📄 লেখক পরিচিতি (১) - শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ.)
"আমার কথা দিয়ে আমি তার ব্যাপারে যত না বর্ণনা করতে পারবো অথবা আমার কলম দিয়ে তিনি যে কত প্রখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন তা লোকদেরকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবো, তিনি তার চেয়েও মহান। তার জীবন, তার জ্ঞান, তার দুঃখ-দুর্দশা এবং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তার সফরগুলো বইয়ের বিশাল দুটো খন্ড পূর্ণ করে দিবে।" - ইমাম আয-যাহাবি (রহ.)
তার নাম, জন্ম ও বংশপরিচয়ঃ তিনি হলেন তাকিউদ্দিন আবুল 'আব্বাস আহমাদ ইবনে শায়খ শিহাবুদ্দিন আবদুল হালিম ইবনে আবুল কাসিম ইবনে তাইমিয়্যাহ আল-হাররানি। তিনি ৬৬১ হিজরি সনের ১০ই / ১২ই রবিউল আউওয়াল মাসে উত্তর ইরাকের হাররানে এক ইলমী ঘরানার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা আবদুল হালিম ইবনে তাইমিয়্যাহ তার নাম রাখেন আহমাদ তাকিউদ্দিন, বড় হলে তিনি আবুল আব্বাস ডাক নাম রাখেন। কিন্তু খানদানী উপাধি 'ইবনে তাইমিয়্যাহ' সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায় আর এ নামেই তিনি পরিচিতি লাভ করেন।
তার পরিবারের চতুর্থ পুরুষ তার পরদাদা মুহাম্মাদ ইবনুল খিযির থেকেই পরিবারটি তাইমিয়্যাহ পরিবার হিসেবে পরিচিত হয়। মুহাম্মাদ ইবনুল খিযিরের মায়ের নাম ছিল তাইমিয়্যাহ, তিনি ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী। বাগ্মীতায় তার অসাধারণ খ্যাতি কিছুদিনের মধ্যেই পরিবারটিকে তাইমিয়্যাহ পরিবার নামে সর্বত্র পরিচিত করে।
তার দাদা মাজদুদ্দিন ইবনে তাইমিয়্যাহ সেই সময়ে হাম্বলী মাযহাবের শ্রেষ্ঠ আলিমদের মধ্যে গণ্য হতেন, কেউ কেউ তাকে মুজতাহিদ হিসেবেও উল্লেখ করেন। তিনি মুনতাকা আল- আখবার নামক বিখ্যাত কিতাব রচনা করেন। পরবর্তীতে ত্রয়োদশ হিজরি সনের শ্রেষ্ঠ আলিম ও মুহাদ্দিস ইমাম শাওকানি 'নাইলুল আওতার' নামে এই কিতাবের বার খন্ডের ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করে কিতাবটির গভীরতা ও শ্রেষ্ঠত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।
তার পিতা শিহাবুদ্দিন আবদুল হালিম ইবনে তাইমিয়্যাহও একজন শ্রেষ্ঠ আলিম, মুহাদ্দিস ও হাম্বলি ফিকাহ শাস্ত্রবিদ ছিলেন। হিরান থেকে দামেশকে চলে আসার পরপরই তিনি দামেশকের জামে উমুবিতে দরসের সিলসিলা চালু করেন। দামেশকের এ কেন্দ্রীয় মসজিদটি ছিল দেশের শ্রেষ্ঠ উলামা, ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণের কেন্দ্রস্থল। কাজেই সেখানকার শ্রেষ্ঠ আলিমদের উপস্থিতিতে দরস দেওয়া চাট্টিখানি কথা ছিল না। তার দরসের বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তিনি সম্পূর্ণ স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভর করে বড় বড় কিতাবের বরাত দিয়ে দরস করে যেতেন, সামনে কোন কিতাবই থাকতো না। দামেশকের দারুল হাদিস আসসিকরিয়ায় তাকে হাদিস ও হাম্বলি ফিকহের উপর শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
তার শিক্ষকঃ
ইবনে তাইমিয়্যাহ তার পিতা এবং অনেক প্রখ্যাত আলিম থেকে দ্বীন শিক্ষা লাভ করেন। তিনি দুইশ'র বেশী আলিম ও আলিমাহ থেকে দ্বীনের ইলম হাসিল করেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন আলিম ও আলিমাহ হলেন - আবু আল-আব্বাস আহমাদ ইবনে আবদুদ দা'ইম আল- মাকদাসি, আবু নাসর আব্দুল-আযিয ইবনে আব্দুল-মুন'ইম, আবু মুহাম্মাদ ইসমা'ইল ইবনে ইব্রাহিমি তানুখি, সিত আদ-দার বিনতে আবদুস সালাম ইবনে তাইমিয়্যাহ, আহমাদ ইবনে আহমাদ আশ শাফি'ই, শারফুদ্দিন আল- মাকদাসি প্রমুখ।
ইবনে তাইমিয়্যাহ'র পিতা তাকে সাত বছর বয়সে দামেস্কে নিয়ে যাওয়ার ফলে তার সৌভাগ্য হয় শ্রেষ্ঠ আলিমদেরদের সংস্পর্শে থেকে ইলম হাসিল করার। তিনি কখনো কখনো একটি আয়াতের অর্থ অনুধাবনের জন্য একশটির বেশী তাফসীর অধ্যয়ন করতেন। তিনি শুধুমাত্র তাফসীর কিতাব পাঠের মাধ্যমেই নিজের জ্ঞান স্পৃহাকে আবদ্ধ করে রাখতেন না, বরং তিনি মুফাসসিরদের কাছে চলে যেতেন আর তাদের সাথে সরাসরি আলোচনা করতেন। তিনি ফিকহ ও হাদিসের বড় বড় আলিমদের পাঠচক্রে গিয়ে তাদের কাছ থেকে ইলম অর্জন করতেন, এমনকি তাদের সাথে বিতর্কও করতেন, অথচ তিনি তখনও যুবক ছিলেন।
তার জ্ঞানগত মর্যাদাঃ
ইবনে তাইমিয়্যাহ'র যুগে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান এতটা বিস্তৃতি লাভ করেছিলো এবং কুরআন ও হাদিসশাস্ত্রের এতো বিশাল ও বিস্তৃত ভাণ্ডার সংগৃহীত হয়ে গিয়েছিলো যে, কোন লোকের পক্ষেই অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী হওয়া ছাড়া সে সব জ্ঞানভাণ্ডার আয়ত্তে আনা যেমন সম্ভব ছিল না, তেমনি বিতর্কিত মাসাইল ও সমস্যার ক্ষেত্রে সমসাময়িক খ্যাতনামা আলিম ও পন্ডিত ব্যক্তিদের সামনে কেউ মুখ খোলার সাহস করতেও পারতো না। একই সাথে কোন মাসআলার ব্যাপারে পূর্ববর্তী কোন আলিমের পেশকৃত সিদ্ধান্তের সাথে মতভেদের অধিকারও থাকতো না।
কিন্তু আল্লাহ তা'আলা ইবনে তাইমিয়্যাহকে যে স্মৃতিশক্তি ও ধারণশক্তি দান করেছিলেন তার সাহায্যে তিনি তাফসীর, হাদিস, রিজালশাস্ত্র, ফিকহ, উসুল, উসুলে ফিকহ, সিরাত, আসার, ইমামদের মতভেদ সম্পর্কিত বিষয়শাস্ত্র, কালামশাস্ত্র, ইতিহাস, অভিধান ও ব্যাকরণশাস্ত্রের যে বিরাট জ্ঞানভাণ্ডার তখন পর্যন্ত গড়ে উঠেছিলো, যত কিতাব ও উৎস-উপকরণ তখন পর্যন্ত বর্তমান ছিল এবং যে পর্যন্ত তার দক্ষতা ও ক্ষমতা ছিল, সেগুলো অধ্যয়ন করেন আর তার শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত স্মৃতিশক্তির সাহায্যে সেগুলো নিজের বুকে ধারণ করেন। এরপর তিনি তার জ্ঞানগত ও লেখক জীবনে সেগুলো থেকে সেভাবে সাহায্য সহায়তা গ্রহণ করেন যেভাবে একজন যুদ্ধাভিজ্ঞ তীরন্দাজ তার তৃণীরের সাহায্য নিয়ে থাকে।
সমসাময়িক সকলেই তার অসাধারণ স্মৃতিশক্তি, ধারণ ক্ষমতা, উল্লেখযোগ্য মেধা ও ধীশক্তির স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং তার সমসাময়িক ও পরবর্তী যুগের সকলেই তার এ গুনের ব্যাপারে একমত। তার কিছু সমসাময়িক ব্যক্তি এমন পর্যন্ত বলেছেন যে কয়েক শতাব্দী যাবত এতো বড় স্মৃতিশক্তির অধিকারী আর কেউ জন্মগ্রহণ করেননি।
একবার তিনি সূরা ইখলাসের প্রথম আয়াত "বলঃ তিনি আল্লাহ, এক ও অদ্বিতীয়।” এর এমন এক তাফসীর করেন যেটি লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে তা বড় এক খন্ডের তাফসীরে রূপ নিলো, এটি তাফসীরে সুরাতুল ইখলাস নামে পরিচিত। সূরা তোয়া-হা এর পঞ্চম আয়াত “আর-রহমান আরশে সমাসীন।” এর তাফসীর প্রায় ৩৫ খন্ড পূর্ণ করে দিয়েছিলো। জুমুআর দিনে তিনি সূরা নূহ এর তাফসীর করা শুরু করলে কয়েক বছর যাবত এই তাফসীর চলতে থাকে।
ইবনে তাইমিয়্যাহ তার ধারালো বোধশক্তি দ্বারা সহজেই কুরআনের সবচেয়ে জটিল অর্থগুলোর অনুসন্ধান করতে পারতেন। তার ক্লাসে কোন ছাত্র কোন আয়াত পাঠ করলে তিনি সেই আয়াতের তাফসীর করা শুরু করতেন, আর সেই তাফসীরের দীর্ঘতা এমন হতো যে সেটি দিয়েই ক্লাস সমাপ্ত হতো। সময়ের ঘাটতি বা ছাত্রদের বিশ্রাম দেওয়া ছাড়া তিনি তাফসীর প্রদানে থামতেন না। তিনি অনেক দৃষ্টিকোণ থেকেই আয়াতের তাফসীর করতে পারতেন।
একবার তাকে একটি হাদিস- “আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে অভিশাপ দিয়েছেন, যে ব্যক্তি একজন তালাকপ্রাপ্ত নারীকে বিয়ে করে তার প্রথম স্বামীর জন্য তাকে হালাল করার উদ্দেশ্যে, এবং সেই স্বামীকেও যে সেই নারীকে ফিরিয়ে নেয়।” সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল। তিনি এর এমন এক বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিলেন যে যেটি লিপিবদ্ধ করলে তা পুরো এক খন্ডের কিতাবে পরিণত হয়, এই কিতাবটি 'ইকামাত আদ-দালিল 'আলা বুতলান আত- তাবিল নামে পরিচিত। এটি একেবারেই বিরল যে তার নিকট কুরআনের কোন আয়াত বা কোন হাদিস বা বিধানের ব্যাপারে উল্লেখ করা হলে তিনি পুরো দিন জুড়ে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করতেন না।
ইমাম আয-যাহাবি বলেন, "হাদিসের মূল পাঠ 'মতন' অধিক পরিমাণে মনে রাখতে, সময়মত তা থেকে সহায়তা গ্রহণ করতে, বিশুদ্ধ বরাত প্রদানে এবং সম্পর্ক সূত্র বর্ণনায় তার চেয়ে অধিক পারদর্শী আর কাউকেই আমি দেখিনি। হাদিসের বিপুল বিস্তৃত ভান্ডার যেন তার চোখের সামনে ও ঠোঁটের কোণে ভেসে বেড়াতো। তার সম্পর্কে এ কথা বলা যথার্থ হবে যে, ইবনে তাইমিয়্যাহ যে হাদিস জানেন না তা কোন হাদিসই না।”
মহান আল্লাহ তাকে আলিমদের ইখতিলাফ, তাদের বক্তব্য, ভিন্ন বিষয়ে তাদের ইজতিহাদ এবং প্রত্যেক যুগের প্রত্যেক আলিমদের শক্ত, দুর্বল, গৃহীত ও প্রত্যাখ্যাত মতামত সম্পর্কে ইলম হাসিলের তাওফিক দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তার খুব সূক্ষ্মদৃষ্টি ছিল যে, তাদের কোন মতামতটি ছিল সবচেয়ে বিশুদ্ধ আর সত্যের সবচেয়ে নিকটবর্তী, আর তিনি সেটি প্রত্যেক আলিমের নাম উল্লেখ করেই করতে পারতেন। তাকে যদি কোন মতামতের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হতো তবে তিনি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রত্যেক হাদিস, সাহাবী ও প্রথম প্রজন্মের আলিম থেকে তার প্রজন্ম পর্যন্ত আলিমদের উক্তি এসব কিছু থেকে তিনি যেটি ইচ্ছা করতেন সেটি গ্রহণ করতেন আর যেটি ইচ্ছা সেটি ত্যাগ করতেন। তার সাথীরা তার চল্লিশ হাজারের বেশী ফাতওয়ার সঙ্কলন করেন। এটি খুবই দুর্লভ যে তাকে কোন কিছুর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি দ্রুত তার জবাব দিতে পারেননি, তিনি এটির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তার জবাবগুলো একেকটি কিতাবে পরিণত হতো।
একবার এক ইয়াহুদী তাকে ৮ লাইনের কবিতা আকারে আল- কদর সম্পর্কে প্রশ্ন করে। তিনি এর জবাব দেন ১৮৪ লাইনের কবিতা দিয়ে, এই কবিতাটি ব্যাখ্যা করার জন্য দু-দুটো বড় খন্ডের কিতাব রচনার প্রয়োজন হতো।
আরবি ব্যাকরণে ইবনে তাইমিয়্যাহ এমনই দক্ষতা অর্জন করেন যে সে সময়কার বিশিষ্ট ব্যাকরণবিদ আবু হাইয়ান তার কাছে যান আর তার প্রশংসায় কবিতা লিখেন। ইবনে তাইমিয়্যাহ আরবি ব্যাকরণের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও জনপ্রিয় কিতাব, ইমাম সিবাওায়হ এর 'আল-কিতাব' বিশেষ যত্ন ও মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করেন আর এর দুর্বল স্থান ও ভুল ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করেন। আর এই কিতাবের আশিটি স্থানে ভুলের উল্লেখ করার পর আবু হাইয়ান চিরদিনের জন্য তার বিরোধী ও সমালোচকে পরিণত হয়।
পিতার মৃত্যুর পর তিনি মাত্র বাইশ বছর বয়সে দারুল হাদিস আসসিকরিয়ায় তার প্রথম দরস প্রদান করেন। এ দরস প্রদানকালে দামিশকের বড় বড় আলিম উপস্থিত ছিলেন। তারা তার দরস দ্বারা প্রভাবিত হোন এবং যুবক ইবনে তাইমিয়্যাহ'র জ্ঞানের গভীরতা, উপস্থিত বুদ্ধি, সাহসিকতা ও ভাষার অলংকারের স্বীকৃতি দান করেন। এ দরসের প্রায় এক মাস পর তিনি জুমুয়ার দিনে তার পিতার স্থলে উমাইয়া মসজিদে তাফসীরের দরস প্রদান করেন। তার জন্য বিশেষভাবে মিম্বর রাখা হয়েছিলো। তার তাফসীর শোনার জন্য দিনে দিনে লোক সমাগম বাড়ছিলো।
যেহেতু তিনি ছিলেন একজন মুজতাহিদে মুতলাক, তাই তিনি নিজেকে নির্দিষ্ট কোন মাযহাবে আবদ্ধ করে রাখেননি, বরং মুজতাহিদে মুতলাক হওয়ার ফলে তিনি তার মতামতের ক্ষেত্রে সরাসরি শারিয়াহ'র উৎসে চলে যেতে পারতেন।
তাকিউদ্দিন ইবনে দাকিকুল ঈদ এর মর্যাদা হাদিসশাস্ত্রে সর্বজনস্বীকৃত এবং সে যুগের উলামায়ে কেরাম সর্বতোভাবে তাকে তাদের ইমাম ও মুরব্বী হিসেবে মানতেন। ৭০০ হিজরি সনে ইবনে তাইমিয়্যাহ মিসরে গেলে ইবনে দাকিকুল ঈদের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে। এই সাক্ষাতের পর তিনি তার মনোভাব এভাবে ব্যক্ত করেন "ইবনে তাইমিয়্যাহ'র সাথে আমার যখন সাক্ষাৎ হল তখন আমি অনুভব করলাম যে জ্ঞানবিজ্ঞানের সকল শাখা প্রশাখাই তার নখদর্পণে; তিনি যেটি ইচ্ছা গ্রহণ করেন আর যেটি ইচ্ছা পরিত্যাগ করেন।"
প্রখ্যাত আলিম ও বহু শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত কামালুদ্দিন ইবনুয- যামালকানী বলেন, "জ্ঞানবিজ্ঞানের কোন শাখায় তাকে যখন কোন প্রশ্ন করা হয় তখন (অবলীলায় তাকে প্রশ্নের উত্তর দিতে দেখে) দর্শক ও শ্রোতা মনে করে যে তিনি কেবল সংশ্লিষ্ট বিষয়টিই জানেন এবং তার সম্পর্কে এই ধারণা করতে বাধ্য হোন যে এই শাস্ত্রে তার মতো জ্ঞানী আর কেউ নেই।”
ইমাম আয-যাহাবির মতো বিস্তৃত দৃষ্টির অধিকারী ঐতিহাসিক ও সমালোচক মনীষী তার ব্যাপারে বলেছেন, "যদি রুকন ও মকামে ইব্রাহীমের মাঝে আমাকে কেউ কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করে তবে আমি হলফ করে বলবো, ইলমের ক্ষেত্রে তার মতো আর কেউকে আমি দেখিনি এবং তিনিও তার সমতুল্য আর কাউকে দেখেননি।”
যদিও ইতিহাস তার বিষয় ছিল না আর এটিকে তিনি তার আলোচ্য বিষয় হিসেবেও গ্রহণ করেননি, এরপরেও ইতিহাস সম্পর্কে তার জ্ঞানের গভীরতা, প্রশস্ত দৃষ্টি ও উপস্থিত বুদ্ধির একটি বিস্ময়কর ঘটনা ইবনুল কায়্যিম বর্ণনা করেন, ঘটনাটি হলঃ
একটি মুসলিম দেশে (সম্ভবত সিরিয়া বা ইরাকে) ইয়াহুদীরা একটি প্রাচীন দস্তাবেজ (লিখিত দলীল) পেশ করে, যা দেখে তা প্রাচীনকালে লিখিত এবং কাগজও বেশ পুরনো আমলের মতো বলে মনে হচ্ছিলো। সেখানে লিখিত ছিল, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) খায়বারের ইয়াহুদীদেরকে জিযিয়া প্রদানের হাত থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছিলেন। লিখিত দস্তাবেজটির উপর আলী (রাঃ), সা'দ ইবনে মু'আয (রাঃ) ও সাহাবীদের অনেকেরই সিগনেচার ছিল। ইতিহাস ও জীবন-চরিত সম্পর্কে আর সে যুগের অবস্থা সম্পর্কে গভীর ও বিস্তৃত দৃষ্টি ছিল না এমন কিছু অজ্ঞ লোক ইয়াহুদীদের এই প্রতারনার শিকার হয় ও এর যথার্থতা সম্পর্কে তাদের নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মে যায় আর তারা এর উপর আমল করতে শুরু করে এবং ইয়াহুদীদেরকে জিযিয়া প্রদানের হাত থেকে নিষ্কৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ দস্তাবেজ ইবনে তাইমিয়্যাহ'র সামনে উপস্থাপন করা হলে তিনি একে বিশ্বাসের একেবারেই অযোগ্য ও জাল বলে মত প্রকাশ করেন এবং এর জাল ও বানোয়াট হওয়া সম্পর্কে দশটি দলীল পেশ করেন। এগুলোর মধ্যে একটি দলীল হল এই যে, দস্তাবেজের উপর সা'দ ইবনে মু'আয (রাঃ) এর সিগনেচার আছে, অথচ খায়বার যুদ্ধের আগেই তিনি ইন্তিকাল করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, দস্তাবেজে উল্লেখ রয়েছে যে ইয়াহুদীদেরকে জিযিয়া থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে, অথচ তখন পর্যন্ত জিযিয়ার হুকুমই নাযিল হয়নি আর সাহাবীরাও এ সম্পর্কে কিছু জানতেন না। জিযিয়ার হুকুম খায়বারের যুদ্ধের তিন বছর পর তাবুক যুদ্ধের বছরে নাযিল হয়। তৃতীয়ত, এতে উল্লেখ রয়েছে যে ইয়াহুদীদেরকে বেগার (বিনা মজুরির শ্রম) খাটানো যাবে না; এটি একটি অবান্তর বিষয়, কারন ইয়াহুদী বা অ-ইয়াহুদী কারো থেকেই বেগার শ্রম গ্রহণ রীতিসিদ্ধ ছিল না। নিশ্চয়ই রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং সাহাবীরা এ ধরণের জুলুম ও জবরদস্তি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন; বরং এটি তো হল অত্যাচারী ও নিপীড়ক বাদশাহদের আবিস্কার যা আজ পর্যন্ত চলে আসছে। চতুর্থত, জ্ঞানী-গুণী, সিয়ার ও মাগাযির লেখক, মুহাদ্দিস, ফকিহ ও মুফাসসিরদের কেউই এ ধরণের কোন দস্তাবেজের উল্লেখ বা আলোচনা করেননি এবং ইসলামের প্রথম যুগগুলোতেও এ দলীলের অস্তিত্ব প্রকাশ পায়নি। তাই সঙ্গত কারনেই বলা চলে যে এ দস্তাবেজ জাল, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট এবং এ ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রমাণ রয়েছে। শায়খুল ইসলামের উল্লেখিত বিশ্লেষণে ইয়াহুদীদের সকল জারিজুরি ফাঁস হয়ে যায় আর তাদের কৃত্তিমতার সকল মুখোশ খুলে পড়ে।
যুহদ ও ইবাদাতঃ ইবনে তাইমিয়্যাহ যখন অল্পবয়স্ক ছিলেন, তখন তার পিতা তার কুরআনের শিক্ষককে চল্লিশ দিরহাম দিয়ে বললেন যে তিনি যেন তার সন্তানকে কুরআন তিলাওয়াত ও এর উপর আমল করানোয় উৎসাহ প্রদান করার উদ্দেশ্যে তাকে প্রতি মাসে সেই চল্লিশ দিরহাম প্রদান করেন। সুতরাং তার শিক্ষক যখন তাকে এই চল্লিশ দিরহাম দিতে গেলেন তখন ইবনে তাইমিয়্যাহ তা গ্রহণ করতে প্রত্যাখ্যান করলেন আর বললেন, "হে আমার শিক্ষক, আমি আল্লাহ'র নিকট ওয়াদা করেছি যে আমি কুরআনের জন্য কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করবো না।”
ইবনুল কায়্যিম বলেন, "ফজরের সালাত আদায়ের পর তিনি স্বস্থানেই বসে থাকতেন আর বসে থাকতে থাকতেই বেলা বেড়ে যেতো। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতেনঃ এটিই আমার নাস্তা, এটি গ্রহণ না করলে আমার শক্তিতে ভাটা পড়বে আর শেষ পর্যন্ত আমার কর্মশক্তিই লোপ পাবে।”
ইমাম আয-যাহাবি বলেন, "তার মতো কাঁদতে, আল্লাহ'র দরবারে সাহায্য চাইতে ও ফরিয়াদ জানাতে এবং তারই দিকে তাওাজ্জুহ (গভীর মনোনিবেশ) করতে আমি আর কাউকে দেখিনি। তিনি বিশেষ বিশেষ সময়ের আমল ও যিকরসমূহ পাবন্দীর সাথে এবং সর্বাবস্থায় অত্যন্ত যত্নের সাথে আদায় করতেন।”
আল কাওাকিব কিতাবে তার ব্যাপারে উল্লেখ আছে যে তিনি যখন সালাত শুরু করতেন তখন তার কাঁধ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গদি কাঁপত, এমন কি ডানে বামে স্পন্দিত ও শিহরিত হতো।
শায়খ 'আলামুদ্দিন আল-বারযালী বলেন, "শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার অবস্থা একই রকম ছিল, আর সেটি হল এই যে, তিনি দারিদ্র্যকেই সবসময় অগ্রাধিকার দিয়েছেন। দুনিয়ার সাথে নামকাওয়াস্তে অর্থাৎ যতটুকু না হলেই নয়, ততটুকু মাত্র সম্পর্ক রেখেছিলেন, আর যেটুকু পেয়েছেন তাও ফিরিয়ে দিয়েছেন।”
তার দানশীলতা এমনই ছিল যে, দেওয়ার মতো কিছু না থাকলে তিনি সতর ঢাকার পরিমাণ কাপড় রেখে শরীরের কাপড় খুলে তা দিয়ে দিতেন। খাবারের ভেতর থেকে একটি দুটি রুটি বাঁচিয়ে রাখতেন আর নিজের প্রয়োজন উপেক্ষা করে অন্যকে তা দিয়ে দিতেন।
তিনি ছিলেন একজন ক্ষমাশীল ব্যক্তি। তার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ কাযী ইবনে মাখলুফ মালিকী তার সম্পর্কে বলে, "আমরা ইবনে তাইমিয়্যাহ'র মতো মহান ও উদারচেতা আর কাউকে দেখিনি। আমরা সুলতানকে তার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেছি, কিন্তু তিনি ক্ষমতা পাওয়ার পর আমাদেরকে পরিস্কার মাফ করে দিয়েছেন আর উল্টো আমাদের পক্ষে সুপারিশ করেছেন।”
ইবনুল কায়্যিম বলেন, "তিনি শত্রুর জন্যও দুয়া করতেন, আমি তাকে একজনের বিরুদ্ধেও বদদুয়া করতে দেখিনি। একদিন আমি তার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ও এমন এক মানুষের মৃত্যুর খবর নিয়ে আসলাম, যে শত্রুতা সাধনে ও যন্ত্রণা প্রদানে সকলের তুলনায় অগ্রগামী ছিলো। তিনি আমাকে ধমক দিয়ে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন আর 'ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন' পাঠ করলেন। এরপর তিনি তার বাড়িতে গেলেন, তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করলেন, সমবেদনা জানালেন আর পরিবারের লোকদের (সান্ত্বনা দিয়ে) বললেনঃ তিনি চলে গেলেও আমি তো রয়েছি। তোমাদের যখন যা দরকার হবে আমাকে বলবে, আমি তোমাদেরকে সে ব্যাপারে সাহায্য করবো।”
হাফিয সিরাজুদ্দিন আল-বাযযার বলেন, “আল্লাহ'র কসম! আমি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর এতো আদব ও এতো ভক্তি- সম্মান প্রদর্শনকারী, তার আনুগত্য ও অনুসরণকারী এবং দ্বীনের সাহায্য করতে আগ্রহী - ইবনে তাইমিয়্যাহ'র চেয়ে বেশী আর কাউকে দেখিনি।”
'আল্লামা 'ইমাদুদ্দিন আল-ওয়াসিতি বলেন, "আমরা আমাদের যুগে একমাত্র ইবনে তাইমিয়্যাহকেই পেয়েছি, যার জীবনে নবুওওয়াতে মুহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নূর এবং যার কথায় ও কাজে সুন্নাহ'র আনুগত্য ও অনুসরণ স্পষ্ট প্রতীয়মান ছিল। সুস্থ মন-মানস এ কথার সাক্ষ্য দিতো, প্রকৃত আনুগত্য ও পরিপূর্ণ অনুসরণ একেই বলে।”
এছাড়াও ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ তাতার, খ্রিস্টান আর রাফেজিদের বিরুদ্ধে জিহাদে এবং বিভিন্ন ভ্রান্ত মতবাদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
সংগ্রামী জীবনঃ
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ এমন এক সময়ে জন্মলাভ করেছিলেন সে সময়টাতে এই উম্মাহ'র জন্য তার মতো এ মহান ব্যক্তিত্বের খুবই দরকার ছিল। উম্মাহ'র মধ্যে শিরক, বিদআত ও বিভিন্ন বিভ্রান্তিপূর্ণ মতবাদের অনুপ্রবেশ, হিংস্র তাতারিদের বর্বর আক্রমণসহ বিভিন্নমুখী বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে দৃঢ়পদে রুখে দাঁড়িয়ে ও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি এই উম্মাহকে পুনরজ্জীবিত করেছেন। তবে শুধুমাত্র এটুকু বলার মাধ্যমেই তার সংগ্রামী জীবন প্রকৃতভাবে অনুধাবন করা সম্ভব না আর এটি তার কোন জীবনীগ্রন্থও নয় যে তার ব্যাপারে বিস্তারিত উল্লেখ করা হবে, বরং খুবই সংক্ষিপ্ত পরিসরে তার সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে কিছু তথ্য এখানে উপস্থাপন করা হবে।
আল-বাযযার বলেন, "প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তি এ ব্যাপারে একমত যে ইবনে তাইমিয়্যাহ হলেন সেই ব্যক্তিদের একজন, যার ব্যাপারে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, 'নিশ্চয়ই আল্লাহ এ উম্মাতের জন্য প্রতি শতাব্দীতে এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন যিনি দ্বীনের সংস্কার করবেন।' ১০ আল্লাহ তার মাধ্যমে শারিয়াহ'র ইস্যুগুলোকে পুনরজ্জীবিত করেছেন, যেগুলো সময়ের পরিবর্তনে বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিলো এবং আল্লাহ তার যুগের সকল লোকদের বিরুদ্ধে তাকে প্রমাণ হিসেবে স্থাপন করলেন। সকল প্রশংসা তো একমাত্র রব্বুল আ'লামিন আল্লাহ'র।”
সপ্তম হিজরির প্রথমার্ধে 'তাতার' শব্দটিই ছিল মুসলিমদের কাছে ভীতি ও আতংকের প্রতীক। তাতারিদের হাতে একের পর এক মার খেতে খেতে মুসলিমরা বিশ্বাস করে নিয়েছিল যে তাতারিরা অজেয়। আরবিতে একটা প্রবাদ ছিল তাদের ব্যাপারে - 'যদি বলা হয় তাতারিরা হেরে গেছে তাহলে সে কথা বিশ্বাস করো না।' তারা ছিল এমনই বর্বর যে ঐতিহাসিক ইবনে আসির তাদের সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, “... তারা গর্ভবতী মেয়েদের পেট তরবারি দিয়ে ফাটিয়ে দিয়েছে আর পেট থেকে বের হয়ে আসা অপরিপুষ্ট বাচ্চাকেও টুকরো টুকরো করেছে।”
ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম তাতারি শাসক কাযান ৬৯৯ হিজরিতে সিরিয়া আক্রমণের জন্য দামেস্ক অভিমুখে সেনাবাহিনী সহকারে যাত্রা শুরু করে, এরপর দামেস্কের বাইরে কাযান ও সুলতানের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুসলিমরা দৃঢ়তা ও বীরত্বের সাথে লড়াই করার পরও তাতারিদের কাছে পরাজিত হয়। সুলতানের বাহিনী মিসর অভিমুখে রওনা হয়, দামেস্কবাসি শহরের অভ্যন্তরে আশ্রয় গ্রহণ করে, বড় বড় উলামায়ে কেরামগণ ও নেতৃস্থানীয় লোকেরা মিসর অভিমুখে পাড়ি জমানোর চিন্তা শুরু করে দিলো, অনেকে এর মধ্যেই শহর ছেড়ে চলে যায়, কয়েদীরা জেল ভেঙে বের হয়ে শহরে তান্ডব চালিয়ে দেয়, অসৎ ও চরিত্রহীন লোকেরা এ সুযোগ কাজে লাগায়। এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে ইবনে তাইমিয়্যাহ ও শহরের সম্মানিত নাগরিকবৃন্দ এক পরামর্শসভায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে তারা কাযানের সাথে দেখা করবেন। ইবনে তাইমিয়্যাহ'র সাথে যাওয়া এক সাথী শাইখ কামালুদ্দিন ইবনুল আনযা কাযানের সাথে সেই সাক্ষাৎকারের বর্ণনা দেন এভাবেঃ
"আমি শায়খের সঙ্গে সেই মজলিসে উপস্থিত ছিলাম। তিনি কাযানকে আদল ও ইনসাফ সম্পর্কিত কুরআনের আয়াত ও হাদিস আর এ সম্পর্কিত হুকুম-আহকাম শোনাচ্ছিলেন। তার আওয়াজ ক্রমান্বয়ে উঁচু হচ্ছিলো আর তিনি ক্রমেই কাযানের নিকটবর্তী হচ্ছিলেন, এমন কি এক পর্যায়ে তার হাঁটু কাযানের হাঁটুর সাথে লেগে যাওয়ার উপক্রম হয়। অবশ্য কাযান তাতে কিছু মনে করেনি। সে অত্যন্ত মনোযোগের সাথে শায়খের কথা শুনছিল। তার সমগ্র দেহ-মন শায়খের প্রতি নিবিষ্ট ছিল। শায়খের প্রতি ভক্তিযুক্ত ভয় ও প্রভাব তাকে এতটা আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো আর সে তা দিয়ে এতো বেশী প্রভাবিত ছিল যে সে সমস্ত লোকদের জিজ্ঞেস করলো, 'কে এই আলিম? আমি আজ পর্যন্ত এমন লোক দেখিনি আর এ ব্যক্তির চেয়ে অধিকতর সাহসী ও শক্ত অন্তঃকরণের ব্যক্তি আজ পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি। আজ পর্যন্ত আমার উপর কারো আর এমন প্রভাব পড়েনি।' লোকেরা তার পরিচয় তুলে ধরেন আর তার জ্ঞান, বিদ্যাবত্তা ও আমলি কামালিয়াত সম্পর্কে আলোচনা করেন।
ইবনে তাইমিয়্যাহ কাযানকে বলেন, 'তুমি দাবী করো যে তুমি মুসলিম, আর আমি জানতে পেরেছি যে তোমার সাথে কাযি, ইমাম আর মুণ্ডাযযিনও সাথে থাকে। কিন্তু এরপরেও তুমি মুসলিমদের উপর হামলা করেছো। ...... আল্লাহ'র বানাদাদের উপর তুমি যুলুম করেছো।'"
এটি ছিল শায়খ ইবনে তাইমিয়্যাহ'র সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের একটা উদাহারন মাত্র।
৭০২ হিজরিতে তাতারিদের সাথে চূড়ান্ত যুদ্ধের পূর্বে এই প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে - তাতারিরা মুসলিম, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ইসলামী শারিয়াহ মতে যুক্তিসঙ্গত হতে পারে? উলামায়ে কেরামগণ এ ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের শিকার হলে ইবনে তাইমিয়্যাহ সব সংশয়ের নিরসন ঘটিয়ে বলেন যে তারা খারেজীদের ন্যায় বিবেচিত হবে। তিনি আলিমদেরকে এর ব্যাখ্যা দিলে আলীমগণ সেই ব্যাখ্যা মেনে নেন। এরপর ইবনে তাইমিয়্যাহ সুলতানের সাথে দেখা করে তার সাথে আলোচনা করার মাধ্যমে সুলতানের মনোবল ও দৃঢ়তা বৃদ্ধি করেন। সুলতান তাকে অনুরোধ করেন যুদ্ধের সময় সুলতানের সাথে থাকার জন্য। অতঃপর ৩রা রমাদান সিরিয়া ও মিসরের বাহিনীর সাথে তাতারিদের যুদ্ধ শুরু হয়, এক প্রচন্ড যুদ্ধের পর মুসলিমরা জয় লাভ করেন। ৪ঠা রমাদান ইবনে তাইমিয়্যাহ দামেস্কে প্রবেশ করলে লোকেরা তাকে মহা আড়ম্বরে অভ্যর্থনা জানায়, মুবারাকবাদ দেন আর তার জন্য দুয়া করেন।
এছাড়া রাফেযি (বাতিনী, ইসমাঈলী, হাকিমী ও নুসায়রী) গোত্রগুলো, যারা ক্রুসেডার ও তাতারিদেরকে মুসলিমদের উপর হামলা পরিচালনায় উস্কানি দিয়েছিলো আর এজন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করেছিলো, তিনি ৭০৫ হিজরিতে সেসব ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনা করেন।
উম্মাহ'র মধ্যে আকিদাহগত যে ভ্রান্ত মতবাদ ছড়িয়ে পড়েছিলো, তিনি তার বিরুদ্ধেও জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ওয়াহদাতুল উজুদ, কবর ও মাযার পূজা, আল্লাহ'র ব্যাপারে ঠাট্টা করা ইত্যাদি শিরক ও বিদআতের বিরুদ্ধে তিনি আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ'র ঝাণ্ডা দৃঢ়ভাবে বহনের মাধ্যমে সংগ্রাম করে যান আর হককে পুনরুজ্জীবিত করেন।
আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকিদা এবং খুলাফায়ে রাশেদিন ও সাহাবায়ে কেরামদের পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষায় ইবনে তাইমিয়্যাহ বিভিন্ন সময়ে শক্ত হাতে কলম ধরেছিলেন। সমসাময়িক শিয়া আলিম ইবনুল মুতাহহিরের একটি বই ছিল, যেটির ব্যাপারে শিয়াদের গর্ব ছিল যে আহলে সুন্নাহ'র কোন আলিমের পক্ষেই এই বইটির জবাব দেওয়া সম্ভব না। হযরত আলী (রাঃ) ও আহলে বাইতের ইমামত ও নিস্পাপতা, প্রথম তিন খলীফার খিলাফাহ'র অবৈধতা এবং সাধারণভাবে সকল সাহাবীদের চরিত্র হনন ছিল এই বইটির প্রধান আলোচ্য বিষয়। বইটি আকায়েদ, তাফসীর, হাদিস ও ইতিহাসসহ বিভিন্ন শাস্ত্রীয় আলোচনা ও জটিল তত্ত্বকথায় ভরপুর ছিল, তাই একজন সর্বজ্ঞান বিশারদ পন্ডিত ব্যক্তির পক্ষেই এ বইটির সমুচিত জবাব দেওয়া সম্ভব ছিল। ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ ছিলেন সেই যোগ্য ব্যক্তি যিনি এই বইটির উপযুক্ত জবাব দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি কিতাবু মিনহাজিস সুন্নাতিন নাবাওিয়্যাহ ফি নাকদি কালামিশ শিয়াতি ওয়াল কুদরিয়্যা (সংক্ষেপে 'মিনহাজুস সুন্নাহ' নামে পরিচিত) নামে একটি কিতাব লিখে সেই বইটির উপযুক্ত জবাব প্রদান করেন।
এছাড়াও বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কারের ক্ষেত্রে ইবনে তাইমিয়্যাহ'র অন্যতম অবদান হল তিনি দর্শন, যুক্তিবাদ ও কালামশাস্ত্রের বিশদ সমালোচনার গুরু দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন আর অকাট্য যুক্তি প্রমাণের আলোকে কুরআন সুন্নাহ'র দাওয়াতি পদ্ধতির শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন। এখানে এর সামান্য কিছু উল্লেখ করা হলঃ
গ্রীক দার্শনিকদের ইলাহিয়্যাত সংক্রান্ত অনুমান নির্ভর বক্তব্যের চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণের পর ক্ষুব্ধ বিস্ময়ে ইবনে তাইমিয়্যাহ প্রশ্ন রেখেছেন যে নবী-রসূলদের ঐশী জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মুকাবিলায় নিজেদের বাজে আন্দাজ অনুমানগুলো পেশ করার নির্বোধ আস্পর্ধা তারা দেখায় কি করে। তিনি লিখেছেন, "দর্শনের আদি গুরু এরিস্টটলের ইলাহিয়্যাহ সংক্রান্ত আলোচনা খুঁটিয়ে দেখলে যে কোন সচেতন পাঠক এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য হবেন, রব্বুল আ'লামিনের পরিচয় সম্পর্কে অজ্ঞতার ক্ষেত্রে গ্রীক দার্শনিকদের সত্যিই কোন তুলনা নেই। তা সত্ত্বেও কিছু সংখ্যক অর্বাচীন যখন গ্রীকদের অতিপ্রাকৃত দর্শনকে রসূলদের ঐশী জ্ঞান ও শিক্ষার মুকাবিলায় টেনে আনে তখন বিস্ময়ে বেদনায় নির্বাক হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। কেননা, ব্যাপারটি তখন গ্রাম্য জমিদারকে শাহানশাহের সাথে তুলনা করার মত দাঁড়ায়, বরং আরও জঘন্য। কেননা, শাহানশাহ যেমন গোটা সাম্রাজ্যের ব্যবস্থাপক, তেমনি জমিদার তার গ্রামের ব্যবস্থাপক, তাই উভয়ের মাঝে দূরতম সাদৃশ্য অন্তত রয়েছে। অথচ নবী ও দার্শনিকদের মাঝে সেটুকুও নেই। কেননা নবীরা যে ইলম ধারণ করেন সে সম্পর্কে দার্শনিকদের বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই, এমন কি তার ধারে কাছে ঘেঁষাও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সত্যি বলতে কি, ইয়াহুদী আর খ্রিস্টান ধর্মনেতারাও তাদের থেকে আল্লাহ- তত্ত্বে অধিক অবগত। এখানে আমি কিন্তু ওহীনির্ভর ইলমের কথা বুঝাতে চাচ্ছি না, সে ইলম আমাদের আলোচনার বিষয়ই নয়। কেননা তা শুধু নবীদেরই বৈশিষ্ট্য, অন্যদের তাতে কোন অংশ নেই। আমি আকল ও বুদ্ধিজাত সে ইলমের কথাই বুঝাতে চাচ্ছি যার সম্পর্ক হল তাওহীদ ও রিসালাতের সাথে, আল্লাহ'র যাত ও সিফাত তথা সত্তা ও গুনের পরিচয়ের সাথে এবং পরকাল ও পরকালীন সৌভাগ্যের নিয়ামক আমলগুলোর সাথে, যেগুলোর অধিকাংশই নবীরা আকল ও বুদ্ধিজাত প্রমাণাদির সাথে বর্ণনা করেছেন। দ্বীন ও শরীয়তের এই বুদ্ধিজাত ইলম সম্পর্কেই আমাদের দার্শনিক বন্ধুরা সম্পূর্ণ বেখবর। ওহীনির্ভর ইলমের তো প্রশ্নই আসে না, কেননা সেগুলো নবীদের একক বৈশিষ্ট্য। সুতরাং দর্শন ও নববী ইলমের তুলনামূলক আলোচনায় সে প্রসঙ্গ আমরা উত্থাপনই করবো না।” মুসলিম মনীষীদের উপর যুক্তিবাদের প্রভাব দর্শনশাস্ত্রের থেকে কম ছিল না। এমন একটা ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে যুক্তিবাদ হল আগাগোড়া বুদ্ধি দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত, নির্ভুল ও বিশুদ্ধ শাস্ত্র যা সত্য মিথ্যা-নির্ধারণের একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। তাই ইবনে তাইমিয়্যাহ বহু কীর্তিত গ্রীক যুক্তিবাদের সমালোচনায়ও অবতীর্ণ হয়েছেন পূর্ণ সাহসিকতা ও আত্মপ্রত্যয়ের সাথে। যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে কিছু মৌলিক আপত্তি উত্থাপন ও সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, বরং একজন মুজতাহিদের দৃষ্টিতে গোটা শাস্ত্রের আগাগোড়া বিচার বিশ্লেষণ ও বিশদ সমালোচনা পর্যালোচনার ঐতিহাসিক দায়িত্বও তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে আঞ্জাম দিয়েছিলেন। শাস্ত্রের বহু স্বীকৃত উসুল ও সূত্রের ভ্রান্তি প্রমাণকল্পে তিনি নিরেট শাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত যুক্তিনির্ভর ও সারগর্ভ আলোচনা করেছেন এবং বিভিন্ন সংজ্ঞার খুঁত ও দুর্বলতা তুলে ধরে নিখুঁত ও সর্বাঙ্গীণ বিকল্প সংজ্ঞা পেশ করেছেন। মোটকথা, গ্রীক দর্শন ও যুক্তিশাস্ত্রে ইবনে তাইমিয়্যাহ'র ইজতিহাদ, স্বাধীন সমালোচনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যালোচনা ইতিহাসের গতিপথে নিঃসন্দেহে একটি মাইলফলকের মর্যাদা লাভ করেছে এবং ইজতিহাদ ও গবেষণার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। কালামশাস্ত্রবিদদের সমালোচনায়ও তিনি সমান তৎপর ছিলেন। কেননা এই ভদ্রলোকেরা ইসলামের আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন সত্য, কিন্তু গায়েবী বিষয়গুলো প্রমাণ করতে গিয়ে তারা দার্শনিকদের প্রমাণ পদ্ধতি এবং দর্শনের সীমাবদ্ধ ভ্রান্তিপূর্ণ পরিভাষাই ব্যবহার করেছেন, অথচ সেগুলোর স্বতন্ত্র আবেদন ও প্রভাব, অর্থ ও তাৎপর্য রয়েছে। তিনি বলেন, "সৃষ্টিতত্ত্ব, স্রষ্টার অস্তিত্ব ও পুনরুত্থানের সততা প্রমাণের ক্ষেত্রে কালামশাস্ত্রবিদদের বক্তব্য আকল ও যুক্তির বিচারে যেমন সারগর্ভ ও সন্তোষজনক নয়, তেমনি (কুরআন- সুন্নাহ'র) নকল ও উক্তিগত দিক থেকেও প্রামাণ্য নয়। (অর্থাৎ, আকল ও নকল, তথা যুক্তি ও উক্তি কোন বিচারেই তা মনোত্তীর্ণ নয়।) তারা নিজেরাও এ সত্য স্বীকার করে থাকেন। ইমাম রাযি শেষ জীবনে পরিস্কার বলেছেনঃ দর্শন ও কালামশাস্ত্রের প্রমানীকরন পদ্ধতি সম্পর্কে গভীর চিন্তাভাবনার পর আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে তাতে রোগের আরোগ্য নেই এবং পিপাসা নিবারণেরও ব্যবস্থা নেই। পক্ষান্তরে কুরআন-সুন্নাহ'র পক্ষকেই আমি নিরাপদ ও নিকটতম পথরূপে পেয়েছি। ...... আমার মতো যে কেউ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবে তাকে এ সিদ্ধান্তেই উপনীত হতে হবে। গাযালি ও ইবনে আকিল প্রায় অভিন্ন কথাই বলেছেন আর এটিই হল সত্য।”
সত্যের ঝান্ডা তুলে ধরে এগিয়ে যেতে গিয়ে ইবনে তাইমিয়্যাহকে কিছু হিংসুটে ব্যক্তির কারনে কয়েকবার কারাগারে যেতে হয়। ৭২৬ হিজরিতে শেষবারের মতো কারাগারে প্রেরণ করা হলে তার বিরোধী ও হিংসুটে লোকেরা এ সময় তার বন্ধু ও শাগরিদদের উপর আক্রমণ চালায়। ইবনে তাইমিয়্যাহকে কারাগারে প্রেরণ করার ঘটনায় সাধারণ মুসলিম আর হাজার হাজার আলিম শোকাতর হয়ে পড়ে এবং প্রবৃত্তিপূজারী, বিদআতি ও ধর্মদ্রোহীরা আনন্দে উল্লসিত হয়ে পড়ে।
দীর্ঘকাল পর কারাগার জীবনে ইবনে তাইমিয়্যাহ তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলতে ও একাগ্রতারূপ মহাসম্পদ লাভে সক্ষম হোন। সম্ভবত কারাগারে আবারও আসার খবর জানতে পেরে তিনি এর প্রতিই লক্ষ্য করে বলেছিলেন "এর ভেতর প্রচুর কল্যাণ আর বিরাট স্বার্থ রয়েছে।” তিনি এই নির্জন ও নিঃসঙ্গ জীবনের পরিপূর্ণ মর্যাদা দান করেন এবং পরিপূর্ণ আত্মনিমগ্নতা ও গভীর আগ্রহ সহকারে ইবাদাত ও কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল হয়ে পড়েন। এই অবকাশ জীবনে তার সবচেয়ে বড় নেশা ছিল কুরআন তিলাওয়াত। দুই বছরের এই বন্দী জীবনে তিনি তার ভাই শায়খ জয়নুদ্দিন ইবনে তাইমিয়্যাহ'র সাথে ৮০ বার কুরআন তিলাওয়াত খতম করেন। কুরআন তিলাওয়াতের পর হাতে যা কিছু সময় থাকতো তা তিনি অধ্যয়ন, কিতাব রচনা আর নিজের কিতাবের সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজে ব্যয় করতেন। কারাগারে তিনি যা কিছু লিখেছিলেন তার বেশিরভাগই ছিল তাফসীর সম্পর্কিত। এর কারনও ছিল সম্ভবত কুরআন তিলাওয়াতের আধিক্য ও কুরআন গভীর অভিনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন। কতিপয় মাসআলা বিষয়ে তিনি পুস্তিকা ও উত্তরপত্র লিখেন। বাইরে থেকে যেসব গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ তত্ত্বগত প্রশ্নাদি ও ফিকহি সংক্রান্ত খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ চেয়ে পাঠানো হতো তিনি তার জওয়াব দিতেন। কারাগারে বসে তিনি যা কিছু লিখতেন লোকে তা হাতে হাতে লুফে নিতো আর তা দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যেতো।
কারাগারের ভেতর তার রচিত একটি পুস্তিকা ছিল যিয়ারতের মাসআলা সম্পর্কিত, যেটিতে তিনি মিসরের আবদুল্লাহ ইবনুল আখনাঈ নামের এক মালিকী মাযহাবের কাযিকে প্রত্যাখ্যান করেন। সেই কাযির মূর্খতা এতে প্রমাণিত হয়ে গেলে সেই কাযি সুলতানের কাছে ইবনে তাইমিয়্যাহ'র বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। এর ফলে সুলতানের আদেশে শাইখের কাছ থেকে লেখাপড়ার সকল উপকরণ ছিনিয়ে নেওয়া হয়। সে সময় তার কাছ থেকে তার সমস্ত পাণ্ডুলিপি ও লিখিত পৃষ্ঠা কারাগার থেকে নিয়ে আদিলিয়ার বড় লাইব্রেরীতে রাখা হয়। এসব কিতাবের পরিমাণ ছিল ৬০ খন্ডের। কিন্তু ইবনে তাইমিয়্যাহ এরপরেও থেমে থাকেননি, তিনি বিচ্ছিন্ন ও টুকরো কাগজ কুড়িয়ে জমা করে সেগুলোর উপর কয়লা দিয়ে লিখতে শুরু করলেন। পরবর্তীকালে এভাবে লিখিত তার কয়েকটি পুস্তিকাও পাওয়া গিয়েছে।
তার ছাত্রঃ
ইবনে তাইমিয়্যাহ তার যৌবন থেকেই শিক্ষা দেওয়া শুরু করেন আর দীর্ঘ ৪০ বছর যাবত তিনি শিক্ষা দান করেন। এ সময়ে অসংখ্য ছাত্র তার থেকে দ্বীনের ইলম হাসিল করেন। তার উল্লেখযোগ্য ছাত্রদের মধ্যে কয়েকজন হলেনঃ ইবনুল কায়্যিম, ইবনে কাসির, আয-যাহাবি, ইবনে কুদামাহ আল- মাকদিসি, ইবনে মুফলিহ আল-হানবালি, আবু মুহাম্মাদ আল-কাসিম আল-বারযালি, আল-বাযযার, ইবনে আবদুল হাদি, উমার আল-হাররানি প্রমুখ।
ইবনে হাযার বলেন, "যদি শাইখ ইবনে তাইমিয়্যাহ'র ইবনুল কায়ি্যমের মতো একজন ছাত্র ছাড়া আর কোন অর্জন না-ও থাকতো, যিনি বহুল প্রচারিত কিতাবসমূহের রচনা করেছেন যেগুলো থেকে তার সাথে ঐকমত আর মতানৈক্য পোষণকারী উভয়ই উপকৃত হয়, তবে এটিই শাইখের মহান মর্যাদা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট হতো।”
তার কর্মঃ
কুরআন-সুন্নাহ'র সুগভীর জ্ঞান, শরীয়তের ভাব ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে পূর্ণ সচেতনতা এবং ফিকহ ও ইজতিহাদের অঙ্গনে পাণ্ডিত্য ও বৈদগ্ধের ছাপ তার প্রতিটি লেখা ও রচনায় ছিল সুস্পষ্ট। ইবনে তাইমিয়্যাহ তাফসীর শাস্ত্রকে তার রচনা ও গবেষণা জীবনের বিশেষ বিষয়রূপে গ্রহণ করেছিলেন। তার ছাত্রদের বর্ণনা মতে, তিনি ৩০ খন্ডেরও বেশী এক সুবিশাল তাফসীর কিতাব রচনা করেছিলেন। এই বিস্তৃত ও ধারাবাহিক তাফসীর কিতাবটি বিলুপ্ত হয়ে গেলেও বিভিন্ন সূরার খন্ডিত তাফসীর ইতিমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত তাফসীর কিতাবগুলো হল - তাফসীরু সুরাতিল ইখলাস, তাফসীরু মু'আওয়াযাতাইন, তাফসীরু সুরাতিন নূর। এছাড়া তার রচনা সমগ্র থেকে তাফসীর বিষয়ক অংশগুলো তাফসিরু ইবনে তাইমিয়্যাহ নামে ৭ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে।
তার রচিত বিপুল সংখ্যক অন্যান্য কিতাবসমূহের মধ্যে কয়েকটি কিতাব হল - মাজমু' ফাতওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ (৩৭ খন্ড), ফাতওয়া আল-কুবরা (৫ খন্ড), আকিদাতুল ওয়াসিতিয়্যাহ, আকিদাতুল হামাওিয়্যাহ, দার তা'আরুদ আল-'আকল ওয়ান নাকল (১২ খন্ড), মিনহাজুস সুন্নাহ আন নাবাওিয়্যাহ (৬ খন্ড), আল-জাওাব আস-সাহিহ লিমান বাদ্দালা দ্বীন আল- মাসিহ (৬ খন্ড), আস- ইস্তিকামাহ, আল-কাওাইদ আন- নুরানিয়্যাহ আল- ফিকহিয়্যাহ, কা'ইদাহ আযিমাহ ফিল ফারাক বাইন 'ইবাদাহ আহল আল-ইসলাম ওয়াল ঈমান ওয়া 'ইবাদাহ আহল আশ- শিরক ওয়ান- নিফাক ইত্যাদি।
তার উক্তিঃ
"আল্লাহ'র পক্ষ থেকে প্রতিটি শাস্তিই হল একদম খাঁটি সুবিচার এবং প্রতিটি দয়াই হল খাঁটি অনুগ্রহ।”
"সত্যিকারের কারারুদ্ধ ব্যক্তি তো সে, যার অন্তর আল্লাহকে স্মরণের ব্যাপারে কারারুদ্ধ; আর সত্যিকারের আটক ব্যক্তি তো সে-ই, যার কামনা-বাসনা তাকে এর ক্রীতদাস বানিয়েছে।”
"এই গোটা দ্বীনের কেন্দ্রই হল সত্যকে জেনে এর উপর আমল করার উপর, আর আমল অবশ্যই সবরের সাথে হতে হবে।"
"আপনি যদি আপনার অন্তরে আমলের মধুরতা অনুভব না করেন তবে সে আমলের ব্যাপারে সন্দেহ করুন, কারন মহিমান্বিত রব তো সবই বুঝতে পারেন।"
"গোলাম তার মালিককে যতই ভালবাসে ততই তার অন্য কিছুর প্রতি ভালোবাসা আর সেগুলোর (অর্থাৎ, ভালোবাসার অন্যান্য বিষয়বস্তুগুলোর) সংখ্যা কমে যায়। আর গোলাম তার মালিককে যত কম ভালবাসে, ততই অন্য কিছুর প্রতি ভালোবাসা আর সেগুলোর সংখ্যা বেড়ে যায়।”
“গোলামের তো সবসময়ই হয় আল্লাহ'র পক্ষ থেকে কোন দয়ার কারনে সেটির প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত, অথবা পাপের ফলে অপরাধী হওয়ার কারনে আল্লাহ'র কাছে তাওবা করে ফিরে যাওয়া উচিত; এভাবে সে আল্লাহ'র এক দয়া থেকে আরেক দয়ার দিকে চলতে থাকে এবং তার তো সবসময়ই তাওবার প্রয়োজন রয়েছে।”
"পাপ হচ্ছে ক্ষতির কারন, আর তাওবা সেই কারণকে দূর করে দেয়।”
"তাওহীদের প্রতি সাক্ষ্য বহন করা কল্যাণের দরজা উন্মুক্ত করে দেয় এবং পাপ থেকে তাওবা করাটা অমঙ্গলের দরজা বন্ধ করে দেয়।”
"অন্তরের বিরুদ্ধে জিহাদ হল কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদের ভিত্তি।”
"কোন ব্যক্তির অন্তর ব্যাধিগ্রস্ত না হলে সে কখনোই আল্লাহ'র পাশাপাশি অন্য কাউকে ভয় করবে না।"
"তাওহীদের পরিপূর্ণতা তো তখনই হয় যখন অন্তরে এগুলো ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না আল্লাহ, তিনি যাদের আর যেগুলো ভালোবাসেন তাদেরকে আর সেগুলোকে ভালোবাসা, এবং তিনি যাদের আর যেগুলোকে ঘৃণা করেন তাদেরকে আর সেগুলোকে ঘৃণা করা, যাদের ব্যাপারে তিনি আনুগত্য করতে বলেছেন তাদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা, যাদের প্রতি তিনি শত্রুতা প্রদর্শন করেছেন তাদের প্রতি শত্রুতা প্রদর্শন করা, তিনি যা করতে আদেশ করেছেন তা করতে আদেশ করা এবং যা করতে নিষেধ করেছেন তা করতে নিষেধ করা।”
“এই দুনিয়াতে একজন ব্যক্তি আল্লাহর স্মরণে, তার প্রশংসায় আর তাঁর ইবাদাতে এমন এক আনন্দ পায় যেটির সাথে কোন কিছুরই তুলনা হয় না।”
“যুহুদের উদ্দেশ্য হল এমনসব কিছু পরিত্যাগ করা যা পরকালে গোলামের ক্ষতি করবে, আর ইবাদাতের উদ্দেশ্য হল এমন সব কাজ করা যা পরকালে তার উপকার করবে।”
“পাপসমূহ হল শিকল ও তালার ন্যায়, যা পাপকর্ম সম্পাদনকারীদেরকে তাওহীদের সুবিশাল বাগানে বিচরণ করা থেকে আর সৎকর্মসমূহের ফসলগুলোকে কাটতে বাধা দেয়।”
“কি করতে পারবে আমার শত্রুরা? আমার অন্তরেই তো রয়েছে আমার জান্নাত, আমি যেখানেই যাই সেটি আমার সাথেই থাকে। আমাকে কারারুদ্ধ করা হলে সেটি হবে আমার রবের সাথে একাকী সঙ্গ লাভের একটি সুযোগ। আমাকে হত্যা করা হলে তো শাহাদাত লাভ করবো আর আমার ভূমি থেকে আমাকে নির্বাসিত করা হলে সেটি হবে এক আধ্যাত্মিক সফর।”
তার মৃত্যুঃ ইবনে তাইমিয়্যাহ কারারুদ্ধ অবস্থাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে দামেশকের শাসনকর্তা তার কাছে রোগ পরিচর্যার উদ্দেশ্যে গমন করেন আর তাকে বলেন, “আমার দ্বারা কোন ত্রুটি বিচ্যুতি হলে বা কষ্ট পেয়ে থাকলে আল্লাহ'র ওয়াস্তে আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।” জবাবে ইবনে তাইমিয়্যাহ বললেন, “আমি আমার পক্ষ থেকে আপনাকে ক্ষমা করেছি আর তাদেরকেও ক্ষমা করেছি যারা আমার সাথে শত্রুতা করেছে। আর আমি যে সত্যের উপর আছি তা তারা জানে না। সুলতান মু'আজ্জাম আল-মালিকুন নাসির আমাকে বন্দী করেছিলেন বলে তার বিরুদ্ধেও আমার কোন অভিযোগ নেই। কেননা তিনি নিজে থেকে এ কাজ করেননি, বরং উলামায়ে কেরামগনের প্রতি আস্থা ও আনুগত্যের কারনে করেছেন। তাই আমি তাকে মা'যুর মনে করি। আমার পক্ষ থেকে আমি আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর দুশমন ছাড়া সবাইকেই মাফ করেছি।”
বেশ কিছুদিন শরীর অসুস্থ থাকার পর তিনি কারারুদ্ধ অবস্থায় ৭২৮ হিজরি সনের ২০শে যুলকাদাহ রাতে ইন্তিকাল করেন। মুত্তাযযিন দুর্গের মিনারে চড়ে শায়খুল ইসলামের মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করেন, এরপর বুরুজে মোতায়েন পাহারারত চৌকিদার সেখান থেকে সেই ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করে, মসজিদগুলো থেকেও ছড়িয়ে পড়ে এ শোকবার্তা, বিদ্যুৎ বেগে ছড়িয়ে পড়ে তার মৃত্যু সংবাদ। মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যায় শহরের সব আনন্দ কোলাহল, শোকের ছায়া নেমে আসে সর্বত্র। দুর্গের দরজা খুলে দিয়ে সর্বসাধারণকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। দলে দলে লোকজন আসতে থাকে শায়খুল ইসলামকে এক নজর দেখার জন্য।
মৃতদেহকে গোসল দেওয়ার পরে তার প্রথম জানাযা দুর্গের ভেতর অনুষ্ঠিত হওয়ার পর তা শহরের বৃহত্তম মসজিদ (এটি তৎকালীন ইসলামী বিশ্বের বৃহত্তম জামে মসজিদও ছিল) জামে উমুবিতে আনা হয়। দুর্গ ও জামে উমুবির মধ্যকার দীর্ঘ রাজপথ লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। এ মসজিদ ভরে গিয়ে সামনের ময়দান, রাজপথ, আশেপাশের অলি-গলি, বাজার সবই লোকে ভরে যায়। ভিড়ের চাপ এতো বেশী ছিল যে সৈন্যদেরকে কফিন ঘিরে রাখতে হয়, অন্যথায় জানাযার হেফাযত ও ইন্তিজাম করা ছিল সত্যিই কঠিন। ঐতিহাসিকদের মতে ইতিপূর্বে ইসলামী বিশ্বের আর কোথাও এতো বড় জানাযা অনুষ্ঠিত হয়নি।
ইবনে কাসির বলেন, "তার জানাযার সামনে, পিছে, ডানে বামে বিপুল সংখ্যক ব্যক্তি অবস্থান করছিলেন। তাদের সংখ্যা একমাত্র আল্লাহই গণনা করতে পারেন। কোন এক ব্যক্তি চিৎকার করে বললেন, 'সুন্নাতের ইমামের জানাযা তো এমনই হয়', এটি শোনার পর লোকেরা কাঁদা শুরু করলো।”
ফজরের পর জানাযা বের হয়েছিলো, যোহরের পর জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয় আর ভিড় ঠেলে নিকটবর্তী কবরস্থান আস-সুফিয়াতে পৌঁছতে আসরের ওয়াক্ত হয়ে পড়ে। অতি অল্প সময়ে শায়েখের মৃত্যু সংবাদ পুরো ইসলামী বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
ইমাম ইবনে রজব বলেন, “নিকটবর্তী ও দূরবর্তী দেশগুলোতে ইমামের গায়েবানা জানাযা পড়া হয়, এমনকি ইয়ামান ও সুদুর চীনেও তার গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। ভ্রমণকারীরা বর্ণনা করেছেন যে চীনের একটি দূরবর্তী শহরে জুমু'আর দিন গায়েবানা জানাযার ঘোষণা এভাবে দেওয়া হয়েছিলো - 'কুরআনুল কারীমের মুখপাত্রের জানাযা হবে।'"
মহান আল্লাহ ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ.) কে ক্ষমা করুন এবং তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস প্রদান করুন, আমীন।
টিকাঃ
৮. ইবনে তায়মিয়্যাহ সম্পর্কে এই লেখক পরিচিতি অংশটি তৈরি করতে মূলত এই উৎসগুলো ব্যবহার করা হয়েছেঃ যুগস্রস্টা সংস্কারক ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ; সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস (২য় খন্ড); Expounds on Islam; The lofty virtues of Ibn Taymiyyah; The essential pearls & gems of Ibn Taymiyyah
৯. হাদিসটি ইবনে মাযাহ, তিরমিযি ও মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত আছে।
১০. হাদিসটি আবু দাউদে (কিতাবুল মালাহিম) ও মুসতাদরাকে হাকিম (৪/৩৯৬) এ বর্ণিত হয়েছে। ইমাম সুয়্যুতি বলেন, হাদিসের আলিমরা এতে একমত যে হাদিসটি সাহিহ।
১১. ইবনুল কায়্যিমের ইগাসা আল লাহফান ১/৭-১০; ইবনে তাইমিয়্যাহ'র মাজমু' ফাতওয়া ১০/৯১-১৪৯
"আমার কথা দিয়ে আমি তার ব্যাপারে যত না বর্ণনা করতে পারবো অথবা আমার কলম দিয়ে তিনি যে কত প্রখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন তা লোকদেরকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবো, তিনি তার চেয়েও মহান। তার জীবন, তার জ্ঞান, তার দুঃখ-দুর্দশা এবং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তার সফরগুলো বইয়ের বিশাল দুটো খন্ড পূর্ণ করে দিবে।" - ইমাম আয-যাহাবি (রহ.)
তার নাম, জন্ম ও বংশপরিচয়ঃ তিনি হলেন তাকিউদ্দিন আবুল 'আব্বাস আহমাদ ইবনে শায়খ শিহাবুদ্দিন আবদুল হালিম ইবনে আবুল কাসিম ইবনে তাইমিয়্যাহ আল-হাররানি। তিনি ৬৬১ হিজরি সনের ১০ই / ১২ই রবিউল আউওয়াল মাসে উত্তর ইরাকের হাররানে এক ইলমী ঘরানার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা আবদুল হালিম ইবনে তাইমিয়্যাহ তার নাম রাখেন আহমাদ তাকিউদ্দিন, বড় হলে তিনি আবুল আব্বাস ডাক নাম রাখেন। কিন্তু খানদানী উপাধি 'ইবনে তাইমিয়্যাহ' সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায় আর এ নামেই তিনি পরিচিতি লাভ করেন।
তার পরিবারের চতুর্থ পুরুষ তার পরদাদা মুহাম্মাদ ইবনুল খিযির থেকেই পরিবারটি তাইমিয়্যাহ পরিবার হিসেবে পরিচিত হয়। মুহাম্মাদ ইবনুল খিযিরের মায়ের নাম ছিল তাইমিয়্যাহ, তিনি ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী। বাগ্মীতায় তার অসাধারণ খ্যাতি কিছুদিনের মধ্যেই পরিবারটিকে তাইমিয়্যাহ পরিবার নামে সর্বত্র পরিচিত করে।
তার দাদা মাজদুদ্দিন ইবনে তাইমিয়্যাহ সেই সময়ে হাম্বলী মাযহাবের শ্রেষ্ঠ আলিমদের মধ্যে গণ্য হতেন, কেউ কেউ তাকে মুজতাহিদ হিসেবেও উল্লেখ করেন। তিনি মুনতাকা আল- আখবার নামক বিখ্যাত কিতাব রচনা করেন। পরবর্তীতে ত্রয়োদশ হিজরি সনের শ্রেষ্ঠ আলিম ও মুহাদ্দিস ইমাম শাওকানি 'নাইলুল আওতার' নামে এই কিতাবের বার খন্ডের ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করে কিতাবটির গভীরতা ও শ্রেষ্ঠত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।
তার পিতা শিহাবুদ্দিন আবদুল হালিম ইবনে তাইমিয়্যাহও একজন শ্রেষ্ঠ আলিম, মুহাদ্দিস ও হাম্বলি ফিকাহ শাস্ত্রবিদ ছিলেন। হিরান থেকে দামেশকে চলে আসার পরপরই তিনি দামেশকের জামে উমুবিতে দরসের সিলসিলা চালু করেন। দামেশকের এ কেন্দ্রীয় মসজিদটি ছিল দেশের শ্রেষ্ঠ উলামা, ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণের কেন্দ্রস্থল। কাজেই সেখানকার শ্রেষ্ঠ আলিমদের উপস্থিতিতে দরস দেওয়া চাট্টিখানি কথা ছিল না। তার দরসের বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তিনি সম্পূর্ণ স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভর করে বড় বড় কিতাবের বরাত দিয়ে দরস করে যেতেন, সামনে কোন কিতাবই থাকতো না। দামেশকের দারুল হাদিস আসসিকরিয়ায় তাকে হাদিস ও হাম্বলি ফিকহের উপর শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
তার শিক্ষকঃ
ইবনে তাইমিয়্যাহ তার পিতা এবং অনেক প্রখ্যাত আলিম থেকে দ্বীন শিক্ষা লাভ করেন। তিনি দুইশ'র বেশী আলিম ও আলিমাহ থেকে দ্বীনের ইলম হাসিল করেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন আলিম ও আলিমাহ হলেন - আবু আল-আব্বাস আহমাদ ইবনে আবদুদ দা'ইম আল- মাকদাসি, আবু নাসর আব্দুল-আযিয ইবনে আব্দুল-মুন'ইম, আবু মুহাম্মাদ ইসমা'ইল ইবনে ইব্রাহিমি তানুখি, সিত আদ-দার বিনতে আবদুস সালাম ইবনে তাইমিয়্যাহ, আহমাদ ইবনে আহমাদ আশ শাফি'ই, শারফুদ্দিন আল- মাকদাসি প্রমুখ।
ইবনে তাইমিয়্যাহ'র পিতা তাকে সাত বছর বয়সে দামেস্কে নিয়ে যাওয়ার ফলে তার সৌভাগ্য হয় শ্রেষ্ঠ আলিমদেরদের সংস্পর্শে থেকে ইলম হাসিল করার। তিনি কখনো কখনো একটি আয়াতের অর্থ অনুধাবনের জন্য একশটির বেশী তাফসীর অধ্যয়ন করতেন। তিনি শুধুমাত্র তাফসীর কিতাব পাঠের মাধ্যমেই নিজের জ্ঞান স্পৃহাকে আবদ্ধ করে রাখতেন না, বরং তিনি মুফাসসিরদের কাছে চলে যেতেন আর তাদের সাথে সরাসরি আলোচনা করতেন। তিনি ফিকহ ও হাদিসের বড় বড় আলিমদের পাঠচক্রে গিয়ে তাদের কাছ থেকে ইলম অর্জন করতেন, এমনকি তাদের সাথে বিতর্কও করতেন, অথচ তিনি তখনও যুবক ছিলেন।
তার জ্ঞানগত মর্যাদাঃ
ইবনে তাইমিয়্যাহ'র যুগে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান এতটা বিস্তৃতি লাভ করেছিলো এবং কুরআন ও হাদিসশাস্ত্রের এতো বিশাল ও বিস্তৃত ভাণ্ডার সংগৃহীত হয়ে গিয়েছিলো যে, কোন লোকের পক্ষেই অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী হওয়া ছাড়া সে সব জ্ঞানভাণ্ডার আয়ত্তে আনা যেমন সম্ভব ছিল না, তেমনি বিতর্কিত মাসাইল ও সমস্যার ক্ষেত্রে সমসাময়িক খ্যাতনামা আলিম ও পন্ডিত ব্যক্তিদের সামনে কেউ মুখ খোলার সাহস করতেও পারতো না। একই সাথে কোন মাসআলার ব্যাপারে পূর্ববর্তী কোন আলিমের পেশকৃত সিদ্ধান্তের সাথে মতভেদের অধিকারও থাকতো না।
কিন্তু আল্লাহ তা'আলা ইবনে তাইমিয়্যাহকে যে স্মৃতিশক্তি ও ধারণশক্তি দান করেছিলেন তার সাহায্যে তিনি তাফসীর, হাদিস, রিজালশাস্ত্র, ফিকহ, উসুল, উসুলে ফিকহ, সিরাত, আসার, ইমামদের মতভেদ সম্পর্কিত বিষয়শাস্ত্র, কালামশাস্ত্র, ইতিহাস, অভিধান ও ব্যাকরণশাস্ত্রের যে বিরাট জ্ঞানভাণ্ডার তখন পর্যন্ত গড়ে উঠেছিলো, যত কিতাব ও উৎস-উপকরণ তখন পর্যন্ত বর্তমান ছিল এবং যে পর্যন্ত তার দক্ষতা ও ক্ষমতা ছিল, সেগুলো অধ্যয়ন করেন আর তার শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত স্মৃতিশক্তির সাহায্যে সেগুলো নিজের বুকে ধারণ করেন। এরপর তিনি তার জ্ঞানগত ও লেখক জীবনে সেগুলো থেকে সেভাবে সাহায্য সহায়তা গ্রহণ করেন যেভাবে একজন যুদ্ধাভিজ্ঞ তীরন্দাজ তার তৃণীরের সাহায্য নিয়ে থাকে।
সমসাময়িক সকলেই তার অসাধারণ স্মৃতিশক্তি, ধারণ ক্ষমতা, উল্লেখযোগ্য মেধা ও ধীশক্তির স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং তার সমসাময়িক ও পরবর্তী যুগের সকলেই তার এ গুনের ব্যাপারে একমত। তার কিছু সমসাময়িক ব্যক্তি এমন পর্যন্ত বলেছেন যে কয়েক শতাব্দী যাবত এতো বড় স্মৃতিশক্তির অধিকারী আর কেউ জন্মগ্রহণ করেননি।
একবার তিনি সূরা ইখলাসের প্রথম আয়াত "বলঃ তিনি আল্লাহ, এক ও অদ্বিতীয়।” এর এমন এক তাফসীর করেন যেটি লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে তা বড় এক খন্ডের তাফসীরে রূপ নিলো, এটি তাফসীরে সুরাতুল ইখলাস নামে পরিচিত। সূরা তোয়া-হা এর পঞ্চম আয়াত “আর-রহমান আরশে সমাসীন।” এর তাফসীর প্রায় ৩৫ খন্ড পূর্ণ করে দিয়েছিলো। জুমুআর দিনে তিনি সূরা নূহ এর তাফসীর করা শুরু করলে কয়েক বছর যাবত এই তাফসীর চলতে থাকে।
ইবনে তাইমিয়্যাহ তার ধারালো বোধশক্তি দ্বারা সহজেই কুরআনের সবচেয়ে জটিল অর্থগুলোর অনুসন্ধান করতে পারতেন। তার ক্লাসে কোন ছাত্র কোন আয়াত পাঠ করলে তিনি সেই আয়াতের তাফসীর করা শুরু করতেন, আর সেই তাফসীরের দীর্ঘতা এমন হতো যে সেটি দিয়েই ক্লাস সমাপ্ত হতো। সময়ের ঘাটতি বা ছাত্রদের বিশ্রাম দেওয়া ছাড়া তিনি তাফসীর প্রদানে থামতেন না। তিনি অনেক দৃষ্টিকোণ থেকেই আয়াতের তাফসীর করতে পারতেন।
একবার তাকে একটি হাদিস- “আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে অভিশাপ দিয়েছেন, যে ব্যক্তি একজন তালাকপ্রাপ্ত নারীকে বিয়ে করে তার প্রথম স্বামীর জন্য তাকে হালাল করার উদ্দেশ্যে, এবং সেই স্বামীকেও যে সেই নারীকে ফিরিয়ে নেয়।” সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল। তিনি এর এমন এক বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিলেন যে যেটি লিপিবদ্ধ করলে তা পুরো এক খন্ডের কিতাবে পরিণত হয়, এই কিতাবটি 'ইকামাত আদ-দালিল 'আলা বুতলান আত- তাবিল নামে পরিচিত। এটি একেবারেই বিরল যে তার নিকট কুরআনের কোন আয়াত বা কোন হাদিস বা বিধানের ব্যাপারে উল্লেখ করা হলে তিনি পুরো দিন জুড়ে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করতেন না।
ইমাম আয-যাহাবি বলেন, "হাদিসের মূল পাঠ 'মতন' অধিক পরিমাণে মনে রাখতে, সময়মত তা থেকে সহায়তা গ্রহণ করতে, বিশুদ্ধ বরাত প্রদানে এবং সম্পর্ক সূত্র বর্ণনায় তার চেয়ে অধিক পারদর্শী আর কাউকেই আমি দেখিনি। হাদিসের বিপুল বিস্তৃত ভান্ডার যেন তার চোখের সামনে ও ঠোঁটের কোণে ভেসে বেড়াতো। তার সম্পর্কে এ কথা বলা যথার্থ হবে যে, ইবনে তাইমিয়্যাহ যে হাদিস জানেন না তা কোন হাদিসই না।”
মহান আল্লাহ তাকে আলিমদের ইখতিলাফ, তাদের বক্তব্য, ভিন্ন বিষয়ে তাদের ইজতিহাদ এবং প্রত্যেক যুগের প্রত্যেক আলিমদের শক্ত, দুর্বল, গৃহীত ও প্রত্যাখ্যাত মতামত সম্পর্কে ইলম হাসিলের তাওফিক দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তার খুব সূক্ষ্মদৃষ্টি ছিল যে, তাদের কোন মতামতটি ছিল সবচেয়ে বিশুদ্ধ আর সত্যের সবচেয়ে নিকটবর্তী, আর তিনি সেটি প্রত্যেক আলিমের নাম উল্লেখ করেই করতে পারতেন। তাকে যদি কোন মতামতের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হতো তবে তিনি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রত্যেক হাদিস, সাহাবী ও প্রথম প্রজন্মের আলিম থেকে তার প্রজন্ম পর্যন্ত আলিমদের উক্তি এসব কিছু থেকে তিনি যেটি ইচ্ছা করতেন সেটি গ্রহণ করতেন আর যেটি ইচ্ছা সেটি ত্যাগ করতেন। তার সাথীরা তার চল্লিশ হাজারের বেশী ফাতওয়ার সঙ্কলন করেন। এটি খুবই দুর্লভ যে তাকে কোন কিছুর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি দ্রুত তার জবাব দিতে পারেননি, তিনি এটির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তার জবাবগুলো একেকটি কিতাবে পরিণত হতো।
একবার এক ইয়াহুদী তাকে ৮ লাইনের কবিতা আকারে আল- কদর সম্পর্কে প্রশ্ন করে। তিনি এর জবাব দেন ১৮৪ লাইনের কবিতা দিয়ে, এই কবিতাটি ব্যাখ্যা করার জন্য দু-দুটো বড় খন্ডের কিতাব রচনার প্রয়োজন হতো।
আরবি ব্যাকরণে ইবনে তাইমিয়্যাহ এমনই দক্ষতা অর্জন করেন যে সে সময়কার বিশিষ্ট ব্যাকরণবিদ আবু হাইয়ান তার কাছে যান আর তার প্রশংসায় কবিতা লিখেন। ইবনে তাইমিয়্যাহ আরবি ব্যাকরণের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও জনপ্রিয় কিতাব, ইমাম সিবাওায়হ এর 'আল-কিতাব' বিশেষ যত্ন ও মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করেন আর এর দুর্বল স্থান ও ভুল ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করেন। আর এই কিতাবের আশিটি স্থানে ভুলের উল্লেখ করার পর আবু হাইয়ান চিরদিনের জন্য তার বিরোধী ও সমালোচকে পরিণত হয়।
পিতার মৃত্যুর পর তিনি মাত্র বাইশ বছর বয়সে দারুল হাদিস আসসিকরিয়ায় তার প্রথম দরস প্রদান করেন। এ দরস প্রদানকালে দামিশকের বড় বড় আলিম উপস্থিত ছিলেন। তারা তার দরস দ্বারা প্রভাবিত হোন এবং যুবক ইবনে তাইমিয়্যাহ'র জ্ঞানের গভীরতা, উপস্থিত বুদ্ধি, সাহসিকতা ও ভাষার অলংকারের স্বীকৃতি দান করেন। এ দরসের প্রায় এক মাস পর তিনি জুমুয়ার দিনে তার পিতার স্থলে উমাইয়া মসজিদে তাফসীরের দরস প্রদান করেন। তার জন্য বিশেষভাবে মিম্বর রাখা হয়েছিলো। তার তাফসীর শোনার জন্য দিনে দিনে লোক সমাগম বাড়ছিলো।
যেহেতু তিনি ছিলেন একজন মুজতাহিদে মুতলাক, তাই তিনি নিজেকে নির্দিষ্ট কোন মাযহাবে আবদ্ধ করে রাখেননি, বরং মুজতাহিদে মুতলাক হওয়ার ফলে তিনি তার মতামতের ক্ষেত্রে সরাসরি শারিয়াহ'র উৎসে চলে যেতে পারতেন।
তাকিউদ্দিন ইবনে দাকিকুল ঈদ এর মর্যাদা হাদিসশাস্ত্রে সর্বজনস্বীকৃত এবং সে যুগের উলামায়ে কেরাম সর্বতোভাবে তাকে তাদের ইমাম ও মুরব্বী হিসেবে মানতেন। ৭০০ হিজরি সনে ইবনে তাইমিয়্যাহ মিসরে গেলে ইবনে দাকিকুল ঈদের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে। এই সাক্ষাতের পর তিনি তার মনোভাব এভাবে ব্যক্ত করেন "ইবনে তাইমিয়্যাহ'র সাথে আমার যখন সাক্ষাৎ হল তখন আমি অনুভব করলাম যে জ্ঞানবিজ্ঞানের সকল শাখা প্রশাখাই তার নখদর্পণে; তিনি যেটি ইচ্ছা গ্রহণ করেন আর যেটি ইচ্ছা পরিত্যাগ করেন।"
প্রখ্যাত আলিম ও বহু শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত কামালুদ্দিন ইবনুয- যামালকানী বলেন, "জ্ঞানবিজ্ঞানের কোন শাখায় তাকে যখন কোন প্রশ্ন করা হয় তখন (অবলীলায় তাকে প্রশ্নের উত্তর দিতে দেখে) দর্শক ও শ্রোতা মনে করে যে তিনি কেবল সংশ্লিষ্ট বিষয়টিই জানেন এবং তার সম্পর্কে এই ধারণা করতে বাধ্য হোন যে এই শাস্ত্রে তার মতো জ্ঞানী আর কেউ নেই।”
ইমাম আয-যাহাবির মতো বিস্তৃত দৃষ্টির অধিকারী ঐতিহাসিক ও সমালোচক মনীষী তার ব্যাপারে বলেছেন, "যদি রুকন ও মকামে ইব্রাহীমের মাঝে আমাকে কেউ কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করে তবে আমি হলফ করে বলবো, ইলমের ক্ষেত্রে তার মতো আর কেউকে আমি দেখিনি এবং তিনিও তার সমতুল্য আর কাউকে দেখেননি।”
যদিও ইতিহাস তার বিষয় ছিল না আর এটিকে তিনি তার আলোচ্য বিষয় হিসেবেও গ্রহণ করেননি, এরপরেও ইতিহাস সম্পর্কে তার জ্ঞানের গভীরতা, প্রশস্ত দৃষ্টি ও উপস্থিত বুদ্ধির একটি বিস্ময়কর ঘটনা ইবনুল কায়্যিম বর্ণনা করেন, ঘটনাটি হলঃ
একটি মুসলিম দেশে (সম্ভবত সিরিয়া বা ইরাকে) ইয়াহুদীরা একটি প্রাচীন দস্তাবেজ (লিখিত দলীল) পেশ করে, যা দেখে তা প্রাচীনকালে লিখিত এবং কাগজও বেশ পুরনো আমলের মতো বলে মনে হচ্ছিলো। সেখানে লিখিত ছিল, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) খায়বারের ইয়াহুদীদেরকে জিযিয়া প্রদানের হাত থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছিলেন। লিখিত দস্তাবেজটির উপর আলী (রাঃ), সা'দ ইবনে মু'আয (রাঃ) ও সাহাবীদের অনেকেরই সিগনেচার ছিল। ইতিহাস ও জীবন-চরিত সম্পর্কে আর সে যুগের অবস্থা সম্পর্কে গভীর ও বিস্তৃত দৃষ্টি ছিল না এমন কিছু অজ্ঞ লোক ইয়াহুদীদের এই প্রতারনার শিকার হয় ও এর যথার্থতা সম্পর্কে তাদের নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মে যায় আর তারা এর উপর আমল করতে শুরু করে এবং ইয়াহুদীদেরকে জিযিয়া প্রদানের হাত থেকে নিষ্কৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ দস্তাবেজ ইবনে তাইমিয়্যাহ'র সামনে উপস্থাপন করা হলে তিনি একে বিশ্বাসের একেবারেই অযোগ্য ও জাল বলে মত প্রকাশ করেন এবং এর জাল ও বানোয়াট হওয়া সম্পর্কে দশটি দলীল পেশ করেন। এগুলোর মধ্যে একটি দলীল হল এই যে, দস্তাবেজের উপর সা'দ ইবনে মু'আয (রাঃ) এর সিগনেচার আছে, অথচ খায়বার যুদ্ধের আগেই তিনি ইন্তিকাল করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, দস্তাবেজে উল্লেখ রয়েছে যে ইয়াহুদীদেরকে জিযিয়া থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে, অথচ তখন পর্যন্ত জিযিয়ার হুকুমই নাযিল হয়নি আর সাহাবীরাও এ সম্পর্কে কিছু জানতেন না। জিযিয়ার হুকুম খায়বারের যুদ্ধের তিন বছর পর তাবুক যুদ্ধের বছরে নাযিল হয়। তৃতীয়ত, এতে উল্লেখ রয়েছে যে ইয়াহুদীদেরকে বেগার (বিনা মজুরির শ্রম) খাটানো যাবে না; এটি একটি অবান্তর বিষয়, কারন ইয়াহুদী বা অ-ইয়াহুদী কারো থেকেই বেগার শ্রম গ্রহণ রীতিসিদ্ধ ছিল না। নিশ্চয়ই রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং সাহাবীরা এ ধরণের জুলুম ও জবরদস্তি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন; বরং এটি তো হল অত্যাচারী ও নিপীড়ক বাদশাহদের আবিস্কার যা আজ পর্যন্ত চলে আসছে। চতুর্থত, জ্ঞানী-গুণী, সিয়ার ও মাগাযির লেখক, মুহাদ্দিস, ফকিহ ও মুফাসসিরদের কেউই এ ধরণের কোন দস্তাবেজের উল্লেখ বা আলোচনা করেননি এবং ইসলামের প্রথম যুগগুলোতেও এ দলীলের অস্তিত্ব প্রকাশ পায়নি। তাই সঙ্গত কারনেই বলা চলে যে এ দস্তাবেজ জাল, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট এবং এ ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রমাণ রয়েছে। শায়খুল ইসলামের উল্লেখিত বিশ্লেষণে ইয়াহুদীদের সকল জারিজুরি ফাঁস হয়ে যায় আর তাদের কৃত্তিমতার সকল মুখোশ খুলে পড়ে।
যুহদ ও ইবাদাতঃ ইবনে তাইমিয়্যাহ যখন অল্পবয়স্ক ছিলেন, তখন তার পিতা তার কুরআনের শিক্ষককে চল্লিশ দিরহাম দিয়ে বললেন যে তিনি যেন তার সন্তানকে কুরআন তিলাওয়াত ও এর উপর আমল করানোয় উৎসাহ প্রদান করার উদ্দেশ্যে তাকে প্রতি মাসে সেই চল্লিশ দিরহাম প্রদান করেন। সুতরাং তার শিক্ষক যখন তাকে এই চল্লিশ দিরহাম দিতে গেলেন তখন ইবনে তাইমিয়্যাহ তা গ্রহণ করতে প্রত্যাখ্যান করলেন আর বললেন, "হে আমার শিক্ষক, আমি আল্লাহ'র নিকট ওয়াদা করেছি যে আমি কুরআনের জন্য কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করবো না।”
ইবনুল কায়্যিম বলেন, "ফজরের সালাত আদায়ের পর তিনি স্বস্থানেই বসে থাকতেন আর বসে থাকতে থাকতেই বেলা বেড়ে যেতো। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতেনঃ এটিই আমার নাস্তা, এটি গ্রহণ না করলে আমার শক্তিতে ভাটা পড়বে আর শেষ পর্যন্ত আমার কর্মশক্তিই লোপ পাবে।”
ইমাম আয-যাহাবি বলেন, "তার মতো কাঁদতে, আল্লাহ'র দরবারে সাহায্য চাইতে ও ফরিয়াদ জানাতে এবং তারই দিকে তাওাজ্জুহ (গভীর মনোনিবেশ) করতে আমি আর কাউকে দেখিনি। তিনি বিশেষ বিশেষ সময়ের আমল ও যিকরসমূহ পাবন্দীর সাথে এবং সর্বাবস্থায় অত্যন্ত যত্নের সাথে আদায় করতেন।”
আল কাওাকিব কিতাবে তার ব্যাপারে উল্লেখ আছে যে তিনি যখন সালাত শুরু করতেন তখন তার কাঁধ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গদি কাঁপত, এমন কি ডানে বামে স্পন্দিত ও শিহরিত হতো।
শায়খ 'আলামুদ্দিন আল-বারযালী বলেন, "শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার অবস্থা একই রকম ছিল, আর সেটি হল এই যে, তিনি দারিদ্র্যকেই সবসময় অগ্রাধিকার দিয়েছেন। দুনিয়ার সাথে নামকাওয়াস্তে অর্থাৎ যতটুকু না হলেই নয়, ততটুকু মাত্র সম্পর্ক রেখেছিলেন, আর যেটুকু পেয়েছেন তাও ফিরিয়ে দিয়েছেন।”
তার দানশীলতা এমনই ছিল যে, দেওয়ার মতো কিছু না থাকলে তিনি সতর ঢাকার পরিমাণ কাপড় রেখে শরীরের কাপড় খুলে তা দিয়ে দিতেন। খাবারের ভেতর থেকে একটি দুটি রুটি বাঁচিয়ে রাখতেন আর নিজের প্রয়োজন উপেক্ষা করে অন্যকে তা দিয়ে দিতেন।
তিনি ছিলেন একজন ক্ষমাশীল ব্যক্তি। তার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ কাযী ইবনে মাখলুফ মালিকী তার সম্পর্কে বলে, "আমরা ইবনে তাইমিয়্যাহ'র মতো মহান ও উদারচেতা আর কাউকে দেখিনি। আমরা সুলতানকে তার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেছি, কিন্তু তিনি ক্ষমতা পাওয়ার পর আমাদেরকে পরিস্কার মাফ করে দিয়েছেন আর উল্টো আমাদের পক্ষে সুপারিশ করেছেন।”
ইবনুল কায়্যিম বলেন, "তিনি শত্রুর জন্যও দুয়া করতেন, আমি তাকে একজনের বিরুদ্ধেও বদদুয়া করতে দেখিনি। একদিন আমি তার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ও এমন এক মানুষের মৃত্যুর খবর নিয়ে আসলাম, যে শত্রুতা সাধনে ও যন্ত্রণা প্রদানে সকলের তুলনায় অগ্রগামী ছিলো। তিনি আমাকে ধমক দিয়ে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন আর 'ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন' পাঠ করলেন। এরপর তিনি তার বাড়িতে গেলেন, তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করলেন, সমবেদনা জানালেন আর পরিবারের লোকদের (সান্ত্বনা দিয়ে) বললেনঃ তিনি চলে গেলেও আমি তো রয়েছি। তোমাদের যখন যা দরকার হবে আমাকে বলবে, আমি তোমাদেরকে সে ব্যাপারে সাহায্য করবো।”
হাফিয সিরাজুদ্দিন আল-বাযযার বলেন, “আল্লাহ'র কসম! আমি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর এতো আদব ও এতো ভক্তি- সম্মান প্রদর্শনকারী, তার আনুগত্য ও অনুসরণকারী এবং দ্বীনের সাহায্য করতে আগ্রহী - ইবনে তাইমিয়্যাহ'র চেয়ে বেশী আর কাউকে দেখিনি।”
'আল্লামা 'ইমাদুদ্দিন আল-ওয়াসিতি বলেন, "আমরা আমাদের যুগে একমাত্র ইবনে তাইমিয়্যাহকেই পেয়েছি, যার জীবনে নবুওওয়াতে মুহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নূর এবং যার কথায় ও কাজে সুন্নাহ'র আনুগত্য ও অনুসরণ স্পষ্ট প্রতীয়মান ছিল। সুস্থ মন-মানস এ কথার সাক্ষ্য দিতো, প্রকৃত আনুগত্য ও পরিপূর্ণ অনুসরণ একেই বলে।”
এছাড়াও ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ তাতার, খ্রিস্টান আর রাফেজিদের বিরুদ্ধে জিহাদে এবং বিভিন্ন ভ্রান্ত মতবাদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
সংগ্রামী জীবনঃ
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ এমন এক সময়ে জন্মলাভ করেছিলেন সে সময়টাতে এই উম্মাহ'র জন্য তার মতো এ মহান ব্যক্তিত্বের খুবই দরকার ছিল। উম্মাহ'র মধ্যে শিরক, বিদআত ও বিভিন্ন বিভ্রান্তিপূর্ণ মতবাদের অনুপ্রবেশ, হিংস্র তাতারিদের বর্বর আক্রমণসহ বিভিন্নমুখী বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে দৃঢ়পদে রুখে দাঁড়িয়ে ও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি এই উম্মাহকে পুনরজ্জীবিত করেছেন। তবে শুধুমাত্র এটুকু বলার মাধ্যমেই তার সংগ্রামী জীবন প্রকৃতভাবে অনুধাবন করা সম্ভব না আর এটি তার কোন জীবনীগ্রন্থও নয় যে তার ব্যাপারে বিস্তারিত উল্লেখ করা হবে, বরং খুবই সংক্ষিপ্ত পরিসরে তার সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে কিছু তথ্য এখানে উপস্থাপন করা হবে।
আল-বাযযার বলেন, "প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তি এ ব্যাপারে একমত যে ইবনে তাইমিয়্যাহ হলেন সেই ব্যক্তিদের একজন, যার ব্যাপারে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, 'নিশ্চয়ই আল্লাহ এ উম্মাতের জন্য প্রতি শতাব্দীতে এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন যিনি দ্বীনের সংস্কার করবেন।' ১০ আল্লাহ তার মাধ্যমে শারিয়াহ'র ইস্যুগুলোকে পুনরজ্জীবিত করেছেন, যেগুলো সময়ের পরিবর্তনে বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিলো এবং আল্লাহ তার যুগের সকল লোকদের বিরুদ্ধে তাকে প্রমাণ হিসেবে স্থাপন করলেন। সকল প্রশংসা তো একমাত্র রব্বুল আ'লামিন আল্লাহ'র।”
সপ্তম হিজরির প্রথমার্ধে 'তাতার' শব্দটিই ছিল মুসলিমদের কাছে ভীতি ও আতংকের প্রতীক। তাতারিদের হাতে একের পর এক মার খেতে খেতে মুসলিমরা বিশ্বাস করে নিয়েছিল যে তাতারিরা অজেয়। আরবিতে একটা প্রবাদ ছিল তাদের ব্যাপারে - 'যদি বলা হয় তাতারিরা হেরে গেছে তাহলে সে কথা বিশ্বাস করো না।' তারা ছিল এমনই বর্বর যে ঐতিহাসিক ইবনে আসির তাদের সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, “... তারা গর্ভবতী মেয়েদের পেট তরবারি দিয়ে ফাটিয়ে দিয়েছে আর পেট থেকে বের হয়ে আসা অপরিপুষ্ট বাচ্চাকেও টুকরো টুকরো করেছে।”
ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম তাতারি শাসক কাযান ৬৯৯ হিজরিতে সিরিয়া আক্রমণের জন্য দামেস্ক অভিমুখে সেনাবাহিনী সহকারে যাত্রা শুরু করে, এরপর দামেস্কের বাইরে কাযান ও সুলতানের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুসলিমরা দৃঢ়তা ও বীরত্বের সাথে লড়াই করার পরও তাতারিদের কাছে পরাজিত হয়। সুলতানের বাহিনী মিসর অভিমুখে রওনা হয়, দামেস্কবাসি শহরের অভ্যন্তরে আশ্রয় গ্রহণ করে, বড় বড় উলামায়ে কেরামগণ ও নেতৃস্থানীয় লোকেরা মিসর অভিমুখে পাড়ি জমানোর চিন্তা শুরু করে দিলো, অনেকে এর মধ্যেই শহর ছেড়ে চলে যায়, কয়েদীরা জেল ভেঙে বের হয়ে শহরে তান্ডব চালিয়ে দেয়, অসৎ ও চরিত্রহীন লোকেরা এ সুযোগ কাজে লাগায়। এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে ইবনে তাইমিয়্যাহ ও শহরের সম্মানিত নাগরিকবৃন্দ এক পরামর্শসভায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে তারা কাযানের সাথে দেখা করবেন। ইবনে তাইমিয়্যাহ'র সাথে যাওয়া এক সাথী শাইখ কামালুদ্দিন ইবনুল আনযা কাযানের সাথে সেই সাক্ষাৎকারের বর্ণনা দেন এভাবেঃ
"আমি শায়খের সঙ্গে সেই মজলিসে উপস্থিত ছিলাম। তিনি কাযানকে আদল ও ইনসাফ সম্পর্কিত কুরআনের আয়াত ও হাদিস আর এ সম্পর্কিত হুকুম-আহকাম শোনাচ্ছিলেন। তার আওয়াজ ক্রমান্বয়ে উঁচু হচ্ছিলো আর তিনি ক্রমেই কাযানের নিকটবর্তী হচ্ছিলেন, এমন কি এক পর্যায়ে তার হাঁটু কাযানের হাঁটুর সাথে লেগে যাওয়ার উপক্রম হয়। অবশ্য কাযান তাতে কিছু মনে করেনি। সে অত্যন্ত মনোযোগের সাথে শায়খের কথা শুনছিল। তার সমগ্র দেহ-মন শায়খের প্রতি নিবিষ্ট ছিল। শায়খের প্রতি ভক্তিযুক্ত ভয় ও প্রভাব তাকে এতটা আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো আর সে তা দিয়ে এতো বেশী প্রভাবিত ছিল যে সে সমস্ত লোকদের জিজ্ঞেস করলো, 'কে এই আলিম? আমি আজ পর্যন্ত এমন লোক দেখিনি আর এ ব্যক্তির চেয়ে অধিকতর সাহসী ও শক্ত অন্তঃকরণের ব্যক্তি আজ পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি। আজ পর্যন্ত আমার উপর কারো আর এমন প্রভাব পড়েনি।' লোকেরা তার পরিচয় তুলে ধরেন আর তার জ্ঞান, বিদ্যাবত্তা ও আমলি কামালিয়াত সম্পর্কে আলোচনা করেন।
ইবনে তাইমিয়্যাহ কাযানকে বলেন, 'তুমি দাবী করো যে তুমি মুসলিম, আর আমি জানতে পেরেছি যে তোমার সাথে কাযি, ইমাম আর মুণ্ডাযযিনও সাথে থাকে। কিন্তু এরপরেও তুমি মুসলিমদের উপর হামলা করেছো। ...... আল্লাহ'র বানাদাদের উপর তুমি যুলুম করেছো।'"
এটি ছিল শায়খ ইবনে তাইমিয়্যাহ'র সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের একটা উদাহারন মাত্র।
৭০২ হিজরিতে তাতারিদের সাথে চূড়ান্ত যুদ্ধের পূর্বে এই প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে - তাতারিরা মুসলিম, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ইসলামী শারিয়াহ মতে যুক্তিসঙ্গত হতে পারে? উলামায়ে কেরামগণ এ ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের শিকার হলে ইবনে তাইমিয়্যাহ সব সংশয়ের নিরসন ঘটিয়ে বলেন যে তারা খারেজীদের ন্যায় বিবেচিত হবে। তিনি আলিমদেরকে এর ব্যাখ্যা দিলে আলীমগণ সেই ব্যাখ্যা মেনে নেন। এরপর ইবনে তাইমিয়্যাহ সুলতানের সাথে দেখা করে তার সাথে আলোচনা করার মাধ্যমে সুলতানের মনোবল ও দৃঢ়তা বৃদ্ধি করেন। সুলতান তাকে অনুরোধ করেন যুদ্ধের সময় সুলতানের সাথে থাকার জন্য। অতঃপর ৩রা রমাদান সিরিয়া ও মিসরের বাহিনীর সাথে তাতারিদের যুদ্ধ শুরু হয়, এক প্রচন্ড যুদ্ধের পর মুসলিমরা জয় লাভ করেন। ৪ঠা রমাদান ইবনে তাইমিয়্যাহ দামেস্কে প্রবেশ করলে লোকেরা তাকে মহা আড়ম্বরে অভ্যর্থনা জানায়, মুবারাকবাদ দেন আর তার জন্য দুয়া করেন।
এছাড়া রাফেযি (বাতিনী, ইসমাঈলী, হাকিমী ও নুসায়রী) গোত্রগুলো, যারা ক্রুসেডার ও তাতারিদেরকে মুসলিমদের উপর হামলা পরিচালনায় উস্কানি দিয়েছিলো আর এজন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করেছিলো, তিনি ৭০৫ হিজরিতে সেসব ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনা করেন।
উম্মাহ'র মধ্যে আকিদাহগত যে ভ্রান্ত মতবাদ ছড়িয়ে পড়েছিলো, তিনি তার বিরুদ্ধেও জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ওয়াহদাতুল উজুদ, কবর ও মাযার পূজা, আল্লাহ'র ব্যাপারে ঠাট্টা করা ইত্যাদি শিরক ও বিদআতের বিরুদ্ধে তিনি আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ'র ঝাণ্ডা দৃঢ়ভাবে বহনের মাধ্যমে সংগ্রাম করে যান আর হককে পুনরুজ্জীবিত করেন।
আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকিদা এবং খুলাফায়ে রাশেদিন ও সাহাবায়ে কেরামদের পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষায় ইবনে তাইমিয়্যাহ বিভিন্ন সময়ে শক্ত হাতে কলম ধরেছিলেন। সমসাময়িক শিয়া আলিম ইবনুল মুতাহহিরের একটি বই ছিল, যেটির ব্যাপারে শিয়াদের গর্ব ছিল যে আহলে সুন্নাহ'র কোন আলিমের পক্ষেই এই বইটির জবাব দেওয়া সম্ভব না। হযরত আলী (রাঃ) ও আহলে বাইতের ইমামত ও নিস্পাপতা, প্রথম তিন খলীফার খিলাফাহ'র অবৈধতা এবং সাধারণভাবে সকল সাহাবীদের চরিত্র হনন ছিল এই বইটির প্রধান আলোচ্য বিষয়। বইটি আকায়েদ, তাফসীর, হাদিস ও ইতিহাসসহ বিভিন্ন শাস্ত্রীয় আলোচনা ও জটিল তত্ত্বকথায় ভরপুর ছিল, তাই একজন সর্বজ্ঞান বিশারদ পন্ডিত ব্যক্তির পক্ষেই এ বইটির সমুচিত জবাব দেওয়া সম্ভব ছিল। ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ ছিলেন সেই যোগ্য ব্যক্তি যিনি এই বইটির উপযুক্ত জবাব দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি কিতাবু মিনহাজিস সুন্নাতিন নাবাওিয়্যাহ ফি নাকদি কালামিশ শিয়াতি ওয়াল কুদরিয়্যা (সংক্ষেপে 'মিনহাজুস সুন্নাহ' নামে পরিচিত) নামে একটি কিতাব লিখে সেই বইটির উপযুক্ত জবাব প্রদান করেন।
এছাড়াও বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কারের ক্ষেত্রে ইবনে তাইমিয়্যাহ'র অন্যতম অবদান হল তিনি দর্শন, যুক্তিবাদ ও কালামশাস্ত্রের বিশদ সমালোচনার গুরু দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন আর অকাট্য যুক্তি প্রমাণের আলোকে কুরআন সুন্নাহ'র দাওয়াতি পদ্ধতির শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন। এখানে এর সামান্য কিছু উল্লেখ করা হলঃ
গ্রীক দার্শনিকদের ইলাহিয়্যাত সংক্রান্ত অনুমান নির্ভর বক্তব্যের চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণের পর ক্ষুব্ধ বিস্ময়ে ইবনে তাইমিয়্যাহ প্রশ্ন রেখেছেন যে নবী-রসূলদের ঐশী জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মুকাবিলায় নিজেদের বাজে আন্দাজ অনুমানগুলো পেশ করার নির্বোধ আস্পর্ধা তারা দেখায় কি করে। তিনি লিখেছেন, "দর্শনের আদি গুরু এরিস্টটলের ইলাহিয়্যাহ সংক্রান্ত আলোচনা খুঁটিয়ে দেখলে যে কোন সচেতন পাঠক এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য হবেন, রব্বুল আ'লামিনের পরিচয় সম্পর্কে অজ্ঞতার ক্ষেত্রে গ্রীক দার্শনিকদের সত্যিই কোন তুলনা নেই। তা সত্ত্বেও কিছু সংখ্যক অর্বাচীন যখন গ্রীকদের অতিপ্রাকৃত দর্শনকে রসূলদের ঐশী জ্ঞান ও শিক্ষার মুকাবিলায় টেনে আনে তখন বিস্ময়ে বেদনায় নির্বাক হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। কেননা, ব্যাপারটি তখন গ্রাম্য জমিদারকে শাহানশাহের সাথে তুলনা করার মত দাঁড়ায়, বরং আরও জঘন্য। কেননা, শাহানশাহ যেমন গোটা সাম্রাজ্যের ব্যবস্থাপক, তেমনি জমিদার তার গ্রামের ব্যবস্থাপক, তাই উভয়ের মাঝে দূরতম সাদৃশ্য অন্তত রয়েছে। অথচ নবী ও দার্শনিকদের মাঝে সেটুকুও নেই। কেননা নবীরা যে ইলম ধারণ করেন সে সম্পর্কে দার্শনিকদের বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই, এমন কি তার ধারে কাছে ঘেঁষাও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সত্যি বলতে কি, ইয়াহুদী আর খ্রিস্টান ধর্মনেতারাও তাদের থেকে আল্লাহ- তত্ত্বে অধিক অবগত। এখানে আমি কিন্তু ওহীনির্ভর ইলমের কথা বুঝাতে চাচ্ছি না, সে ইলম আমাদের আলোচনার বিষয়ই নয়। কেননা তা শুধু নবীদেরই বৈশিষ্ট্য, অন্যদের তাতে কোন অংশ নেই। আমি আকল ও বুদ্ধিজাত সে ইলমের কথাই বুঝাতে চাচ্ছি যার সম্পর্ক হল তাওহীদ ও রিসালাতের সাথে, আল্লাহ'র যাত ও সিফাত তথা সত্তা ও গুনের পরিচয়ের সাথে এবং পরকাল ও পরকালীন সৌভাগ্যের নিয়ামক আমলগুলোর সাথে, যেগুলোর অধিকাংশই নবীরা আকল ও বুদ্ধিজাত প্রমাণাদির সাথে বর্ণনা করেছেন। দ্বীন ও শরীয়তের এই বুদ্ধিজাত ইলম সম্পর্কেই আমাদের দার্শনিক বন্ধুরা সম্পূর্ণ বেখবর। ওহীনির্ভর ইলমের তো প্রশ্নই আসে না, কেননা সেগুলো নবীদের একক বৈশিষ্ট্য। সুতরাং দর্শন ও নববী ইলমের তুলনামূলক আলোচনায় সে প্রসঙ্গ আমরা উত্থাপনই করবো না।” মুসলিম মনীষীদের উপর যুক্তিবাদের প্রভাব দর্শনশাস্ত্রের থেকে কম ছিল না। এমন একটা ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে যুক্তিবাদ হল আগাগোড়া বুদ্ধি দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত, নির্ভুল ও বিশুদ্ধ শাস্ত্র যা সত্য মিথ্যা-নির্ধারণের একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। তাই ইবনে তাইমিয়্যাহ বহু কীর্তিত গ্রীক যুক্তিবাদের সমালোচনায়ও অবতীর্ণ হয়েছেন পূর্ণ সাহসিকতা ও আত্মপ্রত্যয়ের সাথে। যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে কিছু মৌলিক আপত্তি উত্থাপন ও সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, বরং একজন মুজতাহিদের দৃষ্টিতে গোটা শাস্ত্রের আগাগোড়া বিচার বিশ্লেষণ ও বিশদ সমালোচনা পর্যালোচনার ঐতিহাসিক দায়িত্বও তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে আঞ্জাম দিয়েছিলেন। শাস্ত্রের বহু স্বীকৃত উসুল ও সূত্রের ভ্রান্তি প্রমাণকল্পে তিনি নিরেট শাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত যুক্তিনির্ভর ও সারগর্ভ আলোচনা করেছেন এবং বিভিন্ন সংজ্ঞার খুঁত ও দুর্বলতা তুলে ধরে নিখুঁত ও সর্বাঙ্গীণ বিকল্প সংজ্ঞা পেশ করেছেন। মোটকথা, গ্রীক দর্শন ও যুক্তিশাস্ত্রে ইবনে তাইমিয়্যাহ'র ইজতিহাদ, স্বাধীন সমালোচনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যালোচনা ইতিহাসের গতিপথে নিঃসন্দেহে একটি মাইলফলকের মর্যাদা লাভ করেছে এবং ইজতিহাদ ও গবেষণার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। কালামশাস্ত্রবিদদের সমালোচনায়ও তিনি সমান তৎপর ছিলেন। কেননা এই ভদ্রলোকেরা ইসলামের আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন সত্য, কিন্তু গায়েবী বিষয়গুলো প্রমাণ করতে গিয়ে তারা দার্শনিকদের প্রমাণ পদ্ধতি এবং দর্শনের সীমাবদ্ধ ভ্রান্তিপূর্ণ পরিভাষাই ব্যবহার করেছেন, অথচ সেগুলোর স্বতন্ত্র আবেদন ও প্রভাব, অর্থ ও তাৎপর্য রয়েছে। তিনি বলেন, "সৃষ্টিতত্ত্ব, স্রষ্টার অস্তিত্ব ও পুনরুত্থানের সততা প্রমাণের ক্ষেত্রে কালামশাস্ত্রবিদদের বক্তব্য আকল ও যুক্তির বিচারে যেমন সারগর্ভ ও সন্তোষজনক নয়, তেমনি (কুরআন- সুন্নাহ'র) নকল ও উক্তিগত দিক থেকেও প্রামাণ্য নয়। (অর্থাৎ, আকল ও নকল, তথা যুক্তি ও উক্তি কোন বিচারেই তা মনোত্তীর্ণ নয়।) তারা নিজেরাও এ সত্য স্বীকার করে থাকেন। ইমাম রাযি শেষ জীবনে পরিস্কার বলেছেনঃ দর্শন ও কালামশাস্ত্রের প্রমানীকরন পদ্ধতি সম্পর্কে গভীর চিন্তাভাবনার পর আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে তাতে রোগের আরোগ্য নেই এবং পিপাসা নিবারণেরও ব্যবস্থা নেই। পক্ষান্তরে কুরআন-সুন্নাহ'র পক্ষকেই আমি নিরাপদ ও নিকটতম পথরূপে পেয়েছি। ...... আমার মতো যে কেউ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবে তাকে এ সিদ্ধান্তেই উপনীত হতে হবে। গাযালি ও ইবনে আকিল প্রায় অভিন্ন কথাই বলেছেন আর এটিই হল সত্য।”
সত্যের ঝান্ডা তুলে ধরে এগিয়ে যেতে গিয়ে ইবনে তাইমিয়্যাহকে কিছু হিংসুটে ব্যক্তির কারনে কয়েকবার কারাগারে যেতে হয়। ৭২৬ হিজরিতে শেষবারের মতো কারাগারে প্রেরণ করা হলে তার বিরোধী ও হিংসুটে লোকেরা এ সময় তার বন্ধু ও শাগরিদদের উপর আক্রমণ চালায়। ইবনে তাইমিয়্যাহকে কারাগারে প্রেরণ করার ঘটনায় সাধারণ মুসলিম আর হাজার হাজার আলিম শোকাতর হয়ে পড়ে এবং প্রবৃত্তিপূজারী, বিদআতি ও ধর্মদ্রোহীরা আনন্দে উল্লসিত হয়ে পড়ে।
দীর্ঘকাল পর কারাগার জীবনে ইবনে তাইমিয়্যাহ তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলতে ও একাগ্রতারূপ মহাসম্পদ লাভে সক্ষম হোন। সম্ভবত কারাগারে আবারও আসার খবর জানতে পেরে তিনি এর প্রতিই লক্ষ্য করে বলেছিলেন "এর ভেতর প্রচুর কল্যাণ আর বিরাট স্বার্থ রয়েছে।” তিনি এই নির্জন ও নিঃসঙ্গ জীবনের পরিপূর্ণ মর্যাদা দান করেন এবং পরিপূর্ণ আত্মনিমগ্নতা ও গভীর আগ্রহ সহকারে ইবাদাত ও কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল হয়ে পড়েন। এই অবকাশ জীবনে তার সবচেয়ে বড় নেশা ছিল কুরআন তিলাওয়াত। দুই বছরের এই বন্দী জীবনে তিনি তার ভাই শায়খ জয়নুদ্দিন ইবনে তাইমিয়্যাহ'র সাথে ৮০ বার কুরআন তিলাওয়াত খতম করেন। কুরআন তিলাওয়াতের পর হাতে যা কিছু সময় থাকতো তা তিনি অধ্যয়ন, কিতাব রচনা আর নিজের কিতাবের সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজে ব্যয় করতেন। কারাগারে তিনি যা কিছু লিখেছিলেন তার বেশিরভাগই ছিল তাফসীর সম্পর্কিত। এর কারনও ছিল সম্ভবত কুরআন তিলাওয়াতের আধিক্য ও কুরআন গভীর অভিনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন। কতিপয় মাসআলা বিষয়ে তিনি পুস্তিকা ও উত্তরপত্র লিখেন। বাইরে থেকে যেসব গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ তত্ত্বগত প্রশ্নাদি ও ফিকহি সংক্রান্ত খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ চেয়ে পাঠানো হতো তিনি তার জওয়াব দিতেন। কারাগারে বসে তিনি যা কিছু লিখতেন লোকে তা হাতে হাতে লুফে নিতো আর তা দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যেতো।
কারাগারের ভেতর তার রচিত একটি পুস্তিকা ছিল যিয়ারতের মাসআলা সম্পর্কিত, যেটিতে তিনি মিসরের আবদুল্লাহ ইবনুল আখনাঈ নামের এক মালিকী মাযহাবের কাযিকে প্রত্যাখ্যান করেন। সেই কাযির মূর্খতা এতে প্রমাণিত হয়ে গেলে সেই কাযি সুলতানের কাছে ইবনে তাইমিয়্যাহ'র বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। এর ফলে সুলতানের আদেশে শাইখের কাছ থেকে লেখাপড়ার সকল উপকরণ ছিনিয়ে নেওয়া হয়। সে সময় তার কাছ থেকে তার সমস্ত পাণ্ডুলিপি ও লিখিত পৃষ্ঠা কারাগার থেকে নিয়ে আদিলিয়ার বড় লাইব্রেরীতে রাখা হয়। এসব কিতাবের পরিমাণ ছিল ৬০ খন্ডের। কিন্তু ইবনে তাইমিয়্যাহ এরপরেও থেমে থাকেননি, তিনি বিচ্ছিন্ন ও টুকরো কাগজ কুড়িয়ে জমা করে সেগুলোর উপর কয়লা দিয়ে লিখতে শুরু করলেন। পরবর্তীকালে এভাবে লিখিত তার কয়েকটি পুস্তিকাও পাওয়া গিয়েছে।
তার ছাত্রঃ
ইবনে তাইমিয়্যাহ তার যৌবন থেকেই শিক্ষা দেওয়া শুরু করেন আর দীর্ঘ ৪০ বছর যাবত তিনি শিক্ষা দান করেন। এ সময়ে অসংখ্য ছাত্র তার থেকে দ্বীনের ইলম হাসিল করেন। তার উল্লেখযোগ্য ছাত্রদের মধ্যে কয়েকজন হলেনঃ ইবনুল কায়্যিম, ইবনে কাসির, আয-যাহাবি, ইবনে কুদামাহ আল- মাকদিসি, ইবনে মুফলিহ আল-হানবালি, আবু মুহাম্মাদ আল-কাসিম আল-বারযালি, আল-বাযযার, ইবনে আবদুল হাদি, উমার আল-হাররানি প্রমুখ।
ইবনে হাযার বলেন, "যদি শাইখ ইবনে তাইমিয়্যাহ'র ইবনুল কায়ি্যমের মতো একজন ছাত্র ছাড়া আর কোন অর্জন না-ও থাকতো, যিনি বহুল প্রচারিত কিতাবসমূহের রচনা করেছেন যেগুলো থেকে তার সাথে ঐকমত আর মতানৈক্য পোষণকারী উভয়ই উপকৃত হয়, তবে এটিই শাইখের মহান মর্যাদা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট হতো।”
তার কর্মঃ
কুরআন-সুন্নাহ'র সুগভীর জ্ঞান, শরীয়তের ভাব ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে পূর্ণ সচেতনতা এবং ফিকহ ও ইজতিহাদের অঙ্গনে পাণ্ডিত্য ও বৈদগ্ধের ছাপ তার প্রতিটি লেখা ও রচনায় ছিল সুস্পষ্ট। ইবনে তাইমিয়্যাহ তাফসীর শাস্ত্রকে তার রচনা ও গবেষণা জীবনের বিশেষ বিষয়রূপে গ্রহণ করেছিলেন। তার ছাত্রদের বর্ণনা মতে, তিনি ৩০ খন্ডেরও বেশী এক সুবিশাল তাফসীর কিতাব রচনা করেছিলেন। এই বিস্তৃত ও ধারাবাহিক তাফসীর কিতাবটি বিলুপ্ত হয়ে গেলেও বিভিন্ন সূরার খন্ডিত তাফসীর ইতিমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত তাফসীর কিতাবগুলো হল - তাফসীরু সুরাতিল ইখলাস, তাফসীরু মু'আওয়াযাতাইন, তাফসীরু সুরাতিন নূর। এছাড়া তার রচনা সমগ্র থেকে তাফসীর বিষয়ক অংশগুলো তাফসিরু ইবনে তাইমিয়্যাহ নামে ৭ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে।
তার রচিত বিপুল সংখ্যক অন্যান্য কিতাবসমূহের মধ্যে কয়েকটি কিতাব হল - মাজমু' ফাতওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ (৩৭ খন্ড), ফাতওয়া আল-কুবরা (৫ খন্ড), আকিদাতুল ওয়াসিতিয়্যাহ, আকিদাতুল হামাওিয়্যাহ, দার তা'আরুদ আল-'আকল ওয়ান নাকল (১২ খন্ড), মিনহাজুস সুন্নাহ আন নাবাওিয়্যাহ (৬ খন্ড), আল-জাওাব আস-সাহিহ লিমান বাদ্দালা দ্বীন আল- মাসিহ (৬ খন্ড), আস- ইস্তিকামাহ, আল-কাওাইদ আন- নুরানিয়্যাহ আল- ফিকহিয়্যাহ, কা'ইদাহ আযিমাহ ফিল ফারাক বাইন 'ইবাদাহ আহল আল-ইসলাম ওয়াল ঈমান ওয়া 'ইবাদাহ আহল আশ- শিরক ওয়ান- নিফাক ইত্যাদি।
তার উক্তিঃ
"আল্লাহ'র পক্ষ থেকে প্রতিটি শাস্তিই হল একদম খাঁটি সুবিচার এবং প্রতিটি দয়াই হল খাঁটি অনুগ্রহ।”
"সত্যিকারের কারারুদ্ধ ব্যক্তি তো সে, যার অন্তর আল্লাহকে স্মরণের ব্যাপারে কারারুদ্ধ; আর সত্যিকারের আটক ব্যক্তি তো সে-ই, যার কামনা-বাসনা তাকে এর ক্রীতদাস বানিয়েছে।”
"এই গোটা দ্বীনের কেন্দ্রই হল সত্যকে জেনে এর উপর আমল করার উপর, আর আমল অবশ্যই সবরের সাথে হতে হবে।"
"আপনি যদি আপনার অন্তরে আমলের মধুরতা অনুভব না করেন তবে সে আমলের ব্যাপারে সন্দেহ করুন, কারন মহিমান্বিত রব তো সবই বুঝতে পারেন।"
"গোলাম তার মালিককে যতই ভালবাসে ততই তার অন্য কিছুর প্রতি ভালোবাসা আর সেগুলোর (অর্থাৎ, ভালোবাসার অন্যান্য বিষয়বস্তুগুলোর) সংখ্যা কমে যায়। আর গোলাম তার মালিককে যত কম ভালবাসে, ততই অন্য কিছুর প্রতি ভালোবাসা আর সেগুলোর সংখ্যা বেড়ে যায়।”
“গোলামের তো সবসময়ই হয় আল্লাহ'র পক্ষ থেকে কোন দয়ার কারনে সেটির প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত, অথবা পাপের ফলে অপরাধী হওয়ার কারনে আল্লাহ'র কাছে তাওবা করে ফিরে যাওয়া উচিত; এভাবে সে আল্লাহ'র এক দয়া থেকে আরেক দয়ার দিকে চলতে থাকে এবং তার তো সবসময়ই তাওবার প্রয়োজন রয়েছে।”
"পাপ হচ্ছে ক্ষতির কারন, আর তাওবা সেই কারণকে দূর করে দেয়।”
"তাওহীদের প্রতি সাক্ষ্য বহন করা কল্যাণের দরজা উন্মুক্ত করে দেয় এবং পাপ থেকে তাওবা করাটা অমঙ্গলের দরজা বন্ধ করে দেয়।”
"অন্তরের বিরুদ্ধে জিহাদ হল কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদের ভিত্তি।”
"কোন ব্যক্তির অন্তর ব্যাধিগ্রস্ত না হলে সে কখনোই আল্লাহ'র পাশাপাশি অন্য কাউকে ভয় করবে না।"
"তাওহীদের পরিপূর্ণতা তো তখনই হয় যখন অন্তরে এগুলো ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না আল্লাহ, তিনি যাদের আর যেগুলো ভালোবাসেন তাদেরকে আর সেগুলোকে ভালোবাসা, এবং তিনি যাদের আর যেগুলোকে ঘৃণা করেন তাদেরকে আর সেগুলোকে ঘৃণা করা, যাদের ব্যাপারে তিনি আনুগত্য করতে বলেছেন তাদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা, যাদের প্রতি তিনি শত্রুতা প্রদর্শন করেছেন তাদের প্রতি শত্রুতা প্রদর্শন করা, তিনি যা করতে আদেশ করেছেন তা করতে আদেশ করা এবং যা করতে নিষেধ করেছেন তা করতে নিষেধ করা।”
“এই দুনিয়াতে একজন ব্যক্তি আল্লাহর স্মরণে, তার প্রশংসায় আর তাঁর ইবাদাতে এমন এক আনন্দ পায় যেটির সাথে কোন কিছুরই তুলনা হয় না।”
“যুহুদের উদ্দেশ্য হল এমনসব কিছু পরিত্যাগ করা যা পরকালে গোলামের ক্ষতি করবে, আর ইবাদাতের উদ্দেশ্য হল এমন সব কাজ করা যা পরকালে তার উপকার করবে।”
“পাপসমূহ হল শিকল ও তালার ন্যায়, যা পাপকর্ম সম্পাদনকারীদেরকে তাওহীদের সুবিশাল বাগানে বিচরণ করা থেকে আর সৎকর্মসমূহের ফসলগুলোকে কাটতে বাধা দেয়।”
“কি করতে পারবে আমার শত্রুরা? আমার অন্তরেই তো রয়েছে আমার জান্নাত, আমি যেখানেই যাই সেটি আমার সাথেই থাকে। আমাকে কারারুদ্ধ করা হলে সেটি হবে আমার রবের সাথে একাকী সঙ্গ লাভের একটি সুযোগ। আমাকে হত্যা করা হলে তো শাহাদাত লাভ করবো আর আমার ভূমি থেকে আমাকে নির্বাসিত করা হলে সেটি হবে এক আধ্যাত্মিক সফর।”
তার মৃত্যুঃ ইবনে তাইমিয়্যাহ কারারুদ্ধ অবস্থাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে দামেশকের শাসনকর্তা তার কাছে রোগ পরিচর্যার উদ্দেশ্যে গমন করেন আর তাকে বলেন, “আমার দ্বারা কোন ত্রুটি বিচ্যুতি হলে বা কষ্ট পেয়ে থাকলে আল্লাহ'র ওয়াস্তে আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।” জবাবে ইবনে তাইমিয়্যাহ বললেন, “আমি আমার পক্ষ থেকে আপনাকে ক্ষমা করেছি আর তাদেরকেও ক্ষমা করেছি যারা আমার সাথে শত্রুতা করেছে। আর আমি যে সত্যের উপর আছি তা তারা জানে না। সুলতান মু'আজ্জাম আল-মালিকুন নাসির আমাকে বন্দী করেছিলেন বলে তার বিরুদ্ধেও আমার কোন অভিযোগ নেই। কেননা তিনি নিজে থেকে এ কাজ করেননি, বরং উলামায়ে কেরামগনের প্রতি আস্থা ও আনুগত্যের কারনে করেছেন। তাই আমি তাকে মা'যুর মনে করি। আমার পক্ষ থেকে আমি আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর দুশমন ছাড়া সবাইকেই মাফ করেছি।”
বেশ কিছুদিন শরীর অসুস্থ থাকার পর তিনি কারারুদ্ধ অবস্থায় ৭২৮ হিজরি সনের ২০শে যুলকাদাহ রাতে ইন্তিকাল করেন। মুত্তাযযিন দুর্গের মিনারে চড়ে শায়খুল ইসলামের মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করেন, এরপর বুরুজে মোতায়েন পাহারারত চৌকিদার সেখান থেকে সেই ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করে, মসজিদগুলো থেকেও ছড়িয়ে পড়ে এ শোকবার্তা, বিদ্যুৎ বেগে ছড়িয়ে পড়ে তার মৃত্যু সংবাদ। মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যায় শহরের সব আনন্দ কোলাহল, শোকের ছায়া নেমে আসে সর্বত্র। দুর্গের দরজা খুলে দিয়ে সর্বসাধারণকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। দলে দলে লোকজন আসতে থাকে শায়খুল ইসলামকে এক নজর দেখার জন্য।
মৃতদেহকে গোসল দেওয়ার পরে তার প্রথম জানাযা দুর্গের ভেতর অনুষ্ঠিত হওয়ার পর তা শহরের বৃহত্তম মসজিদ (এটি তৎকালীন ইসলামী বিশ্বের বৃহত্তম জামে মসজিদও ছিল) জামে উমুবিতে আনা হয়। দুর্গ ও জামে উমুবির মধ্যকার দীর্ঘ রাজপথ লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। এ মসজিদ ভরে গিয়ে সামনের ময়দান, রাজপথ, আশেপাশের অলি-গলি, বাজার সবই লোকে ভরে যায়। ভিড়ের চাপ এতো বেশী ছিল যে সৈন্যদেরকে কফিন ঘিরে রাখতে হয়, অন্যথায় জানাযার হেফাযত ও ইন্তিজাম করা ছিল সত্যিই কঠিন। ঐতিহাসিকদের মতে ইতিপূর্বে ইসলামী বিশ্বের আর কোথাও এতো বড় জানাযা অনুষ্ঠিত হয়নি।
ইবনে কাসির বলেন, "তার জানাযার সামনে, পিছে, ডানে বামে বিপুল সংখ্যক ব্যক্তি অবস্থান করছিলেন। তাদের সংখ্যা একমাত্র আল্লাহই গণনা করতে পারেন। কোন এক ব্যক্তি চিৎকার করে বললেন, 'সুন্নাতের ইমামের জানাযা তো এমনই হয়', এটি শোনার পর লোকেরা কাঁদা শুরু করলো।”
ফজরের পর জানাযা বের হয়েছিলো, যোহরের পর জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয় আর ভিড় ঠেলে নিকটবর্তী কবরস্থান আস-সুফিয়াতে পৌঁছতে আসরের ওয়াক্ত হয়ে পড়ে। অতি অল্প সময়ে শায়েখের মৃত্যু সংবাদ পুরো ইসলামী বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
ইমাম ইবনে রজব বলেন, “নিকটবর্তী ও দূরবর্তী দেশগুলোতে ইমামের গায়েবানা জানাযা পড়া হয়, এমনকি ইয়ামান ও সুদুর চীনেও তার গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। ভ্রমণকারীরা বর্ণনা করেছেন যে চীনের একটি দূরবর্তী শহরে জুমু'আর দিন গায়েবানা জানাযার ঘোষণা এভাবে দেওয়া হয়েছিলো - 'কুরআনুল কারীমের মুখপাত্রের জানাযা হবে।'"
মহান আল্লাহ ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ.) কে ক্ষমা করুন এবং তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস প্রদান করুন, আমীন।
টিকাঃ
৮. ইবনে তায়মিয়্যাহ সম্পর্কে এই লেখক পরিচিতি অংশটি তৈরি করতে মূলত এই উৎসগুলো ব্যবহার করা হয়েছেঃ যুগস্রস্টা সংস্কারক ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ; সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস (২য় খন্ড); Expounds on Islam; The lofty virtues of Ibn Taymiyyah; The essential pearls & gems of Ibn Taymiyyah
৯. হাদিসটি ইবনে মাযাহ, তিরমিযি ও মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত আছে।
১০. হাদিসটি আবু দাউদে (কিতাবুল মালাহিম) ও মুসতাদরাকে হাকিম (৪/৩৯৬) এ বর্ণিত হয়েছে। ইমাম সুয়্যুতি বলেন, হাদিসের আলিমরা এতে একমত যে হাদিসটি সাহিহ।
১১. ইবনুল কায়্যিমের ইগাসা আল লাহফান ১/৭-১০; ইবনে তাইমিয়্যাহ'র মাজমু' ফাতওয়া ১০/৯১-১৪৯
📄 চিকিৎসা সম্পর্কে কুরআনে বর্ণিত আয়াত
মহান আল্লাহ বলেন,
وَيَشْفِ صُدُورَ قَوْمٍ مُّؤْمِنِينَ (١٤)
"...এবং তিনি মুমিনদের অন্তরসমূহের চিকিৎসা করবেন।” (সূরা তাওবাহ, ৯ : ১৪)
وَإِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفِينِ (৮০)
"এবং যখন আমি অসুস্থ হই, তিনি আমার চিকিৎসা করেন।” (সূরা শু'আরা, ২৬ : ৮০)
يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُم مَّوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِّمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ (٥٧)
“হে মানবজাতি, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে উপদেশ এসেছে, আর এসেছে অন্তরসমূহের সকল রোগের একটি চিকিৎসা, এবং (এটি) মুমিনদের জন্য হিদায়াত (পথপ্রদর্শক) ও রহমত।” (সূরা ইউনুস, ১০ : ৫৭)
وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ وَلَا يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلَّا خَسَارًا (৮২)
"এবং আমরা কুরআন নাযিল করেছি, যা মুমিনদের জন্য একটি চিকিৎসা ও রহমত..." (সূরা ইসরা', ১৭ : ৮২)
هُوَ لِلَّذِينَ آمَنُوا هُدًى وَشِفَاءٌ .
"এটি (কুরআন) আল্লাহ'র বিশ্বাসী বান্দাদের জন্য হিদায়াত আর একটি চিকিৎসা।” (সূরা ফুসসিলাত, ৪১ : ৪৪)
يَخْرُجُ مِن بُطُونِهَا شَرَابٌ مُّخْتَلِفٌ أَلْوَانُهُ فِيهِ شِفَاءٌ لِّلنَّاسِ
"তাদের উদর থেকে নির্গত হয় বিবিধ বর্ণের পানীয় (মধু), যাতে মানুষের জন্য রয়েছে একটি চিকিৎসা।” (সূরা নাহল, ১৬ : ৬৯)
📄 পরিশিষ্ট
এই অধ্যায়ে কোনো কন্টেন্ট এখনো যোগ করা হয়নি।
📄 লেখক পরিচিতি (২) – ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম আল-জাওজিয়্যাহ (রহ.)
তার নাম, জন্ম ও বংশপরিচয়ঃ
তিনি হলেন শামসুদ্দিন আবু ‘আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকর ইবনে আইয়ুব ইবন সা’দ ইবনে হারিয ইবন মাক্কি যাইনুদ্দিন আয-যুরি আদ-দামিস্কি আল-হানবালি। তার পিতা শাইখ আবু বকর ইবনে আইয়ুব আয-যুরি ছিলেন শামের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ হানবালি মাদরাসা, আল- মাদরাসাতুল জাওজিয়্যাহ এর একজন কায়্যিম (পরিচালক)। এ কারনে তিনি ইবনুল কায়্যিম আল-জাওজিয়্যাহ নামেই পরিচিতি লাভ করেন।
তিনি ৬৯১ হিজরির সফর মাসের ৭ তারিখে সিরিয়ার দামাস্কাসের দক্ষিণ-পূর্বে একটি নিকটবর্তী গ্রাম যার- এ এক উচ্চবংশ ও ইলমী পরিবারে জন্মগ্রহন করেন।
ইবনে কাসির বলেন, “তার পিতা ছিলেন একজন সৎকর্মপরায়ণ আবেদ, অকপট ও উন্নতচরিত্রের ব্যক্তি। ...... তার জানাযায় অনেক লোক অংশগ্রহণ করেছিলো আর লোকেরা তার খুব প্রশংসা করতো।”
আস-সাফাদি, ইবনে তাগরি বারদি এবং আশ-শাওকানি বলেন যে, ইবনুল কায়্যিমের পিতা ফারযিয়্যাতের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনি তার পিতার কাছ থেকেই ফারযিয়্যাত সম্পর্কে ইলম অর্জন করেন।
তার শিক্ষকঃ
তিনি উত্তরাধিকার সম্পর্কিত জ্ঞান গ্রহণ করেছেন ইসমাইল বিন মুহাম্মাদের কাছ থেকে, আরবি ভাষা আবু ফাতহ আল-বালাবকি এবং আল-মাজদ আত-তুনিসি থেকে। একদল আলিমের সংস্পর্শে থেকে তিনি ফিকহ অধ্যয়ন করেন, তাদের মধ্যে একজন হলেন ইসমাইল বিন মুহাম্মাদ আল-হাররানি। তিনি উসুল শিক্ষা গ্রহণ করেন আস-সাফি আল-হিন্দি থেকে। তিনি হাদিস সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন শাহাব আল-নাবুলসি, কাযি তাকিউদ্দিন সুলাইমান, ফাতিমা বিনতে জাওহার, ঈসা ইবনে মুত’ইম, আবু বকর ইবনে আব্দুদ্দাইম প্রমুখ যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসদের কাছ থেকে। তবে তার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, যার সাথে সুদীর্ঘ ১৭ বছর থেকে তিনি জ্ঞান অর্জন করেছেন আর যিনি তার জীবনে বড় প্রভাব রেখেছেন, তিনি হলেন মুজাদ্দিদ ও ইমাম, শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ’র অর্জিত জ্ঞান আর ইবনুল কায়্যিমের নিজের অর্জিত জ্ঞানের সমন্বয়ে ইবনুল কায়্যিম ইসলামী জ্ঞানের বহুসংখ্যক শাখাতে এক অসাধারণ আলিমে পরিণত হোন।
তার জ্ঞানগত মর্যাদাঃ
ইবনে রজব বলেন, “সকল ইসলামী শাস্ত্রেই তার দখল ছিলো, তবে তাফসীর জগতে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। উসুল বিষয়ক শাস্ত্রগুলোতেও তিনি শীর্ষস্থানের অধিকারী ছিলেন। হাদিস, হাদিস বিজ্ঞান এবং ইজতিহাদ ও সূক্ষ্ম যুক্তি প্রয়োগে তার কোন সমকক্ষ চোখে পড়ে না। ফিকহ, ফিকহ বিজ্ঞান, আরবি ভাষা ও সাহিত্য এবং কালাম শাস্ত্রেও তার যথেষ্ট দখল ছিল। দখল ছিলো। সূফী দর্শন ও তাসাওউফ তত্ত্বেও তিনি গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। কুরআন-সুন্নাহ'র ভাব ও মর্ম, ঈমানের হাকিকত ও তত্ত্ব সম্পর্কে তার চেয়ে বড় আলিম কাউকে দেখিনি। অবশ্যই তিনি নিস্পাপ ছিলেন না, তবে এসব গুণ ও বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে তার মতো মানুষ আমি দেখিনি।”
ইমাম আয-যাহাবি বলেন, "হাদিসের মতন ও সনদের প্রতিও তার অখণ্ড মনোযোগ ছিলো। ফিকহ অধ্যয়নেই তিনি সবসময় নিমগ্ন থাকতেন আর শাস্ত্রীয় জটিল বিষয়গুলো বিশদভাবে লিখতেন। ব্যাকরণ শিক্ষাদানে তার বেশ নাম ছিল এবং হাদিস-বিজ্ঞান ও ফিকহ- বিজ্ঞানেও তার ভালো যোগ্যতা ছিলো।”
আশ-শাওকানি বলেন, "তিনি নিজেকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দলীলে সীমাবদ্ধ করে রাখতেন আর সেগুলোর উপর আমল করার তারীফ করতেন। তিনি মতামত (রাই) এর উপর নির্ভর করতেন না, তিনি অন্যান্যদেরকে সত্য দিয়ে পরাজিত করতেন আর এ ব্যাপারে তিনি কারো সাথেই কর্কশ ছিলেন না।”
ইবনে হাযার বলেন, "তার ছিল এক নির্ভীক অন্তর, ছিল প্রচুর ইলম এবং ভিন্ন মতামত (ইখতিলাফ) ও সালাফদের মাযহাব সম্পর্কেও তিনি ভালোভাবে পরিচিত ছিলেন।”
ইবনে কাসির বলেন, "দিনরাত তিনি নিজেকে জ্ঞানের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখতেন। .... তিনি এমনসব কিতাব থেকে ইলম অর্জন করেছেন যা অন্য কেউ অর্জন করতে পারেনি। সালাফ ও খালাফদের কিতাব সম্পর্কে তার গভীর বুঝ ছিল।”
আস-সুযুতি বলেন, “তিনি তাফসীর, হাদিস, উসুল, ফুরু আর আরবি ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিম ছিলেন।”
মোল্লা আলী আল-কারী বলেন, “যে কেউই শারহ মানাযিলুস সাইরিন (অর্থাৎ, মাদারিজুস সালিকিন) বইটি বিশ্লেষণ করবে, তার কাছে এটি স্পষ্ট ও পরিস্কার হয়ে যাবে যে এই উম্মাহ'র মধ্যে তারা উভয়ই (অর্থাৎ, ইবনে তাইমিয়্যাহ আর ইবনুল কায়্যিম) আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা'আহ'র সবচেয়ে প্রবীণ আলিমদের মধ্যে আর আল্লাহ'র আওলিয়াদের মধ্যে দুজন আলিম।”
ইবনে নাসিরুদ্দিন আদ- দিমিশকি বলেন, "তিনি বিভিন্ন ইসলামিক বিদ্যার অধিকারী ছিলেন, বিশেষ করে তাফসীর ও উসুল বিদ্যার।”
যুহদ ও ইবাদাতঃ ইবনে রজব বলেন, "বিনিদ্র রজনী যাপনে অভ্যস্ত ইবনুল কায়্যিম ছিলেন খুব ইবাদাত প্রেমিক। খুব দীর্ঘ ও প্রশান্তিপূর্ণ হতো তার সালাত। সবসময়ই তার জবান যিকিরে সজীব থাকতো। হৃদয়ে ছিল আল্লাহ- প্রেম ও আল্লাহতে সমর্পিত হওয়ার এক উদ্বেলিত ভাব। পবিত্র মুখায়বে ছিল আল্লাহ'র হুজুরে নিজের দৈন্য ও নিঃস্বতা এবং অসহায়ত্ব ও দীনতা প্রকাশের এক নূরানী দীপ্তি। এ দুর্লভ ভাবের অভিব্যক্তিতে আমার মনে হয়েছে তিনি সত্যিই অনন্য ও অতুলনীয়। কয়েকবার হাজ্জ সম্পাদন করা ছাড়াও দীর্ঘদিন তিনি মক্কায় অবস্থান করেছেন। মক্কাবাসীরা তার সার্বক্ষণিক ইবাদাত ও তাওয়াফের বিস্ময়কর সব ঘটনা শুনিয়ে থাকেন।"
ইবনে কাসির বলেন, "তিনি প্রচুর সালাত আদায় করতেন আর প্রচুর পরিমানে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। তার চরিত্র ছিল খুবই চমৎকার, তিনি খুবই স্নেহপরায়ণ ও বন্ধুত্বপরায়ণ ছিলেন। ... বড় ভালোবাসার মানুষ ছিলেন তিনি। হিংসা তার স্বভাবেই ছিল না। কাউকে কষ্ট দেওয়া বা হেয় করা তিনি জানতেন না। তার একজন অতি প্রিয় সহচর হিসাবে সমসাময়িক দুনিয়ায় তার চেয়ে ইবাদাত পাগল ও নফল প্রেমিক কেউ ছিল কিনা তা আমার জানা নেই। দীর্ঘ রুকু সিজদাহসহ বড় প্রশান্তিপূর্ণ সালাত আদায় করতেন তিনি। সাথীদের মুখে এজন্য তাকে তিরস্কারও শুনতে হতো, কিন্তু এ স্বাদের জিনিষ পরিত্যাগ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। মোটকথা, গুনে ও কর্মের বিচারে তার তুলনা পাওয়া দুস্কর।"
সংগ্রামী জীবনঃ
ইবনুল কায়্যিমের জীবনের সময়টাতে দ্বন্দ্ব-বিবাদ ও অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছিলো। এছাড়াও ইসলামিক রাষ্ট্রকে ভয়প্রদর্শনকারী বাহ্যিক হুমকিও ছিল। এই কারনে তিনি বিভক্ত হওয়া ও অনৈক্যকে প্রত্যাখ্যান করার এবং আল্লাহ'র কিতাব ও রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরে রাখার আদেশ করতেন।
তার লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি লক্ষ্য ছিল দ্বীন ইসলামের মূল ও বিশুদ্ধ উৎসের দিকে উম্মাহকে ফিরিয়ে আনা এবং একে বিদআত ও কামনা-বাসনা থেকে পরিশুদ্ধ করা। তাই তিনি অন্ধ অনুসরণ (তাকলীদ) করার মাযহাবকে ধ্বংস করার আর সালাফদের মাযহাবে ফিরে আসার এবং তাদের পথ ও পদ্ধতির উপর থেকে এগিয়ে যাওয়ার আহবান করলেন। আর এ কারনেই দেখা যায়, তিনি নিজেকে কেবল হানবালি মাযহাবে সীমাবদ্ধ করে রাখেননি, বরং প্রায়ই তিনি অন্যান্য বিভিন্ন মাযহাব থেকে মতামত গ্রহণ করতেন অথবা এমন হতো যে তিনি এমন এক মতামত দিলেন যেটি কিনা অন্যান্য সকল মাযহাবের মতামতের বিরোধী। এ কারনে ইজতিহাদ করা আর তাকলীদকে প্রত্যাখ্যান করাটাই ছিল তার মাযহাব। এর ফলে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। তার শাইখ ইবনে তাইমিয়্যাহ আর তাকে একই কারাগারে রাখা হয়, অবশ্য তাদেরকে পৃথক করেই রাখা হয়। ইবনে তাইমিয়্যাহ'র মৃত্যুর পর তাকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
তার দীর্ঘ বন্দী জীবনের সবটুকু সময় কেটেছে কুরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন নিমগ্নতায়। ইবনে রজব এ ব্যাপারে বলেন, "বন্দী জীবন তার জন্য খুবই কল্যাণকর হয়েছিলো। সে সময়টাতে তিনি এমন গভীর প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞান লাভ করেছিলেন যে, তত্ত্বজ্ঞানীদের জটিল ও সূক্ষ্ম তত্ত্বজ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করা তার জন্য সহজ হয়ে গিয়েছিলো। তার রচনা- সমগ্র এ ধরণের বিষয়বস্তুতে পরিপূর্ণ।”
তার ছাত্রঃ
তার অনেক ছাত্র ছিল, তাদের মধ্যে কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হলেনঃ ইবনে কাসির, আয-যাহাবী, ইবনে রজব, ইবনে আবদুল হাদি এবং তার দুই পুত্র ইব্রাহীম আর শারাফুদ্দিন আবদুল্লাহ।
তার কর্মঃ
আল-নুমান আল-আলসি আল-বাগদাদি বলেন, "তার তাফসীর সঠিকতার দিক থেকে অনন্য।”
আত-তাহাবি বলেন, “রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিস উল্লেখ ও এর বর্ণনা দেওয়ার ব্যাপারে তিনি খুবই গুরুত্ব দিতেন।”
শাইখ বুরহানুদ্দিন আল- যারি বলেন, "ইবনুল কায়্যিমের সময়টাতে তার মতো জ্ঞানী ব্যক্তি আর কেউই ছিলো না।”
ইবনুল কায়্যিম ষাটটির বেশী কিতাব রচনা ও সংকলন করেছিলেন। তার লিখনিতে অন্তর ছুঁয়ে যাওয়ার এক অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এছাড়াও তার লিখনিতে যথাযথতা, স্পষ্টতা, যুক্তির প্রবলতা আর গবেষণার গভীরতা লক্ষ্য করা যায়। তার রচিত ও সংকলিত কিতাবসমূহের মধ্যে কিছু কিতাবের নাম উল্লেখ করা হলঃ
হাদিস ও সিরাত সম্পর্কিত - তাহযিব সুনান আবু দাউদ, আল- মানারুল মুনিফ, ফাওা'ইদ আল-হাদিসিয়্যাহ, জালা'উল আফহাম, যাদুল মা'আদ।
ঈমান সম্পর্কিত - ইজতিমা' আল-জুয়ুশ আল-ইসলামিয়্যাহ, আস-সাত্তা'ইকুল মুরসালাহ, শিফা'উল 'আলিল, হাদিযুল আরওয়াহ, আল-কাফিয়াতুশ শাফিয়াহ, কিতাবুর রুহ।
আখলাক ও তাযকিয়্যাহ সম্পর্কিত - মাদারিজুস সালিকিন, আদ- দা'ওয়াদ দাওয়া', আল-ওয়াবিলুস সায়্যিব, আল-ফাওা'ইদ, রিসালাতুত তাবুকিয়্যাহ, মিফতাহ দারুস সা'আদাহ, 'উদ্দাতুস সাবিরিন।
কুরআন বিদ্যা সম্পর্কিত - আত-তিবইয়ান ফি আকসামিল কুরআন, আমসালুল কুরআন।
ভাষাগত ও বিবিধ ইস্যু সম্পর্কিত - বাদা'ই আল-ফাওা'ইদ।
ইবনুল কায়ি্যমের বিভিন্ন লিখনি থেকে ব্যাখ্যামূলক মন্তব্য সঙ্কলন করে দুটো বই সম্পাদনা করা হয়েছে, এগুলো হল - তাফসীরুল কায়্যিম এবং তাফসিরুল মুনির।
তার কিছু উক্তিঃ
"তিনি সৃষ্টি করেছেন সাত সাগর, তবুও তিনি তার প্রতি ভয়বশত আপনার চোখের এক ফোঁটা অশ্রু দেখতে ভালোবাসেন, অথচ আপনার চোখদুটো অশ্রুবিহীন!”
"সত্যিকারের মানুষ তো সে-ই, যে তার অন্তরের মৃত্যুর ব্যাপারে ভয় করে, তার শারীরিক মৃত্যুকে নয়।”
"কোন ছোট পাপকেই তাচ্ছিল্য করবেন না, কারন ক্ষুদ্রতম অগ্নিস্ফুলিঙ্গ থেকেই বৃহত্তম অগ্নিকান্ড ঘটতে পারে।”
"বাজে চিন্তাকে তাড়িয়ে দিন, যদি এটি না করেন তবে সেটি একটা উদ্দেশ্যে পরিণত হবে। তাই বাজে উদ্দেশ্যকে তাড়িয়ে দিন, নতুবা সেটি একটি কামনা-বাসনায় পরিণত হবে। সুতরাং কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করুন, যদি না করেন তবে সেটি একটি সংকল্প ও গভীর আসক্তিতে পরিণত হবে।"
"পাপকে অবশ্যই জ্বালিয়ে দেওয়াটা দরকার - হয় অনুতাপের যন্ত্রণা দিয়ে, নতুবা পরকালে দোযখের আগুন দিয়ে।”
"এই দ্বীন (ইসলাম) নিজেই একটি নৈতিক আচরণ। তাই আপনার আচার-আচরণের তুলনায় যে ব্যক্তি আপনার থেকেও এগিয়ে থাকবে, দ্বীন পালনে সে-ই আপনার থেকে উত্তম।”
"পাপগুলোর শাস্তি হিসেবে এটিই যথেষ্ট যে আপনি আল্লাহ'র ইবাদাত করতে চাওয়া সত্ত্বেও সেই পাপগুলো আপনাকে তার ইবাদাত করতে বাধা দিবে।”
"আল্লাহ চোখকে অন্তরের আয়না বানিয়েছেন। তাই গোলাম যদি তার দৃষ্টিকে অবনত করে, তবে তার অন্তর এর কামনা-বাসনাকে অবনত করবে। আর যদি সে তার দৃষ্টিকে বাধাহীন করে দেয়, তবে তার অন্তরও এর কামনা-বাসনাকে বাধাহীন করে দিবে।"
"অন্তর বেঁচে থাকাটা নির্ভর করে কুরআন দিয়ে প্রতিফলিত হওয়া, গোপনে আল্লাহ'র সামনে নম্র থাকা আর পাপ বর্জন করার উপর।”
"আপনি যদি পরীক্ষা করে দেখতে চান যে আল্লাহকে আপনি কতটুকু ভালোবাসেন, তবে দেখুন যে আপনার অন্তর কুরআনকে কত ভালবাসে, আপনি জবাব পেয়ে যাবেন।”
"এই দুনিয়া হল একটি সেতু, আর একটি সেতুকে নিজের আবাস হিসেবে গ্রহণ করাটা উচিত নয়।”
"কি আশ্চর্য! আপনার কাছ থেকে অল্প কিছু হারিয়ে গেলে আপনি কাঁদেন, অথচ আপনার পুরো জীবনটাই ক্ষয়ে যাচ্ছে আর আপনি হাসছেন!”
"অন্তর যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তবে হারাম কাজগুলো আকর্ষণীয় হয়ে যায় আর আল্লাহ'র আনুগত্য করাটা এমন কাজ হয়ে যায় যাকে অবজ্ঞা সহকারে দেখা হয়।”
"আল্লাহ আপনাকে কখনোই ধ্বংস করার জন্য পরীক্ষা করেন না। তিনি আপনার হাত খালি করার মাধ্যমে আপনার কাছ থেকে কিছু দূর করে দেন এর থেকেও উত্তম কিছু উপহার দেওয়ার জন্য।”
"দুর্দশাগ্রস্ত হওয়া ছাড়া অন্তর কখনোই ধর্মপরায়ণ ও বিশুদ্ধ হবে না। এটি স্বর্ণকে বিশুদ্ধ করার মতোই, স্বর্ণ থেকে এর নিকৃষ্ট ধাতুগুলো অপসারন করা ছাড়া স্বর্ণ কখনোই বিশুদ্ধ হয় না।”
"অন্তরে গানের প্রতি ভালোবাসা আর কুরআনের প্রতি ভালোবাসা কখনোই একসাথে থাকতে পারে না, অন্তরে এই দুটি অবস্থান করলে এদের একটি অপরটিকে বিতাড়িত করে।”
"আল্লাহ'র কাছে কোন কিছুর চাওয়া থামিয়ে দিলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হোন, আর মানুষের কাছে কিছু চাওয়া হলে সে অসন্তুষ্ট হয়।”
"আপনি যখন কোন সৃষ্টিকে ভয় করবেন তখন এর দ্বারা প্রতিহত হওয়া অনুভব করবেন আর এটি থেকে পালিয়ে যাবেন। কিন্তু আপনি যখন সৃষ্টিকর্তাকে ভয় করবেন তখন আপনি নিজেকে তার নিকটে অনুভব করবেন আর তার দিকে দৌড়িয়ে যাবেন।”
"অন্তর যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর প্রতি যুক্ত থাকে, তবে সে যেটির সাথে যুক্ত আছে, আল্লাহ তাকে সেটির উপরই নির্ভরশীল করে দিবেন আর সে ব্যক্তি সেটি দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হবে।”
"কোন ব্যক্তিকে কিভাবে সুস্থ প্রকৃতির হিসেবে বিবেচনা করা যায়, যে কিনা শুধু একটিমাত্র লালসাপূর্ণ ঘণ্টার বদলে জান্নাত ও এর অভ্যন্তরে যা আছে সব কিছুই বিক্রি করে দেয়?”
"প্রকৃতপক্ষে অন্তরে রয়েছে এক অভাববোধ, যা আল্লাহ'র সাথে সম্পর্ক করা ছাড়া দূর হয় না। অন্তরে রয়েছে এক বিষণ্ণতা, যা আল্লাহকে জানা আর তার প্রতি সৎ থাকা ছাড়া দূর হয় না। অন্তরে আরও রয়েছে একটি শুন্যতা, যা তাকে ভালোবাসা ও তাওবা করে আল্লাহ'র দিকে ফিরে যাওয়া আর সবসময় তাকে স্মরণ করা ছাড়া পূরণ হয় না। কোন ব্যক্তিকে যদি পুরো দুনিয়া আর এর সব কিছুই প্রদান করা হয়, তবুও এটি তার শুন্যতা পূরণ করতে পারবে না।”
"একজন ব্যক্তির জবান আপনাকে তার অন্তরের স্বাদ দিতে পারে।"
"আল্লাহ'র ইবাদাত ও আনুগত্য অন্তরকে আলোকিত ও শক্তিশালী করে আর অটল রাখে, যতক্ষণ না পর্যন্ত এটি পরিস্কার আয়নার মতো হয়ে যায়, যা আলো দ্বারা চকচক করে। শয়তান যখন এই অন্তরের নিকটবর্তী হয়, সে এর আলো দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয় সেই শয়তানদের মতো, যারা আসমানে আড়ি পেতে শোনার চেষ্টা করলে তাদেরকে তারকা নিক্ষেপের মাধ্যমে আঘাত করা হয়। আর একটি সিংহ থেকে নেকড়ে যেভাবে পালিয়ে যায়, শয়তান এই অন্তর থেকে এর থেকেও বেশী ভয় নিয়ে পালিয়ে যায়।”
"এই পার্থিব জীবন সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হবেন না কারন এটি তো আল্লাহ'র জন্যই। রিযকের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হবেন না কারন এটি আল্লাহ'র পক্ষ থেকে আসে। ভবিষ্যতের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করবেন না কারন এটি তো আল্লাহ'র হাতে। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার কাজ করে যেতে থাকেন। কারন আপনি যদি তাকে সন্তুষ্ট করেন তবে তিনি আপনাকে সন্তুষ্ট করবেন, আপনার অভাব পুরন করে দিবেন আর আপনাকে সমৃদ্ধ করে দিবেন।”
“হে সবরকারীদের পদযুগল, যেতে থাকো, কারন কেবলমাত্র আর অল্পই তো বাকি আছে। ইবাদাতের মধুরতা মনে রাখবে, তাহলে কঠোরভাবে চেষ্টা করে যাওয়ার তিক্ততা তোমার কাছে আরো সহজ হয়ে যাবে।”
"তার নিয়্যতই সবচেয়ে ভালো, যিনি তার রবের সাথে সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন।"
"নারীরা হলেন সমাজের অর্ধেক, আর তারা সমাজের অপর অর্ধেকের জন্ম দেন; তাই ব্যাপারটি যেন এমন যে তারা নিজেরাই হলেন পূর্ণ সমাজ।”
"কুরআনের অনুসারী তো তারাই, যারা এটি পাঠ করে আর এর উপর আমল করে, যদিও তা তাদের হিফয করা না থাকে।"
“তিনটি বিষয় দ্বারা সুখ অর্জিত হয় - পরীক্ষার সময় সবর করা, অনুগ্রহ পাওয়ার সময় শোকরগুজার থাকা এবং পাপ করলে অনুতপ্ত হওয়া।”
"আল্লাহ ও তার সাথে সাক্ষাতের জন্য আকুল আকাংখা করার ব্যাপারটি হল অন্তরের উপর মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে যাওয়ার মত, যা দুনিয়ার আগুনকে নিভিয়ে দেয়। যে ব্যক্তি তার অন্তরকে তার রবের সাথে নির্দিষ্ট করে নিবে, সে স্থির ও প্রশান্তিপূর্ণ অবস্থায় থাকবে। আর যে তার অন্তরকে লোকদের মধ্যে পাঠিয়ে দিবে, সে গোলমাল ও অতিশয় অস্থির অবস্থায় থাকবে।”
"কাফিরদের মধ্যে অপরিচিত হল একজন মুসলিম, মুসলিমদের মধ্যে অপরিচিত হল একজন মুমিন, আর মুমিনদের মধ্যে অপরিচিত হল একজন মুহসিন।”
"পাপ অন্তরকে সেভাবে ধ্বংস করে যেভাবে বিষ ধ্বংস করে শরীরকে।”
"আন্তরিকতা ছাড়া আমল করার ব্যাপারটি হল সেই মুসাফির ব্যক্তির মত, যে তার পানির পাত্রে ময়লা বহন করে; এটি বহন করা তার জন্য একটি বোঝা আর এটি কোন উপকারেই আসে না।"
"এই পার্থিব জীবন তো একটি ছায়ার মতোই। আপনি যদি একে ধরতে চান তবে কখনোই তা করতে পারবেন না। যদি আপনি এটি থেকে নিজের মুখ ঘুরিয়ে এর প্রতি পিঠ প্রদর্শন করেন, তবে আপনাকে অনুসরণ করা ছাড়া আর এটির কোন উপায় থাকবে না।”
"সত্যের পথে যাও আর এক্ষেত্রে একাকী বোধ করো না, কারন অল্পসংখ্যক লোকই এই পথ গ্রহণ করেন। বাতিল পথের ব্যাপারে সতর্ক থেকো, ধ্বংসপ্রাপ্তদের সংখ্যাধিক্য দ্বারা প্রতারিত হয়ো না।”
"কুনজর দেয় এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই হিংসুক, তবে প্রত্যেক হিংসুক ব্যক্তিই কুনজর দেয় না।”
"টাকা যখন আপনার হাতে থাকবে তবে অন্তরে থাকবে না, এটির কারনে আপনার ক্ষতি হবে না যদিও অধিক পরিমাণে টাকা আপনার কাছে থাকে। কিন্তু টাকা যদি আপনার অন্তরেই থাকে, তবে আপনার হাতে কোন টাকা না থাকলেও তা আপনার ক্ষতি করবে।”
"দুনিয়াতে জবান ছাড়া এমন আর কিছুই নেই যেটিকে গুরুতরভাবে কারারুদ্ধ করা প্রয়োজন।”
"পাপের অনেক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে, তার মধ্যে একটি হল এই যে, পাপ আপনার কাছ থেকে জ্ঞান ছিনিয়ে নিবে।”
তার মৃত্যুঃ
তার মৃত্যুর তারিখের ব্যাপারে ঐক্যমত আছে যে তিনি ৭৫১ হিজরি সনের ১৩ই রজব বৃহস্পতিবার রাতে এশা'র আযানের সময় ইন্তিকাল করেন। পরদিন যোহরের সালাতের পর প্রথমে আল-জামি' আল-উমাওি এবং এরপর জামি' জারাহ তে তার জানাযার সালাত আদায় করা হয়। বিপুল সংখ্যক লোক তার জানাযায় অংশগ্রহন করেছিলো।
ইবনে কাসির বলেন, "তার জানাযা লোকে পরিপূর্ণ ছিল, আল্লাহ তার উপর করুণা করুন। এই জানাযার সাক্ষী ছিলেন বিচারকগণ, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বরা এবং সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তিরা – সাধারণ লোক ও অভিজাত শ্রেণী উভয় পক্ষ থেকেই। তার খাটিয়া বহন করার জন্য লোকেরা ভিড় করেছিলো। দামাস্কাসের কবরস্থান আল-বাব আস-সাগির এ তার মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়, আল্লাহ তাদের উভয়কেই ক্ষমা করুন।”
মহান আল্লাহ ইবনুল কায়্যিম (রহ.) কে ক্ষমা করুন এবং তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস প্রদান করুন, আমীন।
টিকাঃ
(৫৯) ইমাম ইবনুল কায়্যিম, দারুসসালাম পাবলিকেশন্স; সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস, (আবুল হাসান আলী নদভী); http://www.sahihalbukhari.com/SPS/sp.cfm?subsecID=SRH06&articleID=SRH060001&articlePages=1; http://www.islamicity.org/7752/short-biography-of-ibn-al-qayyim-al-jawziyya/