📘 আল্লাহকে মানুন নিরাপদ থাকুন > 📄 মহিয়সী খানসা নাখঈয়া

📄 মহিয়সী খানসা নাখঈয়া


কাদিসিয়ার ভয়াবহ যুদ্ধের মর্মান্তিক প্রান্তর। দুপাশে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে মুসলিম ও কাফেররা। একদিকে আল্লাহর দল, আরেকদিকে শয়তানের দল। এক প্রান্তে উড়ছে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর পতাকা, অপর প্রান্তে উড়ছে কুফরির পতাকা। যুদ্ধপ্রান্তরে মুসলমানদের দলে উপস্থিত হয়েছেন মহিয়ষী খানসা নাখঈয়া।
খানসা নাখঈয়া কিবলার দিকে অবনত হয়ে আল্লাহ -র কাছে হাত তুলেছেন। দোয়া করে বলছেন- 'আল্লাহ! এই যুদ্ধে আমার কাছে দেয়ার মতো শুধু চারটি সন্তানই আছে। চার সন্তানের চেয়ে উত্তম কিছু দেয়ার মতো নেই। আমি আমার চার সন্তানকে তোমার রাস্তায় পথিক বানাচ্ছি। তুমি আজ তাদের শাহাদাত লাভে ধন্য করো।'
চার সন্তান ব্যতীত খানসা নাখঈয়ার আপন বলতে নেই। তাকে দেখাশোনার কেউ নেই। দুনিয়াতে এই চার সন্তানের চেয়ে তার প্রিয় বলতে কেউ নেই। প্রাণপ্রিয় সন্তানদের তিনি বললেন- 'আমার ছেলেরা! তোমরা গোসল করে আতর মেখে কাফন পরে জিহাদে বেরিয়ে পড়ো।'
তারা গোসল করলেন। কাফন পরলেন। খানসা নাখঈয়া বললেন- 'আল্লাহর কসম! তোমাদের পিতার কোন খেয়ানত করিনি। তোমাদের মামার কোন খেয়ানত করিনি। আল্লাহর কসম! তোমরা এক পিতার সন্তান। আমি হিসাবের দিন তোমাদের কাছে পাওয়ার আশায় আজ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে বের করছি। তোমরা এক আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ হও। আবার হিসাবের দিন তোমাদের সাথে দেখা হবে।'
এভাবে সন্তানদের বিদায় দিলেন।
যুদ্ধ শেষ। খানসার কাছে লোকেরা সুসংবাদ দিল- 'আপনার চার সন্তান শহীদ হয়েছেন।'
তিনি این সংবাদ শুনে মিষ্টি করে তৃপ্তির সাথে হাসলেন। শোকরিয়া জ্ঞাপন করলেন।
এই হল মুমিনের প্রশান্তি-
আমায় ভাসিয়ে নিল স্ফীত আনন্দের ঢেউ
আমায় কাঁদিয়ে গেল আনন্দলেখা এক মধুর বারতা...
এরপর খানসা নাখঈয়া বললেন, “সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি প্রিয় সন্তানদের শাহাদাত দান করে আমার মর্যাদা বুলন্দ করেছেন। আল্লাহ!
যেদিন ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি কোন কাজে আসবে না; কিন্তু যে শুদ্ধ অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে। [সূরা শুয়ারা : ৮৮, ৮৯] সেদিন আমার সন্তানদের তুমি পাশে রেখো।
মুয়ায ইবনে জাবাল (রাঃ)- ইয়ামানের উদ্দেশে রওয়ানা হচ্ছেন। রাসূল (ﷺ) তাকে নসিহত করলেন-
মুয়ায! যেখানেই থাক, আল্লাহকে ভয় কর। কোন মন্দ কাজ হয়ে গেলে সাথে সাথে নেক কাজ কিছু কর; মন্দ কাজের প্রভাব মুছে যাবে। মানুষের সাথে উত্তম আচরণ কর। [আহমাদ : ২১৪৮২]
মুয়ায! জনপদে, প্রস্তরপ্রান্তে, বৃক্ষভূমিতে আল্লাহকে স্মরণ রেখ। তুমি যখন আল্লাহকে স্মরণ কর, আল্লাহ তখন তোমার সাথেই থাকেন। [ইবনে আবি শাইবা : ৩০১১৪]
রাসূল (ﷺ) ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে উপদেশ দিচ্ছেন-
তুমি আল্লাহর বিধান রক্ষা কর, আল্লাহ তোমাকে সুরক্ষা দিবেন। তুমি আল্লাহর বিধান প্রতিপালন কর, আল্লাহকে তোমার কাছেই পাবে। তোমার প্রাচুর্যের সময় আল্লাহকে স্মরণ রেখ, তোমার কষ্টের সময় আল্লাহ তোমাকে স্মরণ রাখবেন। কোন কিছু চাইলে আল্লাহর কাছেই চাও। কোন সাহায্যের প্রয়োজন আল্লাহকেই শুধু বল। জেনে রাখ, পৃথিবীর সব মানুষ তোমার সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত হলেও আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত তারা তোমার কোন সহযোগিতা করতে পারবে না। পৃথিবীর সব মানুষ তোমার অনিষ্টের জন্য প্রস্তুত হলেও আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত তারা তোমার কোন অনিষ্ট করতে পারবে না। মানুষের ভাগ্য সুস্থির, লিপিবদ্ধ। [আহমাদ : ২৬৬৪]
সাওবান থেকে বর্ণিত, রাসূল ইরশাদ করেন-
আমি আমার উম্মতের সে সব লোককে জানি, যারা কেয়ামতের দিন তিহামার (মক্কা ও ইয়ামানের অবস্থান অঞ্চলকে তিহামা বলা হয়) পর্বতমালার সমান নেক আমল নিয়ে হাযির হবে। কিন্তু আল্লাহ তা বিক্ষিপ্ত ধূলোর ন্যায় করে দিবেন।
সাওবান বললেন, 'হে আল্লাহর রাসূল! তাদের ব্যাপারে আমাদের অবহিত করুন। সবিস্তারে খোলাখুলিভাবে আলোচনা করুন। যাতে অজ্ঞাতসারে আমরা তাদের মধ্যে শামিল না হই।'
রাসূল বললেন-
মনোযোগ দিয়ে শোনো! তারা তোমাদের ভাই এবং তোমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত। রাতে তোমাদের মতো এবাদত করে। কিন্তু তারা এমন কওম, আল্লাহ ঘোষিত হারাম কাজের নিকটবর্তী হলে তারা হারামের পর্দা ছিন্ন করে ফেলে (অর্থাৎ হারাম কাজে লিপ্ত হয়)। [ইবনে মাজাহ : ৪২৪৫]
মানুষ কখনও কখনও আল্লাহ-কে ভয় করে। আবার অন্তর থেকে আল্লাহ -র ভয় খানিকের জন্য উবে যায়। অথচ আল্লাহ চান আমরা সবসময় তাকে ভয় করি। প্রকাশ্যে-গোপনে সর্বাবস্থায় আল্লাহ-কে ভয় করি। যেদিন সব মানুষ আমাকে ভুলে যাবে, সেদিন আল্লাহ-ই আমাকে স্মরণ রাখবেন। আন্দালুসি তার ছেলেকে নসিহত করছেন-
তুমি যখন অন্ধকারে উৎকণ্ঠায় একাকী হও,
মন তোমাকে আহ্বান করে পাপাচারে,
তখন লজ্জা কর মহান আল্লাহর দৃষ্টিকে।
মনকে বল- ‘মন! তোমাকে দেখছেন,
যিনি সৃষ্টি করেছেন এই অন্ধকারের সুযোগ।
ওলামায়ে কেরাম লিখেন, যখন তুমি একাকি থাকবে, আকাশের তারা দেখবে, তখন মনকে জিজ্ঞেস কর- ‘কে তারাগুলোকে ঝলমলে বানিয়েছেন?' যখন একাকি চাঁদের দৃশ্য অবলোকন করবে, তখন চাঁদকে জিজ্ঞেস কর, 'কে তাকে সুউচ্চে স্থাপন করেছে?' আকাশকে জিজ্ঞেস কর, 'কে তাকে সুপরিমিত করেছে?' তুমি যেখানেই থাক, আল্লাহ তোমার সাথে থাকেন। তুমি আল্লাহকে না দেখলেও আল্লাহ তোমাকে দেখছেন ঠিকই।
মুয়ায মৃত্যুশয্যায় শায়িত। মৃত্যুর পূর্বাভাস ফুটে আছে চেহারায়। রাতের ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, 'ভোর হয়েছে?'
ছেলে বাইরে দেখে বলল, 'না। এখনও ভোর হয়নি।'
মুয়ায বসে রইলেন। কিছুক্ষণ পর চোখ তুলে বললেন, 'আল্লাহ! আপনি অল্পতে বরকত দান করেন। অল্পকে বেশি বানান। আমার এই ক্ষতে আপনি বরকত দান করেন।' তার গায়ে তখন প্লেগ রোগের ক্ষত ছিল।
ছেলে বলল, 'আপনি মৃত্যুর আশা করছেন?'
মুয়ায বললেন, 'আল্লাহর কসম! আমি জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে পড়েছি। বেঁচে থাকতে অনিহা লাগছে।'
অতঃপর ছেলেকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, 'ভোর হয়েছে?'
ছেলে বলল, 'হ্যাঁ, ভোর হয়েছে।'
তিনি বললেন, 'এই ভোর বেলা আমি আল্লাহর কাছে জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চাচ্ছি। হে আল্লাহ! আপনি জানেন, আমি বাগ-বাগিচা বানানোর জন্য বেঁচে থাকতে চাইনি। নহর স্থাপনের জন্য বেঁচে থাকতে চাইনি। আমি দালান-কোটার জন্য বেঁচে থাকার আশা করিনি। আমি তিনটি উদ্দেশে বাঁচতে চেয়েছি। দ্বিপ্রহরে পিপাষার্ত থাকার জন্য, যিকিরের মজলিসে আলেমদের প্রতিযোগিতা করার জন্য, তোমার সেজদায় ধূলোয় লুটোপুটি খাওয়ার জন্য।'
আমাশ মৃত্যুশয্যায় শায়িত। তার চেহারায় মৃত্যুর লক্ষণ দেখে ছেলেরা কাঁদতে শুরু করল। আমাশ ছেলেদের বললেন, 'তোমরা কেঁদো না। আল্লাহর কসম! ষাট বছর যাবৎ (সালাতে) ইমামের সাথে আমার তাকবীরুল উলা ছোটেনি!'
আমাশ এ কথা অহংবোধ থেকে বলেননি। বলেছেন তাকবীরুল উলার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য।
প্রখ্যাত বুযুর্গ, দুনিয়াবিমুখ আবেদ ইবনে ইদরিস এর জীবনী আলোকপাত করে ইমাম যাহাবি সিয়ারু আ'লামিন নুবালা গ্রন্থে লিখেন, ইবনে ইদরিস মৃত্যুবরণ করার সময় তার ছেলে মাথার পাশে কান্না করছিল। তিনি ছেলেকে বললেন, আল্লাহকে ভয় কর। তোমার আমার বসবাসের এই ঘরে কখনও আল্লাহর অবাধ্যতা করো না। আল্লাহর কসম! এই ঘরে আমি চার হাজার বার কোরআন খতম করেছি!'
যারা আল্লাহ-কে ভয় করে, মন থেকে মানে, আল্লাহ তাকে উত্তরসূরীদের কাছে জীবন্ত করে রাখেন। উত্তরসূরীরা তার দ্বারা উপকৃত হয়ে থাকে। সূরা কাহফে আল্লাহ এক আল্লাহভীরু নেককার পিতার সম্পদ সন্তানদের জন্য কিভাবে সংরক্ষণ করেছেন, তা বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং যে আল্লাহকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে, আল্লাহ তার স্ত্রী-সন্তান, পরিবার-পরিজনের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহ তার রিযিকেরও ব্যবস্থা করবেন।
একবার রাসূল একটি ঘাটে অবস্থান করছিলেন। ওমর সেখানে প্রবেশ করলেন। সেখানে তিনি অল্প যব ছাড়া কিছু দেখলেন না। এ দৃশ্য দেখে তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে গেল। রাসূল জিজ্ঞেস করলেন, 'ওমর! কী হয়েছে তোমার?' তখন রাসূল একটি চাটাইয়ে শায়িত ছিলেন। রাসূলের পার্শ্বদেশে চাটাইয়ের দাগ পড়ে গিয়েছিল।
ওমর বললেন, 'ইয়া রাসূলাল্লাহ! কিসরা ও কায়সার কত ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশের মধ্যে ডুবে আছে। অথচ আপনি আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ আপনাকে পৃথিবীর সকল মানুষের উপর মর্যাদা দিয়েছেন।'
রাসূল বললেন, 'ওমর! তুমি দ্বিধায় আক্রান্ত! তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তাদের জন্য দুনিয়া আর আমদের জন্য আখেরাত?' [বুখারি: ৪৯১৩]
উসমান একটি কবরস্থানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেখানে একটি লোককে কবর দেয়া হচ্ছিল। তিনি এই দৃশ্য দেখে কান্না শুরু করলেন। কাঁদতে কাঁদতে বেহুশ হয়ে পড়লেন। তাকে সেখান থেকে দ্রুত নিয়ে আসা হল। জিজ্ঞেস করা হল, 'আপনি কোরআন পড়েন, জান্নাত-জাহান্নামের আলোচনা করেন, তখন আপনাকে এভাবে কাঁদতে দেখিনি। অথচ কবর দেখে আপনি এভাবে কাঁদলেন!'
উসমান বললেন, 'রাসূল বলেছেন-
কবর হল আখেরাতের প্রথম ঘাঁটি। যে এখানে মুক্তি পাবে, তার জন্য পরবর্তী সকল ঘাঁটি সহজ হয়ে যাবে। আর যদি এখানে মুক্তি না পায়, তাহলে পরবর্তী সকল ঘাঁটি কঠিন হয়ে পড়বে। [আহমদ: ৪৫৬]
রাসূল আরও বলেছেন-
مَا رَأَيْتُ مَنْظَرًا قَطُّ إِلَّا وَالْقَبْرُ أَفْظَعُ مِنْهُ
আমি কবরের চেয়ে ভয়াবহ কোন দৃশ্য দেখিনি। [আহমদ: ৪৫৬]
আলী এক কবরস্থানে কবরবাসীদের উদ্দেশে বলেন, 'তোমাদের বাহ্যিক দৃশ্য সুন্দরই দেখায়। কিন্তু তোমাদের ভিতর একটি চুলও নেই! আমাদের অবস্থা কী, জান? তোমাদের কবরস্থ করে আমরা প্রস্থান করেছি। তোমাদের ঘরে অন্য মানুষ বাস করছে। স্ত্রীদের বিয়ে হয়ে গেছে। ধনসম্পদ বণ্টিত হয়ে গেছে। এবার বলো, তোমাদের অবস্থা কী?'
এ কথা বলে আলী কান্না শুরু করলেন। বললেন, কবরবাসী উত্তর দিচ্ছে না। তারা উত্তর দিলে এই কথাই বলত-
নিশ্চয় সর্বোত্তম পাথেয় হল তাকওয়া। [সূরা বাকারা : ১৯৭]

📘 আল্লাহকে মানুন নিরাপদ থাকুন > 📄 আল্লাহর ভয় অন্তরে স্থাপন করার চারটি মাধ্যম

📄 আল্লাহর ভয় অন্তরে স্থাপন করার চারটি মাধ্যম


এক.
আল্লাহ -র ভয় অন্তরে স্থাপন করার একটি কার্যকরী মাধ্যম- কবর যিয়ারত করা। কবরগুলোতে আমাদের সন্তান, পূর্বপুরুষ, সাথি-সঙ্গী, বন্ধু-বান্ধব রয়েছে। কবর যিয়ারতের দ্বারা মনে মৃত্যুর কথা জাগে। মৃত্যুর ভয় সৃষ্টি হয়।
মৃত্যু এমনই এক নিয়তি- নিস্তার নেই এর থেকে। পলায়নের জায়গা নেই।
মৃত্যু এমনই এক শয়ান- শাবাধার থেকে এই নামে, এই তো আবার উঠে।
মানুষ কত স্বপ্ন বোনে, কত আশা পুষে রাখে অন্তরে; পড়ন্ত বার্ধক্যে!
গর্বোদ্দীপ্ত ভবন বানায় আকাশ ছুঁয়ে! অথচ সে জানে- মৃত্যু তার অচিরেই...
রাসূল ইরশাদ করেন- তোমরা কবর যিয়ারত কর। কবর মৃত্যুর কথা স্মরণ করায়।' 'কবর তোমাদের আখেরাতের কথা স্মরণ করায়। [আহমাদ : ৯৩৯৫]
রাসূল নিজে কবর যিয়ারত করতেন এবং কবরের কাছে গিয়ে এই দোয়া পড়তেন-
السَّلَامُ عَلَيْكُمْ دَارَ قَوْمٍ مُؤْمِنِينَ وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لَأَحِقُونَ، يَرْحَمُ اللَّهُ الْمُسْتَقْدِمِينَ مِنَّا وَمِنْكُمْ وَالْمُسْتَأْخِرِينَ، نَسْأَلُ اللَّهَ لَنَا وَلَكُمُ الْعَافِيَةَ.
হে মুমিন ঘরের বাসিন্দা! তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। ইনশাআল্লাহ, অচিরেই আমরা তোমাদের সাথে মিলবো। আল্লাহ আমাদের এবং তোমাদের অনুজ-অগ্রজ সকলকে রহম করুন। আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য এবং তোমাদের জন্য নিরাপত্তা কামনা করছি। [মুসলিম : ৯৭৪, বুখারি : ৯৭৫]
মাতরাফ ইবনে আব্দুল্লাহ শাখির। তিনি নিজের ঘটনা বর্ণনা দিয়ে বলেন, আমি প্রতি সপ্তাহে বাসরার গ্রাম থেকে শহরে আসতাম জুমা আদায় করার জন্য। জুমাবারের একরাত আগে আমি সাধারণত আমি চলে আসতাম এবং জুমারাতে বাসরার কবরস্থান যিয়ারত করতাম। তাদের সালাম দিয়ে খুব করে দোয়া করতাম।
একরাতে প্রচন্ড বর্ষা ছিল। আবহাওয়া ছিল অত্যন্ত ঠান্ডা। আমি সে রাতে কবরস্থান যিয়ারত করে কবরবাসীর জন্য দোয়া করতে না পেরে বাড়ি চলে আসলাম।
রাতে ঘুমালাম। স্বপ্নে দেখলাম- কবরের একজন লোক এসে আমাকে বলছে, 'মাতরাফ! আপনি আজ আমদের বঞ্চিত করলেন! আল্লাহর কসম! আপনার দোয়ার উসিলায় এক সপ্তাহ আমাদের কবরের আযাব বন্ধ থাকে।'
মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসির ঘটনা। একটি কবরস্থানের পাশ দিয়ে কোথাও যাওয়ার সময় লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ পাঠ করলেন। পাঠ করতেই অদৃশ্য থেকে শুনতে পেলেন- 'হে মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসি! লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ দ্বারা নিজের পথসম্বল যোগাড় করে নাও। তুমি যদি এর সাওয়াব ও প্রতিদান জানতে, নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে এই কালিমা পাঠ করতে। আমাদের মাঝে এবং এই কালিমার মাঝে এখন পর্দা পড়ে গেছে। আমরা এখন আর তা পড়তে পারি না।'
মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে, তখন তার আমল করার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।
কোন বেনামাযী মারা গেলে তার সালাত কে আদায় করবে?
কোন ব্যক্তি রোযা না রাখলে তার রোযা কে রাখবে?
কে তার পক্ষ থেকে সদকা করবে? ভালো কাজে খরচ করবে?
কে তার পক্ষ থেকে উত্তম আদর্শ দেখাবে?
এসব কি সম্ভব?
মানুষ যখন মরে যায়, তার ভালো কাজ করার রাস্তা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
দুই.
অন্তরে আল্লাহ -র ভয় বদ্ধমূল রাখার দ্বিতীয় একটি পন্থা- সবসময় মৃত্যুর কথা স্মরণ করা। সকাল-সন্ধ্যা মৃত্যুর স্মরণ করা। ঘুমুতে গেলেও মৃত্যুর কথা কল্পনা করা।
ওমর ইবনে আব্দুল আযিযের স্ত্রী ফাতেমা বিনতে আব্দুল মালিক বলেন, ওমর রাতে যখন বিছানায় যেতেন, ঠান্ডায় কাতরানো পাখির মতো ছটফট করতেন। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম- 'আমীরুল মুমিনীন! কী হয়েছে আপনার? আপনি ঘুমুচ্ছেন না কেন?'
তিনি বললেন, 'এই বিছানা, অন্ধকার ঘর আমাকে মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।'
ইমাম যাহাবি সুফয়ান সাওরি এর ব্যাপারে বর্ণনা করেন, তিনি ইশার পর থেকে ফজর পর্যন্ত সূরা তাকাসুর পাঠ করতেন। এর মধ্যে তন্দ্রাচ্ছন্ন হলে বলতেন, আমি কিভাবে ঘুমুবো; কবর আমার সামনে!
তিন.
আল্লাহ-র ভয় সৃষ্টি হওয়ার তৃতীয় একটি পন্থা- সবসময় আল্লাহ-র আযাবের কথা স্মরণ করা। আল্লাহর শাস্তি বড় ভয়ানক। তিনি যখন কাউকে শাস্তি দেন, বড় মর্মন্তুদ শাস্তি দেন। যখন প্রতিশোধ নেন, কঠিন প্রতিশোধ নেন। -এসব কথা সমসময় মনে মনে আওড়ালে আল্লাহ-র ভয় অন্তরে সৃষ্টি হয়।
ওমর সবসময় বলতেন এবং তার গভর্নরদেরও লিখে পাঠাতেন- 'আল্লাহর শাস্তি বড় ভয়াবহ, সে কথা ভুলবে না।'
ওমর ইবনে আব্দুল আযিয আদি ইবনে আরতাকে বলেছিলেন, 'সুবহানাল্লাহ! কিভাবে তুমি জুলুমের পথ বেছে নিলে! কিভাবে তুমি অবাধ্য হলে! তুমি কি কখনও কবর যিয়ারত করনি! তুমি কি জানো না, আল্লাহর আযাব ভয়ঙ্কর!'
চার.
আল্লাহ-র ভয় মনে জাগরুক রাখার চতুর্থ পথা- আল্লাহ-র অসীম দৃষ্টিশক্তির কথা স্মরণ রাখা।
ইবনে তাইমিয়া বলেন, 'অন্তর আল্লাহর ঘর। এই ঘর সুন্দর রাখা এবং শুদ্ধ রাখার জন্য করণীয় হল আল্লাহর সাথে সততার আচরণ করা। সবসময় মনে রাখা- আল্লাহ আমাকে দেখছেন।'
ইমাম আহমদ ঘরে প্রবেশ করেলে ভয়ে এতটুকুন হয়ে বসতেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হল, আপনি সকলের সাথে থাকলে এভাবে ভীত-প্রকম্পিত হয়ে বসেন না, কিন্তু ঘরে গেলে এভাবে বসেন কেন?
তিনি বললেন, আল্লাহ বলেছেন-
أَنَا جَلِيْسٌ مَنْ ذَكَرَنِي
যে আমাকে স্মরণ করে, আমি তার সহাবস্থানকারী। [মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ১২৬৫]
আল্লাহ-র ভয় মনে জাগরুক রাখার জন্য সবসময় মনে রাখতে হবে- আল্লাহ আমাকে দেখছেন। আমি আল্লাহকে না দেখলেও তিনি আমাকে দেখছেন। সবসময় দেখছেন। সর্বাবস্থায় দেখছেন। [বুখারি: ৫০]

📘 আল্লাহকে মানুন নিরাপদ থাকুন > 📄 আল্লাহকে ভয় না করার চারটি কারণ

📄 আল্লাহকে ভয় না করার চারটি কারণ


এক.
আল্লাহ -কে ভয় না করার প্রথম কারণ- উদাসীনতা। কারো মনে উদাসীনতা ঝেঁকে বসলে সে নিজেকেই ভুলে যায়। তার পক্ষে সরল পথে থেকে সঠিক চিন্তা করা সম্ভব হয় না। উদাসীনরা আল্লাহকে স্মরণ করে না। কোন কিছু বুঝেও বোঝে না।
আল্লাহ বলেন-
কতক মানুষ আছে, যাদের অন্তর আছে, কিন্তু অন্তর দ্বারা কিছু বোঝে না। তাদের কান আছে, কিন্তু কান দ্বারা তারা শোনে না। তাদের চোখ আছে, কিন্তু সে চোখে তারা দেখে না।
আল্লাহ বলেন-
এতে উপদেশ রয়েছে তার জন্য, যার অনুাবন করার মত অন্তর রয়েছে। অথবা সে নিবিষ্ট মনে শ্রবণ করে। [সূরা ক্বাফ : ৩৭]
মানুষ মাত্রই প্রত্যেকের অন্তর রয়েছে। কিন্তু কারো অন্তর জীবিত। কারো অন্তর মৃত। আল্লাহ বলেন-
তারা কি কোরআন সম্বন্ধে গভীর চিন্তা করে, না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ! [সূরা মোহাম্মদ : ২৪]
উদাসীনদের অন্তরে অন্ধকার ছেয়ে যায়। তাদের অন্তর তালাবদ্ধ হয়ে যায়। তারা আল্লাহ -র প্রতিশ্রুতি ভুলে যায়। আল্লাহর যিকির ভুলে যায়। নসিহত শোনে, কিন্তু গ্রহণ করে না। বোঝার চেষ্টা করে না। তাদের অন্তরে মহর আঁটা। তাদের অন্তরালোক নিভে গেছে। সে অন্তর আর আলোকিত হয় না।
দুই.
আল্লাহ -র ভয় অন্তর থেকে মুছে যাওয়ার দ্বিতীয় কারণ- গোনাহ ও পাপাচার। বান্দাকে আল্লাহভোলা বানাতে গোনাহ ও পাপ কাজের ভয়াবহ কুপ্রভাব রয়েছে। গোনাহর কারণে অন্তরে অন্ধকার ছেয়ে যায়।
একের উপর এক অন্ধকার। যখন সে তার হাত বের করে, তখন তাকে একেবারেও দেখতে পায় না। আল্লাহ যাকে জ্যোতি দেন না, তার কোন জ্যোতিই নেই। [সূরা নূর: ৪০]
গোনাহ বান্দার মনে প্রথমে সঙ্কীর্ণতা তৈরি করে। ক্রমে অন্তরে মরিচা পড়ে। মরিচার ছাপ পড়ে যায়। অন্তর মহরাঙ্কিত হয়ে যায়।
অন্তর উদাসীনতা দ্বারা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয় মুমিনের। অন্তর মরিচা-আক্রান্ত হয় ফাসেকের। ক্রমধারায় শেষ পরিণতিতে মহরাঙ্কিত হয় কাফেরের।
মুমিনের অন্তরের উদাসীনতার ব্যাপারে রাসূল বলেন-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ تُوبُوا إِلَى اللَّهِ وَاسْتَغْفِرُوهُ فَإِنِّي أَتُوبُ إِلَى اللَّهِ وَأَسْتَغْفِرُهُ فِي كُلِّ يَوْمٍ مِائَةَ مَرَّةٍ أَوْ أَكْثَرَ مِنْ مِائَةِ مَرَّةٍ
হে লোকসকল! আল্লাহর কাছে তাওবা কর। ক্ষমা চাও। আমি প্রতিদিন শতবারের চেয়ে বেশি আল্লাহর কাছে তাওবা করি। [আহমাদ: ১৮২৯৪]
يَا أَيُّهَا النَّاسُ تُوبُوا إِلَى اللَّهِ وَاسْتَغْفِرُوهُ إِنَّهُ لَيُغَانُ عَلَى قَلْبِي وَإِنِّي لَأَسْتَغْفِرُ اللَّهَ فِي الْيَوْمِ مِائَةَ مَرَّةٍ
হে লোকসকল! আল্লাহর কাছে তাওবা কর। ক্ষমা চাও। কারণ অন্তরে উদাসীনতা ভর করে। প্রতিদিন আমি শতবার আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই। [মুসলিম : ৭০৩৩]
অন্তরে মরিচা ধরার কথা আল্লাহ স্বয়ং বলেছেন-
তারা যা করে, তাই তাদের অন্তরে মরিচা ধরিয়ে দিয়েছে। [সূরা মুতাফফিফীন : ১৪]
এই আয়াতে কাফের ও ফাসেক সকলেই অন্তর্ভুক্ত।
তিন.
আল্লাহ-র ভয় অন্তর থেকে ধীরে ধীরে কমে যাওয়ার তৃতীয় কারণ-সুন্নাত মুস্তাহাব বাদ দিয়ে অধিকহারে বৈধ পন্থা অবলম্বন করা। যেমন, দুনিয়ার গর্বোদ্দীপক বস্তু গ্রহণ করা, প্রাচুর্যশীল হওয়া, দুনিয়াকে আখেরাতের উদ্দেশ ও চাহিদার উপর প্রাধান্য দেয়া, আল্লাহর অত্যধিক মর্জির বাইরে কিছু করা ইত্যাদি।
বাস্তবতা হল, আজ আমরা প্রায় সবাই এই সমস্যায় আক্রান্ত।
চার.
অন্তর থেকে আল্লাহ -র ভয় কমে যাওয়ার চতুর্থ কারণ- সময় নষ্ট করা। কেয়ামতের দিন বান্দা থেকে সময়ের হিসাব নেয়া হবে কড়ায়গন্ডায়। অধিকাংশ মুসলমানই অর্থ-সম্পদের ব্যাপারে সজাগ থাকলেও সময়ের ব্যাপারে উদাসীন। মানুষের দিনরাত চলে যায়, সময়ের ব্যাপারে তাদের এতটুকু সচেতনতাও জাগে না।

📘 আল্লাহকে মানুন নিরাপদ থাকুন > 📄 সময়ের সদ্ব্যবহার

📄 সময়ের সদ্ব্যবহার


সময় দ্বারা লাভবান হওয়ার সবচেয়ে উপযোগী ব্যবস্থা হল আল্লাহর ফরযসমূহ আদায় করা।
ইবনে তাইমিয়া -কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, 'মানুষ সন্দেহ-সংশয় এবং কুপ্রবৃত্তির রোগ থেকে বাঁচার জন্য ব্যবস্থাপত্র কী হতে পারে?'
তিনি বললেন, 'এই রোগ থেকে বাঁচার মহৌষধ হলো ফরযসমূহ নিগূঢ় ও বাহ্যিকভাবে শুদ্ধ ও পরিপূর্ণরূপে আদায় করা।'
নিগূঢ়তায় শুদ্ধতার স্বরূপ হল একমাত্র আল্লাহর জন্য নিষ্ঠাপূর্ণ নিয়ত রাখা। সালাতের জন্য যখন দাঁড়াবে, মনে করবে, আমি আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়েছি। এভাবে অন্তরকে আল্লাহর দিকে ধাবিত রাখা।
বাহ্যিকভাবে শুদ্ধতার স্বরূপ হল রাসূল -এর সুন্নাত অনুযায়ী তা পালন করা।
সময় দ্বারা লাভবান হওয়ার জন্য ফরযসমূহ যথাযথভাবে আদায় করার পর সবচেয়ে উপযোগী হল নফল এবাদতে মনোযোগী হওয়া।
ইবনুল জাওযি সাইদুল খাতির গ্রন্থে লিখেন, আশ্চর্য! যে তার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত, সে কিভাবে আল্লাহর আনুগত্য ছাড়া একটি নিঃশ্বাস ফেলতে পারে!
তিনি একটি হাদিস উল্লেখ করেন- রাসূল ইরশাদ করেন-
যে একবার সুবহানাল্লাহিল আযীমি ওয়াবিহামদিহী পাঠ করে, তার জন্য জান্নাতে একটি খেজুর গাছ রোপিত হয়। [তিরমিযি : ৩৪৬৪]
হাদিসটি উল্লেখ করে তিনি লিখেন, আফসোস! কত খেজুর গাছ আমাদের হাতছাড়া হচ্ছে! কারণ আমরা আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করছি না।
আবু কাসেম মাগরিবি ইবনে তাইমিয়া -কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'ফরযসমূহের পর কোন আমলের প্রতি আপনি বেশি গুরুত্ব প্রদান করেন?'
ইবনে তাইমিয়া বলেন, 'ফরযসমূহের পর সবচেয়ে মহান উত্তম ও ফলপ্রদ আমল আল্লাহর যিকির ছাড়া আর কিছু আছে বলে আমার জানা নেই। এবাদতের মধ্যে সবচেয়ে সহজতর এবাদত এটিই।'
আল্লাহ বলেন-
জেনে রাখ, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়। [সূরা রা'দ : ২৮]
তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদের স্মরণ রাখবো। [সূরা বাকারা : ১৫২]

লিঙ্ক শেয়ার করুন
close

লিঙ্ক কপি করুন