📄 কে হবে আপনার উপদেশদাতা - অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি
কে হবে আপনার উপদেশদাতা
১. অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি
উপদেশদাতার কথার পুনরাবৃত্তিতে কখনো কখনো এক কথা দশবারও শুনতে হয়। তবে ঈমানি ছোঁয়া শ্রোতাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করে। উপদেশদাতার কথাগুলো অন্তরের গভীর ছুঁয়ে যায়। কারণ, তার কথাগুলো বের হয় সরাসরি অন্তর থেকে। সুতরাং, জাগ্রত অন্তরের অধিকারী ব্যক্তি আপনাকে অলসতার জটিলতা থেকে মুক্ত করতে পারবে। কেউ যদি দেখে যে, সে তার সাথীকে নসিহত করে যাচ্ছে; কিন্তু তার কথা কোনো প্রভাব ফেলছে না তবে সে বলে দেবে, হয়তো আমার মনে সমস্যা আছে নয়তো তোমার মনে।
হজের মৌসুমে একদিন আমি মসজিদে হারামে সালাত পড়লাম। ইমাম সাহেব সূরা ফাতেহা পড়লেন। তিনি যখন 'আমাদের সরল সঠিক পথের দিশা দেন' এই আয়াতে পৌছলেন, তাঁর চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। কান্নার আওয়াজে পুরো মসজিদ ভরে উঠল। হৃদয় ও বিবেক ভীত হয়ে উঠল। তাই আমাদের এমন হৃদয়বান প্রয়োজন, যে জবানের আগে অন্তর থেকে নসিহত করবেন। এজন্যই জিলানী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, 'তুমি গোপনে ভালো থাকো। তাহলে প্রকাশ্যে বিশুদ্ধ ও স্পষ্টভাষী হতে পারবে।'
📄 ইলম ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তি - উপদেশের চমৎকার কিছু দৃষ্টান্ত
২. ইলম ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তি
আপনাকে নসিহত ও পরামর্শ তালাশ করতে হবে সেই ব্যক্তি থেকেই, যার আছে অন্তর সংশোধন, দাওয়াত বাস্তবায়ন, ঈমানি উন্নতি সাধন, কল্যাণমূলক পরিকল্পনা, পেশাগত উন্নতি, শিক্ষাগত অগ্রগতি, চিন্তার নতুনত্ব এর যেকোনো একটি যোগ্যতা। তারা আপনার উপকারে আসবে। তারা নিজেদের সফল অভিজ্ঞতার সারনির্যাস আপনার সামনে তুলে ধরতে পারবে।
অলসতার পরিধি একদিকের নয়। তাই আপনার নানাবিধ রোগের জন্য অভিজ্ঞ ডাক্তারের খোঁজ করেন। সুতরাং আহলে কুরআন হলেই সে অন্তরের রোগ সম্পর্কে জানবে না। সময় নিয়ন্ত্রক ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের অধিকারী হয়ে যাবে না। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে উদ্যমী হয়ে উঠবে না। প্রত্যেকেরই কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে। অতএব আপনি নিজের প্রয়োজন অনুপাতে যোগ্য লোক বেছে নেন।
আপনার পরামর্শদাতা যদি বেশি হয় এবং নসিহতকারী পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে তাহলে বুঝে নেবেন, আপনি মূল কেন্দ্রবিন্দুতেই আছেন এবং সঠিক পথেই এগোচ্ছেন। এজন্য উমর ফারুক রাজিয়াল্লাহু আনহু বলতেন-
একক অভিমত ঘর্ষণকারী একটি সুতোর মতো। দুটি মত দুটি সুতোর মতো। আর তিনটি অভিমত একত্রিত তিনটি সুতোর মতো, যা ছিড়ে যায় না। ১৩৩
উপদেশের চমৎকার কিছু দৃষ্টান্ত
উপদেশের সঠিক মূল্য বুঝতেন এমন কতক সালাফের দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরছি; যারা অন্যের কাছ থেকে উপদেশ লাভের তরে ছুটে বেড়াতেন-
* আবুল আতাহিয়া রাহিমাহুল্লাহ খলিফা হারুনুর রশিদের কাছে এসে বললেন, আমাকে সংক্ষেপে কিছু কবিতার পংক্তির মাধ্যমে নসিহত করেন! তখন তিনি আবৃত্তি করলেন-
এক পলক কিংবা এক নিঃশ্বাসের ক্ষেত্রেও মৃত্যু থেকে নিশ্চিন্ত হয়ো না যদিও তুমি থাকোঁ কোনো বেষ্টনী কিংবা প্রহরার প্রতিরোধে,
জেনে রাখো, মৃত্যুর তীর আঘাত হানবেই প্রত্যেক বর্মপরিহিত ও দুর্ভেদ্য প্রাচীরে
তুমি মুক্তির পথে না হেঁটেই মুক্তির দেখা পেতে চাও? জাহাজ তো শুকনোতে চলতে পারে না! ১৩৪
* জারির ইবনু ইয়াজিদ রাহিমাহুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনু আলি ইবনু হুসাইনকে বলেন-আমাকে নসিহত করেন! তিনি বললেন-
জারির, দুনিয়াকে এমন সম্পদ বানাও, যা তুমি স্বপ্নে দেখো। এরপর জেগে উঠলে তোমার কাছে কিছুই থাকে না। ১৩৫
* উমর ইবনু আব্দিল আজিজ রাহিমাহুল্লাহ খালিদ ইবনু সফওয়ান রাহিমাহুল্লাহকে বলেন, 'আমাকে সংক্ষিপ্ত নসিহত করেন!' খালিদ রাহিমাহুল্লাহ বললেন—
আমিরুল মুমিনিন, আল্লাহ তাআলা দোষ গোপন রাখার ফলে একদল মানুষ প্রবঞ্চনার শিকার হয় এবং প্রশংসা তাদেরকে ফিতনায় ডুবিয়ে রাখে। সুতরাং আপনার সম্পর্কে অন্যদের অজ্ঞতা নিজের ব্যাপারে আপনার জানার ওপর যেন প্রভাব না ফেলে! গোপন বিষয়ে ধোঁকায় পড়া এবং মানুষের প্রশংসায় উৎফুল্ল হওয়া থেকে আল্লাহ আপনাকে এবং আমাদের সবাইকে বাচিয়ে রাখেন! ১৩৬
* হুমাইদ আত-তওয়িল রাহিমাহুল্লাহ সুলাইমান ইবনু আলি রাহিমাহুল্লাহকে বলেন, আমাকে নসিহত করেন! তিনি বললেন-
তুমি যদি নির্জনে আল্লাহর অবাধ্য হয়ে মনে করো আমি এক বিশাল কাজের দুঃসাহস দেখিয়ে ফেলেছি এবং যদি মনে করো যে, তিনি তোমাকে দেখছেন না তাহলে অবশ্যই তুমি কুফুরী করে বসলে। ১৩৭
* এক ব্যক্তি বাশার ইবনু মানসুর রাহিমাহুল্লাহকে বলল, আমাকে নসিহত করেন! তিনি বললেন-
মৃত্যুর বাহিনী তোমার অপেক্ষায় আছে। ১৩৮
* মুহাম্মদ ইবনুল হুসাইন রাহিমাহুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনু মুকাতিল রাহিমাহুল্লাহর কাছে এসে বললেন, আমাকে নসিহত করেন! তিনি বললেন-
আমল করে যাও। মরে গেলে তো আর ফিরে আসবে না। যারা চলে গেছে তাদের দিকে তাকাও, তারা কি ফিরে এসেছে? ১৩৯
হায়! উপদেশমালারা যদি খুঁজে পেত শ্রোতা! মণি-মুক্তো পেত যদি সংগ্রহকারীর সন্ধান! মূল্যবান পণ্যের জন্য আপনি কোনো বিক্রেতা ও ক্রেতাই খুঁজে পাবেন না! এমনকি উপদেশমালার চাবুক যখন উদাসীনদের পিঠে এসে পড়ে তখন আপনি তাদের কাছ থেকে ওজর পেশকারীর আহাজারী শুনতে পাবেন!
হে উদাসীন
একদল লোক আছে, তারা যখন কোনো উপদেশ-নসিহত শোনে তখন সেই নসিহত তাদের মনের মাঝে সংকল্পের চারাগাছ রোপণ করে দেয়। ফলে তারা অন্য সকল ঘুমন্তদের জাগিয়ে তুলে। বাজপাখি কোনো শিকার দেখতে পেলে শত আরাম আয়েশ ভুলে যায়। তাই নসিহতকারী তার নসিহত মোতাবেক আমল করছে কিনা আপনি সেসব নিয়ে ভাববেন না। কবি বলেন-
উপদেশদাতার উপদেশ লুফে নাও
যদিও সে নিজে হয় ভন্ড
অনেক সময় এমন চিকিৎসকের ঔষধও কাজে আসে
যার নিজেরই ঔষধের অধিক প্রয়োজন।
হে টাকা পয়সার গোলাম, এটিই আপনার মুক্তির সময়! হে লোভ লালসার দাস, এটিই আপনার স্বাধীনতার সুযোগ! প্রত্যেক পণ্যেরই মূল্য আছে। যতক্ষণ না আপনি নিজের সম্পদ ব্যয় করবেন এবং সদকা করবেন, ততক্ষণ জাহান্নাম থেকে মুক্তি নেই। শয়তানের বন্দিত্ব থেকে ততক্ষণ বেরোতে পারবেন না, যতক্ষণ আপনার নামের সাথে জুড়ে থাকবে খন্ডিত দীনের অধিকারী উপাধি। হে জ্ঞানীর কাপড়ে জড়ানো উদাসীন, আগামীকাল যখন লাঞ্চনায় পড়বেন তখন ঠিকই জানতে পারবেন, যা অগ্রে পাঠিয়েছেন তা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই আপনার।
প্রিয় ভাই, পুলসিরাত পাড়ি দেওয়ার সময় জমানো এই পার্থিব ভান্ডার আপনার কোনো কাজেই আসবে না! আপনার সম্পদ আর সন্তান কি মৃত্যুর আক্রমণ থেকে আপনাকে বাঁচাতে পারবে?
টিকাঃ
১০০ সিরাজুল মুলক, আবু বকর আত-তরতুশি: ১/৭৮
১৩৪ রওজাতুল উকালা ওয়া নুযহাতুল ফুজালা: ২৮৫, আবু হাতিম আদ-দারামি আল-বুসতি, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ
১৩৫ আজ-জুহদুল কাবির : ১৪১, আবু বকর আল-বাইহাকি, মুওয়াসসিসাতুল কুতুবিস সিকাফিয়্যাহ, বৈরুত, সংস্করণ: ৩
১৩৬ প্রাগুক্ত: ১৮৭
১৩৭ ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন: ৪/৩৯৮
১৩৮ সিফাতুস সফওয়া: ২/৮১
১৩৯ নাজরাতুন নাঈম ফি মাকারিমি আখলাকির রাসূলিল কারিম: ২/৩৮৭