📄 হাবিব ইবনে যায়েদ এবং মুসায়লামা কাযযাব
মুসায়লামা কাযযাব নিজেকে নবি দাবি করল। রাসূল যখন জানলেন, হাবিব ইবনে যায়েদকে তার কাছে পাঠালেন। হাবিব তখন ত্রিশ বছরের বীর সাহাবি। সে বেড়ে উঠেছিল কোরআনের ছায়ায়। দুনিয়াতে তার সম্পদ বলতে একটি তলোয়ার আর কোরআনই ছিল। তলোয়ার দিয়ে শত্রুর আস্ফালন স্তিমিত করতো। কোরআন দিয়ে আল্লাহ -র কাছে প্রেমের আকুতি জানাতো। প্রত্যুষে সিজদায় অবনমিত হয়ে প্রেম নিবেদন করতো। তার অন্তরে কোরআন ধারণ করতো।
রাসূল বললেন- লোকসকল! আমি তোমাদের বিভিন্ন রাজাদের কাছে পাঠাচ্ছি। তোমরা কেউ বিরোধিতা করো না। [আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৪/২৬৮]
সাহাবায়ে কেরام বললেন, 'হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনার কথা শুনলাম এবং আনুগত্য করলাম।'
রাসূল বললেন- হে হাবিব ইবনে যায়দ! দাঁড়াও। তুমি মুসায়লামা কাযযাবের কাছে যাও।
হাবিব মুসায়লামার কাছে রওয়ানা হচ্ছেন। তার মা তাকে বিদায় জানালেন এবং বিদায় জানানোর সময় খুব কাঁদলেন। কিন্তু তার মা জানতেন, রাসূলের নির্দেশে হাবিব রওয়ানা হয়েছে। তিনি জানতেন, যদিও তার সন্তান এখনই তার থেকে বিচ্ছেদ হচ্ছে, অচিরেই তার সাথে আসমান-যমিনের মতো প্রসস্ত জান্নাতে দেখা হবে। তার অবস্থা হয়েছিল ইবনে যায়দূনের এই কবিতার মতো-
আমাদের বিচ্ছেদ শেষে; যদিও কাঁদিনি দেখেছ তুমি
পার্শদেশ লুটিয়ে, তবুও আমার কপোলদেশ যায়নি বন্ধু শুকিয়ে।
বুকফাটা শোক ছাড়া আর কিছু নেই এই কপালে,
যদিও গো তুমি দেখনি আমায় দুঃখিত বিহ্বলে।
যদিবা হয় সাক্ষাত এই দুনিয়ার ভালোবাসা,
হাশরের দিনে হবে সাক্ষাত -এই মোর প্রেমাশা।
হাবিব মুসায়লামার কাছে আসলেন।
মুসায়লামা তাকে জিজ্ঞেস করল, 'কে তুমি?' : 'আমি হাবিব ইবনে যায়দ।'
মুসায়লামা জিজ্ঞেস করল, 'তোমার সাথে কী এসেছে?'
: 'রাসূল ﷺ-এর পক্ষ থেকে রিসালাতের দাওয়াত নিয়ে এসেছি।'
: 'তুমি কি সাক্ষ্য দিচ্ছ, মোহাম্মদ আল্লাহর রাসূল?'
: 'আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, তিনি আল্লাহর রাসূল।'
: 'তুমি কি সাক্ষ্য দাও, আমিও আল্লাহর রাসূল?'
: 'তুই কি বলছিস, আমি কিছু শুনছি না।'
মুসায়লামা আবার জিজ্ঞেস করল, 'তুমি কি সাক্ষ্য দাও, মোহাম্মদ আল্লাহর রাসূল?'
হাবিব আগের মতোই উত্তর দিলেন, 'আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। মোহাম্মদ ﷺ আল্লাহর রাসূল।'
মুসায়লামা আবার জিজ্ঞেস করল, 'তুমি কি সাক্ষ্য দাও, আমিও আল্লাহর রাসূল?'
হাবিব একই উত্তর দিলেন, 'আমি কিছু শুনছি না।'
মুসায়লামা রেগে গেল। তার এক সৈন্যকে বলল, হাবিবের শরীর থেকে একটু গোশত কেটে ফেল।
আদেশ অনুযায়ী মুসায়লামার এক সৈন্য হাবিব ﷺ-এর শরীর থেকে একটু গোশত কেটে ফেলল।
মুসায়লামা আবার আগের মতো প্রশ্ন করতে থাকল। হাবিব ﷺ ও আগের মতো উত্তর দিতে থাকলেন। মুসায়লামা রাগে ক্ষোভে তার শরীর থেকে আরও গোশত কাটতে থাকল। এক পর্যায়ে হাবিব ইবনে যায়দ ﷺ-এর রুহ আল্লাহ ﷺ-এর কাছে চলে গেল। হাবিব ﷺ শহীদ হলেন।
হে প্রশান্ত মন তুমি, তোমার পালনকর্তার নিকট ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও, এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর। [ফাজর: ২৭-৩০]
📄 খুবাইব ইবনে আদী এবং কোরাইশ কাফেররা
কাফেররা খুবাইব ইবনে আদী-কে ফাঁসির মঞ্চে উপস্থিত করে জিজ্ঞেস করল, 'তোমার শেষ আশা কী, খুবাইব?'
খুবাইব বললেন, 'আমি দুই রাকাত সালাত পড়তে চাই।'
তাকে দুই রাকাত সালাত পড়ার সুযোগ দেয়া হল। তিনি অযু করে দ্রুত দুই রাকাত সালাত আদায় করলেন। সালাত শেষে বললেন, 'তোমরা হয়ত মনে করবে আমি মৃত্যুকে ভয় পেয়েছি। তোমরা যদি এই কথা না বলতে যে, আমি মৃত্যুর ভয়ে ধীরে ধীরে সালাত পড়ছি, তাহলে আমি সালাত আরো ধীরে পড়তাম।'
কাফেররা তাকে আবার ফাঁসির মঞ্চে উঠাল। তিনি তখন আল্লাহর কাছে বললেন,
اللَّهُمَّ أَحْصِهِمْ عَدَدًا وَاقْتُلْهُمْ بَدَدًا وَلَا تُبْقِ مِنْهُمْ أَحَدًا
আল্লাহ, তুমি তাদের গুণে রেখো। তাদের ভয়ঙ্করভাবে ধ্বংস করো। তাদের কাউকে ছেড়ো না।
কাফেররা তখন বলল, 'খুবাইব! তোমাকে তোমার পরিবার-পরিজন, ধন-সম্পদের জন্য ছেড়ে দিয়ে যদি মোহাম্মদকে তোমার স্থানে নিয়ে আসি, তাহলে তুমি কী বল?'
খুবাইব উত্তর দিলেন, 'আল্লাহর কসম! আমি আমার পরিবার-সম্পদের জন্য বেঁচে থাকবো, রাসূলুল্লাহর গায়ে একটি কাঁটা ফুটবে, এমনটা কখনও হতে পারে না।'
অতঃপর কাফেররা তাকে শহীদ করে ফেলল।
ঐতিহাসিকগণ বলেন, মৃত্যুর পূর্বক্ষণে খুবাইব আল্লাহর কাছে দোয়া করে বলছিলেন, 'হে আল্লাহ! আমি যে সুশান্তি পাবো, রাসূলকে তা দিও। হে আল্লাহর রাসূল, সুখের ছটা আপনাকে ছেয়ে নিক। হে আল্লাহর রাসূল, আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। হে আল্লাহর রাসূল, আপনাকে ঘিরে প্রশান্তির নির্ঝরিণী প্রবাহিত হোক।'
খুবাইব মক্কা থেকে এই দোয়া করছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন তখন মদীনায়। রাসূল মদীনা থেকে বললেন, ‘খুবাইব, সুখের ছটা তোমাকেও ছেয়ে নিক। খুবাইব, তোমর উপরও শান্তি বর্ষিত হোক। খুবাইব, তোমাকে ঘিরেও প্রবাহিত হোক প্রশান্তির অবিরল নির্ঝরিণী...’
খুবাইব শহীদ হওয়ার পূর্বে এই কবিতাও পাঠ করেছিলেন-
যেহেতু আমি মুসলিম হিসেবে মৃত্যুবরণ করছি, তাই আমার কোন শঙ্কা নেই; আল্লারহ সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে যে কোন পার্শে আমি ঢলে পড়ি। আমি যেহেতু আল্লাহর পথেই মৃত্যুবরণ করছি, তিনি ইচ্ছা করলে আমার ছিন্নভিন্ন প্রতিটি অঙ্গে বরকত দান করতে পারনে। [সহিহ বুখারি : ৩৯৮৯]
📄 আবু মুসলিম খাওলানি এবং আসওয়াদ আনাসি
আসওয়াদ আনাসি আবু মুসলিম খাওলানিকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুমি আমার উপর ঈমান রাখ? আমাকে নবি মান?’
আবু মুসলিম মিথ্যায় অভিযুক্ত করে বললেন, ‘তুমি কী বলেছ, আমি শুনিনি।’
আবু মুসলিমের উত্তর শুনে আসওয়াদ কিছু লাকড়িতে আগুন জ্বালাল এবং আবু মুসলিমকে সে আগুনে নিক্ষেপ করল।
আবু মুসলিম বললেন, ‘হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি’মাল ওয়াকীল।’ ‘আল্লাহই আমার যথেষ্ট, তিনিই উত্তম কর্মবিধাতা।’
তার দোয়ায় আল্লাহ আগুনকে শীতল ও আরামদায়ক বানিয়ে দিলেন। তিনি যখন মদীনায় ফিরে এলেন, ওমর খুশি হয়ে তার সাথে মুয়ানাকা করলেন এবং বললেন, ‘এই উম্মতের খলীলকে স্বাগতম। ইবরাহিম -র সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ব্যক্তিকে স্বাগতম।’
📄 রবি ইবনে আমের এবং রুস্তম
কাদিসিয়ার যুদ্ধে রবি ইবনে রুস্তম ছিলেন মুসলমানদের শীর্ষব্যক্তি। তিনি যখন বন্দি হয়ে রুস্তমের সামনে উপস্থিত হলেন, রুস্তম তাকে দম্ভভরে হুঙ্কার ছেড়ে বলল, 'কী এসেছে তোমাদের সাথে?'
রবির সাথে ছিল তখন ভাঙ্গা তীর, ছিন্নভিন্ন কাপড়, আহত ঘোড়া। এই নিয়ে রবি প্রতিউত্তর করলেন, 'আল্লাহ আমাদের পাঠিয়েছেন মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে আল্লাহর দাসত্বে মুক্তি দানের জন্য। পার্থিব সঙ্কীর্ণতা থেকে আখেরাতের প্রশস্ততার দিকে ধাবিত করার জন্য। মিথ্যা ধর্মের যাঁতাকল থেকে সত্য ধর্ম ইসলামের ন্যায়নীতি দান করার জন্য।'
দুর্ভাগ্যবান রুস্তম বলল, 'তুমি আমার প্রাসাদ থেকে মুখে-মাথায় মাটি লেপে বের হও।'
রবি ইবনে আমের মাটি নিলেন এবং সাথীদের বললেন, 'এটা হল তোমাদের জন্য সুসংবাদ। আল্লাহ আমাদের এই মাটির মালিক বানাবেন।'
পরবর্তীতে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস সেখানে অভিযান করে বিজয়ী হয়েছিলেন। রুস্তমের প্রাসাদে প্রবেশ করেছিলেন এবং পারস্যদের সব আড্ডাখানা গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। তখন তিনি এই আয়াতগুলো তিলাওয়াত করছিলেন-
'তারা ছেড়ে গিয়েছিল কত উদ্যান আর প্রস্রবণ, কত শষ্যক্ষেত্র আর সুরম্য স্থান, কত সুখের স্থান যাতে তারা সুখগল্প করতো,
এমনই হয়েছিলো এবং আমি এগুলোর মালিক করেছিলাম ভিন্ন সম্প্রদায়কে, তাদের জন্য ক্রন্দন করেনি আকাশ ও পৃথিবী এবং তারা অবকাশও পায়নি।' [দুঃখান: ২৫-২৯]