📄 জাহান্নামের আগুন
জাহান্নামের সবচেয়ে বেশি শাস্তি আগুনেরই হবে, যে ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ এরশাদ করেছেন যে, জাহান্নামের আগুন দুনিয়ার আগুনের চেয়ে সত্তর গুণ বেশি গরম হবে। (মুসলিম)
কুরআনের কোনো কোনো স্থানে তাকে "বড় আগুন" নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (সূরা আলা: ১২)
আবার কোথাও "আল্লাহর প্রজ্জ্বলিত অগ্নি" নামেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। (সূরা হুমাযা: ৫)
আবার কোথাও "লেলিহান জাহান্নাম"ও বলা হয়েছে। (সূরা লাইল: ১৪)
আবার কোথাও "জ্বলন্ত অগ্নি" ও বলা হয়েছে। (সূরা গাসিয়া: ৪)
শাস্তি হিসেবে যদি শুধু মানুষকে জ্বালিয়ে দেয়াই উদ্দেশ্য হতো, তাহলে দুনিয়ার আগুনই যথেষ্ট ছিল যাতে মানুষ ক্ষণিকের মধ্যেই জ্বলে শেষ হয়ে যেতো। কিন্তু জাহান্নামের আগুন তো মূলত কাফির ও মুশরিককে বিশেষভাবে আযাব দেয়ার জন্যই উত্তপ্ত করা হয়েছে, তাই তা পৃথিবীর আগুনের চেয়ে কয়েক গুণ গরম হওয়া সত্ত্বেও এ আগুন জাহান্নামীদেরকে একেবারে শেষ করে দিবে না, বরং তাদেরকে ধারাবাহিকভাবে আযাবে নিমজ্জিত করে রাখবে। আল্লাহ বলেন:
لَا يَمُوتُ فِيهَا وَلَا يَحْيَى
অর্থ: "(জাহান্নামে) সে মরবেও না বাঁচবেও না।" (সূরা ত্বাহা: ৭৪)
রাসূলূল্লাহ -কে স্বপ্নযোগে এক কুৎসিত আকৃতি ও বিবর্ণ চেহারার লোক দেখানো হলো, সে আগুন জ্বালিয়ে যাচ্ছে এবং তাকে উত্তপ্ত করছে, রাসূলুল্লাহ জিবরাঈল (আ)-কে জিজ্ঞেস করলেন এ কে? তিনি উত্তরে বললেন: তার নাম মালেক সে জাহান্নামের দারওয়ান (বুখারী)।
জাহান্নামের আগুনকে আজও উত্তপ্ত করা হচ্ছে, কিয়ামত পর্যন্ত তাকে উত্তপ্ত করা হতে থাকবে, জাহান্নামীদের জাহান্নামে যাওয়ার পরও তাকে উত্তপ্ত করার ধারাবাহিকতা চলতে থাকবে। আল্লাহর বাণী:
كُلَّمَا خَبَهُ زِدْنَاهُمْ سَعِيراً .
অর্থ: "যখই তা হবে- আমি তখনি তাদের জন্য অগ্নি বৃদ্ধি করে দিব।" (সূরা বনী ইসরাঈল: ৯৭)
জাহান্নামের আগুন কত উত্তপ্ত হবে তার হুবহু পরিমাণ বর্ণনা করা তো অসম্ভব, তবে রাসূলুল্লাহ -এর বর্ণনা অনুযায়ী জাহান্নামের আগুনের তাপদাহ পৃথিবীর আগুনের চেয়ে উনসত্তর গুণ বেশি হবে।
সাধারণ অনুমানে পৃথিবীর আগুনের উত্তাপ ২০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ধরা হলে জাহান্নামের আগুনের তাপমাত্রা হয় এক লক্ষ ৩৮ হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এ কঠিন গরম আগুন দিয়ে জাহান্নামীদের পোশাক ও তাদের বিছানা তৈরী করা হবে। ঐ আগুন দিয়ে তাদের ছাতি ও তাবু তৈরী করা হবে। ঐ আগুন দিয়েই তাদের জন্য কার্পেট তৈরী করা হবে। কঠিন আযাবের এ নিকৃষ্ট স্থানে মানুষের জীবন যাপন কেমন হবে, যারা নিজের হাতে সামান্য একটি আগুনের কয়লাও রাখার ক্ষমতা রাখে না?
মানুষের ধৈর্যের বাঁধ তো এই যে, জুন, জুলাই মাসে দুপুর ১২টার সময়ের তাপ ও গরম বাতাস সহ্য করাই অনেকের পক্ষে অসম্ভব হয়ে যায়, দুর্বল, অসুস্থ, বৃদ্ধ লোক এর ফলে মৃত্যুবরণও করে, অথচ রাসূলুল্লাহ এর বাণী অনুযায়ী পৃথিবীর এ কঠিন গরম জাহান্নামের শ্বাস ত্যাগ বা তাপের কারণ মাত্র। যে মানুষ জাহান্নামের তাপই সহ্য করতে পারে না, তারা তার আগুন কি করে সহ্য করবে? কিয়ামতের দিন জাহান্নামের আগুন দেখে সমস্ত নবীগণ এত ভীত সন্ত্রস্ত হবে যে, তাঁরা বলবে যে,
( رَبِّ سَلِّمْ رَبِّ سَلِّمْ) অর্থ: "হে আমার প্রভু! আমাকে বাঁচাও, হে আমার প্রভু! আমাকে বাঁচাও। এ বলে আল্লাহর নিকট স্বীয় জীবনের নিরাপত্তা কামনা করবে।
উম্মুল মু'মিনীন আয়েশা (রা) জাহান্নামের আগুনের কথা স্মরণ করে পৃথিবীতে কাঁদতেন পৃথিবীতে থাকা অবস্থায়ই জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজন সাহাবীর একজন ওমর (রা) কুরআন তেলাওয়াত করার সময় জাহান্নামের আযাবের কথা আসলে বেহুশ হয়ে যেতেন, মুয়াজ বিন জাবাল, আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা, ওবাদা বিন সামেত (রা) দের মত সম্মানিত সাহাবাগণ জাহান্নামের আগুনের কথা স্মরণ করে এতো কাঁদতেন যে, তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যেতেন। আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) কামারের দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে প্রজ্জ্বলিত আগুন দেখে জাহান্নামের কথা স্মরণ করে কাঁদতে থাকতেন।
' উল্লেখ্য: আগুনের উত্তাপের নিদৃষ্ট পরিমাপ নির্ভর করে তার জ্বালানীর ওপর, কখনো কখনো এ উত্তাপের পরিমাণ ২০০০ সেন্টি গ্রেডের চেয়ে কয়েকগুণ বেশিও হয়ে যাবে। সম্ভবত এজন্যই আল্লাহ তাআলা কুরআনে জাহান্নামের জ্বালানীর কথাও উল্লেখ করেছেন, তার জ্বালানী হবে পাথর ও মানুষ (সূরা বাক্বারা: ২৪) সম্ভবত মানুষকে তার জ্বালানী এ জন্যই করা হয়েছে যে, তারা জাহান্নামের আগুনে জ্বলে শেষ হবে না। বরং পাথরের ন্যায় তাদের অস্তিত্বও বাকী থেকে যাবে। (আল্লাই এ ব্যাপারে ভালো জানেন) আতা সুলামী (রা)-এর সাথীরা রুটি বানানোর জন্য চুল্লী প্রস্তুত করলে তিনি তা দেখে বেহুশ হয়ে গেলেন।
সুফিয়ান সাওরীর নিকট যখন জাহান্নামের কথা আলোচনা করা হতো, তখন তার রক্তের পেসাব হত।
রবী (র) সারা রাত বিছানায় একাত ওকাত হতে থাকলে তার মেয়ে জিজ্ঞেস করল, আব্বাজান! সমস্ত মানুষ আরামে ঘুমিয়ে গেছে আপনি কেন জেগে আছেন? তিনি বললেন: হে আমার মেয়ে! জাহান্নামের আগুন তোমার পিতাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না।
আল্লাহর বাণী- إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحْذُوراً
অর্থ: "তোমার প্রতিপালকের শাস্তি ভয়াবহ”। (সূরা বনী ইসরাঈল: ৫৭)
আল্লাহ স্বীয় দয়া ও অনুগ্রহে সমস্ত মুসলমানদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দিন। আমীন!
টিকাঃ
১ উল্লেখ্য: আগুনের উত্তাপের নিদৃষ্ট পরিমাপ নির্ভর করে তার জ্বালানীর ওপর, কখনো কখনো এ উত্তাপের পরিমাণ ২০০০ সেন্টি গ্রেডের চেয়ে কয়েকগুণ বেশিও হয়ে যাবে। সম্ভবত এজন্যই আল্লাহ তাআলা কুরআনে জাহান্নামের জ্বালানীর কথাও উল্লেখ করেছেন, তার জ্বালানী হবে পাথর ও মানুষ (সূরা বাক্বারা: ২৪) সম্ভবত মানুষকে তার জ্বালানী এ জন্যই করা হয়েছে যে, তারা জাহান্নামের আগুনে জ্বলে শেষ হবে না। বরং পাথরের ন্যায় তাদের অস্তিত্বও বাকী থেকে যাবে। (আল্লাই এ ব্যাপারে ভালো জানেন)
📄 স্বীয় পরিবার-পরিজনদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও
কুরআন মাজীদে আল্লাহ এরশাদ করেন:
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَاراً وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ عَلَيْهَا مَلائِكَةٌ غِلاظٌ شِدَادٌ لا يَعْصُونَ اللهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ
অর্থ: হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন হতে বাঁচাও যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর; যেখানে রয়েছে নির্মম ও কঠোর ফেরেশতাকূল, যারা আল্লাহ তাদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন সে ব্যাপারে অবাধ্য হয় না। আর তারা তা-ই করে যা তাদেরকে আদেশ করা হয়। (সূরা তাহরীম ৬৬:৬)
এ আয়াতে আল্লাহ দু'টি কথা স্পষ্ট শব্দে নির্দেশ দিয়েছেন।
১. নিজে নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।
২. নিজের পরিবার-পরিজনদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।
পরিবার-পরিজন বলতে বুঝায়, স্ত্রী, সন্তান, যেন প্রত্যেক ব্যক্তি তার সাথে সাথে নিজের স্ত্রী, সন্তানদেরকেও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে বাধ্যগত। স্বীয় পরিবার-পরিজনের প্রতি প্রকৃত কল্যাণকামিতার দাবী ও তাই। এমনিভাবে যখন আল্লাহ তার রাসূলকে এ নির্দেশ দেন যে,
وَأَنذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ
২৭৫ অর্থ: "তোমার নিকট আত্মীয়দেরকে (জাহান্নামের আগুন) থেকে সতর্ক কর।" (সূরা শুআরা: ২১৪)
তখন নবী স্বীয় পরিবার ও বংশের লোকদেরকে ডেকে, তাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে সতর্ক করলেন। সবশেষে স্বীয় কন্যা ফাতেমা (রা)-কে ডেকে বললেন:
يَا فَاطِمَةُ ، أَنْقِذِي نَفْسَكِ مِنَ النَّارِ، فَإِنِّي لَا أَمْلِكُ لَكُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا
অর্থ: "হে ফাতেমা! নিজে নিজেকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও, (কিয়ামতের দিন) আল্লাহর সামনে আমি তোমাদের জন্য কিছু করতে পারব না।" (মুসলিম)
নিজের পাড়া-প্রতিবেশী ও বংশের লোকদেরকে জাহান্নাম থেকে সতর্ক করার পর, নিজের কন্যাকে জাহান্নামের আগুন থেকে ভয় দেখিয়ে, সমস্ত মুসলমানদেরকে সতর্ক করলেন যে, স্বীয় সন্তানদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোও পিতা-মাতার দায়িত্বসমূহের মধ্যে একটি দায়িত্ব।
এক হাদীসে নবী এরশাদ করেছেন: "প্রত্যেকটি সন্তান ফিতরাত (ইসলামের) ওপর জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু তাদের পিতা-মাতা তাদেরকে ইহুদী, নাসারা বা অগ্নিপূজক বানায়। (বুখারী)
যেন সাধারণ নিয়ম এই যে, পিতা-মাতাই সন্তানদেরকে জান্নাত বা জাহান্নামে নিক্ষেপ করে।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে মাজীদে মানুষের বহু দুর্বলতার উল্লেখ করেছেন। যেমন: মানুষ অত্যন্ত জালেম ও অকৃতজ্ঞ। (সূরা ইবরাহীম: ৩৪)
মানুষ অত্যন্ত তাড়াহুড়া কারী (সূরা বনী ইসরাঈল: ১১)
অন্যান্য দুর্বলতার ন্যায় একটি দুর্বলতা এই বলে বর্ণনা করা হয়েছে যে, মানুষ দ্রুত অর্জিত লাভ সমূহকে অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তা ক্ষণস্থায়ী বা অল্পই হোক না কেন? আর বিলম্বে অর্জিত লাভকে তারা উপেক্ষা করে চলে, যদিও তা স্থায়ী ও অধিকই হোকনা কেন।
আল্লাহর বাণী:
إِنَّ هَؤُلَاءِ يُحِبُّونَ الْعَاجِلَةَ وَيَذَرُونَ وَرَاءَهُمْ يَوْماً ثَقِيلاً
অর্থ: "নিঃসন্দেহে তারা দ্রুত অর্জিত লাভ কে (অর্থাৎ দুনিয়া) ভালবাসে আর পরবর্তী কঠিন দিবসকে উপেক্ষা করে চলে।" (সূরা দাহর: ২৭)
এ হলো মানুষের ঐ স্বভাবজাত দুর্বলতার ফল, যে পিতা-মাতা, স্বীয় সন্তানদেরকে, দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনে উচ্চ মর্যাদা লাভ, সম্মান এবং ভালো পজিশন দেয়া, উচ্চ শিক্ষা দেয়ার জন্য বেশিরভাগ গুরুত্ব দেয়। চাই এ জন্য যত সময়ই লাগুক না কেন, আর যত সম্পদই ব্যায় হোকনা কেন, আর যত দুঃখ-কষ্ট পোহানো হোকনা কেন। অথচ অনেক কম পিতা-মাতাই আছে যারা, তাদের সন্তানদেরকে পরকালের স্থায়ী জীবন, উচ্চ পজিশন, সম্মান, ভালো স্থান লাভের জন্য, দ্বীনি শিক্ষা দেয়ার জন্য গুরুত্ব দেয়। যার অর্জন দুনিয়ার শিক্ষার চেয়ে সহজও বটে আবার দ্বীন ও দুনিয়া উভয় দিক থেকে, পিতা-মাতার জন্য কল্যাণকরও। দুনিয়াবী শিক্ষা অর্জনকারী বেশিরভাগ সন্তান, কর্মজীবনে স্বীয় পিতা-মাতার অবাধ্য থাকে এবং নিজে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে, পক্ষান্তরে দ্বীনি শিক্ষা অর্জনকারী বেশিরভাগ সন্তান, স্বীয় পিতা-মাতার অনুগত থাকে এবং তাদের সেবা করে। আর পরকালের দৃষ্টিতে তো অবশ্যই এ সন্তানরা পিতা-মাতার জন্য কল্যাণকামী হবে। যারা সৎ মোত্তাকী, দ্বীনদার হবে।
এ সমস্ত বাস্তবতাকে জানা সত্ত্বেও কোনো অতিরঞ্জন ব্যতীতই ৯৯% মানুষই দুনিয়াবী শিক্ষাকে, দ্বীনি শিক্ষার ওপর প্রাধান্য দেয়। আসুন মানবতার এ দুর্বলতাকে অন্য এক দিক দিয়ে বিবেচনা করা যাক।
ধরুন- কোনো জায়গায় যদি আগুন লেগে যায়, তাহলে ঐ স্থানের সমস্ত বসবাসকারীরা সেখান থেকে বের হয়ে যাবে, ভুল ক্রমে যদি কোনো বাচ্চা ঐ স্থানে থেকে যায়, তাহলে চিন্তা করুন, ঐ অবস্থায় ঐ বাচ্চার পিতা-মাতার অবস্থা কি হবে? পৃথিবীর যে কোনো ব্যস্ততা বা বাধ্যকতা যেমন ব্যবসা, ডিউটি, দূর্ঘটনা, অসুস্থতা ইত্যাদি পিতা-মাতাকে, বাচ্চার কথা ভুলিয়ে রাখতে পারবে? কখনো নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত বাচ্চা আগুন থেকে বেরিয়ে না আসতে পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত পিতা-মাতা ক্ষণিকের জন্যও আরাম বোধ করবে না। নিজের বাচ্চাকে আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য যদি পিতা-মাতার জীবন বাজি দিতে হয়, তা হলে তাও দিবে। কত আশ্চার্য কথা যে এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে তো প্রত্যেক ব্যক্তিরই অনুভূতি একাজ করে যে, তার সন্তানকে যে কোনো মূল্যের বিনিময়ে হলেও আগুন থেকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু পরকালে জাহান্নামের আগুন থেকে নিজের বাচ্চাকে বাঁচানোর অনুভূতি খুব কম লোকেরই আছে। আল্লাহ তা'আলা কতইনা সত্য বলেছেন:
وَقَلِيلٌ مِنْ عِبَادِيَ الشَّكُورُ
অর্থ: "আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পই কৃতজ্ঞ।" (সূরা সাবা: ১৩)
নিঃসন্দেহে মানুষের এ দুর্বলতা ঐ পরীক্ষার অংশ যার জন্য মানুষকে এ পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু জ্ঞানী সেই যে, এ পরীক্ষার অনুভূতি লাভ করেছে। আর এ পরীক্ষার অনুভূতি এই যে, মানুষ তার স্রষ্টা ও মনিবের হুকুম বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিবে। আল্লাহ ঈমানদারদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচার এবং নিজের স্ত্রী, সন্তানদেরকে তা থেকে বাঁচানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তাহলে ঈমানের দাবী এই যে, প্রত্যেক মুসলমান নিজে নিজেকে এবং তার বিবি-বাচ্চাকে, জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য ৬০ গুণ বেশি চিন্তিত থাকবে। যেমন সে তার বিবি-বাচ্চাকে দুনিয়ার আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য প্রয়োজন অনুভব করে। এ দায়িত্ব পূর্ণ করার জন্য প্রত্যেক মুসলমান দু'টি বিষয় গুরুত্বের চোখে দেখবে:
প্রথমত: কুরআন ও হাদীসের শিক্ষার গুরুত্ব: মুর্খতা এবং অজ্ঞতা চাই তা দুনিয়ার ব্যাপারেই হোক আর দ্বীনের ব্যাপারে হোক, তা মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে এরশাদ করেছেন:
هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ
অর্থ: "যারা জ্ঞানী আর যারা জ্ঞানী নয় তারা কি সমান?" (সূরা যুমার: ৯) এ সর্বসাধারণের কথা, যে ব্যক্তি পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, হাশর-নশর সম্পর্কে অবগত আছে, জান্নাতের চিরস্থায়ী নিয়ামতসমূহ এবং জাহান্নামের শাস্তি সম্পর্কে অবগত আছে, তার জীবন ঐ ব্যক্তির জীবনের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা হবে, যে ব্যক্তি অফিসিয়াল ভাবে আখেরাতকে মানে, কিন্তু হাশর নাশরের অবস্থা জান্নাতের চিরস্থায়ী নিয়ামত এবং জাহান্নামের শান্তি সম্পর্কে অবগত নয়। কিতাব ও সুন্নাতের জ্ঞান যারা রাখে, তারা অন্য লোকদের মোকাবেলায় অধিক সঠিক পথে ঈমানদার এবং কদমে কদমে তারা আল্লাহকে ভয় করে।
আল্লাহর বাণী:
إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ
অর্থ: "মূলত আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে শুধু (কুরআন ও হাদীসের) জ্ঞান যারা রাখে তারাই আল্লাহকে অধিক ভয় করে।" (সূরা ফাতির: ২৮)
অতএব যারা স্বীয় সন্তানদেরকে দুনিয়ার শিক্ষা দেয়ার জন্য কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রাখে, তারা মূলত নিজের সন্তানদের পরকালকে বরবাদ করে, তাদের ওপর অধিক জুলুম করছে। আর যারা তাদের সন্তানদেরকে দুনিয়াবী শিক্ষার সাথে সাথে, কুরআন ও হাদীসের শিক্ষাও দিয়ে যাচ্ছে, তারা শুধু তাদের সন্তানদেরকে তাদের পরকালই আলোকময় করছে না, বরং নিজেরা আল্লাহর আদালতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।
দ্বিতীয়ত: ঘরে ইসলামী পরিবেশ তৈরী: বাচ্চার ব্যক্তিত্বকে ইসলামী ভাবধারায় গড়ে তুলতে হলে, ঘরে ইসলামী পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত পাঁচওয়াক্ত নামায আদায় করা, ঘরে আসা ও যাওয়ার সময় সালাম দেয়া, সত্য বলার অভ্যাস গড়ে তোলা, পানাহারের সময় ইসলামী আদবের প্রতি লক্ষ্য রাখা। দান-খয়রাত করার অভ্যাস গড়ে তোলা। শয়ন ও ঘুম থেকে উঠার সময় দোয়া পাঠের অভ্যাস গড়ে তোলা, গান-বাজনা, ছবি না রাখা, এমনকি ফিল্মী ম্যাগাজিন, উলঙ্গ ছবি যুক্ত পেপার ইত্যাদি থেকে ঘরকে পবিত্র রাখা। মিথ্যা, গিবত, গালিগালাজ, ঝগড়া থেকে বিরত থাকা। নবীদের ঘটনাবলী, ভাল লোকদের জীবনী, কুরআনের ঘটনাবলী, যুদ্ধ, সাহাবাদের জীবন সম্বলিত বই পুস্তক, বাচ্চাদেরকে পড়ানো। পরস্পরের মাঝে উত্তম আচরণ করা, এ সমস্ত কথা সন্তানদের ব্যক্তিত্ব গঠনে মৌলিক বিষয়বস্তু। অতএব যে পিতা-মাতা স্বীয় সন্তানদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য পুরোপুরী দায়িত্ব পালন করতে চায়, তার জন্য আবশ্যক যে, সে তার সন্তানদেরকে কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা দেয়ার সাথে সাথে ঘরের মধ্যে পূর্ণ ইসলামী পরিবেশ তৈরী করা।
📄 একটি ভ্রান্তির অপনোদন
আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার পর শয়তান যখন বিতাড়িত হলো তখন সে অঙ্গীকার করল যে, “হে আমার রব! আমি পৃথিবীতে মানুষের নিকট পাপ কর্মকে অবশ্যই শোভনীয় করে তুলব। আর আমি তাদের সকলকেই বিপথগামী করেই ছাড়ব। (সূরা হিজর: ৩৯)
অন্যত্র আল্লাহ শয়তানের এ উক্তিটি হুবহু নকল করেছেন যে, "অতপর আমি তাদেরকে পথভ্রষ্ট করার জন্য তাদের সম্মুখ দিয়ে, পিছন দিয়ে, ডান দিক দিয়ে এবং বাম দিক দিয়ে তাদের নিকট আসব, (সূরা আরাফ: ১৭)
মূলত শয়তান দিন রাত প্রত্যেক মানুষের পিছনে লেগে আছে, যাতে মৃত্যুর পূর্বে তাকে কোনো না কোনো ফেতনায় ফেলে, জান্নাতের রাস্তা থেকে দূরে সরিয়ে জাহান্নামের রাস্তায় নিক্ষেপ করতে পারে। মানুষকে পাপের মধ্যে লিপ্ত রাখা ও তাকে আমলহীন করার জন্য শয়তানের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো এই যে, "আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল এবং অত্যন্ত দয়ালু, তিনি সবকিছু ক্ষমা করে দিবেন।"
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, আল্লাহর রহমত অত্যন্ত প্রশস্ত, আর তাঁর রহমত তাঁর রাগের ওপর বিজয়ী। কিন্তু এ রহমত প্রাপ্তির জন্যও আল্লাহর দেয়া নিয়ম-কানুন কুরআন মাজীদে স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
আল্লাহর বাণী:
وَإِنِّي لَغَفَّارٌ لِمَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ صَالِحَأَ ثُمَّ اهْتَدَى
অর্থ: "এবং আমি অবশ্যই ক্ষমাশীল তার প্রতি, যে তাওবা করে, ঈমান আনে, সৎকর্ম করে এবং সৎ পথে অবিচল থাকে।" (সূরা ত্বাহা: ৮২) এ আয়াতে আল্লাহ ক্ষমা করার জন্য চারটি শর্ত করেছেন:
১. তাওবা: যদি কোনো ব্যক্তি প্রথমে কুফর ও শিরকের মাঝে লিপ্ত ছিল, তাহলে কুফর ও শিরক থেকে বিরত থাকা, তবে যদি কোনো ব্যক্তি কাফির বা মুশরিক না হয়, কিন্তু কবীরা গুনাহ করেছে তাহলে তার কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকা বা তা পরিত্যাগ করা তার জন্য প্রথম শর্ত।
২. ঈমান: বিশ্বস্ত অন্তর নিয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনে, সাথে সাথে আসমানী কিতাবসমূহ এবং ফেরেশতাগণ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান আনা দ্বিতীয় শর্ত।
৩. নেক কাজ: আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনার পর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ মোতাবেক, জীবন যাপন করা, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসূল -এর সুন্নাতের অনুসরণ করা তৃতীয় শর্ত।
৪. অবিচল থাকা: আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যে যদি কোনো বিপদাপদ আসে, তখন ঐ পথে অবিচল থাকা চতুর্থ শর্ত। যে ব্যক্তি উল্লেখিত চারটি শর্ত পূর্ণ করবে, তার সাথে আল্লাহ ক্ষমা ও দয়ার ওয়াদা করেছেন। এ হলো দয়া করা ও মানুষের গুনাহ মাফ করার ব্যাপারে আল্লাহর বেঁধে দেয়া নিয়ম-নীতি। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা তাওবার নিয়ম বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, ঐ লোকদের তাওবা কবুল যোগ্য যারা না জেনে ভুলবশত গুনাহ করেছে, কিন্তু যারা জেনেশুনে গুনাহ করে চলছে, তাদের জন্য ক্ষমা নয় বরং বেদনাদায়ক শাস্তি।
إِنَّمَا التَّوْبَةُ عَلَى اللهِ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السُّوءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ يَتُوبُونَ مِنْ قَرِيبٍ فَأُوْلَئِكَ يَتُوبُ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا ، وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ حَتَّى إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ الآنَ وَلَا الَّذِينَ يَمُوتُونَ وَهُمْ كُفَّارٌ أُوْلَئِكَ أَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا
অর্থ: নিশ্চয় তাওবা কবুল করা আল্লাহর জিম্মায় তাদের জন্য, যারা অজ্ঞতাবশত মন্দ কাজ করে। তারপর শীঘ্রই তাওবা করে। অতঃপর আল্লাহ এদের তাওবা কবুল করবেন আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়। আর তাওবা নেই তাদের, যারা অন্যায় কাজ করতে থাকে, অবশেষে যখন তাদের কারো মৃত্যু এসে যায়, তখন বলে, আমি এখন তাওবা করলাম, আর তাওবা তাদের জন্য নয়, যারা কাফির অবস্থায় মারা যায়; আমি এদের জন্যই তৈরী করেছি যন্ত্রণাদায়ক আযাব। (সূরা নিসা ৪:১৭-১৮)
এ আয়াতে তিনটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে আলোচিত হয়েছে:
১. গুনাহ থেকে ক্ষমা শুধু ঐ সমস্ত লোকদের জন্য যারা অজ্ঞতা বা ভুল করে গুনাহ করতেছে।
২. জীবনভর ইচ্ছাকৃত গুনাহকারীদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব।
৩. কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণকারীদের জন্যও রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব।
নবী -এর যুগে সংঘটিত তাবুকের যুদ্ধে কা'ব বিন মালেক (রা), হেলাল বিন উমাইয়্যা (রা) এবং মুররা বিন রাবি (রা) ভুলক্রমে অলসতা করেছিল, আর তখন তারা তিন জনেই তাওবা করল, আর আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করলেন। অথচ ঐ যুদ্ধেই মুনাফিকরা ইচ্ছা করে রাসূল -এর নাফরমানী করল, তারাও তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে ক্ষমা চাইল এবং রাসূল -কে সন্তুষ্ট করতে চাইল। তখন আল্লাহ পরিষ্কারভাবে ঘোষণা দিলেন যে,
إِنَّهُمْ رِجْسٌ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ
অর্থ: "তারা হচ্ছে অপবিত্র আর তাদের ঠিকানা হচ্ছে জাহান্নাম। ঐ সব কর্মের বিনিময়ে যা তারা করত।” (সূরা তাওবা: ৯৫)
সাহাবাগণের মধ্যে বেশিরভাগ এমন ছিলেন যে, যাদেরকে রাসূল অত্যন্ত স্পষ্ট করে দুনিয়াতেই জান্নাতের সু-সংবাদ দিয়েছিলেন। যেমন: আশারা মোবাশশারা (জান্নাতের সু সংবাদ প্রাপ্ত দশজন), বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ কারীগণ, বৃক্ষের নীচে বাইয়াত কারীরা কিন্তু এতদ সত্ত্বেও তারা আল্লাহর ভয়ে এত ভীত সন্ত্রস্ত থাকত যে, আখেরাতের কথা স্মরণ হওয়া মাত্রই তারা কাঁদতে শুরু করত।
ওসমান (রা)-এর মত ব্যক্তি যাকে রাসূল একবার নয়, বরং কয়েকবার জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন, এরপরও কবরের কথা স্মরণ হওয়া মাত্রই এত কাঁদতেন যে, তাঁর দাড়ি ভিজে যেত। ওমর (রা) জুমআর খোতবায় সূরা তাকভীর তেলাওয়াত করতে ছিলেন, যখন এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন:
عَلِمَتْ نَفْسٌ مَا أَحْضَرَتْ
২৮১ অর্থ: "তখন প্রত্যেক ব্যক্তিই জানতে পারবে যে সে কি নিয়ে এসেছে।" (সূরা তাকভীর: ১৪)
তখন এত ভীত-সন্ত্রস্ত হলেন যে, তাঁর আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল।
সাদ্দাদ বিন আওস যখন বিছানায় শুইতেন, তখন একাত ওকাত হতেন ঘুম আসত না, আর বলতেন 'হে আল্লাহ! জাহান্নামের ভয় আমার ঘুম হারাম করে দিয়েছে' এর পর উঠে গিয়ে সকাল পর্যন্ত নামাযে কান্নাকাটি করতেন। আবু হুরাইরা (রা) বলেন: সূরা নাজম নাযিল হওয়ার সময় সাহাবাগণ
أَفَمِنْ هَذَا الْحَدِيثِ تَعْجَبُونَ ، وَتَضْحَكُونَ وَلَا تَبْكُونَ
অর্থ: "তোমরা কি একথায় বিস্ময় বোধ করছ? এবং হাসি ঠাট্টা করছ! ক্রন্দন করছ না?" (সূরা নাজম: ৫৯-৬০)
এ আয়াত শুনে এত কাঁদতেন যে, দু'নয়নের অশ্রুতে গাল ভেসে পড়তে ছিল, রাসূল কান্নার আওয়াজ শুনে সেখানে উপস্থিত হলেন, তাঁরও নয়ন অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল। আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) সূরা মুতাফফিফীন পাঠ করতে ছিলেন যখন-
يَوْمَ يَقُومُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ
অর্থ: "যেদিন সমস্ত মানুষ বিশ্বজগতের প্রতিপালকের সামনে দাঁড়াবে।” (সূরা মুতাফফিফীন: ৬)
এ আয়াতে পৌঁছল তখন এত কাঁদলেন যে নিজে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছিলেন না এবং তিনি পড়ে গেলেন। আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) সূরা ক্বাফ তেলওয়াত করতে করতে যখন এ আয়াতে পৌছল:
وَجَاءَتْ سَكْرَةُ الْمَوْتِ بِالْحَقِّ ذَلِكَ مَا كُنْتَ مِنْهُ تَحِيدُ
অর্থ: "মৃত্যু যন্ত্রণা সত্যই আসবে, এ থেকেই তোমরা অব্যাহতি চেয়ে ছিলে।" (সূরা ক্বাফ: ১৯)
তখন কাঁদতে কাঁদতে তার নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেল।
আবু হুরাইরা (রা) মৃত্যু শয্যায় শায়িত অবস্থায় কাঁদতে লাগল, লোকেরা তার কান্নার কারণ জানতে চাইলে, তিনি বললেন: আমি পৃথিবীর (টানে) কাঁদছিনা বরং এ জন্য কাঁদছি যে, তোমার দীর্ঘ সফরে পথের সম্বল খুবই কম। আমি এমন এক টিলার সামনে এসে উপস্থিত হয়েছি যে, যার সামনে জান্নাত ও জাহান্নাম, অথচ আমার জানা নেই যে, আমার ঠিকানা কোথায়?
আবু দারদা (রা) আখেরাতের ভয়ে বলছিল “হায় আমি যদি কোনো বৃক্ষ হতাম যা কেটে ফেলা হত, আর প্রাণীরা তাকে ভক্ষিত তৃণ সাদৃশ করে দিত।
ইমরান বিন হুসাইন (রা) বলতেন হায়! আমি যদি কোনো টিলার বালু কণা হতাম যা বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যেত।
আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়া এবং হিসাব নিকাশ, আমলনামা, অতপর জাহান্নামের আযাবের কারণে এ অবস্থা শুধু দু'একজন নয় বরং সমস্ত সাহাবাগণই এরূপই ছিল। বিস্তারিত ঘটনাবলী এ গ্রন্থের 'সাহাবা কেরাম এবং জাহান্নাম' নামক অধ্যায় দ্র.।
প্রশ্ন হলো সাহাবাগণের কি এ কথা জানা ছিল না যে, আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু?
তাদের কি জানা ছিল না যে আল্লাহ সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করতে পারেন?
তাদের কি একথা জানা ছিলনা যে, আল্লাহর রহমত তাঁর গজবের ওপর বিজয়ী।
সবই তাদের জানা ছিল বরং আমাদের চেয়ে তারা এ বিষয়ে আরো অধিক জ্ঞান রাখতেন। কিন্তু আল্লাহর বড়ত্ব, গৌরব ও মর্যাদার ভয় সর্বদা অন্তরে রাখা ও একটি ইবাদত।
আল্লাহর বাণী:
فَلا تَخَافُوهُمْ وَخَافُونِ إِنْ كُنتُمْ مُّؤْمِنِينَ
অর্থ: "অতএব যদি তোমরা বিশ্বাসী হও তাহলে ওদেরকে ভয় কর না বরং আমাকেই ভয় কর।” (সূরা আলে ইমরান: ১৭৫)
এ কারণে আল্লাহর ফেরেশতারাও তাঁর আযাব ও পাকড়াওকে ভয় করে। রাসূল -ও আল্লাহর আযাব ও গ্রেফতারের ভয়ে ভীত থাকতেন। তিনি বলেন:
وَاللَّهِ إِنِّي لَأَخْشَاكُمُ اللَّهَ
অর্থ: "আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহকে তোমাদের সবার চেয়ে অধিক ভয় করি।" (বুখারী)
রাসূল স্বীয় দোআসমূহে স্বয়ং আল্লাহর ভয় কামনা করতেন। তাঁর দোআসমূহের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দোআ এ ছিল যে,
اللَّهُمَّ اقْسِمْ لَنَا مِنْ خَشْيَتِكَ مَا يَحُولُ بَيْنَنَا وَبَيْنَ مَعَاصِيكَ
অর্থ: "হে আল্লাহ তুমি আমাকে তোমার এতটা ভয় দান কর যা, আমার ও তোমার নাফরমানির মাঝে বাধা হবে।” (তিরমিযী) অন্য এক দোয়ায় রাসূল আল্লাহর ভয় শূন্য অন্তর থেকে আশ্রয় কামনা করেছেন।
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ قَلْبِ لَا يَخْشَعُ
অর্থ: "হে আল্লাহ! আমি এমন অন্তর থেকে তোমার নিকট আশ্রয় চাই, যা তোমাকে ভয় করে না।
তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ী অর্থাৎ: সোনালী যুগের সমস্ত মানুষ আল্লাহর আযাব ও গ্রেফতারকে অধিক পরিমাণে ভয় করত। আল্লাহর ভয় থেকে নির্ভয় হয়ে যাওয়া কবীরা গুনাহ। যার ফলে নিজে নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করা।
আল্লাহর বাণী:
فَلَا يَأْمَنُ مَكْرَ اللَّهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْخَاسِرُونَ
অর্থ: "সর্বনাশগ্রস্ত সম্প্রদায় ব্যতীত কেউই আল্লাহর গ্রেফতার থেকে নিঃশঙ্কক হতে পারে না।” (সূরা আরাফ: ৯৯)
অতএব আল্লাহর ক্ষমা ও দয়ার আকাঙ্ক্ষা ঐ ব্যক্তির রাখা দরকার, যে আল্লাহকে ভয় করে জীবনযাপন করে, আর তার অজান্তে হয়ে যাওয়া গুনাহসমূহের জন্য সর্বদা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। কিন্তু যে ব্যক্তি সর্বদা গুনাহ করে চলছে আর একথা মনে করতেছে যে, আল্লাহ অত্যন্ত দয়ালু ও ক্ষমাশীল তার দৃঢ় বিশ্বাস করা দরকার যে, সে সরাসরি শয়তানের চক্রান্তে লিপ্ত আছে। যার শেষ ফল ধ্বংস ব্যতীত আর কিছুই নয়।
📄 কিছু সময়ের জন্য জাহান্নামে অবস্থানকারীরা
উল্লেখিত নামে এ গ্রন্থে একটি অধ্যায় রচনা করা হয়েছে, যেখানে ঐ মুসলমানদের জাহান্নামে যাওয়ার বর্ণনা রয়েছে যে, যারা কিছু কিছু কবীরা গুনাহর কারণে প্রথমে জাহান্নামে যাবে এবং স্বীয় গুনাহর শাস্তি ভোগ করার পর জান্নাতে যাবে।
উল্লেখিত অধ্যায়ে আমরা ঐ সমস্ত হাদীস বাছাই করেছি যেখানে রাসূল স্পষ্ট করে বলেছেন: "ঐ ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করেছে" এরকম শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে বা তার সাথে সম্পৃক্ত এমন কোনো শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যাতে করে কোনো প্রকার ভুল না বুঝা হয়। কিন্তু এ থেকে এ কথা বুঝা ঠিক হবে না যে, এ কবীরা গুনাহসমূহ ব্যতীত আর এমন কোনো কবীরা গুনাহ নেই, জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হতে পারে। জাহান্নামের বর্ণনা নামক গ্রন্থ লেখার উদ্দেশ্য শুধু এই যে, লোকেরা জাহান্নামের আযাব সম্পর্কে সতর্ক হয়ে তা থেকে বাঁচার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। এ জন্য জরুরী ছিল যে, লোকদেরকে এ সমস্ত কবীরা গুনাহ থেকে সতর্ক করা যা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হবে। এ জন্য আমরা কোনো লম্বা আলোচনায় না গিয়ে ইমাম সাহাবীর 'কিতাবুল কাবায়ের' থেকে কবীরা গুনাহসমূহের সূচী পেশ করছি। এ আশায় যে আল্লাহর শাস্তিকে ভয় কারী, নেককার মুত্তাকী লোকেরা এ থেকে অবশ্যই উপকৃত হবে ইনশাআল্লাহ।
১. শিরক করা।
২. অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা।
৩. যাদু করা বা করানো।
৪. নামায ত্যাগ করা।
৫. যাকাত না দেয়া।
৬. বিনা ওজরে রমযানের রোযা ত্যাগ করা।
৭. ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও হজ্জ না করা।
৮. পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া।
৯. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা।
১০. ব্যভিচার করা।
১১. পুরুষে পুরুষে ব্যভিচার করা।
১২. সুদ আদান প্রদান করা, তা লিখা, এ বিষয়ে সাক্ষী থাকা ইত্যাদি একই ধরনের কবীরা গুনাহ।
১৩. ইয়াতীমের সম্পদ খাওয়া।
১৪. আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নামে মিথ্যা কথা চালিয়ে দেয়া।
১৫. জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা।
১৬. শাসক তার অধিনস্তদের প্রতি যুলুম করা।
১৭. অহংকার করা।
১৮. মিথ্যা সাক্ষী দেয়া।
১৯. মিথ্যা কসম করা।
২০. জুয়া খেলা।
২১. নির্দোষ মহিলাদেরকে মিথ্যা অপবাদ দেয়া।
২২. গনীমতের মাল আত্মসাৎ করা।
২৩. চুরি করা।
২৪. ডাকাতি করা।
২৫. মদ পান করা।
২৬. যুলুম করা।
২৭. চাঁদাবাজী করা।
২৮. হারাম খাওয়া।
২৯. আত্মহত্যা করা।
৩০. মিথ্যা বলা।
৩১. কিতাব ও সুন্নাত বিরোধী বিচার ফায়সালা করা।
৩২. ঘুষ নেয়া।
৩৩. নারী পুরুষ একে অপরের সাদৃশ্যতা অবলম্বন করা।
৩৪. দাইউস হওয়া (নিজের স্ত্রীকে অন্য পুরুষের সহবাসে দেয়া এবং তার উপার্জন ভোগ করা।)
৩৫. হিলা (তিন তালাক প্রাপ্ত মহিলার সাময়িক বিবাহ, যা পূর্ব স্বামীর সাথে পুনঃ বিবাহে সহায়তা করে)। করা বা করানো।
৩৬. পেসাব থেকে সাবধানতা অবলম্বন না করা।
৩৭. লোক দেখানো কাজ করা।
৩৮. পার্থিব সুবিধা লাভের জন্য দ্বীনি ইলম অর্জন করা এবং দ্বীনি ইলম গোপন করা।
৩৯. খিয়ানত করা।
৪০. উপকার করে তা বলে বেড়ানো।
৪১. তাকদীর (ভাগ্যকে) অস্বীকার করা।
৪২. অপরের গোপনীয়তা প্রকাশ করা।
৪৩. চোগলখোরী (এক জায়গার কথা অন্য জায়গায় লাগানো) ও গীবত (পরনিন্দা) করা।
৪৪. লা'নত (অভিসম্পাত) করা।
৪৫. ওয়াদা ভঙ্গ করা।
৪৬. গণকদের কথা বিশ্বাস করা।
৪৭. স্বামীর সাথে স্ত্রীর চরিত্রহীন আচরণ করা।
৪৮. ছবি তোলা।
৪৯. (আত্মীয়-স্বজনদের মৃত্যুতে) উচ্চ স্বরে কান্না-কাটি করা।
৫০. স্ত্রীর কাজের লোকদের সাথে খারাপ আচরণ করা।
৫১. প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া।
৫২. মুসলমানের ওপর হস্তক্ষেপ করা।
৫৩. টাখনুর নীচে কাপড় পরিধান করা।
৫৪. পুরুষের রেশম ও স্বর্ণ ব্যবহার করা।
৫৫. কাজের লোক ভেগে যাওয়া।
৫৬. আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে প্রাণী যবাই করা।
৫৭. আপন পিতা ব্যতীত অপরের প্রতি নিজের সম্পর্ক স্থাপন করা।
৫৮. অন্যায়ভাবে ঝগড়া করা।
৫৯. নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি অপরকে না দেয়া।
৬০. ওজনে কম করা।
৬১. আল্লাহর শাস্তি থেকে নির্ভয় হওয়া।
৬২. সগীরা (ছোট গুনাহর) ওপর অটল থাকা।
৬৩. কোনো ওজর ব্যতীত জামাআত ছেড়ে একা নামায পড়া।
৬৪. ইসলাম বিরোধী উপদেশ (ওসীয়ত) করা।
৬৫. কাউকে ধোঁকা দেয়া।
৬৬. ইসলামী রাষ্ট্রের গোপন তথ্য ফাঁস করা।
৬৭. সাহাবাগণকে গালি দেয়া।২
এ সমস্ত গুনাহ ঐ কবীরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত যার যে কোনো একটিতে লিপ্ত হওয়াই মানুষের জাহান্নামে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। অতএব জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য জরুরী হলো এই যে, প্রথমত এ সমস্ত কবীরা গুনাহ থেকে পরিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকা।
দ্বিতীয়: আর কখনো যদি মানুষিক কোনো কারণে কোনো কবীরা গুনাহ হয়ে যায়, তাহলে সাথে সাথে আল্লাহর নিকট তাওবা করে ভবিষ্যতে কখনো ঐ গুনায় লিপ্ত না হওয়ার জন্য কঠোর মনোভাব গ্রহণ করবে।
তৃতীয়ত: ঐ গুনাহর মাধ্যমে যদি কোনো মানুষের হক নষ্ট হয়, তাহলে তার ক্ষতি পূরণ দেয়া বা তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয়া। আর কোনো কারণে (যেমন ঐ ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছে) যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে তার জন্য বেশি বেশি করে ক্ষমা প্রার্থনা করবে।
চতুর্থ: সগীরা গুনাহসমূহকে মাফকারী নেক আমল যেমন নফল নামায, নফল রোযা, নফল সাদকা, বেশি বেশি করে করবে। কিন্তু এ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো সগীরা গুনাহর ওপর অটল থাকা, সগীরা গুনাহকে কবীরা গুনায় পরিণত করে। যার জন্য তাওবা করা জরুরী। নেক আমলের কারণে ঐ সমস্ত সগীরা গুনাহ মাফ হয় যা মানুষের অনিচ্ছা সত্ত্বেও হয়ে থাকে। উল্লেখিত বিষয়সমূহ পালন করার পর আল্লাহর নিকট দৃঢ় আশা রাখতে হবে, যেন তিনি স্বীয় দয়া ও অনুগ্রহের মাধ্যমে অবশ্যই জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করেন এবং তাঁর নিআমত ভরপুর জান্নাতে প্রবেশ করান। আর তা আল্লাহর জন্য মোটেও কষ্টকর নয়।
টিকাঃ
২ উল্লেখিত সমস্ত গুনাহসমূহ সম্পর্কে ইমাম যাহাবী কুরআন ও হাদীসের আলোকে রেফারেন্স সহ একথা প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, এ সবগুলোই কবীরা গুনাহ।