📘 আল্লাহ তাআলার নান্দনিক নাম ও গুণসমগ্র > 📄 প্রথম মূলনীতি: নাম ও সিফাত প্রমাণের উৎস বা দলিল হলো মাত্র দুটি। একটি হলো আল্লাহর কিতাব আর অপরটি হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত

📄 প্রথম মূলনীতি: নাম ও সিফাত প্রমাণের উৎস বা দলিল হলো মাত্র দুটি। একটি হলো আল্লাহর কিতাব আর অপরটি হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত


প্রথম মূলনীতি: নাম ও সিফাত প্রমাণের উৎস বা দলিল হলো মাত্র দুটি। একটি হলো আল্লাহর কিতাব আর অপরটি হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত।
সুতরাং এ দুটির বাইরে অন্যকোনো দলিল দ্বারা আল্লাহর নাম ও সিফাত প্রমাণিত হবে না।
অতএব কুরআন-সুন্নাহর বক্তব্যের মাধ্যমে আল্লাহর জন্য যেসব নাম ও সিফাত প্রমাণিত হয়েছে তা আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা আবশ্যকীয়। আর কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা যা সাব্যস্ত হয়নি তা আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত না করা আবশ্যকীয়। পাশাপাশি যা সাব্যস্ত হয়নি তার বিপরীতে যে পূর্ণাঙ্গ গুণ রয়েছে তা সাব্যস্ত করা আবশ্যকীয়। আর যে বিষয়টি কুরআন সুন্নায় সাব্যস্তও হয়নি এবং অসাব্যস্তও হয়নি সে বিষয়টি নির্দেশকারী শব্দের ব্যাপারে হাঁ বা না কোনোটিই বলা যাবে না। বলা যাবে না যে এ শব্দটি আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত অথবা সাব্যস্ত নয়। অর্থাৎ কুরআন-সুন্নাহ যেহেতু এ জাতীয় শব্দের ব্যাপারে নীরব থেকেছে কাজেই আমাদেরও নীরব থাকতে হবে।
আর এ জাতীয় শব্দের অর্থের ব্যাপারে বলা যায় যে, তা যদি এমন হয় যা আল্লাহ তা'আলার জন্য উপযোগী তবে আল্লাহর জন্য ব্যবহার করা বৈধ। আর যদি এমন হয় যা আল্লাহর জন্য উপযোগী নয় তবে তা প্রত্যাখ্যান করা ওয়াজিব।
অতএব কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী যেসব সিফাত আল্লাহর জন্য প্রমাণিত তা হলো:
- প্রত্যেক ওই সিফাত যা আল্লাহ তা'আলার নামের সরাসরি নির্দেশনা হিসেবে প্রমাণিত অথবা এমন সিফাত যা আল্লাহ তা'আলার নামে সংবলিত রয়েছে অথবা এমন সিফাত যা আল্লাহ তা'আলার নামের দাবিগত অর্থ হিসেবে প্রমাণিত।
- আল্লাহ তা'আলার জন্য প্রমাণিত সিফাতসমূহের মধ্যে আরেক প্রকার হলো ওইসব সিফাত যা নির্দেশকারী হলো আল্লাহ তা'আলার কোনো ক্রিয়া। যেমন আরশের ওপরে ওঠা, নিম্নাকাশে অবতরণ করা,
কিয়ামতের দিন বান্দাদের মধ্যে ফয়সালার জন্য আসা এবং এ জাতীয় আরো অন্যান্য ক্রিয়া যা গুণে শেষ করা সম্ভব নয়; কেননা আল্লাহ তা'আলা যা ইচ্ছা তাই করেন। ইরশাদ হয়েছে:
وَيَفْعَلُ اللَّهُ مَا يَشَاءُ ) [ ابراهيم: ٢٧]
আর আল্লাহ তা'আলা তা করেন যা তিনি চান। (সূরা ইব্রাহীম: ১৪: ২৭)
- অনুরূপ প্রমাণিত সিফাতের মধ্যে আরও রয়েছে: চেহারা, দু'চোখ, দু'হাত ইত্যাদি।
- প্রমাণিত সিফাতের মধ্যে আরো আছে: কালাম বা কথা, ইচ্ছা এবং চাওয়া- হোক তা মহাবৈশ্বয়িক অথবা শরীয়ত-কেন্দ্রিক। তন্মধ্যে মহাবৈশ্বয়িক হচ্ছে তাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছা (যার সাথে তাঁর শরীয়তগত চাওয়া কিংবা ভালোবাসার সম্পর্ক নেই) আর দ্বিতীয় চাওয়াটি হচ্ছে শরীয়তগত এবং তার সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক রয়েছে।
- প্রমাণিত সিফাতের মধ্যে আরো শামিল রয়েছে; সন্তুষ্টি, মহব্বত, রাগ ও ঘৃণা ইত্যাদি।
আর যেসব সিফাত আল্লাহ তা'আলার জন্য সাব্যস্ত না হওয়া প্রমাণিত এবং এর বিপরীত পূর্ণাঙ্গ সিফাত আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত তা হলো:
- মৃত্যু, নিদ্রা, তন্দ্রা, অক্ষমতা, ক্লান্তি, যুলম, বান্দাদের আমল সম্পর্কে উদাসীনতা, আল্লাহ তা'আলার কোনো সমতুল্য বা সমকক্ষ থাকা ইত্যাদি।
আর যে সব গুণনির্দেশক শব্দ আল্লাহর জন্য সাব্যস্তও করা হয়নি এবং অসাব্যস্তও করা হয়নি, তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে:
- (الجهة) অর্থাৎ দিক। অতএব কেউ যদি প্রশ্ন করে বলে যে, আমরা কি আল্লাহর জন্য দিক শব্দটিকে সাব্যস্ত করব? এ প্রশ্নের উত্তরে বলব যে 'দিক' শব্দটি কুরআন-সুন্নায় আসেনি। হাঁ এবং না কোনোভাবেই আসেনি। অতএব 'দিক' শব্দের ক্ষেত্রে হাঁ ও না কোনোটিই সাব্যস্ত না করে এক্ষেত্রে এতটুকুই বলা যথেষ্ট যে আল্লাহ তা'আলা উপরে আছেন। আর 'দিক' শব্দটির যে অর্থ তার দ্বারা হয়ত নিম্নদিক বুঝানো হবে, অথবা এমন ঊর্ধ্বদিক বুঝানো হবে যা আল্লাহ তা'আলাকে পরিবেষ্টন করে আছে অথবা এমন ঊর্ধ্ব দিক বুঝানো হবে যা আল্লাহ তা'আলাকে পরিবেষ্টন করে নেই। তন্মধ্যে:
প্রথমটি অর্থাৎ নিম্নদিক আল্লাহ তা'আলার জন্য প্রযোজ্য নয়, তা বরং বাতিল; কেননা তা আল্লাহ তা'আলার ঊর্ধ্বতা, যা কুরআন-সুন্নাহ, যুক্তি, ফিতরত ও ইজমা দ্বারা প্রমাণিত, তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
দ্বিতীয়টি অর্থাৎ এমন ঊর্ধদিক যা আল্লাহ তা'আলাকে পরিবেষ্টনকারী, এটিও আল্লাহ তা'আলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, তা বরং বাতিল; কারণ কোনো সৃষ্টবস্তু দ্বারা আল্লাহ তা'আলা পরিবেষ্টিত থাকবেন তা থেকে তিনি পবিত্র ও মহান।
তৃতীয়টি অর্থাৎ এমন ঊর্ধ্বদিক যা আল্লাহ তা'আলাকে পরিবেষ্টন করে নেই। এটি আল্লাহ তা'আলার জন্য প্রযোজ্য এবং তা সত্য; কেননা আল্লাহ তা'আলা সকল সৃষ্টির ঊর্ধ্বে এবং সৃষ্টির কোনো কিছুই তাকে পরিবেষ্টন করতে পারে না।
এই মূলনীতির পক্ষে দলিল হলো ওহী ও যুক্তি:
• ওহী থেকে দলিল হলো আল্লাহ তা'আলার নিম্নোক্ত বাণীসমূহ: ﴿وَهَذَا كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ مُبَارَكٌ فَاتَّبِعُوهُ وَاتَّقُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ﴾ [الانعام: ١٥٥]
আর এটি কিতাব- যা আমি নাযিল করেছি- বরকতময়। সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ কর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও। (সূরা আল আনআম: ৬: ১৫৫)
﴿فَتَامِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ النَّبِيِّ الْأُمِّيِّ الَّذِي يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَكَلِمَاتِهِ وَاتَّبِعُوهُ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ ﴾ [الاعراف: ١٥٨]
সুতরাং তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আন ও তাঁর প্রেরিত উম্মী নবীর প্রতি, যে আল্লাহ ও তাঁর বাণীসমূহের প্রতি ঈমান রাখে। আর তোমরা তার অনুসরণ কর, আশা করা যায়, তোমরা হিদায়েত লাভ করবে। (সূরা আল আরাফ: ৭: ১৫৮)
وَمَا ءَاتَنكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا ﴾ [الحشر: ٧]
রাসূল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও এবং আল্লাহকেই ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি প্রদানে কঠোর। (সূরা আল হাশর: ৫৯: ৭)
مَّن يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهُ وَمَن تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا ﴾ [النساء : ٨٠]
যে রাসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যে বিমুখ হল, তবে আমি তোমাকে তাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক করে প্রেরণ করিনি। (সূরা আন নিসা:: ৪: ৮০)
فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا ﴾ [النساء: ٥٩]
অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ করাও- যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর। (সূরা আন নিসা: ৪: ৫৯)
﴿وَأَنِ احْكُم بَيْنَهُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ ﴾ [المائدة: ٤٩]
আর তাদের মধ্যে তার মাধ্যমে ফয়সালা কর, যা আল্লাহ নাযিল করেছেন এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। (সূরা আল মায়েদা: ৫: ৪৯)
এ ছাড়া আরো অন্যান্য আয়াত যা কুরআন-সুন্নাহর প্রতি ঈমান আনাকে ফরয হিসেবে সাব্যস্ত করে। আর প্রত্যেক ওই আয়াত যা কুরআনের প্রতি ঈমান আনাকে ফরয হিসেবে সাব্যস্ত করে তা সুন্নাহর মাধ্যমে যা কিছু এসেছে তার প্রতিও ঈমান আনাকে আবশ্যক বলে সাব্যস্ত করে; কেননা আল কুরআনে যেসব নির্দেশ এসেছে তন্মধ্যে একটি হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করা এবং বিতর্ক সৃষ্টি হলে তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সোপর্দ করা। সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সোপর্দ করা তাঁর জীবদ্দশায় এবং তাঁর সুন্নতের কাছে সোপর্দ করা তাঁর মৃত্যুর পর।
অতএব, যে ব্যক্তি আল কুরআনের প্রতি ঈমান রাখার দাবি করে অথচ আল কুরআনের নির্দেশ সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণের ব্যাপারে দম্ভ প্রদর্শন করে, সে কীভাবে আল কুরআনের প্রতি ঈমানের দাবিতে সত্যবাদী হতে পারে?
আল কুরআনে আল্লাহ তা'আলার নির্দেশ সত্ত্বেও যে ব্যক্তি বিতর্কিত বিষয় রাসূলুল্লাহর কাছে সোপর্দ করে না, সে আল কুরআনের প্রতি ঈমানের দাবিতে কীভাবে সত্যবাদী হতে পারে?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নায় যা কিছু এসেছে, তা গ্রহণ করার ব্যাপারে আল কুরআনে নির্দেশ আসা সত্ত্বেও যে তা গ্রহণ করে না, সে কীভাবে আল কুরআনের প্রতি ঈমানের দাবিতে সত্যবাদী হতে পারে?
অথচ আল্লাহ তা'আলা বলেছেন: وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَنَا لِكُلِّ شَيْءٍ [النحل: ٨٩]
আর আমরা তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছি প্রতিটি বিষয়ের স্পষ্ট বর্ণনাস্বরূপ। (সূরা আন্-নাহল:৮৯)
আর এটা স্পষ্ট যে ইসলামী শরীয়তের তথ্যগত ও প্রায়োগিক বহু বিষয়ের ব্যাখ্যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর মাধ্যমে এসেছে।
অতএব সুন্নাহর মাধ্যমে বর্ণিত হওয়া প্রকারান্তরে কুরআনের মাধ্যমেই বর্ণিত হওয়া।
যুক্তি: আল্লাহ তা'আলার জন্য কোনটি সাব্যস্ত করা ওয়াজিব, কোনটি সাব্যস্ত করা নিষিদ্ধ এবং কোনটি বৈধ, এ বিষয়গুলো গায়েবের আওতাভুক্ত। অর্থাৎ তা এমন বিষয় যা মানুষ তার বুদ্ধি-বিবেচনা দ্বারা নির্ণয় করতে পারে না। অতএব এ ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহর আশ্রয়ে যাওয়া ওয়াজিব।

📘 আল্লাহ তাআলার নান্দনিক নাম ও গুণসমগ্র > 📄 দ্বিতীয় মূলনীতি: কুরআন-সুন্নাহর শব্দসমূহকে বিকৃত না করে তার প্রকাশ্য অর্থে ব্যবহার করা ওয়াজিব, বিশেষ করে আল্লাহ তা'আলার সিফাত কেন্দ্রিক শব্দমালা; কেননা এ ক্ষেত্রে মানববুদ্ধির কোনো স্থান নেই

📄 দ্বিতীয় মূলনীতি: কুরআন-সুন্নাহর শব্দসমূহকে বিকৃত না করে তার প্রকাশ্য অর্থে ব্যবহার করা ওয়াজিব, বিশেষ করে আল্লাহ তা'আলার সিফাত কেন্দ্রিক শব্দমালা; কেননা এ ক্ষেত্রে মানববুদ্ধির কোনো স্থান নেই


দ্বিতীয় মূলনীতি: কুরআন-সুন্নাহর শব্দসমূহকে বিকৃত না করে তার প্রকাশ্য অর্থে ব্যবহার করা ওয়াজিব, বিশেষ করে আল্লাহ তা'আলার সিফাত কেন্দ্রিক শব্দমালা; কেননা এ ক্ষেত্রে মানববুদ্ধির কোনো স্থান নেই।
এর দলিল ওহী ও যুক্তি।
ওহী থেকে দলিল:
আল্লাহ তা'আলার নিম্নোক্ত বাণীসমূহ ওহী-কেন্দ্রিক দলিল: ﴿نَزَلَ بِهِ الرُّوحُ الْأَمِينُ عَلَى قَلْبِكَ لِتَكُونَ مِنَ الْمُنذِرِينَ * بِلِسَانٍ عَرَبِي مُّبِينٍ ﴾ [الشعراء: ١٩٣، ١٩٥]
বিশ্বস্ত আত্মা¹⁴ এটা নিয়ে অবতরণ করেছে। তোমার হৃদয়ে, যাতে তুমি সতর্ককারীদের অন্তর্ভুক্ত হও। (সূরা আশশু'আরা: ২৬: ১৯৩-১৯৪)
অন্য আয়াতে আছে: إِنَّا أَنزَلْنَاهُ قُرْءَانًا عَرَبِيًّا لَّعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ ﴾ [يوسف: ٢]
নিশ্চয় আমি একে আরবী কুরআনরূপে নাযিল করেছি যাতে তোমরা বুঝতে পার। (সূরা ইউসুফ: ১২:২)
আর একটি আয়াতে আল্লাহ বলেন: ﴿إِنَّا جَعَلْنَاهُ قُرْءَانًا عَرَبِيًّا لَّعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ ﴾ [الزخرف: ٣]
নিশ্চয় আমি তো একে আরবী কুরআন বানিয়েছি, যাতে তোমরা বুঝতে পার। (সূরা আয্যুখরুফ: ৪৩: ৩)
এ আয়াতগুলোর বক্তব্য অনুযায়ী আরবী ভাষার শব্দমালা যে প্রকাশ্য অর্থসমূহ দাবি করে সে অনুযায়ী আল কুরআনকে বুঝতে হবে। যদি না কোনো শরঈ দলিল ভিন্ন অর্থ নেওয়াকে নির্দেশ করে।
ইহুদী সম্প্রদায় বিকৃতি সাধনের আশ্রয় নিয়েছিল, যে কারণে তারা আল্লাহ তা'আলার ভৎর্সনার পাত্র হয়েছিল এবং তারা যে এ বিকৃতিকরণের দ্বারা ঈমান থেকে বহু দূরে চলে গিয়েছিল তাও আল্লাহ তা'আলা স্পষ্টভাবে বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে:
﴿ أَفَتَطْمَعُونَ أَنْ يُؤْمِنُوا لَكُمْ وَقَدْ كَانَ فَرِيقٌ مِنْهُمْ يَسْمَعُونَ كَلَامَ اللَّهِ ثُمَّ يُحَرِّفُونَهُ مِنْ بَعْدِ مَا عَقَلُوهُ وَهُمْ يَعْلَمُونَ ﴾ [البقرة: ٧٥]
তোমরা যারা বিশ্বাসী কি এই আশা করছ যে, তারা তোমাদের প্রতি ঈমান আনবে? অথচ তাদের একটি দল ছিল যারা আল্লাহর বাণী শুনত অতঃপর তা বুঝে নেয়ার পর তা তারা বিকৃত করত জেনে বুঝে। (সূরা আল বাকারা: ২: ৭৫)
অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে:
﴿ مِنَ الَّذِينَ هَادُوا يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ عَنْ مَوَاضِعِهِ، وَيَقُولُونَ سَمِعْنَا وَعَصَيْنَا ﴾ [النساء: ٤٦]
ইয়াহুদীদের মধ্যে কিছু লোক আছে যারা কালামসমূহকে তার স্থান থেকে পরিবর্তন করে ফেলে এবং বলে, 'আমরা শুনলাম ও অমান্য করলাম'। (সূরা আন-নিসা: ৪: ৪৬)
যুক্তি: আল কুরআনের বাণীসমূহ যার পক্ষ থেকে এসেছে, অন্যদের তুলনায় তিনিই এর অর্থ অধিক বোঝেন। আর তিনি স্পষ্ট আরবী ভাষায় এ বাণীগুলো পাঠিয়েছেন। অতএব তা প্রকাশ্য অর্থে গ্রহণ করা ওয়াজিব বলে বিবেচিত হবে। অন্যথায় ভিন্ন ভিন্ন অভিমতের অনুপ্রবেশ ঘটবে, ফলে উম্মত বিভক্ত হয়ে পড়বে।

টিকাঃ
¹⁴ এখানে 'বিশ্বস্ত আত্মা' দ্বারা জিবরীল (আঃ) কে বুঝানো হয়েছে।

📘 আল্লাহ তাআলার নান্দনিক নাম ও গুণসমগ্র > 📄 তৃতীয় মূলনীতি: সিফাত সম্বলিত বাণীসমূহের প্রকাশ্য অর্থ এক হিসেবে আমাদের জানা আর অন্য হিসেবে আমাদের জন্য অজ্ঞাত

📄 তৃতীয় মূলনীতি: সিফাত সম্বলিত বাণীসমূহের প্রকাশ্য অর্থ এক হিসেবে আমাদের জানা আর অন্য হিসেবে আমাদের জন্য অজ্ঞাত


তৃতীয় মূলনীতি: সিফাত সংবলিত বাণীসমূহের প্রকাশ্য অর্থ এক হিসেবে আমাদের জানা আর অন্য হিসেবে আমাদের জন্য তা অজ্ঞাত।
এ বাণীসমূহের প্রকাশ্য অর্থ কি তা আমাদের জ্ঞাত, কিন্তু এ অর্থের 'কাইফিয়াত' তথা আকার-প্রকৃতি বা ধরণ কি তা আমাদের অজ্ঞাত।
এ কথার পক্ষে দলিল হলো ওহী ও যুক্তি।
ওহী থেকে দলিল: আল্লাহ তা'আলার নিম্নোক্ত বাণীসমূহ এ ক্ষেত্রে ওহী-কেন্দ্রিক দলিল:
كِتَابٌ أَنزَلْنَهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِّيَدَّبَّرُواْ ءَايَتِهِ، وَلِيَتَذَكَّرَ أُوْلُواْ الْأَلْبَبِ ﴾ [ص:
[২৯
আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বুদ্ধিমানগণ উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা সাদ: ৩৮: ২৯)
অন্য এক আয়াতে এসেছে:
إِنَّا جَعَلْنَهُ قُرْءَانًا عَرَبِيًّا لَّعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ ﴾ [الزخرف: ৩]
নিশ্চয় আমি তো একে আরবী কুরআন বানিয়েছি, যাতে তোমরা বুঝতে পার। (সূরা আয্‌যুখরুফ: ৪৩: ৩)
আরো ইরশাদ হচ্ছে:
وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ ﴾ [النحل:
[৪৪
এবং তোমার প্রতি নাযিল করেছি কুরআন, যাতে তুমি মানুষের জন্য স্পষ্ট করে দিতে পার, যা তাদের প্রতি নাযিল হয়েছে। আর যাতে তারা চিন্তা করে। (সূরা আন্‌-নাহল: ১৬: ৪৪)
আর চিন্তা-গবেষণা তো সেটাতেই চলে যাতে চিন্তা করলে তা বুঝে তা থেকে অন্যকে বুঝানো সম্ভব হয়।
আর কুরআন আরবী ভাষায় নাযিল হওয়ার অর্থ তো যারা আরবী ভাষা জানে তারা যেন তা যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারে; এটা প্রমাণ করে যে এর অর্থ আমাদের জানা, নতুবা আরবী ভাষা ও অন্য ভাষায় নাযিল করার মধ্যে পার্থক্য হতো না।
আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক মানুষের জন্য কুরআনের বর্ণনা সেটা তার শব্দ ও অর্থ উভয়কেই যথাযথভাবে শামিল করে।
যুক্তি: এটা অসম্ভব যে আল্লাহ তা'আলা এমন কিতাব নাযিল করবেন এবং তাঁর রাসূলের কাছে এমন কথা পাঠাবেন যার উদ্দেশ্য হবে মানুষের হিদায়েত অথচ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে তা থাকবে অজ্ঞাত অর্থবোধক অথবা এমন খন্ডাক্ষরের ন্যায় যা থেকে কোনো কিছুই বোঝা যায় না। এরূপ হলে তা হবে আল্লাহ তা'আলার হিকমতবিরুদ্ধ। আর তাইতো আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন:
﴿ الرَّكِتَابٌ أُحْكِمَتْ عَايَتُهُ ثُمَّ فُصِّلَتْ مِن لَّدُنْ حَكِيمٍ خَبِيرٍ ﴾ [هود: ١]
এটি কিতাব যার আয়াতসমূহ সুস্থিত করা হয়েছে, অতঃপর বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে প্রজ্ঞাময়, সবিশেষ অবহিত সত্ত্বার পক্ষ থেকে। (সূরা হুদ: ১১: ১)
সিফাত-বিষয়ক কুরআন ও হাদীসের ভাষ্যসমূহের বাহ্যিক অর্থ যে আমাদের জানা, তার পক্ষে ওহী ও যুক্তিভিত্তিক দলিল ওপরে পেশ করা হলো।
আর আমরা যে সিফাত-বিষয়ক কুরআন ও সুন্নাহর ভাষ্যসমূহের বাহ্যিক অর্থ জানা সত্ত্বেও তার বাস্তব আকার-প্রকৃতি বা ধরণ কি সে ব্যাপারে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই এ কথার পক্ষে ওহী ও যুক্তিভিত্তিক দলিল সিফাত-বিষয়ক ষষ্ঠ মূলনীতিতে উল্লিখিত হয়েছে।
এর দ্বারা বুঝা গেল যে 'মুফাউয়েযা' সম্প্রদায় যা বলে তা বাতিল। মুফাউয়েযা সম্প্রদায় হলো তারা যারা সিফাত-বিষয়ক কুরআন ও হাদীসের ভাষ্যসমূহের অর্থ আল্লাহর ইলমের কাছে সোপর্দ করেন। অর্থাৎ তারা বলেন, এসবের বাহ্যিক অর্থ আমাদের জানা নেই, বরং একমাত্র আল্লাহ তা'আলাই এসবের অর্থ সম্পর্কে ইলম রাখেন। তারা দাবি করেন যে এটাই হলো সালাফে সালেহীনদের মাযহাব। অথচ সালাফগণ এ জাতীয় চিন্তাধারা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন। সালাফদের থেকে বরং অকাট্য বর্ণনা পরম্পরায় এসব টেক্সট বা ভাষ্যের অর্থ সাব্যস্ত করার কথা এসেছে। কখনো এজমালি অর্থ আবার কখনো বিস্তারিত অর্থ। তবে এ অর্থের বাস্তব আকার-প্রকৃতি কি, তা তারা আল্লাহ তা'আলার ইলমের কাছে সমর্পণ করেছেন। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ র, তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব 'আকল ও নকল' এর প্রথম খন্ডের ১১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় বলেন: 'আর তাফওয়ীয (অর্থাৎ আল্লাহর ইলমের কাছে সমর্পণ করা) এর ব্যাপারে বলব, এটা স্পষ্ট যে আল্লাহ তা'আলা কুরআনের আয়াতসমূহে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা, বুঝা ও তার অর্থোদ্ধারের জন্য আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব আল কুরআন বুঝা, আল কুরআন জানা এবং তার অর্থোদ্ধার করা থেকে বিমুখ হওয়া কীভাবে কাম্য হতে পারে? এরপর তিনি ১১৮ নং পৃষ্ঠায় বলেন: 'কথা যদি এ রকমই হত, তাহলে বলতে হবে যে, আল্লাহ তা'আলা আল কুরআনে নিজের সিফাত সম্পর্কে যা যা বলেছেন, অথবা এ ব্যাপারে অধিকাংশ বিষয় যা তিনি বলেছেন, তার অর্থ নবীগণও বুঝতেন না। বরং তারা এমন কথা বলতেন যার অর্থ তাদের কাছে বোধগম্য ছিল না। বলাবাহুল্য যে এটা আল কুরআন এবং নবীগণ উভয়কেই দোষারোপ করা; কারণ আল্লাহ তা'আলা কুরআন নাযিল করেছেন এবং তিনি সংবাদ দিয়েছেন যে তা তিনি হিদায়েত ও মানুষের জন্য বর্ণনাস্বরূপ নাযিল করেছেন। এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি যেন তা স্পষ্টাকারে পৌঁছিয়ে দেন। তিনি যেন মানুষের জন্য স্পষ্টরূপে বয়ান করে দেন তাদের ওপর কি নাযিল করা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা আল কুরআনে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করতে বলেছেন, তিনি তা বুঝতে বলেছেন। এর পাশাপাশি আল কুরআনের সর্বোত্তম বিষয় হলো রাব্বুল আলামীন তাঁর সিফাত বিষয়ক যে বাণীগুলো নাযিল করেছেন। অতএব এটা কীভাবে বলা শুদ্ধ হতে পারে যে, এসবের অর্থ কেউ জানে না, এসব বোধগম্য নয়। এটা কি হতে পারে যে মানুষের জন্য যা নাযিল হয়েছে তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছে স্পষ্টভাবে পৌঁছাননি? অথচ এই ধারণার ওপর নির্ভর করেই প্রত্যেক মুলহিদ ও বিদআতপন্থী বলে যে, প্রকৃত সত্য হলো তা যার ইলম আমি নিজ মত ও বুদ্ধির মাধ্যমে পেয়েছি, আর কুরআন-সুন্নাহর টেক্সট বা ভাষ্যে আমার মতের বিপরীত কিছু নেই; কেননা ওইসব টেক্সট বা ভাষ্য দুর্বোধ্য, মুতাশাবিহ, কেউ তার অর্থ বোঝে না। আর যার অর্থ কেউ জানে না তা দ্বারা দলিল দেওয়া শুদ্ধ নয়। এ জাতীয় কথার অর্থ হলো নবীগণের পক্ষ থেকে যে হিদায়েত এসেছে তার দরজা বন্ধ করে দেওয়া এবং যারা তাদের বিরোধী তাদের দরজা উন্মুক্ত করা। এরূপ ব্যক্তি প্রকারান্তরে বলে যে হিদায়েত ও বয়ান আমাদের পথে, নবীগণের পথে নয়; কেননা আমরা যা বলি তার অর্থ আমরা জানি এবং মানুষের জন্য তা যুক্তিভিত্তিক দলিল দ্বারা বয়ান করি। আর নবীগণ যা বলতেন তার অর্থ তারা বুঝতেন না, অতএব মানুষের জন্য তা বয়ান করার তো প্রশ্নই আসে না।
এ আলোচনার দ্বারা বুঝা গেল যে আহলে তাফউয়ীয তথা এগুলো বাহ্যিক অর্থ আল্লাহর কাছে সমর্পণকারী সম্প্রদায়, যারা সুন্নাতের অনুসারী এবং সালাফদের অনুসারী হিসেবে নিজেদের মনে করে, তাদের কথা ইলহাদ ও বিদআতপন্থীদের সকল কথার চেয়ে জঘন্য কথা।'
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ র. এর কথা এখানেই শেষ। তিনি সঠিক কথা বলেছেন যা পরিপক্ক চিন্তা থেকে উঠে এসেছে। এ কথার পর এ ব্যাপারে অতিরিক্ত আর কিছু বলার থাকে না। আল্লাহ তা'আলা তাঁর ওপর অঢেল রহমত বর্ষণ করুন এবং জান্নাতে আমাদেরকে তাঁর সঙ্গে একত্র করুন।

📘 আল্লাহ তাআলার নান্দনিক নাম ও গুণসমগ্র > 📄 চতুর্থ মূলনীতি: কুরআন ও সুন্নাহর টেক্সট বা ভাষ্যসমূহের বাহ্যিক অর্থ যা টেক্সট বা ভাষ্যসমূহ সামনে আসার পর তৎক্ষণাৎ মাথায় আসে। এ বাহ্যিক অর্থ কনটেক্সট বা বাক্যের পূর্বাপর সম্পর্ক অনুযায়ী এবং এর সাথে সম্পৃক্ত কথা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে

📄 চতুর্থ মূলনীতি: কুরআন ও সুন্নাহর টেক্সট বা ভাষ্যসমূহের বাহ্যিক অর্থ যা টেক্সট বা ভাষ্যসমূহ সামনে আসার পর তৎক্ষণাৎ মাথায় আসে। এ বাহ্যিক অর্থ কনটেক্সট বা বাক্যের পূর্বাপর সম্পর্ক অনুযায়ী এবং এর সাথে সম্পৃক্ত কথা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে


চতুর্থ মূলনীতি: কুরআন ও সুন্নাহর টেক্সট বা ভাষ্যসমূহের বাহ্যিক অর্থ তা-ই যা টেক্সট বা ভাষ্যসমূহ সামনে আসার পর তৎক্ষণাৎ মাথায় আসে। এ বাহ্যিক অর্থ কনটেক্সট বা বাক্যের পূর্বাপর সম্পর্ক অনুযায়ী এবং এর সাথে সম্পৃক্ত কথা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।
একই শব্দ এক কনটেক্সট-এ এক অর্থ দেয় আবার অন্য কনটেক্সট-এ অন্য অর্থ দেয়। শব্দমালার গাঁথুনি একভাবে হলে তার অর্থ হয় এক ধরনের আবার অন্যভাবে হলে তার অর্থ হয় অন্যধরনের।
যেমন আরবী القرية (আল কারইয়াহ) শব্দটির অর্থ কখনো হয় জাতি, আবার কখনো হয় বাড়িঘর যেখানে কোনো জাতির লোকেরা বসবাস করে।
প্রথম অর্থের উদাহরণ: আল্লাহ তা'আলার বাণী:
وَإِن مِّن قَرْيَةٍ إِلَّا نَحْنُ مُهْلِكُوهَا قَبْلَ يَوْمِ الْقِيَامَةِ أَوْ مُعَذِّبُوهَا عَذَابًا شَدِيدًا [الاسراء: ٥٨]
আর এমন কোনো জনপদ নেই, যা আমি কিয়ামতের দিনের পূর্বে ধ্বংস করব না অথবা যাকে কঠোর আযাব দেব না। (সূরা আল ইসরা: ১৭: ৫৮)
দ্বিতীয় অর্থের উদাহরণ আল্লাহ তা'আলার বাণী, যা ইবরাহীমের মেহমান ফিরিশতাগণ বলেছিলেন:
إِنَّا مُهْلِكُوا أَهْلِ هَذِهِ الْقَرْيَةِ [العنكبوت: ٣١]
নিশ্চয় আমরা এ জনপদের অধিবাসীদের ধ্বংস করব। (সূরা আল আনকাবুত: ২৯: ৩১)
আরেকটি উদাহরণ: আপনি হয়তো বলবেন যে, 'আমি এ জিনিসটি আমার দু'হাত দিয়ে বানিয়েছি।' এখানে আপনার দু'হাত এবং আল্লাহ তা'আলার নিম্নোক্ত বাণীতে উল্লিখিত দু'হাতের মধ্যে আদৌ কোনো সাদৃশ্য নেই। বাণীটি হলো এই:
﴿لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَى﴾ [ص: ٧٥]
আমার দু'হাতে আমি যাকে সৃষ্টি করেছি। (সূরা সাদ: ৩৮: ৭৫)
আপনি যে বাক্যটি বলেছেন সেখানে 'দু'হাত'কে সৃষ্টিজীব মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব এখানে হাত বলতে তাই বুঝাবে যা সৃষ্টিজীবের জন্য উপযোগী। আর আল কুরআনের আয়াতে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দু'হাতকে উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব তা হবে এমন হাত যা সৃষ্টিকর্তার জন্য উপযোগী। সুতরাং স্বচ্ছ প্রকৃতি ও সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন কোনো ব্যক্তিই এটা বলতে পারে না যে সৃষ্টিকর্তার হাত সৃষ্টিজীবের হাতের মতো অথবা এর উল্টো।
আরেকটি উদাহরণ এই যে, আপনি যদি বলেন: 'আপনার কাছে তো শুধু যায়েদ।' এবং 'যায়েদ তো শুধু আপনার কাছে।' তাহলে উভয় বাক্যের শব্দমালা অভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও অর্থের দিক থেকে আলাদা। প্রথম বাক্যের অর্থ হলো যে আপনার কাছে যায়েদ ছাড়া অন্যকোনো মানুষ নেই। আর দ্বিতীয় বাক্যের অর্থ হলো, যায়েদ কোথাও নেই তবে আপনার কাছে। যায়েদের সঙ্গে আপনার কাছে অন্যান্য লোকজনও থাকতে পারে। অতএব শব্দের গঠন-কাঠামোর কারণে অর্থের ভিন্নতা আসে এ বিষয়টি স্পষ্ট।
এ আলোচনার পর বলব যে, সিফাত-কেন্দ্রিক টেক্সট বা ভাষ্যসমূহের বাহ্যিক অর্থ তাই যা এ টেক্সট বা ভাষ্যগুলো দেখামাত্র মস্তিষ্কে আসে। আর এ ক্ষেত্রে মানুষ তিন দলে বিভক্ত হয়েছে:
প্রথম দল: এ টেক্সট বা ভাষ্যগুলো থেকে যে বাহ্যিক অর্থ বুঝা যায় সে অর্থকেই আল্লাহর জন্য উপযুক্ত পদ্ধতিতে আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করেছে এবং এ টেক্সটগুলোর অর্থনির্দেশ এখানেই সীমিত রেখেছে। এই দলটি হলো সালাফে সালেহীনদের দল; যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ যার ওপর ছিলেন তার ওপর একত্র হয়েছেন। যারা প্রকৃত অর্থে আহলে সুন্নত ওয়াল জামা'আত খেতাবে ভূষিত এবং এ খেতাবটি কেবল তাদের জন্যই।
তাঁরা উল্লিখিত বক্তব্যের ওপর ঐকমত্য পোষণ করেছেন। যেমন ইবনে আবদিল বার র. বলেন, 'আহলে সুন্নাত আল কুরআন ও সুন্নায় যেসব সিফাত উল্লিখিত হয়েছে তা স্বীকার করে নেওয়া ও তার ওপর ঈমান আনার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তারা উক্ত সিফাতগুলোকে রূপক অর্থে নয় বরং প্রকৃত অর্থে বহন করার ব্যাপারেও একমত হয়েছেন। তবে তারা কোনো অর্থেরই আকার-প্রকৃতি নির্ধারণ করেন না।
কাজী আবু ইয়া'লা তার কিতাব 'ইবতালুত তাবিল' এ উল্লেখ করেন, 'এই সংবাদগুলো [অর্থাৎ সিফাত-বিষয়ক টেক্সটগুলো] প্রত্যাখ্যান করা বৈধ নয়। এ ব্যাপারে তাবিল প্রক্রিয়ায় মশগুল হওয়াও বৈধ নয়। বরং এ টেক্সটগুলোকে তার বাহ্যিক অর্থে বহন করা ওয়াজিব এবং এটাও বিশ্বাস করা ওয়াজিব যে তা আল্লাহ তা'আলার সিফাত; যা সৃষ্টিবস্তুর সিফাততুল্য নয়। আর এ ক্ষেত্রে 'তাশবীহ'তেও বিশ্বাস করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে ইমাম আহমদ র. ও অন্যান্য ইমামগণ যেভাবে বলেছেন সেভাবেই বিশ্বাস করতে হবে। [ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ ইবনে আবদুল বার ও কাজী আবু ইয়ালা থেকে উক্ত বক্তব্য তার 'আল ফাতওয়া আল হামুবিয়া'-এ উল্লেখ করেছেন। (দ্র: মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৮৭-৮৯)
এটাই হলো বিশুদ্ধ মাযহাব এবং প্রজ্ঞাপূর্ণ সোজা পথ। আর তা দু'কারণে:
প্রথম কারণ: আল্লাহ তা'আলার নাম ও সিফাত সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহয় যা এসেছে তার যথার্থ ও পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন এ পথেই সম্ভব। বস্তুনিষ্ঠ ও ইনসাফপূর্ণভাবে যে ব্যক্তি কুরআন-সুন্নায় এ বিষয়ে তথ্য অনুসন্ধান করবে তার সামনে এ বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্টাকারে ধরা পড়বে।
দ্বিতীয় কারণ: আমরা হয়তো বলব যে, সালাফগণ যা বলেছেন তাই হক ও সত্য অথবা বলব যে সালাফগণ ছাড়া অন্যান্যরা যা বলেছেন তা সত্য। বলার অপেক্ষা রাখে না যে দ্বিতীয় কথাটি বাতিল। কেননা দ্বিতীয় কথাটিকে বাতিল না বললে এর যুক্তিগত দাবি এটা দাঁড়ায় যে, সালাফগণ অর্থাৎ সাহাবী ও তাবে'ঈগণ সরাসরি অথবা বাহ্যিকভাবে বাতিল কথা বলেছেন এবং একবারের জন্যও তারা সরাসরি ও বাহ্যিকভাবে যা বিশ্বাস করা ওয়াজিব এমন হক কথা বলেননি। এর অর্থ দাঁড়ায়, সালাফগণ হয়তো সত্য সম্পর্কে জাহেল ছিলেন অথবা সত্য তাদের জানা ছিল কিন্তু তারা তা গোপন করেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে সালাফগণ উভয় বিষয় থেকেই পবিত্র ছিলেন। অতএব সত্য যে কেবল সালাফগণের সঙ্গেই এতে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকল না।
দ্বিতীয় দল: যারা সিফাত-বিষয়ক টেক্সটসমূহের বাহ্যিক অর্থকে বাতিল করে দিয়েছেন এই ভেবে যে তা আল্লাহর জন্য উপযোগী নয়। আর এটাই হলো তাশবীহ তথা সাদৃশ্যকরণ। তারা তাশবীহনির্ভর অর্থকেই বহাল রেখেছেন। এ দলটিই হলো মুশাব্বিহাদের দল। এদের মতামত কয়েক কারণে বাতিল ও হারাম:
প্রথমত: এটা সিফাত-বিষয়ক টেক্সটসমূহের বিরুদ্ধে অন্যায় এবং তার যে অর্থ রয়েছে সেটাকে নাকচ করে দেওয়া। এটা কি করে বলা সঙ্গত যে এ টেক্সটসমূহকে বাহ্যিক অর্থের ওপর বহন করলে তা তাশবীহ হয়ে যায়, অথচ আল্লাহ তা'আলা বলেছেন:
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ [الشورى: ۱۱]
তাঁর মত কিছু নেই। (সূরা আশ-শূরা: ৪২: ১১)
অর্থাৎ যারা এ টেক্সটসমূহের বাহ্যিক অর্থ বাতিল করে দেন তারা এই মনে করে বাতিল করে দেন যে বাহ্যিক অর্থগুলো সৃষ্টিজীবের সিফাতের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। তাদের এ ধারণাটিই হলো মূলত তাশবীহ; কেননা আল্লাহর সিফাতের সঙ্গে সৃষ্টিজীবের সিফাতের আদৌ কোনো তুলনা হয় না। তারাই বরং এ ধরণের অযাচিত তুলনার আশ্রয় নেয়।
দ্বিতীয়ত: আকল-বুদ্ধি দ্বারা এটি স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে সৃষ্টিকর্তা সত্তাগত এবং গুণগতভাবে সর্বদিক থেকেই সৃষ্টিজীব হতে সম্পূর্ণ আলাদা। অতএব সৃষ্টিকর্তার সিফাত সৃষ্টিজীবের সিফাতের সমতুল্য হবে এটা কিভাবে কল্পনা করা যায়?
তৃতীয়ত: মুশাব্বিহ বা 'সাদৃশ্য স্থাপনকারী ব্যক্তি' সিফাত-বিষয়ক টেক্সটসমূহ থেকে যা বুঝেছে তা সালাফ তথা উত্তম পূর্বপুরুষদের বুঝ থেকে ভিন্ন। অতএব তা বাতিল।
[একটি সন্দেহ ও তার উত্তর]
আর যদি মুশাব্বিহ তথা সাদৃশ্যস্থাপনকারী ব্যক্তি বলে: আমি আল্লাহ তা'আলার অবতরণ, আল্লাহ তা'আলার হাত ইত্যাদির দ্বারা তা-ই বুঝি যা সৃষ্টিজীবের রয়েছে; কেননা আল্লাহ তা'আলা আমাদের বোধগম্য ভাষাতেই তাঁর বাণী পাঠিয়েছেন, তবে এর উত্তর তিনভাবে দেওয়া যায়:
প্রথমত: যিনি বাণী পাঠিয়েছেন স্বয়ং তিনিই নিজ সম্পর্কে বলেছেন: لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ [الشورى: ۱۱]
তাঁর মত কিছু নেই। (সূরা আশ-শুরা: ৪২: ১১)
অন্যত্র বলেছেন: فَلَا تَضْرِبُوا لِلَّهِ الْأَمْثَالَ إِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ ﴾ [النحل: ٧٤]
সুতরাং তোমরা আল্লাহর জন্য অন্যকোন দৃষ্টান্ত স্থাপন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ জানেন আর তোমরা জান না। (সূরা আন্-নাহল: ১৬: ৭৪)
তিনি অন্য এক আয়াতে বলেন: فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَندَادًا وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ ﴾ [البقرة: ٢٢]
সুতরাং তোমরা জেনে-বুঝে আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করো না। (সূরা আল বাকারা: ২: ২২)
আর আল্লাহ তা'আলার সকল কথাই সত্য এবং একটি অন্যটিকে সমর্থন করে। অতএব এ ক্ষেত্রে কোনো বৈপরিত্ব নেই।
দ্বিতীয়ত: সাদৃশ্যস্থাপনকারী ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলা হবে: তুমি কি বুঝতে পার না যে আল্লাহ তা'আলার একটি সত্তা রয়েছে যা অন্যান্য সত্তার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়? উত্তরে সে বলবে, হ্যাঁ, বুঝতে পারি। এবার তাকে বলা হবে, তাহলে তুমি এটা কেন বুঝবে না যে আল্লাহ তা'আলার সিফাত রয়েছে যা অন্যসব সিফাত থেকে ভিন্ন। কারণ সত্তার ব্যাপারে যা প্রযোজ্য তা সিফাতেরও ব্যাপারেও প্রযোজ্য। আর যে ব্যক্তি সত্তা ও সিফাতের মধ্যে পার্থক্য করল সে বৈপরীত্যের আশ্রয় নিল।
তৃতীয়ত: সাদৃশ্যস্থাপনকারী ব্যক্তিকে বলা হবে, তুমি কি দেখ না যে মাখলুকাতের মধ্যে এমন অনেক কিছু আছে যার নাম অভিন্ন কিন্তু প্রকৃতি ও আকার-ধরনের বিবেচনায় একটি অন্যটি থেকে ভিন্ন? সে বলবে, হ্যাঁ দেখি। এরপর তাকে বলা হবে যদি তুমি মাখলুকাতের মধ্যে এ পার্থক্য মেনে নাও, তবে খালিক ও মাখলুকের মধ্যে পার্থক্য কেন মেনে নাও না। অথচ খালিক ও মাখলুকের মধ্যে পার্থক্যের বিষয়টি খুবই স্পষ্ট। বরং খালিক ও মাখলুকের মধ্যে সাদৃশতা একটি অসম্ভব ব্যাপার। সিফাত-বিষয়ক ষষ্ঠ মূলনীতিতে এ বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে।
তৃতীয় দল: যারা বলে যে সিফাত-বিষয়ক টেক্সটসমূহের বাহ্যিক অর্থ বাতিল এবং তা আল্লাহর জন্য উপযোগী নয়। বরং তা হলো তাশবীহ বা সাদৃশ্য স্থাপন। এরপর তারা বাহ্যিক অর্থকে আল্লাহর জন্য উপযোগী পদ্ধতিতে মেনে নেয়াকেও অস্বীকার করেন। এরা হলো আহলে তা'তীল অর্থাৎ অর্থশূণ্যকারী সম্প্রদায়। তাদের এই অর্থশূণ্যকরণ প্রক্রিয়া নাম ও সিফাত উভয় ক্ষেত্রেই অথবা শুধু সিফাতের ক্ষেত্রে অথবা নাম ও সিফাত এ দুয়ের মধ্যে যেকোনো একটির ক্ষেত্রে সেটা তারা করে থাকে। তারা নাম ও সিফাত সংবলিত এ টেক্সটসমূহের বাহ্যিক অর্থ থেকে সরে এসে নিজেদের বুদ্ধি-বিবেচনা অনুযায়ী সেগুলোর অর্থ নির্ধারণ করেছে। তবে তারা এ অর্থ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিক্ষিপ্ত পথ অবলম্বন করেছে। তারা এটার নাম দিয়েছে তা'বিল বা ব্যাখ্যা, কিন্তু আসলে তা তাহরীফ বা বিকৃতি।
তাদের এ মতামত কয়েক কারণে বাতিল:
প্রথমত: এটা আল্লাহ ও তার রাসূলের বাণীর বিপক্ষে স্পর্ধা প্রদর্শন; কারণ তারা আল্লাহ এবং তার রাসূলের বাণীর এমন অর্থ করেছে যা বাতিল এবং আল্লাহর জন্য অনুপযোগী, বরং আল্লাহর উদ্দেশের বিরুদ্ধে।
দ্বিতীয়ত: এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথাকে তার বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, অথচ আল্লাহ তা'আলা মানুষকে স্পষ্ট আরবী ভাষায় খেতাব করেছেন। যাতে মানুষ আল্লাহর কালামকে আরবী ভাষার দাবি অনুযায়ী বুঝতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় কথা বলেছেন; অতএব আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণীকে আরবী ভাষার বাহ্যিক অর্থ ও দাবি অনুযায়ী বুঝতে হবে। তবে আল্লাহর (সত্ত্বা, নাম ও গুণের) ক্ষেত্রে সে অর্থের আকার-প্রকৃতি, ধরণ ও তুলনা নির্ধারণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
তৃতীয়ত: আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথাকে বাহ্যিক অর্থে না নিয়ে এমন অর্থে নেওয়া যা বাহ্যিক অর্থের বিপরীত, নিশ্চয় একটি হারাম কাজ এবং অজ্ঞতাবশত আল্লাহর ব্যাপারে এমন কথা বলা যা তিনি বলেন নি। বিষয়টি যে হারাম তা নিম্নোক্ত আয়াত থেকে বুঝা যায়:
﴿ قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَن تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَن تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ ﴾ [الاعراف: 33]
বল, 'আমার রব তো হারাম করেছেন অশ্লীল কাজ- যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে, আর পাপ ও অন্যায়ভাবে সীমালঙ্ঘন এবং আল্লাহর সাথে তোমাদের শরীফ করা, যে ব্যাপারে আল্লাহ কোনো প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর উপরে এমন কিছু বলা যা তোমরা জান না'। (সূরা আল আরাফ: ৭: ৩৩)
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُوْلَبِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا ﴾ [الاسراء: ٣٦]
"আর যে ব্যাপারে তোমার জ্ঞান নেই সেটার অনুসরণ করো না, নিশ্চয় কান, চোখ এবং অন্তর এসব কিছু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।" (সূরা আল ইসরা: ১৭: ৩৬)
অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথাকে তার বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে বিপরীত কোনো অর্থে ব্যবহার করল সে এমন বিষয়ের অনুসরণ করল যার ব্যাপারে তার কোনো ইলম নেই এবং আল্লাহর ব্যাপারে এমন কথা বলল যার ব্যাপারে তার কোনো জ্ঞান নেই; কারণ:
এক. সে ধারণা করল যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণীর উদ্দেশ্য এরকম নয়, অথচ এরকমটাই বাণীর বাহ্যিক অর্থ।
দুই. সে ধারণা করল যে বাণীর উদ্দেশ্য অন্যটা; যা বাহ্যত বাণী থেকে বুঝা যাচ্ছে না।
আর এটা আমাদের জানা যে, আল কুরআনের কোনো শব্দের যদি দুটি অর্থ থাকে এবং উভয়টিই সমান সম্ভাবনাময় হয়, তাহলে এই দুই অর্থের মধ্যে একটিকে নির্ধারণ করে দেওয়া বৈধ নয়; কেননা এতে অজ্ঞতাবশত আল্লাহর ওপর এমন কথা বলা হবে যা তিনি বলেননি। বিষয়টি যদি এমনই স্পর্শকাতর হয়ে থাকে, তাহলে আপনিই বলুন, যদি কেউ বাহ্যিক অর্থ বর্জন করে এমন অনগ্রাধিকারপ্রাপ্ত অর্থকে নির্ধারিত করে দেয় যা তার বিপরীত, তাহলে সে কি ধরনের অন্যায়ের আশ্রয় নেয়?
এর উদাহরণ: ইবলীসকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তা'আলার বাণী:
(قَالَ يَإِبْلِيسُ مَا مَنَعَكَ أَن تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ) [ص:
[٧٥
আল্লাহ বললেন, হে ইবলীস, আমার দু'হাতে আমি যাকে সৃষ্টি করেছি তার প্রতি সিজদাবনত হতে কিসে তোমাকে বাধা দিল? (সূরা সাদ: ৩৮: ৭৫)
এই আয়াতের অর্থ নির্ধারণে যদি কেউ বাহ্যিক অর্থ থেকে সরে গিয়ে বলে যে, এখানে দু'হাত বলতে মূলত হাত বুঝানো হয়নি বরং এখানে হাত দ্বারা বুঝানো হয়েছে এই এই। তাহলে এই ব্যক্তিকে বলব যে আপনি যে বাহ্যিক অর্থকে নাকচ করে দিলেন এর পক্ষে আপনার দলিল কি? আর যে অর্থকে আপনি প্রমাণ করলেন তার সপক্ষে প্রমাণ কি? সে যদি দলিল নিয়ে আসতে পারে তো ভালো, কিন্তু সে দলিল পাবে কোথায়। অতএব সে যা নাকচ করল এবং যা প্রমাণ করল উভয় ক্ষেত্রেই সে ইলম ব্যতীত আল্লাহর ওপর এমন কথা বলল যা আল্লাহ তা'আলা বলেননি।
চতুর্থত: আহলে তা'তীল তথা 'আল্লাহর নাম ও গুণের ভাষ্যসমূহকে অর্থশূণ্যকারী' সম্প্রদায়ের কথা এজন্যও প্রত্যাখ্যাত যে সিফাত-বিষয়ক টেক্সটসমূহকে বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে দেওয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরام, এ উম্মতের উত্তম পূর্বপুরুষ ও ইমামগণ যার ওপর ছিলেন তার বিরুদ্ধে যাওয়া। অতএব তা বাতিল। কেননা হক ও সত্য তো নিঃসন্দেহে তাই যার ওপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, এ উম্মতের উত্তম পূর্বপুরুষ ও ইমামগণ ছিলেন।
পঞ্চমত: এ ধরনের ব্যক্তিকে প্রশ্ন করে বলা হবে, আল্লাহ তা'আলা নিজ সম্পর্কে যতটুকু জানেন তুমি কি তার থেকেও বেশি জান? সে নিশ্চয় উত্তরে বলবে যে না, জানি না।
এবার তাকে প্রশ্ন করে বলা হবে: আল্লাহ তা'আলা নিজ সম্পর্কে যা জানিয়েছেন তা কি হক ও সত্য? সে নিশ্চয় উত্তরে বলবে, হ্যাঁ, হক ও সত্য।
এরপর তাকে বলা হবে: আল্লাহ তা'আলার বাণী যে বিশুদ্ধতম ও স্পষ্টতম বাণী, তা কি তুমি বিশ্বাস কর? সে অবশ্যই বলবে, হ্যাঁ, বিশ্বাস করি।
এরপর তাকে বলা হবে: তাহলে তুমি কি মনে কর যে, আল্লাহ তা'আলা এই টেক্সটসমূহের অর্থ কি তা অস্পষ্ট আকারে রেখে দেবেন যাতে মানুষ তার বুদ্ধি-বিবেচনা ব্যবহার করে তা উদ্ধার করে নেয়। উত্তরে সে অবশ্যই বলবে: না।
এ গেল আল-কুরআনের টেক্সটসমূহের কথা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নায় সিফাত-বিষয়ক যেসব টেক্সট এসেছে তার ব্যাপারে একই ধরনের প্রশ্ন করা যায়। অতঃপর বলা যায় যে: তুমি কি আল্লাহর ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেও অধিক জান? সে বলবে, না, জানিনা।
এরপর তাকে বলা হবে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ সম্পর্কে যা বলেছেন তা কি হক ও সত্য? সে বলবে, হ্যাঁ, হক ও সত্য।
এরপর তাকে বলা হবে: তুমি কি এমন কাউকে জান যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেয়ে অধিক বিশুদ্ধ ও স্পষ্টভাষী? উত্তরে সে অবশ্যই বলবে, না।
এরপর তাকে বলা হবে: তুমি কি এমন কাউকে জান যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেয়ে উম্মতের জন্য অধিক শুভাকাঙ্ক্ষী? সে অবশ্যই বলবে, না।
এরপর তাকে বলা হবে: যদি তুমি উল্লিখিত কথাগুলো স্বীকার করে নাও, তাহলে কেন তোমার যথেষ্ট সাহস হয় না যে তুমি আল্লাহর জন্য ঠিক তা সাব্যস্ত করবে যা তিনি নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন এবং যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করেছেন, প্রকৃত ও আল্লাহর জন্য উপযোগী বাহ্যিক অর্থ হিসেবে। অথচ দেখা যায় যে প্রকৃত ও বাহ্যিক অর্থ নাকচ করে দেওয়া এবং এর স্থলে বিপরীত অর্থ নেওয়ার ক্ষেত্রে তুমি বাহাদুরী দেখাও।
এতে তোমার কি ক্ষতি যে, আল্লাহ তা'আলা নিজের জন্য তাঁর কিতাবে যা সাব্যস্ত করেছেন তুমিও তা তাঁর জন্য সাব্যস্ত করবে। অথবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সুন্নাতে আল্লাহর জন্য উপযোগীভাবে যা সাব্যস্ত করেছেন তুমিও তা সাব্যস্ত করবে। অতএব কুরআন-সুন্নায় সাব্যস্ত করা ও অসাব্যস্ত করার বিষয়ে যা কিছু এসেছে তুমি তা মেনে নেবে। এটাইকি তোমার জন্য সঠিক ও নিরাপদ নয়? কারণ তোমাকে তো কিয়ামতের ময়দানেই জিজ্ঞাসা করা হবে:
﴿مَاذَا أَجَبْتُمُ الْمُرْسَلِينَ ﴾ [القصص: ٦٥]
'তোমরা রাসূলদেরকে কী জবাব দিয়েছিলে?' (সূরা আল কাসাস: ২৮: ৬৫)
তুমি যদি সিফাত-বিষয়ক বাণীসমূহকে বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে নিয়ে তার অন্যকোনো অর্থ কর, এটা কি তোমার জন্য বিপদের কারণ হবে না, কেননা হতে পারে যে তুমি যে অর্থ করেছ সেটা উদ্দেশ্য নয় বরং উদ্দেশ্য হলো অন্যটা।
ষষ্ঠত: আহলে তা'তীল তথা আল্লাহর নাম ও গুণের ভাষ্যসমূহকে অর্থশূণ্যকারীদের কথা এজন্যও অগ্রহণযোগ্য যে তা মেনে নিলে কিছু অযাচিত সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে। অতএব তা বাতিল। যেমন:
এক. আহলে তা'তীল: সিফাত-বিষয়ক টেক্সটসমূহকে তার বাহ্যিক অর্থ থেকে এ জন্যে সরিয়ে নেয় যে তারা মনে করে থাকে এগুলোর বাহ্যিক অর্থ এ অনুভূতি দেয় অথবা এ দাবি করে যে আল্লাহ তা'আলা সৃষ্টিজীব সদৃশ। অথচ আল্লাহ তা'আলাকে সৃষ্টিজীব সদৃশ মনে করা কুফরি; কেননা তাতে আল কুরআনের ওই আয়াতকে অস্বীকার করা হয় যেখানে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন:
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ [الشورى: ١١]
'তাঁর মত কিছু নেই।' (সূরা আশ-শূরা: ৪২: ১১)
নু'আইম ইবনে হাম্মাদ আল-খুযা'ঈ, যিনি ইমাম বুখারী র. এর একজন উস্তাদ ছিলেন, তিনি বলেছেন, 'যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলাকে মাখলুকের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ করল সে কাফের হয়ে গেল। আর আল্লাহ তা'আলা নিজেকে যেভাবে গুণান্বিত করেছেন এবং তাঁর রাসূল তাঁকে যেভাবে গুণান্বিত করেছেন তাতে কোনো তাশবীহ তথা সাদৃশ্যকরণ নেই।'
আর এটা স্পষ্ট যে সবচেয়ে বড় বাতিল বিষয় হচ্ছে, মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীর বাহ্যিক অর্থকে এমন মনে করা যে তাতে সৃষ্টিজীবের সঙ্গে সৃষ্টিকর্তা সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়া বাধ্য করে এবং তাতে কুফরি হওয়া আবশ্যক হয়ে যায় অথবা সেটাতে নিপতিত হওয়ার সন্দেহে পড়তে হয়।
দ্বিতীয়ত: আল্লাহ তা'আলার কিতাব যা তিনি নাযিল করেছেন সকল বিষয়ের বর্ণনা হিসেবে, মানুষের জন্য হিদায়েত হিসেবে, অন্তরে থাকা সকল ব্যাধির চিকিৎসা ও প্রস্ফুটিত আলো হিসেবে, হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী হিসেবে, সে কিতাবে আল্লাহ তা'আলা তাঁর নাম ও সিফাত সম্পর্কে কি ধরনের বিশ্বাস পোষণ করতে হবে তা স্পষ্টভাবে বলে দেবেন না বরং বিষয়টি মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনার ওপর ছেড়ে দেবেন যে, তারা যা ইচ্ছা তা সাব্যস্ত করবে এবং যা ইচ্ছা তা অসাব্যস্ত করবে, এটা কি করে সম্ভব! অতএব এ ধরনের বিশ্বাসই বরং বাতিল।
তৃতীয়ত: আহলে তা'তীলের কথা মেনে নিলে বলতে হয় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, খুলাফায়ে রাশেদা, সাহাবায়ে কেরাম, সালাফগণ এবং আয়েম্মায়ে কিরাম মহান আল্লাহর সিফাত-বিষয়ে যা জানার প্রয়োজন ছিল তা জানা এবং প্রচার করার ক্ষেত্রে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন; কেননা আহলে তা'তীল 'তাবিল' এর নামে যেসব কথা বলেছেন এসব কথার একটি অক্ষরও তাঁরা বলেননি।
অতএব হয়তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, খুলাফায়ে রাশেদা, সাহাবায়ে কেরাম, সালাফগণ এবং আয়েম্মায়ে কিরাম সিফাত-বিষয়ে যথার্থ জ্ঞানার্জন বিষয়ে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন অথবা উম্মতের উদ্দেশে তা বর্ণনা করার ক্ষেত্রে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। আর উভয় কথাই বাতিল।
চতুর্থত: আহলে তা'তীলের কথা মেনে নিলে বলতে হয় যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা সাব্যস্ত করেছেন তা নাকচ করে দেওয়া বৈধ। অর্থাৎ যেখানে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন,
﴿وَجَاءَ رَبُّكَ ﴾ [الفجر: ٢٢]
(এবং তোমার রব আসবেন।' (সূরা: আল ফাজর: ৮৯:২২'
সেখানে বলা শুদ্ধ হবে যে, না, আল্লাহ তা'আলা আসবেন না। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানে বলেছেন যে,
ينزل ربنا إلى السماء الدنيا
''আল্লাহ তা'আলা প্রতি রাতেই নিম্নাকাশে অবতরণ করেন'
সেখানে বলা শুদ্ধ হবে যে, না, আল্লাহ তা'আলা অবতরণ করেন না। কারণ তারা উল্লিখিত আয়াত এবং হাদীসের অর্থ করতে গিয়ে বলেন যে এখানে 'আসা' এবং 'অবতরণ' করাকে আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা রূপক অর্থে, প্রকৃত অর্থে নয়। অর্থাৎ তাদের ধারণা মতে এখানে অর্থ হবে, 'আল্লাহর নির্দেশ আসা'। রূপক অর্থের বড় আলামত হলো প্রকৃত অর্থকে নাকচ করে দেওয়া শুদ্ধ হওয়া। আর আল্লাহ এবং তার রাসূল যা সাব্যস্ত করেছেন তা নাকচ করে দেওয়া জঘন্যতম বাতিল বিষয়। অন্যকোনো অর্থে তাবিল করার দ্বারা এ বাতুলতা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না; কেননা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণীর কনটেক্সটে এমন কোনো ইশারা নেই যার দ্বারা বুঝা যাবে যে এখানে অর্থ হলো 'নির্দেশ আসা'।

লিঙ্ক শেয়ার করুন
close

লিঙ্ক কপি করুন