📄 লেখক পরিচিতি (২) – ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম আল-জাওজিয়্যাহ (রহ.)
তার নাম, জন্ম ও বংশপরিচয়ঃ
তিনি হলেন শামসুদ্দিন আবু ‘আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকর ইবনে আইয়ুব ইবন সা’দ ইবনে হারিয ইবন মাক্কি যাইনুদ্দিন আয-যুরি আদ-দামিস্কি আল-হানবালি। তার পিতা শাইখ আবু বকর ইবনে আইয়ুব আয-যুরি ছিলেন শামের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ হানবালি মাদরাসা, আল- মাদরাসাতুল জাওজিয়্যাহ এর একজন কায়্যিম (পরিচালক)। এ কারনে তিনি ইবনুল কায়্যিম আল-জাওজিয়্যাহ নামেই পরিচিতি লাভ করেন।
তিনি ৬৯১ হিজরির সফর মাসের ৭ তারিখে সিরিয়ার দামাস্কাসের দক্ষিণ-পূর্বে একটি নিকটবর্তী গ্রাম যার- এ এক উচ্চবংশ ও ইলমী পরিবারে জন্মগ্রহন করেন।
ইবনে কাসির বলেন, “তার পিতা ছিলেন একজন সৎকর্মপরায়ণ আবেদ, অকপট ও উন্নতচরিত্রের ব্যক্তি। ...... তার জানাযায় অনেক লোক অংশগ্রহণ করেছিলো আর লোকেরা তার খুব প্রশংসা করতো।”
আস-সাফাদি, ইবনে তাগরি বারদি এবং আশ-শাওকানি বলেন যে, ইবনুল কায়্যিমের পিতা ফারযিয়্যাতের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনি তার পিতার কাছ থেকেই ফারযিয়্যাত সম্পর্কে ইলম অর্জন করেন।
তার শিক্ষকঃ
তিনি উত্তরাধিকার সম্পর্কিত জ্ঞান গ্রহণ করেছেন ইসমাইল বিন মুহাম্মাদের কাছ থেকে, আরবি ভাষা আবু ফাতহ আল-বালাবকি এবং আল-মাজদ আত-তুনিসি থেকে। একদল আলিমের সংস্পর্শে থেকে তিনি ফিকহ অধ্যয়ন করেন, তাদের মধ্যে একজন হলেন ইসমাইল বিন মুহাম্মাদ আল-হাররানি। তিনি উসুল শিক্ষা গ্রহণ করেন আস-সাফি আল-হিন্দি থেকে। তিনি হাদিস সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন শাহাব আল-নাবুলসি, কাযি তাকিউদ্দিন সুলাইমান, ফাতিমা বিনতে জাওহার, ঈসা ইবনে মুত’ইম, আবু বকর ইবনে আব্দুদ্দাইম প্রমুখ যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসদের কাছ থেকে। তবে তার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, যার সাথে সুদীর্ঘ ১৭ বছর থেকে তিনি জ্ঞান অর্জন করেছেন আর যিনি তার জীবনে বড় প্রভাব রেখেছেন, তিনি হলেন মুজাদ্দিদ ও ইমাম, শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ’র অর্জিত জ্ঞান আর ইবনুল কায়্যিমের নিজের অর্জিত জ্ঞানের সমন্বয়ে ইবনুল কায়্যিম ইসলামী জ্ঞানের বহুসংখ্যক শাখাতে এক অসাধারণ আলিমে পরিণত হোন।
তার জ্ঞানগত মর্যাদাঃ
ইবনে রজব বলেন, “সকল ইসলামী শাস্ত্রেই তার দখল ছিলো, তবে তাফসীর জগতে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। উসুল বিষয়ক শাস্ত্রগুলোতেও তিনি শীর্ষস্থানের অধিকারী ছিলেন। হাদিস, হাদিস বিজ্ঞান এবং ইজতিহাদ ও সূক্ষ্ম যুক্তি প্রয়োগে তার কোন সমকক্ষ চোখে পড়ে না। ফিকহ, ফিকহ বিজ্ঞান, আরবি ভাষা ও সাহিত্য এবং কালাম শাস্ত্রেও তার যথেষ্ট দখল ছিল। দখল ছিলো। সূফী দর্শন ও তাসাওউফ তত্ত্বেও তিনি গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। কুরআন-সুন্নাহ'র ভাব ও মর্ম, ঈমানের হাকিকত ও তত্ত্ব সম্পর্কে তার চেয়ে বড় আলিম কাউকে দেখিনি। অবশ্যই তিনি নিস্পাপ ছিলেন না, তবে এসব গুণ ও বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে তার মতো মানুষ আমি দেখিনি।”
ইমাম আয-যাহাবি বলেন, "হাদিসের মতন ও সনদের প্রতিও তার অখণ্ড মনোযোগ ছিলো। ফিকহ অধ্যয়নেই তিনি সবসময় নিমগ্ন থাকতেন আর শাস্ত্রীয় জটিল বিষয়গুলো বিশদভাবে লিখতেন। ব্যাকরণ শিক্ষাদানে তার বেশ নাম ছিল এবং হাদিস-বিজ্ঞান ও ফিকহ- বিজ্ঞানেও তার ভালো যোগ্যতা ছিলো।”
আশ-শাওকানি বলেন, "তিনি নিজেকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দলীলে সীমাবদ্ধ করে রাখতেন আর সেগুলোর উপর আমল করার তারীফ করতেন। তিনি মতামত (রাই) এর উপর নির্ভর করতেন না, তিনি অন্যান্যদেরকে সত্য দিয়ে পরাজিত করতেন আর এ ব্যাপারে তিনি কারো সাথেই কর্কশ ছিলেন না।”
ইবনে হাযার বলেন, "তার ছিল এক নির্ভীক অন্তর, ছিল প্রচুর ইলম এবং ভিন্ন মতামত (ইখতিলাফ) ও সালাফদের মাযহাব সম্পর্কেও তিনি ভালোভাবে পরিচিত ছিলেন।”
ইবনে কাসির বলেন, "দিনরাত তিনি নিজেকে জ্ঞানের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখতেন। .... তিনি এমনসব কিতাব থেকে ইলম অর্জন করেছেন যা অন্য কেউ অর্জন করতে পারেনি। সালাফ ও খালাফদের কিতাব সম্পর্কে তার গভীর বুঝ ছিল।”
আস-সুযুতি বলেন, “তিনি তাফসীর, হাদিস, উসুল, ফুরু আর আরবি ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিম ছিলেন।”
মোল্লা আলী আল-কারী বলেন, “যে কেউই শারহ মানাযিলুস সাইরিন (অর্থাৎ, মাদারিজুস সালিকিন) বইটি বিশ্লেষণ করবে, তার কাছে এটি স্পষ্ট ও পরিস্কার হয়ে যাবে যে এই উম্মাহ'র মধ্যে তারা উভয়ই (অর্থাৎ, ইবনে তাইমিয়্যাহ আর ইবনুল কায়্যিম) আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা'আহ'র সবচেয়ে প্রবীণ আলিমদের মধ্যে আর আল্লাহ'র আওলিয়াদের মধ্যে দুজন আলিম।”
ইবনে নাসিরুদ্দিন আদ- দিমিশকি বলেন, "তিনি বিভিন্ন ইসলামিক বিদ্যার অধিকারী ছিলেন, বিশেষ করে তাফসীর ও উসুল বিদ্যার।”
যুহদ ও ইবাদাতঃ ইবনে রজব বলেন, "বিনিদ্র রজনী যাপনে অভ্যস্ত ইবনুল কায়্যিম ছিলেন খুব ইবাদাত প্রেমিক। খুব দীর্ঘ ও প্রশান্তিপূর্ণ হতো তার সালাত। সবসময়ই তার জবান যিকিরে সজীব থাকতো। হৃদয়ে ছিল আল্লাহ- প্রেম ও আল্লাহতে সমর্পিত হওয়ার এক উদ্বেলিত ভাব। পবিত্র মুখায়বে ছিল আল্লাহ'র হুজুরে নিজের দৈন্য ও নিঃস্বতা এবং অসহায়ত্ব ও দীনতা প্রকাশের এক নূরানী দীপ্তি। এ দুর্লভ ভাবের অভিব্যক্তিতে আমার মনে হয়েছে তিনি সত্যিই অনন্য ও অতুলনীয়। কয়েকবার হাজ্জ সম্পাদন করা ছাড়াও দীর্ঘদিন তিনি মক্কায় অবস্থান করেছেন। মক্কাবাসীরা তার সার্বক্ষণিক ইবাদাত ও তাওয়াফের বিস্ময়কর সব ঘটনা শুনিয়ে থাকেন।"
ইবনে কাসির বলেন, "তিনি প্রচুর সালাত আদায় করতেন আর প্রচুর পরিমানে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। তার চরিত্র ছিল খুবই চমৎকার, তিনি খুবই স্নেহপরায়ণ ও বন্ধুত্বপরায়ণ ছিলেন। ... বড় ভালোবাসার মানুষ ছিলেন তিনি। হিংসা তার স্বভাবেই ছিল না। কাউকে কষ্ট দেওয়া বা হেয় করা তিনি জানতেন না। তার একজন অতি প্রিয় সহচর হিসাবে সমসাময়িক দুনিয়ায় তার চেয়ে ইবাদাত পাগল ও নফল প্রেমিক কেউ ছিল কিনা তা আমার জানা নেই। দীর্ঘ রুকু সিজদাহসহ বড় প্রশান্তিপূর্ণ সালাত আদায় করতেন তিনি। সাথীদের মুখে এজন্য তাকে তিরস্কারও শুনতে হতো, কিন্তু এ স্বাদের জিনিষ পরিত্যাগ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। মোটকথা, গুনে ও কর্মের বিচারে তার তুলনা পাওয়া দুস্কর।"
সংগ্রামী জীবনঃ
ইবনুল কায়্যিমের জীবনের সময়টাতে দ্বন্দ্ব-বিবাদ ও অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছিলো। এছাড়াও ইসলামিক রাষ্ট্রকে ভয়প্রদর্শনকারী বাহ্যিক হুমকিও ছিল। এই কারনে তিনি বিভক্ত হওয়া ও অনৈক্যকে প্রত্যাখ্যান করার এবং আল্লাহ'র কিতাব ও রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরে রাখার আদেশ করতেন।
তার লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি লক্ষ্য ছিল দ্বীন ইসলামের মূল ও বিশুদ্ধ উৎসের দিকে উম্মাহকে ফিরিয়ে আনা এবং একে বিদআত ও কামনা-বাসনা থেকে পরিশুদ্ধ করা। তাই তিনি অন্ধ অনুসরণ (তাকলীদ) করার মাযহাবকে ধ্বংস করার আর সালাফদের মাযহাবে ফিরে আসার এবং তাদের পথ ও পদ্ধতির উপর থেকে এগিয়ে যাওয়ার আহবান করলেন। আর এ কারনেই দেখা যায়, তিনি নিজেকে কেবল হানবালি মাযহাবে সীমাবদ্ধ করে রাখেননি, বরং প্রায়ই তিনি অন্যান্য বিভিন্ন মাযহাব থেকে মতামত গ্রহণ করতেন অথবা এমন হতো যে তিনি এমন এক মতামত দিলেন যেটি কিনা অন্যান্য সকল মাযহাবের মতামতের বিরোধী। এ কারনে ইজতিহাদ করা আর তাকলীদকে প্রত্যাখ্যান করাটাই ছিল তার মাযহাব। এর ফলে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। তার শাইখ ইবনে তাইমিয়্যাহ আর তাকে একই কারাগারে রাখা হয়, অবশ্য তাদেরকে পৃথক করেই রাখা হয়। ইবনে তাইমিয়্যাহ'র মৃত্যুর পর তাকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
তার দীর্ঘ বন্দী জীবনের সবটুকু সময় কেটেছে কুরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন নিমগ্নতায়। ইবনে রজব এ ব্যাপারে বলেন, "বন্দী জীবন তার জন্য খুবই কল্যাণকর হয়েছিলো। সে সময়টাতে তিনি এমন গভীর প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞান লাভ করেছিলেন যে, তত্ত্বজ্ঞানীদের জটিল ও সূক্ষ্ম তত্ত্বজ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করা তার জন্য সহজ হয়ে গিয়েছিলো। তার রচনা- সমগ্র এ ধরণের বিষয়বস্তুতে পরিপূর্ণ।”
তার ছাত্রঃ
তার অনেক ছাত্র ছিল, তাদের মধ্যে কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হলেনঃ ইবনে কাসির, আয-যাহাবী, ইবনে রজব, ইবনে আবদুল হাদি এবং তার দুই পুত্র ইব্রাহীম আর শারাফুদ্দিন আবদুল্লাহ।
তার কর্মঃ
আল-নুমান আল-আলসি আল-বাগদাদি বলেন, "তার তাফসীর সঠিকতার দিক থেকে অনন্য।”
আত-তাহাবি বলেন, “রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিস উল্লেখ ও এর বর্ণনা দেওয়ার ব্যাপারে তিনি খুবই গুরুত্ব দিতেন।”
শাইখ বুরহানুদ্দিন আল- যারি বলেন, "ইবনুল কায়্যিমের সময়টাতে তার মতো জ্ঞানী ব্যক্তি আর কেউই ছিলো না।”
ইবনুল কায়্যিম ষাটটির বেশী কিতাব রচনা ও সংকলন করেছিলেন। তার লিখনিতে অন্তর ছুঁয়ে যাওয়ার এক অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এছাড়াও তার লিখনিতে যথাযথতা, স্পষ্টতা, যুক্তির প্রবলতা আর গবেষণার গভীরতা লক্ষ্য করা যায়। তার রচিত ও সংকলিত কিতাবসমূহের মধ্যে কিছু কিতাবের নাম উল্লেখ করা হলঃ
হাদিস ও সিরাত সম্পর্কিত - তাহযিব সুনান আবু দাউদ, আল- মানারুল মুনিফ, ফাওা'ইদ আল-হাদিসিয়্যাহ, জালা'উল আফহাম, যাদুল মা'আদ।
ঈমান সম্পর্কিত - ইজতিমা' আল-জুয়ুশ আল-ইসলামিয়্যাহ, আস-সাত্তা'ইকুল মুরসালাহ, শিফা'উল 'আলিল, হাদিযুল আরওয়াহ, আল-কাফিয়াতুশ শাফিয়াহ, কিতাবুর রুহ।
আখলাক ও তাযকিয়্যাহ সম্পর্কিত - মাদারিজুস সালিকিন, আদ- দা'ওয়াদ দাওয়া', আল-ওয়াবিলুস সায়্যিব, আল-ফাওা'ইদ, রিসালাতুত তাবুকিয়্যাহ, মিফতাহ দারুস সা'আদাহ, 'উদ্দাতুস সাবিরিন।
কুরআন বিদ্যা সম্পর্কিত - আত-তিবইয়ান ফি আকসামিল কুরআন, আমসালুল কুরআন।
ভাষাগত ও বিবিধ ইস্যু সম্পর্কিত - বাদা'ই আল-ফাওা'ইদ।
ইবনুল কায়ি্যমের বিভিন্ন লিখনি থেকে ব্যাখ্যামূলক মন্তব্য সঙ্কলন করে দুটো বই সম্পাদনা করা হয়েছে, এগুলো হল - তাফসীরুল কায়্যিম এবং তাফসিরুল মুনির।
তার কিছু উক্তিঃ
"তিনি সৃষ্টি করেছেন সাত সাগর, তবুও তিনি তার প্রতি ভয়বশত আপনার চোখের এক ফোঁটা অশ্রু দেখতে ভালোবাসেন, অথচ আপনার চোখদুটো অশ্রুবিহীন!”
"সত্যিকারের মানুষ তো সে-ই, যে তার অন্তরের মৃত্যুর ব্যাপারে ভয় করে, তার শারীরিক মৃত্যুকে নয়।”
"কোন ছোট পাপকেই তাচ্ছিল্য করবেন না, কারন ক্ষুদ্রতম অগ্নিস্ফুলিঙ্গ থেকেই বৃহত্তম অগ্নিকান্ড ঘটতে পারে।”
"বাজে চিন্তাকে তাড়িয়ে দিন, যদি এটি না করেন তবে সেটি একটা উদ্দেশ্যে পরিণত হবে। তাই বাজে উদ্দেশ্যকে তাড়িয়ে দিন, নতুবা সেটি একটি কামনা-বাসনায় পরিণত হবে। সুতরাং কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করুন, যদি না করেন তবে সেটি একটি সংকল্প ও গভীর আসক্তিতে পরিণত হবে।"
"পাপকে অবশ্যই জ্বালিয়ে দেওয়াটা দরকার - হয় অনুতাপের যন্ত্রণা দিয়ে, নতুবা পরকালে দোযখের আগুন দিয়ে।”
"এই দ্বীন (ইসলাম) নিজেই একটি নৈতিক আচরণ। তাই আপনার আচার-আচরণের তুলনায় যে ব্যক্তি আপনার থেকেও এগিয়ে থাকবে, দ্বীন পালনে সে-ই আপনার থেকে উত্তম।”
"পাপগুলোর শাস্তি হিসেবে এটিই যথেষ্ট যে আপনি আল্লাহ'র ইবাদাত করতে চাওয়া সত্ত্বেও সেই পাপগুলো আপনাকে তার ইবাদাত করতে বাধা দিবে।”
"আল্লাহ চোখকে অন্তরের আয়না বানিয়েছেন। তাই গোলাম যদি তার দৃষ্টিকে অবনত করে, তবে তার অন্তর এর কামনা-বাসনাকে অবনত করবে। আর যদি সে তার দৃষ্টিকে বাধাহীন করে দেয়, তবে তার অন্তরও এর কামনা-বাসনাকে বাধাহীন করে দিবে।"
"অন্তর বেঁচে থাকাটা নির্ভর করে কুরআন দিয়ে প্রতিফলিত হওয়া, গোপনে আল্লাহ'র সামনে নম্র থাকা আর পাপ বর্জন করার উপর।”
"আপনি যদি পরীক্ষা করে দেখতে চান যে আল্লাহকে আপনি কতটুকু ভালোবাসেন, তবে দেখুন যে আপনার অন্তর কুরআনকে কত ভালবাসে, আপনি জবাব পেয়ে যাবেন।”
"এই দুনিয়া হল একটি সেতু, আর একটি সেতুকে নিজের আবাস হিসেবে গ্রহণ করাটা উচিত নয়।”
"কি আশ্চর্য! আপনার কাছ থেকে অল্প কিছু হারিয়ে গেলে আপনি কাঁদেন, অথচ আপনার পুরো জীবনটাই ক্ষয়ে যাচ্ছে আর আপনি হাসছেন!”
"অন্তর যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তবে হারাম কাজগুলো আকর্ষণীয় হয়ে যায় আর আল্লাহ'র আনুগত্য করাটা এমন কাজ হয়ে যায় যাকে অবজ্ঞা সহকারে দেখা হয়।”
"আল্লাহ আপনাকে কখনোই ধ্বংস করার জন্য পরীক্ষা করেন না। তিনি আপনার হাত খালি করার মাধ্যমে আপনার কাছ থেকে কিছু দূর করে দেন এর থেকেও উত্তম কিছু উপহার দেওয়ার জন্য।”
"দুর্দশাগ্রস্ত হওয়া ছাড়া অন্তর কখনোই ধর্মপরায়ণ ও বিশুদ্ধ হবে না। এটি স্বর্ণকে বিশুদ্ধ করার মতোই, স্বর্ণ থেকে এর নিকৃষ্ট ধাতুগুলো অপসারন করা ছাড়া স্বর্ণ কখনোই বিশুদ্ধ হয় না।”
"অন্তরে গানের প্রতি ভালোবাসা আর কুরআনের প্রতি ভালোবাসা কখনোই একসাথে থাকতে পারে না, অন্তরে এই দুটি অবস্থান করলে এদের একটি অপরটিকে বিতাড়িত করে।”
"আল্লাহ'র কাছে কোন কিছুর চাওয়া থামিয়ে দিলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হোন, আর মানুষের কাছে কিছু চাওয়া হলে সে অসন্তুষ্ট হয়।”
"আপনি যখন কোন সৃষ্টিকে ভয় করবেন তখন এর দ্বারা প্রতিহত হওয়া অনুভব করবেন আর এটি থেকে পালিয়ে যাবেন। কিন্তু আপনি যখন সৃষ্টিকর্তাকে ভয় করবেন তখন আপনি নিজেকে তার নিকটে অনুভব করবেন আর তার দিকে দৌড়িয়ে যাবেন।”
"অন্তর যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর প্রতি যুক্ত থাকে, তবে সে যেটির সাথে যুক্ত আছে, আল্লাহ তাকে সেটির উপরই নির্ভরশীল করে দিবেন আর সে ব্যক্তি সেটি দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হবে।”
"কোন ব্যক্তিকে কিভাবে সুস্থ প্রকৃতির হিসেবে বিবেচনা করা যায়, যে কিনা শুধু একটিমাত্র লালসাপূর্ণ ঘণ্টার বদলে জান্নাত ও এর অভ্যন্তরে যা আছে সব কিছুই বিক্রি করে দেয়?”
"প্রকৃতপক্ষে অন্তরে রয়েছে এক অভাববোধ, যা আল্লাহ'র সাথে সম্পর্ক করা ছাড়া দূর হয় না। অন্তরে রয়েছে এক বিষণ্ণতা, যা আল্লাহকে জানা আর তার প্রতি সৎ থাকা ছাড়া দূর হয় না। অন্তরে আরও রয়েছে একটি শুন্যতা, যা তাকে ভালোবাসা ও তাওবা করে আল্লাহ'র দিকে ফিরে যাওয়া আর সবসময় তাকে স্মরণ করা ছাড়া পূরণ হয় না। কোন ব্যক্তিকে যদি পুরো দুনিয়া আর এর সব কিছুই প্রদান করা হয়, তবুও এটি তার শুন্যতা পূরণ করতে পারবে না।”
"একজন ব্যক্তির জবান আপনাকে তার অন্তরের স্বাদ দিতে পারে।"
"আল্লাহ'র ইবাদাত ও আনুগত্য অন্তরকে আলোকিত ও শক্তিশালী করে আর অটল রাখে, যতক্ষণ না পর্যন্ত এটি পরিস্কার আয়নার মতো হয়ে যায়, যা আলো দ্বারা চকচক করে। শয়তান যখন এই অন্তরের নিকটবর্তী হয়, সে এর আলো দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয় সেই শয়তানদের মতো, যারা আসমানে আড়ি পেতে শোনার চেষ্টা করলে তাদেরকে তারকা নিক্ষেপের মাধ্যমে আঘাত করা হয়। আর একটি সিংহ থেকে নেকড়ে যেভাবে পালিয়ে যায়, শয়তান এই অন্তর থেকে এর থেকেও বেশী ভয় নিয়ে পালিয়ে যায়।”
"এই পার্থিব জীবন সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হবেন না কারন এটি তো আল্লাহ'র জন্যই। রিযকের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হবেন না কারন এটি আল্লাহ'র পক্ষ থেকে আসে। ভবিষ্যতের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করবেন না কারন এটি তো আল্লাহ'র হাতে। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার কাজ করে যেতে থাকেন। কারন আপনি যদি তাকে সন্তুষ্ট করেন তবে তিনি আপনাকে সন্তুষ্ট করবেন, আপনার অভাব পুরন করে দিবেন আর আপনাকে সমৃদ্ধ করে দিবেন।”
“হে সবরকারীদের পদযুগল, যেতে থাকো, কারন কেবলমাত্র আর অল্পই তো বাকি আছে। ইবাদাতের মধুরতা মনে রাখবে, তাহলে কঠোরভাবে চেষ্টা করে যাওয়ার তিক্ততা তোমার কাছে আরো সহজ হয়ে যাবে।”
"তার নিয়্যতই সবচেয়ে ভালো, যিনি তার রবের সাথে সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন।"
"নারীরা হলেন সমাজের অর্ধেক, আর তারা সমাজের অপর অর্ধেকের জন্ম দেন; তাই ব্যাপারটি যেন এমন যে তারা নিজেরাই হলেন পূর্ণ সমাজ।”
"কুরআনের অনুসারী তো তারাই, যারা এটি পাঠ করে আর এর উপর আমল করে, যদিও তা তাদের হিফয করা না থাকে।"
“তিনটি বিষয় দ্বারা সুখ অর্জিত হয় - পরীক্ষার সময় সবর করা, অনুগ্রহ পাওয়ার সময় শোকরগুজার থাকা এবং পাপ করলে অনুতপ্ত হওয়া।”
"আল্লাহ ও তার সাথে সাক্ষাতের জন্য আকুল আকাংখা করার ব্যাপারটি হল অন্তরের উপর মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে যাওয়ার মত, যা দুনিয়ার আগুনকে নিভিয়ে দেয়। যে ব্যক্তি তার অন্তরকে তার রবের সাথে নির্দিষ্ট করে নিবে, সে স্থির ও প্রশান্তিপূর্ণ অবস্থায় থাকবে। আর যে তার অন্তরকে লোকদের মধ্যে পাঠিয়ে দিবে, সে গোলমাল ও অতিশয় অস্থির অবস্থায় থাকবে।”
"কাফিরদের মধ্যে অপরিচিত হল একজন মুসলিম, মুসলিমদের মধ্যে অপরিচিত হল একজন মুমিন, আর মুমিনদের মধ্যে অপরিচিত হল একজন মুহসিন।”
"পাপ অন্তরকে সেভাবে ধ্বংস করে যেভাবে বিষ ধ্বংস করে শরীরকে।”
"আন্তরিকতা ছাড়া আমল করার ব্যাপারটি হল সেই মুসাফির ব্যক্তির মত, যে তার পানির পাত্রে ময়লা বহন করে; এটি বহন করা তার জন্য একটি বোঝা আর এটি কোন উপকারেই আসে না।"
"এই পার্থিব জীবন তো একটি ছায়ার মতোই। আপনি যদি একে ধরতে চান তবে কখনোই তা করতে পারবেন না। যদি আপনি এটি থেকে নিজের মুখ ঘুরিয়ে এর প্রতি পিঠ প্রদর্শন করেন, তবে আপনাকে অনুসরণ করা ছাড়া আর এটির কোন উপায় থাকবে না।”
"সত্যের পথে যাও আর এক্ষেত্রে একাকী বোধ করো না, কারন অল্পসংখ্যক লোকই এই পথ গ্রহণ করেন। বাতিল পথের ব্যাপারে সতর্ক থেকো, ধ্বংসপ্রাপ্তদের সংখ্যাধিক্য দ্বারা প্রতারিত হয়ো না।”
"কুনজর দেয় এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই হিংসুক, তবে প্রত্যেক হিংসুক ব্যক্তিই কুনজর দেয় না।”
"টাকা যখন আপনার হাতে থাকবে তবে অন্তরে থাকবে না, এটির কারনে আপনার ক্ষতি হবে না যদিও অধিক পরিমাণে টাকা আপনার কাছে থাকে। কিন্তু টাকা যদি আপনার অন্তরেই থাকে, তবে আপনার হাতে কোন টাকা না থাকলেও তা আপনার ক্ষতি করবে।”
"দুনিয়াতে জবান ছাড়া এমন আর কিছুই নেই যেটিকে গুরুতরভাবে কারারুদ্ধ করা প্রয়োজন।”
"পাপের অনেক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে, তার মধ্যে একটি হল এই যে, পাপ আপনার কাছ থেকে জ্ঞান ছিনিয়ে নিবে।”
তার মৃত্যুঃ
তার মৃত্যুর তারিখের ব্যাপারে ঐক্যমত আছে যে তিনি ৭৫১ হিজরি সনের ১৩ই রজব বৃহস্পতিবার রাতে এশা'র আযানের সময় ইন্তিকাল করেন। পরদিন যোহরের সালাতের পর প্রথমে আল-জামি' আল-উমাওি এবং এরপর জামি' জারাহ তে তার জানাযার সালাত আদায় করা হয়। বিপুল সংখ্যক লোক তার জানাযায় অংশগ্রহন করেছিলো।
ইবনে কাসির বলেন, "তার জানাযা লোকে পরিপূর্ণ ছিল, আল্লাহ তার উপর করুণা করুন। এই জানাযার সাক্ষী ছিলেন বিচারকগণ, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বরা এবং সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তিরা – সাধারণ লোক ও অভিজাত শ্রেণী উভয় পক্ষ থেকেই। তার খাটিয়া বহন করার জন্য লোকেরা ভিড় করেছিলো। দামাস্কাসের কবরস্থান আল-বাব আস-সাগির এ তার মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়, আল্লাহ তাদের উভয়কেই ক্ষমা করুন।”
মহান আল্লাহ ইবনুল কায়্যিম (রহ.) কে ক্ষমা করুন এবং তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস প্রদান করুন, আমীন।
টিকাঃ
(৫৯) ইমাম ইবনুল কায়্যিম, দারুসসালাম পাবলিকেশন্স; সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস, (আবুল হাসান আলী নদভী); http://www.sahihalbukhari.com/SPS/sp.cfm?subsecID=SRH06&articleID=SRH060001&articlePages=1; http://www.islamicity.org/7752/short-biography-of-ibn-al-qayyim-al-jawziyya/