📄 নেয়ামতের প্রকারসমূহ
এক.
প্রকাশ্য নেয়ামত। ধন-সম্পদ মানুষের প্রকাশ্য নেয়ামত。
ধন-সম্পদ কখনো মানুষের জন্য নেয়ামত। কখনোও আবার শাস্তি পাওয়ার উপকরণ。
ধন-সম্পদ আল্লাহ -এর সন্তুষ্টির জন্য ব্যয়িত হলে আল্লাহ সেই সম্পদ দিয়ে মানুষকে দুনিয়া-আখেরাতে সফল করে তোলেন。
আব্দুর রহমান ইবনে আউফ ধন-সম্পদ ব্যয় করে জান্নাতের অধিকারী হয়েছেন。
কেউ যদি মনে করে, ইসলাম ধন-সম্পদ ও অর্থনীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, তাহলে তার এই ধারণা ভুল। বরং ইসলাম ধন-সম্পদের বিলাসিতা, অপচয় ইত্যাদিকে নিষেধ করে。
ধন-সম্পদ যদি দীনের খেদমতের জন্য ব্যয়িত হয়, আল্লাহ -এর আনুগত্যের অধীন হয়, তবে তা মানুষের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ বয়ে আনবে。
তাবুক যুদ্ধের সময় রাসূল ﷺ মিম্বারে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'কে এই কঠিন দিনের সেনাবাহিনী সাজিয়ে দিবে? তার জন্য জান্নাতের ঘোষণা!' [আহমাদ : ৫১৩]
সকলের মাঝ থেকে উসমান (রাঃ) দাঁড়ালেন। বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি এই কঠিন দিনের বাহিনী সাজিয়ে দিবো। অর্থ, অস্ত্র, ঘোড়া, জিনপোশ, -আল্লাহর রাহে সবই আমি বহন করবো।
উসমানের ঘোষণা শুনে রাসূলের দুই চোখে অশ্রু গড়ালো। রাসূল তার জন্য দোয়া করে বললেন, 'আল্লাহ! উসমানের পূর্বাপর সব গুনাহ মাফ করো। আল্লাহ! তুমি তার উপর সন্তুষ্ট হও, আমিও তার উপর সন্তুষ্ট। আজকের পর উসমানের কোন কর্ম তার ক্ষতি বয়ে আনবে না।' [আহমাদ : ২০১০৭]
দুই.
পদ-পদবী মানুষের প্রকাশ্য নেয়ামত। पद-पदवी কখনো ইসলামের সাহায্য করে। কখনো ইসলামের বিরোধী শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। দাঈ ও দাওয়াতের পথে দুর্ভেদ্য গিরিপথের ভূমিকা পালন করে।
ওমর ইবনে আব্দুল আযিয (রহঃ) খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি সৎ ছিলেন। মানুষকে মুক্তির পথে পরিচালিত করেছিলেন।
অপর দিকে আবু মুসলিম খোরাসানি, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ শাসক হয়ে হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ মুসলমান হত্যা করেছিল।
আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূল (সঃ)-কে বলতে শুনেছেন, ‘বনী ইসরাইলের মধ্যে তিনজন লোক ছিল। একজন শ্বেতরোগী। একজনের মাথায় টাক। একজন অন্ধ।
আল্লাহ (সুবঃ) তাদের পরীক্ষা কতে চাইলেন। তিনি তাদের কাছে একজন ফেরেশতা পাঠালেন। ফেরেশতা প্রথমে শ্বেতরোগীর কাছে আসলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'তোমার কাছে কোন জিনিস বেশি প্রিয়?'
সে জবাব দিল, 'সুন্দর রং ও সুন্দর চামড়া। কারণ মানুষ আমাকে ঘৃণা করে।' ফেরেশতা তার শরীরের উপর হাত বুলিয়ে দিলেন। তার রোগ সেড়ে গেল। তার শরীরে সুন্দর চামড়া ও রং দান করা হল।
ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন ধরনের সম্পদ তোমার কাছে বেশি প্রিয়?’
সে জবাব দিল, 'উট'। অথবা সে বলল, 'গরু'।
(এ ব্যাপারে বর্ণনাকরীর সন্দেহ রয়েছে যে, শ্বেতরোগী বা টাকওয়ালা, দুজনের একজন বলেছিল উট আর অপরজন বলেছিল গরু।)
তাকে একটি দশ মাসের গর্ভবতী উটনী দেয়া হল। ফেরেশতা উট দিয়ে দোয়া করলেন- 'এতে তোমার জন্য বরকত হোক।'
এরপর ফেরেশতা টাকওয়ালার কাছে গেলেন। বললেন, 'তোমার কাছে কী পছন্দনীয়?'
সে বলল, 'সুন্দর চুল আমার বেশি পছন্দনীয়। আমি চাই- এ রোগ যেন চলে যায়। মানুষ এ রোগের কারণে আমাকে ঘৃণা করে।'
ফেরেশতা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তৎক্ষণাৎ মাথার টাক চলে গেল। মাথা ভর্তি সুন্দর চুল গজিয়ে উঠল।
ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'কোন সম্পদ তোমার নিকট অধিক প্রিয়?'
সে বলল, আমার সবচে প্রিয় সম্পদ গরু।
তাকে একটি গর্ভবতী গাভী দেয়া হল। ফেরেশতা তার জন্য দোয়া করলেন, 'এতে তোমাকে বরকত দান করা হোক।'
এরপর ফেরেশতা অন্ধের কাছে আসলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'কোন জিনিস তোমার কাছে বেশি প্রিয়?'
সে বলল, 'আল্লাহ যেন আমার চোখের জ্যোতি ফিরিয়ে দেন। আমি যেন মানুষকে দেখতে পারি।'
ফেরেশতা তার চোখে হাত বুলিয়ে দিলেন। তৎক্ষণাৎ আল্লাহ তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিলেন।
ফেরেশতা জিজ্ঞেস করলেন, 'তোমার সবচে প্রিয় সম্পদ কী?'
সে জবাব দিল, 'ছাগল আমার বেশি প্রিয়।'
ফেরেশতা তাকে একটি গর্ভবতী ছাগী দিলেন।
উল্লিখিত লোকদের পশুগুলো বাচ্চা দিল। একজনের উটে ময়দান ভরে গেল। অপরজনের গরুতে মাঠ পূর্ণ হয়ে গেল। অপর একজনের ছাগলে উপত্যকা ভরে গেল।
ফেরেশতা তার পূর্ববর্তী আকৃতি ধারণ করে শ্বেতরোগীর কাছে এসে বললেন, 'আমি একজন নিঃস্ব ব্যক্তি। আমার সফরের সকল সম্বল শেষ হয়ে গেছে। আজ আমার গন্তব্যে পৌঁছার জন্য আল্লাহ ️ছাড়া কোন উপায় নেই। আমি তোমার কাছে ঐ সত্তার নামে একটি উট চাচ্ছি, যিনি তোমাকে সুন্দর রং, কোমল চামড়া এবং সম্পদ দান করেছেন। আমি এর উপর সাওয়ার হয়ে আমার গন্তব্যে পৌঁছুবো।'
লোকটি বলল, 'আমার উপর বহু দায়-দায়িত্ব রয়েছে। কাজেই আমার পক্ষে দান করা সম্ভব নয়।'
ফেরেশতা তাকে বললেন, 'সম্ভবত আমি তোমাকে চিনি। তুমি কি একসময় শ্বেতরোগী ছিলে না, মানুষ তোমাকে ঘৃণা করত? তুমি কি ফকীর ছিলে না, এরপর আল্লাহ তোমাকে প্রচুর সম্পদ দান করেছেন?'
লোকটি বলল, 'আমি তো এ সম্পদ আমার পূর্বপুরুষ থেকে ওয়ারিশ সূত্রে পেয়েছি।'
ফেরেশতা বললেন, 'তুমি যদি মিথ্যাবাদী হও, তবে আল্লাহ তোমাকে সেরূপ কের দিন, যেমন তুমি ছিলে।'
এরপর ফেরেশতা মাথায় টাকওয়ালার কাছে তার সেই বেশভূষা ও আকৃতিতে গেলেন এবং তাকে ঠিক তদ্রূপই বললেন, যেরূপ তিনি শ্বেতরোগীকে বলেছিলেন। টাকওয়ালাও ফেরেশতাকে ঠিক অনুরূপ জবাব দিল, যেমন জবাব শ্বেতীরোগী দিয়েছিল। তখন ফেরেশতা বললেন, 'যদি তুমি মিথ্যাবাদী হও, তবে আল্লাহ তোমাকে তেমন অবস্থায় ফিরিয়ে দিন, যেমন তুমি ছিলে।'
শেষে ফেরেশতা অন্ধ লোকটির কাছে তার আকৃতিতে আসলেন এবং বললেন, 'আমি একজন নিঃস্ব লোক। মুসাফির মানুষ। আমার সফরের সকল সম্বল শেষ হয়ে গেছে। আজ বাড়ি পৌঁছার জন্য আল্লাহ ছাড়া কোন গতি নেই। তাই আমি তোমার কাছে সেই সত্তার নামে একটি ছাগী প্রার্থনা করছি, যিনি তোমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমি এই ছাগীটি নিয়ে আমার এ সফরে বাড়ি পৌঁছুতে পারবো।'
সে বলল, 'বাস্তবিকই আমি অন্ধ ছিলাম। আল্লাহ আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমি ফকীর ছিলাম, আল্লাহ আমাকে ধনী বানিয়েছেন। এখন তুমি যা চাও, নিয়ে যাও। আল্লাহর কসম! আল্লাহর ওয়াস্তে তুমি যা কিছু নিবে, তার জন্য আজ আমি তোমার কাছে কোন প্রশংসাই দাবি করবো না।'
তখন ফেরেশতা বললেন, 'তোমার মাল তুমি রেখে দাও। তোমাদের তিনজনকে পরীক্ষা করা হল মাত্র। আল্লাহ তোমার উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, আর তোমার সাথি দুজনের উপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন।' [বুখারি: ৩৪৬৪]
উক্ত হাদিস থেকে প্রমাণিত হল, যে আল্লাহর নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা পোষণ করে, আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট হন। যে নেয়ামতের অকৃতজ্ঞতা করে, পাপাচারে ব্যয় করে, আল্লাহর আয়াতের সাথে গাদ্দারী করে, আল্লাহ তার উপর অসন্তুষ্ট হন। এসব নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা পোষণ করা উচিত। কারণ, এবাদত কখনও নেয়ামতের জন্য যথেষ্ঠ নয়।
বনি ইসরাইলের জনৈক আবেদ এক উপত্যকায় আল্লাহ -র এবাদতে মগ্ন ছিল। সারাদিন সে এবাদত করত। এভাবে পাঁচশ বছর কেটে গেল। লোকটি যখন মৃত্যুবরণ করল, তাকে জিজ্ঞেস করা হল, 'তুমি তোমার এবাদত দিয়ে জান্নাতে যেতে চাও, নাকি আল্লাহ -র রহমতে জান্নাতে যেতে চাও?'
লোকটি বলল, 'আমি পাঁচশ বছর এবাদত করেছি। আমি আমার এবাদত দিয়ে জান্নাতে যেতে চাই।'
আল্লাহ তখন ফেরেশতাদের আদেশ করলেন, 'এই লোকের আমল গুণে দেখ এবং তার প্রতি আমার নেয়ামতগুলোও গুণে দেখ।'
ফেরেশতারা তার এবাদত গুণে দেখল, পাঁচশ বছরের এবাদত শুধু চোখের নেয়ামতেরই বদলাতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে!
আল্লাহ বললেন- 'ওকে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর।'
লোকটি তখন চিৎকার জুড়ে দিল। বলল, 'আল্লাহ! তোমার রহমতেই আমি জান্নাতে যেতে চাই।'
আল্লাহ তাকে রহম করলেন। তাকে জান্নাতে প্রবেশ করালেন। যেন সে একথা বুঝতে পারে, আল্লাহর নেয়ামতের কোন শেষ নেই। কেউ তা গুণে শেষ করতে পারবে না।
রাসূল ইরশাদ করেন – 'তোমাদের কেউ আল্লাহর রহম ছাড়া নিজ আমল দ্বারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।'
সাহাবায়ে কেরام জিজ্ঞেস করলেন, 'আল্লাহর রাসূল! আপনিও?'
রাসূল বললেন- 'হ্যাঁ, আমিও। তবে আল্লাহ আমাকে তার রহম দ্বারা পূর্ণ করেছেন।' [বুখারি: ৫৬৭৩]
আমরা সকলেই আল্লাহ-র কাছে মুখাপেক্ষী। আমরা সকলেই ভুল করি। আমরা অপূর্ণ। আমাদের এমন কোন আমল নেই, যা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবো। আমরা আল্লাহর রহম কামনা করি। তাঁর অনুকম্পা ভিক্ষা করি।
📄 শোকরিয়ার স্বরূপ
আল্লাহ-র নেয়ামতের শোকরিয়ার স্বরূপ হল- বান্দা নিজে সৎ হয়ে যাওয়া। অপরকে ভালো কাজের আহ্বান করা।
ইসলাম বলে, সৎকাজে আদেশকারী এবং অসৎকাজে নিষেধকারীরাই সফল। যারা চুপ থাকে, সৎকাজে আদেশ করে না, অসৎকাজে নিষেধ করে না, তারা আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকারকারী পাপীদের মতই নিজেদের ধ্বংস করছে।
আল্লাহ বলেন-
আমি সেসব লোককে মুক্তি দান করলাম যারা মন্দ কাজ থেকে বারণ করত। আর পাকড়াও করলাম গোনাহগারদের নিকৃষ্ট আযাবের মাধ্যমে তাদের নাফরমানীর দরুন। [সূরা আরাফ: ১৬৫]
📄 কৃতজ্ঞতার লাভ
১. কৃতজ্ঞের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হন। দুনিয়া ও আখেরাতে তাঁকে সফল করেন।
২. কেয়ামতের দিন যখন নেয়ামতের কথা জিজ্ঞেস করবেন, তখন কৃতজ্ঞতাই সে জিজ্ঞাসার জবাবে যথেষ্ট হবে।
৩. মানুষ কৃতজ্ঞের জন্য কল্যাণের দোয়া করে।
আল্লাহ আমাদের কৃতজ্ঞ বান্দা হওয়ার তাওফিক দান করুন। কৃতঘ্নতা থেকে হেফাযত করুন।