📄 চতুর্দশ উদাহরণ
চতুর্দশ উদাহরণ
আল্লাহ তা'আলার বাণী:
إِنَّ الَّذِينَ يُبَايِعُونَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُونَ اللَّهَ يَدُ اللَّهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ ﴾ [الفتح: ١০]
আর যারা তোমার কাছে বাই'আত গ্রহণ করে, তারা শুধু আল্লাহরই কাছে বাই'আত গ্রহণ করে; আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর। (সূরা আল ফাতহ: ৪৮: ১০)
উত্তর:
এর উত্তরে বলা হবে যে, এ আয়াতটি দুটি বাক্য শামিল করে আছে। প্রথম বাক্যটি হলো:
إِنَّ الَّذِينَ يُبَايِعُونَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُونَ اللَّهَ ﴾ [الفتح: ১০]
আর যারা তোমার কাছে বাই'আত গ্রহণ করে, তারা শুধু আল্লাহরই কাছে বাই'আত গ্রহণ করে। (সূরা আল ফাতহ:৪৮: ১০)
সালাফ অর্থাৎ আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত আয়াতটিকে বাহ্যিক ও প্রকৃত অর্থেই নিয়েছেন। অর্থাৎ সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছেই সরাসরি বাই'আত গ্রহন করেছিলেন। এ কথাটি নিম্নোক্ত আয়াতেও স্পষ্ট:
﴿لَقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ ﴾ [الفتح: ١৮]
অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তারা গাছের নিচে আপনার হাতে বাই'আত গ্রহণ করেছিল। (সূরা আল ফাতহ: ৪৮: ১৮)
আর-
﴿إِنَّمَا يُبَايِعُونَ اللَّهَ ﴾ [الفتح: ১০]
তারা শুধু আল্লাহরই কাছে বাই'আত গ্রহণ করে। (সূরা আল ফাতহ: ৪৮: ১৮)
আল্লাহ তা'আলার এ কথা থেকে কেউ এটা বুঝে না যে, সাহাবীগণ সরাসরি আল্লাহর কাছেই বাই'আত গ্রহণ করেছিলেন। কেউ এটা বলবে না যে সরাসরি আল্লাহর কাছে বাই'আত গ্রহণ করাই এ আয়াতের বাহ্যিক ও প্রকাশ্য অর্থ, কেননা এরূপ হলে তা আয়াতের প্রথমাংশ ও বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যাবে। কেননা আল্লাহ তা'আলা আয়াতের প্রথম অংশে এটা স্পষ্ট করেছেন যে, সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতেই সরাসরি বাই'আত গ্রহণ করেছিলেন।
রাসূলের কাছে বাই'আত গ্রহণ করাকে আল্লাহ তা'আলা তাঁর কাছেই বাই'আত গ্রহণ করা এ জন্যে বলেছেন যে, রাসূল হলেন আল্লাহ তা'আলারই রাসূল যার হাতে সাহাবীগণ আল্লাহর পথে জিহাদের জন্য বাই'আত গ্রহণ করেছিলেন। আর রাসূলকে যিনি পাঠিয়েছেন তাঁর পথে জিহাদ করার উদ্দেশে রাসূলের কাছে বাই'আত গ্রহণ করা প্রকারান্তরে তাঁর কাছেই বাই'আত গ্রহণ করা। কেননা তিনি তো তাঁর পক্ষ থেকে বাণী পৌঁছে দেওয়ার জন্যই রাসূল। অনুরূপভাবে রাসূলের আনুগত্য করা যিনি রাসূলকে পাঠিয়েছেন তারই আনুগত্য করা। কারণ আল্লাহ তা'আলা বলেন:
﴿ مَّن يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهُ ﴾ [النساء: ٨٠]
যে রাসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। (সূরা আন্-নিসা: ৪: ৮০)
আর রাসূলের কাছে সাহাবীগণের বাই'আতকে আল্লাহর কাছে বাই'আত বলার মধ্যে নিহিত আছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্মানিত করা, তাঁকে সমর্থন করা, কৃত বাই'আতকে জোরদার করা, বাই'য়াতের আযমতকে বাড়িয়ে দেওয়া এবং বাই'আতকারীদের শানকে বাড়িয়ে দেওয়া। এ বিষয়গুলো অত্যন্ত স্পষ্ট এবং কারও কাছেই গোপন নয়।
দ্বিতীয় বাক্য:
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ يَدُ اللَّهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ﴾ [الفتح: ١٠]
আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর। (সূরা আল ফাতহ: ৪৮: ১০)
এ বাক্যটিও বাহ্যিক ও প্রকৃত অর্থেই; কেননা আল্লাহ তা'আলার হাত বাই'আতকারীদের হাতের উপর; হাত হলো আল্লাহ তা'আলার একটি সিফাত আর আল্লাহ হলেন আরশের ওপর। অতএব তাঁর হাত বাই'আতকারীদের হাতের ওপরে। এটাই হলো উক্ত বাক্যের বাহ্যিক ও প্রকৃত অর্থ। আর এতে আছে এ কথার তাগিদ যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বাই'আত করা আল্লাহর কাছেই বাই'আত করা। এর দ্বারা এটা আবশ্যক হয় না যে আল্লাহ তা'আলার হাত তাদের হাতের সঙ্গে লেগে থাকবে। যদি বলা হয় যে 'আকাশ আমাদের ওপরে' তাহলে এটা বুঝা যাবে না যে আকাশ আমাদের মাথার সঙ্গে লেগে আছে, আকাশ আমাদের থেকে দূরে ও বিচ্ছিন্ন থাকা সত্ত্বেও উক্ত বাক্যটি বলা শুদ্ধ।
অনুরূপভাবে, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে বাই'আত করেছিলেন, আল্লাহর হাত তাদের হাতের ওপরে যদিও আল্লাহ তা'আলা মাখলুক থেকে আলাদা এবং তাদের থেকে ঊর্ধ্বে।
'আল্লাহর হাত তাদের হাতের ওপরে।' এখানে 'আল্লাহর হাত'-কে নবীর হাত বলে বুঝার কোনো সম্ভাবনা নেই। এটা দাবি করার কোনো সুযোগও নেই যে এটাই হলো শব্দের বাহ্যিক অর্থ; কেননা আল্লাহ তা'আলা এখানে 'হাত'-কে তাঁর নিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে উল্লেখ করেছেন এবং তিনি বলেছেন যে তাঁর হাত তাদের হাতের ওপরে। আর বাই'আত করার সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাত সাহাবীগণের হাতের ওপরে ছিল না, কেননা বাই'আত করার সময় তিনি তাঁর হাত প্রসারিত করে ধরতেন আর সাহাবীগণ, যেভাবে মুসাফাহা করা হয় সেভাবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতকে ধরতেন। অতএব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাত তাদের হাতের সঙ্গে থাকত, তাদের হাতের ওপরে থাকত না。
📄 পঞ্চদশ উদাহরণ
পঞ্চদশ উদাহরণ
হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা'আলা বলেন:
"يا ابن آدم، مرضت فلم تعدني"
হে আদম সন্তান, আমি অসুস্থ হয়েছিলাম কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে আসনি। -আল হাদীস。
হাদীসটি 'সদাচার, সম্পর্ক রক্ষা ও শিষ্টাচার' অধ্যায়ের আওতাধীন রোগী দেখার ফজীলত অধ্যায়ে ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
(আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের দিন বলবেন: হে আদম সন্তান, আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে আসনি। সে বলবে: হে আমার রব, আমি কীভাবে আপনাকে দেখতে যাব, আপনি তো রাব্বুল আলামীন? তিনি বলবেন: তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, কিন্তু তুমি তো তাকে দেখতে যাওনি। তুমি কি জানতে না যে, যদি তুমি তাকে দেখতে যেতে তবে আমাকে তার কাছেই পেতে? হে আদম সন্তান, আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি আমাকে খাবার দাওনি। সে বলবে, হে আমার রব, আমি আপনাকে কীভাবে খাওয়াব, আপনি তো সৃষ্টিকুলের রব? তিনি বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল, কিন্তু তুমি তাকে খাবার দাওনি। তুমি কি জানতে না যে, তুমি যদি তাকে খাবার দিতে তবে তা আমার কাছে পেতে? হে আদম সন্তান, আমি তোমার কাছে পানি পান করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে পানি পান করতে দাওনি। সে বলল: হে আমার রব, আমি আপনাকে কীভাবে পানি পান করাব, আপনি তো রাব্বুল আলামীন? তিনি বলবেন: আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি পান করতে চেয়েছিল, কিন্তু তুমি তাকে পানি পান করাওনি, তুমি যদি তাকে পানি পান করাতে তবে তা আমার কাছে পেতে?)
উত্তর:
এর উত্তর হলো, সালাফগণ নিজেদের খেয়ালখুশি মোতাবেক হাদীসটির অর্থে বিকৃতি সাধন না করেই হাদীসটিকে গ্রহণ করেছেন। সালাফগণ এ হাদীসটির ঠিক সে ব্যাখ্যাই দিয়েছেন যে ব্যাখ্যা হাদীসটির যিনি বক্তা তিনি দিয়েছেন। অতএব, 'আমি অসুস্থ হয়েছিলাম', 'তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম', আমি তোমার কাছে পানি পান করতে চেয়েছিলাম', এ কথাগুলোর ব্যাখ্যা আল্লাহ তা'আলা নিজেই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, 'তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল', 'যে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল', 'আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি পান করতে চেয়েছিল'। অর্থাৎ বিষয়টি খুবই স্পষ্ট যে, এখানে উদ্দেশ্য হলো- আল্লাহ তা'আলার বান্দাদের মধ্যে কোনো বান্দার অসুস্থ হয়ে পড়া, আল্লাহ তা'আলার বান্দাদের মধ্যে কোনো বান্দার খাবার চাওয়া, আল্লাহ তা'আলার বান্দাদের মধ্যে কোনো বান্দার পানি পান করতে চাওয়া। আর এ ব্যাখ্যা যিনি দিয়েছেন তিনি খোদ ওই সত্তা যিনি এ কথাগুলো বলেছেন এবং আল্লাহ তা'আলা তাঁর উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত। অতএব আমরা যদি এখানে অসুস্থ হওয়া, খাবার চাওয়া, পানি পান করতে চাওয়া- যা আল্লাহর দিকে নিসবত করে উল্লেখ করা হয়েছে- তার ব্যাখ্যায় যদি বলি যে, এখানে মূলত, বান্দার অসুস্থতা, খাবার চাওয়া ও পানি পান করতে চাওয়াকে বুঝানো হয়েছে, তবে এতে বাণীর যে বাহ্যিক অর্থ তা থেকে সরে যাওয়া হবে না; কারণ যিনি এ বাণীগুলো বলেছেন, তিনি নিজে এসবের ব্যাখ্যা এভাবেই দিয়েছেন। যেমন নাকি তিনি শুরুতেই কথাগুলো এভাবেই বলেছেন। হ্যাঁ, আল্লাহ তা'আলা নিজের দিকে সম্পৃক্ত করে বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন মানুষকে আগ্রাহান্বিত ও উৎসাহিত করার উদ্দেশে। যেমন আল্লাহ তা'আলা এক আয়াতে বলেন:
﴿مَن ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللَّهَ ﴾ [البقرة: ٢٤٥]
কে আছে, যে আল্লাহকে ঋণ দেবে? (সূরা আল বাকারা: ২: ২৪৫)
অতএব উক্ত হাদীসটি তাবিলপন্থীদের বিরুদ্ধে একটি বড় প্রমাণ; কেননা তাবিলপন্থীরা আল্লাহ তা'আলার সিফাত সংবলিত বক্তব্যগুলোকে, কুরআন- সুন্নাহর কোনো প্রমাণ ব্যতীতই, বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে নেয়। তারা কিছু অমূলক যুক্তি দাঁড় করিয়ে তাহরীফ তথা অর্থবিকৃতির আশ্রয় নেয়। কেননা সেসব বক্তব্যের উদ্দেশ্য বাহ্যিকভাবে যা বুঝা যায় তা না হয়ে যদি অন্যকোনো উদ্দেশ্য হতো- অর্থাৎ তারা যেভাবে দাবি করে সেভাবে হতো- তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ তা'আলা অথবা তাঁর রাসূল তা বর্ণনা করতেন। যদি সেসব বক্তব্যের বাহ্যিক অর্থ আল্লাহর ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ হতো- যেমন তারা ধারণা করেছে-তবে নিশ্চয় আল্লাহ তা'আলা এবং তার রাসূল তা বর্ণনা করতেন যেভাবে উক্ত হাদীসে বর্ণনা করেছেন। যদি এসব বক্তব্যের বাহ্যিক অর্থ আল্লাহর জন্য উপযোগীভাবে নেওয়া আল্লাহর ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ হতো, তাহলে বলতে হবে যে, কুরআন ও সুন্নাহয় আল্লাহ তা'আলা এমন সব অগণিত গুণে নিজেকে গুনান্বিত করেছেন যা তাঁর ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ। আর এটি কখনো সম্ভব হতে পারে না।
উল্লিখিত উদাহরণগুলোর মাধ্যমেই আমার বক্তব্য শেষ করতে চাই এ আশায় যে তা অন্যান্য ক্ষেত্রে পথনির্দেশিকার কাজ করবে। অন্যথায়, এক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের নীতি সুস্পষ্ট। অর্থাৎ সিফাত-বিষয়ক আয়াত ও হাদীসসমূহকে তার বাহ্যিক অর্থেই বহন করা, কোনো বিকৃতিসাধন, বাতিলকরণ, ধরনধারণ নির্ণয়করণ এবং উদাহরণ নির্ণয়করণ ব্যতীতই।
সিফাত-বিষয়ক বক্তব্য সংক্রান্ত নীতিমালাসমূহে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সকল প্রশংসা আল্লাহ তা'আলার জন্য যিনি সৃষ্টিকুলের রব。
টিকাঃ
38 - মুসলিম, হাদীস নং ২৫৬৯।