📄 কে নিজের মনের হিসাব করবে?
মুহাসাবা এমন নয় যে সমাজের একদল মানুষ তা করবে এবং অন্যেরা তা করবে না। বরং ছোট-বড়, নারী-পুরুষ, নেককার-বদকার, আলেম-জাহেল ইত্যাদি সকল মুমিন আমভাবে তার অন্তর্ভুক্ত। যিনি জাহেল-অজ্ঞ তিনি এভাবে নিজের হিসাব করবেন যে, অজ্ঞ অবস্থায় কীভাবে তিনি আল্লাহ্র ইবাদত করছেন? কখন তার এ অজ্ঞতা দূর হবে? কীভাবে দূর হবে? কীভাবে সে শিখবে? কী দিয়ে শুরু করবে?
এভাবে আলেম বা বিদ্বান ব্যক্তিও নিজের হিসাব করবে। কথিত আছে যে, শুরুতে করা মুহাসাবা থেকে শেষে করা মুহাসাবা হবে আরও নিবিড়। অর্থাৎ জীবনের প্রথম বেলায় লোকেরা যখন আল্লাহ্র পথ সম্পর্কে অজ্ঞ ও গাফেল থাকে তখন নিজেদের মনের যেভাবে হিসাব নেয়, সেই অজ্ঞতা ও গাফলতি কেটে গিয়ে তাদের জীবন যখন উঁচু পর্যায়ে উন্নীত হয় এবং তারা বিদ্যাচর্চা, সৎকাজ সম্পাদন, ন্যায়ের আদেশ, অন্যায়ের নিষেধ ইত্যাদি আমল করতে থাকে তখন তাদের মনের হিসাব আরও কঠোরভাবে করতে হবে। আমরা কত তালেবুল ইলম বা দ্বীনী জ্ঞান অর্জনকারীকে দেখেছি যারা মনের হিসাব রাখে না এবং আল্লাহ ও রাসূলের বিরোধী পথ থেকে আত্মরক্ষা করে না। ফলে নানান জায়গায় তাদের পদস্খলন ঘটেছে এবং মানবতা বিনষ্টকারী আচরণ থেকে তারা নিজেদের হেফাযত করতে পারেনি। মাকরূহ বা অপসন্দনীয় কাজ পরহেয করাতো দূরের কথা, সময়বিশেষে তারা বরং হারামের সাথেও জড়িয়ে পড়ে।
এ ধরনের দ্বীনী জ্ঞান অর্জনকারীরা নিজেদের বিদ্যার উপর নির্ভর করে মনের হিসাব রাখে না। তারা তাদের বিদ্যার বড়াই করে এবং অহংকার বশত কাউকে গ্রাহ্য করে না। হিংসা-বিদ্বেষ, গীবত ও পরনিন্দা তাদের স্বভাবে পরিণত হয়। তারা কুৎসিত কথা ছড়িয়ে বেড়ায় এবং গোপনীয় বিষয় ফাঁস করে দেয়। তারা নিজেদের জন্য এমন এমন মর্যাদার কথা ভাবে যা তাদের ছাড়া অন্যদের জন্য তারা ভাবতেই পারে না। হয়তো এক পর্যায়ে তাদের ভাবনা সঠিক হ'তেও পারে, কিন্তু আল্লাহ তা'আলা তো সকল শ্রেণীর মানুষেরই পাপ-পঙ্কিলতার হিসাব নিবেন। সেক্ষেত্রে বরং তাদের হিসাব হবে আরও কঠোর। তাদের মতো শিক্ষার্থীদের বিদ্যা তাদের কোন উপকারে আসে না। কেননা মুজাহিদের জন্য যেমন তলোয়ার, আমলের জন্য তেমনি বিদ্যা। তলোয়ার ব্যবহার না করলে তা দ্বারা মুজাহিদ কিভাবে উপকৃত হবে? আবার ক্ষুধার্তকে দেখুন, সে ক্ষুধা থেকে বাঁচার জন্য খাদ্য জমা করে। কিন্তু ক্ষুধার সময় যদি সে নাই খেল, তবে আর খাদ্য জমিয়ে কি লাভ! কবি বলেন,
يُحَاوِلُ نَيْلَ الْمَجْدِ وَالسَّيْفُ مُعْمَدٌ * وَيَأْمَلُ إِدْرَاكَ الْعُلَاَ وَهُوَ نَائِمُ
'সে মুজাহিদের সম্মান লাভে প্রয়াসী, অথচ তার তলোয়ার কোষবদ্ধ, সে উচ্চমার্গের নাগাল পেতে আশাবাদী, অথচ ঘুমিয়ে আছে বিছানায়'।
জাহিল-মূর্খদের অবস্থা অনেক সময় এ ধরনের শিক্ষার্থীদের থেকে ভাল হয়ে থাকে। কেননা কিছু কিছু জাহিল-মূর্খ নিজেদের মনের হিসাব করে মন্দ আমলগুলো বের করে ফেলে এবং খেয়াল-খুশীতে মজে গিয়ে সর্বনাশ ডেকে আনার আগে নিজেদের সংশোধনে সচেষ্ট হয়। অনেক শিক্ষার্থী তাদের শেখা বিদ্যার প্রচার-প্রসার করে না এবং পঠন-পাঠনেও অংশ নেয় না। এটি তাদের একটা বড় ভুল। অথচ এ ভুল যাতে না হয়, সেজন্য তাদের নিজেদের দায়িত্বের হিসাব রাখা আবশ্যক ছিল। আর যারা বিদ্বান বা আলেম তারা নিজেদের মনের হিসাব রাখতে অন্যান্যদের তুলনায় বেশী সমর্থ। আজকাল আমরা ইন্টারনেট, ইউটিউব, টিভি ইত্যাদি মিডিয়াতে প্রচারিত যেসব ভুলে ভরা দ্বীন বিনষ্টকারী ফৎওয়া দেখতে পাই তার কারণ আলেমদের মুহাসাবা বিমুখতা। তারা যদি নিজেদের মনে একবারের জন্যও ভেবে দেখতেন তাহ'লে ফৎওয়া জিজ্ঞাসাকারীদের খেয়াল-খুশী অনুযায়ী তাদের মর্যী মাফিক ঐসব বাজে ফৎওয়া দিতেন না। কাজেই আলেম ও তালেবুল এলেম বা দ্বীন শিক্ষার্থীদের জন্য অন্য যে কারও তুলনায় নিজেদের মনের হিসাব কঠিনভাবে রাখা উচিত। কেননা তারা যদি নিজেদের মনের হিসাব রাখে তবে নিজেরা উপকৃত হবে এবং জনগণেরও উপকার করতে পারবে। আর যদি নিজেদের মনের হিসাব রাখা ছেড়ে দেয় তবে নিজেরা পথহারা হবে এবং অন্যদেরও পথহারা করবে।
টিকাঃ
৩৪. ইবনুল জাওযী, আল-মুদহিশ, পৃ. ৪৭০।
📄 কোত্থেকে আমরা আত্মসমালোচনা শুরু করব?
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, প্রথমেই ফরয আমল দিয়ে নিজের হিসাব শুরু করবে। তাতে কোন ত্রুটি বুঝতে পারলে কাযা অথবা সংশোধনের মাধ্যমে তার প্রতিবিধান করবে। তারপর নিষিদ্ধ বিষয়ের হিসাব নেবে। যখন সে বুঝতে পারবে যে, সে কোন একটা নিষিদ্ধ কাজ করে ফেলেছে তখন তওবা, ইস্তিগফার ও পাপ বিমোচক কোন পুণ্য কাজ করে তার প্রতিবিধান করবে। তারপর গাফলতির হিসাব নিবে। নিজের সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে যদি সে গাফেল থাকে তাহ'লে আল্লাহ্র দিকে ফিরে আসা এবং যিকির করার মাধ্যমে সে গাফলতির প্রতিবিধান করবে।
তারপর সে কী কথা বলেছে, কোথায় দু'পায়ে হেঁটে গেছে, দু'হাত দিয়ে কী ধরেছে, দু'কান দিয়ে কী শুনেছে তার হিসাব নিবে। সে ভাববে এ কাজ দ্বারা আমার কী নিয়ত ছিল? কার জন্য আমি এ কাজ করেছি? কোন পদ্ধতিতে কাজটি করেছি? জেনে রাখা দরকার যে, প্রত্যেক হরকত (কাজ) ও কথার জন্য দু'টো খাতা (রেজিস্টার) তৈরি করতে হবে। এক খাতায় থাকবে, কার জন্য কাজ করছি তার তালিকা; আরেক খাতায় থাকবে, কীভাবে কাজ করছি তার তালিকা। প্রথমটা ইখলাছ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা এবং দ্বিতীয়টা অনুসরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা।
ইবনুল কাইয়িম (রহঃ) নফস বা মনের হিসাব গ্রহণের একটি কার্যকরী পদ্ধতি তুলে ধরেছেন। তিনি কোত্থেকে মুহাসাবা শুরু করতে হবে এবং কোনটার পর কোনটা করতে হবে ধারাবাহিকভাবে তা বর্ণনা করেছেন। নিম্নে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হ'ল।-
📄 মনকে শাস্তি প্রদান
মুমিন যখন তার নফস বা মনের হিসাব নিবে তখন দেখতে পাবে, মন কোন না কোন পাপ করেছে, কিংবা ফযীলতমূলক কাজে শিথিলতা ও অলসতা দেখিয়েছে। ফলে যা ছুটে গেছে তার প্রতিকারের জন্য মনকে শাস্তি-সাজা ও আদব শিক্ষা দেওয়া তার কর্তব্য। যাতে ভবিষ্যতে এমনটা আর না ঘটে এবং মন শায়েস্তা ও কর্মতৎপর হয়।
মনকে মুজাহাদা বা কর্মতৎপর না রাখলে, হিসাব না নিলে এবং শাস্তি না দিলে মন সোজা থাকবে না। আশ্চর্য যে, মানুষ কখনো কখনো চারিত্রিক দোষ কিংবা অন্য কোন ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে নিজ পরিবারের সদস্য ও চাকর-বাকরদের শাস্তি দেয়, কিন্তু সে নিজে কোন মন্দ কাজ করলে নিজেকে শাস্তি দেয় না। অথচ নিজেকে শাস্তি দেওয়াই উত্তম ও সুবিবেচনাপ্রসূত কাজ। কখনো কখনো শাস্তির নামে উপেক্ষা ও ছাড় দিতে দেখা যায়। তবে নিজেকে শাস্তি দানের মূল লক্ষ্য নিজের মনকে আল্লাহ্র অনুগত রাখা এবং আগে করা হয়নি এমন সব ভালো কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা। মনকে শাস্তি দানের পূর্বসূরীদের পদ্ধতি এমনই ছিল। এখানে তার কিছু নমুনা তুলে ধরা হ'ল :
ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর একবার আছর ছালাতের জামা'আত ছুটে গিয়েছিল। সেজন্য নিজেকে শাস্তি স্বরূপ তিনি এক খণ্ড জমি দান করে দেন। যার মূল্য ছিল দুই লক্ষ দিরহাম!!
টিকাঃ
৪৮. 'উমদাতুল ক্বারী, ১২/১৭৩।
📄 মনকে শাস্তি প্রদানের সীমা
একজন মুসলিমের নিজ মনকে এমনভাবে পরিচালনা করা কর্তব্য, যাতে আখিরাতে সে নাজাত পেতে পারে। এজন্য সে মনের সঙ্গে সংগ্রাম (মুজাহাদা) করবে, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে ভাল কাজে লাগাবে। যখন সে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়বে তখন তার সাথে সদাচার (মুদারাত) করবে এবং কষ্ট দেওয়া বন্ধ রাখবে। এভাবে সংগ্রাম ও সদাচারের মধ্য দিয়ে না চললে মন ঠিক থাকবে না।
যখন দেখবে, মন বেশ নির্ভয় ও নিশ্চিন্ত হয়ে আছে তখন তাকে আল্লাহ্র কথা স্মরণ ও তাঁকে ভয় করতে বলবে। আবার যখন দেখবে, মন বিচলিত ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে তখন তার মাঝে আল্লাহ্র নিকটে ভাল ফল লাভের আশা জাগাবে। এভাবেই মনের পরিচালনা ও পরিচর্যা করতে হবে।
অনেক সময় মনোলোভা কিছু বিষয় মনের সামনে তুলে ধরবে। তাকে বুঝাবে যে, তুমি এটা করলে এ পুরস্কার পাবে। তখন তার জন্য অনেক সৎকাজ করা সহজ হয়ে যাবে। ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেন, একবার আমার পাশ দিয়ে দু'জন কুলি একটা গাছের ভারী গুঁড়ি বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। ওরা গান গাচ্ছিল আর পথ চলছিল। দু'জনের একজন অন্যজন কী বলে তা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, অতঃপর তার কথার পুনরাবৃত্তি করছিল অথবা তার মতো কিছু একটা বলছিল। প্রথমজনও আবার দ্বিতীয় জনের কথা খেয়াল করছিল। আমি ভেবে দেখলাম, তারা দু'জন যদি এভাবে গান না গাইত তাহ'লে তাদের কষ্ট বেড়ে যেত এবং গাছের গুঁড়ি বহন দুষ্কর হয়ে পড়ত। কিন্তু এখন যেই তারা গান গাইছে অমনি তাদের জন্য বোঝা বহন সোজা হয়ে আসছে। কেন তা সহজ হচ্ছে, আমি তার কারণও ভেবে দেখলাম। বুঝতে পারলাম, প্রত্যেকের মনোসংযোগ অন্যে কী বলছে তার প্রতি নিবদ্ধ হচ্ছে। আবার নিজেও অনুরূপ জবাব দানের চেষ্টা করছে। এভাবেই তাদের পথ কেটে যাচ্ছে; গুঁড়ি বহনের কথা মনেই আসছে না।
এখান থেকে আমি একটা আজব শিক্ষা পেলাম। আমি খেয়াল করলাম, মানুষকেও তো অনেক কঠিন কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হয়। তন্মধ্যে সবচেয়ে কঠিন দায়িত্ব, মন যা ভালবাসে তা থেকে তাকে বিরত রাখা এবং যা ভালবাসে না তা করতে তাকে অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে মনকে বাগে আনা এবং তাকে এ অবস্থায় ধৈর্য ধরানোর সাধনা। আমি বুঝতে পারলাম, ধৈর্যের সাধনায় মনকে পাকাপোক্ত করতে হ'লে তাকে সান্ত্বনা যোগানো ও তার সঙ্গে মজা করার মতো কিছু একটা করতে হবে।
টিকাঃ
৫৫. ইবনুল মুবারক, আয-যুদ, পৃ. ২৭৭; তারীখু দিমাশক ৪৭/১৫৯।
৫৬. ইবনুল মুবারক, আয-যুহৃদ, পৃ. ৯৫; তারীখু দিমাশক ৫৭/৪২৬।
৫৭. আহমাদ ইবনু হাম্বল, আয-যুহৃদ পৃ. ৩৪০; হিলয়াতুল আওলিয়া ২/১১৪।
৫৮. এ ছিল এক ধরনের বোল, যা কুলিরা সমস্বরে বলে, যাতে বোঝা বহনের কথা ভুলে থাকা ও পথ চলা সহজ হয় ।- অনুবাদক।
৫৯. ইবনুল জাওযী, ছায়দুল খাতির, পৃ. ৭১।