📄 মৃত অন্তর
এটি এমন এক অন্তর যার কোন প্রাণ নেই। এটি তার রবকে জানে না এবং তার রবের আদেশের প্রতি অনুগত থাকার মাধ্যমে আর রব যা ভালোবাসেন ও যা করলে সন্তুষ্ট হোন সেগুলো করার মাধ্যমে সে রবের ইবাদাত করে না। এর পরিবর্তে এটি এর জাগতিক কামনা-বাসনা, লোভ-লালসা ও আনন্দের গোলাম; এগুলো কি তাদের রবের অসন্তুষ্টি আর ক্রোধের দিকে পরিচালিত করছে কিনা সে ব্যাপারে এটি অমনোযোগী ও উদাসীন। কাজেই এটি আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর ইবাদাত করে; আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর প্রতিই এর ভালোবাসা, আশা, আনন্দ, বিরক্তি, প্রশংসা থাকে আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো প্রতি আত্মসমর্পণ করে। যদি এটি কিছু ভালবাসে তবে সেই ভালোবাসা হয় এর হীন কামনা-বাসনার জন্য, আর যদি কিছু ঘৃণা করে তবে সেটিও হয় এর হীন কামনা-বাসনার জন্য, যদি এটি কিছু প্রদান করে তবে সেটি হয় এর হীন কামনা-বাসনার জন্য, যদি প্রদান করা অস্বীকার করে তবে সেটিও এর হীন কামনা-বাসনার জন্যই। এটি এর হীন কামনা-বাসনাকে অগ্রাধিকার দেয় এবং এর মালিককে সন্তুষ্ট করার চাইতে এগুলোই তার কাছে অধিকতর প্রিয়।
হীন কামনা-বাসনাই হল এর নেতা, জাগতিক কামনা-বাসনা এর সেনাপতি, অজ্ঞতা এর চালিকাশক্তি এবং অমনোযোগিতা হল জাহাজ- যার উপর এটি আরোহণ করে। এটি এর জাগতিক কামনা-বাসনার অনুসরণে সম্পূর্ণভাবে নিমজ্জিত। এর হীন কামনা-বাসনা আর জাগতিক বিষয়গুলোর নেশায় এটি উন্মত্তভাবে পরিচালিত হয়। আল্লাহ ও পরকালের আবাসের আহবান সে বহুদূরবর্তী স্থান থেকে শোনে এবং আন্তরিক উপদেশদাতার প্রতি কোন সাড়া দেয় না। সে প্রতিটি ধূর্ত শয়তানকে অনুসরণ করে এবং দুনিয়াই এর ক্রোধ ও আনন্দের কারন হয়ে থাকে। হীন কামনা-বাসনা একে বধির করে দেয় এবং সেই সাথে মিথ্যা ব্যতীত সব কিছুর প্রতি অন্ধও করে দেয়। এই দুনিয়াতে এটি হল লাইলা সম্পর্কে যা বলা হয়েছিলো তারই অনুরূপ -
যেকোন শত্রুর প্রতি সে দেখায় শত্রুতা
এবং তাদের সাথে চলে যাদের সে পছন্দ করে
সে যে কারোরই নিকটবর্তী হয়
সেও ভালবাসে আর তার নিকটবর্তী হয়।
যে ব্যক্তির এই অন্তর রয়েছে, তার সাথে মেলামেশা করা হল একটি অসুস্থতা, তার সাথে আলাপচারিতা হল বিষ আর তার সাথে বসাটা হল ধংস।
📄 ব্যাধিগ্রস্ত অন্তর
এটি এমন এক অন্তর যাতে প্রাণ রয়েছে আর একই সাথে একটি ত্রুটিও রয়েছে। এর রয়েছে দুটো তাড়না যা একে আহবান করে- একটি তাড়না একে জীবনের দিকে পরিচালিত করে আর অপরটি পরিচালিত করে মৃত্যুর দিকে। এই দুটোর মধ্যে যেটি এর উপর প্রাধান্য বিস্তার করে এটি তারই অনুসরণ করে।
এই অন্তর মহিমান্বিত আল্লাহ'র প্রতি ভালোবাসা, ঈমান, আন্তরিকতা, আস্থা ও নির্ভরতা বহন করে; এই বিষয়গুলো অন্তরের জীবনের জন্য অপরিহার্য।
এই অন্তর এর জাগতিক কামনা-বাসনা আর এগুলোকে পছন্দে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং এগুলো অর্জনের আগ্রহও ধারণ করে। এই অন্তরে আরও রয়েছে হিংসা, দাম্ভিকতা, আত্মঅহংকার আর নেতৃত্ব অর্জনের মাধ্যমে পদমর্যাদা লাভের ব্যাপারে ভালোবাসা- এ বিষয়গুলো অন্তরকে অবধারিতভাবে ধ্বংস ও সর্বনাশের দিকে পরিচালিত করে।
এই অন্তরটিকে প্রতিনিয়তই দুটো আহবানকারীর তাদের দিকে আহবান করার মাধ্যমে চেষ্টা করে যেতে থাকে - এদের মধ্যে একজন আহ্বানকারী আহবান করে আল্লাহ, তার রসুল (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) আর পরকালের আবাসের দিকে; অপরদিকে অন্য আহ্বানকারী একে আহবান করে দ্বীন বিরোধী জাগতিক বিষয়গুলোর দিকে। এই অন্তরটি সে সময়ে এর সবচেয়ে নিকটবর্তী ও সবচেয়ে প্রভাবশালী আহবানকারীর আহবানে সাড়া দেয়।
সুতরাং, প্রথম প্রকারের অন্তর হল জীবিত, নম্র, কোমল, মনোযোগী ও সতর্ক অন্তর। দ্বিতীয় প্রকারের অন্তর হল ভঙ্গুর, শুস্ক ও মৃত অন্তর। তৃতীয় প্রকারের অন্তর হল ব্যাধিগ্রস্ত অন্তর - হয় এটি এর মুক্তির নিকটবর্তী অথবা এর ধ্বংসের নিকটবর্তী।
মহিমান্বিত আল্লাহ এই তিন প্রকার অন্তর সম্পর্কে বলেন,
وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ وَلَا نَبِيٍّ إِلَّا إِذَا تَمَنَّى أَلْقَى الشَّيْطَانُ فِي أَمْنِيَّتِهِ فَيَنسَخُ اللَّهُ مَا يُلْقِي الشَّيْطَانُ ثُمَّ يُحْكِمُ اللَّهُ آيَاتِهِ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ (٥٢) لِّيَجْعَلَ مَا يُلْقِي الشَّيْطَانُ فِتْنَةً لِّلَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ وَالْقَاسِيَةِ قُلُوبُهُمْ ۖ وَإِنَّ الظَّالِمِينَ لَفِي شِقَاقَ بَعِيدٍ (٥٣) وَلِيَعْلَمَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَيُؤْمِنُوا بِهِ فَتُخْبِتَ لَهُ قُلُوبُهُمْ وَإِنَّ اللَّهَ لَهَادِ الَّذِينَ آمَنُوا إِلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ (٥٤)
"আমি তোমার আগে এমন কোন নবী বা রসূল পাঠাইনি (যারা এ ঘটনার সম্মুখীন হয়নি যে) যখন সে (নবী আল্লাহ'র আয়াতসমুহ পড়ার) আগ্রহ প্রকাশ করলো তখন শয়তান তার সে আগ্রহের কাজে (কাফিরদের মনে) সন্দেহ ঢেলে দেয়নি, এরপর আল্লাহ শয়তানদের নিক্ষিপ্ত (সন্দেহগুলো) মিটিয়ে দেন এবং আল্লাহ নিজের আয়াতসমুহকে (আরো) মজবুত করে দেন, আল্লাহ (সবকিছু) জানেন, তিনি হলেন বিজ্ঞ কুশলী। (এর উদ্দেশ্য হল) যেন আল্লাহ (এর মাধ্যমে) শয়তানের প্রক্ষিপ্ত (সন্দেহ)- গুলোকে সেসব মানুষের পরীক্ষার বিষয় বানিয়ে দিতে পারেন, যাদের অন্তরে (আগে থেকেই মুনাফিকির) ব্যাধি আছে, উপরন্তু যারা একান্ত পাষাণ হৃদয়; অবশ্যই এ জালিমরা অনেক মতবিরোধ ও সন্দেহে নিমজ্জিত হয়ে আছে। (এটি এ কারনে,) যাদের (আল্লাহ'র কাছ থেকে) জ্ঞান দেওয়া হয়েছে তারা যেন জানতে পারে, এটিই তোমার রবের পক্ষ থেকে আসা সত্য, এরপর তারা যেন তাতে (পুরোপুরি) ঈমান আনে এবং তাদের মন যেন সে দিকে আরো আকৃষ্ট হয়ে পড়ে, অবশ্যই আল্লাহ ইমানদারদের সঠিক পথে পরিচালিত করেন।” (সূরা হাজ্জ, ২২ : ৫২-৫৪)
এই তিনটি আয়াতে মহিমান্বিত ও গৌরবান্বিত আল্লাহ দুই ধরণের অন্তরকে পরীক্ষা করার এবং এক ধরণের অন্তরকে বিজয়ী করার কথা উল্লেখ করেছেন। যে দুই ধরণের অন্তরকে পরীক্ষা করার ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হল ব্যাধিগ্রস্ত ও বাঁকা অন্তর। বিজয়ী অন্তর হল একজন মুসলিমের অন্তর যেটি তার রবের সামনে নম্র থাকে, এটি তার রবের প্রতি স্থির ও পরিতৃপ্ত এবং বাধ্য ও অনুগত থাকে।
অন্তর ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যাপারে কামনা করা হয় যে এরা সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান থাকবে, এদের থাকবে না কোন ত্রুটি যাতে করে এগুলো তাদের প্রকৃতির সাথে খাপ খায় এমন কাজ করতে পারে এবং যে উদ্দেশ্যে এগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে সে উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে পারে। আল্লাহ'র আনুগত্যে ইস্তিকামা (অটল অবিচল থাকা) করার সীমার বাইরে চলে যাওয়ার কারণটি হতে পারে অন্তরের শুস্কতা ও কঠোরতার কারনে অথবা অন্তরের সম্পর্কে যেটি কামনা করা হয় অন্তরের সেটি করার অভাবে। এক্ষেত্রে এটি হল একটি বাকশক্তিহীন জবান বা অন্ধ চোখ বা আংশিকভাবে দেখতে পায় এমন চোখের মতো, এমনটা ঘটে থাকে কিছু প্রকার ব্যাধি বা ত্রুটির কারনে। এ কারনে অন্তরকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে -
(১) সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান অন্তর - যেটি কোন প্রতিবন্ধক বা অন্তরায় ধারণ করে না যা একে সত্য গ্রহণ করা, সেটিকে ভালোবাসা আর সেটি সম্পর্কে জানার পর এটিকে অন্য কিছু থেকে পছন্দে অগ্রাধিকার দেওয়া থেকে বাধা দিবে। কাজেই এর সত্যের বুঝ সঠিক আর এটি সত্যকে গ্রহণ করে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের সাথে।
(২) মৃত, কঠিন ও শুস্ক অন্তর - যেটি সত্যকে গ্রহণ করে না আর এর প্রতি আত্মসমর্পণও করে না।
(৩) ব্যাধিগ্রস্ত অন্তর - যখন এর ব্যাধি প্রাধান্য বিস্তার করে তখন এটি মৃত ও শুস্ক অন্তরের সারিতে যোগ দেয়, কিন্তু যদি এর সুস্থতা প্রাধান্য বিস্তার করে তবে এটি সত্যনিষ্ঠ ও সুস্থ অন্তরের সারিতে যোগ দেয়।
শয়তানের দ্বারা কোন ব্যক্তির প্রতি যা কিছু পরিচালিত হয়, যেমনঃ নিশ্চিতভাবে কিছু শব্দ শুনিয়ে দেওয়া বা অন্তরের প্রতি কিছু উত্থাপন করা - যেমনঃ সন্দেহ ও ধারণা - এগুলো পরবর্তী দুই ধরণের অন্তরের জন্য পরীক্ষা হিসেবে কাজ করে এবং জীবিত, সত্যনিষ্ঠ ও সুস্থ অন্তরকে অধিকতর শক্তিশালী করে।
কারন জীবিত অন্তর এর সবকিছুই প্রত্যাখ্যান করে, অপছন্দ করে আর এটি দ্বারা রেগে যায়। কারন এই অন্তর জানে যে সত্য এর বিরোধীতা করে। কাজেই সুস্থ অন্তর সত্যের প্রতি আত্মসমর্পণ করে আর সেটি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে। শয়তান যা দিয়ে প্রলুব্ধ করে, সুস্থ অন্তর সেই প্রতারণা সম্পর্কে জানে এবং এ কারনে সত্য সম্পর্কে এর দৃঢ় বিশ্বাস, এর প্রতি ভালোবাসা আর মিথ্যাকে প্রত্যাখ্যান করা বৃদ্ধি পায়।
এরপরেও পরীক্ষায় থাকা অন্তরে শয়তান কর্তৃক তার দিকে নিক্ষেপ করা সন্দেহ ও দ্বন্দ্ব অবশিষ্ট থাকে। অপরদিকে, সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান অন্তর শয়তান কর্তৃক এর প্রতি পরিচালিত কিছু দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
হুযাইফা বিন আল-ইয়ামান বলেছেন যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “চাটাই বুননের মত এক এক করে ফিতনা মানুষের অন্তরে আসতে থাকে। যে অন্তরে তা গেঁথে যায়, তাতে একটি করে কাল দাগ পড়ে। আর যে অন্তর তা প্রত্যাখ্যান করবে, তাতে একটি করে শুভ্রোজ্জ্বল চিহ্ন পড়বে। এমনি করে দুটি অন্তর দুধরনের হয়ে যায়। একটি শ্বেত পাথরের মত; আসমান ও যমীন যতদিন থাকবে ততদিন কোন ফিতনা তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আর অপরটি হযে যায় উল্টানো কাল কলসির মত, প্রবৃত্তি তার মধ্যে যা সেঁধে দিয়েছে তা ছাড়া ভালমন্দ বলতে সে কিছুই চিনে না।” ৬১
সুতরাং, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) পরীক্ষার সূত্রপাতের উপমা দিলেন অন্তরের উপর চাটাই বুননের মতো একটির পর একটি ফিতনা আসতে থাকার বর্ণনা দেওয়ার মাধ্যমে। অন্তর এসব পরীক্ষার প্রতি কিভাবে প্রতিক্রিয়া করে সেটির উপর ভিত্তি করে তিনি (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্তরকে এ দুটো প্রকারে বিভক্ত করেছেন –
(১) এমন এক অন্তর, যেটির প্রতি ফিতনা উন্মোচিত হলে সেটি ফিতনায় অনুপ্রবেশ করে, যেমন করে স্পঞ্জ পানিতে সিক্ত হয়ে যায়। কাজেই এর উপর একটি কালো দাগ হয় আর এটি এই ফিতনাগুলো গ্রহণ করতেই থাকবে এটি পরিপূর্ণভাবে কালো ও বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। এটিই হল হাদিসে বর্ণিত "উল্টানো কাল কলসির মত", যার অর্থ হল বিপর্যস্ত। এরপর যখন এটি কালো ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন এটি প্রদত্ত দুটো ব্যাধির অধিনস্ত হয়ে পড়ে যা একে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয় -
(ক) ভালো ও মন্দ সম্পর্কে এর এমন গোলমাল অবস্থা হয় যে, এটি ভালোটা জানে না আর মন্দটাও প্রত্যাখ্যান করে না। এটিও সম্ভব যে এর ব্যাধি ব্যক্তিকে ভালোকে মন্দ আর মন্দকে ভালো হিসেবে, সুন্নাহকে বিদাআত আর বিদআতকে সুন্নাহ হিসেবে এবং সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য হিসেবে বিশ্বাস করানোর মাধ্যমে প্রতারিত করবে।
(খ) বিচার মীমাংসা চাওয়ার সময় এটি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) যা সহকারে এসেছেন সেটিকে প্রাধান্য দেওয়ার পরিবর্তে তার হীন কামনাকে অগ্রাধিকার দিবে ও সেটির প্রতি নিজেকে সমর্পণ করবে আর সেগুলো অনুসরণ করবে।
(২) সাদা অন্তর ঈমানের আলোয় স্থিরভাবে জ্বলন্ত আর এটি প্রকৃতই আলোকিত হয়। যখন এর প্রতি কোন ফিতনা উপস্থিত হয় তখন এটি তা প্রত্যাখ্যান করে আর এটিকে তাড়িয়ে দেয়, তাই এর আলো, সাদা দাগ আর শক্তি বৃদ্ধি পায়।
অন্তরের প্রতি উপস্থাপিত ফিতনাগুলো এর ব্যাধির কারন। সেগুলো হল জাগতিক কামনা আর সন্দেহের ফিতনা, উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরাফিরা করা আর পথভ্রষ্টটার ফিতনা, পাপ ও বিদআতের ফিতনা এবং জুলুম আর অজ্ঞতার ফিতনা। প্রথম প্রকার ফিতনা (জাগতিক কামনা) পরিচালিত করে কামনা ও উদ্দেশ্যের বিকৃতির দিকে, এবং দ্বিতীয় প্রকার ফিতনা (সন্দেহ) পরিচালিত করে জ্ঞান ও ঈমানের বিকৃতির দিকে।
সাহাবীরা অন্তরকে চারটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন, যেমনটা নির্ভরযোগ্যরূপে বর্ণিত হয়েছে হুযাইফা বিন আল-ইয়ামান (রাঃ) থেকে "চার প্রকারের অন্তর রয়েছে - (১) এমন অন্তর যা কেবলমাত্র আলোকিত হয় একটি উদ্দীপ্ত আলোকদানী দ্বারা, এটি হল একজন মুমিনের অন্তর; (২) এমন অন্তর যা আবৃত অবস্থায় রয়েছে, এটি হল কাফিরের অন্তর; (৩) এমন অন্তর যা বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছে, এটি হল মুনাফিকের অন্তর, সে কেবল প্রত্যাখ্যান করতেই জানতো আর সে কেবল অন্ধ হওয়ার জন্যই দেখতো; (৪) এমন অন্তর যেটির দুটো তাড়নাই রয়েছে, একটি তাড়না একে ঈমানের দিকে আহবান করে আর অপর তাড়না আহবান করে নিফাকের দিকে, এরপর এটি এর অগ্রবর্তী তাড়নার অধীনস্ত হয়ে পড়ে।” ৬২
"এমন অন্তর যা কেবলমাত্র...” - এর অর্থ হল, এটি এমন এক অন্তর যেটি আল্লাহ ও তার রসূল (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাড়া সকল কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে। এ কারনে এটি সত্য ছাড়া সব কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন ও সুরক্ষিত করে রাখে।
"আলোকিত হয় একটি উদ্দীপ্ত আলোকদানী দ্বারা" - এটি দিয়ে প্রকৃত ঈমানকে নির্দেশ করা হয়েছে। "কেবলমাত্র” – দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে এটি মিথ্যা সন্দেহ আর বিভ্রান্ত জাগতিক কামনা থেকে সুরক্ষিত। "একটি উদ্দীপ্ত আলোকদানী” - দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে অন্তরটি জ্ঞান ও ঈমানের আলো দিয়ে স্থিরভাবে প্রজ্জলিত ও আলোকিত হয়েছে।
"আবৃত অন্তর” – দ্বারা কাফিরের অন্তরকে নির্দেশ করা হয়েছে। কারন এটি একটি আবরণ দ্বারা আবৃত ও আচ্ছাদিত, তাই জ্ঞান ও ঈমানের আলো এতে পৌঁছাতে পারে না। আল্লাহ ইহুদীদের সম্পর্কে বলেন,
وَقَالُوا قُلُوبُنَا غُلْفٌ
"এবং তারা বলেঃ আমাদের অন্তর আবৃত ...।" (সূরা বাকারাহ, ২: ৮৮)
সত্য প্রত্যাখ্যান করা আর তা গ্রহণ করার ব্যাপারে অতি অহংকারের কারনে আল্লাহ শাস্তিস্বরূপ তাদের অন্তরকে এই আবরণ দিয়ে আবৃত করে রাখেন। সুতরাং, এটি হল অন্তরের উপর একটি আবরণ, কানের জন্য সীলমোহর এবং চোখের জন্য অন্ধত্ব। এটি হল চোখের উপর থাকা এক অদৃশ্য পর্দা, যেটি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
وَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ جَعَلْنَا بَيْنَكَ وَبَيْنَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ حِجَابًا مَّسْتُورًا (٤٥) وَجَعَلْنَا عَلَى قُلُوبِهِمْ أَكِنَّةً أَن يَفْقَهُوهُ وَفِي آذَانِهِمْ وَقْرًا
“এবং তুমি যখন কুরআন পাঠ করো তখন তোমার আর যারা পরকালে বিশ্বাস করে না তাদের মধ্যে এক অদৃশ্য পর্দা রেখে দেই। আমি তাদের অন্তরের উপর আবরণ দিয়েছি যেন তারা উপলব্ধি করতে না পারে এবং তাদের কানে (দিয়েছি) বধিরতা।” (সূরা আল-ইসরা, ১৭: ৪৫-৪৬)
এই ধরণের অন্তর বিশিষ্ট লোকদের যখন তাদের তাওহীদকে বিশুদ্ধ করার ও ইত্তিবা (অনুসরণ) করার উপদেশ দেওয়া হয়, তখন তারা খুব দ্রুত দৌড়ে পালায়!
“বিপর্যস্ত অন্তর” – এটি দিয়ে মুনাফিকদের অন্তরকে নির্দেশ করা হয়েছে, যেমনটা মহিমান্বিত আল্লাহ বলেন,
فَمَا لَكُمْ فِي الْمُنَافِقِينَ فِئَتَيْنِ وَاللَّهُ أَرْكَسَهُم بِمَا كَسَبُوا
"এ কি হলো তোমাদের! তোমরা মুনাফিকদের ব্যাপারে দুই দল হয়ে গেলে? (বিশেষ করে) যখন স্বয়ং আল্লাহই তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদের উপর অভিশাপ নাযিল করেছেন।” (সূরা নিসা, ৪:৮৮)
অর্থাৎ, তাদের প্রতারণাপূর্ণ কাজের কারনে আল্লাহ তাদেরকে পুনরায় অধঃপতিত করে দিয়েছেন আর যে মিথ্যায় তারা অভ্যস্ত ছিল সেটির দিকে তাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
এটিই হল সবচেয়ে মন্দ ও জঘন্য অন্তর, কারন এটি মিথ্যাকে সত্য বলে বিশ্বাস করে এবং যারা এর অনুসরণ করে তাদের প্রতি ভালোবাসা ও বশ্যতা প্রদর্শন করে। এই অন্তর সত্যকে মিথ্যা বলেও বিশ্বাস করে এবং যারা এর অনুসরণ করে তাদের প্রতি শত্রুতা প্রদর্শন করে। (এমন অন্তর থেকে) আল্লাহ'র নিকট আশ্রয় চাই।
“এমন অন্তর যেটির দুটো তাড়না রয়েছে”- এটি দিয়ে নির্দেশ করা হয়েছে সেই অন্তরকে, যেটিতে ঈমান দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয় নি, কারন এটি নিজেকে কেবলমাত্র সেই সত্যের প্রতি অনুগত করেনি- যে সত্যকে আল্লাহ তার রসূল (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে প্রেরণ করেছিলেন। এর পরিবর্তে এই অন্তরে রয়েছে কিছু ঈমান আর কিছু এর বিপরীত - কখনো এটি ঈমানের চেয়ে কুফরির অধিকতর নিকটে থাকে, আর অন্যান্য সময় এটি কুফরির চেয়ে ঈমানের অধিকতর নিকটে থাকে। কোন সময়ে এই অন্তর সেটির অনুসরণই করে, যেটি তার উপর সে সময়ে সবচেয়ে বেশী প্রভাবশালী থাকে।
টিকাঃ
(৬১) সাহিহ মুসলিম (২৬৭)
(৬২) আল-ঈমান (পৃষ্ঠা ১৭), আবি শাইবাহ এবং অন্যান্যরা এটি সহিহ সনদে বর্ণনা করেছেন।