📄 কারুন
কারুনের ঘটনা। আল্লাহ ﷻ তাকে সম্পদ দিয়েছিলেন অঢেল। অকল্পনীয়। কিন্তু সে আল্লাহকে মানেনি। শুভাকাঙ্ক্ষীদের গুরুত্ব দেয়নি। সদুপদেশে কর্ণপাতও করেনি। সে বরং দম্ভ করেছিল। অহমিকায় ফেঁপে উঠেছিল। বলেছিল-
إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِنْدِي
আমি আমার জ্ঞানবলে এই সম্পদ প্রাপ্ত হয়েছি। [কাসাস: ৭৮]
পরিণামে আল্লাহ তাকে চূর্ণ করেছিলেন। তার ঘরবাড়িসহ ভূগর্ভস্থ করেছিলেন। কারুনের দুনিয়া ধ্বংস হয়েছে। আখিরাতও ধ্বংস হয়েছে। কারুনের সর্বধ্বংস হয়েছে।
📄 বারামেকি মন্ত্রীগণ
আব্বাসি খেলাফতযুগের একটি ঘটনা। বাদশাহ হারুনুর রশিদের কতক মন্ত্রী ছিল। জাতি হিসেবে তারা ছিল বারামেকি। পরিবারসহ তারা একটি কলোনিতে বসবাস করত। আল্লাহ -র রহমতে যেন সম্পদের সামিয়ানায় সুখছায়া উপভোগ করছিল তারা। আল্লাহ তাদের দান করেছিলেন রাশি রাশি সোনা রূপা আর কাড়ি কাড়ি সম্পদ। তাদের ছিল রঙ-বেরঙয়ের বহুতল ভবন। কোন কোন ভবনের পলেস্তরায় ছিল স্বর্ণধোয়া প্রলেপ。
তারা এতকিছু পেয়েছে, কিন্তু আল্লাহকে পায়নি। ফলে তারা কিছুই পায়নি। তারা আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করেছে। তাদের বহুতল ভবনে ছিল বহুধরণের গোনাহ। ছিলো সীমালঙ্ঘন আর অবাধ্যতা। তাদের ভবনে চলতো গানবাজনা, মদ্যপান, মাস্তি, আরো কত কি! এমনকি ন্যূনতম সালাতটুকুও তারা আদায় করতোনা।
তাদের অবাধ্যতা আল্লাহ জানতেন। আল্লাহ অবাধ্যকে সুযোগ দেন, ছেড়ে দেননা। আল্লাহ তাদের পাকড়াও করলেন।
আল্লাহ তাদের প্রিয়পাত্র বাদশাহ হারুনুর রশিদের হাতেই তাদের শাস্তি রচনা করলেন। বারামেকিদের সবচেয়ে প্রিয় ও বন্ধুভাবাপন্ন বাদশাহ হারুনুর রশিদ একদিন সকালবেলা ক্রোধের সূর্যাগ্নি নিয়ে তাদের সামনে তেজিয়ে দাঁড়ালেন। দুপুর গড়ানোর আগেই তলোয়ারের সূর্যতেজ আঘাতে যুবকদের হত্যা করলেন। কারান্তরীণ করলেন বৃদ্ধদের। রুমে-রুমে বন্দী করলেন নারীদের। শিশু কিশোরদের আবদ্ধ রাখলেন কলোনীর নির্দিষ্ট সীমায়, এক মুক্ত জেলখানায়। আল্লাহর অবাধ্যতার সে কি করুণ পরিণতি! চারদিকে কান্না, কান্না। রক্তভেজা কান্না!
বারামেক গোত্রের জনৈক ব্যক্তি ইয়াহইয়া ইবনে খালেদ বারামেকি। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, কোন অপরাধে তোমাদের এ করুণ পরিণতি? সম্পদের সামিয়ানায় সুখছায়ার বদলে দুঃখের অন্ধকার নেমে আসলো কেন? কেন আজ বহুতল ভবনের পলেস্তরায় স্বর্ণধোয়া প্রলেপের পরিবর্তে রক্তলাল প্রলেপ?
ইয়াহইয়া ইবনে খালেদ কেঁদে ফেললেন। বললেন, 'মজলুমের আর্তনাদ রাতের আঁধারকে গাঢ় করে তুলেছে। আমরা উদাসীন ছিলাম, কিন্তু আল্লাহ উদাসীন হননি।'
আলি ইবনে হোসাইন -কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, 'আল্লাহর আরশ এবং যমিনের মাঝে দূরত্ব কতটুকু?' তিনি উত্তর করেছিলেন, 'আরশ এবং যমিনের মাঝে দূরত্ব শুধু আল্লাহর কাছে মাকবুল দোয়া।'
আলী ইবনে হোসাইন তাঁর উত্তরে মাইল বা কিলোমিটারের দূরত্ব নির্ণয় করেননি। তিনি বলেছেন, 'আরশ এবং যমিনের মাঝে দূরত্ব শুধু আল্লাহর কাছে মাকবুল দোয়া।' মকবুল দোয়া আল্লাহ মেঘরাশির উপর তুলে নেন। সেখান থেকে তা মুহূর্তে আল্লাহর কাছে পৌঁছে। অতপর আল্লাহ বলেন- 'আমার ইযযতের কসম! আমার সম্মানের কসম! একটু বিলম্বে হলেও আমি তোমার সাহায্য অবশ্যই করবো!'
এ মর্মে রাসুল ﷺ থেকে সহিহ সূত্রে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। মুয়ায কে রাসুল ﷺ বলেছিলেন-
وَاتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ فَإِنَّهُ لَيْسَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ اللَّهِ حِجَابٌ
মজলুমের দোয়াকে ভয় কর। মাযলুমের দোয়া এবং আল্লাহর মাঝে কোন আড়াল নেই।
বাদশাহ হারুনুর রশিদের হাতে বারামেকিদের ভয়াবহ শাস্তি রচিত হলো। যুবকদের হত্যা করা হলো। বৃদ্ধদের সাত বছর বন্দী করে রাখা হলো। তাদের বন্দীজীবনও ছিল অত্যন্ত দুর্বিষহ। বন্দীজীবনে তাদের চুল মোচ নখ কাটার জন্য কোন কাঁচির ব্যবস্থা ছিলোনা। ফলে চুল মোচ নখ দীর্ঘ লম্বা আকার ধারণ করেছিলো। দাঁত পরিষ্কার করার জন্য একটি মেসওয়াকের ব্যবস্থাও ছিলোনা। এমনকি তারা যেখানে থাকতো, সেখানেই প্রাকৃতিক প্রয়োজন সাড়তে হতো। সুখময় প্রাচুর্যময় জীবনের পর এই ছিলো তাদের বন্দীশালার জীবন। রেশমি আর সোনালি জীবনের পর এই ছিলো তাদের লৌহশিকের জীবন।
তাদের অবশিষ্ট জীবন যাপিত হলো ক্ষীণ আশায়, স্বল্প স্বপ্নের আবদ্ধে, তারা অবতীর্ণ হলো অপদস্থের ভূতলে, এককাল প্রতিপত্তির পর।
সেসব পরাস্ত লোকেরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি আর কখনও।
কতই না নিকৃষ্ট তাদের সে অবস্থান!
আল্লাহ সত্যই সকল হেকমতের আধার। আল্লাহ সকল বিষয়ের সমাধানকারী। আল্লাহর হাতেই সকল নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি। তিনি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দান করেন, সম্মানিত করেন। আবার রাজত্ব ছিনিয়ে নেন, অপদস্থ করেন।
📄 খলিফা কাহের
আব্বাসি খেলাফতযুগে কাহের নামীয় এক খলিফা ছিলেন। একবার তিনি ভবিষ্যতের সাম্ভাব্য সঙ্কটকালের চিন্তা করে কিছু সম্পদ গচ্ছিত রাখার মনস্থির করলেন। মাটিতে একটি গর্ত খনন করে স্বর্ণ-রূপা ভর্তি করে রাখলেন। তিনি আল্লাহর উপর ভরসা করলেননা। সন্তানদের ডেকে বললেন, 'আমার আদরের ছেলেরা, তোমাদের জন্য বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ-রূপার ডিবি খনন করে রেখেছি। গচ্ছিত এই স্বর্ণ-রূপা যদি সমগ্র বাগদাদবাসীর মাঝে বিতরণ করা হয়, তাহলে সকলে বড় ব্যবসায়ী হয়ে যাবে। সুতরাং তোমাদের ভবিষ্যতজীবনে দারিদ্রের ভয় করোনা'।
এভাবে কাহের যখন আল্লাহর অবাধ্য হল, সীমালঙ্ঘন করল, আল্লাহ তার রাজত্ব ছিনিয়ে নিলেন। শাসকের রাজমুকুট তার মাথা থেকে খসে পড়লো। তার দৃষ্টিশক্তি জরাগ্রস্ত হল। তার শাসনকাজ পরবর্তী খলিফার কাছে হস্তান্তর হলো। অতপর একদিন তিনি বাগদাদের মসজিদে দাঁড়িয়ে সমবেতদের বললেন, ‘লোক সকল, সম্পদ থেকে দূরে থাক। আমার সম্পদ আমাকে শেষ করেছে!’
সমবেত লোকজন বলাবলি করতে লাগলো, ‘দেখো দেখো, ঐ অপদস্থকে দেখো। আল্লাহ তাকে কেমন অপদস্থ বানিয়েছেন!’
এতে উপদেশ রয়েছে তার জন্য, যার অনুধাবন করার মত অন্তর রয়েছে। অথবা সে নিবিষ্ট মনে শ্রবণ করে। [সূরা ক্বফ: ৩৭]