📄 তাওবার সাহায্যকারী উপাদান
১। বান্দাকে আল্লাহর শক্তিমত্তা ও ক্ষমতা বুঝতে হবে। তিনি ইচ্ছা করলে তাকে শাস্তি দিতে পারেন। এই অনুভূতি বান্দাকে সাথে সাথে তাওবা করতে সাহায্য করবে। এজন্য সলফে সালেহীনদের একজন বলেছিলেন, “কেমন গুনাহ করেছ সেটি না দেখে বরং দেখো কার বিরুদ্ধে তুমি গুনাহ করেছ।” আল্লাহ বলেন,
“তোমাদের কি হলো যে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব আশা করছো না, অথচ তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন।” (সুরা নুহ, আয়াত ১৩-১৪)
২। বান্দার উচিৎ মৃত্যু ও মৃত্যুর যন্ত্রণার কথা স্মরণ করা। তার কল্পনা করা উচিৎ কতটা নিসঙ্গ আর একাকী হবে তার কবর! আল্লাহ বলেন,
“প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আর তোমরা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণভাবে বদলা প্রাপ্ত হবে।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৮৫)
“কেউ জানেনা আগামীকাল সে কি উপার্জন করবে। কেউ এটাও জানেনা কোথায় তার মরণ হবে।” (সুরা লোকমান, আয়াত ৩৪)
মুজাহিদ (রঃ) বলেন, “যখন আদম সন্তানকে কবরে রাখা হবে তখন কবর তাকে বলবে, 'হে আদম সন্তান, লানত তোমার উপর! কোন জিনিস তোমাকে আমার সম্পর্কে ভুলিয়ে রেখেছিল? তুমি কি জানতে না আমি হলাম পোকা মাকড় ভর্তি, নিসঙ্গ আর অন্ধকার ঘর। আমি তোমার জন্য এসব জিনিসই তৈরি করে রেখেছি। তুমি আমার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়ে এসেছো?”
ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, “সকালে তুমি আরেকটি সন্ধ্যা আর সন্ধ্যায় তুমি আরেকটি সকাল পাবে এমন আশা করো না। অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে, মৃত্যুর আগে জীবনকে গুরুত্ব দাও।”
৩। বান্দার জেনে রাখা উচিৎ যে পরকালের উদ্দেশ্যে করা কাজের মাধ্যমেই উভয় জগতের সাফল্য পাওয়া যেতে পারে। এই পৃথিবী অল্প কিছু মুহুর্ত মাত্র, যা নিঃশেষ হয়ে যাবে।
“হে মানুষ, তোমাদের রবের সাথে সাক্ষাতের আগ পর্যন্ত তাঁর সন্তুষ্টির জন্য কঠিন পরিশ্রম করো।” (সুরা আল-ইনশিকাক, আয়াত ৬)
“তাদের কাছে পার্থিব জীবনের উপমা বর্ণনা করুন। তা হলো পানির ন্যায়, যা আমি আকাশ থেকে নাযিল করি। অতঃপর এর সংমিশ্রণে সবুজ শ্যামল ভুমিজ লতাপাতা নির্গত হয়। অতঃপর তা এমন শুষ্ক চূর্ণ বিচুর্ণ হয় যে বাতাসে উড়ে যায়। আল্লাহ এসব কিছুর উপর শক্তিমান।” (সুরা আল-কাহফ, আয়াত ৪৫)
“হে মানুষ, নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য, সুতরাং পার্থিব জীবন যেন তোমাকে প্রতারণায় না ফেলে। সেই প্রবঞ্চক (শয়তান) যেন কিছুতেই আল্লাহ সম্পর্কে তোমাদেরকে ধোঁকা দিতে না পারে।” (সুরা আল-ফাতির, আয়াত ৫)
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “আল্লাহর কাছে যদি এই দুনিয়ার মূল্য একটা মাছির পাখার সমানও হতো তবে তিনি কোন কাফেরকে এক ফোঁটা পানিও দিতেন না।” (সুনান তিরমিজি)
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেন, “পরকালের তুলনায় দুনিয়া হলো এক ফোঁটা পানির মত যা সাগরে আঙ্গুল ডুবালে তোমার একটি আঙ্গুলের সাথে উঠে আসে।” (সহীহ বুখারি ও সহীহ মুসলিম)
ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, “বিচারের দিন এই পৃথিবীকে একজন দাঁতহীন, কুশ্রী, বুড়ো মহিলার চেহারায় উপস্থাপন করা হবে। সে মানুষের সামনে উপস্থিত হলে মানুষ জিজ্ঞেস করবে, কে এই মহিলা? তারা আল্লাহর কাছে এই মহিলার সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকার প্রার্থনা করবে। তখন তাদের বলা হবে, এই হলো সেই দুনিয়া যার জন্য তোমরা ঝগড়াঝাটি করতে, সম্পর্ক ভেঙে দিতে। এই হলো সেই দুনিয়া যার জন্য তোমরা একে অপরকে হিংসা করতে, ঈর্ষা করতে। একে অপরের সাথে প্রতারণা করতে।
সেই মহিলাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করলে সে বলবে, হে আমার প্রভু! আমার অনুসারীরা কোথায়? কোথায় আমার লোকজন? আল্লাহ তখন তার অনুসারী ও লোকজনকে তার সাথে ছুড়ে ফেলার আদেশ দিবেন।”
৪। বান্দার জেনে রাখা উচিৎ, দুনিয়াতে হয়তো কোন শাস্তি তাড়াতাড়ি দেয়া হতে পারে। তার জীবনের সব কিংবা কোন একটি সমস্যা হলো তার গুণাহের ফল।
“আল্লাহ তাদের প্রতি অবিচার করেননি। বরং তারাই নিজেদের প্রতি জুলুম করেছে।” (সুরা আন-নাহল, আয়াত ৩৩)
ফুজাইল (রঃ) বলেন, “আমি যদি আল্লাহকে অমান্য করি, তার ফলাফল আমার গাধা আর চাকরের উপর পড়তে দেখি (অর্থাৎ তারাও সেদিন আমাকে মান্য করে না)।”
ইবনে সিরীন (রঃ) বলেন, “বিশ বছর আগে আমি একজন মানুষকে ছোট করেছিলাম তাকে 'হে দরিদ্র লোক' বলে, এজন্য আল্লাহ তারপর থেকে আমার উপর দারিদ্র্য দিয়েছেন।”
ফুজাইল (রঃ) বলেন, “একজন মানুষের জামাতে নামাজ ছুটে যায় অতীতে কোন পাপ করার কারণে।”
কাব উল আহবার (রঃ) বলেন, “দোযখের মানুষেরা চরম আফসোস বোধ থেকে নিজেদের হাত কাঁধ পর্যন্ত খেয়ে ফেলবে, অথচ টেরও পাবে না (আফসোস বোধ এতটাই তীব্র হবে)।”
ইয়াজিদ আর রুকাসি (রঃ) বলেন, “আমি নিজেকে দোযখের আগুনে দেখতে পাই একদিকে আমাকে লোহার হাতুড়ি দিয়ে মারা হচ্ছে অন্যদিকে আমি কাঁটা খাচ্ছি আর পুঁজ পান করছি। আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, তুমি কি চাও? আমি উত্তর দেই, আমি যদি নেক আমল করার জন্য পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারতাম আর এই শাস্তির হাত থেকে বাঁচতে পারতাম। তার পর আমি কল্পনা করি আমি বেহেস্তের বাগানে হেটে বেড়াচ্ছি, সেখানে রেশমী কাপড় পরে কুমারী হুরদের সাথে মিলছি। আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, তুমি কি চাও? আমি উত্তর দেই, আমি চাই পৃথিবীতে ফিরে যেতে, যাতে আমি আরো অনেক বেশী নেক আমল করতে পারি আর বিনিময়ে এখানে আরো অধিক পরিমানে নেয়ামত পেতে পারি।
এরপর আমি নিজেকে বলি, হায়! তুমি কল্পরাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছো। সুতরাং নিজের লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করো।”
হে আল্লাহর বান্দারা, আমরা ঘোরের মধ্যে বাস করছি। আসুন আমরা তাওবা করি, অনুশোচনা করি আর আল্লাহর দিকে ফিরে যাই।
📄 অতীত যুগের কাহিনী
আপনি যদি অপ্রতিরোধ্য গুনাহে মোহগ্রস্ত হয়ে থাকেন তবে এগুলো মনে রাখবেন:
১ – এক লোক ইব্রাহীম আদামের (রঃ) কাছে গেলেন এবং বললেন, হে আবু ইসহাক, আমি সীমালংঘন করেছি (পাপ করার মাধ্যমে)। আমাকে আপনি এমন একটি উপায় বলে দিন যাতে আমার হৃদয় সেই অনুযায়ী কাজ করতে পারে। ইব্রাহীম বললেন, পাঁচটি অভ্যাস গড়ে তুলবে আর তার উপর অটল থাকবে। তাহলে কোন কিছু আর তোমার ক্ষতি করতে পারবে না আর কোন (অন্যায়) ভোগ-বিলাস তোমাকে ধ্বংস করতে পারবে না:
১। তুমি যদি আল্লাহকে অমান্য করতে চাও তবে তাঁর দেয়া কোন কিছু তুমি খেতে পারবে না। তোমাকে যে হাত খাওয়ায় তাতে তুমি কি করে কামড় বসাবে?
২। তুমি যদি আল্লাহকে অমান্যই করবে তবে তাঁর মালিকানাধীন কোন জায়গায় তুমি থাকতে পারবে না। কেমন করে তুমি তাঁর জিনিস খেয়ে আর তাঁর দয়ায় বেঁচে থেকে তাঁকে অমান্য করার ইচ্ছা পোষণ করতে পারো?
৩। তুমি যদি এমন অকৃতজ্ঞই হও আর তাঁকে অমান্য করতে চাও, তবে এমন কোন জায়গা খুঁজে নাও যেখানে তুমি তা গোপনে করতে পারবে। তোমার গুনাহ করার স্পর্ধা হয় কি করে যখন তিনি তোমার সামনে উপস্থিত?
৪। যখন মালাকুল মাওত চলে আসবেন, তখন তুমি তাঁকে বল তোমার রুহ কবজ করতে কিছুটা দেরি করতে যাতে তুমি আন্তরিক তাওবা করে কিছু নেক আমল করে নিতে পারো। ফেরেশতা তোমার আবেদন শুনবেন না। বরং তখনই তোমার রুহকে নিয়ে যাবেন। তাহলে কি করে তুমি পালিয়ে যাওয়ার আশা করছো?
৫। যখন জাহান্নামের ফেরেশতা তোমাকে দোযখের দিকে নিয়ে যেতে আসে, তাঁকে অনুসরণ করো না। কিন্তু তুমি তাকে চাইলেও ঠেকাতে পারবে না। তাহলে তুমি কেমন করে নিজেকে বাঁচানোর আশা করতে পারো?
লোকটি বললো, যথেষ্ট হয়েছে ইব্রাহীম। আমি এখনই আন্তরিক ভাবে তাওবা করছি। লোকটি তাই করলো এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইব্রাহীমের (রঃ) সাহচর্যেই ছিল।
২ - ফুজাইল ইবনে আয়াজ (রঃ) ছিলেন একজন ডাকাত। তিনি গভীরভাবে একজন তরুণীর প্রেমে পড়েছিলেন। একরাতে যখন তিনি সেই তরুণীর ঘরের দেয়াল বেয়ে উঠছিলেন তখন তিনি শুনতে পেলেন, কেউ একজন সুরা আল-হাদীদের এই আয়াত তেলাওয়াত করছেন:
“যারা মুমিন তাদের জন্য কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তার কারণে হৃদয় বিগলিত হবার সময় আসেনি?” (সুরা আল-হাদীদ, আয়াত ১৬)
ফুজাইল এই আয়াত দ্বারা এতই প্রভাবিত হলেন যে তিনি তখনই তাওবা করলেন এবং কাছাকাছি এক নির্জন জায়গায় রাত কাটালেন। সেই রাতে তিনি শুনতে পেলেন কিছু মুসাফির চিৎকার করে বলছে, 'সাবধান! সাবধান! সামনেই ফুজাইল আছে। সে তোমাদের সব কিছু লুট করে নিয়ে যাবে।' ফুজাইল চিৎকার করে বললেন, 'ফুজাইল তাওবা করেছে।' তিনি মুসাফিরদের নিরাপদ সফরের নিশ্চয়তা দিলেন। ফুজাইল ইবনে আয়াজ হয়ে গেলেন হেদায়েতের পথ প্রদর্শক। আজও তাঁর বাণী উল্লেখ করা হয়।
৩ - এক দুঃস্বপ্ন মহান দরবেশ মালিক ইবনে দিনার (রঃ) কে তাওবার দিকে নিয়ে যায়। তাঁকে তাঁর তাওবার পিছনের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,
আমি ছিলাম পুলিশের লোক এবং মদ্যপায়ী। আমার এক দাসী ছিল যে আমার সাথে খুব ভাল আচরণ করতো। তার গর্ভে আমার এক মেয়ে হয়, যার প্রতি আমার তীব্র অনুরাগ ছিল। যখন সে হাঁটতে শিখলো তখন তার প্রতি আমার ভালবাসা আরো বেড়ে যায়। আমি যখন মদ খেতে যেতাম তখন সে এসে আমার মদের গ্লাস ধরে টান দিত আর সব আমার কাপড়ের উপর গড়িয়ে পড়ত। আমার মেয়ের বয়স যখন দুই বছর, তখন সে মারা যায়। আমি অত্যন্ত ভেঙ্গে পড়লাম। সেই বছর এক শুক্রবারে ১৫ই শাবান এলো। আমি নামায না পড়েই মাতাল হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। আমি স্বপ্নে দেখলাম কিয়ামত এসে গেছে, শিংগায় ফু দেয়া হয়েছে, কবরগুলোর পুনরুত্থান ঘটেছে। আরো দেখলাম মানুষদের একত্রিত করা হলো। আমিও ছিলাম তাদের মাঝে। আমি আমার পিছনে হিস হিস শব্দ শুনতে পেলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি একটা নীল কালো বিশাল সাপ আমার দিকে তেড়ে আসছে। আমি ভয়ে আতংকে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগলাম। আমি তখন একজন বুড়ো মানুষের মুখোমুখি হলাম। তার পরনে ছিল সুন্দর পোষাক, গায়ে সুগন্ধী। আমি তাকে সালাম দিয়ে আমাকে সাহায্য করতে বললাম। তিনি কেঁদে উঠে বললেন তিনি অনেক দুর্বল আর সাপটি তার চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী। তিনি আমাকে বললেন দৌড়াতে। হয়তো সামনে এমন কাউকে পাব যে আমাকে সাহায্য করতে পারবে। আমি দৌড়ে একটা উচু জায়গায় পৌঁছে গেলাম। খেয়াল করে দেখি আমি আগুনের উপত্যকার শীর্ষে বসে আছি। আগুন দেখে এতটা ভয় পেলাম যে আমার মনে হলো আমি আগুনে প্রায় পড়েই যাচ্ছি। তখন আমি একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম। কে যেন বলছে, এখান থেকে চলে যাও। তুমি এখানকার নও। আমি সেই চিৎকার শুনে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলাম। আমি আরো দৌড়াতে লাগলাম। সাপটি তখন আমার পায়ের গোড়ালির সাথে ছিল। আমি সেই বুড়োকে আবার দেখতে পেয়ে আমাকে সাহায্য করতে বললাম। তিনি পুনরায় একই জবাব দিলেন। এরপর তিনি আমাকে একটি পাহাড় দেখিয়ে দিলেন। বললেন, আমি সেখানে নিজের কিছু সঞ্চয় পেতে পারি যা হয়তো আমাকে সাহায্য করবে। আমি পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, এটি বৃত্তাকার এবং রুপার তৈরি। পাহাড়ে ছিল অনেকগুলো ছিদ্র করা জানালা ও ঝুলন্ত পর্দা। প্রতিটি জানালায় ছিল দুইটা সোনার কপাট। প্রতিটা কপাট রেশমী পর্দা দিয়ে সাজানো। আমি দ্রুত সেই পাহাড়ের দিকে দৌড়ে গেলাম। একজন ফেরেশতা বলে উঠলেন, পর্দা উঠাও। কপাট খুলে দেখো। হয়তো এখানে এই দুর্দশাগ্রস্ত মানুষটির কোন সঞ্চয় আছে যা তাকে সাহায্য করবে। আমি তখন অনেকগুলো ছোট শিশুকে দেখতে পেলাম যাদের চেহারা জানালার ফাক দিয়ে ছোট চাঁদের মত উকি দিচ্ছে। তখন তাদের একজন বলে উঠল, তোমাদের কি হলো? জলদি আসো, তার শত্রু তাকে প্রায় ধরে ফেলেছে। তারা এগিয়ে এলো এবং তাদের জানালার ফাঁক দিয়ে উকি দিয়ে তাকালো। তারা সংখ্যায় শত শত। আমি তখন আমার মৃত মেয়েটির চেহারা দেখতে পেলাম। সে যখন আমাকে দেখলো, তখন সে কেঁদে উঠে বললো, খোদার শপথ! উনি আমার বাবা। এরপর সে জানালা দিয়ে এত দ্রুত বেরিয়ে নুরের পুকুরে লাফ দিল, ঠিক যেন ধনুক থেকে বের হওয়া তীর। তারপর সে আমার দিকে তার হাত বাড়ালো। আমি তার হাত আকড়ে ধরে ঝুলে রইলাম। সে তার আরেকটি হাত দিয়ে সাপটিকে তাড়িয়ে দিল।
এরপর সে আমাকে বসালো। আমার কোলের উপর বসে আমার দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললো, 'আব্বা! যারা মুমিন তাদের জন্য কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তার কারণে হৃদয় বিগলিত হবার সময় আসেনি?' আমি কাঁদতে শুরু করলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম সে কোথা থেকে কোরআন শিখলো। সে বললো এখানকার শিশুরা পৃথিবীতে যা জানতো তার চাইতে বেশী জানে। আমি তখন আমার পিছনে আসা সাপটি সম্পর্কে জানতে চাইলাম। সে জানালো, সেটি হলো আমার খারাপ আমল যা আমাকে দোযখে নিয়ে যেতো। আমি তখন সেই বুড়ো লোকটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। আমার মেয়ে বললো, সে হলো আমার ভাল আমল যা এত দুর্বল যে আমাকে সাপটি থেকে রক্ষা করতে পারলো না।
আমি এরপর জানতে চাইলাম, তারা (শিশুরা) পাহাড়ের ভিতরে কি করছে? সে জানাল, এরা সবাই হলো মুসলিমদের মৃত সন্তান। এরা তাদের বাবা মায়ের সাথে দেখা হবার জন্য অপেক্ষা করছে। তারা কিয়ামতের দিন তাদের বাবা মায়ের জন্য শাফায়াত করবে। মালিক বলেন, আমি আতংকে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। আমি আমার মদের সব বোতল ভেঙে ফেললাম আর আল্লাহর কাছে তাওবা করলাম। এই হচ্ছে আমার তাওবার কাহিনী।
৪ – সেই একই ব্যক্তি মালিক ইবনে দিনار (রঃ) একবার বসরার রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন। তিনি দেখেন এক রাজকীয় সুন্দরী দাসী অনেক চাকর বেষ্টিত হয়ে যাচ্ছিল। মালিক তাকে ডেকে বললেন,
“ও হে দাসী, তোমার মনিব কি তোমাকে বিক্রি করবে?”
“ও হে বৃদ্ধ তুমি কেমন করে এটা বললে?” সে জবাব দিলো। মালিক আবার বললেন, “তোমার মনিব কি তোমাকে বিক্রি করবে?” উত্তর এলো, “যদি তিনি বিক্রি করেন, তবে তোমার মত মানুষেরা কি কিনবে?”
সে বললো, “অবশ্যই! এমন কি তোমার চাইতে ভাল দামে।”
এরপর সে হেসে তার অনুচরদের বললো মালিককে তার কামরায় নিয়ে যেতে। নিজের কক্ষে এসে সে তার প্রভুকে এই ঘটনা বললো। শুনে তিনিও হাসলেন এবং মালিককে দেখতে চাইলেন। মালিককে ভিতরে আনা হলো। তাকে দেখে তিনি প্রভাবিত হলেন। “তুমি কি চাও” মনিব জিজ্ঞেস করলো।
মালিক বললেন, “তোমার দাসীকে আমার কাছে বিক্রি করো।”
“তোমার কি কেনার মত সামর্থ্য আছে?”
“তার দাম আমার কাছে দুইটা পচে যাওয়া খেজুরের বিচির চাইতে বেশি নয়।” কক্ষের সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
প্রত্যেকে বিদ্রুপের স্বরে বললো, “কি করে তার দাম এমন হতে পারে?”
মালিক বললেন, “কারণ তার অনেক খুত আছে।”
“আচ্ছা কি তার খুত?”
“সে সুগন্ধি না দিলে তার নিশ্বাস দুর্গন্ধ ছড়ায়। দাঁত না মাজলে তার দাঁত থেকে বাজে গন্ধ আসে। চুল না আঁচড়ালে তার চুল হয়ে পড়ে উকুন ভর্তি আর এলোমেলো। আর কিছু দিন বেঁচে থাকলে সে হয়ে পড়বে বুড়ো মহিলা। তার হায়েজ হয়, সে প্রস্রাব পায়খানা করে। সম্ভবত সে নিজ স্বার্থের জন্য তোমাদের পছন্দ করে। এমনকি সে হয়তো তোমাদের প্রতি বিশ্বস্তও নয়। যদি তোমরা তার আগে মারা যাও, সে তোমাদের মতই অন্য একজনকে খুঁজে বের করবে।
তোমরা তোমাদের দাসীর জন্য যে দাম চাইছো তার চাইতেও সস্তায় আমি এমন দাসী কিনতে পারি, যে পুরো বিশুদ্ধ কপূরের তৈরি। সে যদি নোনা, বাজে পানিতে তার থুথু ফেলে তবে তা হয়ে যাবে মিষ্টি পানি । সে যদি মৃতদের সাথে কথা বলে, তবে তার মিষ্টি আওয়াজে মৃতরাও সাড়া দিবে। সূর্যের দিকে যদি সে তার হাত বাড়ায়, সূর্য তার উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলবে। যদি সে রাতে আসে, রাত আলোয় ঝলমল করবে। তার পোশাক আর অলংকার নিয়ে যদি সে দিগন্তের মুখোমুখি হত, তবে দিগন্ত তার আলোয় সেজে উঠতো। মেশকাম্বর আর জাফরান দিয়ে তার পরিচর্যা করা হয়। তার বেড়ে ওঠা বাগানে, তাকে খাওয়ানো হয় তাসনিম (স্বর্গের পানি)। সে কখনোই তার মনিবের প্রতি অবাধ্য হয় না। তোমার প্রতি তার ভালবাসা সবসময় অটুট থাকবে।
এই দুই দাসীর মধ্যে কোনটি বেশী মুল্য পাওয়ার অধিকারী?” মালিক ইতি টানলেন।
“সেটি, যার বর্ণনা তুমি দিলে।” মনিব স্বীকার করলেন।
"তাহলে জেনে রাখ, তাকে পাওয়া সম্ভব, তার কাছে যাওয়াও সম্ভব।”
"তার দাম কত? আল্লাহ তোমার উপর রহম করুন।”
“খুব সস্তা। রাতের কিছু অংশ ব্যয় করো। আন্তরিকতা নিয়ে দুই রাকাত নামায আদায় করো। যখন নিজের সামনে খাবার আসে, তখন ক্ষুধার্ত মানুষের কথা ভাবো। অতিরিক্ত ভোজনের আকাঙ্খাকে কোরবানী করো (আর ক্ষুধার্তদের খাওয়াও)। রাস্তা থেকে পাথর আর ময়লা সরিয়ে দেও। বাকি জীবন সামান্য জীবিকার উপর কাটাও। এই বিস্মৃতির পৃথিবীর সব দুশ্চিন্তা দূর করো, যাতে তুমি এই পৃথিবীতে একজন সংযমী মানুষ হিসেবে সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারো। আগামীকাল মর্যাদার গন্তব্যে শান্তির সাথে যাও আর বেহেশতে বাস করো চিরকালের জন্য।”
মনিব তখন সেই দাসীর দিকে ফিরে বললেন, “হে দাসী তুমি কি শুনেছ আমাদের বুড়ো মানুষটি কি বলেছেন?”
“হ্যাঁ,” সে জবাব দিল।
“সে কি সত্য বলেছে? নাকি সে নেহায়েত গল্পই বললো শুধু?”
“না, তিনি ঠিক বলেছেন। তিনি দয়ালু আর ভাল পরামর্শ দিয়েছেন।”
মনিব তখন চেঁচিয়ে উঠলো, “তাই যদি হয় তবে তুমি আল্লাহর ওয়াস্তে মুক্ত, এই এই সম্পত্তি তোমার। আমার আশেপাশের সব নওকরেরা, তোমরা সবাই মুক্ত। তোমরা এই সব সম্পদ নিয়ে যেতে পার। আমার এই বাড়ি আর সবকিছু আল্লাহর পথে দান করে দিলাম।” তারপর সে একটি পর্দার কাপড় ছিড়ে দামী কাপড় বদলে তাই পরে নিল।
তখন দাসীটি বললো, “হে মনিব আপনি ছাড়া আমার কোন জীবন নেই। সেও তার দামী সাজসজ্জা খুলে তার বদলে খুব সাধারণ কাপড় পরে তার মনিবের সাথে বের হয়ে গেলো। মালিক তাদেরকে বের হতে দেখলেন। তিনি এক পথে গেলেন, তারা অন্য পথে।
৫ – সুলায়মান ইবনে খালিদ (রঃ) বলেন, এক বুড়ি মহিলার এক পরিচারিকার কথা হিসাম ইবনে আব্দুল মালিকের (দামেস্কের খলিফা/১০৫ হিজরী) কাছে উল্লেখ করা হলো। এই তরুণী তার সৌন্দর্য, উত্তম ব্যবহার, কোরআন তেলাওয়াত ও কাব্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। হিসাম কুফার গভর্নরের কাছে চিঠি লিখে বললেন, যত দামই হোক এই মেয়েটিকে দ্রুত তার মালিকের কাছ থেকে কিনে নিয়ে তার কাছে পাঠিয়ে দিতে। সাথে তিনি একজন নওকরও পাঠিয়ে দিলেন। গভর্নর যখন চিঠিটি পেলেন, তিনি বুড়ো মহিলার জন্য লোক পাঠালেন। বুড়ি ঐ তরুণীকে ২০০০ দিরহাম ও এমন একটি খেজুরের বাগানের বিনিময়ে বিক্রি করে দিলেন, যাতে প্রতি বছর পাঁচ শত মিসকাল খেজুর ধরতো। গভর্নর মেয়েটিকে রাজকীয় পোশাক পরিয়ে হিসামের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। হিসাম তাকে নিজের বাসা ও অনেকগুলো চাকর দিলেন। তিনি তাকে অনেক মুল্যবান অলংকার এবং জমকালো পোশাকও উপহার দিলেন।
একদিন হিসাম যখন মেয়েটির সাথে একটা অভিজাত সুগন্ধী আর বালিশ বেষ্টিত বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, মেয়েটি তাকে কিছু চমকপ্রদ গল্প বললেন আর কিছু কবিতা রচনা করলেন। হঠাৎ সেখানে সাহায্যের জন্য চিৎকার শোনা গেলো। হিসাম বারান্দা থেকে তাকিয়ে অনেক লোকের একটি শবযাত্রা দেখতে পেলেন। সে শবযাত্রার পিছনে ছিল অনেক বিলাপকারী মহিলা। এক বিলাপরত মহিলা চিৎকার করে বলছিল, হায়! তোমাকে আজ কাঠের খাটিয়াতে করে বহন করা হচ্ছে, তোমাকে মৃতদের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তোমাকে নিঃসঙ্গ কবরে রেখে আসা হবে। অল্পক্ষণের মধ্যে তোমার বিশ্রামের জায়গায় তুমি হয়ে যাবে আগন্তক। ওহে, যাকে আজ স্থানান্তরিত করা হচ্ছে। হায় যদি আমি জানতাম, যারা তোমাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে তাদেরকে কি তুমি বলেছ তোমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যেতে। নাকি তুমি তাদের জিজ্ঞেস করেছ, তোমাকে তারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? নাকি তুমি তাদের বলেছ তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে?
হিসাম কাঁদতে শুরু করলেন। তিনি তাঁর আনন্দ উপভোগ ত্যাগ করে বলতে লাগলেন, “মৃত্যু আসলেই অনেক শোকের।”
ঘাদিদ (মেয়েটি) বললো, “এই বিলাপকারী আমার হৃদয় ভেঙ্গে দিয়েছে।”
হিসাম বললেন, “এটি আসলেই মারাত্মক বিষয়। তিনি তার চাকরকে ডাকলেন। তারপর বারান্দা থেকে নেমে চলে গেলেন। ঘাদিদ তার সোফায় শুয়ে রইলো। সেই রাতে সে স্বপ্ন দেখলো কেউ একজন তার কাছে এসে তাকে বলছে,
“তুমি তোমার সৌন্দর্য আর রুপের মোহে ডুবে আছো। তখন তোমার অবস্থা কি হবে, যখন শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে, যখন মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে আর তাদের কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে?” ঘাদিদ আতঙ্কিত হয়ে জেগে উঠলো। নিজেকে শান্ত করার জন্য কিছু পান করলো। তারপর সে তার এক খাদেমকে ডেকে গোসলের আয়োজন করতে বললো। গোসল শেষে নিজের অলংকার আর পোষাক খুলে উলের তৈরী জালাবিয়া পরে কোমরে ফিতা দিয়ে বেধে নিলো। তারপর একটি কাঠির আগায় তার ব্যাগ বেধে নিয়ে দ্রুত হিসামের ঘরে প্রবেশ করলো। হিসাম তাকে চিনতে পারেনি। “আমি ঘাদীদ, তোমার দাসী”, সে জবাব দিলো। “এক সতর্ককারী এসেছিল আমার কাছে, তার সাবধান বাণী আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। তুমি আমাকে ভোগ করেছ। এবার আমাকে এই পৃথিবীর দাসত্ব থেকে মুক্তি দাও।”
হিসام বললেন, “যারা আনন্দ খুঁজে বেড়ায় তাদের মাঝে আছে অনেক ফারাক। তুমি তোমার আনন্দ খুঁজে পেয়েছ। সুতরাং তুমি আল্লাহর ওয়াস্তে মুক্ত। কিন্তু তুমি কোথায় যাওয়ার চিন্তা করছ?”
"আমি আল্লাহর ঘর যিয়ারত করতে চাই।”
“যাও,” হিসাম বললেন, “কেউ তোমার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না।”
সে তখন রাজধানী ত্যাগ করে মক্কায় পৌঁছাল। দিনের বেলায় পাখির মতো সে নীড়ে আশ্রয় নিতো, রোজা রাখতো। রাত এলে কাবার চারদিকে তাওয়াফ করে বলতো, “হে আমার সম্পদ, তুমি আমার জীবিকা। আমার আশা নষ্ট করো না, আমার ইচ্ছাগুলোকে পূর্ণ করো। আমার ফিরে যাওয়াকে সুন্দর করো। আর উদার হয়ে আমাকে পুরষ্কার দান করো।” সে অনেক বিখ্যাত হয়ে গেলো আর এইভাবে ইবাদাত করতে করতে মারা গেলো। আল্লাহ তার উপর রহম করুন।
৬ - ইব্রাহীম ইবনে আদহামের (রঃ) শিষ্য ইব্রাহীম ইবনে বাসাহার (রঃ) বলেন, তিনি একবার ইবনে আদহামকে জিজ্ঞেস করলেন কিভাবে তিনি আল্লাহর প্রতি ঝুঁকলেন। তিনি বলেন,
আমার বাবা ছিলেন বালখের (মধ্য খুরাসান) রাজা। আমরা শিকার করতে ভালবাসতাম। একদিন আমি আমার কুকুরকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বের হলাম। হঠাৎ করে আমার সামনে একটা শিয়াল বা খরগোশ লাফিয়ে উঠলো। তখন আমি আমার পিছন থেকে একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম, “তুমি এর জন্য সৃষ্টি হওনি, আর তোমাকে এর জন্য আদেশও দেয়া হয়নি (আনন্দের জন্য শিকার)”। আমি আমার ডানে বামে তাকালাম, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। আমি শয়তানকে অভিশাপ দিলাম এবং এগিয়ে গেলাম। কিন্তু তখন আমি আমার ঘোড়াকে আবার কাঁপতে দেখলাম এবং একই স্বরে একই কথা আবারো শুনতে পেলাম। আমি চারদিকে তাকালাম। কিন্তু কাউকে দেখতে না পেয়ে শয়তানকে অভিশাপ দিয়ে আবারো সামনে আগাতে চাইলাম। কিন্তু আমার ঘোড়া আমাকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলো। তখন আমি শুনতে পেলাম নীচ থেকে কেউ একজন আমার নাম ধরে ডাকছে আর বলছে, “হে ইব্রাহীম! তোমাকে এই জন্য সৃষ্টি করা হয়নি আর তোমাকে এটা করতে আদেশও দেয়া হয়নি।” সুতরাং আমি থামলাম আর বুঝতে পারলাম আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন সতর্ককারী আমাকে আমার ঘোরের জগৎ থেকে জাগাতে এসেছেন।
আমি শপথ নিলাম আজ থেকে আল্লাহর কোন আদেশ অমান্য করবো না। আমি আমার পরিবারের কাছে ফিরে গেলাম। আমি আমার বাবার একজন রাখালের কাছে গেলাম আর তার লম্বা শার্ট আর কম্বলের সাথে আমার পোশাক বদল করলাম। আমি এরপর পর্বত আর উপত্যকা পেরিয়ে ইরাকে গিয়ে পৌছলাম। সেখানে আমি কিছুদিন কাজ করলাম, কিন্তু আমি আমার উপার্জনের বিশুদ্ধতা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আমি একজন আলেমকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি আমাকে বললেন সিরিয়ায় যেতে। তার কথামত আমি সিরিয়ার একটি শহরে পৌছলাম। শহরটির নাম আল-মানসুরা। কিন্তু এখানেও আমি আমার উপার্জন নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আরেকজন আলেম আমাকে বললেন তারুসে যেতে যেখানে কাজের ও হালাল উপার্জনের সুযোগ আছে। আমি সেখানে গিয়ে সাগরের পারে গিয়ে বসলাম। একজন লোক এসে আমাকে তার বাগানের পাহারাদার হিসেবে কাজ করার জন্য নিয়োগ দিলেন। আমি বহু বছর সেখানে একজন গ্রাম্য পাহারাদার হিসেবে রয়ে গেলাম। একদিন এক নওকর তার অনেক বন্ধু বান্ধব নিয়ে বাগানে এসে আমাকে ডাক দিলো। আমি সেখানে গেলে আমাকে বললো বাগানের সবচেয়ে বড় আর উৎকৃষ্ট ডালিম নিয়ে আসতে। আমি সবচেয়ে বড় ডালিম নিয়ে গেলাম তাদের কাছে। সে একটি কেটে দেখলো এটি খুব টক। সে আমাকে বললো, 'পাহারাদার! তুমি এতদিন ধরে আমাদের বাগানের ফল খাচ্ছো। অথচ তুমি জানো না কোনটা টক আর কোনটা ভাল?' আমি তাকে বললাম, 'যেসব ফল আমি পাহার দেই, তার কোনোটিই আমি কখনো খাইনি।' চাকরটি তার বন্ধুদের দিকে ফিরে বললো, 'তোমরা শুনেছ সে কি বললো। ইব্রাহীম আদহাম তার জায়গায় হলে এমনই বলতেন।'
চাকরটি চলে গেলো এবং মসজিদে গিয়ে আমার কথা আলোচনা করলো। এক ব্যক্তি আমাকে চিনতে পারলো। পরের দিন সেই চাকরটি এক দল লোক নিয়ে সেই বাগানে এলো। আমি গাছ পালার আড়ালে লুকিয়ে গেলাম এবং যত দ্রুত সম্ভব সে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেলাম।
এভাবে আমার আল্লাহর পথে যাত্রা শুরু হলো। আর এমনি করে আমি তারুস ত্যাগ করে মরুভুমির দিকে পাড়ি জমিয়েছি।
৭ - আব্দুল্লাহ ইবনে ফুজাইল (রঃ) বলেন, তাঁর ঘরের জন্য একজন দিনমজুরের প্রয়োজন হলো। তিনি বাজারে গিয়ে একটি কম বয়সী রোগা ছেলেকে দেখতে পেলেন। ছেলেটির পরনে ছিল উলের বেল্ট দিয়ে বাঁধা একটা উলের শার্ট। হাতে একটা ঝুড়ি আর দড়ি। আব্দুল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, সে কাজ করবে কি না। ছেলেটি এক দিরহাম ও এক দানিকের বিনিময়ে কাজ করতে রাজি হলো। তবে সে শর্ত দিল, যোহর ও আসরের আজান হলে সে কাজ থামিয়ে দিবে। আব্দুল্লাহ এতে রাজি হলেন। তিনি ছেলেটিকে বাসায় এনে কি কাজ করতে হবে তা দেখিয়ে দিলেন। ছেলেটি কোন কথা ছাড়া সুন্দরভাবে কাজ করে গেলো। যোহরের আজান দিলে সে আব্দুল্লাহকে তার শর্তের কথা মনে করিয়ে দিল। আব্দুল্লাহ তাকে যেতে বললেন। ছেলেটি নামাজ পড়ে ফিরে এলো এবং আসর পর্যন্ত কাজ করলো। আবার আসরের সময় সে চলে গেলো। তারপর ফিরে এসে দিন শেষ হবার আগ পর্যন্ত কাজ করলো। আব্দুল্লাহ তার পারিশ্রমিক মিটিয়ে দিলে সে চলে গেলো।
কিছুদিন পর আবারো আব্দুল্লাহর কিছু কাজ করার দরকার হলো। তার স্ত্রী বললেন আগের ছেলেটিকে নিয়ে আসতে। কারণ সে কাজে কর্মে ভাল ও সৎ ছিল। আব্দুল্লাহ ছেলেটিকে অনেক খুঁজেও পেলেন না। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলে তারা বললো, ছেলেটি নিসঙ্গতা প্রিয়। সে শুধুমাত্র শনিবারে কাজ করে।
আব্দুল্লাহ শনিবারের জন্য অপেক্ষা করে ছেলেটিকে পেলেন। ছেলেটি একই শর্তে কাজ করতে রাজি হলো। কাজ শেষে আব্দুল্লাহ তাকে কিছু বাড়তি টাকা দিতে চাইলে সে অসন্তুষ্ট হয়ে চলে যেতে চাইলো। আব্দুল্লাহ তার পিছে পিছে গিয়ে তাকে অনুরোধ করলেন অন্তত তার পারিশ্রমিকটা নিয়ে যেতে। সে তাই নিয়ে চলে গেলো।
কিছুদিন পর আব্দুল্লাহর ছেলেটিকে আবারো প্রয়োজন হলো। তিনি শনিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করে বাজারে গেলেন। কিন্তু সেখানে তিনি তাকে পেলেন না। একজন তাকে বললো ছেলেটি প্রতিদিন এক দানিক খরচ করতো। কিন্তু বর্তমানে ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
আব্দুল্লাহ ছেলেটির বাসায় গেলেন তাকে দেখতে। সে একজন বুড়ো মহিলার ঘরে থাকতো। তিনি দেখেন, ছেলেটি একটি ইটের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। আব্দুল্লাহ তাকে প্রশ্ন করলেন, 'তুমি কি কিছু চাও?' ছেলেটি বললো, 'হ্যা যদি তুমি রাজি থাকো।' আব্দুল্লাহ সায় দিলেন।
ছেলেটি বলতে থাকল, 'যখন আমি মারা যাব, আমার দড়ি বিক্রি করে দিও। আমার শার্ট আর বেল্ট ধুয়ে আমার সাথে কবর দিও। আমার শার্টের পকেটে একটা আংটি পাবে। খলিফা হারুনুর রাশিদ এই শহরে এলে তুমি এমন এক জায়গায় দাঁড়াবে, যাতে তিনি তোমাকে দেখতে পান। তারপর তার কাছে গিয়ে তাকে এই আংটি দেখাবে। কিন্তু এই সব কিছু করবে আমাকে কবর দেয়ার পর।' আব্দুল্লাহ তাতে রাজি হলেন।
ছেলেটি মারা গেলে আব্দুল্লাহ তার কথামত সবই করলেন। খলিফা শহরে এলে আব্দুল্লাহ তাকে দেখতে গেলেন এবং জানালেন তার কাছে কিছু গচ্ছিত জিনিস আছে। তিনি আংটিটা দেখালেন। খলিফা তাকে তার ঘরে আসতে বললেন। আব্দুল্লাহ সেখানে গেলে দরবারের সবাইকে বেরিয়ে যেতে বলা হলো। এরপর খলিফা জানতে চাইলেন আব্দুল্লাহর পরিচয় কি আর কোথা থেকে তিনি এই আংটি পেলেন। আব্দুল্লাহ উভয় প্রশ্নের জবাব দিলেন। খলিফা সেই ছেলেটির লম্বা কাহিনী শুনে এতবেশি কাঁদতে লাগলেন যে তার জন্য আব্দুল্লাহর খারাপ লাগলো। 'হে আমিরুল মুমিনীন,' আব্দুল্লাহ খলিফাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, 'এই ছেলেটি আপনার কে হয়?'
'সে আমার ছেলে।' খলিফা আক্ষেপ করে বললেন।
'সে এমন হয়ে গেলো কেন?'
'আমি খলিফা হবার আগে তার জন্ম হয়। সে খুব ভালভাবে বেড়ে ওঠে। কোরআন, বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ে সে সুশিক্ষিত হয়ে ওঠে। যখন আমি খলিফা হই, সে চলে গেলো। আমার পার্থিব কোন ধন সম্পদের প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপই করলো না। সে তার মায়ের খুবই প্রিয় ছিল। আমি তার মাকে এই নীলকান্তমণীর দামী আংটিটি দিলাম তাকে দেয়ার জন্য। সে খুব অনিচ্ছা সহকারে আংটিটি নিয়েছিল। তারপর তার মাও মারা গেলো। আর এতদিন পর তুমি একমাত্র ব্যক্তি যার কাছে তার খবর পেলাম। তুমি আজ রাতে আমাকে তার কবরের কাছে নিয়ে চলো।’
আব্দুল্লাহ খলিফাকে তার ছেলের কবরের কাছে নিয়ে গেলেন। খলিফা অনেকক্ষণ ধরে কাঁদলেন। তিনি সেখানে রইলেন ভোর পর্যন্ত। তিনি আব্দুল্লাহকে অনুরোধ করলেন তার সাথে থাকতে যাতে করে আব্দুল্লাহকে নিয়ে রাতে তিনি তার ছেলের কবরের কাছে যেতে পারেন। খলিফা বলার আগ পর্যন্ত আব্দুল্লাহ জানতেন না ছেলেটি খলিফা হারুনুর রশীদের সন্তান।
“আন্তরিক তাওবা” বইয়ের এখানেই সমাপ্তি। একমাত্র আল্লাহই ইচ্ছাকে কাজে পরিণত করেন। একমাত্র তাঁর রহমতেই সব ভাল কাজ সম্পন্ন হয়।
📄 গ্রন্থপঞ্জী
১। পবিত্র কোরআন
২। ইহয়াউল-উলুম, গাজালি (মাকতাব তাকাফী, মিশর)
৩। তাফসীরে কুরতুবী (দারুল শুব, মিশর)
৪। তাসবিরাহ, ইবনে জাওজী, (জামাল ফাউন্ডেশন, বৈরুত)
৫। জুরাইয়াহ, ইসফিহানি, (দারুল ওয়াফা, মানসুরাহ)
৬। রিয়াদুস সালিহীন, নববী, (মাক্তাব আল কুদসি, মিশর)
৭। লাতাইফুল মাআরিফ, ইবনে রজব
৮। নিন আখলাকিল সালফ, আহমেদ ফরিদ, আল্বাসিরাহ, আলেক্সান্দ্রিয়া
৯। মিফতাহি দারি সাদাহ, ইবনে কাইয়্যিম (মাক্তাব মুতানাবি, মিশর)
১০। আল মুদহাস, ইবনে জাওযী (দার মারওয়ান)
১১। মাদারিজুল সালিকিন, ইবনে জাওজী (দারুল হাদিস, মিশর)
১২। মুখতাসার মিনহাজুল কাসিদিন, ইবনে কুদামাহ (দার বদর, মিশর)
১৩। কুরানের আয়াতের নির্ঘন্ট, আব্দুল বাকি (দারুল হাদিস, মিশর)
১৪। মানহাজুল তালিবিন, আল রুসতাকি (আল হালবি, মিশর)
১৫। মুওয়াকিফ মুশরিকাহ ফি হায়াতিস সালাফ, মুসা মুহাম্মাদ আল আশ্রাফ মাতাবুস সুন্দুস কুয়েত
১৬। কিতাবুল তাইবিন, ইবনে কুদামাহ আল মাকদিসি (মুয়াসসালাতুল রাইয়ান, বৈরুত)