📄 আল্লাহওয়ালাদের স্তর
ওলামায়ে কেরাম আল্লাহওয়ালাদের দুটি স্তর বলে থাকেন। একটি সাধারণ স্তর, অপরটি বিশেষ স্তর।
ইবনে তাইমিয়া -এর দৃষ্টিতে মানুষ তিন প্রকার। যেমনটা আল্লাহ নিজেই বলেছেন-
অতঃপর আমি কিতাবের অধিকারী করেছি তাদেরকে যাদের আমি আমার বান্দাদের মধ্য থেকে মনোনীত করেছি। তাদের কেউ কেউ নিজের প্রতি অত্যাচারী, কেউ মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী এবং কেউ আল্লাহর নির্দেশক্রমে কল্যাণের পথে এগিয়ে গেছে। [সূরা ফাতির: ৩২]
আয়াতে উল্লিখিত নিজের উপর অত্যাচারী হলো সেই ব্যক্তি, যে মাঝেমধ্যে ওয়াজিব ছেড়ে দেয়। মাঝেমধ্যে কবীরা গোনাহে লিপ্ত হয়।
মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী- যিনি আল্লাহর ফরয ও ওয়াজিবসমূহ আদায় করেন। কবীরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকেন। তবে কখনও কখনও মুস্তাহাব আমল তার থেকে ছুটে যায় এবং মাকরূহ বিভিন্ন কাজে তিনি লিপ্ত হয়ে পড়েন।
কল্যাণের পথে অগ্রসর- যিনি ফরয ও ওয়াজিবসমূহ আদায় করার পাশাপাশি মুস্তাহাব এবাদত করে আল্লাহ -এর নৈকট্য অর্জন করেন। কবীরা গোনাহ থেকে বাঁচার পাশাপাশি সগীরা গোনাহ এবং মাকরূহ গোনাহ থেকেও বেঁচে থাকেন।
ইবনুল কাইয়ূম এর দৃষ্টিতে তিনিই কল্যাণের পথে অগ্রসর ব্যক্তি, যিনি ঘুমিয়ে গেলে তার অন্তর আরশের পাশে প্রদক্ষিণ করে। তার অন্তর সবসময় আল্লাহ -এর স্মরণে জাগ্রত থাকে। গভীর রাতে ঘুম থেকে জাগেন। অজু করেন। আল্লাহ -এর জন্য ভীত অন্তরে ত্রস্ত হয়ে পড়েন। সালাত পড়েন। নিভৃতে আল্লাহ -এর কাছে মনের আলাপন তুলে ধরেন। তার ইচ্ছা ও ভালোবাসার সকল অভিসার, অন্তর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সকল মিনতি আল্লাহর কাছে ঝরে পড়ে। নিজের জন্য তার কোন চাওয়া-পাওয়া থাকে না।
হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন-
مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا فَقَدْ بَارَزَنِي بِالْحَرْبِ
যে আমার কোন অলির সাথে শত্রুতা করল, সে আমার সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হল। [সহিহ বুখারি : ৬৫০২]
কোন মুসলমানের সাথে শত্রুতা, রাগ-গোস্বার পর দুজন আন্তরিক বন্ধু হয়ে গেলেও কি শত্রুতা বলে বিবেচিত হবে!
কিছু ঝগড়া-বিবাদ, বিতর্ক-বিরোধিতা শত্রুতার মধ্যে গণ্য নয়। আল্লাহ -এর বন্ধুত্বের টানে পারস্পরিক তর্ক-বিবাদ শত্রুতার অন্তর্ভুক্ত নয়। যেমন আবু বকরের প্রতি রাফেযিদের শত্রুতা, আলীর প্রতি নাসেবিদের শত্রুতা, মুমিনদের সাথে কাফের-মুনাফেকদের শত্রুতা ও ঠাট্টা-বিদ্রূপ, আহলে সুন্নাতের সাথে বিদয়াতপন্থীদের শত্রুতা রয়েছে। কিন্তু এগুলো আবু বকর, আলী, মুমিন ও আহলে সুন্নতের দিক থেকে শত্রুতা নয়। কারণ, এগুলো হয়েছে আল্লাহ -এর সাথে তাদের বন্ধুত্বের খাতিরে।
তদ্রূপ আলেমদের পরস্পর বিতর্ক ও মতানৈক্য, সহজাত পরমত-অসহিষ্ণুতা মূলত আল্লাহওয়ালাদের সাথে শত্রুতা নয়।
যে আমার কোন অলির সাথে শত্রুতা করল, সে আমার সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হল। [সহিহ বুখারি : ৬৫০২]
আল্লাহ-র সাথে যুদ্ধে মুখোমুখি হওয়ার অর্থ- বান্দা এমন অবস্থার সম্মুখীন হবে, যাতে তার ধ্বংস অনিবার্য। বান্দা আল্লাহ- -র সাথে এমন আচরণ করবে, যাতে আল্লাহ রাগ হন। আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দেন।
বান্দা সবসময় নফল এবাদতদ্বারা আল্লাহ-র নৈকট্য অর্জন করতে থাকবে, একসময় আল্লাহ তাকে ভালবাসবো।
ফরয বিধান নফলের তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ। তবু নফলকে আল্লাহ-র ভালোবাসা ও নৈকট্যলাভের পন্থা হিসেবে নির্ণয় করা হয়েছে। কারণ নফল আদায়ে ঐ ব্যক্তিই আন্তরিক ও ব্রতী হন, যিনি ফরযসমূহ যথাযথভাবে পালন করেন। আল্লাহর ভয়েই শুধু নয়, আল্লাহর নৈকট্য ও ভালোবাসা লাভের চেষ্টায় ফরযসমূহ আদায় করেন।
নফল দ্বারা যে কোন নফলই উদ্দেশ্য। সালাতের মধ্যে তাহাজ্জুদ, ইশরাক, সুন্নত, বিতর ইত্যাদি।
সালাত ছাড়াও সওম, হজ্জ, দান-সদকা ইত্যাদি।
অনেকে মনে করে, ফরযের অতিরিক্ত যেসব এবাদত রয়েছে, সেসব আদায় করলেই সে নফল আদায়কারী হয়ে গেল। যেমন ফজরের সালাত কাযা আদায় করে ইশরাকের দুই রাকাতের প্রতি খুবই গুরুত্ব দেখাল। এশার ফরয সালাত আদায় না করে তারাবির প্রতি খুবই আন্তরিকতা দেখাল। এগুলো ভুল।
যেমন হাদিসে কুদসিতে আছে-
كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِي يَسْمَعُ بِهِ، وَبَصَرَهُ الَّذِي يُبْصِرُ بِهِ، وَيَدَهُ الَّتِي يَبْطُشُ بِهَا، وَرِجْلَهُ الَّتِي يَمْشِي بِهَا
আমি তার কান হয়ে যাবো, যা দিয়ে সে শোনে। আমি তার চোখ হয়ে যাবো, যা দিয়ে সে দেখে। আমি তার হাত হয়ে যাবো, যা দিয়ে সে ধরে। আমি তার পা হয়ে যাবো, যা দিয়ে সে চলে। [সহিহ বুখারি: ৬৫০২]
ওলামায়ে কেরام হাদিসের এই অংশের একাধিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।
কারো মতে হাদিসে মূলত একটি তুলনামূলক বক্তব্য বিবৃত হয়েছে। অর্থাৎ, এই বান্দা আমার নৈকট্য ও আনুগত্য খুব ভালোবাসে, যেমন সে নিজের কান চোখ পা ভালোবাসে।
অনেকে ব্যাখ্যা প্রদান করেন- তার প্রতিটি অঙ্গ আমার সন্তুষ্টির চাদরে চলে আসে। তখন তার কান দিয়ে আমার সন্তুষ্টির কথাবার্তাই শোনে। তার চোখ দিয়ে আমার সন্তুষ্টির বস্তুই শুধু দেখে। তার পা দিয়ে আমার সন্তুষ্টির পথেই হাঁটে।
অনেকের ব্যাখ্যা অনুযায়ী আল্লাহ তার চোখ কান পায়ের হেফাযতকারী হয়ে যান।
তাকে প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে সর্বপ্রাণিধানযোগ্য ব্যাখ্যা হল, আল্লাহ আল্লাহ-র সন্তুষ্টি অর্জন করার তাওফিক দান করেন।
হাদিসের এই অংশের দু'টি ভুল ব্যাখ্যাও রয়েছে। একটি হলো সুফিদের গান-বাজনা সমর্থক গোষ্ঠি। তারা বলে, আল্লাহ যখন বান্দার কান হয়ে যাবেন, তখন বান্দা আর নিজ ইচ্ছায় গান-বাজনা শোনে না। আল্লাহ তাকে গান-বাজনা শোনান। তাকে গান-বাজনা শোনার সামর্থ্য দান করেন।
অপর একটি ব্যাখ্যা আহলে হুলূলদের। তাদের মতে, আল্লাহ কিছু বান্দার মধ্যে মিশে যান। আল্লাহ নিজেই সেই বান্দার মধ্যে মিশে তার কান চোখ পা ইত্যাদি হয়ে যান।
এ ধরণের ব্যাখ্যা সুস্পষ্ট কুফর ও অবিশ্বাসের নামান্তর। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন।
إِنْ سَأَلَنِي أَعْطَيْتُهُ
বান্দা যদি আমার কাছে কিছু চায়, অবশ্যই আমি তাকে দান করবো। [সহিহ বুখারি: ৬১৩৭]
বাস্তবতা হল, এমন অনেক আল্লাহওয়ালা পাওয়া যায়, যারা আল্লাহ-র কাছে কিছু চেয়েছেন, কিন্তু দুনিয়াতে তা পাননি।
এই দ্বিবিধ ভাষ্যের মীমাংসা হল বান্দার দোয়ার প্রেক্ষিতে আল্লাহ কখনও তাকে দুনিয়াতে যা ইচ্ছা, দান করেন। আবার কখনও বান্দার দোয়া গচ্ছিত রাখেন এবং দুনিয়ার পরিবর্তে আখেরাতে তাকে দ্বিগুণ দান করেন। আবার কখনও কখনও এই দোয়ার উসিলায় দুনিয়ার অনেক বিপদাপদ তার থেকে দূর করে দেন। আমরা জানি না, এসবের কোনটা আমাদের জন্য উত্তম। আল্লাহই সকল কর্মের কল্যাণদর্শী বিধায়ক।
وَمَا تَرَدَّدْتُ عَنْ شَيْءٍ أَنَا فَاعِلُهُ تَرَدُّدِى عَنْ نَفْسِ الْمُؤْمِنِ يَكْرَهُ الْمَوْتَ وَأَكْرَهُ مَسَاءَتَهُ
আমি যে কোন কাজ করতে চাইলে কোন সংকোচ করি না, মুমিন বান্দার প্রাণ হরণে যতটা দ্বিধা সংকোচ করি। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে, আমি তার কষ্ট অপছন্দ করি। [সহিহ বুখারি: ৬৫০২]
স্বাভাবিক দৃষ্টিতে কোন কাজে সংকোচ করা কর্তার অপূর্ণতা এবং দুর্বলতার প্রমাণ। কবি বলেন-
কথা বলো দৃঢ়তর, দ্বিধা-সংকোচে থাকে না কথার ভার।
প্রশ্ন হল আল্লাহ কি কোন কাজ করতে সংকোচ করতে পারেন! আল্লাহ -র কি কোন দুর্বলতা আছে! অপূর্ণতা আছে! এ তো অসম্ভব!
হাদিসে উক্ত কাজে আল্লাহ -র সংকোচ করার অর্থ-
১. মুমিন কোন আকস্মিকতায় যখন বিপদে পতিত হয়, বিপদ তার জুতার ফিতার চেয়েও কাছে থাকে, আল্লাহ তখন তার থেকে মৃত্যুদূত ফিরিয়ে রাখেন। এই মৃত্যুসদৃশ বিপদেও মুমিন থেকে মৃত্যুদূত ফিরিয়ে রাখার বিষয়টিকে সংকোচের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
২. সংকোচটি হয়ে থাকে মৃত্যুর ফেরেসতা এবং মুমিনের মাঝে। যেমনটি মুসা -র সাথে হয়েছিল। মৃত্যুর ফেরেসতা যখন তার রূহ নেয়ার জন্য আগমন করলেন, তিনি ফেরেসতাকে একটি থাপ্পর মারলেন। এতে তার এক চোখ নষ্ট হয়ে যায়। ফেরেসতা আল্লাহ -র কাছে গেলে আল্লাহ তার চোখ ফিরিয়ে দেন। এরপর তিনি আবার এসে মুসা -র রূহ নিয়ে যান।
৩. এই হল মৃত্যুর ফেরেসতা এবং মুমিনের মাঝে সংকোচের স্বরূপ। কিন্তু এই ব্যাখ্যাটি নিতান্তই দুর্বল।
৪. আল্লাহ মুমিনের রূহ নেয়ার সময় মুমিনের সাথে খুব দয়ার আচরণ করেন। তার প্রাণবিয়োগ সহজতর হয়ে যায়। আল্লাহ -র এই দয়ার আচরণ প্রমাণ বহন করে যে, আল্লাহ মুমিনের রুহ নিতে চান না।
৫. তিনি এ-ও জানেন যে বান্দা মৃত্যুর শাস্তি ও কষ্ট অপছন্দ করে। আল্লাহ বান্দাকে কষ্টও দিতে চান না। মুমিন বান্দার প্রতি এই ভালোবাসা এবং তাকে কষ্ট দিতে না চাওয়াকেই সংকোচ বলা হয়েছে।
মূলত আল্লাহ -র ক্ষমতায় বা কার্য নির্বাহে কোন সংকোচ বা দ্বিধা নেই। আল্লাহ যা চান, তাই হয়। আল্লাহ -ই এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত।
পরিশেষে, হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ -র বন্ধুর প্রতি আল্লাহ -র অগাদ ভালোবাসার কথা ফুটে উঠেছে। তদ্রূপ আল্লাহ -র বন্ধুর সাথে শত্রুতা পোষণের ব্যাপারেও কঠোর হুমকি দেয়া হয়েছে। যে আল্লাহ -র বন্ধুর সাথে শত্রুতা পোষণ করে, সে যেন আল্লাহ -র সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আল্লাহ তাকে পরাজিত করেন, স্মরণকালের পরাজয়।
আল্লাহ আমাদের সকলকে তার একান্ত বন্ধুরূপে গ্রহণ করুন।
📄 আল্লাহ আছেন তোমার সাথে
আল্লাহ আমাদের শ্রেষ্ঠ হেফাযতকারী। প্রতিটি বস্তুরই হেফাযতকারী। তিনি দয়ালুদের সেরা দয়ালু। প্রতিটি বিষয়ের বিধায়ক। তিনিই তার নির্বাচিত খাঁটি বান্দাদের বিপদাপদে সুরক্ষা দান করেন।
ইয়াকুব প্রিয় পুত্র ইউসুফকে হারালেন। ইউসুফের ভাইয়েরা ইয়াকুবকে এসে বলেছিল- 'ইউসুফকে বাঘে খেয়েছে'।
ইয়াকুব বুঝেছিলেন ইউসুফকে বাঘে খায়নি।
ভাইয়েরা বলেছিল, 'ইউসুফ শূন্য মাঠে হারিয়ে গেছে।'
ইয়াকুব-র বিশ্বাস ছিল ইউসুফ হারায়নি।
ভাইয়েরা বলেছিল, 'ইউসুফ আমাদের সাথে রাগ করে গন্তব্যহীন কোথায় যেন চলে গেছে'।
ইয়াকুবের মন বলছিল এমন কিছুই হয়নি।
ইয়াকুব তখন অবচেতনে একটাই কথা বলেছিলেন-
فَاللَّهُ خَيْرٌ حَفِظَا
আল্লাহই শ্রেষ্ঠ হেফাযতকারী। [সূরা ইউসুফ: ৬৪]
অতএব ইউসুফকে আল্লাহই হেফাযত করবেন। ইউসুফ আল্লাহর হেফাযতে আছে। আল্লাহ তার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন, তাই হবে।
আল্লাহ-ই হেফাযতকারী। তিনি যুগে যুগে মনোনীত বান্দাদের হেফাযত করেছেন। আসহাবে কাহফ; গুহার অধিবাসী যুবকরা তাদের সুরম্য অট্টালিকা ছেড়ে যখন পাহাড়ের গুহা বেছে নিলেন, তখন আল্লাহ-ই তাদের হেফাযত করেছিলেন।
📄 মূসা -র প্রতি আল্লাহর সাহায্য ও অনুগ্রহ
মুসা। একটি নাম। যে নামের সাথে স্মরিত হয় বীরত্বগাঁথা এক অসম সাহসিকতার গল্প। আমানত রক্ষার নিষ্ঠাপূর্ণ অনুপম উপাখ্যান। অন্তরে জেগে ওঠে ভক্তি ও শক্তির অসামান্য কাহিনী। আল্লাহ-র পথে জীবন বিছিয়ে দেয়ার, প্রাণ উৎসর্গ করার সৌষ্ঠব আলেখ্য।
পৃথিবীর বর্বরোচিত ইতিহাসের শীর্ষ হোতার নাম ফেরাউন। আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক ফেরাউন বর্বরের উপর। একদিন সে স্বপ্নে দেখল বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে একটি আগ্নেয়গিরি মিসরের দিকে ধেয়ে আসছে। ছাইভস্ম করে জ্বালিয়ে দিচ্ছে মিসরের উঁচু-উঁচু অট্টালিকা আর স্থাপত্যগুলো।
অশুভ এই স্বপ্ন দেখে বিষণ্ণ হয়ে উঠল ফেরাউন। সকালে খাসকামরা থেকে যখন বেরিয়ে এল, চেহারায় তখন মেঘখেলা খেলছে চিন্তা আর পেরেশানি। জ্যোতিষী, গণক, যাদুকর, বাজিকর, ভেলকিবাজ সকলকে ডেকে স্বপ্নের বর্ণনা শোনাল। স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাইল। তারা স্বপ্নের ব্যাখ্যা শোনাল- বনী ইসরাঈলের এক ছেলে তোমার রাজত্বে হামলা করবে। শেষ করে দিবে তোমার শাসন আর কর্তৃত্ব।
স্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনে ফেরাউন আরো চিন্তিত হল। ভেতরের পশু চরিত্র পিশাচের মতো আরও বর্বর হয়ে ওঠল। সিদ্ধান্ত নিল, রাজত্ব ও কর্তৃত্ব রক্ষার জন্য এই সিজনের সকল নবজাতক ছেলেকে হত্যা করা হবে!
ফেরাউন তার গুপ্তচর ছড়িয়ে দিল কোথায় কার ছেলে সন্তান ভূমিষ্ট হচ্ছে, জানার জন্য। বনী ইসরাঈলের সকল নবজাতক ছেলে হত্যা করার জন্য তার বাহিনী লেলিয়ে দিল। শুরু হল শিশুহত্যা। রক্তের স্রোত বয়ে গেল বনী ইসরাঈলের অলিতে-গলিতে। ফুলেল শিশুগুলোর অপাপ আত্মা উড়ে গেল বেহেসতের আকাশে। নিষ্পাপ প্রাণগুলো আল্লাহর কাছে তুলে ধরল শিশুহত্যার অভিযোগ।
আল্লাহ! তুমি এই ফেরাউনি যুগেই মুসাকে দুনিয়ায় পাঠালে!
আল্লাহ! একজন দিশেহারা অসহায় মা পোষাক মুড়িয়ে ছেলেকে আগলে রাখছে ঐ জল্লাদ হায়েনাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য! তাহলে এই এতীম মুসাকে এখন কে হেফাযত করবে!
আল্লাহ! মুসার মত শত-সহস্র শিশু যখন নিহত হয়েছে, তখন মুসাকে তো তুমিই বাঁচাবে! তোমারই অনুগ্রহে তাকে বাঁচিয়ে রাখবে! তোমারই প্রতিপালনে তাকে বড় করবে!
মুসা-র পুরো কাহিনী জুড়ে রয়েছে ভয় আর আতঙ্ক। আছে সাহসের সমাচার। বিপদ থেকে উত্তরণের অবিশ্বাস্য দৃশ্য। আল্লাহ বলেন-
طسم ا﴾ تِلْكَ ايْتُ الْكِتَبِ الْمُبِيْنِ ﴿٢﴾ نَتْلُوا عَلَيْكَ مِنْ نَبَا مُوسَى وَ فِرْعَوْنَ بِالْحَقِّ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ ﴿٣﴾ إِنَّ فِرْعَوْنَ عَلَا فِي الْأَرْضِ وَ جَعَلَ أَهْلَهَا شِيَعًا يَسْتَضْعِفُ طَائِفَةً مِنْهُمْ يُذَبِّحُ أَبْنَاءَهُمْ وَيَسْتَحْيِ نِسَاءَهُمْ إِنَّهُ كَانَ مِنَ الْمُفْسِدِينَ
ত্বা সীন মীম। এগুলো সুস্পষ্ট কিতাবের আয়াত।আমি আপনার কাছে মুসা ও ফেরাউনের বৃত্তান্ত সত্যসহ বর্ণনা করছি ঈমানদারদের জন্য। ফেরাউন তার দেশে উদ্ধত হয়েছিল এবং সে দেশবাসীকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে তাদের একটি দলকে দুর্বল করে দিয়েছিল। সে তাদের পুত্রসন্তানদের হত্যা করতো এবং নারীদের জীবিত রাখতো। নিশ্চয় সে ছিলো অনর্থ সৃষ্টিকারী। [সূরা কাসাস: ০১-০৪]
ফেরাউন ছেলে সন্তানদের হত্যা করে মেয়ে সন্তানদের জীবিত রাখতো। এভাবে সে তার দেশের একটি দলকে দুর্বল করতে চাইল। কিন্তু আল্লাহ মুসা-কে অলৌকিকভাবে রক্ষা করলেন। আল্লাহ বলেন-
وَ أَوْحَيْنَا إِلَى أُمِّ مُوسَى أَنْ أَرْضِعِيهِ فَإِذَا خِفْتِ عَلَيْهِ فَأَلْقِيْهِ فِي الْيَمِّ وَلَا تَخَافِي وَلَا تَحْزَنِي إِنَّا رَادُّوهُ إِلَيْكِ وَجَاعِلُوهُ مِنَ الْمُرْسَلِينَ
আমি মুসা জননীকে আদেশ পাঠালাম যে তাকে স্তন্য দান করতে থাক। অতঃপর যখন তুমি তার সম্পর্কে বিপদের আশঙ্কা কর, তখন তাকে দরিয়ায় নিক্ষেপ কর এবং ভয় করো না, দুঃখও করো না। আমি অবশ্যই তাকে তোমার কছে ফিরিয়ে দিবো এবং তাকে পয়গম্বরদের একজন বানাবো। [সূরা কাসাস: ০৭]
সুবহানাল্লাহ! মানুষ যখন কোন জিনিস খোয়া যাওয়ার ভয় করে, তখন তা গুরুত্বের সাথে হেফাযত করে। নিজের কাছে আগলে রাখে। অথচ আল্লাহ মুসা-কে হেফাযত করতে বলেননি। নিজের কাছে আগলে রাখতেও বলেননি। বলেছেন, বিপদের আশঙ্কা করলে তাকে দরিয়ায় নিক্ষেপ কর!
আল্লাহ শুরু থেকেই নির্ধারণ করে রেখেছেন, মুসার মাধ্যমে ফেরাউনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাবেন। আল্লাহ নিজেই তাকে হেফাযত করবেন। তাই মুসা জননীকে আদেশ করেছেন- তাকে দরিয়ায় নিক্ষেপ কর, আল্লাহ তাকে প্রতিপালন করবেন। আল্লাহ তাকে ফেরাউনের বিরোধিতার জন্য সক্ষম করে তুলবেন। আল্লাহই তাকে হেফাযত করবেন।
এই যে পাখ-পাখালি, নিজের ভালো-মন্দের মালিক তারা নয়, কে তাদের পালন করছে! কে তাদের আহার যুগিয়ে পরিতৃপ্ত করছে! বন-বাঁদাড়ে পশুগুলোকে কে হেফাযত করছে! কে নিঃশ্ব অসহায় এতীমদের লালনপালন করছে! তিনিই আমাদের আল্লাহ!
মুসা-র মা তাকে দরিয়ায় নিক্ষেপ করলেন। আল্লাহর তত্ত্বাবধানে সোপর্দ করলেন। তিনি আল্লাহর ওয়াদায় আস্থা রাখলেন। আল্লাহ তার কাছে ইলহামের মাধ্যমে প্রত্যাদেশ জানিয়েছেন, তিনি তার উপর ভরসা করলেন। তা কেমন দৃশ্য! একজন অসহায় মা। দুঃখীনী মা। তিনি তার সন্তানকে দরিয়ায় নিক্ষেপ করলেন! তিনি জানতেন, মুসা দরিয়ায় ডুববে না। আল্লাহ যার হেফাযত করেন, সে ডোবে না। মুসার কোন ক্ষতি হবে না। আল্লাহ যার তত্ত্বাবধান করেন, তার কোন ক্ষতি হয় না। মুসা নিঃশেষ হবে না। আল্লাহ যার সহায়, সে কখনও নিঃশেষ হয় না।
মুসার মা তাকে পানিতে ভাসমান কোন বস্তুর উপর রেখে দিলেন। পানি তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। কিন্তু কোথায় কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে? মিসরে বন-বাগানের অভাব নেই। বাগানের পর বাগান। ঐ তো সামনে একটি বাগান। এই বাগানের কাছেই মুসা ঠেকবে! এটি যে ফেরাউনের বাগান! হাঁ, মুসা ফেরাউনের সুরম্য অট্টালিকার পাশে এসেই ঠেকলেন!
ফেরাউনের অত্যাচারী জালিম বাহিনী মুসাকে দেখে বুঝল এটি বনী ইসরাঈলের শিশু। তারা খুব খুশি হয়ে গেল। শিশু মুসাকে ফেরাউনের কাছে নিয়ে আসল। ফেরাউন তাকে যথারীতি হত্যা করতে উদ্যত হলেন। কিন্তু এখানেও আল্লাহর অনুগ্রহ আরেকবার প্রকাশ পেল। আল্লাহই শিশু মুসাকে হেফাযত করবেন। আল্লাহ বলেন-
إِنَّا رَادُّوهُ إِلَيْكِ وَجَاعِلُوهُ مِنَ الْمُرْسَلِينَ
আমি অবশ্যই তাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিবো এবং তাকে পয়গম্বরগণের একজন বানাবো। [সূরা কাসাস: ০৭]
আল্লাহ সেখানে ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়াকে উপস্থিত করালেন। আসিয়া এসে বলল-
قُرَّتُ عَيْنٍ لِي وَلَكَ এ শিশু আমার ও তোমার নয়নমণি। তাকে হত্যা করো না। [সূরা কাসাস: ০৯]
কেমন ছিল আসিয়ার বক্তব্য! কেমন ছিল আল্লাহর অনুগ্রহ! ঘটনার আকস্মিকতা ও পরম্পরা! আসিয়া তার জালিম বর্বর স্বামীকে বলছে, 'এ শিশু আমার- তোমার নয়নমণি।' এ শিশুকে আমরা লালনপালন করবো। আল্লাহ এর দ্বারা আমাদের লাভবান করবেন।
কসম আল্লাহর! মুসার দ্বারা আসিয়া লাভবান হয়েছিলেন। দুনিয়াতে মুসার মাধ্যমে ঈমান আনার তাওফিকপ্রাপ্ত হয়েছেন। আখেরাতে জান্নাতের অধিবাসী হয়েছেন। এই তো আল্লাহর সেই বাণী-
وَ ضَرَبَ اللهُ مَثَلًا لِلَّذِينَ آمَنُوا امْرَأَتَ فِرْعَوْنَ إِذْ قَالَتْ رَبِّ ابْنِ لِي عِنْدَكَ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ وَنَجِّنِي مِنَ فِرْعَوْنَ وَعَمَلِهِ وَنَجْنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّلِمِينَ
আল্লাহ মুমিনদের জন্য ফেরাউনপত্নীর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। সে বলল, 'হে আমার পালনকর্তা! আপনার সন্নিকটে জান্নাতে আমার জন্য একটি ঘর নির্মাণ করুন। আমাকে ফেরাউন ও তার দুষ্কর্ম থেকে উদ্ধার করুন এবং আমাকে জালিম সম্প্রদায় থেকে মুক্তি দিন। [সূরা তাহরীম: ১১]
আসিয়া স্বামী ফেরাউনের কাছে শিশু মুসাকে ছেড়ে দেয়ার বায়না ধরল। ফেরাউন তার বায়না পূর্ণ করল। শিশু মুসাকে ছেড়ে দিল।
আল্লাহ শিশু মুসাকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে আনবেন। অচিরেই মুসাকে তার কোলে ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দিলেন।
মুসাকে স্তন্যদানের জন্য ফেরাউনের রাজদরবারে স্তন্যদানকারী মহিলারা আসতে শুরু করল। কিন্তু মুসা কারও স্তন্য পান করছেন না। একজন মহিলারও দুগ্ধ পান করলেন না। মুসা -র বোনও সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি বললেন-
۞ هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى مَنْ يَكْفُلُهُ * আমি কি তোমাদের বলবো, কে তাকে লালনপালন করবেন? [সূরা তাহা: ৪০]
কে তাকে হেফাযত করবেন? কে তাকে দুধ পান করাবেন? কে তাকে কোলেকাঁখে বড় করে তুলবেন?
সবাই খুশি হল। মুসার বোনের কথা অনুযায়ী মুসার মা-কে ডাকা হল। তার কাছে মুসাকে সোপর্দ করা হল। মুসার মা মুসাকে নিয়ে গেলেন। আদরে সোহাগে যতনে তাকে লালনপালন করলেন। দুধ পান করানোর জন্য ফেরাউন থেকে পারিশ্রমিকও গ্রহণ করলেন। অবস্থা এমন ছিল যে- যেন তিনি মুসার মা-ই নন!
দুগ্ধপান শেষে মুসা আবার ফেরাউনের দরবারে ফিরে এলেন।
মুসা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছেন। তার বিবেক-বুদ্ধি বাড়ছে। বয়সের সাথে সাথে চোখও খুলছে। এই ছোট বয়সেই তিনি এক কান্ড বাধিয়ে বসলেন। প্রায় সময় তিনি ফেরাউনের গালে কষে থাপ্পর দিচ্ছেন। যেন তাকে ইঙ্গিত দিচ্ছেন, এই হাতেই তোমার সিংহাসন উপড়ে পড়বে। এই হাতেই তোমার সাম্রাজ্য ধ্বসে পড়বে। এই হাতেই মানবতার মুক্তি মিলবে, মানুষকে অন্যায়ভাবে দাস বানিয়ে রাখার প্রভুত্ব খতম হবে।
শিশু মুসার থাপ্পর খেয়ে খেয়ে একসময় ফেরাউনের খুব রাগ হল। দুঃখে ক্ষোভে অপমানে ফেটে পড়ল ফেরাউন। শিশু মুসাকে হত্যা করার জন্য উদ্যত হল। কিন্তু গোল বাধালো ফেরাউনের স্ত্রী। স্ত্রী আসিয়া আবার ফেরাউনের সামনে এসে দাঁড়ালেন। স্বামীর বিবেকের কাছে প্রশ্ন রেখে বললেন, 'এ তো শিশু। কিছু জানে না, বুঝে না। কেন হত্যা করবে এই শিশুকে!'
আসিয়া মুসাকে পরীক্ষা করে দেখার বুদ্ধি দিলেন। বললেন, 'তার সামনে আগুনের অঙ্গার এবং খেজুর রেখে দেখ। সে যদি খেজুর গ্রহণ করে, তাহলে সে বুঝবুদ্ধির ছেলে হয়েছে। তখন তাকে হত্যা করো। আর যদি অঙ্গারে হাত দেয়, তাহলে সে বুঝবুদ্ধির ছেলে হয়নি। তাকে ছেড়ে দাও।'
স্ত্রীর বুদ্ধি ধরে ফেরাউন তাই করল। শিশু মুসার সামনে খেজুর ও অঙ্গার রাখল। আল্লাহর কুদরত তখনও তাকে পাহাড়া দিচ্ছে। আল্লাহ তখনও তাকে হেফাযত করছেন। কেউ কিছু বুঝতে পারল না। মুসা আগুনের অঙ্গারে হাত বাড়ালেন। একটি অঙ্গার তুলে মুখে পুরলেন। কিন্তু মুসা মুখে কাঁচা খেজুরের মিষ্টি স্বাদ অনুভব করলেন!
ফেরাউন তাকে এই যাত্রায়ও ক্ষমা করলেন। ছেড়ে দিলেন মুসাকে। মুসা ফেরাউনের রাজদরবারেই আল্লাহর প্রতিপালনে বেড়ে ওঠলেন।
মুসা একদিন ফেরাউনের প্রাসাদ ছেড়ে বেরুলেন। কেন বের হয়েছেন সেই বর্ণনা কোরআনে নেই। কোরআনে যে কোন ঘটনার অত্যাবশ্যকীয় নসীহতপূর্ণ অংশটুকুই শুধু অবতীর্ণ হয়েছে। মুসা রাস্তায় বের হয়ে হাঁটছেন। মানুষের সাথে মিশছেন, সময় দিচ্ছেন, দিন কাটাচ্ছেন।
একদিন এক কাঠুরিয়া মুসা-র কাছে এলেন। কাঠুরিয়া ছিলো বনী ইসরাঈলের লোক। সে জনৈক মিসরির কাজ করত। মিসরি তার সাথে অহঙ্কার, দর্প ও অন্যায়সূলভ আচরণ দেখাত। কারণ মিসরির পেছনে ফেরাউন আছে। তার একটা শক্তি আছে। এই শক্তির উপর ভর করে সে বনী ইসরাঈলের কাঠুরিয়াকে প্রহার করল। কাঠুরিয়া মুসার কাছে সব বলল। মুসার কাছে এর একটা বিহিত চাইল। এই জালেমের কবল থেকে নিষ্কৃতি চাইল। মুসা ছিলেন সুঠام শক্তিশালী পুরুষ। তিনি এসে মিসরিকে শক্ত এক ঘা আঘাত বসিয়ে দিলেন। মুসার আঘাত খেয়ে মিসরি নিষ্প্রাণ দেহে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। মিসরির দিন এখানেই শেষ। মরে গেল বেচারা।
মুসা কর্তৃক মিসরি হত্যার ঘটনা ফেরাউনের কানে গেল। আবার রেগে উঠল ফেরাউন। মুসাকে এবার হত্যা করতেই হবে। স্থির সিদ্ধান্ত।
জনৈক ব্যক্তি মুসা-র কাছে সংবাদ নিয়ে আসল-
وَ جَاءَ رَجُلٌ مِّنْ أَقْصَا الْمَدِينَةِ يَسْعَى قَالَ يُمُوسَى إِنَّ الْمَلَا يَأْتَمِرُونَ بِكَ لِيَقْتُلُوكَ فَاخْرُجُ إِنِّي لَكَ مِنَ النَّصِحِينَ)
মুসা, রাজ্যের পরিষদবর্গ তোমাকে হত্যা করার পরামর্শ করছে। অতএব তুমি বের হয়ে যাও। আমি তোমার হিতাকাঙ্ক্ষী। [সূরা কাসাস: ২০]
তারা তোমাকে গ্রেফতার করার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করছে। গুপ্তচর ছড়িয়েছে। সুতরাং তুমি এ শহর ছেড়ে চলে যাও। পালাও, পালাও, মুক্তির পথে পালাও।
মুসা ঘটনার আকমিকতা বুঝতে পারলেন। কৃত হত্যার ঘটনার জন্য আল্লাহর কাছে অনুতাপ প্রকাশ করলেন-
হে আল্লাহ, আমাকে মার্জনা কর। [সূরা আরাফ: ১৫১]
আল্লাহ তাকে মার্জনা করলেন।
কুরআনের ব্যাখ্যাকাররা বলেন, এটি একটি অতি প্রেমাবহী তত্ত্বকথা যে আল্লাহ গোনাহ এবং ক্ষমার মাঝে কোন দূরত্ব রাখেননি। মানুষ যখন অন্যায়ের ময়লা গায়ে মাখে, গোনাহের আবর্জনায় কলঙ্কিত হয়, অতঃপর দোষ স্বীকার করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, আল্লাহ তখন তার দিকে মনোনিবেশ করেন। আল্লাহ তাকে ক্ষমার জলে ধুয়ে পরিচ্ছন্ন করে দেন। আল্লাহ বলেন-
তারা কখনও কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা কোন মন্দ কাজে জড়িত হয়ে নিজের উপর জুলুম করে ফেললে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া আর কে পাপ ক্ষমা করবেন? তারা নিজের কৃতকর্মের জন্য হঠকারিতা প্রদর্শন করেনা এবং জেনে শুনে তাই করতে থাকেনা। [সূরা আলে ইমরান: ১৩৫]
মুসা শহর থেকে বের হবেন। কিন্তু কোথায় যাবেন? শহরের সকল দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফেরাউনের বাহিনী তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। পথে পথে ওঁৎ পেতে খুঁজছে। ফেরাউন নিজেই তাকে খুঁজছে। দুপুরের পর মানুষ যখন বিশ্রামে থাকে, এমন এক সময় মুসা আলাইহিস সালাম শহর থেকে কৌশলে বের হলেন। পথ চলা শুরু করলেন অজানা গন্তব্যে...
মুসা মাদয়ানের দিকে পথ চলতে শুরু করলেন। আল্লাহ বলছেন-
যখন তিনি মাদয়ান অভিমুখে রওয়ানা হলেন, তখন বললেন, আশা করা যায় আমার পালনকর্তা আমাকে সরল পথ দেখাবেন। [সূরা কাসাস: ২২]
আল্লাহ ﷻ তাকে সরল পথ দেখালেন। শূন্য প্রান্তরে তাকে বড় একটি পানিময় উপত্যকায় নিয়ে পৌঁছালেন। সেখানে পানির কাছে অনেক রাখাল। অনেক মানুষ পানি সংগ্রহ করছে। দু'টি মেয়েও তাদের ছাগলপালকে পানি খাওয়ানোর চেষ্টায় দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের ভীড় কমবে, সকলে চলে যাবে, তখন তারা নিজেদের ছাগলকে পানি পান করাবে।
মুসা আলাইহিস সালাম মেয়ে দু'টির প্রয়োজন অনুমান করে তাদের কাছে আসলেন। তাদের ছাগলপাল নিয়ে আসলেন। শক্তি খাটিয়ে মানুষের ভীড় কমালেন। পানি পান করিয়ে ছাগলগুলো তাদের কাছে ফিরিয়ে দিলেন। মুসা আলাইহিস সালাম তখন নিজে অনেক ক্ষুধার্ত ছিলেন, আল্লাহ ﷻ ছাড়া তা আর কেউ জানতো না।
মুসা আলাইহিস সালাম অনেক দরিদ্র ও অসুস্থ ছিলেন, আল্লাহ ﷻ ছাড়া তা আর কেউ জানতো না। ইমাম আহমদ রাহি. তার কিতাবুয যুহদ-এ উল্লেখ করেন, মুসা আলাইহিস সালাম পানির কাছে ফিরে গিয়ে আল্লাহর কাছে বললেন, 'আল্লাহ, আমি অসুস্থ। গরীব। ক্ষুধার্ত। ফকীর।' আল্লাহ বললেন, 'মুসা! ফকীর ঐ ব্যক্তি, আমি যার দারিদ্র বিমোচনকারী নই। অসুস্থ ঐ ব্যক্তি, আমি যার ডাক্তার নই। গরীব ঐ ব্যক্তি, আমি যার বন্ধু নই। ক্ষুধার্ত ঐ ব্যক্তি, আমি যার ক্ষুদা নিবারণকারী নই।'
মুসা আলাইহিস সালাম একটি গাছের ছায়ায় বসলেন। আল্লাহর কাছে বললেন-
আল্লাহ, তুমি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ নাযিল করবে, আমি তার মুখাপেক্ষী। [সূরা কাসাস: ২৪]
আল্লাহ ﷻ তার উপর আরেকবার অনুগ্রহের খোলা দরজা দিয়ে বাতাস প্রবাহিত করলেন। মেয়ে দুজনের একজন বাবার কাছে এল। বাবাকে পানির ঘাটে যা ঘটেছে, সব খুলে বলল।
বাবার নির্দেশে মেয়ে লজ্জাজড়িত পদক্ষেপে মুসা আলাইহিস সালাম -কে খুঁজতে আসলেন, বাবার পক্ষ থেকে মুসা আলাইহিস সালাম -কে তার প্রাপ্য পরিশোধ করবেন। মুসার কাছে এসে মুসাকে সালাম জানালেন। বাবার নির্দেশ শোনালেন। মুসা আলাইহিস সালাম তার বাবার সাথে দেখা করার জন্য রওয়ানা করলেন। মুসা আলাইহিস সালাম মেয়ের আগে হাঁটছেন, 'যেন মেয়ের উপর তার চোখ না পড়ে।
মুসা মেয়েদের বাবাকে সালাম দিয়ে নিজের রহস্যজনক এবং ভীতিপ্রদ সকল কাহিনী খুলে বললেন। ফেরাউনের ত্রাস সঞ্চারী সকল তৎপড়তার কথাও খুলে বললেন। মেয়ের বাবা সব শুনে বললেন-
ভয় পেওনা, তুমি জালেম সম্প্রদায় থেকে রক্ষা পেয়েছ। [সূরা কাসাস: ২৫]
তোমার অন্তর প্রশান্ত ও নির্ভয় হোক। তুমি আল্লাহর হেফাযতে আছ। ভয় পেওনা। তোমার আর কিছু হবেনা। তুমি জালেম সম্প্রদায় থেকে মুক্তি পেয়েছ।
এই মেয়ের বাবা হলেন মহান নবী শোয়াইব।
শোয়াইব মুসার সাথে একটি চুক্তি করলেন। মুসা শোয়াইব-র এক মেয়ে বিয়ে করবেন। বিনিময়ে নির্দিষ্ট একট সময় মুসা শোয়াইবের () ছাগল চড়াবেন। তিনি চাইলে আট বছরও চড়াতে পারেন, দশ বছরও চড়াতে পারেন। শোয়াইব বললেন-
আমি আমার এই কন্যাদ্বয়ের একজনকে তোমার বিবাহে দিতে চাই এই শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার চাকরি করবে। যদি তুমি দশ বছর পূর্ণ কর, তা তোমার ইচ্ছা। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আল্লাহ চাইলে তুমি আমাকে সৎকর্মপরায়ণ পাবে। [সূরা কাসাস: ২৭]
তুমি ইচ্ছা করলে তোমার উদারতা প্রদর্শন করে দশ বছর থাকতে পার। এটা তোমার উপর আবশ্যক নয়। ইনশাআল্লাহ, তুমি আমাকে সৎ লোক হিসেবেই পাবে।
মুসা নিজ ইচ্ছায় দশ বছরই থাকলেন। শোয়াইব-র ছাগল চড়ালেন। ইবনে আব্বাস বলেন, 'মুসা ইচ্ছাধীন দুই চুক্তির সবচেয়ে উত্তম এবং সম্মানজনক চুক্তিটিই পূর্ণ করেছেন।'
দশ বছর শেষ। মুসা শোয়াইব-র ছাগপাল চড়ানোর কাজে নিরত ছিলেন। এরপর তিনি স্ত্রী এবং কিছু বকরিসহ আপন ভূমির উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। আসার সময় শোয়াইব তাকে একটি লাঠি উপহার দিলেন। চুড়ান্ত বিপ্লবের এই তো সূচনা...
এই লাঠি দিয়েই মুসা জালেমের দুনিয়াকে ওলট-পালট করে দিবেন। এই লাঠি দিয়েই ফেরাউনের সাথে বোঝাপড়া, যাদুকর ও অবাদ্ধদের পরাস্ত করা, কুরআনে বর্ণিত আরও নানা ঘটনা...
মুসা মাদয়ান থেকে বের হয়ে বিস্তীর্ণ মরুভূমি পারি দিলেন। এখানে প্রকাশ পেল আল্লাহর আরেক অনুগ্রহ। আল্লাহ-ই ভাল জানেন কখন তার রিসালাত অর্পণ করবেন। আল্লাহ তাকে এ পথে আনলেন। চলতে চলতে দিন পেরিয়ে রাতের পথ। রাতটি ছিল ঘনান্ধকারের পর্দায় ঘেরা। কোন আলো নেই। অন্ধকার দূর করে সামান্য আলোর কোন ব্যবস্থাও নেই। সেই ঘোরতর পরিস্থিতে হঠাৎ দূরে সামান্য আলোর আভাস দেখলেন, মিটমিট জ্বলছে।
স্ত্রীর কাছে ভালোবাসাপূর্ণ বাচনে অনুমতি চেয়ে বললেন, 'তোমরা অপেক্ষা কর, আমি আগুন দেখেছি। সম্ভবত আমি সেখান থেকে তোমাদের কাছে কোন খবর নিয়ে আসতে পারি অথবা কোন জ্বলন্ত কাষ্ঠখণ্ড আনতে পারি, যেন তোমরা আগুন পোহাতে পার।'
মুসা আগুনের কাছে গেলেন। তার পায়ে জুতা ছিল। আল্লাহ তাকে বললেন, 'তোমার জুতা দুটি খোল'। সেটি ছিল পবিত্র স্থান। এবাদতের স্থান। মর্যাদা ও মাহাত্বপূর্ণ স্থান। এই পবিত্র স্থানে তোমার পায়ে জুতা থাকবে না। জুতা খুলে সামনে অগ্রসর হও।
মুসা এমন একটি আওয়ায শুনলেন, যে আওয়াযের ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না। কোথা থেকে আসছে এই আওয়ায! আল্লাহর পক্ষ থেকে! আল্লাহ কথা বলছেন এই বান্দার সাথে! যে মুসাকে পানির কোলে রেখে এসেছিল তার মা, আল্লাহ কথা বলছেন সে মুসার সাথে! যে মুসা ছাগল চড়াতো, সে মুসার সাথে! যে মুসা মরুভূমিতে ঘুরঘুর করেছে অসহায় মনে, দুর্বল শরীরে, সাথে কিছু নেই, পাশে কেউ নেই, আল্লাহ কথা বলছেন সেই মুসার সাথে!
আল্লাহ মুসা-কে বললেন-
إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا
আমিই আল্লাহ, আমি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। [সূরা ত্বাহা: ১৪]
মুসার অন্তরে প্রথম পয়গাম অনুরণিত হলো- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর ধ্বনিতে মুসার অন্তর কেঁপে ওঠল। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দুলে ওঠল। শিহরিত হল তার আস্তিত্ব। তিনি চিন্তা করছেন, কে এই কথা বললেন- 'আমিই আল্লাহ, আমি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই'! তিনি আকাশের দিকে তাকালেন, সেখানে আল্লাহর কুদরত! যমিনে দেখলেন, সেখানেও আল্লাহর সৃজন! যেদিকেই তাকালেন, প্রতিটি বস্তুতে আল্লাহর অপার মহিমা। প্রতিটি বস্তুই বলছে, আল্লাহ এক। আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই।
আল্লাহ মুসাকে আবার বললেন-
তোমার হাতের লাঠিটি নিক্ষেপ করো। [সূরা আরাফ: ১১৭]
ٱلْقِ عَصَاكَ
মুসা লাঠিটি নিক্ষেপ করলেন। এ কি! যে লাঠি দিয়ে তিনি ছাগল চড়াতেন, সেই লাঠিটিই দেখছি জীবন্ত সাপ! তিরতির করছে! ছোটাছুটি করছে! মুসা ভয় পেলেন। পিছু হটলেন, সেখান থেকে দৌড়ে পালাবেন। কোন কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। আয় আল্লাহ! যে লাঠি দিয়ে আমি ছাগল চড়াতাম, শৃগাল তাড়াতাম, সে লাঠিই কিনা...! এই রাতের আঁধারে এসব কেমন খেলা! এই অন্ধকার চাদরে এসব কেমন ঘটনা! কে আমি! আমি তো এক রাখাল! তাহলে এসব কী?
অমনি আবার আল্লাহর পক্ষ থেকে ডাক আসল-
يُمُوسَى لَا تَخَفْ إِنِّى لَا يَخَافُ لَدَى ٱلْمُرْسَلُونَ **
মুসা! ভয় করবে না। আমি যে রয়েছি, আমার কাছে পয়গম্বরগণ ভয় করে না। [সূরা নমল: ১০]
মুসা সাহস পেলেন। সামনে আগালেন। সাপের মুখে হাত বাড়ালেন। সাপটি পূর্ববৎ অবস্থায় ফিরে এল। ঈষৎ কাঁপুনি খেলল মুসার হাতে। আল্লাহ মুসাকে আবার ডাকলেন। বললেন-
وَٱضْمُمْ يَدَكَ إِلَىٰ جَنَاحِكَ)
তোমার হাতটি বগলে রাখ। [সূরা নমল: ১২]
মুসা হাত বগলে রাখলেন। বগল থেকে হাত বের করে দেখলেন, তার হাত উজ্জ্বল, সুশুভ্র! হাতে তো কোন রোগ নেই, তবু সাদা হয়ে জ্বলজ্বল করছে!
অতঃপর আল্লাহ বললেন-
اذْهَبْ إِلَى فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى
ফেরাউনের কাছে যাও, সে দারুণ উদ্ধত হয়ে গেছে। [সূরা ত্বাহা: ২৪]
ঘটনাগুলো কেমন অবিশ্বাস্য! মুসা ভাবছেন, সব ঠিক আছে তো! আমিই তো ছাগল চড়াতাম! আমিই অন্ধকারে একটু আলো খুঁজছিলাম! আমিই এখন ফেরাউনের কাছে যাবো! কে আমাকে ফেরাউনের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন? কে আমাকে ফেরাউনের প্রাসাদ অতিক্রম করার জন্য নিয়ে যাচ্ছেন? ফেরাউনের ভূখণ্ডে নিয়ে যাচ্ছেন? কে আমাকে ফেরাউনের সাথে কথা বলার জন্য নিয়ে যাচ্ছেন? আমি তো তাদের এক লোক হত্যার অপরাধে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম! তারা আমাকে সামনে পেলেই তো তিল-তিল করে মারবে!
মুসা আল্লাহর কথার উপর কোন কথা বললেন না। শুধু আবেদন করলেন,
আল্লাহ, কাজটি অনেক কঠিন। দায়িত্বটি অনেক গুরুভার। অতএব-
قَالَ رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي ﴿۲۵﴾ وَيَسْرُ لِي أَمْرِي
হে আল্লাহ, আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন। আমার কাজ সহজ করে দিন। আমার জিহ্বা থেকে জড়তা দূর করে দিন। [সূরা ত্বাহা: ২৫, ২৬]
মুসা শিশুকালে যে অঙ্গার মুখে দিয়েছিলেন, তার একটা প্রভাব মুখে রয়ে গিয়েছিল। কথা বলার সময় মুখ জড়িয়ে আসে। কথা সুস্পষ্ট হচ্ছে না। মুসার ভাষা যদি স্পষ্ট না হয়, তাহলে ফেরাউন বলবে-
أَمْ أَنَا خَيْرٌ مِّنْ هُذَا الَّذِي هُوَ مَهِينٌ وَلَا يَكَادُ يُبِينُ
আমি যে উত্তম এই ব্যক্তি থেকে, যে নীচ এবং সুস্পষ্ট কথা বলতেও সক্ষম নয়। [যুখরুফ: ৫২]
মুসা -র দোয়ার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তার মুখের জড়তা দূর করে দিলেন। ভাষা স্পষ্ট করে দিলেন। তবে হারুনের মতো অনর্গল ও সুস্পষ্ট ভাষী হননি।
মুসা আল্লাহর কাছে আরও দোয়া করলেন-
وَاجْعَلْ لِّي وَزِيرًا مِّنْ أَهْلِي ﴿۲۹﴾ هُرُونَ أَخِي ﴿۲۰﴾ اشْدُدْ بِهِ أَزْرِي
এবং আমার পরিবারের মধ্য থেকে আমার একজন সাহায্যকারী করে দিন। আমার ভাই হারুনকে। তার মাধ্যমে আমার কোমর মযবুত করে দিন। [সূরা ত্বাহা: ২৯-৩১]
وَأَخِي هُرُونُ هُوَ أَفْصَحُ مِنِّي لِسَانًا فَأَرْسِلْهُ مَعِيَ رِدْاً يُصَدِّقُنِي إِنِّي أَخَافُ أَنْ يُكَذِّبُونِ
আমার ভাই হারুন আমার চেয়ে প্রাঞ্জলভাষী। অতএব তাকে আমার সাথে সাহায্যের জন্য প্রেরণ করুন। সে আমকে সমর্থন জানাবে। [সূরা কাসাস: ৩৪]
অর্থাৎ, হারুন আমার চেয়ে স্পষ্ট ও অনর্গল ভাষী। বিতর্ক-বাদানুবাদে আমার চেয়ে শক্ত বাগ্মী। মুসা আরও দোয়া করলেন-
لَى نُسَبِّحَكَ كَثِيرًا
যেন আমরা বেশি করে আপনার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতে পারি। [সূরা ত্বাহা: ৩৩]
কারণ দুজন একজনের চেয়ে বেশি তাসবীহ পাঠ করতে পারে। একজন অপরজনের তাসবীহ করার জন্য উৎসাহিত করে। এজন্য সফর করলে সাথে কোন সঙ্গী রাখতে হয়। রাসূল -ও সফরকালে সঙ্গী রাখতে বলেছেন।
الرَّاكِبُ شَيْطَانُ
একাকী সফরকারী শয়তান। [সুনানে তিরমিযি: ৮৮৪৯]
মুসা ফেরাউনের প্রাসাদে পৌঁছুলেন। তার গায়ে একটি পশমী জুব্বা ছিল। প্রাসাদের দরজায় তার লাঠি দিয়ে সাড়া দিলেন। ফেরাউনের লোকজন বেরিয়ে এল। মুসা -কে জিজ্ঞেস করল, 'কী চান আপনি?'
মুসা বললেন, 'আমি ফেরাউনের মোকাবেলায় এসেছি। তাকে আমি আল্লাহর দিকে আহ্বান করবো।'
ফেরাউনের লোকজন বলল, 'তিনিই তো আল্লাহ!' (নাউযুবিল্লাহ)
তারা ফেরাউনের কাছে মুসার আগমনের সংবাদ জানাল। ফেরাউন মুসাকে ভিতরে আসার অনুমতি দিলেন। ফেরাউন তখন মনে করছিলেন, মুসা হয়তো পাগল। এই বুঝে ফেরাউন সভাসদের উদ্দেশে বলল-
قَالَ إِنَّ رَسُولَكُمُ الَّذِي أُرْسِلَ إِلَيْكُمْ لَمَجْنُونُ)
তোমাদের কাছে প্রেরিত তোমাদের রাসূলটি নিশ্চয় বন্ধ পাগল। [সূরা শুয়ারা: ২৭]
ফেরাউন মুসা-র উদ্দেশে বলল-
لَئِنِ اتَّخَذْتَ إِلَهَا غَيْرِي لَأَجْعَلَنَّكَ مِنَ الْمَسْجُونِينَ)
তুমি যদি আমার পরিবর্তে অন্যকে উপাস্যরূপে গ্রহণ কর, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করবো। [সূরা শুয়ারা: ২৯]
মুসা বললেন, আমি যদি সুস্পষ্ট কোন নিদর্শন দেখাই?
অতঃপর মুসা নিদর্শনাবলী দেখালেন। হাতের মুজিযা দেখালেন। লাঠির মুজিযা দেখালেন। কিন্তু খবীস ফেরাউন মুজিয়ার বিরুদ্ধে উত্তর প্রদানের জন্য উদ্যত হল। শুক্রবারে তার সকল যাদুকরকে একত্র করল। মানুষের কানে কানে ঘোষণা পাঠাল, সকলেই যেন শুক্রবার সকালে উপস্থিত থাকে। মুসা মনে মনে মানবিক দুর্বলতায় সামান্য ভয়ের আঁচ করলেন। আল্লাহ অহি নাযিল করলেন- 'মুসা! ভয় পেওনা। আমি আছি তোমার পাশে। আমি আছি তোমার সাথে। আমি আছি তোমার পিছনে। তুমি ভয় করো না।'
শুক্রবারের নির্ধারিত সকালে সমবেত সাধারণ মানুষ। উপস্থিত আমন্ত্রিত যাদুকররা। শুরু হল যাদুর খেলা। যাদুকররা তাদের হাতের রশিগুলো ছেড়ে দিল। অমনি রশিগুলো ছুটাছুটি শুরু করল। উড়ে উড়ে ছুটতে শুরু করল। মুসা -র তখনকার অবস্থা-
فَأَوْجَسَ فِي نَفْسِهِ خِيفَةً مُوسَى ﴿۷﴾ قُلْنَا لَا تَخَفْ إِنَّكَ أَنْتَ الْأَعْلَى
অতঃপর মুসা মনে মনে কিছুটা ভীতির আঁচ করলেন। আমি বললাম, ভয় করো না। তুমিই বিজয়ী। [সূরা ত্বাহা: ৬৭, ৬৮]
তুমিই বিজয়ী। তুমি এখনই দেখবে, কে জয়ী হয়, আর কে পরাজিত হয়! মুসা আলাইহিস সালাম তার হাতের লাঠি নিক্ষেপ করলেন। মুসার লাঠি যাদুকরদের রশিগুলো গিলতে শুরু করল। আল্লাহর ইচ্ছা কতো অজেয়! কতো অসীম! মুসার লাঠি যাদুকরদের রশিগুলো গিলে এবার ফেরাউনের দিকে ফিরল তাঁকেও গিলবে বলে! ফেরাউন এ দেখে ত্রস্ত হয়ে গেল।
হাসান বসরি বলেন, ফেরাউন মূলত ছিল ভারহীন, সাহসহীন, উদ্দেশ্যহীন। কবি বলেন-
তুমি যুদ্ধক্ষেত্রে হরীণী দেখে সুখ পাও।
পাখির ডানায় উড়ে যায় তোমার অন্তর।
আমাকোই শুধু অবরোধ; যুদ্ধের কতো আনন্দ-
সেনাপতির হুইসেলে উটপাখিও উড়ে যায়...
মুসা -র রোমাঞ্চকর কাহিনীর শেষে আল্লাহ মুসাকেই জয়ী করেন। ফেরাউনকে পরাজিত করেন। ফেরাউন মুসার পশ্চাদ্ধাবন করে। তারা সমুদ্র সামনে রেখে আগাতে থাকে।
সামনে সমুদ্র। মুসা সমুদ্র দেখে দাঁড়িয়ে যান। আল্লাহ তখন মুসা -কে বলেন, 'তোমার লাঠি দিয়ে সমুদ্রবুকে আঘাত কর'। মুসা তাই করলেন। সমুদ্র চিরে দুই খণ্ড হয়ে যায়। মাঝখানে প্রশস্ত ও নির্বিঘ্ন রাস্তা। মুসা এবং তার কওম সেই রাস্তা দিয়ে সমুদ্র পার হয়ে যান।
ফেরাউনও সামনে অগ্রসর হয়। রাস্তায় উঠার মনস্থ করে। কিন্তু মনে মনে ভয় পেয়ে যায়। সে তার বাহন নিয়ে পিছু হটতে চায়। কিন্তু আল্লাহ তার বাহনকে পিছু হটতে বারণ করেন।
একটি ইসরাঈলি বর্ণনায় পাওয়া যায়, সেখানে জিবরাইল অবতীর্ণ হন। জিবরাইলের বাহন ছিলো একটি খচ্চরী। ফেরাউনের কাছে ছিলো একটি ঘোড়া। ঘোড়া সবসময় খচ্চরীর প্রতি আসক্ত হয়ে থাকে। জিবরাইল তার খচ্চরীসহ সমুদ্রের রাস্তায় উঠলে খচ্চরীর প্রতি আসক্ত হয়ে ফেরাউনের ঘোড়াও সমুদ্রপথে প্রবেশ করে। ফেরাউনের সাথে তার বাহিনীও প্রবেশ করে। ব্যাস!
এটি একটি ইসরাঈলি বর্ণনা। সত্যও হতে পারে, মিথ্যাও হতে পারে।
ফেরাউন তার বাহিনীসহ সমুদ্রের মাঝামাঝি যায়। ও পর্যন্তই তার জীবন শেষ। দুই থেকে মিলে যায় সমুদ্র। গভীর জলরাশিতে পরিণত হয় সমুদ্রবুকের অলৌকিক রাস্তা।
মুসা সমুদ্র পার হয়ে চলে আসেন। আল্লাহর কথা অনুযায়ী মুসাই হন সেদিনের বিজয়ী। আল্লাহর অনুগ্রহ এভাবেই তার প্রিয় বান্দাদের সাথে থাকে। দুনিয়াতেও থাকে, আখেরাতেও থাকে।
📄 রাসূল ﷺ-র প্রতি আল্লাহর সাহায্য ও অনুগ্রহ
রাসূল ﷺ-কে গুপ্তহত্যার সিদ্ধান্ত নিল মক্কার কাফেররা। গোত্রপতিরা বিষমাখানো ধারালো তরবারি তুলে দিল প্রত্যেক গোত্রের সাহসী যুবকদের হাতে। টগবগে কম্পমান যুবকরা তরবারি হাতে রাসূলের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে, কখন রাসূল বের হবেন সেই অপেক্ষায়।
আল্লাহ মহান রাসূলকে সংবাদ জানিয়ে দিলেন, কোরাইশ কাফেররা ঘরের চারদিক ঘিরে নিয়েছে। ফাঁদ পেতে আছে তোমাকে হত্যার জন্য। সুতরাং তুমি ঘর থেকে বের হও।
রাসূল ﷺ এক মুঠো ধুলোমাটি হাতে বের হলেন। ধুলোমাটি ছড়িয়ে দিলেন যুবকদের চোখেমুখে। নিরাপদে ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেলেন পাহাড়ের গুহায়। কাফের যুবকদের তো মাথায় হাত!
কাফের যুবকরা তরবারি হাতে রাসূলের পশ্চাদ্ধাবন করল। যে গুহায় রাসূল অবস্থান করেছেন, সে গুহাটির প্রবেশমুখে আনাগোনা করছে। কে এখন রক্ষা করবে রাসূলকে?
রাসূলের সাথে ছিলেন আবু বকর । তিনি ভয়ে শঙ্কায় কাঁপছেন, রাসূলের না জানি কী হয়ে যায়! রাসূল দৃপ্তভরে বললেন,
لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا
ভয় পেওনা। নিশ্চয় আল্লাহ রয়েছেন আমাদের সাথে। [সূরা তাওবা: ৪০]
আল্লাহর কী কুদরত! একটি কবুতর এসে বাসা বানাল রাসূলের গুহার মুখে! মাকড়শা এসে জাল বুনলো রাসূলের গুহার মুখে। গুহার মুখে এতকিছু দেখে কেউ কি ধারণা করতে পারে, এখানে কোন লোক আছে!
কবির ভাষায়-
ভাবলো তারা মাকড়শায় কবুতরে কী হবে!
ওরা জাল বুনে বাসা বুনে রাসূলকে বাঁচাবে?
কিন্তু কী হবে তীর-বর্শায়
কী হবে কেল্লা বা দুর্গে?
আল্লাহর কারিশমা এসব কিছুর ঊর্ধ্বে, বহু ঊর্ধ্বে!
কাফের সুরাকা রাসূলের খোঁজে বাজবেগে ছুটল মরুর বুকে। কখন পাবে কাঙ্ক্ষিত শিকারী! কখন ধরবে মোহাম্মদকে! কিন্তু আল্লাহর সাথে রাসূলের এক গোপন কথায় সব শেষ! রাসূল আল্লাহর কাছে বললেন-
اللَّهُمَّ اكْفِنَاهُ بِمَا شِئْتَ
তুমি যেভাবে চাও, আমাদের পক্ষে ওর জন্য যথেষ্ট হয়ে যাও। [বুখারি : ৫৬০৭]
রাসূলের এক কথায় খেল খতম। কোন কষ্ট ছাড়া, অবরোধ ছাড়া রাসূল নিরাপদে মদীনায় পৌঁছে গেলেন। আল্লাহ-ই রাসূলের পক্ষে সুরাকার জন্য যথেষ্ট হলেন। তার ঘোড়া পা গেরে মরুর বালিতে বসে পড়ল। সে নিজেও ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ল। গুপ্তহত্যার এত চেষ্টার পর আল্লাহই রাসূল-কে বিজয়ী করলেন।