📘 অন্তরের ব্যাধি সমূহ ও তার চিকিৎসা > 📄 হিংসা ও কামনা-বাসনার মাঝে

📄 হিংসা ও কামনা-বাসনার মাঝে


কৃপণতা আর হিংসা হল এমন অসুস্থতা, যা আত্মাকে এর জন্য কল্যাণকর কিছুকে ঘৃণা করার দিকে আর এর জন্য ক্ষতিকর কিছুকে ভালোবাসার দিকে পরিচালিত করে। এ কারনেই পূর্ববর্তী হাদিসে হিংসাকে ঘৃণা ও অসন্তোষের পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়েছে। কামনা-বাসনা ও প্রবল আবেগতাড়িত ভালোবাসাজনিত অসুস্থতার ব্যাপারে আত্মা তার ক্ষতিকারক কিছুকে ভালবাসে আর এটির সাথে তার যুক্ত থাকাটা হল তার জন্য কল্যাণকর কিছুকে ঘৃণা করা।

প্রবল আবেগতাড়িত ভালোবাসা একটি মানসিক অসুস্থতা। যখন এর প্রভাব শরীরে লক্ষ্য করা যায়, এটি এমন অসুস্থতায় পরিণত হয় যা মনকেও দুর্দশাগ্রস্ত করে- হয় বিষণ্ণতার অনুরূপ কিছু দ্বারা মনকে দুর্দশাগ্রস্ত করার মাধ্যমে, অথবা দুর্বলতা ও ক্ষীণতার মাধ্যমে শরীরকে দুর্দশাগ্রস্ত করার মাধ্যমে। কিন্তু এখানে উদ্দেশ্য হল অন্তরের উপর এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা। কারন প্রবল আবেগতাড়িত ভালোবাসাই হল সেই ভিত্তি, যা আত্মাকে তার ক্ষতিকারক কিছুর প্রতি লোভাতুর করে। অনুরূপ হল শারীরিকভাবে দুর্বল সেই ব্যক্তি, যে তার শরীরের জন্য ক্ষতিকারক কোন কিছুর প্রতি লোভ করে। সে যদি সেটি দ্বারা সম্পূর্ণভাবে পরিতৃপ্ত না হয় তবে সে দুঃখে পতিত হয় আর সম্পূর্ণভাবে পরিতৃপ্ত হলে তার অসুস্থতা বৃদ্ধি পায়।

📘 অন্তরের ব্যাধি সমূহ ও তার চিকিৎসা > 📄 প্রবল আবেগতাড়িত ভালোবাসার (ইশ্ক) বাস্তবতা

📄 প্রবল আবেগতাড়িত ভালোবাসার (ইশ্ক) বাস্তবতা


এই ভালোবাসা দিয়ে দুর্দশাগ্রস্ত হওয়া অন্তরের ক্ষেত্রেও অনুরূপ প্রযোজ্য। কারন এটি এর ভালোবাসার বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্ক দ্বারা হয় দেখা, স্পর্শ করা, শ্রবণ করা, এমনকি সেটি সম্পর্কে চিন্তা করা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদি সে ভালবাসাকে দমন করে, তবে তার অন্তর এর দ্বারা আহত হবে ও কষ্ট পাবে। আর যদি সে কামনা-বাসনার প্রতি আত্মসমর্পণ করে, তবে অসুস্থতা আরও প্রবল হবে আর তা এমন এক নিমিত্তে পরিণত হবে যেটির মাধ্যমে দুর্দশা বৃদ্ধি পাবে।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তার বিশ্বাসী গোলামদেরকে দুনিয়া থেকে এমনভাবে আশ্রয় দেন, যেমনটা তোমাদের মধ্যে কেউ তোমাদের অসুস্থ ব্যক্তিকে (তার জন্য ক্ষতিকারক) খাবার ও পানীয় থেকে আশ্রয় দিয়ে থাকো।”

আয-যুহদ কিতাবে ইমাম আহমাদ কর্তৃক লিপিবদ্ধ মুসা (আঃ) কে রক্ষা করা সম্পর্কে ওয়াহব -৫১ বর্ণিত এক হাদিসে আছে যে আল্লাহ বলেন, "নিশ্চয়ই আমি আমার বন্ধুদেরকে এই দুনিয়ার আনন্দ-উল্লাস, এর প্রাচুর্য ও আরাম-আয়েশ থেকে তাড়িয়ে দেই, যেমনটি দয়ালু পশুপালক তার উটকে তাড়িয়ে দেয় বিপজ্জনক চারণ ভূমি থেকে। আর নিশ্চয়ই আমি তাদেরকে এর প্রশান্তি ও জীবিকা থেকে এড়িয়ে রাখি, যেমনটি দয়ালু পশুপালক তার উটকে সহজেই শিকার করা যায় এমন বিশ্রামের স্থান থেকে এড়িয়ে রাখে। এটি এ কারনে নয় যে আমি তাদেরকে তুচ্ছ মনে করি, তবে (এটির জন্য যে) যাতে করে তারা নিরাপত্তা ও প্রাচূর্যে আমার দয়ার অংশ সম্পূর্ণ করতে পারে, দুনিয়ার আনন্দ-উল্লাস তাকে আকর্ষণ করবে না আর কামনা-বাসনা তাকে পরাস্ত করবে না।"

সুতরাং, অসুস্থতার একমাত্র চিকিৎসা নির্ভর করে তার অন্তর থেকে এই নিন্দনীয় ভালোবাসা দূরীভূত করার মাধ্যমে তার অসুস্থতা দূর করার উপর।

প্রবল আবেগতাড়িত ভালবাসা বিষয়ে লোকেরা দুটি মতামতে বিভক্ত প্রথম দল বলে যে এটি নিয়্যত ও ইচ্ছার শ্রেণীতে পড়ে, এটি হল বিখ্যাত মতামত।

অপর দল বলে, এটি কল্পনা ও খোশখেয়ালের শ্রেণীর মধ্যে পড়ে আর এটি কল্পনাশক্তির একটি বিকৃতি, যেহেতু এর কারনে ব্যক্তি তার ভালোবাসার ব্যক্তিকে তার সত্যিকারের বাস্তবতার পরিবর্তে কল্পনায় ছবির মতো তুলে ধরে। এই দলটি এরপর বলে, “এবং এ কারনেই আল্লাহকে প্রবল আবেগতাড়িত ভালোবাসা (ইশক) সহকারে বর্ণনা করা হয় নি আর না তিনি প্রবল আবেগতাড়িতভাবে (ইয়া'শিক) ভালোবাসেন, কারন তিনি এ থেকে বহুদূরে। আর যার এই বিকৃত চিন্তাগুলো রয়েছে সে প্রশংসিত হতে পারে না।"

প্রথম দলের লোকেরা বলে, "তিনি প্রবল আবেগতাড়িত ভালোবাসা (ইশক) সহকারে বর্ণিত হয়েছেন, কারন এটি হল একটি সম্পূর্ণ ও যথাযথ ভালোবাসা এবং আল্লাহ ভালোবাসেন (যুহিব)।”

আর আব্দুল ওয়াহিদ বিন যাইদ এর বর্ণনায় রয়েছে যে তিনি বলেন, "আমাকে ভালবাসতে থেকে গোলাম সমসময় আমার নিকটবর্তী হতে থাকবে আর আমি তাকে ভালবাসতে থাকব (আ'শিকুহু)।”

এটি হল কিছু সুফির কথা, তবে অধিকাংশই এই শব্দ আল্লাহর প্রতি সংশ্লিষ্ট করেন না। কারণ প্রবল আবেগতাড়িত ভালোবাসা (ইশক) হল যথাযথ সীমাকে ছাড়িয়ে যাওয়া এক ভালবাসা, আর আল্লাহকে ভালবাসার কোন শেষ নেই এবং তা যথাযথ সীমাও ছাড়িয়ে যেতে পারে না। কোন ব্যাতিক্রম ছাড়াই প্রবল আবেগতাড়িত ভালবাসাকে নিন্দনীয় বিবেচিত করতে হবে। সৃষ্টিকর্তা বা সৃষ্ট- যার প্রতিই এটি নির্দেশ করুক না কেন, এটি প্রশংসিত হবে না কারণ এটি এমন এক ভালোবাসা যা যথাযথ সীমা অতিক্রম করে।

এটিও সত্য, কারন "প্রবল আবেগতাড়িত ভালবাসা” (“ইশক”) শব্দটি কেবলমাত্র সে ব্যক্তির প্রতিই প্রয়োগ করা হয়, যে একজন নারী বা শিশুকে ভালবাসে (অথবা বিপরীতভাবে), এটিকে ব্যক্তির পরিবার, সম্পত্তি বা তার অবস্থার প্রতি প্রয়োগ করা হয় না, যেমনটি এটি প্রয়োগ করা হয় না নবী-রাসুলগণ বা ধার্মিক ব্যাক্তিদের সম্পর্কে ভালবাসার প্রতি। সাধারনত আপনি নিষিদ্ধ কাজের পাশাপাশি এই শব্দ পাবেন, যেমন- এমন নারীকে ভালোবাসা যে নারী তার জন্য বৈধ নয়, অবৈধ দৃষ্টি ও স্পর্শ আর অনুরূপ অন্যান্য অবৈধ কাজ সহকারে একজন শিশুকে ভালোবাসা।

একজন পুরুষের তার স্ত্রী বা ক্রীতদাসীর জন্য ভালোবাসা তাকে ন্যায়পরায়নতার গন্ডির বাইরে এমনভাবে পরিচালিত করে যে, সে সেই নারীর জন্য হারাম কাজ করে আর ফরয কাজ বর্জন করে, যা সাধারণভাবে ঘটে থাকে - এমনকি সেটি এই পর্যন্ত গড়ায় যে সে তার নতুন স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার কারণে তার পুরনো স্ত্রী থেকে জন্মলাভ করা পুত্রের উপর জুলুম করে, অথবা সেটি এ পর্যন্ত গড়ায় যে সেই নারীকে সুখী রাখার জন্য সে এমন কাজ করবে যা তার দ্বীন ও পার্থিব জগতের জীবনের ক্ষতি করবে। উদাহারনস্বরূপ, সেই নারীকে এমন উত্তরাধিকারের জন্য বেছে নেওয়া সে যেটির প্রাপ্য নয়, অথবা তাকে পরিবারের কতৃত্ব ও সম্পত্তি প্রদান করা, যা আল্লাহ'র স্থির করে দেওয়া সীমা অতিক্রম করে; অথবা সেই নারীর জন্য বাড়াবাড়ি খরচ করা; অথবা সেই ব্যক্তি কর্তৃক সেই নারীর জন্য হারাম বিষয়গুলোকে সেই নারীর সাধ্যে নিয়ে আসা যা সেই ব্যক্তির দ্বীন ও পার্থিব জগতের জীবনের ক্ষতিসাধন করবে।

তার জন্য অনুমোদিত ব্যক্তি সম্পর্কেই এই প্রবল আবেগতাড়িত ভালোবাসা হারাম, সুতরাং তার ক্ষেত্রে এটি কেমন হবে, যার কিনা হারাম ব্যক্তির জন্য বা দুই ব্যক্তি সম্পর্কে প্রবল আবেগতাড়িত ভালোবাসা আছে? কারন এতে এমন এক বিকৃতি রয়েছে যেটির সীমা গোলামদের রব ছাড়া আর কেউই পরিমাপ করতে পারবে না। এটি একটি অসুস্থতা যা দ্বীন ও এর অধিকারী ব্যক্তির উদ্দেশ্যকে বিকৃত করে, এরপর এটি তার বুদ্ধিমত্তাকে বিকৃত করে আর পরবর্তীতে বিকৃত করে তার শরীরকে। মহান আল্লাহ বলেন,
يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِّنَ النِّسَاءِ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوفًا (۳۲)
"... যদি তোমরা (সত্যিই) আল্লাহকে ভয় করো, তাহলে (অন্য পুরুষদের সাথে) কথা বলার সময় কোমলতা অবলম্বন করো না, (যদি এমন করো) তাহলে যার অন্তরে কোন ব্যাধি আছে সে তোমার ব্যাপারে প্রলুব্ধ হয়ে পড়বে, (তবে) তোমরা (সবসময়ই) নিয়মমাফিক কথা বলবে।” (সূরা আহযাব, ৩৩: ৩২)

এমন কিছু মানুষ রয়েছে যাদের অন্তরে কামনা-বাসনার ব্যাধি রয়েছে আর যাদের উপলব্ধি কেবলই অগভীর। যখন কামনা-বাসনার বিষয়বস্তুতে আত্মসমর্পণ করা হয়, তখন অসুস্থতা পরিতৃপ্ত হয়; আর এই পরিতৃপ্তি কামনা-বাসনাকে শক্তিশালী করে ও সেই কাঙ্ক্ষিত বিষয়ের অনুসরণ করে, এরপর অসুস্থতা শক্তিশালী হয়।

এটি হল সেই ব্যক্তির বিপরীত, যার কাঙ্ক্ষিত বিষয় মিলেনি। এই ব্যর্থতার ফলে তার অসুস্থতা শক্তিশালীকারী চরিতার্থ দূর হয়ে যায়, যার ফলে ভালোবাসার মতো কামনা-বাসনাও কমজোর হয়ে পড়ে। কারন ব্যক্তি স্পষ্টভাবে মনস্থ করে যে তার কামনা-বাসনার সাথে সাথে সেই কাজটি সম্পাদন হওয়ার ব্যাপারটিও থাকবে; কারন অন্যথায় তার সকল কামনা-বাসনা হবে কেবলই আত্মার ফিসফিসানি, যদি না কিছু কথা বা দৃষ্টি এর সাথে থাকে।

এই প্রবল আবেগতাড়িত ভালবাসা দ্বারা যে নিপীড়িত ব্যাক্তি তা করা থেকে নিজেকে আটকিয়ে রাখে আর সবর অবলম্বন করে, আল্লাহ নিশ্চয়ই তাকে তার তাকওয়ার জন্য পুরস্কৃত করবেন; যেমনটি বর্ণিত হয়েছে হাদিসে- “যে ব্যাক্তি কাউকে প্রবল আবেগতাড়িত হয়ে ভালোবাসা সত্ত্বেও নিজেকে তা থেকে আটকিয়ে রাখে, সেটি গোপন করে আর সবর অবলম্বন করে এবং এরপর এর উপরই (আমল করা অবস্থায়) মারা যায়, তবে সে একজন শহীদ হবে। ৫২

এই হাদিসটি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে মুজাহিদ থেকে ইয়াহয়া আল-কাতাতের বর্ণনা হিসেবে পরিচিত, কিন্তু এই হাদিসটি সন্দেহযুক্ত আর এ ধরণের হাদিসের উপর নির্ভর করা যায় না।

কিন্তু শারিয়াহ'র দলীলগুলো থেকে জানা যায় যে, যদি কেউ হারাম কাজ করা থেকে নিজেকে আটকিয়ে রাখে - এটি হোক দেখা, বলা বা কর্ম সম্পাদন করা, আর সে এটি গোপন করে ও এটি স্পষ্টভাবে বলে না যাতে সে হারামে পতিত না হয় এবং আল্লাহ'র প্রতি আনুগত্যে সবর অবলম্বন করে আর প্রবল আবেগতাড়িত ভালোবাসার কারনে তার অন্তরে অনুভূত বেদনা সত্ত্বেও আল্লাহ'র অবাধ্যতা থেকে দূরে থাকে (অনুরূপ ঘটনা তার ক্ষেত্রেও, যে দুর্দশা চলাকালীন সময়ে সবর অবলম্বন করে), তবে নিশ্চয়ই এই ব্যক্তি মুত্তাকী ও সবর অবলম্বনকারী ব্যক্তিদের মতো পুরস্কৃত হবে।
إِنَّهُ مَن يَتَّقِ وَيَصْبِرْ فَإِنَّ اللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِينَ (۹۰)
"নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করে আর সবর করে, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের পুরস্কার বিনষ্ট করেন না।” (সুরা ইউসুফ, ১২:৯০)

এটি অন্তরকে পীড়িতকারী ব্যাধি হিংসা ও অন্যান্য সকল অসুস্থতার জন্য সত্য। সুতরাং, আল্লাহ রাগান্বিত হোন এমন কিছুকে যখন আত্মা অনুসরণ করে আর ব্যাক্তি আল্লাহকে ভয় করে তা থেকে নিজেকে বিরত রাখে, তবে সে আল্লাহ যা বলেছেন তার অন্তর্ভুক্ত -
وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى (٤٠) فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى (٤١)
"পক্ষান্তরে যে তার রবের সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে আর তার আত্মাকে নিরর্থক কামনা বাসনা থেকে বিরত রেখেছে, তবে নিশ্চয়ই জান্নাতই হবে তার ঠিকানা। (সুরা নাজিয়াত, ৭৯: ৪০-৪১)

আত্মা যখন কোন কিছু ভালবাসে, তখন সে তা অর্জনের জন্য সব কিছুই করে। সুতরাং যে ব্যক্তি নিন্দনীয় ভালোবাসা বা ঘৃণাবশত এটি করে, তার এই কাজটি পাপপূর্ণ হবে। এর একটি উদাহারন হল, কোন ব্যক্তিকে হিংসা করার কারনে তাকে ঘৃণা করা, আর এর ফলে সেই ব্যক্তির সাথে সংযুক্ত ব্যক্তির ক্ষতি করা হয় তার অধিকার ব্যাহত করার মাধ্যমে। বা তাদেরকে শত্রুতা প্রদর্শনের মাধ্যমে বা আল্লাহ'র কোন আদেশ আল্লাহ'র কারনে নয় বরং নিজের কামনা-বাসনার কারনে সম্পাদন করা।

এই ধরণের অসুস্থতা সাধারণভাবে অন্তরে পাওয়া যায়। ব্যক্তি কোন কিছুকে ঘৃণা করতে পারে আর এই ঘৃণার কারনে সে নিছকই খামখেয়ালীর কারনে অনেক কিছুই ভালবাসে। যেমনটি এটি দ্বারা প্রভাবিত এক কবি বলেন,
একটি সুদানি মেয়ের জন্য সে সুদানকে ভালবাসলো এর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে
সে ভালবাসলো কালো কুকুরকে ওর প্রতি তার ভালোবাসার কারনে।

সুতরাং সে একজন কাল মেয়েকে ভালবাসলো, আর এ কারনে সে সব ধরণের কালোকে ভালবাসলো, এমনকি কুকুরদের কালিমাকেও! এর সবই হল এর মায়া, কল্পনা ও কামনা-বাসনা সম্পর্কিত অন্তরের একটি অসুস্থতা। আমরা আল্লাহ'র নিকট দুয়া করি যেন তিনি আমাদের অন্তর থেকে এসব ব্যাধি দূর করে দেন; আর আমরা মন্দ কার্যপদ্ধতি, কামনা-বাসনা ও অসুস্থতা থেকে আল্লাহ'র নিকট আশ্রয় চাই।

টিকাঃ
(৫১) ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বিহ একজন সম্মানিত তাবীঈ, কিন্তু তার থেকে বর্ণিত এই হাদিস সরাসরি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে (অর্থাৎ, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম এবং এই তাবীঈ' র বর্ণনার মধ্যে কোন সাহাবী কর্তৃক এর বর্ণনা পাওয়া যায় নি) আর এটি নির্ভরযোগ্য নয়।
(৫২) এটি একটি যয়ীফ হাদিস। এর অনির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে ইবনুল কায়ি‍্যমের আল-জাওাব আল-কাফি ও রাওদাহ আল-মুহিব্বিন কিতাবে এবং আল-আলবানীর সিসিলাহ আয-যয়ীফ কিতাবে আলোচনা রয়েছে।

📘 অন্তরের ব্যাধি সমূহ ও তার চিকিৎসা > 📄 আল্লাহকে ভালবাসাই হল অন্তরের সহজাত প্রবৃত্তি

📄 আল্লাহকে ভালবাসাই হল অন্তরের সহজাত প্রবৃত্তি


অন্তরকে কেবল আল্লাহ'র ইবাদাতের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এটিই হল সহজাত প্রকৃতি (ফিতরাত), যেটির উপরে আল্লাহ তার গোলামদের সৃষ্টি করেছেন, যেমনটি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন –

"প্রত্যেক শিশু ফিতরাতের উপর ভুমিষ্ট হয়ে থাকে। এরপর তার পিতামাতা তাকে ইয়াহুদি, খ্রিস্টান ও মাজুসি করে গড়ে তোলে। যেমনটি বকরীর নিখুঁত বাচ্চা পয়দা হয়, এরপর বকরীর মালিক তার কান কেটে দেয়।”

এরপর আবু হুরাইরা (রাঃ) বললেন, যদি চাও আল্লাহ'র এই আয়াত তিলাওয়াত করো -
فِطْرَتَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا
"যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন; আল্লাহ'র সৃষ্টিতে কোন পরিবর্তন নেই।” (সুরা রুম, ৩০: ৩০)

সুতরাং আল্লাহ তার গোলামের সহজাত স্বভাব করে দিয়েছেন তাকে ভালোবাসার জন্য আর একমাত্র তারই ইবাদাত করার জন্য। সুতরাং, যদি সহজাত স্বভাবের বিকৃতি সাধন ছাড়াই এটি কারো থেকে চলে যায় তবে এ ব্যাপারে আল্লাহ'ই ভালো জানেন, একমাত্র তাকেই ভালবাসতে হবে। কিন্তু অন্তরের অসুস্থতার কারনে সহজাত প্রবৃত্তি বিকৃত হয়ে থাকে, যেমন - পিতামাতা কর্তৃক একে ইয়াহুদি বা খ্রিস্টান বানানো; এমনকি যদিও এটি আল্লাহ'র ইচ্ছা ও পূর্বনির্ধারণের কারনে হয়, যেমনটি শরীরের পরিবর্তন ঘটে অঙ্গচ্ছেদের দ্বারা। কিন্তু এর পরেও এটি সম্ভব যে অন্তর এর সহজাত স্বভাবে ফিরে আসবে যদি আল্লাহ সে ব্যক্তির জন্য সহজ করে দেন - যে ব্যক্তি সহজাত স্বভাবে ফিরে যাওয়ার জন্য তার সর্বাধিক প্রচেষ্টা করবে।

রসূলদের প্রেরণ করা হয়েছিলো সহজাত স্বভাবের সত্যতা সমর্থন ও এর পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য আর এটিকে যথাযথ করার জন্য, এর পরিবর্তনের জন্য নয়। সুতরাং অন্তর যখন কেবলই আল্লাহকে ভালবাসে, একনিষ্ঠভাবে তার জন্যই দ্বীন পালন করে, তখন এটি অন্য কাউকে ভালবাসবে না।

এখানে প্রবল আবেগতাড়িত ভালোবাসা সহকারে চেষ্টা করার উল্লেখ করা হয়নি, কারন এটি যদি প্রবল আবেগতাড়িত ভালোবাসা দিয়ে নিপীড়িত হতো তবে এটি কেবলই আল্লাহ'র প্রতি ভালোবাসা কমিয়ে দিতো। এ কারনেই ইউসুফ (আঃ) কে যখন তার প্রতি এই প্রবল আবেগতাড়িত ভালোবাসা (ইশক) দ্বারা চেষ্টা করা হয়েছিলো, তখন তার কেবল আল্লাহ'র প্রতি ভালোবাসা আর একমাত্র আল্লাহ'র জন্যই একনিষ্ঠভাবে দ্বীন পালন করা তাকে এর দ্বারা পরাস্ত হতে সম্মতি দেয়নি, বরং আল্লাহ বলেন,
لَوْلَا أَن رَّأَى بُرْهَانَ رَبِّهِ ۚ كَذَلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوءَ وَالْفَحْشَاءَ ۚ إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُخْلَصِينَ (٢٤)
"এভাবেই (আমি ইউসুফকে নৈতিকতার উচ্চমানে প্রতিষ্ঠিত রাখলাম) যেন আমি তার থেকে অন্যায় ও অশ্লীলতাপূর্ণ কাজ দূরে সরিয়ে রাখতে পারি, অবশ্যই সে ছিল আমার নিষ্ঠাবান বানাদাদের একজন।” (সুরা ইউসুফ, ১২ : ২৪)

আল-আযীযের স্ত্রী আর তার জাতি ছিল মুশরিক, তাই সে প্রবল আবেগতাড়িত ভালবাসা দিয়ে নিপীড়িত হয়েছিল। কেবলমাত্র আল্লাহ'র ইবাদাত ও ঈমানের হ্রাস করা ছাড়া কেউই প্রবল আবেগতাড়িত ভালোবাসা (ইশক) দিয়ে নিপীড়িত হয় না।

যে অন্তর আল্লাহ'র কাছে তওবা করে আর তাকে ভয় করে, তার দুটো পথ আছে, যা দ্বারা সে তার এই প্রবল আবেগতাড়িত ভালোবাসা দূর করতে পারে।

📘 অন্তরের ব্যাধি সমূহ ও তার চিকিৎসা > 📄 প্রবল আবেগতাড়িত ভালোবাসা প্রতিরোধের উপায়

📄 প্রবল আবেগতাড়িত ভালোবাসা প্রতিরোধের উপায়


১) আল্লাহ'র কাছে তাওবা করা আর তাকে ভালবাসা, কারন নিশ্চয়ই এটিই হল যেকোন কিছু থেকে অধিকতর সন্তোষজনক ও পবিত্র; আর আল্লাহ'র পাশাপাশি ভালোবাসার মতো আর কিছুই থাকবে না।

২) আল্লাহকে ভয় করা, কারন নিশ্চয়ই ভয় হল প্রবল আবেগতাড়িত ভালবাসার বিপরীত আর এটিকে দূর করে।

সুতরাং, যারা কাউকে গভীর আসক্তি সহকারে বা অন্যভাবে কোন কিছুকে ভালবাসে, তাদের এই ভালোবাসা দূর করা যাবে এর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী অধিকতর প্রিয় কিছুকে ভালোবাসা দ্বারা। ৫৪

এই ভালোবাসা দূর করার আরও একটি উপায় হল এমন ক্ষতিসাধনের ব্যাপারে ভয় করা, যেটি ব্যক্তির নিকট এই ভালোবাসা বর্জন করার থেকেও অধিকতর ঘৃণ্য। সুতরাং যখন গোলামের কাছে যে কোন কিছু থেকে আল্লাহই অধিকতর প্রিয় হবেন আর সে যেকোন কিছু থেকে আল্লাহকেই অধিকতর ভয় করবে, তখন সে প্রবল আবেগতাড়িত ভালোবাসায় পড়বে না বা আল্লাহ'র প্রতি ভালোবাসার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী কোন ভালোবাসা পাবে না এটি ব্যতীত যে অবহেলা করা বা কিছু ফরয দায়িত্ব ও কিছু হারাম কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে এই ভালোবাসা ও ভয় দুর্বল হয়ে যাবে। কারন, নিশ্চয়ই ঈমান বৃদ্ধি পায় আল্লাহ'র আনুগত্য করার মাধ্যমে আর কমে যায় আল্লাহ'র অবাধ্য হওয়ার মাধ্যমে। সুতরাং গোলাম যখন ভালোবাসা ও ভয়বশত আল্লাহ'র আনুগত্য করবে আর তার প্রতি ভালোবাসা ও ভয়বশত একটি হারাম কাজ ত্যাগ করবে, তার ভালোবাসা ও ভয় অধিকতর শক্তিশালী হবে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর প্রতি ভালোবাসা বা ভয় তার অন্তর থেকে চলে যাবে।

টিকাঃ
(৫৪) ইবনুল কায়ি‍্যমের রাওদাহ আল-muhibbin কিতাবে এর উল্লেখ আছে, এ সম্পর্কে তার চমৎকার এক আলোচনা আছে।

লিঙ্ক শেয়ার করুন
close

লিঙ্ক কপি করুন