📄 তাকওয়ার অন্যতম নিদর্শন সালাত
তাকওয়ার অন্যতম নিদর্শন সালাত। যথাগুরুত্বের সাথে সালাত আদায়কে আল্লাহ তাঁর বিধান রক্ষার অন্তর্ভূক্ত করেছেন। বলেছেন- অবশ্যই সফলকাম হয়েছে বিশ্বাসীরা ... যারা তাদের সালাতে যত্নবান।' [সূরা মুমিনূন: ৯]
যারা যথাগুরুত্বের সাথে সালাতের যত্নবান হয়, যথাসময়ে জামাতের সাথে স্থির অঙ্গে অন্তরপূর্ণ সালাত আদায় করে, আল্লাহ তাঁদের সহায় হন। পৃথিবীর নষ্ট সময়েও আল্লাহ তাঁদের সুরক্ষা দান করেন।
সালাত বিরত রাখে অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে। [আনকাবূত: ৪৫]
ওমর ইবনে খাত্তাব মৃত্যুশয্যায় শায়িত। দুচোখ গড়িয়ে দরদর পানি ঝরছে। কণ্ঠ অস্ফুট হয়ে আসছে। তখনও তিনি বলছেন-
اللَّهُ اللَّهُ فِي الصَّلَاةِ لَا حَقٌّ فِي الإِسْلَامِ لِمَنْ تَرَكَ الصَّلَاةَ
তোমরা সালাতের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। সালাত তরককারীর জন্য ইসলামে কোন অংশ নেই। [মুয়াত্তা মালেক: ৮৪]
যে সালাতে গুরুত্ব দিবে, আল্লাহ তাকে গুরুত্ব দিবেন। যে সালাতে বিমুখ হবে, আল্লাহ তাকে ধ্বংস করবেন।
ওমর ইবনে খাত্তাব তাঁর প্রাদেশিক শাসক ও আমিরদের কাছে সালাতের গুরুত্ব দিয়ে চিঠি পাঠাতেন। চিঠিতে লিখতেন, 'তোমাদের জন্য সালাত আবশ্যক। সালাত হল ইসলামের প্রথম ভিত্তি। ধর্মজীবনে তোমরা সর্বশেষ সালাত ছেড়ে দিবে।'
সালাতের গুরুত্ব দিয়ে আল্লাহ মহান ইরশাদ করেছেন-
তোমরা সালাতের প্রতি যত্নবান হবে, বিশেষত মধ্যবর্তী সালাতের। [বাকারা: ২৩৮]
📄 সালাতে মগ্ন হওয়ার তিন পদ্ধতি
১. সময়মত সালাত আদায় করা। কারণ, অপ্রয়োজনে সালাতের সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলে আল্লাহ সেই সালাত কবুল করেননা। আল্লাহ সেই সালাত মুসল্লির মুখে জড়িয়ে নিক্ষেপ করেন। তখন সালাত মুসল্লিকে ভর্ৎসনা করে। আল্লাহর কাছে বদদোয়া করে বলে, 'তুমি আমাকে উপেক্ষিত করেছো, আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করুন।'
কেয়ামতের দিনে মানুষের চেহারা বিবর্ণ হয়ে যাবে। অসাড় হয়ে যাবে মানুষের বিবেক-বুদ্ধি। তখন সর্বপ্রথম মানুষের সালাতের হিসাব নেয়া হবে। সালাতের হিসাবে যে উত্তীর্ণ হবে, ভয়াবহ সে সন্ধিক্ষণে আল্লাহ তাকে হেফাযত করবেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাসুল-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'সর্বোত্তম আমল কোনটি?' রাসুল উত্তর করলেন, 'সর্বোত্তম আমল হল সময়মত সালাত আদায় করা।' [বুখারি: ৫৯৭০]
২. সর্বদা জামাতের সাথে সালাত আদায় করা। মসজিদে মিনারে যখন আযান ধ্বনিত হয়, মুয়াযযিন যখন চিরহীতাকাঙ্ক্ষী হয়ে ডাক দিয়ে যায় মধুর আহ্বানে- 'সালাতের দিকে আস...' 'সফলতার দিকে আস...' তখন আর বিলম্ব না করা। অলসতা ঝেড়ে মসজিদে চলে আসা। মনে মনে বিশ্বাসের সাথে স্মরণ রাখা, আমি মসজিদে জামাতের সাথে সালাত আদায় করবো, আলিমুল গাইব আল্লাহ আমার সহায় হবেন।
৩. খুশু-খুযুর সাথে সালাত আদায় করা। ইবনুল কায়্যিম সালাতে খুশু-খুযূর বর্ণনা দিয়ে বলেন, 'ইমাম মনের মাধুরি মিশিয়ে সালাতে কোরআন তেলাওয়াত করবেন, মুসল্লি হৃদয়ের সোহাগ মিশিয়ে তেলাওয়াত শুনবে। মুসল্লির হৃদয়পটে সে উদার তেলাওয়াত পরম প্রেমাক্ষরে উৎকীর্ণ হবে। পার্থিব জীবনের পাথেয় হিসেবে কোরআনের শিক্ষাবিলাস ঘটনাগুলো মর্মে অনুধাবন করবে। মনেপ্রাণে অনুভব করবে, যেমন সালাতের সারিতে শান্ত মনে দাঁড়িয়ে আছি, তেমনই আখেরাতে বিস্তৃত আঙ্গিনায় প্রশান্ত চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকবো আল্লাহর সামনে!'
📄 অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুরক্ষা
আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের গোনাহ থেকে হেফাযত করেন। প্রিয় বান্দাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গোনাহ থেকে বাঁচিয়ে আল্লাহর আনুগত্যে অবনত রাখেন। গোনাহের উৎপত্তিস্থল অন্তর এবং যবানকে সর্বতো হেফাযত রাখেন।
📄 অন্তর গোনাহমুক্ত রাখার স্বরূপ
অন্তর মানুষের সকল গোনাহের উৎপত্তিস্থল। মানুষের অন্তর যখন গোনাহের প্রণোদনা থেকে মুক্ত থাকে, তখনই সকল গোনাহের পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র থাকা সম্ভব হয়।
আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের অন্তর গোনাহমুক্ত রাখেন। কুপ্রবৃত্তি থেকে, কামনা-বাসনা ও লোভ-লালসা থেকে, সর্বোপরি শাহওয়াত থেকে সুরক্ষিত রাখেন। শরিয়তের কোন বিধানে সংশয়, অনিশ্চয়তা ও অস্পষ্টতা থেকে, সর্বোপরি শুবুহাত থেকে মুক্ত রাখেন।
প্রতিটি মানুষের শরীরে একটি মাংসখণ্ড রয়েছে। এ মাংসখণ্ডটি যতক্ষণ সুরক্ষিত থাকে, মানুষ ততক্ষণ গোনাহমুক্ত থাকে। এ মাংসখণ্ডটি যখন বিনষ্ট ও বিপদগ্রস্ত হয়, মানুষও তখন বিপথে চলতে থাকে। গোনাহের পথে ধ্বংস হতে থাকে। সে মাংসখণ্ডটি হল মানুষের অন্তর। রাসুলের ভাষায় বিষয়টি এমন-
জেনে রাখ, শরীরের মধ্যে একটি গোশতের টুকরো আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখ, সে গোশতের টুকরোটি হল অন্তর। [বুখারি: ৫২]
অর্থাৎ, মানুষ যখন আল্লাহর আনুগত্যে, আল্লাহর সদাস্মরণে অন্তরকে পরিশুদ্ধ রাখবে, মানুষের হাত, পা, চোখ, কান, পেট, যৌনাঙ্গ সবকিছু তখন গোনাহমুক্ত থাকবে।
কেয়ামতের দিন হিসাবের বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য মানুষের পরিবার-পরিজন, ধন-দৌলত সবকিছুই অনর্থ অকার্যকার বিবেচিত হবে। হিসাবের বিপদ থেকে পরিত্রাণের জন্য কার্যকর হবে একমাত্র পরিশুদ্ধ অন্তর।
যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবেনা। সেদিন উপকৃত হবে কেবল সে, যে আল্লাহর নিকট আসবে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে। [সূরা শুয়ারা: ৮৮, ৮৯]
বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ, অর্থাৎ যে অন্তরে কামনা-বাসনা, লোভ-লালসা, শরিয়তের কোন বিধানে সংশয়, অনিশ্চয়তা, অস্পষ্টতা, সর্বোপরি শাহওয়াত ও শুবুহাতের অনুপ্রবেশ নেই।
পরিশুদ্ধ অন্তর, অর্থাৎ যে অন্তরের ধ্যানে-মগ্নে, সদাস্মরণে আল্লাহই শুধু চিরজাগ্রত। যে অন্তরের শ্বাসে-প্রশ্বাসে, আবেগ-উচ্ছ্বাসে শুধু এক অনুরণন- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ...
মানুষের অন্তর যখন শাহওয়াত ও শুবুহাতের গুপ্তরোগ থেকে আরোগ্য পাবে, শিরক নেফাক ও রিয়া থেকে পবিত্র থাকবে, সে অন্তর আল্লাহর একত্বে ও বড়ত্বে পরিপূর্ণ থাকবে। এখলাস ও সততায় নিষ্ঠ হয়ে ওঠবে। মানুষের অহংকার ও দম্ভ যখন চূর্ণ হবে, মনের সকল দ্বেষ-বিদ্বেষ, হিংসা-বিরাগ দূর হবে। মানুষ তখন মহান আল্লাহর প্রেমতাড়িত ভয়ে সদাপ্রকম্পিত থাকবে। আল্লাহর ভরসায়, তাঁর দয়ার আশায় দুনিয়া সকল কিছু থেকে বিমুখ থাকবে। এমন মানুষের অন্তর হবে ইবরাহিম -র অন্তরের মত।
আর ইবরাহিম তাঁর অনুগামীদের অন্তর্ভুক্ত। স্মরণ কর, সে তাঁর প্রতিপালকের নিকট উপস্থিত হয়েছিল বিশুদ্ধচিত্তে। [সূরা সাফফাত: ৮৩, ৮৪]
যে আল্লাহকে বিশ্বাস করে, আল্লাহ তাঁর অন্তরকে সুপথে পরিচালিত করেন। [তাগাবুন: ১১]
অর্থাৎ, যে আল্লাহকে সেজদা করে, আল্লাহ তাঁকে সুপথে পরিচালিত করেন। যে মসজিদে গমন করে, আল্লাহর দরবারে মোনাজাতের বিনীত হাত উত্তোলন করে, আল্লাহ তাঁর অন্তরকে জ্যোতির্ময় ভুবনে বিচরণ করান। আল্লাহ বলেন-
যারা আমার উদ্দেশ্যে সংগ্রাম করে আমি তাদের অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করবো। আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণদের সাথে থাকেন। [সূরা আনকাবূত: ৬৯]
যে দীনের কোন আলোচনায় বসে, দীনের কোন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে, ভালো কাজে অগ্রসর হয়, আল্লাহ তাঁর সাথে অনর্থ ও অশ্লীল আড্ডাবাজ, গান ও নেশার আসরে অংশগ্রহণকারী, মাস্তি ও ফুর্তিবাজ, প্রমোদবাজদের সাথে পার্থক্য রেখেছেন। ইরশাদ করেছেন-
আমি কি আত্মসমর্পণকারীদেরকে অপরাধীদের সদৃশ গণ্য করবো! তোমাদের কী হয়েছে? এ তোমরা কেমন সিদ্ধান্ত দিচ্ছ! [সূরা ক্বলম: ৩৫, ৩৬]
যে হেদায়াতের বাণী শুনে বিমুখ হয়, দীনের আলোচনা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে, ভ্রুকুঞ্চন করে, সে মহাবিপর্যয়ের উন্মুক্ত দ্বারে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
তারা যেমন প্রথমবার এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেনি, তেমন আমিও তাদের অন্তরে দৃষ্টিতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবো। তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াতে ছেড়ে দিবো।' [সূরা আনয়াম: ১১০]
সকল মুমিনের জন্য অপিহার্য কর্তব্য হলো তাঁর অন্তর সর্বান্তকরণে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করা। তাহলেই আল্লাহ তাঁকে সঠিক পথের পথিক বানাবেন। আল্লাহ বলেন-
এতে উপদেশ রয়েছে তার জন্য, যার রয়েছে অন্তঃকরণ, অথবা যে শ্রবণ করে নিবিষ্ট চিত্তে। [সূরা ক্বফ, ৩৭]
আল্লাহ সকলকেই অন্তর দিয়েছেন, কিন্তু অন্তরালোকসম্পন্ন সফল অন্তর ক'জনের আছে! কোরআনের ভাষায়-
মানুষের চর্মচোখ অন্ধ হয়না, বরং অন্ধ হয় তাদের বক্ষস্থ অন্তরালোক। [সূরা হজ্জ: ৪৬]
যে ব্যক্তি জানে যে, যা কিছু পালনকর্তার পক্ষ থেকে আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা সত্য, সে কি ঐ ব্যক্তির সমান যে অন্ধ? তারাই বোঝে, যারা বোধশক্তিসম্পন্ন। [সূরা রাদ: ১৯]
এজন্যই যেসব লোক তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা উপকৃত হয়নি, আল্লাহ তাদের ভৎসনা করেছেন। তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করে তাদের পরিচয় দিয়েছেন। বলেছেন-
আমি বহু জিন ও মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় আছে, কন্তুি তা দ্বারা তারা উপলব্ধি করেনা। তাদের চোখ আছে, কিন্তু তা দ্বারা দেখেনা। তাদের কান আছে, তা দ্বারা শোনেনা। তারা পশুর ন্যায়, না, পশু অপেক্ষাও অধিক মুঢ়। তারাই উদাসীন। [সূরা আরাফ: ১৭৯]
অন্তরের গুপ্তরোগ অনেক ধরণের। মানুষ অজান্তে অসচেতনতায় এসব গুপ্তরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাই অন্তরের ব্যাপারে সজাগ থাকা, অন্তরকে যথানির্দেশ করা, গুপ্তরোগের সমূহ আশঙ্কা থেকে বাঁচিয়ে সতর্ক রাখা সকল মুসলমানের আবশ্যক দায়িত্ব।
আল্লাহর কাছে মানুষের ভাল কাজের গ্রহণযোগ্যতার পরিমাপক মানুষের অন্তর। যাঁর অন্তরে আল্লাহর ভালবাসা ও বড়ত্ব ভরপুর, তাঁর ভাল কাজের গ্রহণযোগ্যতা আল্লাহর কাছে অত্যুচ্চ। এই অন্তরের অবস্থাভেদের কারণেই একই ভাল কাজের দুই সম্পাদনকারীর প্রতিদান ও মর্যাদার মাঝে আকাশ-পাতাল পার্থক্য দাঁড়িয়ে যায়। রাসুল ইরশাদ করেন-
জেনে রাখ, শরীরের মধ্যে একটি গোশতের টুকরো আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখ, সে গোশতের টুকরোটি হল অন্তর। [বুখারি : ৫২]