📄 আত্মবিচারের কয়েকটি উপকারিতা
মুহাসাবাহ বা আত্মবিচারের অনেক মূল্যবান চাক্ষুষ উপকারিতা রয়েছে। নিম্নে কয়েকটি পেশ করা হলো।
১. প্রথম উপকারিতা হলো, এর দ্বারা নিজের দোষত্রুটি খুঁজে বের করা খুব সহজ হয়ে যায়। এটা নিজেকে শোধরানোর মহৌষধ। কেননা যে ব্যক্তি নিজের দোষ সম্পর্কেই অবহিত নয়, সে কীভাবে নিজেকে সংশোধন করবে?
২. দ্বিতীয় উপকারিতা হলো, এর দ্বারা অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হয় এবং পরকালের প্রস্তুতি গ্রহণ সহজ হয়।
৩. মুমিনের সামনে প্রকৃত লাভ-লোকসানের চিত্র স্পষ্ট হয়।
৪. দুনিয়ায় মুহাসাবাতুন নাফস পরকালে মুমিন বান্দাকে বিপুলভাবে লাভবান ও উপকৃত করবে।
৫. এর দ্বারা আল্লাহ তাআলার আদেশ পালন করা হয়। কেননা আল্লাহ তাআলা কুরআনে মানবজাতিকে নিজ নিজ জীবনের হিসাব ও আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করার আদেশ করেছেন।
৬. মানুষ গাফলত ও উদাসীনতা থেকে মুক্তি পায়। পাপ ও নাফরমানিতে ডুবে থাকা থেকে রক্ষা পায়।
৭. অতীতের যেসব ফরজ ও ওয়াজিব ইবাদত ছুটে গেছে তার ক্ষতিপূরণ আদায়ে মুমিন বান্দাকে সাহায্য করে।
৮. আত্মবিচারের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হয়।
৯. এর দ্বারা মানুষ তার ওপর আল্লাহ তাআলার হক সম্পর্কে জ্ঞাত হয়। কেননা যে ব্যক্তি নিজের ওপর আল্লাহর কী কী হক রয়েছে সেটাই জানে না, সে কীভাবে আল্লাহর হক আদায় করবে?
১০. আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জিত হয় মুহাসাবাহ দ্বারা। আর আত্মা নষ্ট ও পাপে ডুবে যায় মুক্তভাবে ছেড়ে রাখার কারণে।
টিকাঃ
১০. নাদরাতুন নাইম: ৮/৩৩২৪, ইগাছাতুল লাহফান: ১/৮৪, ইহসানু সুলুকিল আবদ: ১/৭১।
📄 পুরো জীবনের হিসাবনামা
মুহাসাবাহর সারকথা হলো, সারা জীবনের হিসাব আয়ত্বে রাখতে হবে। প্রথমে জীবনের যাবতীয় ফরজ আমল সম্পর্কে হিসাব করতে হবে। যদি দেখা যায় যে, জীবনের কোনো এক সময়ে ফরজ কোনো বিধানে ত্রুটি হয়ে গেছে, তবে সেটার ক্ষতিপূরণ করে নেবে। কাজাযোগ্য ফরজ হলে কাজার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ করা, কাজাযোগ্য না হলে নিজেকে সংশোধন করার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ আদায় করা। সেই সঙ্গে ছুটে যাওয়া ফরজগুলোর জন্য অনুশোচনা করা ও অনুতপ্ত হওয়া। এরপর নিষিদ্ধ কাজগুলো সম্পর্কে মুহাসাবাহ করতে হবে যে, জীবনে কখনো নিষিদ্ধ কোনো কাজ সংঘটিত হয়েছে কি-না? হয়ে থাকলে তাওবা, ইস্তেগফার ও ক্ষতিপূরণ হিসেবে অন্যান্য নেক আমলের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া।
এরপর গাফলতের বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা। যদি দেখা যায় যে, যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে, তাতে গাফলতি হয়েছে, তবে যিকির ও আল্লাহর দিকে ধাবিত হওয়ার মাধ্যমে সেটার ক্ষতিপূরণ করা। এরপর জীবনে যেসব কথোপকথন হয়েছে সেগুলোর হিসাব নেয়া। এরপর যেখানে যেখানে কদম রেখেছে, সে বিষয়ে চিন্তা করা এবং ভাববে এসব কদমের কোনটা বৈধ ছিল, কোনটা অবৈধ ছিল, সেগুলোর হিসাব করা। হাত দিয়ে যা ধরেছিল, কান দিয়ে যা শ্রবণ করেছিল—এর সবগুলো নিয়েই ভাবা এবং চিন্তা করা যে, এসব কোন উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল? কীভাবে করা হয়েছিল? বৈধ উপায়ে না অবৈধ উপায়ে? এরপর দৃঢ়ভাবে এই বিশ্বাস পোষণ করা যে, কেয়ামত দিবসে তার সামনে আমলনামা খুলে দেয়া হবে। তাতে প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি কথা, প্রতিটি পদক্ষেপ লিপিবদ্ধ থাকবে এবং এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:
فَوَرَبِّكَ لَنَسْأَلَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ عَمَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ.
'তোমার রবের শপথ! আমি অবশ্যই তাদেরকে তাদের কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করব।'১১
আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন:
فَلَنَسْتَلَنَّ الَّذِينَ أُرْسِلَ إِلَيْهِمْ وَلَنَسْتَلَنَّ الْمُرْسَلِينَ فَلَنَقُصَّنَّ عَلَيْهِمْ بِعِلْمٍ وَمَا كُنَّا غَائِبِينَ.
'আর যাদের নিকট রাসূল প্রেরণ করা হয়েছিল, তাদেরকে আমি অবশ্যই জিজ্ঞাসা করব এবং রাসুলগণকেও জিজ্ঞাসা করব। তারপর তাদের নিকট থেকে পূর্ণ জ্ঞানের সঙ্গে অবশ্যই তাদের কার্যাবলি বিবৃত করব, আর আমি তো তাদের কর্মের সময় অনুপস্থিত ছিলাম না।'১২
আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন:
لِيَسْأَلَ الصَّادِقِينَ عَن صِدْقِهِمْ.
'... সত্যবাদীদেরকে তাদের সত্যতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার জন্য। '১৩
مَالِ هَذَا الْكِتَابِ لَا يُغَادِرُ الخ
'হায়, এ কেমন কিতাব, ছোটো-বড়ো কিছুই ছাড়ে না...'১৪
এসব আয়াত পাঠ করে আমরা জানতে পারলাম, আল্লাহ তাআলা স্বয়ং নবী-রাসুলগণকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন। সুতরাং আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে কি আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞাসার ঊর্ধ্বে রাখবেন? সত্যবাদীদেরকে যদি এভাবে হিসাবের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, তবে আমাদের মতো অতি সাধারণ ব্যক্তিদের কোথায় দাঁড়াতে হবে? এসব বিষয় নিয়েই ভাবতে হবে। নিজের আত্মাকে এসব প্রশ্নের সম্মুখীন করতে হবে।
নিজ আত্মার কাছেই জিজ্ঞাসা করতে হবে যে, মহান নবী-রাসুলগণের যখন এই অবস্থা, তখন তোমার মতো পাপী ও মিথ্যাবাদী আত্মার অবস্থা কত ভয়ানক হতে পারে? আত্মা ও নিজের সত্তাকে এভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন করাই হলো মুহাসাবাহ বা আত্মবিচার। এভাবেই জীবনের প্রতিটি কাজ ও কর্মের হিসাব নিতে হবে। দুনিয়ায় হিসাব করে আখেরাতের হিসাব এগিয়ে রাখতে হবে অর্থাৎ সহজ করে রাখতে হবে।
আমরা বাস্তব জীবনেই এর দৃষ্টান্ত দেখি। মালিকের হিসাব নেয়ার আগেই যদি ম্যানেজার নিজে নিজে হিসাব করে রাখে, তবে তার জন্য মালিকের কাছে হিসাব দিতে সুবিধা ও সহজ হয়। মালিক তখন সাধারণ ভুল-ত্রুটি এড়িয়ে যান। কিন্তু হিসাব করে না রাখলে এবং হিসাবের খাতা এলোমেলো করে রাখলে মালিক ভীষণ বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট হন। তার কাজের উদাসীনতার জন্য তাকে তিরস্কার করেন। প্রতিটি হিসাবের পাতা ভুল আছে মনে করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হিসাব নিতে থাকেন। এর ফলে মহাজনের কাছে হিসাব দেয়া কঠিন হয়ে যায়। পরকালের অবস্থাও এমন হবে। আমরা যদি নিজেরাই নিজেদের আত্মার কাছ থেকে হিসাব নিয়ে তাকে কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে আবদ্ধ করতে সক্ষম হই, তবে আল্লাহ আমাদের হিসাব সহজ করবেন।
টিকাঃ
১১. সুরা হিজর: ৯২-৯৩।
১২. সুরা আরাফ: ৬-৭।
১৩. সুরা আহযাব: ৮।
১৪. সুরা কাহাফ: ৪৯।