ভয়ানক। সুতরাং এখানে নিষেধের বিষয়টি আরও উত্তমভাবে প্রযোজ্য হবে। তবে হাদিসে তিনজনের আলোচনা করা হয়েছে; কারণ, সর্বপ্রথম যে সংখ্যায় উক্ত অর্থ (দুঃখবানায় পড়া) পাওয়া যাবে, সেটি হলো তিন। সুতরাং যেখানেই এই অর্থ পাওয়া যাবে, সেখানেই হুকুম প্রযোজ্য হবে।”
ইবানে বাত্তাল ﷺ বলেন, “একজনকে বাদ দিয়ে বাকিদের আলোচনার দল যত বড় হবে, পেরেশানির বিষয়টি তত বেশি হবে এবং তোমাদের উপস্থিত থাকতে এখানে আরও উত্তমভাবে হারামের বিষয়টি সংযুক্ত হবে।”১৬
ইমাম খাত্তাবি ﷺ বলেন, ‘(তার ধারণার কারণে) সেটি তাকে দুঃখবানায় ফেলে দেবে। আর এটি তাকে বাদ দিয়ে অন্যকে সম্মানের সাথে বিশেষায়িত করা হবে।’১৭
রিয়াযুস সালেহিন এবং ইবনে আল্লানের ব্যাখ্যাগ্রন্থে উল্লেখ আছে, ‘প্রয়োজন ছাড়া অনুমতিতে তৃতীয়জনকে ছেড়ে দুজনের গোপন আলাপ নিষেধের অধ্যায়। অবশ্য যদি প্রয়োজন থাকে, তাহলে বলা যাবে। কারণ, তখন তাদের দুজনের অনুযায়ী অকল্যাণের ওপর কল্যাণকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। তাদের দুজনের ভিন্ন ভাষায় কথা বলা—যা তৃতীয়জন বোঝে না—এটাও গোপন আলাপের অন্তর্ভুক্ত হবে।’১৮
৩. কেউ কোথাও বসার পর তাকে তার বসার স্থান থেকে সরিয়ে সেখানে না বসা; বরং তার অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা
যে যেখানে বসেছে, সে-ই সেখানে বসার ব্যাপারে অন্যদের তুলনায় অধিক হকদার। তাকে সেখান থেকে উঠিয়ে দেওয়ার অধিকার কারও নেই। এটি একটি ইসলামি আদব, যার লক্ষ্য হলো, আসনের মালিকের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা। সে আগে বসার কারণে সে-ই স্থানকার বেশি হকদার।
আর নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর হবে, যখন কেউ তাকে তার স্থান থেকে এই মনে করে সরিয়ে দেবে যে, ওই ব্যক্তির ওপর তার শ্রেষ্ঠত্ব বেশি।
এই হুকুম বিষয়টি ব্যাপকভাবে সব মজলিশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে ইবাদত ও আমলের মজলিশগুলোতে এটি বেশি অধিকারযোগ্য। কারণ, ইসলাম কল্যাণের কাজে দ্রুত ছুটে যাওয়া, সালাতে সবার আগে উপস্থিত হওয়া, একতাবদ্ধ হওয়া ও জামাতের প্রতি উৎসাহিত করেছে। সুতরাং কেউ যখন কোনো স্থানে অন্যদের আগে উপস্থিত হয়, তখন অন্য কারও জন্য তাকে উঠিয়ে দেওয়ার অধিকার নেই। তারপরেও তাকে উঠিয়ে দিয়ে সেখানে বসবে, সে যেন নষ্ট চেহারা ও নষ্ট পরিমাপযন্ত্র সংগ্রহ করেছে।’১৯
আবুল খাসিব থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি বসা ছিলাম। এমতাবস্থায় ইবনে উমর ﷺ আসলেন। মজলিশের এক লোক তাঁর জন্য উঠে গেলেন। কিন্তু ইবনে উমর ﷺ সেখানে না বসে অন্য এক স্থানে বসলেন। লোকটি বলল, “যদি আপনি এখানে আসতেন, তাহলে কী সমস্যা ছিল?” তিনি বললেন, “যা আমি রাসুল ﷺ-এর থেকে দেখেছি, তা দেখার পর আমি কোনো স্থান বা অন্য কারও স্থানে বসতে পারি না : এক লোক রাসুল ﷺ-এর নিকট অন্য লোকের জন্য তার স্থান হতে উঠে দাঁড়াল। সে সেখানে বসার জন্য যেতে থাকলে নবিজি ﷺ তাকে বারণ করলেন।”’২০
ইবনে উমর ﷺ থেকে বর্ণিত, নবিজি ﷺ বলেন :
لَا يُقِيمُ الرَّجُلُ الرَّجُلَ مِنْ مَقْعَدِهِ، ثُمَّ يَجْلِسُ فِيهِ وَلَكِنْ تَفَسَّحُوا وَتَوَسَّعُوا
‘কোনো ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে তার বসার স্থান থেকে উঠিয়ে দিয়ে সেখানে বসবে না। বরং তোমরা (অন্যের) প্রশস্ত করে দাও, জায়গা বিস্তার করে দাও।’
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে :
‘আমি বললাম, (فِي يَوْمِ الْجُمُعَةِ) “জুমার দিনে?” তিনি বললেন, (فِي يَوْمِ الْجُمُعَةِ وَغَيْرِهَا) “জুমার দিনে এবং অন্য দিনে।”’
ইবনে উমর ﷺ-এর জন্য কেউ যখন মজলিশ থেকে উঠে জায়গা করে দিত, তখন তিনি সেখানে বসতেন না।২১
আবু হুরাইরা ﷺ থেকে বর্ণিত, রাসুল ﷺ বলেন :
لَا يُقِيمُ الرَّجُلُ الرَّجُلَ مِنْ مَجْلِسِهِ، وَلَكِنِ افْسَحُوا يَفْسَحِ اللَّهُ لَكُمْ
‘কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তির জন্য তার বসার জায়গা থেকে দাঁড়াবে না। তবে তোমরা জায়গা প্রশস্ত করে দাও, আল্লাহ তোমাদের জন্য প্রশস্ত করে দেবেন।’২২
আলবানি ﷺ এই হাদিসের ব্যাপারে বলেন, ‘বাহ্যিকভাবে এটাই বোঝা যায় যে, এটি ইসলামি শিষ্টাচার নয় যে, কেউ তার বসার স্থান থেকে উঠে যাবে; যেন সেখানে অন্য কেউ বসতে পারে। মানুষ এমনটি করে সম্মান দেখিয়ে। এ ধরনের অবস্থা নবিজি ﷺ-এর নির্দেশনার বিপরীত। নবিজি ﷺ এ কথা থেকে সর্বনিম্ন মাকরুহ বোঝা যায় : (...) لَا يَقُومُ الرَّجُلُ لِلرَّجُلِ مِنْ مَجْلِسِهِ ‘ (কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তির জন্য তার বসার জায়গা থেকে দাঁড়াবে না।)’ কারণ, এটি নফি (নেতিবাচক)—নিষেধের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে মূল হলো হারাম, মাকরুহ নয়। তবে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক ভালো জানেন।২৩
৪. অধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তির অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা, যখন মজলিশে সে নিজের স্থানে ফিরে আসবে
ইসলাম অধিকারওয়ালাকে বর্ণনা দিয়ে তা তার প্রাপকের জন্য সংরক্ষণ করেছে। যেন মতানৈক্য সৃষ্টি না হয় এবং কেউ নিজের অনধিকার চর্চা না করে। আর এর ফলে কোনো হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি না হয়।
এ রকম একটি ব্যাপার হলো, জায়গার ব্যাপার। যখন কেউ কোনো সাধারণ স্থানে আগে এসে বসবে, তখন সে-ই স্থানের বেশি হকদার। তারপর যদি সে কোনো প্রয়োজনে সেখান থেকে উঠে যায় এবং পুনরায় সেখানে ফিরে আসে, তাহলে সে স্থানের ব্যাপারে সে-ই বেশি হকদার। যে স্থানে বসেছে, তার জন্য সেখান থেকে উঠে যাওয়া আবশ্যক।
তবে উত্তম হলো, সে স্থানে উপস্থিত ব্যক্তি সেখানে এমন কোনো প্রমাণ বা নিদর্শন রেখে যাবে যে, এটি তার আসন; যেন এর মাধ্যমে ঝগড়া বা বিবাদের পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়।
আবু হুরাইরা ﷺ থেকে বর্ণিত, নবিজি ﷺ বলেছেন :
إِذَا قَامَ أَحَدُكُمْ مِنْ مَجْلِسِهِ، ثُمَّ رَجَعَ إِلَيْهِ فَهُوَ أَحَقُّ بِهِ
‘যখন তোমাদের কেউ নিজের বসার স্থান থেকে উঠে যায়, তারপর সেখানে ফিরে আসে, তাহলে সে-ই সে স্থানের (বসার) অধিক হকদার।’২৪
এটি এমন একটি মাসআলা, যার ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষ উদাসীন; বিশেষ করে যখন সভার স্থান সংকীর্ণ হয় তখন।
৫. মজলিশে বড়দের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা এবং তাদের সম্মান ও কথা বলার ইত্যাদির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া
এটি ইসলামের একটি বড় শিষ্টাচার যে, বড়দের আগে ছোটরা কথা বলবে না। বরং ছোটরা যদি বড়দের কথা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করে, তাহলে এটিকে উত্তম আচরণ হিসেবে গণনা করা হয়।
টিকাঃ
১১. মুসনাদু আহমাদ : ৫৯৪৯।
১২. সুনানুত তিরমিজি : ২৭৫২।
১৩. আব্দুল মালেক : ১০/১০৩।
১৪. সহিহুল বুখারি : ৬২৯০, সহিহু মুসলিম : ২১৮৪।
১৫. শারহুন নববি আলা মুসলিম : ১৪/১৬৭।
১৬. ফাতহুল বারি : ১১/৮৬।
১৭. মাআলিমুস সুনান : ৪/১১৭ (ঈষৎ পরিবর্তিত)।
১৮. শারহু ইবনি আল্লান : ৮/১০৫।
১৯. আদাবুল কুবরা : ৩১৬ পৃ.।
২০. মুসনাদু আহমাদ : ৫৫৬৭, সুনানু আবি দাউদ : ৪৮২৮।
২১. সহিহু মুসলিম : ২১৭৭।
২২. মুসনাদু আহমাদ : ১০২৬৬।
২৩. মাজমুউ ফাতাওয়াল রাযি : ২২১ পৃ.।
২৪. সহিহু মুসলিম : ২১৭৯।