📘 আল আযকার > 📄 মিথ্যার নিষিদ্ধতা ও যেক্ষেত্রে বৈধ

📄 মিথ্যার নিষিদ্ধতা ও যেক্ষেত্রে বৈধ


মিথ্যার নিষিদ্ধতা ও মিথ্যার ধরন
সামগ্রিকভাবে মিথ্যা হারাম হওয়ার ওপর কুরআন-হাদিসে একাধিক দলিল বিদ্যমান। এটা সবচেয়ে নিকৃষ্ট গুনাহ ও সর্বাধিক খারাপ দোষ। কুরআন-সুন্নাহর দলিলের সাথে সাথে মিথ্যা হারাম হওয়ার ওপর উম্মতের ইজমাও সংঘটিত হয়েছে। সেগুলো আলাদা আলাদা বয়ান করার জরুরত নেই। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হল, হারামের হুকুম থেকে যে মিথ্যাকে বাদ দেয়া হয়েছে সেটা বর্ণনা করা এবং এর সূক্ষ্ম বিষয়গুলো সম্পর্কে অবিহিত করা। মিথ্যার প্রতি ঘৃণার জন্য সর্বসম্মতিক্রমে সহিহ এই হাদিসটাই যথেষ্ট:
(৯৮২) হজরত আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلَاثُ : إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ.
অর্থ: মুনাফিকের আলামত তিনটি: এক. কথা বললে মিথ্যা বলে। দুই. ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে। তিন. তার কাছে আমানত রাখা হলে খেয়ানত করে。
(৯৮৩) হজরত আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস রাদি. থেকে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
أَرْبَعُ مَنْ كُنَّ فِيْهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا، وَمَنْ كَانَتْ فِيْهِ خَصْلَةٌ مِنْهُنَّ كَانَتْ فِيْهِ خَصْلَةٌ مِنَ النِّفَاقِ حَتَّى يَدَعَهَا : إِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ، وَإِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ.
অর্থ: চারটি অভ্যাস যার মধ্যে থাকবে সে খাঁটি মুনাফিক। আর যার মাঝে চারটির যে কোনো একটি অভ্যাস থাকবে, তার মাঝে নিফাকের একটি অভ্যাস থাকবে যতক্ষণ না সে তা পরিত্যাগ করবে: এক. যখন তার কাছে আমানত রাখা হয়, সে খেয়ানত করে। দুই. যখন কথা বলে মিথ্যা বলে। তিন. ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে। চার, ঝগড়ার সময় গালিগালাজ করে。
যেসব মিথ্যা হারাম নয়
(৯৮৪) হজরত উম্মে কুলসুম রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন-
لَيْسَ الْكَذَّابُ الَّذِي يُصْلِحُ بَيْنَ النَّاسِ، فَيَنْمِي خَيْرًا أَوْ يَقُوْلُ خَيْرًا. زَادَ مُسْلِمٌ: قَالَتْ أَمْ كُلْثُومٍ: وَلَمْ أَسْمَعْ يُرَخَّصُ فِي شَيْءٍ مِمَّا يَقُوْلُ النَّاسُ كَذِبُ إِلَّا فِي ثَلَاثٍ : الْحَرْبُ، وَالْإِصْلَاحُ بَيْنَ النَّاسِ، وَحَدِيثُ الرَّجُلِ امْرَأَتَهُ وَحَدِيْثُ الْمَرْأَةِ زَوْجَهَا.
অর্থ: মানুষের ঝগড়া মিটমাট করতে গিয়ে ভালো কথা পৌঁছানো ব্যক্তি মিথ্যাবাদী নয়। সহিহ মুসলিমে অতিরিক্ত আছে- উম্মে কুলসুম বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনটি স্থান ছাড়া আর কোথাও মিথ্যা বলার অনুমতি দিয়েছেন বলে আমি শুনিনি:
এক. যুদ্ধ কৌশলের ক্ষেত্রে।
দুই. মানুষের মাঝে মীমাংসা করার জন্য।
তিন. স্ত্রীর সাথে স্বামীর এবং স্বামীর সাথে স্ত্রীর কথা বলার ক্ষেত্রে。
এই হাদিসে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে, কিছু জায়গায় কোনো কল্যাণে মিথ্যা বলা জায়েজ আছে। কোন কোন জায়গায় মিথ্যা বলা বৈধ উলামায়ে কেরাম সেটার একটা মূলনীতি বর্ণনা করেছেন। আমার দেখা সবচেয়ে উত্তম নীতি হল, গাজালি রহ. যা বর্ণনা করেছেন। আর তা হল- কথা মূলত বলা হয় উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। প্রত্যেক এমন প্রশংসনীয় উদ্দেশ্য যা সত্য ও মিথ্যা উভয় ধরনের কথা বলেই হাসিল করা যায়, সে ক্ষেত্রে প্রয়োজন না থাকার কারণে মিথ্যা বলা হারাম। যদি কেবল মিথ্যা বলেই উদ্দেশ্য হাসিল করা যায়, সত্য বলে সম্ভব না হয়, তাহলে বৈধ উদ্দেশ্যর জন্য মিথ্যা বলা বৈধ। যদি উদ্দেশ্য হাসিল করা ওয়াজিব হয়, তাহলে সেখানে মিথ্যা বলাও ওয়াজিব। কোনো মুসলিম কোনো অত্যাচারীর ভয়ে আত্মগোপনে থাকলে এবং তার ব্যাপারে কাউকে জিজ্ঞাসা করা হলে তার জন্য মিথ্যা বলা ওয়াজিব।
এ ধরনের আরো বিভিন্ন উদাহরণ কিতাবে আছে। তবে এসব ক্ষেত্রে তাওরিয়া অবলম্বন করাই সর্তকতা। তাওরিয়া বলা হয়- সঠিক কোনো উদ্দেশ্যে এমনভাবে কথা বলা যে, এটার দিকে সম্বন্ধ করাতে সে মিথ্যাবাদী নয়; যদিও বাহ্যিকভাবে মিথ্যাবাদী মনে হয়। তবে এসব জায়গায় তাওরিয়া অবলম্বন না করে সরাসরি মিথ্যা বলাও হারাম নয়। ইমাম গাজালি রহ. বলেন, নিজের বা অন্যের স্বার্থ জড়িত এমন বিষয়ে পূর্ববর্তী হুকুমই হবে।
নিজের স্বার্থ জড়িত থাকার উদাহরণ হল, কোনো জালিম কাউকে গ্রেফতার করতঃ দখলের উদ্দেশ্যে তার সম্পদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করল। এমতাবস্থায় তার জন্য অস্বীকার করা জায়েজ আছে। অথবা বাদশাহ কাউকে তার এমন কোনো মন্দকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল, যার হিসাব তার ও আল্লাহর মাঝেই হবে। এমতাবস্থায় তার জন্য সেটা অস্বীকার করা বৈধ আছে। যেমন বলল- আমি ব্যভিচার করিনি, আমি মদপান করিনি।
অন্যের স্বার্থ জড়িত এমন বিষয়ের উদাহরণ হচ্ছে, কাউকে তার মুসলিম ভাইয়ের গোপন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হল। সে তা বলতে অস্বীকার করল। তাকে সত্য-মিথ্যা দুটোর অকল্যাণ নিয়ে ভাবা উচিত। যদি সত্যে বেশি অকল্যাণ হয় তাহলে মিথ্যা বলবে। যদি মিথ্যাতেই বেশি ক্ষতি হয় বা সন্দেহ হয় তাহলে মিথ্যা বলা হারাম। নিজের স্বার্থের কারণে মিথ্যা বৈধ হয়ে থাকলে মিথ্যা না বলা মুস্তাহাব। অন্যের স্বার্থে বৈধ হয়ে থাকলে, অন্যের স্বার্থের ব্যাপারে ছাড় দেয়া বৈধ নয়। ওয়াজিব ছাড়া সাধারণ বৈধতার সব জায়গায়ই মিথ্যা বর্জন করাই বাঞ্ছনীয়।
জ্ঞাতব্য, আহলে সুন্নাতের মত অনুযায়ী মিথ্যা বলা হয়- বাস্তবতার বিপরীত কোনো বিষয়ে সংবাদ দেয়া; হোক তা জেনে-শুনে ইচ্ছা করে অথবা না জেনে অনিচ্ছায়। তবে না জেনে অনিচ্ছায় হলে গুনাহ হবে না। গুনাহ হবে কেবল ইচ্ছা করে বললে। আমাদের দলিল হচ্ছে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিসে মিথ্যাকে ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত করে বলেছেন-
مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ.
অর্থ: যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে আমার নামে কোনো মিথ্যা হাদিস বলবে, সে যেন জাহান্নাম তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়。
কিছু বর্ণনার ক্ষেত্রে নিশ্চিত হওয়া আবশ্যক; নিশ্চিত না হয়ে বর্ণনা করা নিষেধ
আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ * إِنَّ السَّمْعَ وَ الْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا.
অর্থ: যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার পিছনে তুমি পড় না। নিশ্চয় কান, চোখ এবং অন্তর সবগুলো (নিজ কৃতকর্ম সম্পর্কে) জিজ্ঞাসিত হবে。
আরো বলেন-
مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ.
অর্থ: মানুষ যাই বলে তা সংরক্ষণের জন্য একজন সদা প্রস্তুত প্রহরী রয়েছেন。
অন্যত্র বলেন-
إِنَّ رَبَّكَ لَبِالْمِرْصَادِ.
অর্থ: নিশ্চয় আপনার পালকর্তা প্রতীক্ষমান。
(৯৮৫) আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
كَفَى بِالْمَرْءِ كَذِبًا أَنْ يُحَدِّثَ بِكُلِّ مَا سَمِعَ.
অর্থ: প্রত্যেক শুনা কথা (যাচাই ছাড়া) বর্ণনা করে দেয়া মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট。
(৯৮৬) হজরত উমর রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
بِحَسْبِ الْمَرْءِ مِنَ الْكَذِبِ أَنْ يُحَدِّثَ بِكُلِّ مَا سَمِعَ.
অর্থ: মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য প্রত্যেক শুনা কথা বর্ণনা করে দেয়াই যথেষ্ট।
এ অধ্যায়ে সাহাবায়ে কেরামের অনেক বক্তব্য রয়েছে।
(৯৮৭) হজরত ইবনে মাসউদ রাদি. অথবা হজরত হুজায়ফা বিন ইয়ামান রাদি. থেকে সহিহ সনদে বর্ণিত, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-
بِئْسَ مَطِيَّةُ الرَّجُلِ : زَعَمُوا.
অর্থ: ব্যক্তির "তারা ধারণা করে" নামক বাহনটি কতইনা নিকৃষ্ট。
ইমাম খাত্তাবি রহ. "মাআলিমুস সুনান” কিতাবে বলেন- রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষ কথার শুরুতে যে "তারা মনে করে” বা এ জাতীয় কিছু বলে এবং তা দ্বারা উদ্দেশ্য বুঝাতে চায়, সেটাকে বাহনের সাথে তুলনা করেছেন। “তারা মনে করে” বা এ জাতীয় কথা তো কেবল সূত্রবিহীন ও ভিত্তিহীন কথার ক্ষেত্রেই বলা হয়। সেটা আরেকজনকে শুনানোর জন্যই বর্ণনা করা হয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ধরনের কথা বর্ণনার নিন্দা করেছেন। বর্ণনাকৃত বিষয়টি আগেই যাচাই করে নিশ্চিত হতে আদেশ দিয়েছেন। যতক্ষণ কোনো প্রমাণ না পাওয়া যাবে, ততক্ষণ বর্ণনা করবে না।
ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলা ও তাওরিয়ার পথ অবলম্বন করা
জ্ঞাতব্য, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কারণ, এটি প্রচুর পরিমাণ ব্যবহার হয়। বিষয়টি ব্যাপক আকারও ধারণ করেছে। সুতরাং এর পর্যালোচনায় গুরুত্ব দেয়া উচিত। যে সেটা জানে তাকে সে ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা এবং সে অনুযায়ী আমল করা উচিত। মিথ্যার অধ্যায়ে আমরা সেটা মারাত্মক হারাম হওয়ার কথা বলেছি। যবান অনিয়ন্ত্রণের ভয়াবহতার ব্যাপারে বলেছি। এ অধ্যায় হচ্ছে, তা থেকে নিরাপদ থাকার একটা পদ্ধতি।
জ্ঞাতব্য, তারিজ ও তাওরিয়ার ব্যাখ্যা হল, কোনো শব্দ বাহ্যিকভাবে এক অর্থে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু আপনি অন্য অর্থ উদ্দেশ্য নিলেন যা ঐ শব্দের মধ্যে আছে। কিন্তু সেটা বাহ্যিক অর্থের বিপরীতে। এটা এক ধরনের ধোঁকা ও প্রতারণা।
উলামায়ে কেরাম বলেন- শ্রোতাকে ধোঁকা দেয়ার তুলানায় অগ্রগণ্য শরয়ি কোনো কল্যাণ অথবা মিথ্যা ছাড়া পূরণ হয় না এমন কোনো প্রয়োজনের জন্য হলে সমস্যা নেই। এমন কোনো কারণ না থাকলে সেটা মাকরুহ হবে; হারাম নয়। তবে যদি এর মাধ্যমে কোনো অন্যায় পথ গ্রহণ করতে চায় বা কোনো সত্য প্রতিহত করতে চায়, তাহলে সেট হারাম হয়ে যাবে। এটাই হচ্ছে, অধ্যায়ের মূলনীতি।
পক্ষ-বিপক্ষের দলিলগুলো উপরিউক্ত মূলনীতি অনুযায়ী গ্রহণ করতে হবে।
নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে এসেছে:
(৯৮৮) সুফিয়ান বিন আসিদ রাদি. থেকে বর্ণিত, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-
كَبُرَتْ خِيَانَةً أَنْ تُحَدِّثَ أَخَاكَ حَدِيثًا هُوَ لَكَ بِهِ مُصَدِّقُ وَأَنْتَ لَهُ بِهِ كَاذِبٌ.
অর্থ: কতইনা বড় খেয়ানত যে, আপন মুসলিম ভাইয়ের কাছে কোনো কথা এমনভাবে উপস্থাপন করলেন। যাতে সে তোমাকে সত্যবাদী মনে করছে, কিন্তু বাস্তবে তুমি মিথ্যাবাদী。
হজরত ইবনে সীরিন রহ. থেকে বর্ণিত আছে- কথার ময়দান অনেক প্রশস্ত। চালাক ব্যক্তির জন্য মিথ্যা কথা বলার প্রয়োজনই পড়ে না।
বৈধ তারিজের একটা উদাহরণ যা ইবরাহিম নাখায়ি বলেছেন- যখন কারো কাছে তোমার ব্যাপারে সংবাদ যাবে যে, তুমি তাকে নিয়ে কিছু বলেছ, তখন বলবে-
اللهُ يَعْلَمُ مَا قُلْتُ مِنْ ذَلِكَ مِنْ شَيْءٍ.
অর্থ: আমি এ বিষয়ে কিছু বলে থাকলে আল্লাহ পাক অবগত আছেন। এতে শ্রোতা মনে করবে, তুমি তাকে কিছু বলনি। অথচ তুমি এ কথা বলে উদ্দেশ্য নিয়েছ যে, আমি যা বলেছি সেটা আল্লাহ জানেন। (অর্থাৎ শব্দটি আরবিতে “না” বুঝানোর জন্য আসে, আবার অনির্দিষ্টভাবে ব্যাপকতাও বুঝে আসে। তো শ্রোতা নেতিবাচক অর্থ নিবে, আর তুমি অনির্দিষ্ট ব্যাপকতা বুঝাবে)
ইমাম নাখায়ি রহ. আরো বলেন- তুমি নিজ ছেলেকে এভাবে বলবে না যে, আমি তোমার জন্য মিষ্টি ক্রয় করব; বরং বলবে, দেখ! আমি যদি তোমার জন্য মিষ্টি খরিদ করি? ইমাম নাখায়িকে জনৈক ব্যক্তি তলব করলে তিনি দাসীকে বললেন, তুমি তাকে বলে দাও- তাকে মসজিদে গিয়ে তালাশ করুন। আরেকজন বলেন, আমার পিতা একটু আগে বেরিয়ে গেছেন।
ইমাম শাবি রহ. রেখা টেনে দাসীকে বলতেন, তুমি এখানে আঙ্গুল রেখে বলবে, তিনি এখানে নয়। কিছু বুজুর্গ এমন ছিলেন, কেউ তাদেরকে খানার আমন্ত্রণ জানালে বলতেন, আমি এক নিয়তে আছি। নিজে রোজাদার তাকে এ কথা বুঝাতেন, কিন্তু নিয়ত থাকত দাওয়াত ত্যাগের। এমনিভাবে তুমি কি তাকে দেখেছ? এর জবাবে বলবে, আমি তাকে দেখিনি, অর্থাৎ আমি তার শ্বাসযন্ত্র দেখিনি। এছাড়াও অগণিত দৃষ্টান্ত বিদ্যমান।
যদি উপরিউক্ত পন্থায় শপথ করে এবং শপথে তাওরিয়া করে, তাহলে শপথ ভঙ্গকারী হবে না। চাই আল্লাহর নামে শপথ করুক অথবা তালাক ইত্যাদির শপথ করুক। এ ক্ষেত্রে তালাক ইত্যাদি সংঘটিত হবে না। এ হল যদি বিচারক মকদ্দমায় শপথ না করায়। বস্তুতঃ বিচারক আল্লাহর নামে শপথ করালে বিচারকের নিয়ত বিবেচ্য। যদি তালাকের ব্যাপারে শপথ করায় তাহলে শপথকারীর নিয়ত বিবেচ্য। কেননা, বিচারকের জন্য তাকে তালাকের শপথ করানো বৈধ নয়। এ ক্ষেত্রে সে অন্যান্য মানুষের ন্যায়। আল্লাহ তাআলাই সর্বজ্ঞ।
ইমাম গাজালি রহ. বলেন, মানুষ সাধারণত আধিক্য বুঝানোর জন্য বলে থাকে:- তোমাকে ১০০ বার বলেছি, তোমাকে ১০০ বার ডেকেছি। এটাও হারাম মিথ্যার অন্তর্ভুক্ত। এখানে মূলত সংখ্যা উদ্দেশ্য থাকে না, আধিক্য উদ্দেশ্য থাকে। যদি কেবল একবারই ডেকে থাকে তাহলে এভাবে বলাটা মিথ্যে হবে। যদি এত বেশি ডাকে যে, সাধারণত মানুষ এতবার ডাকে না, তাহলে সে গুনাহগার হবে না। যদিও ১০০ বার পর্যন্ত না পৌঁছায়। এ দুটোর মাঝে অনেক ধাপ রয়েছে, যা অতিক্রমকারী অতিক্রম করে থাকে।
ইমাম নববি রহ. বলেন, আধিক্য বুঝানোর জন্য এরকম বলার বৈধতা ও সেটা মিথ্যা পরিগণিত না হওয়ার দলিল হল-
(৯৮৯) নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
أَمَّا أَبُو جَهْمٍ، فَلَا يَضَعُ عَصَاهُ عَنْ عَاتِقِهِ، وَأَمَّا مُعَاوِيَةُ، فَصُعْلُوكُ، لَا مَالَ لَهُ.
অর্থ: আবু জাহম তো ঘাড় থেকে লাঠি নামান না। আর মুআবিয়ার তো কোনো সম্পদ নেই।
অথচ সর্বজনবিদিত যে, মুআবিয়ার পরার মত কাপড় ছিল এবং আবু জাহম ঘুম ও অন্যান্য সময় লাঠি নামিয়ে রাখতেন।

টিকাঃ
১৪৫৩. সহিহ বুখারি: ৩৩, সহিহ মুসলিম: ৫৯।
১৪৫৪. সহিহ বুখারি: ৩৪, সহিহ মুসলিম ৫৮, সুনানে আবু দাউদ: ৪৬৮৮, সুনানে তিরমিজি: ২৬৩৪, সুনানে নাসাঈ ৮/১১৬, মু. আহমাদ ২/১৮৯।
১৪৫৫. সহিহ বুখারি: ২৬৯২, সহিহ মুসলিম: ২৬০৫, সুনানে আবু দাউদ: ৪১২১, সুনানে তিরমিজি: ১৯৩৯, মু. আহমাদ ৬/৪০৩।
১৪৫৬. সহিহ বুখারি: ১২৯১, সহিহ মুসলিম: ৪।
১৪৫৭. ইসরা: ৩৬
১৪৫৮. কাফ: ১৮।
১৪৫৯. সুরা গাশিয়া: ১৪।
১৪৬০. সহিহ মুসলিম ১/১০, সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৯২।
১৪৬১. সহিহ মুসলিম ১/১১।
১৪৬২. সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৭২।
১৪৬৩. সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৭১।
১৪৬৪. সহিহ মুসলিম: ১৪৮০।

📘 আল আযকার > 📄 যেসব শব্দ মাকরুহ নয়

📄 যেসব শব্দ মাকরুহ নয়


যে সব শব্দ একদল আলেমদের দৃষ্টিতে মাকরুহ, অথচ এগুলো মাকরুহ নয়
জেনে রাখুন, এ অধ্যায় এ জন্যে যাতে বাতিল মতবাদে কেউ ধোঁকাগ্রস্ত না হয়। এগুলো বিশ্বাস না করে।
জেনে রাখুন, শরিয়তের বিধান পাঁচটি: ওয়াজিব, মুস্তাহাব, হারাম, মাকরুহ এবং মুবাহ। এগুলোর কোনোটাই দলিল ছাড়া প্রমাণিত হয় না। শরিয়তের দলিলাদি প্রসিদ্ধ বিষয়। অতএব, যেটার পক্ষে দলিল থাকবে না সেটার দিকে কর্ণপাত করা হবে না। সেটা খণ্ডনেরও মুখাপেক্ষী নয়। কেননা সেটা যখন দলিল নয়, খণ্ডনেরও প্রয়োজন নেই। এতদসত্ত্বেও উলামায়ে কেরাম এমন বিষয়ের খণ্ডনে দলিল উল্লেখের কসরত করেছেন। আমার এই ভূমিকা উল্লেখের কারণ হল, আমি যা উল্লেখ করব যে, অমুক একে অপছন্দ করেছেন। অতঃপর বলব, অথচ এটা অপছন্দনীয় নয় অথবা এ কথা বাতিল ইত্যাদি। তখন যাতে এটা বাতিলকরণে দলিলের প্রয়োজন না পড়ে। কোথাও দলিল উল্লেখ করলে সেটা হবে অতিরিক্ত। আমার এ অধ্যায় কায়েমের অভীষ্ট লক্ষ্যই হল, শুদ্ধ-অশুদ্ধের পার্থক্য করা। যাতে করে এই বাতিল উক্তির সম্বন্ধিত ব্যক্তির মর্যাদার কারণে কেউ ধোঁকাগ্রস্ত না হয়।
জেনে রাখুন, আমি এ সকল বাক্য অপছন্দনীয় বলা ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করব না, যাতে তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ না হয়। তাদের প্রতি মানুষের খারাপ ধারণা সৃষ্টি না হয়। তাদের দুর্নাম করা উদ্দেশ্য নয়। তাদের থেকে বর্ণিত বাতিল উক্তি সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করাই লক্ষ্য। চাই এগুলো তাদের থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হোক অথবা না হোক। বিশুদ্ধ হলেও তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে না, যেমনটা অতীত হয়েছে। তবে কখনো আমি ভালো নিয়তে কিছু সংযোজনও করেছি...।
ইমাম আবু জাফর নাহহাস তার কিতাব 'শরহু আসমায়িল্লাহি সুবহানাহু ওয়া তাআলা'য় কিছু আলেম থেকে নকল করেছেন- তিনি এ কথা বলতে অপছন্দ করতেন যে, “আল্লাহ পাক তোমাকে দান করেছেন”। তিনি বলতেন, কেননা দানকারী প্রতিদানের আকাঙ্ক্ষা রাখে।
ইমাম নববি বলেন, এই হুকুম সুস্পষ্ট ভুল ও নিকৃষ্ট মূর্খতা। এই যুক্তিপ্রদান অত্যন্ত নিন্দনীয়। অথচ সহিহ মুসলিমে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ভ্রমণে নামাজ সংক্ষিপ্তকরণের ব্যাপারে বর্ণিত আছে-
صَدَقَةٌ تَصَدَّقَ اللهُ بِهَا عَلَيْكُمْ، فَاقْبَلُوا صَدَقَتَهُ.
অর্থ: এটা আল্লাহ পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য দানস্বরূপ। সুতরাং তার দান গ্রহণ কর。
“হে আল্লাহ আমাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দাও” বলা মাকরুহ নয়
ইমাম নাহহাস পূর্বের বক্তা থেকে নকল করেন যে, তিনি اللَّهُمَّ أَعْتِقْنِي مِنَ النَّارِ : হে আল্লাহ আমাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দাও- বলতে অপছন্দ করতেন। কেননা, তিনি সওয়াবের প্রত্যাশী ছাড়া অন্য কাউকে মুক্তি দেন না।
ইমাম নববি বলেন, এই দাবী ও যুক্তি অত্যন্ত মারাত্মক ভুল ও শরিয়তের বিধান সম্পর্কে হীনতর মূর্খতা। যদি আল্লাহ তাআলা-কর্তৃক তার ইচ্ছানুযায়ী সৃষ্টিকে ক্ষমা বিষয়ক সহিহ হাদিসগুলো অনুসন্ধান করি, তাহলে কিতাবের কলেবর অনেক বড় হয়ে যাবে। যেমন-
مَنْ أَعْتَقَ رَقَبَةً مُسْلِمَةً، أَعْتَقَ اللهُ بِكُلِّ عُضْرٍ مِنْهُ عُضْوًا مِنْهُ مِنَ النَّارِ.
অর্থ: যে ব্যক্তি কোনো দাস মুক্ত করবে, আল্লাহ পাক তার প্রত্যেক অঙ্গের বদলে তার একটি অঙ্গ থেকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবেন。
مَا مِنْ يَوْمٍ أَكْثَرَ مِنْ أَنْ يُعْتِقَ اللهُ فِيْهِ عَبْدًا مِنَ النَّارِ مِنْ يَوْمِ عَرَفَةَ.
অর্থ: আল্লাহ পাক আরাফার দিনে যত মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, অন্য কোনো দিন তত মানুষকে মুক্তি দেন না。
আল্লাহর নামে এরকম কর বলা মাকরুহ নয়
কারো কারো উক্তি- “আল্লাহর নামের ওপর (নামে) এরকম কর” বলা মাকরুহ। কেননা, আল্লাহর নাম সবকিছুর উপরে। কাজি ইয়াজসহ অনেকে বলেছেন, এই বক্তব্য গলদ। সহিহ সনদে বর্ণিত আছে যে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানির ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামকে বলেছেন-
اذْبَحُوا عَلَى اسْمِ اللهِ .
অর্থ: তোমরা আল্লাহর নামের ওপর জবাই কর। অর্থাৎ বিসমিল্লাহ বল।
"আল্লাহ পাক আমাদেরকে তার রহমতের নিবাসে একত্রিত করুন” বলা মাকরুহ নয়
ইমাম নাহহাস আবু বকর মুহাম্মাদ বিন ইয়াহিয়া থেকে নকল করেছেন। তিনি একজন ফকিহ ও আদিব ছিলেন। তিনি বলতেন, এরকম বলবে না যে, আল্লাহ পাক আমাদেরকে তার রহমতের নিবাসে একত্রিত করেছেন। কেননা আল্লাহর রহমত নিবাসের ঊর্ধ্বে। তিনি আরো বলেন, এও বলবে না যে, হে আল্লাহ, আপনার রহমতে আমাদের ওপর রহমত করুন।
ইমাম নববি বলেন, তার দাবীকৃত বাক্যদ্বয়ের কোনো দলিল আমাদের জানা নেই এবং এর কোনো দলিলও নেই। কেননা, রহমতের নিবাস দ্বারা বক্তার অভীষ্ট: জান্নাত। পুরো বাক্যের অর্থ দাঁড়ায়: আল্লাহ পাক আমাদেরকে জান্নাতে একত্রিত করুক, যা প্রশান্তি, অবস্থান ও নিবাসের ঘর। সেখানে প্রবেশকারীরা আল্লাহর রহমতেই প্রবেশ করবে, যেই প্রবেশ করবে চিরদিন বসবাস করবে। সে বিপদাপদ ও পঙ্কিলতামুক্ত থাকবে। এটা স্রেফ আল্লাহর রহমতে অর্জন হবে। অতএব, সে যেন বলছে- আমাদেরকে এমন অবস্থানস্থলে একত্রিত করুন, যাতে আমরা আপনার রহমত আহরণ করতে পারি।
“হে আল্লাহ, আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিন” এবং “হে আল্লাহ, আমাদের জন্য নবিজির সুপারিশ কবুল করুন” বলা মাকরুহ নয়।
ইমাম নাহহাস ঐ আবু বকর থেকে নকল করেন। তিনি বলতেন, এভাবে বলবে না-
اللَّهُمَّ أَجِرْنَا مِنَ النَّارِ : হে আল্লাহ, আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিন
এবং এভাবে বলবে না-
اللَّهُمَّ ارْزُقْنَا شَفَاعَةَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : হে আল্লাহ, আমাদের জন্য নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুপারিশ কবুল করুন।
কেননা, সুপারিশ তো তার জন্যই করা হয়, যার জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়ে যায়।
ইমাম নববি বলেন, এটা গুরুতর ভ্রান্তি ও সুস্পষ্ট মূর্খতা। যদি এই ভুলে মানুষ ধোঁকাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা না থাকত এবং তা লিখিত কিতাবাদিতে না হত তাহলে আমি এটা নকল করার দুঃসাহস দেখাতাম না। অথচ বহু সহিহ হাদিসে পরিপূর্ণ ঈমানদারকে উৎসাহ প্রদানে তাদের সাথে কৃত নবিজির সুপারিশের কথা এসেছে। যেমন:
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী-
مَنْ قَالَ مِثْلَ مَا يَقُوْلُ المُؤَذِّنُ حَلَّتْ لَهُ شَفَاعَتِي.
অর্থ: যে মুয়াজ্জিনের উক্তির ন্যায় আজানের জবাব দিবে, তার জন্য আমার সুপারিশ অবধারিত হয়ে যাবে。
ইমাম হাফেজ ফকিহ আবুল ফজল ইয়াজ রহ. কতইনা সুন্দর বলেছেন- সালাফে সালেহ রাদিয়াল্লাহু আনহুম-কর্তৃক নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুপারিশ কামনা করা এবং এর প্রতি তাদের আগ্রহের বিষয়টি সুপ্রসিদ্ধ বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। তিনি আরো বলেন, যারা একে অপছন্দ করেন এবং একে পাপীষ্ঠদের সাথে বিশিষ্ট করেন, তাদের কথায় কর্ণপাত করা যাবে না। কেননা, সুপারিশের মাধ্যমে কিছু লোকের বিনা হিসাবে জান্নাতে যাওয়ার এবং কিছু লোকের জান্নাতে স্তর বৃদ্ধির কথা সহিহ মুসলিম ইত্যাদির হাদিসে প্রমাণিত আছে। তিনি আরো বলেন, প্রত্যেক সমঝদার লোকই নিজের শিথিলতার স্বীকারকারী, ক্ষমার মুখাপেক্ষী এবং ধ্বংসের আশঙ্কাকারী। অতএব, এমন কথার বক্তাকে মাগফিরাত ও রহমতের প্রত্যাশা করাও অনুচিত। কারণ, এগুলো পাপীষ্ঠদের জন্য। এগুলো সালাফ-খালাফের প্রসিদ্ধ দুআর খেলাপ।
"আমি আমার রব রাব্বে কারিমের ওপর ভরসা করলাম” বলা মাকরুহ নয়
ইমাম নাহহাস ঐ আবু বকর থেকে নকল করেছেন যে, তুমি এরকম বলবে-
تَوَكَّلْتُ عَلَى رَبِّيَّ الرَّبِّ الْكَرِيمِ : আমি আমার রব রাব্বে কারিমের ওপর ভরসা করলাম; বরং বলবে-
تَوَكَّلْتُ عَلَى رَبِّيَّ الْكَرِيمِ : আমি আমার রাব্বে কারিমের ওপর ভরসা করলাম।
ইমাম নববি বলেন, তার কথার কোনো ভিত্তি নেই।
বায়তুল্লাহর তাওয়াফকে শাওত ও দাওর বলা মাকরুহ নয়
একদল আলেমদের থেকে কথিত আছে যে, তারা বায়তুল্লাহর তাওয়াফকে শাওত (রাউন্ড) ও দাওর (চক্র) বলতে অপছন্দ করতেন। তারা বলতেন, বরং প্রথমবারকে বলবে তাওফা, দ্বিতীয়বারকে তাওফাতাইন, তৃতীয়বারকে তাওফাত এবং সপ্তমবারকে তাওয়াফ।
ইমাম নববি বলেন, আমার জানা মতে তাদের এ কথার কোনো ভিত্তি নেই। এগুলো জাহিলি যুগের শব্দ হওয়ার দরুন হয়তবা তারা অপছন্দ করেছেন, তবে এতে কোনো অপছন্দনীয়তা নেই। এটাই বিশুদ্ধ মত。
(৯৯১) হজরত ইবনে আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত আছে-
أَمَرَهُمُ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يَرْمُلُوا الْأَشْوَاطَ الثَّلَاثَةَ، وَلَمْ يَمْنَعْهُ أَنْ يَأْمُرَهُمْ أَنْ يَرْمُلُوا الْأَشْوَاطَ كُلَّهَا إِلَّا الْإِبْقَاءُ عَلَيْهِمْ.
অর্থ: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে তিন শাওতে (চক্রে) দুলে দুলে চলতে নির্দেশ দিয়েছেন। স্রেফ তাদের প্রতি করুণা স্বরূপ সকল চক্রে দুলে দুলে চলতে নির্দেশ দেননি。
"আমরা রমজানের রোজা রেখেছি" এবং "রমজান এসেছে” বলার হুকুম
আমরা রমজানের রোজা রেখেছি এবং রমজান এসেছে ইত্যাদি দ্বারা রমজান মাস উদ্দেশ্য নিলে এটা মাকরুহ হওয়ার ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে।
একদল পূর্বসূরীদের মতে মাসের বৃদ্ধি ছাড়া স্রেফ রমজান বলা মাকরুহ। এ কথা হাসান বাসরি ও মুজাহিদ থেকে বর্ণিত। ইমাম বাইহাকি রহ. বলেন, তাদের উভয় পর্যন্ত সনদ দুর্বল। আর আমাদের উলামাদের মাজহাব হল, এরকম বলা মাকরুহ- রমজান এসেছে, রমজান প্রবেশ করেছে, রমজান উপস্থিত হয়েছে অথবা এ জাতীয় কিছু। যাতে এগুলো দ্বারা মাস অভীষ্ট হওয়ার কোনো আলামত থাকে না। তবে সাথে মাস বুঝায় এমন কোনো আলামত থাকলে মাকরুহ নয়। যেমন- আমি রমজানের রোজা রেখেছি, আমি রমজানের রাতে কিয়াম করেছি, রমজানের রোজা ফরজ, বরকতময় মাস রমজান হাজির হয়েছে। অথবা এ জাতীয় কিছু। আমাদের উলামায়ে কেরামগণ এমনই বলেছেন। ইমাম কাজি আবুল হাসান মাওয়ারদি তার কিতাব "আলহাভি” (৩/২৪১) এ এবং আবু নাসর বিন সাব্বাগ তার "আশশামিল” কিতাবে আমাদের আলেমদের থেকে এমনই নকল করেছেন। তাদের ছাড়া অন্যান্য আলেমগণও মুক্তভাবে নকল করেছেন। তারা নিম্নোক্ত হাদিস দ্বারা যুক্তিপ্রদান করেন।
(৯৯২) হজরত আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَا تَقُوْلُوْا رَمَضَانَ، فَإِنَّ رَمَضَانَ اسْمُ مِنْ أَسْمَاءِ اللَّهِ تَعَالَى، وَلَكِنْ قُوْلُوا: شَهْرُ رَمَضَانَ.
অর্থ: তোমরা রমজান বলবে না। কেননা, রমজান আল্লাহর নামসমূহের এক নাম। তবে তোমরা বলবে, রমজান মাস。
এই হাদিস দুর্বল। স্বয়ং ইমাম বাইহাকি একে দুর্বল আখ্যায়িত করেছেন। এর দুর্বলতা সুস্পষ্ট, কারণ আল্লাহর নামসমূহের ওপর অনেকেই কিতাবাদি লিখেছেন, কিন্তু কেউই রমজান কোনো নাম উল্লেখ করেননি।
ইমাম নববি বলেন, বিশুদ্ধ মত মনে হচ্ছে তাই (আল্লাহই ভালো জানেন) যা ইমাম আবু আবদুল্লাহ বুখারি রহ. তার সহিহে (৩/২৫) এবং অন্যান্য মুহাক্কিক আলেমরা বলেছেন। এতে মুক্তভাবে কোনো অপছন্দনীয়তা নেই, যেভাবেই বলে বলুক। কেননা, দলিল ছাড়া মাকরুহ সাব্যস্ত হয় না, আর এটা মাকরুহ হওয়ার বিষয়ে কোনো দলিল নেই। বরং হাদিসে বিপরীতে বৈধতা প্রমাণিত। এ ব্যাপারে সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম ইত্যাদিতে অগণিত হাদিস বিদ্যমান। আমি সেগুলো একত্রিত করতে গেলে শতাধিক হয়ে যাবে। তবে মাত্র একটি হাদিস দ্বারা লক্ষ্যার্জন হয়ে যায়, সেটা হল-
(৯৯৩) হজরত আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إِذَا جَاءَ رَمَضَانُ ؛ فُتَّحَتْ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ، وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النَّارِ، وَصُفِّدَتِ الشَّيَاطِينُ. وَفِي بَعْضِ رِوَايَاتِ الصَّحِيحَيْنِ فِي هَذَا الْحَدِيْثِ: إِذَا دَخَلَ رَمَضَانُ. وَفِي رِوَايَةٍ لِمُسْلِمٍ: إِذَا كَانَ رَمَضَانَ. وَفِي الصَّحِيحِ لَا تَقَدَّمُوْا رَمَضَانَ.
অর্থ: রমজান আসলে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। শয়তানকে শিকলাবদ্ধ করা হয়。
অন্য বর্ণনায় এই হাদিসে আছে- যখন রমজান প্রবেশ করে。
সহিহ মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে- যখন রমজান হয়...。
সহিহ হাদিসে আছে- তোমরা রমজানের অগ্রবর্তী হয়ো না。
সহিহ হাদিসে আছে- ইসলামের মৌলিক ভিত্তি পাঁচ বস্তুর ওপর... তন্মধ্যে রয়েছে: রমজানের রোজা।
এরকম আরো বহু প্রসিদ্ধ হাদিস বিদ্যমান।
"সুরা বাকারা” ইত্যাদি বলা মাকরুহ নয়
কিছু পূর্ববর্তী থেকে কথিত আছে যে, তারা সুরা বাকারা, সুরা নিসা, সুরা দুখান, সুরা আনকাবুত, সুরা রোম, সুরা আহজাব ইত্যাদি বলাকে অপছন্দ করতেন। তারা বলতেন, বরং এভাবে বলবে- ঐ সুরা যাতে বাকারার কথা আলোচিত হয়েছে, ঐ সুরা যাতে নিসা আলোচিত হয়েছে ইত্যাদি।
ইমাম নববি বলেন, এ কথা ভ্রান্ত ও সুন্নাহর বিপরীত। হাদিসে অসংখ্য জায়গায় এরকম ব্যবহার বিদ্যমান। যেমন: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী-
الْآيَتَانِ مِنْ آخِرِ سُوْرَةِ الْبَقَرَةِ مَنْ قَرَأَهُمَا فِي لَيْلَةٍ كَفَتَاهُ.
অর্থ: যে ব্যক্তি রাতে সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পাঠ করবে, তা তার নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে。
এরকম আরো অগণিত হাদিস রয়েছে।
"আল্লাহ তাআলা তার কিতাবে বলেন” বলা মাকরুহ নয়
হজরত মুতাররিফ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি এরকম বলতে অপছন্দ করতেন- আল্লাহ তাআলা তার কিতাবে বলেন, বরং এভাবে বলবে যে, আল্লাহ তাআলা বলেন। এটা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালবাচক ক্রিয়া হওয়ার কারণে হয়তবা তিনি অপছন্দ করতেন। অথচ আল্লাহর বাণী হচ্ছে তার কালাম, যা কাদিম (অবিনশ্বর)।
ইমাম নববি বলেন, এ কথা গ্রহণযোগ্য নয়,। কারণ, বহু সহিহ হাদিসে বিভিন্নভাবে এর ব্যবহার এসেছে। আমি শরহে সহিহ মুসলিম (৭/৮৪) এ এবং আদাবুল কুররা (পৃ. ১৫৩) এ এ বিষয়ে সতর্ক করেছি।
আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَاللَّهُ يَقُوْلُ الْحَقَّ .
অর্থ: আল্লাহ পাক সত্য বলছেন。
সহিহ মুসলিমে হজরত আবু জর রাদি. থেকে বর্ণিত-
يَقُوْلُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ: مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا.
অর্থ: নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা বলছেন, যে ব্যক্তি একটি পুণ্য সম্পাদন করবে তার জন্য এর সমপরিমাণ (لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا) দশটি পুণ্য থাকবে。
সহিহ বুখারিতে আয়াতের ব্যাখ্যায় আছে-
অর্থ: হজরত আবু তালহা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা বলছেন-
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا.
অর্থ: তোমরা পরিপূর্ণ কল্যাণ ততক্ষণ অর্জন করতে পারবে না, যতক্ষণ নিজের প্রিয় বস্তু থেকে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করবে না。

টিকাঃ
১৪৬৯. সহিহ মুসলিম: ৬৮৬, সুনানে আবু দাউদ: ১১৯৯, সুনানে তিরমিজি: ৩০৩৭, সুনানে নাসাঈ ৩/১১৬।
১৪৭০. সহিহ বুখারি: ৬৭১৫, সহিহ মুসলিম ১৫০৯/২২।
১৪৭১. সহিহ মুসলিম: ১৩৪৮, সুনানে নাসাঈ ৫/২৫১।
১৪৭২. সহিহ মুসলিম: ৩৮৪।
১৪৭৩. সহিহ বুখারি: ১৬০২, সহিহ মুসলিম: ১২৬৬।
১৪৭৪. সুনানে বাইহাকি ৪/২০১।
১৪৭৫. সহিহ বুখারি: ১৮৯৮, সহিহ মুসলিম: ১০৭৯।
১৪৭৬. সহিহ বুখারি: ৩২৭৭, সহিহ মুসলিম: ১০৭৯।
১৪৭৭. সহিহ মুসলিম: ১০৭৯।
১৪৭৮. সহিহ বুখারি: ১৯১৪, সহিহ মুসলিম ১০৮২।
১৪৭৯. সহিহ বুখারি: ৮, সহিহ মুসলিম: ১৬।
১৪৮০. সহিহ বুখারি: ৪০০৮, সহিহ মুসলিম: ৮০৭।
১৪৮১. সুরা আহজাব: ৪।
১৪৮২. সহিহ মুসলিম: ২৬৮৭।
১৪৮৩. সহিহ বুখারি: ৪৫৫৪।

লিঙ্ক শেয়ার করুন
close

লিঙ্ক কপি করুন