📄 তৃতীয় মূলনীতি: আল্লাহ তা'আলার গুণসমূহ দু'ভাগে বিভক্ত। সাব্যস্তজাত গুণ ও অসাব্যস্তজাত গুণ
তৃতীয় মূলনীতি: আল্লাহ তা'আলার গুণসমূহ দু'ভাগে বিভক্ত। সাব্যস্তজাত গুণ ও অসাব্যস্তজাত গুণ。
সাব্যস্তজাত গুণ: যা আল্লাহ তা'আলা তার কিতাবে অথবা তার রাসূলের যবানে নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন। আর এসবই হলো পূর্ণাঙ্গ গুণ যাতে কোনো অপূর্ণাঙ্গতা নেই। যেমন জীবন, ইলম, কুদরত, আরশের ওপরে থাকা, নিম্নাকাশে অবতরণ, চেহারা, দু'হাত, ইত্যাদি。
এসব গুণ আল্লাহ তা'আলার জন্য তাঁর শান অনুযায়ী প্রকৃত অর্থে সাব্যস্ত করা ওয়াজিব। এর দলিল হলো ওহী ও আকল।
ওহী থেকে দলিল হলো, আল্লাহ তা'আলার বাণী:
يَأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوا عَامِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي نَزَّلَ عَلَى رَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي أَنزَلَ مِن قَبْلُ وَمَن يَكْفُرْ بِاللَّهِ وَمَلَ بِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا [النساء : ١٣٦]
হে মুমিনগণ, তোমরা ঈমান আন আল্লাহর প্রতি, তাঁর রাসূলের প্রতি এবং সে কিতাবের প্রতি যা তিনি তাঁর রাসূলের উপর নাযিল করেছেন এবং সে কিতাবের প্রতি যা তিনি পূর্বে নাযিল করেছেন। আর যে আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কেউ কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ এবং শেষ দিনকে অস্বীকার করবে, সে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত হবে। (সূরা আন নিসা: ৪: ১৩৬)
আল্লাহর প্রতি ঈমান তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমানকেও শামিল করে। আর রাসূলের প্রতি যে কিতাব নাযিল হয়েছে তাঁর প্রতি ঈমান, কিতাবে-থাকা আল্লাহর সকল গুণের প্রতিও ঈমান। আর প্রেরিত পুরুষ হিসেবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান ওইসব সংবাদের প্রতি ঈমানকেও শামিল করে যা তিনি তাঁর প্রেরক অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা সম্পর্কে দিয়েছেন。
মানব বিবেক-বুদ্ধির দলিল হলো, আল্লাহ তা'আলা নিজের ব্যাপারে এসব বিষয়ের সংবাদ দিয়েছেন। আর তিনি নিজের ব্যাপারে অন্যের চেয়ে ভালো জানেন। তিনি সর্বোচ্চ সত্যবাদী এবং তাঁর কথা সর্বোচ্চ সৌন্দর্যমন্ডিত। অতএব আল্লাহ তা'আলা যেভাবে সংবাদ দিয়েছেন বিনা দ্বিধায় তা আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা ওয়াজিব; কেননা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তো তখন আসে যখন সংবাদটি এমন কোনো উৎস থেকে আসে যার ব্যাপারে অজ্ঞতা, মিথ্যা ও ভাব প্রকাশে অপারগতার ধারণা করা যেতে পারে। আর এ তিন প্রকার দোষের প্রতিটি থেকেই আল্লাহ তা'আলা পবিত্র。
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা'আলার ব্যাপারে যেসব সংবাদ দিয়েছেন সেসবের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য; কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রবের ব্যাপারে সকল মানুষের চেয়ে ভালো জানেন। তিনি এ ব্যাপারে সমধিক সত্যবাদী ও শুভাকাঙ্খী। আর ভাব প্রকাশে তিনি মানুষের মধ্যে সব থেকে অধিক পারঙ্গম। অতএব তিনি যেসব সংবাদ দিয়েছেন তা গ্রহণ করা ওয়াজিব।
অসাব্যস্তজাত সিফাত: আর তা হলো আল্লাহ তা'আলা তাঁর কিতাবে অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যবানে যা অসাব্যস্ত করেছেন তা। আর এসবই হলো আল্লাহর জন্য অপূর্ণাঙ্গ গুণ। যেমন মৃত্যু, নিদ্রা, অজ্ঞতা, ভুলে যাওয়া, অক্ষমতা এবং অবসাদ। অতএব এসব গুণ আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত না করা ওয়াজিব। এর পাশাপাশি এসবের বিপরীত গুণগুলো পূর্ণাঙ্গরূপে আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা ওয়াজিব। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা নিজের জন্য যা অসাব্যস্ত করেছেন তা এ জন্য অসাব্যস্ত করেছেন যে এসবের বিপরীতগুলো আল্লাহর জন্য পূর্ণাঙ্গরূপে সাব্যস্ত। শুধু অসাব্যস্ত করা উদ্দেশ্য নয়। কেননা অসাব্যস্ত করা কোনো পূর্ণাঙ্গতা নয়। তবে যদি অসাব্যস্তকরণ পূর্ণাঙ্গতা শামিল করে তবে তার কথা ভিন্ন। এটা এ কারণে যে অসাব্যস্ত বিষয় হলো অস্তিত্বহীন বিষয়। আর অস্তিত্বহীন বিষয় কোনো বিষয়ই না। অতএব তা পূর্ণাঙ্গ হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আর অসাব্যস্তকরণ কখনো কখনো পাত্রের অনুপযোগিতার কারণে হয়ে থাকে। অতএব এ অবস্থায়ও তা পূর্ণাঙ্গতাকে হারায়। উদাহরণত, যদি বলি দেওয়াল জুলুম করে না, তবে এ কথা শুদ্ধ হবে না; কারণ দেওয়ালের জুলুম করার কোনো ক্ষমতাই নাই।
আবার কখনো কখনো অপূর্ণাঙ্গতা হয় অক্ষমতার কারণে, ফলে তা অপূর্ণাঙ্গতা বিবেচিত হয়। যেমন কোনো কবি বলেন,
এ গোত্র কোনো যিম্মাদারীরই অন্যথা করতে পারে না,
তারা মানুষকে সরিষা পরিমাণও জুলুমের ক্ষমতা রাখে না
অন্য কবি বলেন,
কিন্তু আমার জাতি যদিও তারা অনেক সম্মানিত বংশীয় তবুও তারা
যত অপমানিতই হোক না কেন কোনো অনিষ্টের ক্ষমতা রাখে না।12।
কোনো গুণকে অসাব্যস্ত করার অর্থ তার বিপরীত পূর্ণাঙ্গ গুণকে আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা। এর উদাহরণ আল্লাহ তা'আলার বাণী:
﴿وَتَوَكَّلْ عَلَى الْحَيِّ الَّذِي لَا يَمُوتُ ﴾ [الفرقان: ٥٧]
আর তুমি ভরসা কর এমন চিরঞ্জীব সত্তার উপর যিনি মরবেন না। (সূরা আল ফুরকান: ২৫: ৫৮)
অতএব আল্লাহর জন্য মৃত্যুকে অসাব্যস্ত করার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ জীবনকে আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা শামিল রয়েছে。
আরেকটি উদাহরণ:
﴿وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا ﴾ [الكهف: ٤٩]
আর তোমার রব কারো প্রতি জুলুম করেন না। (সূরা আল কাহাফ: ১৮: ৪৯)
অতএব আল্লাহর জন্য জুলুম অসাব্যস্ত করার মধ্যে তাঁর জন্যে পূর্ণাঙ্গ ইনসাফ সাব্যস্ত করা শামিল রয়েছে।
তৃতীয় উদাহরণ: আল্লাহ তা'আলার বাণী: وَمَا كَانَ اللهُ لِيُعْجِزَهُ مِن شَيْءٍ فِي السَّمَوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ [فاطر: ٤٤]
আল্লাহ তো এমন নন যে, আসমানসমূহ ও জমিনের কোনো কিছু তাকে অক্ষম করে দেবে। (সূরা ফাতির: ৩৫: ৪৪)
এখানে আল্লাহ তা'আলার জন্য অক্ষমতাকে অসাব্যস্ত করা হয়েছে। আর অক্ষমতাকে অসাব্যস্ত করার মধ্যে আল্লাহর জন্য ইলম ও কুদরতকে পূর্ণাঙ্গরূপে সাব্যস্ত করা শামিল রয়েছে। এজন্যই আল্লাহ তা'আলা আয়াতের শেষে বলেছেন: إِنَّهُ كَانَ عَلِيمًا قَدِيرًا
নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। (সূরা ফাতির: ৩৫: 88)
কেননা অক্ষমতার কারণ হয়তো কোনো কিছুকে অস্তিত্বদানের কার্যকারণের ব্যাপারে অজ্ঞতা, অথবা ক্ষমতার অপ্রতুলতা। আর আল্লাহ তা'আলা পূর্ণাঙ্গ ইলমের অধিকারী এবং আকাশ ও পৃথিবীতে তাঁর ক্ষমতাকে খর্বকারী কেউ নেই。
এ উদাহরণ থেকে জানা গেল যে অসাব্যস্তজাত গুণগুলো কখনো কখনো একাধিক পূর্ণাঙ্গতাকে শামিল করে।
টিকাঃ
12 উভয় কবিই প্রকারান্তরে তাদের গোত্রের অযোগ্যতা ও অক্ষমতার কথাই প্রকাশ করেছে। [সম্পাদক]
📄 চতুর্থ মূলনীতি: সাব্যস্তজাত গুণগুলো প্রশংসা ও পূর্ণাঙ্গসূচক গুণ। অতএব এসব গুণ যত বেশি হবে এবং এসবের অর্থে যত বেশি বিভিন্নতা আসবে, যিনি এসব গুণে গুণান্বিত তাঁর পূর্ণাঙ্গতা তত অধিক প্রকাশ পাবে
চতুর্থ মূলনীতি:
সাব্যস্তজাত গুণগুলো প্রশংসা ও পূর্ণাঙ্গসূচক গুণ। অতএব এসব গুণ যত বেশি হবে এবং এসবের অর্থে যত বেশি বিভিন্নতা আসবে, যিনি এসব গুণে গুণান্বিত তাঁর পূর্ণাঙ্গতা তত অধিক প্রকাশ পাবে।
এ কারণেই যেমনটি সর্বজন বিদিত যে, সাব্যস্তজাত যেসব গুণের কথা আল্লাহ তা'আলা বলেছেন তা অসাব্যস্তজাত গুণ থেকে অনেক বেশি।
এর বিপরীতে অসাব্যস্তজাত গুণগুলো কেবল তিন অবস্থায় উল্লেখ করা হয়েছে। আর তা হলো নিম্নরূপ:
প্রথমত, আল্লাহর পূর্ণাঙ্গতার ব্যাপকতা বোঝানোর অবস্থায়। যেমন আল্লাহ তা'আলার বাণী: لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ ﴾ [الشورى: ١١]
তাঁর মত কিছু নেই, আর তিনি হলেন সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (সূরা আশ-শুরা: ৪২: ১১)১০
﴿وَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌ ﴾ [الإخلاص : ٤]
আর তাঁর কোনো সমকক্ষও নেই। (সূরা আল ইখলাস: ১১২: ৪)
দ্বিতীয়ত: মিথ্যাবাদীরা আল্লাহর ব্যাপারে যা দাবি করেছে তা নস্যাৎ করার অবস্থায়। যেমন ইরশাদ হয়েছে: ﴿أَن دَعَوْا لِلرَّحْمَنِ وَلَدًا وَمَا يَنْبَغِي لِلرَّحْمَنِ أَن يَتَّخِذَ وَلَدًا ﴾ [مريم: ٩١، ٩٢]
কারণ তারা পরম করুণাময়ের সন্তান আছে বলে দাবি করে। অথচ সন্তান গ্রহণ করা পরম করুণাময়ের জন্য শোভনীয় নয়। (সূরা মারয়াম: ১৯: ৯১-৯২)
তৃতীয়ত: এই সুনির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলার পূর্ণাঙ্গতায় কোনো কমতি থাকতে পারে এ ধরনের ধারণা নস্যাৎ করার ক্ষেত্রে। যেমন ইরশাদ হয়েছে: ﴿وَمَا خَلَقْنَا السَّمَاءَ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا لَعِبِينَ ﴾ [الانبياء: ١৬]
আসমান-জমিন ও তাদের মাঝখানে যা কিছু আছে তার কোনো কিছুই আমি খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। (সূরা আল আম্বিয়া: ২১:১৬)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে: وَلَقَدْ خَلَقْنَا السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ وَمَا مَسَّنَا مِن لَّغُوبٍ ) [ق: ٣٨]
আর অবশ্যই আমি আসমানসমূহ ও জমিন এবং এতদোভয়ের মধ্যস্থিত সবকিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছি। আর আমাকে কোনরূপ ক্লান্তি স্পর্শ করেনি। (সূরা ক্বাফ: ৫০: ৩৮)
টিকাঃ
১০ - দেখুন, মুহাম্মদ ইবনে আমীন আশানকিতী, আদওয়াউল বয়ান, - - - - -
📄 পঞ্চম মূলনীতি: সাব্যস্তজাত গুণ দু ভাগে বিভক্ত। আল্লাহর সত্তাসংলগ্ন গুণ ও তাঁর কর্মসংলগ্ন গুণ
পঞ্চম মূলনীতি: সাব্যস্তজাত গুণ দু'ভাগে বিভক্ত। আল্লাহর সত্তাসংলগ্ন গুণ ও তাঁর কর্মসংলগ্ন গুণ।
সত্তাসংলগ্ন গুণ হলো, যেগুলো অনাদি কাল থেকে আল্লাহর সত্তার সঙ্গে রয়েছে এবং অনন্তকাল ধরে থাকবে। যেমন ইলম, কুদরত, শ্রবণ, দর্শন, পরাক্রমশীলতা, হিকমত, সর্বোচ্চতা, 'আযমত। এর মধ্যে সংবাদজাত গুণ যেমন চেহারা, দু'হাত, দু'চোখ ইত্যাদিও শামিল রয়েছে。
আর কর্মসংলগ্ন গুণ হলো ওইসব গুণ, যা আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছার সঙ্গে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ এমন সব কর্ম যা আল্লাহ তা'আলা ইচ্ছা করলে করেন এবং ইচ্ছা না করলে করেন না। যেমন আরশের ওপর উঠা এবং নিম্নাকাশে অবতরণ করা।
আবার কখনও কখনও সিফাতে যাতিয়া অর্থাৎ সত্তাসংলগ্ন গুণ দু'ভাবে কর্মসংলগ্ন গুণও হতে পারে, যেমন কালাম বা কথা। এ গুণটি তার মৌলিকতার বিবেচনায় সিফাতে যাতিয়া (সত্তাসংলগ্ন গুণ); কেননা আল্লাহ তা'আলা অনাদি অনন্তকাল ধরে মুতাকাল্লিম থেকেছেন এবং থাকবেন। আর সুনির্দিষ্ট কোনো কথার ক্ষেত্রে 'কালাম' গুণটি সিফাতে ফি'লিয়া তথা কর্মসংলগ্ন গুণ। কেননা কথা বলা আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি যখন যা ইচ্ছা করেন বলেন। যেমন আল্লাহ তা'আলার বাণী:
﴿إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَن يَقُولَ لَهُ كُن فَيَكُونُ ﴾ [يس: ٨٢]
নিশ্চয়ই তাঁর ব্যাপার শুধু এই যে, কোন কিছুকে তিনি যদি 'হও' বলতে চান, তখনই তা হয়ে যায়। (ইয়াসীন: ৩৬: ৮২)
﴿وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَن يَشَاءَ اللهُ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا ﴾ [الانسان: ٣٠]
আর আল্লাহ ইচ্ছা না করলে তোমরা ইচ্ছা করতে পারবে না; নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রাজ্ঞ। (সূরা আল ইনসান:৩০)
📄 ষষ্ঠ মূলনীতি: সিফাত সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে বড় দুটি নিষিদ্ধ বিষয় থেকে মুক্ত থাকা খুবই জরুরি। এর একটি হলো 'তামছীল' (সাদৃশ্য নির্ধারণ) আর অপরটি হলো 'তাকয়ীফ' (ধরণ নির্ধারণ)
ষষ্ঠ মূলনীতি: সিফাত (গুণাগুণ) সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে বড় দুটি নিষিদ্ধ বিষয় থেকে মুক্ত থাকা খুবই জরুরি। এর একটি হলো 'তামছীল' (সাদৃশ্য নির্ধারণ) আর অপরটি হলো 'তাকয়ীফ' (ধরণ নির্ধারণ)।
'তামছীল' হলো, গুণাগুণ সাব্যস্তকারী ব্যক্তির এ বিশ্বাস আসা যে, আল্লাহর জন্য সে যে গুণাগুণ সাব্যস্ত করছে তা সৃষ্টিজীবের গুণাগুণের অনুরূপ (সৃষ্টিজীবের গুণাগুণের মতো)। এ ধরনের বিশ্বাস বাতিল বিশ্বাস। এর প্রমাণ ওহী ও মানববুদ্ধি।
ওহী থেকে এর প্রমাণ হলো আল্লাহ তা'আলার বাণী: لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ [الشورى: ١١]
তার মত কিছু নেই। (সূরা আশ-শূরা: ৪২: ১১)
তিনি আরো বলেন:
﴿ أَفَمَن يَخْلُقُ كَمَن لَّا يَخْلُقُ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ ﴾ [النحل: ١٧]
সুতরাং যে সৃষ্টি করে, সে কি তার মত, যে সৃষ্টি করে না? অতএব তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবে না? (সূরা আন্-নাহল: ১৬: ১৭)
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেন: ﴿ هَلْ تَعْلَمُ لَهُ سَمِيًّا ﴾ [مريم: ٦٥]
তুমি কি তাঁর সমতুল্য কাউকে জান? (মারয়াম: ১৯: ৬৫)
আরো বলেন: ﴿ وَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌ ﴾ [الاخلاص: ٤]
আর তাঁর কোনো সমকক্ষও নেই। (সূরা আল ইখলাস: ১১২: ৪)
মানববুদ্ধির দলিল
প্রথমত: এটা স্বতসিদ্ধভাবে জানা যে সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টিবস্তুর মধ্যে সত্তাগতভাবে পার্থক্য রয়েছে। এ পার্থক্যের দাবি হলো এ উভয়ের মধ্যে গুণের ক্ষেত্রেও পার্থক্য হবে। কেননা প্রত্যেক গুণান্বিতের তার উপযুক্ত গুণ বা সিফাত থাকে। এটা ভিন্ন ভিন্ন সৃষ্টবস্তুর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন গুণ থাকার মধ্যে স্পষ্ট। উদাহরণত উটের ক্ষমতা ও পরমাণুর ক্ষমতার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। অতএব যদি সৃষ্টিবস্তুর গুণের মধ্যে পরস্পরে পার্থক্য থাকে যদিও তারা সৃষ্টিবস্তু হওয়া হিসেবে সমতুল্য, তাহলে সৃষ্টবস্তু ও সৃষ্টিকর্তার মধ্যে পার্থক্যের বিষয়টি তো আরো স্পষ্ট এবং অধিক শক্তিশালী।
দ্বিতীয়ত: যিনি সৃষ্টকর্তা রব, যিনি সকল দিক থেকে পূর্ণাঙ্গ তিনি গুণের ক্ষেত্রে কীভাবে সৃষ্টিবস্তুর সমতুল্য হবেন যে নাকি অপূর্ণাঙ্গ ও মুখাপেক্ষী। অতএব যদি কেউ সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টিবস্তু সমতুল্য বলে বিশ্বাস করে তবে তার এ বিশ্বাস সৃষ্টিকর্তার অধিকারকে খর্ব করবে; কেননা যিনি পূর্ণাঙ্গ তাকে অপূর্ণাঙ্গের সঙ্গে উদাহরণ দেওয়া পূর্ণাঙ্গকে অপূর্ণাঙ্গ করে দেওয়া।
তৃতীয়ত: সৃষ্টিবস্তুর মধ্যেও এ বিষয়টি লক্ষণীয় যে নামের ক্ষেত্রে অভিন্নতা থাকলেও প্রকৃতি ও ধরন-ধারণের ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকে। যেমন মানুষের যে হাত রয়েছে তা হাতির হাতের মত নয়। মানুষের শক্তি উটের শক্তির মত নয়। যদিও নাম অভিন্ন। অর্থাৎ এটাও হাত এবং ওটাও হাত। এটাও শক্তি আর ওটাও শক্তি। তবে ধরন-ধারণ ও গুণবৈশিষ্ট্যের মধ্যে পার্থক্য আছে। এর দ্বারা বুঝা গেল যে নাম এক হলেও প্রকৃতিগতভাবে সমতুল্য হওয়া জরুরি নয়。
আর 'তাশবীহ' অর্থাৎ সাদৃশ্য নির্ণয় করা 'তামছীল' তথা সমতুল্য বলে ধারণা করার মতই। তবে এ দুটির মধ্যে এভাবে পার্থক্য করা যেতে পারে যে, 'তামছীল' হলো সকল সিফাতের ক্ষেত্রে সমতুল্য বলে ধারণা করা। আর তাশবীহ হলো অধিকাংশ গুণের ক্ষেত্রে সমতুল্য বলে ধারণা করা। তবে 'তামছীল' শব্দটি ব্যবহার করাই হবে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ। কেননা এ ক্ষেত্রে আল কুরআনে একই ধাতুর শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন:
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ [الشورى: ١١]
তার মত কিছু নেই। (সূরা আশ্শুরা: ৪২: ১১)
'তাকয়ীফ': তাকয়ীফ হলো সুনির্দিষ্ট কোনো উদাহরণযুক্ত না করেই আল্লাহ তা'আলার সিফাতের ব্যাপারে ধারণা করা যে তার ধরন এই এই। যেমন কেউ বলল, আল্লাহ তা'আলার চেহারা আছে আর তার আকার-আকৃতি হলো এই এই। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো মাখলুকের চেহারার উদাহরণ উল্লেখ করল না। এ ধরনের বিশ্বাসও বাতিল বিশ্বাস। এর প্রমাণ ওহী ও মানববুদ্ধির যুক্তি।
ওহী থেকে প্রমাণ হলো আল্লাহ তা'আলার বাণী:
وَلَا يُحِيطُونَ بِهِ عِلْمًا ﴾ [طه: ۱۱۰]
কিন্তু তারা জ্ঞান দিয়ে তাঁকে বেষ্টন করতে পারবে না। (সূরা তাহা: ২০: ১১০)
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেন: ﴿ وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُوْلَبِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا ﴾ [الإسراء: ٣٦]
আর যে বিষয় তোমার জানা নেই তার অনুসরণ করো না। নিশ্চয় কান, চোখ ও অন্তকরণ - এদের প্রতিটির ব্যাপারে সে জিজ্ঞাসিত হবে। (সূরা আল ইসরা: ১৭; ৩৬)
এটা স্পষ্ট যে আমাদের রব তা'আলার সিফাতের ধরণ-ধারণ কি তা আমাদের জানা নেই। কেননা তিনি সিফাত সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন, কিন্তু সিফাতের আকার-প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের জানাননি। অতএব সিফাতের আকার-প্রকৃতি বর্ণনা করার অর্থ এমন বিষয়ে কথা বলা যে বিষয়ে আমাদের আদৌ কোনো জ্ঞান নেই।
মানববুদ্ধির দলিল হলো: কোনো একটি জিনিসের গুণবৈশিষ্ট্যের আকার- প্রকৃতি ওই জিনিসটির সত্তার আকার-প্রকৃতির ব্যাপারে জ্ঞান লাভের পর অথবা ওই জিনিসটির সমতুল্য কোনো জিনিসের জ্ঞান লাভের পর অথবা ওই জিনিস সম্পর্কে সত্যবাদী কোনো ব্যক্তির সংবাদের পরই সম্ভব।
আর আল্লাহ তা'আলার সিফাতের ক্ষেত্রে উল্লিখিত এ তিনটি পন্থার কোনোটিই প্রযোজ্য নয়। অতএব 'তাকয়ীফ' প্রক্রিয়াকে বাতিল বলে বিশ্বাস করা ওয়াজিব। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার সিফাতের আকার-প্রকৃতি কি তা জানা আমাদের পক্ষে অসম্ভব।
উপরন্তু আমরা এ প্রশ্ন করতে পারি যে, আপনি আল্লাহ তা'আলার সিফাতের জন্যে কি ধরনের আকার-প্রকৃতি নির্ধারণ করবেন?
কারণ আপনি আপনার বুদ্ধি-বিচার দ্বারা যে ধরনের আকার-প্রকৃতিই নির্ধারণ করুন না কেন আল্লাহ তা'আলা তার থেকেও বড় ও সম্মানিত।
আর আপনি যে ধরনের আকার-প্রকৃতি নির্ধারিত করবেন তাতে আপনি নিশ্চিতরূপেই মিথ্যাবাদী হবেন; কেননা এ ব্যাপারে আপনার কোনো ইলম নেই।
অতএব আল্লাহ তা'আলার সিফাতের ব্যাপারে সকল প্রকার 'তাকয়ীফ' তথা আকার-প্রকৃতি নির্ধারণ থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। হোক তা অন্তরের কল্পনা দ্বারা অথবা জিহ্বার কথা দ্বারা অথবা হাত দ্বারা লিখার মাধ্যমে।
এ ব্যাপারে আমাদের বিশ্বাস কি হবে তার ব্যাখ্যা খোঁজে পাওয়া যায় ইমাম মালিক র. এর প্রসিদ্ধ উক্তিতে, যা তিনি নিম্নোক্ত আয়াতের ব্যাপারে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন। আয়াতটি হলো:
﴿الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى ) [طه: ٥]
দয়াময় (আল্লাহ) আরশের উপর উঠেছেন। (সূরা তাহা: ২০: ৫)
উক্ত আয়াতের নিরিখে প্রশ্নকারী প্রশ্ন করে বলেছেন, 'আল্লাহ তা'আলা আরশের ওপরে কীভাবে উঠেছেন?' প্রশ্নটি শোনে ইমাম মালিক র. মাথা নিচু করলেন, এমনকি তাঁর কপাল থেকে ঘام বেরুতে শুরু করল। এরপর তিনি বললেন:
الاستواء غير مجهول، والكيف غير معقول، والإيمان به واجب، والسؤال عنه بدعة
অর্থাৎ (ইস্তিওয়া তথা 'ওপরে ওঠা' অজানা নয়, আর আকার-প্রকৃতি বোধগম্য নয় [অর্থাৎ আল্লাহর ক্ষেত্রে ইস্তিওয়া শব্দের অর্থের আকার-প্রকৃতি কি তা বোধগম্য নয়] তবে এর প্রতি ঈমান আনা ওয়াজিব এবং এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা বিদ'আত।) ইমাম মালিক র. এর উস্তাদ রাবিয়া র. এর ব্যাপারে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন: ('ইস্তিওয়া' (উপরে উঠা) অজানা নয়, আর এর ধরন-ধারণ বোধগম্য নয়।)
তাদের দুজনের পর আলেমগণ উল্লিখিত নীতির উপরই চলেছেন। আর যদি আকার-প্রকৃতি বোধগম্য বিষয় না হয়ে থাকে এবং এ ব্যাপারে শরীয়তেও কোনো স্পষ্ট বক্তব্য উল্লিখিত না হয়ে থাকে তাহলে এর অর্থ হলো যে যুক্তি ও শরীয়ত উভয়টিই আকার-প্রকৃতি নির্ধারণমূলক সকল দলিল থেকে মুক্ত। অতএব এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব।
সুতরাং খুব সাবধান হোন আকার-প্রকৃতি নির্ধারণ এবং এ জাতীয় যেকোনো প্রয়াস থেকে; কেননা যদি এরূপ কাজে আপনি নিপতিত হন তবে তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া কঠিন হবে। আর যদি আপনার অন্তরে এ জাতীয় কোনো কিছু উদিত হয়, তবে নিশ্চিতরূপে জানুন যে তা শয়তানের কুমন্ত্রণা। এ ক্ষেত্রে আপনি আল্লাহ তা'আলার আশ্রয় প্রার্থনা করুন; কেননা একমাত্র তিনিই আশ্রয় দাতা। ইরশাদ হয়েছে:
وَإِمَّا يَنزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ ) [فصلت: ٣٦]
আর যদি শয়তানের পক্ষ থেকে কোন কুমন্ত্রণা কখনো তোমাকে প্ররোচিত করে, তাহলে তুমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করবে। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা।