📄 যবানের হেফাযত
অধ্যায়- ১৯
যবানের হেফাজত
আল্লাহ তাআলা বলেন-
مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ.
অর্থ: বান্দা যাই বলে তা গ্রহণের জন্য সদা প্রস্তুত একজন প্রহরী নিয়োজিত।
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন-
إِنَّ رَبَّكَ لَبِالْمِرْصَادِ.
অর্থ: নিশ্চয় আপনার রব সতর্ক দৃষ্টি রাখেন。
ইতিপূর্বে আমি যেসব জিকিরে আল্লাহ খুশি হন, সেগুলো উল্লেখ করেছি। এখন ঐ সব কথার আলোচনা করতে চাচ্ছি, যা অপছন্দনীয় বা হারাম। যেন এই কিতাবটিতে কথাবার্তার সকল বিধান থাকে এবং কথাবার্তার সকল প্রকারের আলোচনা হয়ে যায়। সুতরাং এখন আমি এর এমন কিছু উদ্দেশ্য উল্লেখ করব যেগুলো জানা প্রত্যেক দীনদারের জন্য প্রয়োজন। আমি যা উল্লেখ করব, তার অধিকাংশ সবার জানা কথা, তাই বেশিরভাগের সাথে দলিল উল্লেখ করব না। সবকিছুর তাওফিক আল্লাহর হাতেই।
প্রয়োজনে কথা বলা
জ্ঞাতব্য, সবধরনের অনর্থক কথাবার্তা থেকে যবানকে হেফাজতে রাখা প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির জন্য উচিত। শুধু এমন কথা বলবে, যাতে কল্যাণ নিহিত। যখন কথা বলা বা ছেড়ে দেয়া কল্যাণের ক্ষেত্রে বরাবর হয়, তখন বিরত থাকাই সুন্নাহ। কেননা, কখনো নির্দোষ কথাবার্তাও হারাম বা মাকরুহ পর্যন্ত নিয়ে যায়। বরং সাধারণত এটা আরো বেশি হয়ে থাকে। চুপ থাকার বিকল্প কিছু নেই।
(৮৭৪) হজরত আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ، وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ.
অর্থ: যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে (কথা বললে) যেন উত্তম কথা বলে। অন্যথায় যেন চুপ থাকে।
ব্যাখ্যা: এটি সর্বসম্মতিক্রমে সহিহ হাদিস। এটি দ্বারা সুস্পষ্টত বুঝা যায় যে, যখন কথা বলাটা উত্তম হবে, তখনই কথা বলা উচিত। উত্তম তখনই হবে, যখন কথায় থাকবে কল্যাণ। আর যখন কথা দ্বারা কল্যাণ হওয়া/না হওয়া নিয়ে সন্দেহ থাকবে, তখন কথা বলবে না। ইমাম শাফেয়ি রহ. বলেন, কথা বলার আগে চিন্তা করা জরুরি। কথায় কল্যাণ থাকলে বলবে। সন্দেহ হলে কল্যাণ প্রকাশের আগে বলবে না।
(৮৭৫) হজরত আবু মুসা আশআরি রাদি. থেকে বর্ণিত-
قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَيُّ الْإِسْلَامِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُوْنَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ.
অর্থ: আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম, কোন মুসলিম সর্বশ্রেষ্ঠ হে আল্লাহর রাসুল? বললেন, যার হাত ও যবান থেকে অন্য সব মুসলমান নিরাপদ থাকে。
(৮৭৬) হজরত সাহল বিন সাদ রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ يَضْمَنْ لِي مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ، وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ أَضْمَنْ لَهُ الْجَنَّةَ.
অর্থ: যে ব্যক্তি আমাকে তার যবান ও লজ্জাস্থান হেফাজতের গ্যারান্টি দিতে পারবে, আমি তার জান্নাতের জিম্মাদারি নেব。
(৮৭৭) হজরত আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন-
إِنَّ الْعَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مَا يَتَبَيَّنُ فِيْهَا يَزِلُّ بِهَا فِي النَّارِ أَبْعَدَ مِمَّا بَيْنَ الْمَشْرِقِ.
অর্থ: নিশ্চয় অনেক সময় বান্দা এমন কথা বলে, যার পরিণামের কথা চিন্তা করলে জাহান্নামের এমন গভীরে যেতে হবে, যার দূরত্ব পশ্চিম-পূর্বের দূরত্ব থেকেও বেশি।
(৮৭৮) হজরত আবু হুরায়রা রাদি. এর সূত্রে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত-
إِنَّ الْعَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنْ رِضْوَانِ اللهِ، لَا يُلْقِي لَهَا بَالًا يَرْفَعُهُ اللهُ بِهَا دَرَجَاتٍ، وَإِنَّ الْعَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنْ سَخَطِ اللهِ، لَا يُلْقِي لَهَا بَالًا يَهْوِي بِهَا فِي جَهَنَّمَ.
অর্থ: নিশ্চয় বান্দা কখনো নিজের অজান্তেই আল্লাহর সন্তুষ্টির কোনো কথা বলে ফেলে, যদ্দারা আল্লাহ তার মর্যাদা অনেক বাড়িয়ে দেন। আবার কখনো অবচেতন মনে আল্লাহর অসন্তুষ্টির কোনো কথা বলে ফেলে, যার কারণে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে。
(৮৭৯) হজরত বিলাল বিন হারিস মুজানি রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إِنَّ الرَّجُلَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنْ رِضْوَانِ اللهِ ، مَا كَانَ يَظُنُّ أَنْ تَبْلُغَ مَا بَلَغَتْ، يَكْتُبُ اللهُ لَهُ بِهَا رِضْوَانَهُ إِلَى يَوْمٍ يَلْقَاهُ. وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنْ سَخَطِ اللهِ، مَا كَانَ يَظُنُّ أَنْ تَبْلُغَ مَا بَلَغَتْ، يَكْتُبُ اللَّهُ لَهُ بِهَا سَخَطَهُ إِلَى يَوْمِ يَلْقَاهُ.
অর্থ: নিশ্চয় মানুষ পরিণাম না ভেবে আল্লাহর সন্তুষ্টির এমন কথা বলে ফেলে, যদ্দারা আল্লাহ তাআলা তার জন্য কেয়ামত পর্যন্ত স্বীয় সন্তুষ্টি লিখে দেন। আবার কেউ কখনো অবচেতন মনে আল্লাহর অসন্তুষ্টির কথা বলে ফেলে, যার কারণে আল্লাহ পাক কেয়ামত পর্যন্ত তার জন্য স্বীয় অসন্তুষ্টি লিখে দেন। -তিরমিজি রহ. বলেন, হাদিসটি হাসান সহিহ。
(৮৮০) হজরত সুফিয়ান বিন আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত-
قُلْتُ : يَا رَسُوْلَ اللهِ، حَدَّثْنِي بِأَمْرٍ أَعْتَصِمُ بِهِ. قَالَ: قُلْ رَبِّيَ اللَّهُ، ثُمَّ اسْتَقِمْ. قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ ، مَا أَخْوَفُ مَا تَخَافُ عَلَى ؟ فَأَخَذَ بِلِسَانِ نَفْسِهِ ثُمَّ قَالَ : هَذَا.
অর্থ: আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমাকে এমন কথা বলে দিন, যা আমি আকড়ে ধরে থাকব। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি বল, আমার প্রভু আল্লাহ। এরপর এই কথার ওপর অটল থাক। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমার জন্য সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় কী? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের জিহবা ধরে বললেন, এটা (সবচেয়ে আশঙ্কার)। -ইমাম তিরমিজি রহ. বলেন, হাদিসটি হাসান সহিহ。
(৮৮১) হজরত ইবনে উমর রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَا تُكْثِرُوا الْكَلَامَ بِغَيْرِ ذِكْرِ اللهِ، فَإِنَّ كَثْرَةَ الْكَلَامِ بِغَيْرِ ذِكْرِ اللَّهِ، قَسْوَةً لِلْقَلْبِ، وَإِنَّ أَبْعَدَ النَّاسِ مِنَ اللَّهِ، الْقَلْبُ الْقَاسِيِّ.
অর্থ: আল্লাহর স্মরণ ছাড়া বেশি কথা বল না। কেননা আল্লাহর স্মরণ ছাড়া অতি কথন অন্তরকে শক্ত করে দেয়। আল্লাহ থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী ব্যক্তি হচ্ছে, কঠিন হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তি。
(৮৮২) আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ وَقَاهُ اللهُ شَرَّ مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَشَرَّ مَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ دَخَلَ الْجَنَّةَ.
অর্থ: আল্লাহ তাআলা যাকে মুখ ও লজ্জাস্থানের অকল্যাণ থেকে বাঁচিয়ে রাখেন, সে জান্নাতে যাবে। -ইমাম তিরমিজি রহ. বলেন, হাদিসটি হাসান。
(৮৮৩) উকবা বিন আমের রাদি. থেকে বর্ণিত, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! নাজাত কীসে? উত্তরে বললেন-
أَمْسِكْ عَلَيْكَ لِسَانَكَ، وَلْيَسَعْكَ بَيْتُكَ، وَابْكِ عَلَى خَطِيئَتِكَ.
অর্থ: তুমি তোমার যবান সংযমে রাখ। নিজের ঘরকেই নিজের জন্য যথেষ্ট মনে কর। (অর্থাৎ একান্ত জরুরত ছাড়া ঘর থেকে বের হয়ো না) নিজের গুনাহের জন্য (আল্লাহর কাছে) কাঁদতে থাক। ইমাম তিরমিজি রহ. বলেন, হাদিসটি হাসান。
(৮৮৪) হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদি. থেকে বর্ণিত, নবি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন-
إِذَا أَصْبَحَ ابْنُ آدَمَ فَإِنَّ الْأَعْضَاءَ كُلَّهَا تُكَفِّرُ اللَّسَانَ، فَتَقُوْلُ: اتَّقِ اللَّهَ فِيْنَا، فَإِنَّمَا نَحْنُ بِكَ، فَإِنِ اسْتَقَمْتَ اسْتَقَمْنَا، وَإِنِ اعْوَجَجْتَ اعْوَجَجْنَا.
অর্থ: প্রতিদিন আদম সন্তানের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো বিনিতভাবে যবানকে বলে, তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। কেননা, আমরা তো কেবল তোমার অনুগত। তুমি ঠিক থাকলে আমরাও ঠিক থাকব, তুমি বেঁকে গেলে আমরাও বেঁকে যাব。
(৮৮৫) উম্মে হাবিবা রাদি. থেকে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
كُلُّ كَلَامِ ابْنِ آدَمَ عَلَيْهِ، لَا لَهُ، إِلَّا أَمْرُ بِمَعْروفٍ، أَوْ نَهْي عَنْ مُنْكَرٍ، أَوْ ذِكْرُ اللهِ .
অর্থ: আদম সন্তানের প্রতিটি কথা তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। শুধু সৎকাজের আদেশ, অসৎ কাজ থেকে বারণ এবং আল্লাহর জিকির তার পক্ষে দাঁড়াবে。
(৮৮৬) হজরত মুআজ রাদি. থেকে বর্ণিত-
كُنْتُ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي سَفَرٍ، فَأَصْبَحْتُ يَوْمًا قَرِيبًا مِنْهُ وَنَحْنُ نَسِيرُ، فَقُلْتُ: يَا رَسُوْلَ اللهِ ، أَخْبِرْنِي بِعَمَلٍ يُدْخِلُنِي الْجَنَّةَ وَيُبَاعِدُنِي عَنِ النَّارِ. قَالَ: لَقَدْ سَأَلْتَنِي عَنْ عَظِيمٍ، وَإِنَّهُ لَيَسِيرُ عَلَى مَنْ يَسَّرَهُ اللَّهُ عَلَيْهِ ؛ تَعْبُدُ اللهَ وَلَا تُشْرِكْ بِهِ شَيْئًا، وَتُقِيمُ الصَّلَاةَ، وَتُؤْتِي الزَّكَاةَ، وَتَصُومُ رَمَضَانَ، وَتَحُجُّ الْبَيْتَ، ثُمَّ قَالَ: أَلَا أَدُلُّكَ عَلَى أَبْوَابِ الْخَيْرِ ؟ الصَّوْمُ جُنَّةُ، وَالصَّدَقَةُ تُطْفِئُ الْخَطِيئَةَ كَمَا يُطْفِئُ الْمَاءُ النَّارَ ، وَصَلَاةُ الرَّجُلِ مِنْ جَوْفِ اللَّيْلِ. قَالَ: ثُمَّ تَلَا { تَتَجَافَى جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ } حَتَّى بَلَغَ { يَعْمَلُوْنَ }، ثُمَّ قَالَ: أَلَا أُخْبِرُكَ بِرَأْسِ الْأَمْرِ كُلِّهِ وَعَمُوْدِهِ وَذِرْوَةِ سَنَامِهِ ؟ قُلْتُ: بَلَى يَا رَسُوْلَ اللهِ، . قَالَ: رَأْسُ الْأَمْرِ الْإِسْلَامُ، وَعَمُودُهُ الصَّلَاةُ، وَذِرْوَةُ سَنَامِهِ الْجِهَادُ. ثُمَّ قَالَ: أَلَا أُخْبِرُكَ بِمَلَاكِ ذَلِكَ كُلِّهِ ؟ قُلْتُ: بَلَى يَا نَبِيَّ اللهِ . فَأَخَذَ بِلِسَانِهِ قَالَ: كُفَّ عَلَيْكَ هَذَا. فَقُلْتُ: يَا نَبِيَّ اللَّهِ، وَإِنَّا لَمُؤَاخَذُونَ بِمَا نَتَكَلَّمُ بِهِ ؟ فَقَالَ: ثَكِلَتْكَ أُمُّكَ يَا مُعَادُ، وَهَلْ يَكُبُّ النَّاسَ فِي النَّارِ عَلَى وُجُوهِهِمْ - أَوْ عَلَى مَنَاخِرِهِمْ - إِلَّا حَصَائِدُ أَلْسِنَتِهِمْ.
অর্থ: আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমাকে এমন আমল বলে দিন, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি অনেক বড় একটি বিষয়ে প্রশ্ন করেছ। এটা এমন ব্যক্তির জন্য সহজ, যাকে আল্লাহ সহজ করে দেন। (কিছু আমলের বর্ণনা:) তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে। তার সাথে কাউকে শরিক করবে না। নামাজ কায়েম করবে। জাকাত আদায় করবে। রমজানে রোজা রাখবে। হজ পালন করবে। এরপর বললেন, আমি কি তোমাকে কল্যাণের দরজার কথা জানাব না? (সাহাবি বললেন, অবশ্যই) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, রোজা হল ঢাল। সাদকা গুনাহকে মিটিয়ে দেয়, যেমনিভাবে পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়। রাতের শেষাংশে তাহাজ্জুদ পড়া (ও কল্যাণের একটি দরজা) এরপর নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত করলেন-
تَتَجَافَى جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا وَ مِمَّا رَزَقْنَهُمْ يُنْفِقُونَ فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ.
অর্থ: তাদের পার্শ্বদেশ বিছানা থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং তারা নিজ প্রতিপালককে ভয় ও আশার (মিশ্রিত অনুভূতির) সাথে ডাকে। আমি তাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে (সৎকজে) ব্যয় করে। সুতরাং কোনো ব্যক্তি জানে না এরূপ লোকদের জন্য তাদের কর্মফল স্বরূপ চোখ জুড়ানোর কত কি উপকরণ লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
এরপর বললেন, আমি কি তোমাকে দীনের মৌলিক ভিত্তি, খুঁটি ও তার চূড়া সম্পর্কে জানাব না? অবশ্যই ইয়া রাসুলুল্লাহ আমি বললাম। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দীনের মৌলিক ভিত্তি হল আত্মসমর্পণ করা। খুঁটি হল, নামাজ। সর্বোচ্চ চূড়া হল, জিহাদ। এরপর বললেন, আমি এ সব কিছুর সারসংক্ষেপ সম্পর্কে বলব না? আমি বললাম, অবশ্যই। তিনি নিজের জিহবা ধরে বললেন, এই অঙ্গকে তুমি সংযত করবে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা কি আমাদের কথাবার্তার কারণে পাকড়াও হব? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, হে মুআজ! তোমাকে তোমার মা হারিয়ে ফেলুক! মানুষকে তো শুধু তার জিহবার উপার্জনের কারণেই অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। -ইমাম তিরমিজি রহ. বলেন, হাদিসটি হাসান সহিহ。
(৮৮৭) হজরত আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيْهِ.
অর্থ: মানুষের উৎকৃষ্টতা হল, অনর্থক বিষয় বর্জন করা। -হাদিসটি হাসান。
(৮৮৮) আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস রাদি. থেকে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ صَمَتَ نَجَا.
অর্থ: যে চুপ থাকে সে নাজাত পায়। -হাদিসটি দুর্বল। আমি এটা উল্লেখ করেছি কেবল মাশহুর হওয়ার কারণে।
উপরোল্লিখিত হাদিসগুলোর মতো আরো বহু সহিহ হাদিস আছে। যতটুকু ইঙ্গিত করেছি, তা তাওফিক প্রাপ্তদের জন্য যথেষ্ট। গীবতের অধ্যায়ে আরো কিছু হাদিস আলোচনা করব। আল্লাহই তাওফিকদাতা। এ ব্যাপারে পূর্বসূরীদের আসার বা বাণীও রয়েছে অসংখ্য। এগুলোর পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই। তারপরও তাদের থেকে বর্ণিত প্রধান প্রধান কিছু বাণীর উদ্ধৃতি দিচ্ছি।
বর্ণিত আছে যে, একবার কুস বিন সায়িদা এবং আকসাম বিন সাইফি পরস্পর মিলিত হন। একজন অপরজনকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি আদম সন্তানের মধ্যে কী কী দোষ পেয়েছেন? অপরজন বললেন, অগণিত। আমার গণনায় যা এসেছে তার সংখ্যা আট হাজার। তবে আমি এমন একটি গুণও পেয়েছি, যা তুমি আমলে নিলে সব দোষ ঢেকে রাখতে পারবে। সেটা কি? উত্তরে বললেন, যবানের হেফাজত।
আবু আলি ফুজাইল বিন ইয়াজ রহ. বলেন, যে তার কথাবার্তাকে আমলের অংশ মনে করবে, তার অনর্থক কথাবার্তা কমে যাবে। ইমাম শাফেয়ি রহ. তার ছাত্র রবি বিন সুলায়মানকে বলেছিলেন, হে রবি! তুমি অনর্থক কোনো কথা বলবে না। কেননা, কথা বললে কথাই তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করবে; তুমি কথাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না।
ইবনে মাসউদ রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- আটকে রাখার জন্য জিহবা থেকে উপযোগী আর কিছু হতে পারে না। কেউ বলেন, জিহবার উদাহরণ হিংস্র পশুর মতো। তাকে শৃঙ্খলিত না করলে তোমার উপর আক্রমণ করে বসবে।
উসতাজ আবুল কাশেম কুশাইরি রহ. তার প্রসিদ্ধ রিসালায় (পৃ. ৯৭) বলেন, চুপ থাকাই নিরাপদ। এটাই মূল। সময়মতো চুপ থাকা ব্যক্তির গুণ, যেমনিভাবে জায়গামতো কথা বলা সর্বোত্তম অভ্যাস। আবুল কাশেম কুশাইরি আরো বলেন, আমি আবু আলি দাক্কাককে বলতে শুনেছি, যে সত্য বলা থেকে চুপ থাকে সে বোবা শয়তান। আরো বলেন, বুজুর্গানে দীন চুপ থাকাকে এজন্য প্রাধান্য দিয়েছেন যে, তারা বুঝতে পেরেছেন, কথা বললে অনেক ধরনের বিপদ আসে। যেমন- কথা বললে নিজেকে বড় করা, নিজের প্রশংসনীয় গুণাবলী প্রকাশ করা, সুন্দর কথাবার্তার কারণে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হওয়ার দিকে ঝুঁকে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। এটাই আত্মশুদ্ধির লোকদের বিশেষ গুণ। এটা নিজেকে নীচুজ্ঞান ও মানুষকে সংশোধনের মূলনীতি।
এ ব্যাপারে কবিরা বলেন-
احْفَظُ لِسَانَكَ أَيُّهَا الْإِنْسَانُ ... لَا يَلْدِغَنَّكَ إِنَّهُ ثُعْبَانُ
كَمْ فِي الْمَقَابِرِ مِنْ قَتِيلِ لِسَانِهِ ... قَدْ كَانَ هَابَ لِقَاءَهُ الشُّجْعَانُ.
অর্থ: হে মানুষ! তোমরা জিহবাকে সংযত রাখ। কেননা, এটা অজগর; তোমাকে দংশন করে ছাড়বে।
স্বীয় জিহ্বা দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত কত লোক কবরে শুয়ে আছে; বাহাদুররাও তাদের সাক্ষাতে ভয় পেত। -রিয়াশি রহ. বলেন-
لَعُمْرُكَ إِنَّ فِي ذَنْبِي لَشُغلًا ... لِنَفْسِي عَنْ ذُنُوْبِ بَنِي أُمَيَّةَ
عَلَى رَبِّي حِسَابُهُم إِلَيْهِ ... تَنَاهَى عِلْمُ ذَلِكَ لَا إِلَيَّهْ
وَلَيْسَ بِضَائِرِيَ مَا قَدْ أَتَوْهُ ... إِذَا مَا اللَّهُ أَصْلَحَ مَا لَدَيَّهْ.
অর্থ: তোমার জীবনের কসম! আমার নিজের গুনাহ নিয়েই আমার অনেক ব্যস্ততা আছে।
বনু উমাইয়ার দোষ নিয়ে কথা বলার সময় আমার নেই।
তাদের হিসাবের দায়িত্ব আমার রবের।
সে ব্যাপারে তিনিই চূড়ান্ত জানেন, আমি নই।
তাদের কর্ম আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
যখন স্বয়ং আল্লাহ আমার সবকিছু ঠিকঠাক রাখবেন।
টিকাঃ
১২৫৬. সুরা কাফ: ১৮।
১২৫৭. সুরা ফজর: ১৪।
১২৫৮. সহিহ বুখারি: ৬০১৮, সহিহ মুসলিম: ৪৭, সুনানে আবু দাউদ: ৫১৪৫, সুনানে তিরমিজি: ২৫০২, সুনানে ইবনে মাজাহঃ ৩৯৭১।
১২৫৯. সহিহ বুখারি: ১১, সহিহ মুসলিম: ৪২, সুনানে তিরমিজি: ২৫০৬, সুনানে নাসাঈ ৮/১০৬।
১২৬০. সহিহ বুখারি: ৬৪৭৪, সুনানে তিরমিজি: ২৪১০, মু. আহমাদ ৫/৩৩৩।
১২৬১. সহিহ বুখারি: ৬৪৭৮।
১২৬২. মুয়াত্তা মালিক ২/৯৮৫, সুনানে তিরমিজি: ২৩২০, সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩৯৬৯।
১২৬৩. সুনানে তিরমিজি: ২৪১২, সুনানে নাসাঈ: ১১৪২৬, সুনানে ইবনে মাজাহঃ ৩৯৭২, ইবনে হিব্বان: ২৫৪৩, সহিহ মুসলিম: ৩৮।
১২৬৪. সুনানে তিরমিজি: ২৪১৩।
১২৬৫. সুনানে তিরমিজি: ২৪০৯, সহিহ ইবনে হিব্বান: ২৫৪৬, মু. হাকেম ৪/৩৫৭।
১২৬৬. সুনানে তিরমিজি: ২৪০৮, মু. আহমাদ ৪/১৪৮।
১২৬৭. সুনানে তিরমিজি: ২৪০৯, মু. আহমাদ ৩/৯৬
১২৬৮. সুনানে তিরমিজি: ২৪১৪, সুনানে ইবনে মাজাহঃ ৩৯৭৪।
১২৬৯. সাজদাহ: ১৬-১৭।
১২৭০. সুনানে তিরমিজি: ২৬১৯, মু. আহমাদ ৫/২৩১, সুনানে ইবনে মাজাহঃ ৩৯৭৩।
১২৭১. সুনানে তিরমিজি: ২৩১৭, সুনানে ইবনে মাজাহঃ ৩৯৭৬।
অধ্যায়- ১৯
যবানের হেফাজত
আল্লাহ তাআলা বলেন-
مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ.
অর্থ: বান্দা যাই বলে তা গ্রহণের জন্য সদা প্রস্তুত একজন প্রহরী নিয়োজিত।
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন-
إِنَّ رَبَّكَ لَبِالْمِرْصَادِ.
অর্থ: নিশ্চয় আপনার রব সতর্ক দৃষ্টি রাখেন。
ইতিপূর্বে আমি যেসব জিকিরে আল্লাহ খুশি হন, সেগুলো উল্লেখ করেছি। এখন ঐ সব কথার আলোচনা করতে চাচ্ছি, যা অপছন্দনীয় বা হারাম। যেন এই কিতাবটিতে কথাবার্তার সকল বিধান থাকে এবং কথাবার্তার সকল প্রকারের আলোচনা হয়ে যায়। সুতরাং এখন আমি এর এমন কিছু উদ্দেশ্য উল্লেখ করব যেগুলো জানা প্রত্যেক দীনদারের জন্য প্রয়োজন। আমি যা উল্লেখ করব, তার অধিকাংশ সবার জানা কথা, তাই বেশিরভাগের সাথে দলিল উল্লেখ করব না। সবকিছুর তাওফিক আল্লাহর হাতেই।
প্রয়োজনে কথা বলা
জ্ঞাতব্য, সবধরনের অনর্থক কথাবার্তা থেকে যবানকে হেফাজতে রাখা প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির জন্য উচিত। শুধু এমন কথা বলবে, যাতে কল্যাণ নিহিত। যখন কথা বলা বা ছেড়ে দেয়া কল্যাণের ক্ষেত্রে বরাবর হয়, তখন বিরত থাকাই সুন্নাহ। কেননা, কখনো নির্দোষ কথাবার্তাও হারাম বা মাকরুহ পর্যন্ত নিয়ে যায়। বরং সাধারণত এটা আরো বেশি হয়ে থাকে। চুপ থাকার বিকল্প কিছু নেই।
(৮৭৪) হজরত আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ، وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ.
অর্থ: যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে (কথা বললে) যেন উত্তম কথা বলে। অন্যথায় যেন চুপ থাকে।
ব্যাখ্যা: এটি সর্বসম্মতিক্রমে সহিহ হাদিস। এটি দ্বারা সুস্পষ্টত বুঝা যায় যে, যখন কথা বলাটা উত্তম হবে, তখনই কথা বলা উচিত। উত্তম তখনই হবে, যখন কথায় থাকবে কল্যাণ। আর যখন কথা দ্বারা কল্যাণ হওয়া/না হওয়া নিয়ে সন্দেহ থাকবে, তখন কথা বলবে না। ইমাম শাফেয়ি রহ. বলেন, কথা বলার আগে চিন্তা করা জরুরি। কথায় কল্যাণ থাকলে বলবে। সন্দেহ হলে কল্যাণ প্রকাশের আগে বলবে না।
(৮৭৫) হজরত আবু মুসা আশআরি রাদি. থেকে বর্ণিত-
قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَيُّ الْإِسْلَامِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُوْنَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ.
অর্থ: আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম, কোন মুসলিম সর্বশ্রেষ্ঠ হে আল্লাহর রাসুল? বললেন, যার হাত ও যবান থেকে অন্য সব মুসলমান নিরাপদ থাকে。
(৮৭৬) হজরত সাহল বিন সাদ রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ يَضْمَنْ لِي مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ، وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ أَضْمَنْ لَهُ الْجَنَّةَ.
অর্থ: যে ব্যক্তি আমাকে তার যবান ও লজ্জাস্থান হেফাজতের গ্যারান্টি দিতে পারবে, আমি তার জান্নাতের জিম্মাদারি নেব。
(৮৭৭) হজরত আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন-
إِنَّ الْعَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مَا يَتَبَيَّنُ فِيْهَا يَزِلُّ بِهَا فِي النَّارِ أَبْعَدَ مِمَّا بَيْنَ الْمَشْرِقِ.
অর্থ: নিশ্চয় অনেক সময় বান্দা এমন কথা বলে, যার পরিণামের কথা চিন্তা করলে জাহান্নামের এমন গভীরে যেতে হবে, যার দূরত্ব পশ্চিম-পূর্বের দূরত্ব থেকেও বেশি।
(৮৭৮) হজরত আবু হুরায়রা রাদি. এর সূত্রে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত-
إِنَّ الْعَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنْ رِضْوَانِ اللهِ، لَا يُلْقِي لَهَا بَالًا يَرْفَعُهُ اللهُ بِهَا دَرَجَاتٍ، وَإِنَّ الْعَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنْ سَخَطِ اللهِ، لَا يُلْقِي لَهَا بَالًا يَهْوِي بِهَا فِي جَهَنَّمَ.
অর্থ: নিশ্চয় বান্দা কখনো নিজের অজান্তেই আল্লাহর সন্তুষ্টির কোনো কথা বলে ফেলে, যদ্দারা আল্লাহ তার মর্যাদা অনেক বাড়িয়ে দেন। আবার কখনো অবচেতন মনে আল্লাহর অসন্তুষ্টির কোনো কথা বলে ফেলে, যার কারণে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে。
(৮৭৯) হজরত বিলাল বিন হারিস মুজানি রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إِنَّ الرَّجُلَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنْ رِضْوَانِ اللهِ ، مَا كَانَ يَظُنُّ أَنْ تَبْلُغَ مَا بَلَغَتْ، يَكْتُبُ اللهُ لَهُ بِهَا رِضْوَانَهُ إِلَى يَوْمٍ يَلْقَاهُ. وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنْ سَخَطِ اللهِ، مَا كَانَ يَظُنُّ أَنْ تَبْلُغَ مَا بَلَغَتْ، يَكْتُبُ اللَّهُ لَهُ بِهَا سَخَطَهُ إِلَى يَوْمِ يَلْقَاهُ.
অর্থ: নিশ্চয় মানুষ পরিণাম না ভেবে আল্লাহর সন্তুষ্টির এমন কথা বলে ফেলে, যদ্দারা আল্লাহ তাআলা তার জন্য কেয়ামত পর্যন্ত স্বীয় সন্তুষ্টি লিখে দেন। আবার কেউ কখনো অবচেতন মনে আল্লাহর অসন্তুষ্টির কথা বলে ফেলে, যার কারণে আল্লাহ পাক কেয়ামত পর্যন্ত তার জন্য স্বীয় অসন্তুষ্টি লিখে দেন। -তিরমিজি রহ. বলেন, হাদিসটি হাসান সহিহ。
(৮৮০) হজরত সুফিয়ান বিন আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত-
قُلْتُ : يَا رَسُوْلَ اللهِ، حَدَّثْنِي بِأَمْرٍ أَعْتَصِمُ بِهِ. قَالَ: قُلْ رَبِّيَ اللَّهُ، ثُمَّ اسْتَقِمْ. قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ ، مَا أَخْوَفُ مَا تَخَافُ عَلَى ؟ فَأَخَذَ بِلِسَانِ نَفْسِهِ ثُمَّ قَالَ : هَذَا.
অর্থ: আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমাকে এমন কথা বলে দিন, যা আমি আকড়ে ধরে থাকব। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি বল, আমার প্রভু আল্লাহ। এরপর এই কথার ওপর অটল থাক। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমার জন্য সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় কী? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের জিহবা ধরে বললেন, এটা (সবচেয়ে আশঙ্কার)। -ইমাম তিরমিজি রহ. বলেন, হাদিসটি হাসান সহিহ。
(৮৮১) হজরত ইবনে উমর রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَا تُكْثِرُوا الْكَلَامَ بِغَيْرِ ذِكْرِ اللهِ، فَإِنَّ كَثْرَةَ الْكَلَامِ بِغَيْرِ ذِكْرِ اللَّهِ، قَسْوَةً لِلْقَلْبِ، وَإِنَّ أَبْعَدَ النَّاسِ مِنَ اللَّهِ، الْقَلْبُ الْقَاسِيِّ.
অর্থ: আল্লাহর স্মরণ ছাড়া বেশি কথা বল না। কেননা আল্লাহর স্মরণ ছাড়া অতি কথন অন্তরকে শক্ত করে দেয়। আল্লাহ থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী ব্যক্তি হচ্ছে, কঠিন হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তি。
(৮৮২) আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ وَقَاهُ اللهُ شَرَّ مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَشَرَّ مَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ دَخَلَ الْجَنَّةَ.
অর্থ: আল্লাহ তাআলা যাকে মুখ ও লজ্জাস্থানের অকল্যাণ থেকে বাঁচিয়ে রাখেন, সে জান্নাতে যাবে। -ইমাম তিরমিজি রহ. বলেন, হাদিসটি হাসান。
(৮৮৩) উকবা বিন আমের রাদি. থেকে বর্ণিত, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! নাজাত কীসে? উত্তরে বললেন-
أَمْسِكْ عَلَيْكَ لِسَانَكَ، وَلْيَسَعْكَ بَيْتُكَ، وَابْكِ عَلَى خَطِيئَتِكَ.
অর্থ: তুমি তোমার যবান সংযমে রাখ। নিজের ঘরকেই নিজের জন্য যথেষ্ট মনে কর। (অর্থাৎ একান্ত জরুরত ছাড়া ঘর থেকে বের হয়ো না) নিজের গুনাহের জন্য (আল্লাহর কাছে) কাঁদতে থাক। ইমাম তিরমিজি রহ. বলেন, হাদিসটি হাসান。
(৮৮৪) হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদি. থেকে বর্ণিত, নবি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন-
إِذَا أَصْبَحَ ابْنُ آدَمَ فَإِنَّ الْأَعْضَاءَ كُلَّهَا تُكَفِّرُ اللَّسَانَ، فَتَقُوْلُ: اتَّقِ اللَّهَ فِيْنَا، فَإِنَّمَا نَحْنُ بِكَ، فَإِنِ اسْتَقَمْتَ اسْتَقَمْنَا، وَإِنِ اعْوَجَجْتَ اعْوَجَجْنَا.
অর্থ: প্রতিদিন আদম সন্তানের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো বিনিতভাবে যবানকে বলে, তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। কেননা, আমরা তো কেবল তোমার অনুগত। তুমি ঠিক থাকলে আমরাও ঠিক থাকব, তুমি বেঁকে গেলে আমরাও বেঁকে যাব。
(৮৮৫) উম্মে হাবিবা রাদি. থেকে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
كُلُّ كَلَامِ ابْنِ آدَمَ عَلَيْهِ، لَا لَهُ، إِلَّا أَمْرُ بِمَعْروفٍ، أَوْ نَهْي عَنْ مُنْكَرٍ، أَوْ ذِكْرُ اللهِ .
অর্থ: আদম সন্তানের প্রতিটি কথা তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। শুধু সৎকাজের আদেশ, অসৎ কাজ থেকে বারণ এবং আল্লাহর জিকির তার পক্ষে দাঁড়াবে。
(৮৮৬) হজরত মুআজ রাদি. থেকে বর্ণিত-
كُنْتُ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي سَفَرٍ، فَأَصْبَحْتُ يَوْمًا قَرِيبًا مِنْهُ وَنَحْنُ نَسِيرُ، فَقُلْتُ: يَا رَسُوْلَ اللهِ ، أَخْبِرْنِي بِعَمَلٍ يُدْخِلُنِي الْجَنَّةَ وَيُبَاعِدُنِي عَنِ النَّارِ. قَالَ: لَقَدْ سَأَلْتَنِي عَنْ عَظِيمٍ، وَإِنَّهُ لَيَسِيرُ عَلَى مَنْ يَسَّرَهُ اللَّهُ عَلَيْهِ ؛ تَعْبُدُ اللهَ وَلَا تُشْرِكْ بِهِ شَيْئًا، وَتُقِيمُ الصَّلَاةَ، وَتُؤْتِي الزَّكَاةَ، وَتَصُومُ رَمَضَانَ، وَتَحُجُّ الْبَيْتَ، ثُمَّ قَالَ: أَلَا أَدُلُّكَ عَلَى أَبْوَابِ الْخَيْرِ ؟ الصَّوْمُ جُنَّةُ، وَالصَّدَقَةُ تُطْفِئُ الْخَطِيئَةَ كَمَا يُطْفِئُ الْمَاءُ النَّارَ ، وَصَلَاةُ الرَّجُلِ مِنْ جَوْفِ اللَّيْلِ. قَالَ: ثُمَّ تَلَا { تَتَجَافَى جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ } حَتَّى بَلَغَ { يَعْمَلُوْنَ }، ثُمَّ قَالَ: أَلَا أُخْبِرُكَ بِرَأْسِ الْأَمْرِ كُلِّهِ وَعَمُوْدِهِ وَذِرْوَةِ سَنَامِهِ ؟ قُلْتُ: بَلَى يَا رَسُوْلَ اللهِ، . قَالَ: رَأْسُ الْأَمْرِ الْإِسْلَامُ، وَعَمُودُهُ الصَّلَاةُ، وَذِرْوَةُ سَنَامِهِ الْجِهَادُ. ثُمَّ قَالَ: أَلَا أُخْبِرُكَ بِمَلَاكِ ذَلِكَ كُلِّهِ ؟ قُلْتُ: بَلَى يَا نَبِيَّ اللهِ . فَأَخَذَ بِلِسَانِهِ قَالَ: كُفَّ عَلَيْكَ هَذَا. فَقُلْتُ: يَا نَبِيَّ اللَّهِ، وَإِنَّا لَمُؤَاخَذُونَ بِمَا نَتَكَلَّمُ بِهِ ؟ فَقَالَ: ثَكِلَتْكَ أُمُّكَ يَا مُعَادُ، وَهَلْ يَكُبُّ النَّاسَ فِي النَّارِ عَلَى وُجُوهِهِمْ - أَوْ عَلَى مَنَاخِرِهِمْ - إِلَّا حَصَائِدُ أَلْسِنَتِهِمْ.
অর্থ: আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমাকে এমন আমল বলে দিন, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি অনেক বড় একটি বিষয়ে প্রশ্ন করেছ। এটা এমন ব্যক্তির জন্য সহজ, যাকে আল্লাহ সহজ করে দেন। (কিছু আমলের বর্ণনা:) তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে। তার সাথে কাউকে শরিক করবে না। নামাজ কায়েম করবে। জাকাত আদায় করবে। রমজানে রোজা রাখবে। হজ পালন করবে। এরপর বললেন, আমি কি তোমাকে কল্যাণের দরজার কথা জানাব না? (সাহাবি বললেন, অবশ্যই) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, রোজা হল ঢাল। সাদকা গুনাহকে মিটিয়ে দেয়, যেমনিভাবে পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়। রাতের শেষাংশে তাহাজ্জুদ পড়া (ও কল্যাণের একটি দরজা) এরপর নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত করলেন-
تَتَجَافَى جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا وَ مِمَّا رَزَقْنَهُمْ يُنْفِقُونَ فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ.
অর্থ: তাদের পার্শ্বদেশ বিছানা থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং তারা নিজ প্রতিপালককে ভয় ও আশার (মিশ্রিত অনুভূতির) সাথে ডাকে। আমি তাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে (সৎকজে) ব্যয় করে। সুতরাং কোনো ব্যক্তি জানে না এরূপ লোকদের জন্য তাদের কর্মফল স্বরূপ চোখ জুড়ানোর কত কি উপকরণ লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
এরপর বললেন, আমি কি তোমাকে দীনের মৌলিক ভিত্তি, খুঁটি ও তার চূড়া সম্পর্কে জানাব না? অবশ্যই ইয়া রাসুলুল্লাহ আমি বললাম। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দীনের মৌলিক ভিত্তি হল আত্মসমর্পণ করা। খুঁটি হল, নামাজ। সর্বোচ্চ চূড়া হল, জিহাদ। এরপর বললেন, আমি এ সব কিছুর সারসংক্ষেপ সম্পর্কে বলব না? আমি বললাম, অবশ্যই। তিনি নিজের জিহবা ধরে বললেন, এই অঙ্গকে তুমি সংযত করবে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা কি আমাদের কথাবার্তার কারণে পাকড়াও হব? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, হে মুআজ! তোমাকে তোমার মা হারিয়ে ফেলুক! মানুষকে তো শুধু তার জিহবার উপার্জনের কারণেই অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। -ইমাম তিরমিজি রহ. বলেন, হাদিসটি হাসান সহিহ。
(৮৮৭) হজরত আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيْهِ.
অর্থ: মানুষের উৎকৃষ্টতা হল, অনর্থক বিষয় বর্জন করা। -হাদিসটি হাসান。
(৮৮৮) আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস রাদি. থেকে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ صَمَتَ نَجَا.
অর্থ: যে চুপ থাকে সে নাজাত পায়। -হাদিসটি দুর্বল। আমি এটা উল্লেখ করেছি কেবল মাশহুর হওয়ার কারণে।
উপরোল্লিখিত হাদিসগুলোর মতো আরো বহু সহিহ হাদিস আছে। যতটুকু ইঙ্গিত করেছি, তা তাওফিক প্রাপ্তদের জন্য যথেষ্ট। গীবতের অধ্যায়ে আরো কিছু হাদিস আলোচনা করব। আল্লাহই তাওফিকদাতা। এ ব্যাপারে পূর্বসূরীদের আসার বা বাণীও রয়েছে অসংখ্য। এগুলোর পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই। তারপরও তাদের থেকে বর্ণিত প্রধান প্রধান কিছু বাণীর উদ্ধৃতি দিচ্ছি।
বর্ণিত আছে যে, একবার কুস বিন সায়িদা এবং আকসাম বিন সাইফি পরস্পর মিলিত হন। একজন অপরজনকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি আদম সন্তানের মধ্যে কী কী দোষ পেয়েছেন? অপরজন বললেন, অগণিত। আমার গণনায় যা এসেছে তার সংখ্যা আট হাজার। তবে আমি এমন একটি গুণও পেয়েছি, যা তুমি আমলে নিলে সব দোষ ঢেকে রাখতে পারবে। সেটা কি? উত্তরে বললেন, যবানের হেফাজত।
আবু আলি ফুজাইল বিন ইয়াজ রহ. বলেন, যে তার কথাবার্তাকে আমলের অংশ মনে করবে, তার অনর্থক কথাবার্তা কমে যাবে। ইমাম শাফেয়ি রহ. তার ছাত্র রবি বিন সুলায়মানকে বলেছিলেন, হে রবি! তুমি অনর্থক কোনো কথা বলবে না। কেননা, কথা বললে কথাই তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করবে; তুমি কথাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না।
ইবনে মাসউদ রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- আটকে রাখার জন্য জিহবা থেকে উপযোগী আর কিছু হতে পারে না। কেউ বলেন, জিহবার উদাহরণ হিংস্র পশুর মতো। তাকে শৃঙ্খলিত না করলে তোমার উপর আক্রমণ করে বসবে।
উসতাজ আবুল কাশেম কুশাইরি রহ. তার প্রসিদ্ধ রিসালায় (পৃ. ৯৭) বলেন, চুপ থাকাই নিরাপদ। এটাই মূল। সময়মতো চুপ থাকা ব্যক্তির গুণ, যেমনিভাবে জায়গামতো কথা বলা সর্বোত্তম অভ্যাস। আবুল কাশেম কুশাইরি আরো বলেন, আমি আবু আলি দাক্কাককে বলতে শুনেছি, যে সত্য বলা থেকে চুপ থাকে সে বোবা শয়তান। আরো বলেন, বুজুর্গানে দীন চুপ থাকাকে এজন্য প্রাধান্য দিয়েছেন যে, তারা বুঝতে পেরেছেন, কথা বললে অনেক ধরনের বিপদ আসে। যেমন- কথা বললে নিজেকে বড় করা, নিজের প্রশংসনীয় গুণাবলী প্রকাশ করা, সুন্দর কথাবার্তার কারণে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হওয়ার দিকে ঝুঁকে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। এটাই আত্মশুদ্ধির লোকদের বিশেষ গুণ। এটা নিজেকে নীচুজ্ঞান ও মানুষকে সংশোধনের মূলনীতি।
এ ব্যাপারে কবিরা বলেন-
احْفَظُ لِسَانَكَ أَيُّهَا الْإِنْسَانُ ... لَا يَلْدِغَنَّكَ إِنَّهُ ثُعْبَانُ
كَمْ فِي الْمَقَابِرِ مِنْ قَتِيلِ لِسَانِهِ ... قَدْ كَانَ هَابَ لِقَاءَهُ الشُّجْعَانُ.
অর্থ: হে মানুষ! তোমরা জিহবাকে সংযত রাখ। কেননা, এটা অজগর; তোমাকে দংশন করে ছাড়বে।
স্বীয় জিহ্বা দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত কত লোক কবরে শুয়ে আছে; বাহাদুররাও তাদের সাক্ষাতে ভয় পেত। -রিয়াশি রহ. বলেন-
لَعُمْرُكَ إِنَّ فِي ذَنْبِي لَشُغلًا ... لِنَفْسِي عَنْ ذُنُوْبِ بَنِي أُمَيَّةَ
عَلَى رَبِّي حِسَابُهُم إِلَيْهِ ... تَنَاهَى عِلْمُ ذَلِكَ لَا إِلَيَّهْ
وَلَيْسَ بِضَائِرِيَ مَا قَدْ أَتَوْهُ ... إِذَا مَا اللَّهُ أَصْلَحَ مَا لَدَيَّهْ.
অর্থ: তোমার জীবনের কসম! আমার নিজের গুনাহ নিয়েই আমার অনেক ব্যস্ততা আছে।
বনু উমাইয়ার দোষ নিয়ে কথা বলার সময় আমার নেই।
তাদের হিসাবের দায়িত্ব আমার রবের।
সে ব্যাপারে তিনিই চূড়ান্ত জানেন, আমি নই।
তাদের কর্ম আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
যখন স্বয়ং আল্লাহ আমার সবকিছু ঠিকঠাক রাখবেন।
টিকাঃ
১২৫৬. সুরা কাফ: ১৮।
১২৫৭. সুরা ফজর: ১৪।
১২৫৮. সহিহ বুখারি: ৬০১৮, সহিহ মুসলিম: ৪৭, সুনানে আবু দাউদ: ৫১৪৫, সুনানে তিরমিজি: ২৫০২, সুনানে ইবনে মাজাহঃ ৩৯৭১।
১২৫৯. সহিহ বুখারি: ১১, সহিহ মুসলিম: ৪২, সুনানে তিরমিজি: ২৫০৬, সুনানে নাসাঈ ৮/১০৬।
১২৬০. সহিহ বুখারি: ৬৪৭৪, সুনানে তিরমিজি: ২৪১০, মু. আহমাদ ৫/৩৩৩।
১২৬১. সহিহ বুখারি: ৬৪৭৮।
১২৬২. মুয়াত্তা মালিক ২/৯৮৫, সুনানে তিরমিজি: ২৩২০, সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩৯৬৯।
১২৬৩. সুনানে তিরমিজি: ২৪১২, সুনানে নাসাঈ: ১১৪২৬, সুনানে ইবনে মাজাহঃ ৩৯৭২, ইবনে হিব্বان: ২৫৪৩, সহিহ মুসলিম: ৩৮।
১২৬৪. সুনানে তিরমিজি: ২৪১৩।
১২৬৫. সুনানে তিরমিজি: ২৪০৯, সহিহ ইবনে হিব্বান: ২৫৪৬, মু. হাকেম ৪/৩৫৭।
১২৬৬. সুনানে তিরমিজি: ২৪০৮, মু. আহমাদ ৪/১৪৮।
১২৬৭. সুনানে তিরমিজি: ২৪০৯, মু. আহমাদ ৩/৯৬
১২৬৮. সুনানে তিরমিজি: ২৪১৪, সুনানে ইবনে মাজাহঃ ৩৯৭৪।
১২৬৯. সাজদাহ: ১৬-১৭।
১২৭০. সুনানে তিরমিজি: ২৬১৯, মু. আহমাদ ৫/২৩১, সুনানে ইবনে মাজাহঃ ৩৯৭৩।
১২৭১. সুনানে তিরমিজি: ২৩১৭, সুনানে ইবনে মাজাহঃ ৩৯৭৬।
📄 পরনিন্দা ও চুগলি করা হারাম
পরনিন্দা ও চুগলি করা হারাম
এ দুটি দোষ সবচেয়ে খারাপ এবং মানুষের মাঝে ছড়ায় সবচেয়ে বেশি। কমই মানুষ দোষ দুটো থেকে মুক্ত। এগুলো থেকে সতর্ককরণে খুব প্রয়োজনীয়তা লক্ষ্য করতঃ এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করছি।
গীবত বা পরনিন্দা: মানুষের এমন কোনো দোষচর্চা করা, যা সে পছন্দ করে না। হোক না তা তার শরীরে, ধর্ম পালনে, জাগতিক বিষয়ে, সত্তায়, সৃষ্টিতে, চরিত্রে, সম্পদে, কিংবা সন্তানাদি, পিতা-মাতা, স্বামী বা স্ত্রী, খাদেম, অধীনস্থ কারো মাঝে। অথবা তার পাগড়িতে, কাপড়ে, চলাফেরায় বা তার প্রফুল্লতায়, অনৈতিকতায়, কঠোরতায়, সাবলীলতায় কিংবা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে। সে আলোচনা হোক না যবানে-কলমে। অথবা চোখ, হাত, মাথা কিংবা অন্য কিছু দিয়ে ইশারা-ইঙ্গিতে।
শারীরিক বিষয়ে দোষচর্চার কিছু উদাহরণ: যেমন বলা- অমুক অন্ধ। লেংড়া। কানা। কুষ্ঠরোগী। খাটো। লম্বা। কালো। কিংবা সাদা।
দীনি বিষয়ে: অমুক ফাসেক। চোর। খেয়ানতকারী। অত্যাচারী। নামাজে শিথিলতা প্রদর্শনকারী। নাপাকের ব্যাপারে অসতর্ক। মা-বাবার সাথে অসদাচরণকারী। নির্দিষ্ট স্থানে জাকাত অনাদায়ী। গীবত পরিহার করে না।
জাগতিক বিষয়ে: অমুক বেয়াদব। মানুষকে তুচ্ছজ্ঞানী। অন্যের হক অস্বীকারকারী। বাচাল। পেটুক। বেশি ঘুমায়। অসময়ে ঘুমায়। অস্থানে বসে পড়ে।
পিতা সংক্রান্ত: তার পিতা ফাসেক। হিন্দি। নাবতি। নিগ্রো। মুচি। কাপড় ব্যবসায়ী। পশু ব্যবসায়ী। কাঠমিস্ত্রি। কামার। তাঁতী। অথবা এ ধরনের কিছু বলা।
চরিত্র বিষয়ে: চরিত্র খারাপ। অহঙ্কারী। ঝগড়াটে। হঠকারী। স্বেচ্ছাচারী। অক্ষম। দুর্বল অন্তরের অধিকারী। চেহারায় সবসময় বিরক্তিভাব প্রকাশকারী অথবা নির্লজ্জ; এ জাতীয় কিছু বলা।
পোশাক বিষয়ে: তার পোশাকের হাতা প্রশস্ত। আচল লম্বা। তার কাপড় নোংরা। ইত্যাদি। অন্যান্য বিষয়গুলোকে এর ওপর অনুমান করে নিবেন। মূলনীতি: অপরের অপছন্দনীয় জিনিস আলোচনা করা।
ইমাম আবু হামেদ গাজালি রহ. এ ব্যাপারে উম্মাহর ঐক্য নকল করেছেন যে, গীবত বলা হয়- অন্যের এমন বিষয় আলোচনা করা, যা সে পছন্দ করে না। একটু পরেই এ সম্পর্কে হাদিস আসছে।
চোগলখোরি: বিশৃংখলার উদ্দেশ্যে একজনের কথা আরেকজনের কাছে পৌঁছানো। এ হল গীবত ও চোগলখোরির সংজ্ঞা।
উভয়ের হুকুম: উম্মাহর ঐক্যমতে এই অভ্যাস দুটো হারাম। কুরআন, সুন্নাহ এবং ইজমায়ে উম্মতে এর বহু দ্ব্যর্থহীন দলিল বিদ্যমান। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا.
অর্থ: তোমরা একে অপরের দোষচর্চা কর না。
আরো বলেন-
وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ.
অর্থ: প্রত্যেক পরনিন্দাকারী ও দোষচর্চাকারীর জন্য বড়ই দুর্ভোগ!
আরো বলেন-
هَمَّازٍ مَشَّاءٍ بِنَمِيمٍ.
অর্থ: সে নিন্দা করতে অভ্যস্ত, চুগলি করে বেড়ায়。
(৮৮৯) হজরত হুজায়ফা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ نَمَّامُ.
অর্থ: চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না。
(৮৯০) হজরত ইবনে আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত-
أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّ بِقَبْرَيْنِ، فَقَالَ: إِنَّهُمَا يُعَذِّبَانِ وَمَا يُعَذِّبَانِ فِي كَبِيرٍ. وَفِي رِوَايَةِ الْبُخَارِيُّ: بَلَى إِنَّهُ كَبِيرُ، أَمَّا أَحَدُهُمَا، فَكَانَ يَمْشِيْ بِالنَّمِيمَةِ، وَأَمَّا الْآخَرُ، فَكَانَ لَا يَسْتَتِرُ مِنْ بَوْلِهِ.
অর্থ: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার দুটি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। বললেন, এদেরকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে, কিন্তু বড় কোনো কারণে নয়। বর্ণনাকারী বলেন, বুখারির রেওয়ায়াতে আছে: হ্যাঁ, অবশ্যই আজাবের কারণটা বড় বিষয় ছিল। তাদের একজন চোগলখুরী করত আর অপরজন প্রস্রাবের ছিঁটা থেকে বেঁচে থাকত না。
উলামায়ে কেরাম বলেন, "বড় কোনো কারণে শাস্তি দেয়া হচ্ছে না” এর ব্যাখ্যা হল- তাদের ধারণায় সেটা বড় কোনো বিষয় ছিল না অথবা যেটা ছেড়ে দেয়া তাদের পক্ষে কঠিন কিছু ছিল না。
(৮৯১) হজরত আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
أَتَدْرُوْنَ مَا الْغِيْبَةُ ؟ قَالُوا : اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ. قَالَ: ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ. قِيلَ: أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ فِي أَخِي مَا أَقُولُ ؟ قَالَ: إِنْ كَانَ فِيْهِ مَا تَقُوْلُ فَقَدِ اغْتَبْتَهُ، وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيْهِ فَقَدْ بَهَتَهُ.
অর্থ: তোমরা জান কি গীবত কাকে বলে? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আল্লাহ এবং তার রাসুল ভালো জানেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার ভাইয়ের এমন বিষয় আলোচনা করা, যা সে পছন্দ করে না। বলা হল, যদি ভাইয়ের মাঝে আলোচিত দোষটা থাকে (তবুও কি গীবত হবে?) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি বলা দোষটা থাকে তাহলে তুমি তার গীবত করলে। আর যদি সেটা না থাকে তাহলে তাকে অপবাদ দিলে। -ইমাম তিরমিজি রহ. বলেন, হাদিসটি হাসান সহিহ。
(৮৯২) হজরত আবু বাকরা রাদি. থেকে বর্ণিত, বিদায় হজে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানির দিনে মিনার খুতবায় বলেন-
إِنَّ دِمَاءَكُمْ، وَأَمْوَالَكُمْ عَلَيْكُمْ حَرَامٌ، كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا، فِي شَهْرِكُمْ هَذَا، فِي بَلَدِكُمْ هَذَا، إِلَى يَوْمِ تَلْقَوْنَ رَبَّكُمْ، أَلَا هَلْ بَلَّغْتُ؟
অর্থ: তোমাদের প্রত্যেকের জান-মাল, ইজ্জত-আবরু অপর জনের জন্য হারাম। যেমন হারাম এই মাস, এই শহর, এই দিন। আমি কি তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি?
(৮৯৩) হজরত আয়েশা রাদি. থেকে বর্ণিত-
قُلْتُ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: حَسْبُكَ مِنْ صَفِيَّةَ كَذَا وَكَذَا. قَالَ غَيْرُ مُسَدَّدٍ : تَعْنِي قَصِيرَةٌ. فَقَالَ : لَقَدْ قُلْتِ كَلِمَةً لَوْ مُزِجَتْ بِمَاءِ الْبَحْرِ لَمَزَجَتْهُ قَالَتْ: وَحَكَيْتُ لَهُ إِنْسَانًا، فَقَالَ: مَا أُحِبُّ أَنِّي حَكَيْتُ إِنْسَانًا وَأَنَّ لِي كَذَا وَكَذَا.
অর্থ: আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, সাফিয়া থেকে আপনার দূরে থাকার জন্য তার এই এই দোষ যথেষ্ট। বর্ণনাকারী বলেন, এ দ্বারা তিনি তাকে খাটো উদ্দেশ্য নিয়েছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি তো এমন এক দুর্গন্ধময় কথা বলে ফেলেছ, তা যদি সমুদ্রের পানির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়, তাহলে সব পানি দুর্গন্ধ হয়ে যাবে। আয়েশা রাদি. বলেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এক ব্যক্তির সমালোচনা করলাম। তিনি বললেন, কোনো ব্যক্তির সমালোচনা করতে আমি পছন্দ করি না, অথচ আমার মধ্যেও সমালোচনার বিষয় আছে। -ইমাম তিরমিজি রহ. একে হাসান সহিহ বলেছেন。
ফায়দা: مَزَجَتْهُ অর্থ: সমুদ্রের সাথে এমনভাবে মিশ্রিত হবে যে, দুর্গন্ধ ও কদর্যতার কারণে সমুদ্রের পানির স্বাদ ও গন্ধ পরিবর্তন হয়ে যাবে। হাদিসটি গীবতের ব্যাপারে বড় ধমকিগুলোর একটি, অথবা এটিই সবচেয়ে বড় ধমকি। গীবতের নিন্দার ক্ষেত্রে এর মত কোনো হাদিস আছে বলে আমার জানা নেই। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ প্রবৃত্তি থেকে কোনো কথা বলেন না, যাই বলেন তা কেবল তার প্রতি প্রেরিত ওহি। আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে তার দয়া ও সমস্ত অপছন্দনীয় কাজ থেকে বিরত থাকার তাওফিক প্রার্থনা করি।
(৮৯৪) হজরত আনাস রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَمَّا عُرِجَ بِي مَرَرْتُ بِقَوْمٍ لَهُمْ أَظْفَارُ مِنْ نُحَاسٍ، يَحْمِشُوْنَ وُجُوهَهُمْ وَصُدُوْرَهُمْ، فَقُلْتُ: مَنْ هَؤُلَاءِ يَا جِبْرِيلُ ؟ قَالَ: هَؤُلَاءِ الَّذِينَ يَأْكُلُوْنَ لُحُوْمَ النَّاسِ، وَيَقَعُوْنَ فِي أَعْرَاضِهِمْ.
অর্থ: আমি মেরাজের রাতে এক সম্প্রদায়ের পাশ দিয়ে অতিক্রম করি। তাদের রয়েছে তামার নখ, যা দিয়ে তারা নিজেদের চেহারা ও বুক আচড়াচ্ছিল। জিবরিল আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? বললেন, ঐ সমস্ত লোক যারা মানুষের গোশত ভক্ষণ করত এবং তাদের ইজ্জত নষ্ট করার পিছনে পড়ত।
(৮৯৫) হজরত সাঈদ বিন জায়েদ রাদি. থেকে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إِنَّ مِنْ أَرْبَى الرِّبَا الاسْتِطَالَةَ فِي عِرْضِ الْمُسْلِمِ بِغَيْرِ حَقٌّ.
অর্থ: নিশ্চয়ই সবচেয়ে নিকৃষ্ট সুদ (অপরাধ) হচ্ছে, অন্যায়ভাবে কোনো মুসলমানের সম্মান বিনষ্টের চেষ্টা করা।
(৮৯৬) আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ، لَا يَخُونُهُ ، وَلَا يَكْذِبُهُ، وَلَا يَخْذُلُهُ، كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ؛ عِرْضُهُ، وَمَالُهُ ، وَدَمُهُ، التَّقْوَى هَاهُنَا، بِحَسْبِ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْتَقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ.
অর্থ: মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার ভাইয়ের সাথে খেয়ানত করতে পারে না, মিথ্যা বলতে পারে না এবং তাকে অপমান করতে পারে না। প্রত্যেক মুসলমানের জান-মাল ইজ্জত-আবরু অপর মুসলমানের জন্য হারাম। এক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করতে হবে। কোনো ব্যক্তি নিকৃষ্ট হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ করে দেখে। -ইমাম তিরমিজি রহ. বলেন, হাদিসটি হাসান। নববি রহ. বলেন, এই হাদিসের ফায়দা অনেক ব্যাপক ও বৃহৎ।
গীবতের সংজ্ঞা-সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বর্ণনা
পূর্বের অধ্যায়ে আমরা উল্লেখ করেছি যে, গীবত বলা হয়- অপরের এমন বিষয় আলোচনা করা, যা সে অপছন্দ করে। হোক সেটা মৌখিক বা লিখিত কিংবা চোখ, হাত বা মাথা দিয়ে ইঙ্গিতের মাধ্যমে। মূলনীতি হল, প্রত্যেক এমন পদক্ষেপ, যা দ্বারা তুমি কারো কাছে অপর মুসলমানের ত্রুটি বুঝাতে চাইবে। সেটাও হারাম গীবতের মধ্যে পড়বে। এ কারণেই যার ত্রুটি বর্ণনা করা উদ্দেশ্য হয়, তার অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে লেংড়িয়ে বা কেঁপে কেঁপে অথবা অন্য কোনো ঢংয়ে হাঁটা- সবই ঐক্যমতে হারাম।
যদি কোনো লেখক তার কিতাবে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির কথা এভাবে উল্লেখ করেন যে, অমুক এরকম বলেন। আর উদ্দেশ্য হয় তার ত্রুটি ও নিন্দা বয়ান করা, তাহলে সেটাও হারাম। তবে যদি তার ভুল বাতলে দেয়া উদ্দেশ্য হয়, যাতে মানুষ তার অনুসরণ না করে। অথবা ইলমের ক্ষেত্রে তার দুর্বলতা বয়ান করা অভীষ্ট হয়, যেন তার কথা গ্রহণ করে কেউ ধোঁকাগ্রস্থ না হয়, তবে সেটা গীবত হবে না। বরং সেটা ওয়াজিব নসিহা হবে। নিয়ত করলে নসিহার সওয়াবও পাবে। এমনিভাবে যদি কোনো লেখক বা অন্য কেউ এরকম বলেন, কওম বা দল এরকম বলেছে, এটা ভুল, অজ্ঞতা ও উদাসীনতা ইত্যাদি; তবে গীবত হবে না। নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা দলের আলোচনা করাকেই গীবত বলা হয়।
এরকম বলা- কোনো এক ব্যক্তি, কোনো এক ফকিহ, ইলমের দাবীদারী কোনো এক লোক, কোনো এক মুফতি, কথিত সৎ ব্যক্তি বা দুনিয়াত্যাগী, আজ আমাদের নিকট দিয়ে অতিক্রমকারী এক ব্যক্তি অথবা আমাদের দেখা এক ব্যক্তি এরকম করেছে, অথবা এ জাতীয় কোনো কথা বলা- হারাম। গীবতের মধ্যে তখনই পড়বে, যখন শ্রোতা উদ্দীষ্ট ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করে বুঝতে পারে। কারণ, এখানে শ্রোতাকে নির্দিষ্ট কারো দোষ বুঝানো হয়েই যায় (এটাই গীবত)।
দীনি জ্ঞান অর্জনকারী এবং আবেদকদের করা গীবতও হারাম। কেননা তারা এমনভাবে গীবত পেশ করেন যে, স্পষ্ট শব্দে যা বুঝে আসে, তাদের কথা দ্বারাও তা বুঝে আসে। যেমন, কাউকে জিজ্ঞাসা করা হল, অমুকের অবস্থা কেমন? উত্তরে বলল- আল্লাহ আমাদের সংশোধন করে দিন, আল্লাহ আমাদের মাফ করে দিন, আল্লাহ তাকে ঠিক করে দিন, আল্লাহর কাছে আমরা মুক্তি চাই, আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করি, যিনি আমাদেরকে জালেমদের কাছে উপস্থিত হওয়ার পরীক্ষায় ফেলেননি, আমরা আল্লাহর কাছে অকল্যাণ থেকে পানাহ চাই, লজ্জার কমতি থেকে আল্লাহ আমাদের বাঁচান, আল্লাহ আমাদের তাওবা কবুল করুক। অথবা এ ধরনের কিছু বলল, যা দ্বারা জিজ্ঞাসিত ব্যক্তির ত্রুটি বুঝে আসে। সবই হবে হারাম গীবত। যদি এরকম বলে- আমরা যেটিতে লিপ্ত, সেটিতে অমুকেও লিপ্ত, এ থেকে বাঁচতে তার কোনো চেষ্টা ছিল না, আমরা সবাই এটা করেছি। এগুলোও গীবত। গীবতের মূলনীতি হল, মানুষের কোনো ত্রুটি শ্রোতাকে বুঝিয়ে দেয়া। এ সবকিছুই পূর্বের অধ্যায়ে গীবতের সংজ্ঞায় উল্লিখিত হাদিসের মর্ম থেকেই বোধগম্য। আল্লাহ সর্বাধিক জ্ঞাত।
গীবত শোনা হারাম; কাউতে গীবত করতে দেখলে করণীয়
চর্চাকারীর জন্য গীবত যেমন হারাম, তেমনি শ্রোতার জন্যও শোনা ও স্বীকৃতি দেয়া হারাম। সুতরাং কেউ যখন কোনো ব্যক্তিকে হারাম গীবত করতে শুনবে, বাহ্যিক কোনো ক্ষতির আশঙ্কা না থাকলে তাকে এ থেকে নিষেধ করা ওয়াজিব। যদি নিষেধ করলে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তাহলে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করা এবং সম্ভব হলে সেই মজলিস ত্যাগ করা ওয়াজিব। যদি মুখে প্রতিবাদ করতে পারে বা অন্য কথা বলে গীবত বন্ধ করতে সক্ষম হয়, তবে সেটা তার জন্য আবশ্যক। এমনটা না করলে সে গুনাহগার হবে। যদি কেউ মুখে বলে, চুপ কর; আর মনে মনে বলে, গীবতটা চলতে থাকুক, তাহলে এটাও মুনাফেকি। আবু হামেদ গাজালি রহ. বলেন, এরকম 'চুপ করো' বলার দ্বারা সে গুনাহ মুক্ত হবে না। অন্তর দিয়ে অপছন্দ করা আবশ্যক。
যখন সে গীবতের মজলিসে থাকতে বাধ্য হয় এবং বিরোধিতা করতে অক্ষম হয় বা তার বিরোধিতা আমলে না নেয়া হয় এবং কোনোভাবেই সেই মজলিস থেকে উঠে যাওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে মনোযোগ দিয়ে গীবত শোনা হারাম। তার করণীয় হল, মুখে ও অন্তরে অথবা শুধু অন্তরে জিকির করবে অথবা অন্য কোনো বিষয়ে চিন্তা করতে থাকবে, যেন গীবত শোনা থেকে বিরত থাকতে পারে। এরপরও অমনোযোগিতার সাথে কিছু কানে চলে আসলে কোনো গুনাহ হবে না। যদি সেই মজলিস থেকে উঠে যেতে সক্ষম হয়, আর গীবত ইত্যাদি বিষয় চলমান থাকে, তাহলে মজলিস ত্যাগ করা তার জন্য আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ إِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُوْنَ فِيْ أَيْتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ وَإِمَّا يُنْسِيَنَّكَ الشَّيْطَنُ فَلَا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَى مَعَ الْقَوْمِ الظَّلِمِينَ.
অর্থ: যখন আপনি এমন ব্যক্তিদের দেখবেন, যারা আমার আয়াত নিয়ে সমালোচনা করে, তখন তাদেরকে এড়িয়ে যান যতক্ষণ না তারা অন্য কথায় লিপ্ত হয়। যদি শয়তান আপনাকে ভুলিয়ে দেয়, তাহলে স্মরণ হওয়ার পর আর জালিমদের সাথে বসে থাকবেন না。
কথিত আছে- ইবরাহিম বিন আদহামকে একবার ওলিমার দাওয়াত দেয়া হয়। তিনি সেখানে উপস্থিত হলেন। লোকেরা অনুপস্থিত এক ব্যক্তির আলোচনা করতে লাগল। অনেকে বলল, সে তো ঢিলে লোক। এ কথা শুনে ইবরাহিম বললেন, আমি নিজে নিজেই এই কাজটা করলাম যে, গীবতের এক মজলিসে উপস্থিত হয়ে গেলাম। এ কথা বলে সেখান থেকে প্রস্থান করেন। এরপর তিন দিন পর্যন্ত খানা খাননি। এ ব্যাপারে কবির ভাষ্য এরকম-
وَسَمْعَكَ صُنْ عَنْ سِمَاعِ الْقَبِيحِ * كَصَوْنِ اللِّسَانِ عَنِ النُّطْقِ بِهِ
فَإِنَّكَ عِنْدَ سَمَاعِ الْقَبِيحِ " شَرِيْكُ لِقَائِلِهِ فَانْتَبِهِ.
অর্থ: তোমার যবানকে যেভাবে খারাপ কথা থেকে রক্ষা কর, তেমনি তোমার কানকেও খারাপ শোনা থেকে বাঁচিয়ে রাখ। কেননা, খারাপ কথা শুনলে তুমিও তার মতোই হলে। সুতরাং সতর্ক থাক।
নিজেকে গীবত থেকে বাঁচানোর উপায়
এ বিষয়ে কুরআন-হাদিসে অনেক দলিল রয়েছে। এখানে আমি কেবল অল্প কিছু দলিলের দিকে ইশারা করব। যার শিক্ষা নেয়ার তাওফিক হবে, সে এ দ্বারাই সতর্ক হয়ে যাবে। যার তাওফিক হবে না সে অনেক খণ্ড কিতাব দ্বারাও সতর্ক হবে না।
অধ্যায়ের সারকথা: গীবত হারাম হওয়ার ব্যাপারে ইতিপূর্বে যা উল্লেখ করেছি তা নিজের সামনে পেশ করবে, অতঃপর চিন্তা করবে আল্লাহ তাআলার এই বাণীসমূহে-
مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ.
অর্থ: মানুষ যাই বলে তা সংরক্ষণ করে রাখেন সদাপ্রস্তুত একজন প্রহরী。
আরো বলেন-
وَتَحْسَبُونَهُ هَيِّنًا وَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ عَظِيمٌ.
অর্থ: অথচ তোমরা একে মামুলী মনে করেছিলে অথচ এটা ছিল আল্লাহ পাকের কাছে অনেক বড় বিষয়।
সহিহ হাদিসে আছে- রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, অনেক সময় মানুষ অবচেতন মনে আল্লাহর অসন্তুষ্টির কিছু বলে ফেলে, যার কারণে সে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।
এ ধরনের আরো আয়াত ও হাদিস আমরা ইতিপূর্বে জিহ্বা সংযত রাখা ও গীবতের অধ্যায়ে উল্লেখ করেছি, সেগুলো নিয়েও ফিকির করবে। পাশাপাশি বুজুর্গদের এই উক্তিও মনে রাখবে- আল্লাহ আমার সাথে আছেন, আমাকে দেখছেন এবং আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হজরত হাসান বসরি রহ. থেকে বর্ণিত- এক ব্যক্তি তাকে বলল, আপনি আমার গীবত করেন। তিনি বললেন, আমার কাছে তোমার মর্যাদা এই পর্যায়ের না যে, তোমাকে আমার নেকির ব্যাপারে বিচারক বানাব। হজরত আবদুল্লাহ বিন মুবারক রহ. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন- আমি যদি কারো গীবত করতাম, তবে পিতা-মাতার গীবত করতাম। কেননা, তারাই আমার নেকির অধিকতর হকদার。
টিকাঃ
১২৭২. সুরা হুজুরাত: ১২।
১২৭৩. সুরা হুমাজাহ: ১। তরজমা: অধমের অনূদিত তাফসিরে হেদায়াতুল কুরআন ৯ম খণ্ড থেকে।
১২৭৪. সুরা কালাম: ১১।
১২৭৫. সহিহ বুখারি: ৬০৫৬, সহিহ মুসলিম: ১০৫, সু. আবু দাউদ: ৪৭৭১, সুনানে তিরমিজি: ২০৩৭, মু. আহমাদ ৫/৩৮৯।
১২৭৬. সহিহ বুখারি: ৬০৫৫, সহিহ মুসলিম: ২৯২, সু. আবু দাউদ: ২০, সুনানে তিরমিজি: ৭০, সুনানে নাসাঈ ১/২৮, মু. আহমাদ ১/২২৫, সুনানে দারিমি: ৭৪৫।
১২৭৭. সহিহ মুসলিম: ২৫৮৯, সুনানে আবু দাউদ: ৪৮৭৪, সুনানে তিরমিজি: ১৯৩৪, সুনানে নাসাঈ: ১১৪৫৪, সুনানে দারিমি: ২৭১৭, মু. আহমাদ ২/২৩০।
১২৭৮. সহিহ বুখারি: ৬৭, সহিহ মুসলিম: ১৬৭৯, সুনানে আবু দাউদ: ১৯৪৭, মু. আহমাদ ৫/৩৭।
১২৭৯. সুনানে আবু দাউদ: ৪৮৭৫, সুনানে তিরমিজি: ২৫০৩, মু. আহমাদ ৬/১৮৯।
১২৮০. সুরা নাজম: ৩-৪।
১২৮১. সুনানে তিরমিজি: ১৯২৭।
১২৮২. ইহয়াউ উলুমিদ্দিন ৩/১৪৬।
১২৮৩. আনআম: ৬৮।
১২৮৪. কাফ: ১৮।
১২৮৫. নুর: ১৫।
১২৮৬. আলফুতুহাত ৬/৫০১।
১২৮৭. রিসালায়ে কুশাইরিয়া পৃ. ১২৫।
পরনিন্দা ও চুগলি করা হারাম
এ দুটি দোষ সবচেয়ে খারাপ এবং মানুষের মাঝে ছড়ায় সবচেয়ে বেশি। কমই মানুষ দোষ দুটো থেকে মুক্ত। এগুলো থেকে সতর্ককরণে খুব প্রয়োজনীয়তা লক্ষ্য করতঃ এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করছি।
গীবত বা পরনিন্দা: মানুষের এমন কোনো দোষচর্চা করা, যা সে পছন্দ করে না। হোক না তা তার শরীরে, ধর্ম পালনে, জাগতিক বিষয়ে, সত্তায়, সৃষ্টিতে, চরিত্রে, সম্পদে, কিংবা সন্তানাদি, পিতা-মাতা, স্বামী বা স্ত্রী, খাদেম, অধীনস্থ কারো মাঝে। অথবা তার পাগড়িতে, কাপড়ে, চলাফেরায় বা তার প্রফুল্লতায়, অনৈতিকতায়, কঠোরতায়, সাবলীলতায় কিংবা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে। সে আলোচনা হোক না যবানে-কলমে। অথবা চোখ, হাত, মাথা কিংবা অন্য কিছু দিয়ে ইশারা-ইঙ্গিতে।
শারীরিক বিষয়ে দোষচর্চার কিছু উদাহরণ: যেমন বলা- অমুক অন্ধ। লেংড়া। কানা। কুষ্ঠরোগী। খাটো। লম্বা। কালো। কিংবা সাদা।
দীনি বিষয়ে: অমুক ফাসেক। চোর। খেয়ানতকারী। অত্যাচারী। নামাজে শিথিলতা প্রদর্শনকারী। নাপাকের ব্যাপারে অসতর্ক। মা-বাবার সাথে অসদাচরণকারী। নির্দিষ্ট স্থানে জাকাত অনাদায়ী। গীবত পরিহার করে না।
জাগতিক বিষয়ে: অমুক বেয়াদব। মানুষকে তুচ্ছজ্ঞানী। অন্যের হক অস্বীকারকারী। বাচাল। পেটুক। বেশি ঘুমায়। অসময়ে ঘুমায়। অস্থানে বসে পড়ে।
পিতা সংক্রান্ত: তার পিতা ফাসেক। হিন্দি। নাবতি। নিগ্রো। মুচি। কাপড় ব্যবসায়ী। পশু ব্যবসায়ী। কাঠমিস্ত্রি। কামার। তাঁতী। অথবা এ ধরনের কিছু বলা।
চরিত্র বিষয়ে: চরিত্র খারাপ। অহঙ্কারী। ঝগড়াটে। হঠকারী। স্বেচ্ছাচারী। অক্ষম। দুর্বল অন্তরের অধিকারী। চেহারায় সবসময় বিরক্তিভাব প্রকাশকারী অথবা নির্লজ্জ; এ জাতীয় কিছু বলা।
পোশাক বিষয়ে: তার পোশাকের হাতা প্রশস্ত। আচল লম্বা। তার কাপড় নোংরা। ইত্যাদি। অন্যান্য বিষয়গুলোকে এর ওপর অনুমান করে নিবেন। মূলনীতি: অপরের অপছন্দনীয় জিনিস আলোচনা করা।
ইমাম আবু হামেদ গাজালি রহ. এ ব্যাপারে উম্মাহর ঐক্য নকল করেছেন যে, গীবত বলা হয়- অন্যের এমন বিষয় আলোচনা করা, যা সে পছন্দ করে না। একটু পরেই এ সম্পর্কে হাদিস আসছে।
চোগলখোরি: বিশৃংখলার উদ্দেশ্যে একজনের কথা আরেকজনের কাছে পৌঁছানো। এ হল গীবত ও চোগলখোরির সংজ্ঞা।
উভয়ের হুকুম: উম্মাহর ঐক্যমতে এই অভ্যাস দুটো হারাম। কুরআন, সুন্নাহ এবং ইজমায়ে উম্মতে এর বহু দ্ব্যর্থহীন দলিল বিদ্যমান। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا.
অর্থ: তোমরা একে অপরের দোষচর্চা কর না。
আরো বলেন-
وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ.
অর্থ: প্রত্যেক পরনিন্দাকারী ও দোষচর্চাকারীর জন্য বড়ই দুর্ভোগ!
আরো বলেন-
هَمَّازٍ مَشَّاءٍ بِنَمِيمٍ.
অর্থ: সে নিন্দা করতে অভ্যস্ত, চুগলি করে বেড়ায়。
(৮৮৯) হজরত হুজায়ফা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ نَمَّامُ.
অর্থ: চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না。
(৮৯০) হজরত ইবনে আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত-
أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّ بِقَبْرَيْنِ، فَقَالَ: إِنَّهُمَا يُعَذِّبَانِ وَمَا يُعَذِّبَانِ فِي كَبِيرٍ. وَفِي رِوَايَةِ الْبُخَارِيُّ: بَلَى إِنَّهُ كَبِيرُ، أَمَّا أَحَدُهُمَا، فَكَانَ يَمْشِيْ بِالنَّمِيمَةِ، وَأَمَّا الْآخَرُ، فَكَانَ لَا يَسْتَتِرُ مِنْ بَوْلِهِ.
অর্থ: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার দুটি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। বললেন, এদেরকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে, কিন্তু বড় কোনো কারণে নয়। বর্ণনাকারী বলেন, বুখারির রেওয়ায়াতে আছে: হ্যাঁ, অবশ্যই আজাবের কারণটা বড় বিষয় ছিল। তাদের একজন চোগলখুরী করত আর অপরজন প্রস্রাবের ছিঁটা থেকে বেঁচে থাকত না。
উলামায়ে কেরাম বলেন, "বড় কোনো কারণে শাস্তি দেয়া হচ্ছে না” এর ব্যাখ্যা হল- তাদের ধারণায় সেটা বড় কোনো বিষয় ছিল না অথবা যেটা ছেড়ে দেয়া তাদের পক্ষে কঠিন কিছু ছিল না。
(৮৯১) হজরত আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
أَتَدْرُوْنَ مَا الْغِيْبَةُ ؟ قَالُوا : اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ. قَالَ: ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ. قِيلَ: أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ فِي أَخِي مَا أَقُولُ ؟ قَالَ: إِنْ كَانَ فِيْهِ مَا تَقُوْلُ فَقَدِ اغْتَبْتَهُ، وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيْهِ فَقَدْ بَهَتَهُ.
অর্থ: তোমরা জান কি গীবত কাকে বলে? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আল্লাহ এবং তার রাসুল ভালো জানেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার ভাইয়ের এমন বিষয় আলোচনা করা, যা সে পছন্দ করে না। বলা হল, যদি ভাইয়ের মাঝে আলোচিত দোষটা থাকে (তবুও কি গীবত হবে?) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি বলা দোষটা থাকে তাহলে তুমি তার গীবত করলে। আর যদি সেটা না থাকে তাহলে তাকে অপবাদ দিলে। -ইমাম তিরমিজি রহ. বলেন, হাদিসটি হাসান সহিহ。
(৮৯২) হজরত আবু বাকরা রাদি. থেকে বর্ণিত, বিদায় হজে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানির দিনে মিনার খুতবায় বলেন-
إِنَّ دِمَاءَكُمْ، وَأَمْوَالَكُمْ عَلَيْكُمْ حَرَامٌ، كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا، فِي شَهْرِكُمْ هَذَا، فِي بَلَدِكُمْ هَذَا، إِلَى يَوْمِ تَلْقَوْنَ رَبَّكُمْ، أَلَا هَلْ بَلَّغْتُ؟
অর্থ: তোমাদের প্রত্যেকের জান-মাল, ইজ্জত-আবরু অপর জনের জন্য হারাম। যেমন হারাম এই মাস, এই শহর, এই দিন। আমি কি তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি?
(৮৯৩) হজরত আয়েশা রাদি. থেকে বর্ণিত-
قُلْتُ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: حَسْبُكَ مِنْ صَفِيَّةَ كَذَا وَكَذَا. قَالَ غَيْرُ مُسَدَّدٍ : تَعْنِي قَصِيرَةٌ. فَقَالَ : لَقَدْ قُلْتِ كَلِمَةً لَوْ مُزِجَتْ بِمَاءِ الْبَحْرِ لَمَزَجَتْهُ قَالَتْ: وَحَكَيْتُ لَهُ إِنْسَانًا، فَقَالَ: مَا أُحِبُّ أَنِّي حَكَيْتُ إِنْسَانًا وَأَنَّ لِي كَذَا وَكَذَا.
অর্থ: আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, সাফিয়া থেকে আপনার দূরে থাকার জন্য তার এই এই দোষ যথেষ্ট। বর্ণনাকারী বলেন, এ দ্বারা তিনি তাকে খাটো উদ্দেশ্য নিয়েছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি তো এমন এক দুর্গন্ধময় কথা বলে ফেলেছ, তা যদি সমুদ্রের পানির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়, তাহলে সব পানি দুর্গন্ধ হয়ে যাবে। আয়েশা রাদি. বলেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এক ব্যক্তির সমালোচনা করলাম। তিনি বললেন, কোনো ব্যক্তির সমালোচনা করতে আমি পছন্দ করি না, অথচ আমার মধ্যেও সমালোচনার বিষয় আছে। -ইমাম তিরমিজি রহ. একে হাসান সহিহ বলেছেন。
ফায়দা: مَزَجَتْهُ অর্থ: সমুদ্রের সাথে এমনভাবে মিশ্রিত হবে যে, দুর্গন্ধ ও কদর্যতার কারণে সমুদ্রের পানির স্বাদ ও গন্ধ পরিবর্তন হয়ে যাবে। হাদিসটি গীবতের ব্যাপারে বড় ধমকিগুলোর একটি, অথবা এটিই সবচেয়ে বড় ধমকি। গীবতের নিন্দার ক্ষেত্রে এর মত কোনো হাদিস আছে বলে আমার জানা নেই। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ প্রবৃত্তি থেকে কোনো কথা বলেন না, যাই বলেন তা কেবল তার প্রতি প্রেরিত ওহি। আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে তার দয়া ও সমস্ত অপছন্দনীয় কাজ থেকে বিরত থাকার তাওফিক প্রার্থনা করি।
(৮৯৪) হজরত আনাস রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَمَّا عُرِجَ بِي مَرَرْتُ بِقَوْمٍ لَهُمْ أَظْفَارُ مِنْ نُحَاسٍ، يَحْمِشُوْنَ وُجُوهَهُمْ وَصُدُوْرَهُمْ، فَقُلْتُ: مَنْ هَؤُلَاءِ يَا جِبْرِيلُ ؟ قَالَ: هَؤُلَاءِ الَّذِينَ يَأْكُلُوْنَ لُحُوْمَ النَّاسِ، وَيَقَعُوْنَ فِي أَعْرَاضِهِمْ.
অর্থ: আমি মেরাজের রাতে এক সম্প্রদায়ের পাশ দিয়ে অতিক্রম করি। তাদের রয়েছে তামার নখ, যা দিয়ে তারা নিজেদের চেহারা ও বুক আচড়াচ্ছিল। জিবরিল আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? বললেন, ঐ সমস্ত লোক যারা মানুষের গোশত ভক্ষণ করত এবং তাদের ইজ্জত নষ্ট করার পিছনে পড়ত।
(৮৯৫) হজরত সাঈদ বিন জায়েদ রাদি. থেকে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إِنَّ مِنْ أَرْبَى الرِّبَا الاسْتِطَالَةَ فِي عِرْضِ الْمُسْلِمِ بِغَيْرِ حَقٌّ.
অর্থ: নিশ্চয়ই সবচেয়ে নিকৃষ্ট সুদ (অপরাধ) হচ্ছে, অন্যায়ভাবে কোনো মুসলমানের সম্মান বিনষ্টের চেষ্টা করা।
(৮৯৬) আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ، لَا يَخُونُهُ ، وَلَا يَكْذِبُهُ، وَلَا يَخْذُلُهُ، كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ؛ عِرْضُهُ، وَمَالُهُ ، وَدَمُهُ، التَّقْوَى هَاهُنَا، بِحَسْبِ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْتَقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ.
অর্থ: মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার ভাইয়ের সাথে খেয়ানত করতে পারে না, মিথ্যা বলতে পারে না এবং তাকে অপমান করতে পারে না। প্রত্যেক মুসলমানের জান-মাল ইজ্জত-আবরু অপর মুসলমানের জন্য হারাম। এক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করতে হবে। কোনো ব্যক্তি নিকৃষ্ট হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ করে দেখে। -ইমাম তিরমিজি রহ. বলেন, হাদিসটি হাসান। নববি রহ. বলেন, এই হাদিসের ফায়দা অনেক ব্যাপক ও বৃহৎ।
গীবতের সংজ্ঞা-সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বর্ণনা
পূর্বের অধ্যায়ে আমরা উল্লেখ করেছি যে, গীবত বলা হয়- অপরের এমন বিষয় আলোচনা করা, যা সে অপছন্দ করে। হোক সেটা মৌখিক বা লিখিত কিংবা চোখ, হাত বা মাথা দিয়ে ইঙ্গিতের মাধ্যমে। মূলনীতি হল, প্রত্যেক এমন পদক্ষেপ, যা দ্বারা তুমি কারো কাছে অপর মুসলমানের ত্রুটি বুঝাতে চাইবে। সেটাও হারাম গীবতের মধ্যে পড়বে। এ কারণেই যার ত্রুটি বর্ণনা করা উদ্দেশ্য হয়, তার অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে লেংড়িয়ে বা কেঁপে কেঁপে অথবা অন্য কোনো ঢংয়ে হাঁটা- সবই ঐক্যমতে হারাম।
যদি কোনো লেখক তার কিতাবে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির কথা এভাবে উল্লেখ করেন যে, অমুক এরকম বলেন। আর উদ্দেশ্য হয় তার ত্রুটি ও নিন্দা বয়ান করা, তাহলে সেটাও হারাম। তবে যদি তার ভুল বাতলে দেয়া উদ্দেশ্য হয়, যাতে মানুষ তার অনুসরণ না করে। অথবা ইলমের ক্ষেত্রে তার দুর্বলতা বয়ান করা অভীষ্ট হয়, যেন তার কথা গ্রহণ করে কেউ ধোঁকাগ্রস্থ না হয়, তবে সেটা গীবত হবে না। বরং সেটা ওয়াজিব নসিহা হবে। নিয়ত করলে নসিহার সওয়াবও পাবে। এমনিভাবে যদি কোনো লেখক বা অন্য কেউ এরকম বলেন, কওম বা দল এরকম বলেছে, এটা ভুল, অজ্ঞতা ও উদাসীনতা ইত্যাদি; তবে গীবত হবে না। নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা দলের আলোচনা করাকেই গীবত বলা হয়।
এরকম বলা- কোনো এক ব্যক্তি, কোনো এক ফকিহ, ইলমের দাবীদারী কোনো এক লোক, কোনো এক মুফতি, কথিত সৎ ব্যক্তি বা দুনিয়াত্যাগী, আজ আমাদের নিকট দিয়ে অতিক্রমকারী এক ব্যক্তি অথবা আমাদের দেখা এক ব্যক্তি এরকম করেছে, অথবা এ জাতীয় কোনো কথা বলা- হারাম। গীবতের মধ্যে তখনই পড়বে, যখন শ্রোতা উদ্দীষ্ট ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করে বুঝতে পারে। কারণ, এখানে শ্রোতাকে নির্দিষ্ট কারো দোষ বুঝানো হয়েই যায় (এটাই গীবত)।
দীনি জ্ঞান অর্জনকারী এবং আবেদকদের করা গীবতও হারাম। কেননা তারা এমনভাবে গীবত পেশ করেন যে, স্পষ্ট শব্দে যা বুঝে আসে, তাদের কথা দ্বারাও তা বুঝে আসে। যেমন, কাউকে জিজ্ঞাসা করা হল, অমুকের অবস্থা কেমন? উত্তরে বলল- আল্লাহ আমাদের সংশোধন করে দিন, আল্লাহ আমাদের মাফ করে দিন, আল্লাহ তাকে ঠিক করে দিন, আল্লাহর কাছে আমরা মুক্তি চাই, আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করি, যিনি আমাদেরকে জালেমদের কাছে উপস্থিত হওয়ার পরীক্ষায় ফেলেননি, আমরা আল্লাহর কাছে অকল্যাণ থেকে পানাহ চাই, লজ্জার কমতি থেকে আল্লাহ আমাদের বাঁচান, আল্লাহ আমাদের তাওবা কবুল করুক। অথবা এ ধরনের কিছু বলল, যা দ্বারা জিজ্ঞাসিত ব্যক্তির ত্রুটি বুঝে আসে। সবই হবে হারাম গীবত। যদি এরকম বলে- আমরা যেটিতে লিপ্ত, সেটিতে অমুকেও লিপ্ত, এ থেকে বাঁচতে তার কোনো চেষ্টা ছিল না, আমরা সবাই এটা করেছি। এগুলোও গীবত। গীবতের মূলনীতি হল, মানুষের কোনো ত্রুটি শ্রোতাকে বুঝিয়ে দেয়া। এ সবকিছুই পূর্বের অধ্যায়ে গীবতের সংজ্ঞায় উল্লিখিত হাদিসের মর্ম থেকেই বোধগম্য। আল্লাহ সর্বাধিক জ্ঞাত।
গীবত শোনা হারাম; কাউতে গীবত করতে দেখলে করণীয়
চর্চাকারীর জন্য গীবত যেমন হারাম, তেমনি শ্রোতার জন্যও শোনা ও স্বীকৃতি দেয়া হারাম। সুতরাং কেউ যখন কোনো ব্যক্তিকে হারাম গীবত করতে শুনবে, বাহ্যিক কোনো ক্ষতির আশঙ্কা না থাকলে তাকে এ থেকে নিষেধ করা ওয়াজিব। যদি নিষেধ করলে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তাহলে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করা এবং সম্ভব হলে সেই মজলিস ত্যাগ করা ওয়াজিব। যদি মুখে প্রতিবাদ করতে পারে বা অন্য কথা বলে গীবত বন্ধ করতে সক্ষম হয়, তবে সেটা তার জন্য আবশ্যক। এমনটা না করলে সে গুনাহগার হবে। যদি কেউ মুখে বলে, চুপ কর; আর মনে মনে বলে, গীবতটা চলতে থাকুক, তাহলে এটাও মুনাফেকি। আবু হামেদ গাজালি রহ. বলেন, এরকম 'চুপ করো' বলার দ্বারা সে গুনাহ মুক্ত হবে না। অন্তর দিয়ে অপছন্দ করা আবশ্যক。
যখন সে গীবতের মজলিসে থাকতে বাধ্য হয় এবং বিরোধিতা করতে অক্ষম হয় বা তার বিরোধিতা আমলে না নেয়া হয় এবং কোনোভাবেই সেই মজলিস থেকে উঠে যাওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে মনোযোগ দিয়ে গীবত শোনা হারাম। তার করণীয় হল, মুখে ও অন্তরে অথবা শুধু অন্তরে জিকির করবে অথবা অন্য কোনো বিষয়ে চিন্তা করতে থাকবে, যেন গীবত শোনা থেকে বিরত থাকতে পারে। এরপরও অমনোযোগিতার সাথে কিছু কানে চলে আসলে কোনো গুনাহ হবে না। যদি সেই মজলিস থেকে উঠে যেতে সক্ষম হয়, আর গীবত ইত্যাদি বিষয় চলমান থাকে, তাহলে মজলিস ত্যাগ করা তার জন্য আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ إِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُوْنَ فِيْ أَيْتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ وَإِمَّا يُنْسِيَنَّكَ الشَّيْطَنُ فَلَا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَى مَعَ الْقَوْمِ الظَّلِمِينَ.
অর্থ: যখন আপনি এমন ব্যক্তিদের দেখবেন, যারা আমার আয়াত নিয়ে সমালোচনা করে, তখন তাদেরকে এড়িয়ে যান যতক্ষণ না তারা অন্য কথায় লিপ্ত হয়। যদি শয়তান আপনাকে ভুলিয়ে দেয়, তাহলে স্মরণ হওয়ার পর আর জালিমদের সাথে বসে থাকবেন না。
কথিত আছে- ইবরাহিম বিন আদহামকে একবার ওলিমার দাওয়াত দেয়া হয়। তিনি সেখানে উপস্থিত হলেন। লোকেরা অনুপস্থিত এক ব্যক্তির আলোচনা করতে লাগল। অনেকে বলল, সে তো ঢিলে লোক। এ কথা শুনে ইবরাহিম বললেন, আমি নিজে নিজেই এই কাজটা করলাম যে, গীবতের এক মজলিসে উপস্থিত হয়ে গেলাম। এ কথা বলে সেখান থেকে প্রস্থান করেন। এরপর তিন দিন পর্যন্ত খানা খাননি। এ ব্যাপারে কবির ভাষ্য এরকম-
وَسَمْعَكَ صُنْ عَنْ سِمَاعِ الْقَبِيحِ * كَصَوْنِ اللِّسَانِ عَنِ النُّطْقِ بِهِ
فَإِنَّكَ عِنْدَ سَمَاعِ الْقَبِيحِ " شَرِيْكُ لِقَائِلِهِ فَانْتَبِهِ.
অর্থ: তোমার যবানকে যেভাবে খারাপ কথা থেকে রক্ষা কর, তেমনি তোমার কানকেও খারাপ শোনা থেকে বাঁচিয়ে রাখ। কেননা, খারাপ কথা শুনলে তুমিও তার মতোই হলে। সুতরাং সতর্ক থাক।
নিজেকে গীবত থেকে বাঁচানোর উপায়
এ বিষয়ে কুরআন-হাদিসে অনেক দলিল রয়েছে। এখানে আমি কেবল অল্প কিছু দলিলের দিকে ইশারা করব। যার শিক্ষা নেয়ার তাওফিক হবে, সে এ দ্বারাই সতর্ক হয়ে যাবে। যার তাওফিক হবে না সে অনেক খণ্ড কিতাব দ্বারাও সতর্ক হবে না।
অধ্যায়ের সারকথা: গীবত হারাম হওয়ার ব্যাপারে ইতিপূর্বে যা উল্লেখ করেছি তা নিজের সামনে পেশ করবে, অতঃপর চিন্তা করবে আল্লাহ তাআলার এই বাণীসমূহে-
مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ.
অর্থ: মানুষ যাই বলে তা সংরক্ষণ করে রাখেন সদাপ্রস্তুত একজন প্রহরী。
আরো বলেন-
وَتَحْسَبُونَهُ هَيِّنًا وَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ عَظِيمٌ.
অর্থ: অথচ তোমরা একে মামুলী মনে করেছিলে অথচ এটা ছিল আল্লাহ পাকের কাছে অনেক বড় বিষয়।
সহিহ হাদিসে আছে- রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, অনেক সময় মানুষ অবচেতন মনে আল্লাহর অসন্তুষ্টির কিছু বলে ফেলে, যার কারণে সে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।
এ ধরনের আরো আয়াত ও হাদিস আমরা ইতিপূর্বে জিহ্বা সংযত রাখা ও গীবতের অধ্যায়ে উল্লেখ করেছি, সেগুলো নিয়েও ফিকির করবে। পাশাপাশি বুজুর্গদের এই উক্তিও মনে রাখবে- আল্লাহ আমার সাথে আছেন, আমাকে দেখছেন এবং আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হজরত হাসান বসরি রহ. থেকে বর্ণিত- এক ব্যক্তি তাকে বলল, আপনি আমার গীবত করেন। তিনি বললেন, আমার কাছে তোমার মর্যাদা এই পর্যায়ের না যে, তোমাকে আমার নেকির ব্যাপারে বিচারক বানাব। হজরত আবদুল্লাহ বিন মুবারক রহ. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন- আমি যদি কারো গীবত করতাম, তবে পিতা-মাতার গীবত করতাম। কেননা, তারাই আমার নেকির অধিকতর হকদার。
টিকাঃ
১২৭২. সুরা হুজুরাত: ১২।
১২৭৩. সুরা হুমাজাহ: ১। তরজমা: অধমের অনূদিত তাফসিরে হেদায়াতুল কুরআন ৯ম খণ্ড থেকে।
১২৭৪. সুরা কালাম: ১১।
১২৭৫. সহিহ বুখারি: ৬০৫৬, সহিহ মুসলিম: ১০৫, সু. আবু দাউদ: ৪৭৭১, সুনানে তিরমিজি: ২০৩৭, মু. আহমাদ ৫/৩৮৯।
১২৭৬. সহিহ বুখারি: ৬০৫৫, সহিহ মুসলিম: ২৯২, সু. আবু দাউদ: ২০, সুনানে তিরমিজি: ৭০, সুনানে নাসাঈ ১/২৮, মু. আহমাদ ১/২২৫, সুনানে দারিমি: ৭৪৫।
১২৭৭. সহিহ মুসলিম: ২৫৮৯, সুনানে আবু দাউদ: ৪৮৭৪, সুনানে তিরমিজি: ১৯৩৪, সুনানে নাসাঈ: ১১৪৫৪, সুনানে দারিমি: ২৭১৭, মু. আহমাদ ২/২৩০।
১২৭৮. সহিহ বুখারি: ৬৭, সহিহ মুসলিম: ১৬৭৯, সুনানে আবু দাউদ: ১৯৪৭, মু. আহমাদ ৫/৩৭।
১২৭৯. সুনানে আবু দাউদ: ৪৮৭৫, সুনানে তিরমিজি: ২৫০৩, মু. আহমাদ ৬/১৮৯।
১২৮০. সুরা নাজম: ৩-৪।
১২৮১. সুনানে তিরমিজি: ১৯২৭।
১২৮২. ইহয়াউ উলুমিদ্দিন ৩/১৪৬।
১২৮৩. আনআম: ৬৮।
১২৮৪. কাফ: ১৮।
১২৮৫. নুর: ১৫।
১২৮৬. আলফুতুহাত ৬/৫০১।
১২৮৭. রিসালায়ে কুশাইরিয়া পৃ. ১২৫।
📄 যেসব ক্ষেত্রে গীবত বৈধ
যেসব ক্ষেত্রে গীবত বৈধ
গীবত হারাম হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ প্রয়োজনে সেটা বৈধ হয়ে যায়। গীবতের বৈধতা দানকারী হল, এমন কোনো শরয়ি উদ্দেশ্য, যেটা দোষের আলোচনা ছাড়া হাসিল হয় না। আর তা ছয় কারণের যে কোনো একটি কারণে-
১. জুলুমের অভিযোগ করা: মাজলুমের জন্য বাদশাহ, কাজি প্রমুখের কাছে জুলুমের অভিযোগ করা বৈধ আছে, যাদের প্রশাসনিক ক্ষমতা রয়েছে অথবা যাদের জালেম থেকে অত্যাচারের সঠিক বিচার করার সক্ষমতা আছে। সে গিয়ে বলবে, অমুকে আমার ওপর জুলুম করেছে, আমার সাথে এমন আচরণ করেছে, আমার অমুক জিনিস আত্মসাৎ করেছে ইত্যাদি।
২. খারাপ কাজের পরিবর্তন ও গুনাগারকে সঠিক পথে ফেরানোর জন্য সাহায্য প্রার্থনা করা। যার ব্যাপারে আশা হয় যে, সে অশ্লীল কাজ পরিবর্তনের সামর্থ্য রাখে তার কাছে গিয়ে বলবে, অমুকে এমন কাজ করে আপনি তাকে সেটা থেকে নিষেধ করেন অথবা এ ধরনের অন্য কিছু বলা। তবে উদ্দেশ্য হতে হবে, খারাপ কাজ দূর করার উসিলা গ্রহণ করা। অন্যথায় সেটা হারাম।
৩. ফতোয়া চাওয়া: যেমন, মুফতিকে এভাবে বলা যে, আমার পিতা বা ভাই অথবা অমুক আমার ওপর এই এই জুলুম করেছেন। সেটা তার জন্য বৈধ হয়েছে কিনা? এ থেকে আমার মুক্তি পাওয়ার, আমার হক আদায় করে নেয়ার এবং আমার থেকে জুলুম দূর করার পদ্ধতি কী? অথবা এ ধরনের অন্য কিছু বলা। এমনিভাবে এরকম বলা যে, আমার স্ত্রী/স্বামী এমন এমন করেন, অথবা এধরনের কিছু; সবই প্রয়োজনের কারণে জায়েজ। তবে এরকম বলা সর্তকতা- আপনি এমন ব্যক্তির ব্যাপারে কী বলেন, যার কাজ এরকম বা এমন স্বামী বা স্ত্রীর ক্ষেত্রে কি বলেন, যে এই এই আচরণ করে। অথবা এ ধরনের কিছু বলা। কেননা, এখানে নির্দিষ্ট করা ছাড়াই উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যায়। এরপরও নির্দিষ্ট করে বলাও জায়েজ আছে হিন্দার হাদিসের কারণে, যেটা আমরা সামনে উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ। হজরত হিন্দা বলেছেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! নিশ্চয় আবু সুফিয়ান একজন কৃপণ ব্যক্তি...। তবুও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে নিষেধ করেননি। (এ দ্বারা নির্দিষ্ট করে বলা জায়েজ প্রমাণিত হয়)
৪. মুসলমানদেরকে অকল্যাণ থেকে সতর্ক করা ও তাদেরকে উপদেশ দেয়া। এটা অনেক ধরনে হতে পারে: ক. হাদিসের বর্ণনাকারীদের জারাহ (সমালোচনা) করা, সাক্ষীদের কোনো দোষ বর্ণনা করা। এগুলো মুসলমানদের ঐক্যমতে বৈধ, বরং প্রয়োজনে ওয়াজিব। খ. যখন কেউ বিয়ে, অংশীদারিত্ব, আমানত রাখা বা কারো আমানত নিজের কাছে রাখা অথবা অন্যান্য লেনদেনের বিষয়ে তোমার কাছে পরামর্শ চায়, তখন তোমার জন্য ওয়াজিব হল, কল্যাণকামিতা হিসাবে সে সম্বন্ধে জ্ঞানানুসারে বর্ণনা করে দেয়া। যদি এটুকু বলা দ্বারাই তোমার উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যায় যে, তার সাথে লেনদেন করা বা তার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা শুভ হবে না, অথবা তুমি এমনটি কর না। অথবা এই ধরনের কিছু বললেই উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যায়, তবে নির্দিষ্ট দোষ বলা বৈধ হবে না। যদি স্পষ্ট করে বলা ছাড়া উদ্দেশ্য হাসিল না হয় তবেই স্পষ্ট বলবে।
গ. যখন এমন কোনো ব্যক্তিকে দেখবে যে, এমন এক গোলাম কিনছে যে চুরি, যিনা বা মদ পানে অভ্যস্ত অথবা এ ধরনের অন্য কোনো খারাপ গুণে প্রসিদ্ধ, তখন তোমার জন্য আবশ্যক হল, এই দোষগুলো (আগে থেকে তার জানা না থাকলে) তার কাছে বলে দেয়া। এটা শুধু গোলামের সাথেই নির্দিষ্ট না, বরং প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি যে বিক্রিত পণ্যের এমন কোনো দোষ জানে যেটা ক্রেতা জানে না, তার জন্য ক্রেতাকে অবহিত করা আবশ্যক।
ঘ. যখন তুমি কোনো ফিকহ অর্জনকারীকে দেখবে যে, সে কোনো বিদআতি বা ফাসেকের কাছে যাতায়াত করতঃ তার কাছ থেকে ইলম শিখে। আর এতে সেই ফিকহ অর্জনকারীর ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা কর, তাহলে তোমার জন্য আবশ্যক হল, তার অবস্থা বর্ণনা করে তাকে সেই ফাসেক বা বিদআতির কাছে যাওয়া থেকে বিরত থাকার উপদেশ দেয়া। এ ক্ষেত্রে কল্যাণকামিতার নিয়ত থাকা শর্ত। এখানেই বেশি ভুল হয়ে থাকে। অনেক সময় বক্তা এ ক্ষেত্রে হিংসার শিকার হয় অথবা শয়তান তার সামনে বিষয়টা ঘোলাটে করে তুলে। তার কাছে মনে হয় যে, সেটা কল্যাণকামিতা ও দয়া। সুতরাং এ সব ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতা কাম্য।
ঙ. যদি দায়িত্ববান ব্যক্তি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করে। হয়ত সে তার যোগ্য না বা সে ফাসেক অথবা উদাসীন অথবা অন্য কোনো কারণে। তখন ওয়াজিব হল, সেটা এমন ব্যক্তির কাছে বলা, যে সেই অযোগ্য দায়িত্বশীলের ওপর কর্তৃত্ববান। যেন তিনি তাকে বরখাস্ত করে তদস্থলে যোগ্য কাউকে নিয়োগ দেন। অথবা তার ব্যাপারে উনার জানা থাকে, যেন তার সাথে সে অনুযায়ী আচরণ করেন। ধোঁকাগ্রস্ত না হন। যেন তিনি তাকে ঠিক হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন, অন্যথায় তাকে বদলি করে দেয়ার ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পারেন।
৫. যদি কোনো ব্যক্তি খোলাখুলিভাবে পাপ বা বিদআতে লিপ্ত হয় যেমন- প্রকাশ্যে মদ পানকারী, জবরদখলকারী, চাঁদাবাজ, অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ আত্মসাৎকারী, প্রকাশ্যে খারাপ কাজে নেতৃত্বদানকারী ইত্যাদি। এদের প্রকাশ্য দোষগুলোর আলোচনা করা বৈধ। এছাড়া অন্যান্য দোষচর্চা বৈধ নয়। তবে যদি অন্য কোনো (শরয়ি) কারণ থাকে তাহলে ভিন্ন কথা।
৬. পরিচয়প্রদান: যখন কোনো ব্যক্তি নির্দিষ্ট কোনো নিন্দনীয় উপাধিতে প্রসিদ্ধ হয়ে যায়, তখন এর মাধ্যমে পরিচয়প্রদান করা বৈধ। যেমন- দুর্বল দৃষ্টিসম্পন্ন, লেংড়া, বধির, অন্ধ, ট্যারা, বোবা ইত্যাদি। পরিচয়দানের শর্তে। তবে নিন্দা করার লক্ষ্যে এগুলো বলা হারাম। সর্বোপরি এগুলো ছাড়া অন্য কিছুর মাধ্যমে পরিচয়প্রদান করা সম্ভব হলে সেটা করা অধিকতর উত্তম।
এই ছয় কারণে গীবত হালাল হওয়ার কথা উলামায়ে কেরাম উল্লেখ করেছেন। এসব কারণ বয়ান করেছেন ইমাম আবু হামেদ গাজালি তার প্রসিদ্ধ কিতাব "ইহয়াউ উলুমিদ্দিন” কিতাবে (৩/১৫২) এবং অন্যান্য উলামায়ে কেরাম তাদের রচনাবলিতে। কারণগুলোর প্রামাণিকতা সহিহ প্রসিদ্ধ একাধিক হাদিস দ্বারাও রয়েছে। অধিকাংশ কারণগুলোর ব্যাপারে ঐক্যমত যে, সেগুলো থাকলে গীবত করা বৈধ।
(৮৯৭) হজরত আয়েশা রাদি. থেকে বর্ণিত-
أَنَّ رَجُلًا اسْتَأْذَنَ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: ائْذَنُوا لَهُ، بِئْسَ أَخُو الْعَشِيرَةِ.
অর্থ: এক ব্যক্তি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি চাইলে তিনি বললেন, তাকে অনুমতি দাও। সে হচ্ছে কওমের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি। ইমাম বুখারি রহ. এই হাদিস দিয়ে বিশৃঙ্খলাকারী ও সংশয়বাদীদের গীবত জায়েজ হওয়ার ওপর দলিল পেশ করেছেন।
(৮৯৮) হজরত ইবনে মাসউদ রাদি. থেকে বর্ণিত-
قَسَمَ رَسُولُ اللهِ، صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قِسْمَةً، فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الْأَنْصَارِ: وَاللَّهِ، مَا أَرَادَ مُحَمَّدُ بِهَذَا وَجْهَ اللهِ . فَأَتَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَخْبَرْتُهُ؛ فَتَمَعَّرَ وَجْهُهُ، وَقَالَ: رَحِمَ اللهُ مُوسَى، لَقَدْ أُوْذِيَ بِأَكْثَرَ مِنْ هَذَا فَصَبَرَ.
অর্থ: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার কোনো কিছু বণ্টন করলেন, তখন এক আনসারি বললেন, আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করেননি। আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে সেটা জানালাম। এটা শুনে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারার বীভৎস হয়ে গেল এবং (রেগে গিয়ে) বললেন, আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা আলাইহিস সালামের ওপর রহম করুক, তাকে এর থেকেও বেশি কষ্ট দেয়া হয়েছে। তবে তিনি ধৈর্যধারণ করেছেন। কোনো বর্ণনায় আছে: হজরত ইবনে מסউদ বলেন, আমি মনস্থ করলাম, আর কোনো বিষয়ে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কখনো অভিযোগ করব না। - ইমাম নববি বলেন, ইমাম বুখারি এই হাদিস দিয়ে ব্যক্তির গীবত সম্পর্কে তাকে অবহিতকরণের ওপর দলিল পেশ করেছেন।
(৮৯৯) হজরত আয়েশা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَا أَظُنُّ فُلَانًا وَفُلَانًا يَعْرِفَانِ مِنْ دِينِنَا شَيْئًا. قَالَ اللَّيْثُ: كَانَا رَجُلَيْنِ مِنَ الْمُنَافِقِينَ.
অর্থ: আমি অমুক অমুকের ব্যাপারে মনে করি না যে, তারা আমাদের দীন সম্পর্কে কিছু জানেন। হাদিসের একজন বর্ণনাকারী হজরত লাইস বিন সাদ বলেন, এই দুইজন ব্যক্তি মুনাফিক ছিল。
(৯০০) হজরত জায়েদ বিন আরকাম রাদি. থেকে বর্ণিত-
خَرَجْنَا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي سَفَرٍ أَصَابَ النَّاسَ فِيْهِ شِدَّةٌ، فَقَالَ عَبْدُ اللهِ بْنُ أُبَيَّ لِأَصْحَابِهِ: لَا تُنْفِقُوا عَلَى مَنْ عِنْدَ رَسُوْلِ اللَّهِ، حَتَّى يَنْفَضُّوا مِنْ حَوْلِهِ. وَقَالَ: لَئِنْ رَجَعْنَا إِلَى الْمَدِينَةِ لَيُخْرِجَنَّ الْأَعَزُّ مِنْهَا الْأَذَلَّ. فَأَتَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَأَخْبَرْتُهُ بِذَلِكَ، فَأَرْسَلَ إِلَى عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أُبي .... وَأَنْزَلَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ تَصْدِيقِهِ: إِذَا جَاءَكَ الْمُنَافِقُوْنَ.
অর্থ: আমরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে একবার এক সফরে বের হলাম। সফরে এক কঠিন অবস্থা লোকদের গ্রাস করে নিল। তখন আবদুল্লাহ বিন উবাই বলল, আল্লাহর রাসুলের সহচরদের ওপর তোমরা ব্যয় কর না যতক্ষণ না তারা তার সঙ্গ ত্যাগ করে। সে আরো বলল, যদি আমরা মদিনায় প্রত্যাগমন করি তাহলে ক্ষমতাধর লোকেরা দুর্বল লোকদের মদিনা থেকে বহিষ্কার করবেই। এ কথা শুনে আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বিষয়টি অবিহিত করলাম। অতঃপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ বিন উবাইকে ডেকে পাঠালেন। আল্লাহ তাআলা হজরত জায়েদের সত্যায়নে সুরা মুনাফিকুন নাজিল করেন。
হজরত আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হজরত হিন্দার হাদিসে নবিজির উদ্দেশ্যে তার এই বক্তব্য এসেছে যে, আবু সুফিয়ান একজন ব্যয়কুণ্ঠ ব্যক্তি.....। হজরত ফাতেমা বিনতে কায়েসের হাদিসে নবিজি বলেছেন, মুআবিয়া হলেন একদম রিক্তহস্ত। আর আবু জাহম: স্ত্রীদের বেধড়ক প্রহারকারী。
টিকাঃ
১২৮৮. সহিহ বুখারি: ৬০৫৪, সহিহ মুসলিম: ২৫৯১, মুয়াত্তা মালেক ২/৯০৩, সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৯১, সুনানে তিরমিজি: ১৯৯৭, মু. আহমাদ ৬/৩৮।
১২৮৯. সহিহ বুখারি: ৬০৫৯, সহিহ মুসলিম: ১০৬২।
১২৯০. সহিহ বুখারি: ৬০৬৭।
১২৯১. সহিহ বুখারি: ৪৯০৩, সহিহ মুসলিম: ২৭৭২।
১২৯২. সহিহ বুখারি: ২২১১, সহিহ মুসলিম: ১৭১৪।
১২৯৩. সহিহ মুসলিম: ১৪৮০, সহিহ ইবনে হিব্বান: ৪০৪৯, মুয়াত্তা মালেক ২/৫৮০, সুনানে আবু দাউদ: ২২৮৪।
যেসব ক্ষেত্রে গীবত বৈধ
গীবত হারাম হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ প্রয়োজনে সেটা বৈধ হয়ে যায়। গীবতের বৈধতা দানকারী হল, এমন কোনো শরয়ি উদ্দেশ্য, যেটা দোষের আলোচনা ছাড়া হাসিল হয় না। আর তা ছয় কারণের যে কোনো একটি কারণে-
১. জুলুমের অভিযোগ করা: মাজলুমের জন্য বাদশাহ, কাজি প্রমুখের কাছে জুলুমের অভিযোগ করা বৈধ আছে, যাদের প্রশাসনিক ক্ষমতা রয়েছে অথবা যাদের জালেম থেকে অত্যাচারের সঠিক বিচার করার সক্ষমতা আছে। সে গিয়ে বলবে, অমুকে আমার ওপর জুলুম করেছে, আমার সাথে এমন আচরণ করেছে, আমার অমুক জিনিস আত্মসাৎ করেছে ইত্যাদি।
২. খারাপ কাজের পরিবর্তন ও গুনাগারকে সঠিক পথে ফেরানোর জন্য সাহায্য প্রার্থনা করা। যার ব্যাপারে আশা হয় যে, সে অশ্লীল কাজ পরিবর্তনের সামর্থ্য রাখে তার কাছে গিয়ে বলবে, অমুকে এমন কাজ করে আপনি তাকে সেটা থেকে নিষেধ করেন অথবা এ ধরনের অন্য কিছু বলা। তবে উদ্দেশ্য হতে হবে, খারাপ কাজ দূর করার উসিলা গ্রহণ করা। অন্যথায় সেটা হারাম।
৩. ফতোয়া চাওয়া: যেমন, মুফতিকে এভাবে বলা যে, আমার পিতা বা ভাই অথবা অমুক আমার ওপর এই এই জুলুম করেছেন। সেটা তার জন্য বৈধ হয়েছে কিনা? এ থেকে আমার মুক্তি পাওয়ার, আমার হক আদায় করে নেয়ার এবং আমার থেকে জুলুম দূর করার পদ্ধতি কী? অথবা এ ধরনের অন্য কিছু বলা। এমনিভাবে এরকম বলা যে, আমার স্ত্রী/স্বামী এমন এমন করেন, অথবা এধরনের কিছু; সবই প্রয়োজনের কারণে জায়েজ। তবে এরকম বলা সর্তকতা- আপনি এমন ব্যক্তির ব্যাপারে কী বলেন, যার কাজ এরকম বা এমন স্বামী বা স্ত্রীর ক্ষেত্রে কি বলেন, যে এই এই আচরণ করে। অথবা এ ধরনের কিছু বলা। কেননা, এখানে নির্দিষ্ট করা ছাড়াই উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যায়। এরপরও নির্দিষ্ট করে বলাও জায়েজ আছে হিন্দার হাদিসের কারণে, যেটা আমরা সামনে উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ। হজরত হিন্দা বলেছেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! নিশ্চয় আবু সুফিয়ান একজন কৃপণ ব্যক্তি...। তবুও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে নিষেধ করেননি। (এ দ্বারা নির্দিষ্ট করে বলা জায়েজ প্রমাণিত হয়)
৪. মুসলমানদেরকে অকল্যাণ থেকে সতর্ক করা ও তাদেরকে উপদেশ দেয়া। এটা অনেক ধরনে হতে পারে: ক. হাদিসের বর্ণনাকারীদের জারাহ (সমালোচনা) করা, সাক্ষীদের কোনো দোষ বর্ণনা করা। এগুলো মুসলমানদের ঐক্যমতে বৈধ, বরং প্রয়োজনে ওয়াজিব। খ. যখন কেউ বিয়ে, অংশীদারিত্ব, আমানত রাখা বা কারো আমানত নিজের কাছে রাখা অথবা অন্যান্য লেনদেনের বিষয়ে তোমার কাছে পরামর্শ চায়, তখন তোমার জন্য ওয়াজিব হল, কল্যাণকামিতা হিসাবে সে সম্বন্ধে জ্ঞানানুসারে বর্ণনা করে দেয়া। যদি এটুকু বলা দ্বারাই তোমার উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যায় যে, তার সাথে লেনদেন করা বা তার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা শুভ হবে না, অথবা তুমি এমনটি কর না। অথবা এই ধরনের কিছু বললেই উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যায়, তবে নির্দিষ্ট দোষ বলা বৈধ হবে না। যদি স্পষ্ট করে বলা ছাড়া উদ্দেশ্য হাসিল না হয় তবেই স্পষ্ট বলবে।
গ. যখন এমন কোনো ব্যক্তিকে দেখবে যে, এমন এক গোলাম কিনছে যে চুরি, যিনা বা মদ পানে অভ্যস্ত অথবা এ ধরনের অন্য কোনো খারাপ গুণে প্রসিদ্ধ, তখন তোমার জন্য আবশ্যক হল, এই দোষগুলো (আগে থেকে তার জানা না থাকলে) তার কাছে বলে দেয়া। এটা শুধু গোলামের সাথেই নির্দিষ্ট না, বরং প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি যে বিক্রিত পণ্যের এমন কোনো দোষ জানে যেটা ক্রেতা জানে না, তার জন্য ক্রেতাকে অবহিত করা আবশ্যক।
ঘ. যখন তুমি কোনো ফিকহ অর্জনকারীকে দেখবে যে, সে কোনো বিদআতি বা ফাসেকের কাছে যাতায়াত করতঃ তার কাছ থেকে ইলম শিখে। আর এতে সেই ফিকহ অর্জনকারীর ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা কর, তাহলে তোমার জন্য আবশ্যক হল, তার অবস্থা বর্ণনা করে তাকে সেই ফাসেক বা বিদআতির কাছে যাওয়া থেকে বিরত থাকার উপদেশ দেয়া। এ ক্ষেত্রে কল্যাণকামিতার নিয়ত থাকা শর্ত। এখানেই বেশি ভুল হয়ে থাকে। অনেক সময় বক্তা এ ক্ষেত্রে হিংসার শিকার হয় অথবা শয়তান তার সামনে বিষয়টা ঘোলাটে করে তুলে। তার কাছে মনে হয় যে, সেটা কল্যাণকামিতা ও দয়া। সুতরাং এ সব ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতা কাম্য।
ঙ. যদি দায়িত্ববান ব্যক্তি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করে। হয়ত সে তার যোগ্য না বা সে ফাসেক অথবা উদাসীন অথবা অন্য কোনো কারণে। তখন ওয়াজিব হল, সেটা এমন ব্যক্তির কাছে বলা, যে সেই অযোগ্য দায়িত্বশীলের ওপর কর্তৃত্ববান। যেন তিনি তাকে বরখাস্ত করে তদস্থলে যোগ্য কাউকে নিয়োগ দেন। অথবা তার ব্যাপারে উনার জানা থাকে, যেন তার সাথে সে অনুযায়ী আচরণ করেন। ধোঁকাগ্রস্ত না হন। যেন তিনি তাকে ঠিক হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন, অন্যথায় তাকে বদলি করে দেয়ার ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পারেন।
৫. যদি কোনো ব্যক্তি খোলাখুলিভাবে পাপ বা বিদআতে লিপ্ত হয় যেমন- প্রকাশ্যে মদ পানকারী, জবরদখলকারী, চাঁদাবাজ, অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ আত্মসাৎকারী, প্রকাশ্যে খারাপ কাজে নেতৃত্বদানকারী ইত্যাদি। এদের প্রকাশ্য দোষগুলোর আলোচনা করা বৈধ। এছাড়া অন্যান্য দোষচর্চা বৈধ নয়। তবে যদি অন্য কোনো (শরয়ি) কারণ থাকে তাহলে ভিন্ন কথা।
৬. পরিচয়প্রদান: যখন কোনো ব্যক্তি নির্দিষ্ট কোনো নিন্দনীয় উপাধিতে প্রসিদ্ধ হয়ে যায়, তখন এর মাধ্যমে পরিচয়প্রদান করা বৈধ। যেমন- দুর্বল দৃষ্টিসম্পন্ন, লেংড়া, বধির, অন্ধ, ট্যারা, বোবা ইত্যাদি। পরিচয়দানের শর্তে। তবে নিন্দা করার লক্ষ্যে এগুলো বলা হারাম। সর্বোপরি এগুলো ছাড়া অন্য কিছুর মাধ্যমে পরিচয়প্রদান করা সম্ভব হলে সেটা করা অধিকতর উত্তম।
এই ছয় কারণে গীবত হালাল হওয়ার কথা উলামায়ে কেরাম উল্লেখ করেছেন। এসব কারণ বয়ান করেছেন ইমাম আবু হামেদ গাজালি তার প্রসিদ্ধ কিতাব "ইহয়াউ উলুমিদ্দিন” কিতাবে (৩/১৫২) এবং অন্যান্য উলামায়ে কেরাম তাদের রচনাবলিতে। কারণগুলোর প্রামাণিকতা সহিহ প্রসিদ্ধ একাধিক হাদিস দ্বারাও রয়েছে। অধিকাংশ কারণগুলোর ব্যাপারে ঐক্যমত যে, সেগুলো থাকলে গীবত করা বৈধ।
(৮৯৭) হজরত আয়েশা রাদি. থেকে বর্ণিত-
أَنَّ رَجُلًا اسْتَأْذَنَ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: ائْذَنُوا لَهُ، بِئْسَ أَخُو الْعَشِيرَةِ.
অর্থ: এক ব্যক্তি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি চাইলে তিনি বললেন, তাকে অনুমতি দাও। সে হচ্ছে কওমের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি। ইমাম বুখারি রহ. এই হাদিস দিয়ে বিশৃঙ্খলাকারী ও সংশয়বাদীদের গীবত জায়েজ হওয়ার ওপর দলিল পেশ করেছেন।
(৮৯৮) হজরত ইবনে মাসউদ রাদি. থেকে বর্ণিত-
قَسَمَ رَسُولُ اللهِ، صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قِسْمَةً، فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الْأَنْصَارِ: وَاللَّهِ، مَا أَرَادَ مُحَمَّدُ بِهَذَا وَجْهَ اللهِ . فَأَتَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَخْبَرْتُهُ؛ فَتَمَعَّرَ وَجْهُهُ، وَقَالَ: رَحِمَ اللهُ مُوسَى، لَقَدْ أُوْذِيَ بِأَكْثَرَ مِنْ هَذَا فَصَبَرَ.
অর্থ: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার কোনো কিছু বণ্টন করলেন, তখন এক আনসারি বললেন, আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করেননি। আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে সেটা জানালাম। এটা শুনে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারার বীভৎস হয়ে গেল এবং (রেগে গিয়ে) বললেন, আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা আলাইহিস সালামের ওপর রহম করুক, তাকে এর থেকেও বেশি কষ্ট দেয়া হয়েছে। তবে তিনি ধৈর্যধারণ করেছেন। কোনো বর্ণনায় আছে: হজরত ইবনে מסউদ বলেন, আমি মনস্থ করলাম, আর কোনো বিষয়ে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কখনো অভিযোগ করব না। - ইমাম নববি বলেন, ইমাম বুখারি এই হাদিস দিয়ে ব্যক্তির গীবত সম্পর্কে তাকে অবহিতকরণের ওপর দলিল পেশ করেছেন।
(৮৯৯) হজরত আয়েশা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَا أَظُنُّ فُلَانًا وَفُلَانًا يَعْرِفَانِ مِنْ دِينِنَا شَيْئًا. قَالَ اللَّيْثُ: كَانَا رَجُلَيْنِ مِنَ الْمُنَافِقِينَ.
অর্থ: আমি অমুক অমুকের ব্যাপারে মনে করি না যে, তারা আমাদের দীন সম্পর্কে কিছু জানেন। হাদিসের একজন বর্ণনাকারী হজরত লাইস বিন সাদ বলেন, এই দুইজন ব্যক্তি মুনাফিক ছিল。
(৯০০) হজরত জায়েদ বিন আরকাম রাদি. থেকে বর্ণিত-
خَرَجْنَا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي سَفَرٍ أَصَابَ النَّاسَ فِيْهِ شِدَّةٌ، فَقَالَ عَبْدُ اللهِ بْنُ أُبَيَّ لِأَصْحَابِهِ: لَا تُنْفِقُوا عَلَى مَنْ عِنْدَ رَسُوْلِ اللَّهِ، حَتَّى يَنْفَضُّوا مِنْ حَوْلِهِ. وَقَالَ: لَئِنْ رَجَعْنَا إِلَى الْمَدِينَةِ لَيُخْرِجَنَّ الْأَعَزُّ مِنْهَا الْأَذَلَّ. فَأَتَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَأَخْبَرْتُهُ بِذَلِكَ، فَأَرْسَلَ إِلَى عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أُبي .... وَأَنْزَلَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ تَصْدِيقِهِ: إِذَا جَاءَكَ الْمُنَافِقُوْنَ.
অর্থ: আমরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে একবার এক সফরে বের হলাম। সফরে এক কঠিন অবস্থা লোকদের গ্রাস করে নিল। তখন আবদুল্লাহ বিন উবাই বলল, আল্লাহর রাসুলের সহচরদের ওপর তোমরা ব্যয় কর না যতক্ষণ না তারা তার সঙ্গ ত্যাগ করে। সে আরো বলল, যদি আমরা মদিনায় প্রত্যাগমন করি তাহলে ক্ষমতাধর লোকেরা দুর্বল লোকদের মদিনা থেকে বহিষ্কার করবেই। এ কথা শুনে আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বিষয়টি অবিহিত করলাম। অতঃপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ বিন উবাইকে ডেকে পাঠালেন। আল্লাহ তাআলা হজরত জায়েদের সত্যায়নে সুরা মুনাফিকুন নাজিল করেন。
হজরত আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হজরত হিন্দার হাদিসে নবিজির উদ্দেশ্যে তার এই বক্তব্য এসেছে যে, আবু সুফিয়ান একজন ব্যয়কুণ্ঠ ব্যক্তি.....। হজরত ফাতেমা বিনতে কায়েসের হাদিসে নবিজি বলেছেন, মুআবিয়া হলেন একদম রিক্তহস্ত। আর আবু জাহম: স্ত্রীদের বেধড়ক প্রহারকারী。
টিকাঃ
১২৮৮. সহিহ বুখারি: ৬০৫৪, সহিহ মুসলিম: ২৫৯১, মুয়াত্তা মালেক ২/৯০৩, সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৯১, সুনানে তিরমিজি: ১৯৯৭, মু. আহমাদ ৬/৩৮।
১২৮৯. সহিহ বুখারি: ৬০৫৯, সহিহ মুসলিম: ১০৬২।
১২৯০. সহিহ বুখারি: ৬০৬৭।
১২৯১. সহিহ বুখারি: ৪৯০৩, সহিহ মুসলিম: ২৭৭২।
১২৯২. সহিহ বুখারি: ২২১১, সহিহ মুসলিম: ১৭১৪।
১২৯৩. সহিহ মুসলিম: ১৪৮০, সহিহ ইবনে হিব্বান: ৪০৪৯, মুয়াত্তা মালেক ২/৫৮০, সুনানে আবু দাউদ: ২২৮৪।
📄 মিথ্যা সাক্ষ্যদান, খোটা দেয়া ও অভিশম্পাত করা
মিথ্যা সাক্ষ্যপ্রদান অত্যন্ত হারাম কাজ
আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَاجْتَنِبُوا قَوْلَ الزُّوْرِ.
অর্থ: তোমরা মিথ্যা সাক্ষ্যপ্রদান থেকে বিরত থাক。
আরো বলেন-
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا.
অর্থ: যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার পিছনে তুমি পড় না। নিশ্চয় কান, চোখ এবং অন্তর সবগুলো (নিজ কৃতকর্ম সম্পর্কে) জিজ্ঞাসিত হবে。
(৯১৪) হজরত আবু বাকরা নুফাই বিন হারিস রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনবার এ কথাটি বলেছেন-
أَلَا أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ ، قَالُوا : بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ، قَالَ: الْإِشْرَاكُ بِاللَّهِ، ، وَعُقُوْقُ الْوَالِدَيْنِ وَجَلَسَ وَكَانَ مُتَّكِنًا فَقَالَ: أَلَا وَقَوْلُ الزُّوْرِ. قَالَ : فَمَا زَالَ يُكَرِّرُهَا حَتَّى قُلْنَا: لَيْتَهُ سَكَتَ.
অর্থ: আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় গুনাহ সম্বন্ধে অবহিত করব না? আমরা বললাম, অবশ্যই ইয়া রাসুলুল্লাহ! বললেন, আল্লাহর সাথে শরিক করা এবং মা-বাবার অবাধ্যতা করা। তিনি হেলান দিয়ে বসে ছিলেন, উঠে বললেন, সাবধান! মিথ্যা কথা ও মিথ্যা সাক্ষ্যপ্রদান থেকে বেঁচে থাকবে। এ কথা এতবার বলছিলেন যে, এক পর্যায়ে আমরা মনে মনে বলেছিলাম, তিনি চুপ করেন না কেন?
ইমাম নববি রহ. বলেন, এ অধ্যায়ে অনেক হাদিস আছে, যা উল্লেখ করেছি তাই যথেষ্ট। এ ব্যাপারে উম্মাহর ঐক্য সংঘটিত হয়েছে।
দান বা অনুগ্রহ করে খোটা দেয়া নিষেধ
আল্লাহ তাআলা বলেন-
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُبْطِلُوا صَدَقْتِكُمْ بِالْمَنِ وَالْأَذَى كَالَّذِي يُنْفِقُ مَالَهُ رِئَاءَ النَّاسِ.
অর্থ: হে ঈমানদারগণ! অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান-খয়রাতকে বরবাদ কর না। - মুফাসসিরিনে কেরাম বলেন, অর্থাৎ এর সওয়াব বিনষ্ট কর না।
(৯১৫) হজরত আবু জর রাদি. থেকে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
ثَلَاثَةٌ لَا يُكَلِّمُهُمُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ، وَلَا يُزَكِّيهِمْ، وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ. قَالَ : فَقَرَأَهَا رَسُولُ اللهِ، صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثَلَاثَ مِرَارًا. قَالَ أَبُو ذَرٍّ: خَابُوا وَخَسِرُوا مَنْ هُمْ يَا رَسُوْلَ اللهِ ؟ قَالَ: الْمُسْبِلُ ، وَالْمَنَّانُ، وَالْمُنَفِّقُ سِلْعَتَهُ بِالْحَلِفِ الْكَاذِبِ.
অর্থ: আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তিন শ্রেণীর লোকের সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না এবং তাকে পবিত্রও করবেন না। বরং তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। বর্ণনাকারী বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা তিনবার বলেছেন। আবু জর রাদি. বললেন, তাহলে তো তারা ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যর্থ; কিন্তু তারা কারা ইয়া রাসুলুল্লাহ! রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে লোক পায়ের গোছার নিচে ঝুলিয়ে কাপড় পরিধান করে। যে ব্যক্তি দান করে খোটা দেয়। যে মিথ্যা শপথ দ্বারা পণ্য বিক্রয় করে。
অভিসম্পাত করা নিষেধ
(৯১৬) হজরত সাবেত বিন দাহহাক রাদি. (তিনি বায়আতে রিদওয়ানের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَعْنُ الْمُؤْمِنِ كَقَتْلِهِ.
অর্থ: মুমিনকে অভিসম্পাত করা তাকে হত্যার সমতুল্য。
(৯১৭) হজরত আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَا يَنْبَغِي لِصِدِّيْقٍ أَنْ يَكُوْنَ لَعَانًا.
অর্থ: সিদ্দিকের পক্ষে কাউকে লানত করা উচিত না。
(৯১৮) হজরত আবু দারদা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَا يَكُونُ اللَّعَانُونَ شُفَعَاءَ وَلَا شُهَدَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.
অর্থ: অভিসম্পাতকারীরা কেয়ামতের দিন কোনো সুপারিশকারী বা সাক্ষী হবে না。
(৯১৯) হজরত সামুরা বিন জুনদুব রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَا تَلَاعَنُوْا بِلَعْنَةِ اللهِ، ، وَلَا بِغَضَبِهِ، وَلَا بِالنَّارِ.
অর্থ: তোমরা একে অপরের জন্য আল্লাহর লানত, ক্রোধ এবং জাহান্নামের বদদুআ কর না। -তিরমিজি রহ. বলেন, হাদিসটি হাসান সহিহ。
(৯২০) হজরত ইবনে মাসউদ রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَيْسَ الْمُؤْمِنُ بِالطَّعَانِ، وَلَا اللَّعَانِ، وَلَا الْفَاحِشِ، وَلَا الْبَدِيءِ.
অর্থ: মুমিন কখনো দোষারোপকারী ও নিন্দাকারী হতে পারে না। অভিসম্পাতকারী হতে পারে না। অশ্লীল কাজ করতে পারে না। কটুভাষীও হতে পারে না। -তিরমিজি রহ. বলেন, হাদিসটি হাসান。
(৯২১) হজরত আবু দারদা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا لَعَنَ شَيْئًا صَعِدَتِ اللَّعْنَةُ إِلَى السَّمَاءِ فَتُغْلَقُ أَبْوَابُ السَّمَاءِ دُونَهَا، ثُمَّ تَهْبِطُ إِلَى الْأَرْضِ فَتُغْلَقُ أَبْوَابُهَا دُوْنَهَا، ثُمَّ تَأْخُذُ يَمِينًا وَشِمَالًا، فَإِذَا لَمْ تَجِدْ مَسَانًا رَجَعَتْ إِلَى الَّذِي لُعِنَ، فَإِنْ كَانَ لِذَلِكَ أَهْلًا وَإِلَّا رَجَعَتْ إِلَى قَائِلِهَا.
অর্থ: বান্দা যখন কোনো বস্তুকে অভিশাপ দেয়, তখন ঐ অভিশাপ আকাশের দিকে অগ্রসর হয়। অতঃপর সেই অভিশাপের আকাশে ওঠার পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর ঐ অভিশাপ দুনিয়ার দিকে অগ্রসর হয়, তখন ঐ অভিশাপের দুনিয়াতে ফেরার পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর সেটা ডানে-বামে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অবশেষে অন্য কোনো পথ না পেয়ে যাকে অভিশাপ দেয়া হয়েছে তার দিকেই ফিরে আসে। যদি সে তার যোগ্য হয় তো তার উপর পতিত হয়, অন্যথায় অভিশাপকারীর দিকেই ফিরে আসে。
(৯২২) হজরত ইবনে আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ لَعَنَ شَيْئًا لَيْسَ لَهُ بِأَهْلِ رَجَعَتِ اللَّعْنَةُ عَلَيْهِ.
অর্থ: যে ব্যক্তি এমন কোনো বস্তুকে অভিসম্পাত করল যা এর যোগ্য নয়, ঐ অভিশাপ তার দিকেই ফিরে আসে。
(৯২৩) হজরত ইমরান বিন হুসাইন থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
بَيْنَمَا رَسُوْلُ اللهِ، صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي بَعْضِ أَسْفَارِهِ، وَامْرَأَةٌ مِنَ الْأَنْصَارِ عَلَى نَاقَةٍ، فَضَجِرَتْ، فَلَعَنَتْهَا، فَسَمِعَ ذَلِكَ رَسُوْلُ اللَّهِ، صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: خُذُوا مَا عَلَيْهَا وَدَعُوهَا؛ فَإِنَّهَا مَلْعُونَةٌ. قَالَ عِمْرَانُ: فَكَأَنِّي أَرَاهَا الْآنَ تَمْشِي فِي النَّاسِ مَا يَعْرِضُ لَهَا أَحَدٌ.
অর্থ: একবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সফরে ছিলেন, সে সময় এক আনসারি মহিলা উষ্ট্রীর পিঠে আরোহী ছিলেন। তিনি তার আচরণে বিরক্ত হয়ে তাকে অভিসম্পাত করলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটা শুনে বললেন, এর উপর যা আছে তা নিয়ে নাও এবং একে ছেড়ে দাও। কারণ, এটা তো অভিশপ্ত হয়ে গেছে। ইমরান বলেন, আমি যেন সেই উষ্ট্রীকে এখনো দেখতে পাচ্ছি যে, মানুষের মাঝে ঘুরছে, কিন্তু কেউ তার দিকে ভ্রুক্ষেপও করছে না。
ফায়দা: হজরত ইমরানের বাবা হুসাইনের ইসলাম গ্রহণ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্য নিয়ে উলামায়ে কেরামের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। সহিহ মত হল, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যও পেয়েছেন। তাই আমি রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছি।
(৯২৪) হজরত আবু বারজা রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
بَيْنَمَا جَارِيَةٌ عَلَى نَاقَةٍ عَلَيْهَا بَعْضُ مَتَاعِ الْقَوْمِ إِذْ بَصُرَتْ بِالنَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَتَضَايَقَ بِهِمُ الْجَبَلُ ، فَقَالَتْ: حَلِ ، اللَّهُمَّ الْعَنْهَا. قَالَ : فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا تُصَاحِبْنَا نَاقَةُ عَلَيْهَا لَعْنَةٌ. وَفِي رِوَايَةٍ: لَا تُصَاحِبْنَا رَاحِلَةُ عَلَيْهَا لَعْنَةُ مِنَ اللهِ .
অর্থ: একবার এক মেয়ে উষ্ট্রীর উপর আরোহী ছিল। উষ্ট্রীর উপর তার সম্প্রদায়ের কিছু মাল-সামানাও ছিল। হঠাৎ সে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে পেল, আর পাহাড়ের কারণে রাস্তা সঙ্কীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তখন সে আরবিতে উট তাড়ানোর একটা শব্দ উচ্চারণ করল, পরে বলল, হে আল্লাহ! আপনি এর উপর লানত করুন। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা শুনে বললেন, আমাদের সাথে এমন উষ্ট্রী যেন না থাকে, যার উপর অভিশাপ রয়েছে। অন্য এক বর্ণনায় আছে, আমাদের সাথে এমন বাহন থাকবে না যার উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে অভিশাপ রয়েছে।
অনির্দিষ্ট ও অপ্রসিদ্ধ পাপীষ্ঠকে লানত করা বৈধ
একাধিক সহিহ প্রসিদ্ধ হাদিসে প্রমাণিত যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَعَنَ اللهُ الْوَاصِلَةَ وَالْمُسْتَوْصِلَةَ.
অর্থ: আল্লাহ ঐ সব নারীদের উপর লানত করুক, যারা নিজেরা পরচুলা লাগায় এবং অন্যকে লাগিয়ে দেয়...।
আরো বলেছেন-
لَعَنَ اللهُ آكِلَ الرِّبَا.
অর্থ: আল্লাহ পাক সুদখোরের ওপর লানত করুক...।
আরো বলেছেন-
لَعَنَ اللهُ المُصَوِّرِينَ.
অর্থ: আল্লাহ চিত্রাঙ্কনকারীদের (রহমত থেকে) বিতাড়িত করুক。
আরো বলেন-
لَعَنَ اللَّهُ مَنْ غَيَّرَ مَنَارَ الْأَرْضِ.
অর্থ: আল্লাহ পাক ঐ ব্যক্তিকে অভিশাপ দিক, যে অন্যায়ভাবে জমির (সীমানার) চিহ্ন পরিবর্তন করে。
আরো বলেছেন-
لَعَنَ اللهُ السَّارِقَ يَسْرِقُ البَيْضَةَ.
অর্থ: আল্লাহ এমন চোরের উপর লানত করুক, যে ডিম চুরি করে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
لَعَنَ اللهُ مَنْ لَعَنَ وَالِدَيْهِ، وَلَعَنَ اللَّهُ مَنْ ذَبَحَ لِغَيْرِ الله.
অর্থ: যে ব্যক্তি নিজের মা-বাবার ওপর অভিসম্পাত করে, আল্লাহ তার প্রতি অভিশম্পাত করুক। যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে যবেহ করে, তার ওপর আল্লাহ লানত করুক。
আরো বলেছেন-
مَنْ أَحْدَثَ فِينَا حَدَثاً، أَوْ آوَى مُحْدِثاً، فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ.
অর্থ: যে ব্যক্তি মদিনায় কোনো বিদআত সৃষ্টি করবে অথবা কোনো বিদআতিকে আশ্রয় দিবে, তার ওপর আল্লাহ, ফেরেশতা এবং সমগ্র মানবজাতির অভিশাপ。
তিনি আরো বলেন-
اللَّهُمَّ الْعَنْ رِعْلاً وَذَكْوَانَ وَعُصَيَّةً عَصَتِ اللَّهَ وَرَسُوْلَهُ.
অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি রিয়িল, জাকওয়ান ও উসাইয়াহ গোত্রগুলোর ওপর লানত করুন। তারা আল্লাহ ও রাসুলের অবাধ্যতা করেছে। এরা হল আরবের তিনটি গোত্র।
আরো বলেন-
لَعَنَ اللهُ الْيَهُودَ حُرِّمَتْ عَلَيْهِمُ الشُّحُوْمُ فَجَمَلُوْهَا فَبَاعُوْهَا.
অর্থ: আল্লাহ তাআলা ইহুদিদের ওপর লানত করুক: তাদের ওপর চর্বি হারাম করা হয়েছিল, কিন্তু তারা সেটা বিক্রি করা শুরু করেছিল。
তিনি আরো বলেছেন-
لَعَنَ اللهُ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ.
অর্থ: আল্লাহ পাক ইহুদি-খ্রীস্টানের ওপর অভিসম্পাত করুক। কারণ, তারা নিজেদের নবিদের কবরকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে。
তিনি আরো বলেছেন-
لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمُتَشَبِّهِينَ مِنَ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ، وَالْمُتَشَبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ.
অর্থ: পুরুষদের মধ্য থেকে মহিলাদের সাদৃশ্য গ্রহণকারী ও মহিলাদের মধ্য থেকে পুরুষদের সাদৃশ্য গ্রহণকারিণীদের ওপর লানত।
এ সমস্ত হাদিসের কিছু تو সহিহ বুখারি ও মুসলিমের উভয়টাতে আছে, কিছু যে কোনো একটিতে। সংক্ষিপ্ততার স্বার্থে সবগুলো সনদসহ উল্লেখ না করে শুধু ইঙ্গিত দিলাম।
(৯২৫) হজরত জাবের রাদি. থেকে বর্ণিত-
أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّ عَلَيْهِ حِمَارُ قَدْ وُسِمَ فِي وَجْهِهِ، فَقَالَ: لَعَنَ اللهُ الَّذِي وَسَمَهُ.
অর্থ: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখলেন এক গাধাকে তার চেহারায় দাগ দেয়া হয়েছে। বললেন, আল্লাহ তাআলা ঐ ব্যক্তির ওপর লানত করুক যে এর চেহারায় দাগ দিয়েছে。
(৯২৬) সহিহ বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত আছে-
أَنَّ ابْنَ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا مَرَّ بِفِتْيَانٍ مِنْ قُرَيْشٍ قَدْ نَصَبُوْا طَيْرًا وَهُمْ يَرْمُوْنَهُ، فَقَالَ ابْنُ عُمَرَ: لَعَنَ اللهُ مَنْ فَعَلَ هَذَا؛ إِنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَعَنَ مَنِ اتَّخَذَ شَيْئًا فِيْهِ الرُّوْحُ غَرَضًا.
অর্থ: হজরত ইবনে উমর রাদি. কিছু কুরাইশি যুবকদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যারা একটি পাখিকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে তীরন্দাজি করছিল। তিনি বললেন, যে এ কাজ করে তার ওপর আল্লাহর অভিশাপ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ঐ ব্যক্তির ওপর আল্লাহ তাআলার অভিশাপ, যে কোনো প্রাণীকে তীরন্দাজির লক্ষ্যবস্তু বানায়。
বৈধ-অবৈধ অভিশাপ
গুনাহ থেকে পবিত্র মুসলিমকে অভিশাপ দেয়া মুসলিমদের ঐক্যমতে হারাম। খারাপ গুণাবলী সম্পন্ন ব্যক্তিদের লানত করা বৈধ আছে। যেমন এভাবে বলা- আল্লাহ পাক অত্যাচারীদের ওপর লানত বর্ষণ করুক, কাফেরদের ওপর আল্লাহর লানত বর্ষণ হোক, ইহুদি-খ্রীস্টানের ওপর আল্লাহর লানত, ফাসেকদের ওপর আল্লাহ লানত বর্ষণ করুক। ছবি অঙ্কনকারীদের ওপর আল্লাহর লানত বর্ষণ হোক। এ ধরনের অন্যান্য শব্দ বলা, যা পূর্বের পরিচ্ছেদে অতীত হয়েছে।
কোনো গুনাহে লিপ্ত নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে লানত করাও হাদিসের বাহ্যিক অর্থ অনুযায়ী হারাম নয়। যেমন এভাবে বলা- ইহুদি, খ্রীস্টান অথবা ঐ অত্যাচারী, ব্যভিচারী, ছবি অঙ্কনকারী, চোর কিংবা সুদখোরের ওপর আল্লাহ লানত বর্ষণ করুক। কিন্তু ইমাম গাজালি রহ. এও হারাম হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তবে যাদের ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত জানি যে, তারা কুফরের ওপর মারা গেছে। যেমন- আবু লাহাব, আবু জাহেল, ফেরাউন, হামান। এ জাতীয় লোকদের ওপর অভিশাপ দেয়া যাবে। ইমাম গাজালি নির্দিষ্ট গুনাহগারকে লানত করাকে বৈধ বলেন না এ জন্য যে, লানত হল আল্লাহর রহমত থেকে বিতাড়ন করা। অথচ এই কাফের বা ফাসেকের শেষ পরিণতি কী হবে তা আমরা জানি না। আরো বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদের নির্দিষ্ট নাম নিয়ে লানত করেছেন, সেটা জায়েজ ছিল। কারণ, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের মৃত্যু কুফরের ওপর হবে বলে জানতেন। তিনি আরো বলেন, মানুষের প্রতি বদদুআ করা এমনকি জালেমের জন্যও বদদুআ করা লানতের কাছাকাছি। যেমন- কোনো ব্যক্তি দুআ করল, আল্লাহ তার শরীর সুস্থ না করুক, তাকে নিরাপত্তা না দিক। অথবা এ জাতীয় কিছু। এ সবই নিন্দনীয়। এমনিভাবে সকল প্রাণী ও জড় পদার্থকে লানত করাও নিন্দনীয়。
অনুপযুক্ত ব্যক্তিকে অভিসম্পাত করলে প্রতিকার কীভাবে
জনৈক আলেম থেকে আবু জাফর বর্ণনা করেন- যখন কেউ এমন কোনো বস্তুকে লানত করে ফেলে যে এর উপযুক্ত নয়, সে যেন তাড়াতাড়ি এ কথা বলে, তবে সে যদি উপযুক্ত না হয় (তাহলে তার ওপর লানত নয়)
সৎকাজের আদেশ প্রদান ও অসৎকাজে নিষেধ করার সময় যা বলা যাবে
সৎকাজের আদেশকারী ও অসৎকাজ থেকে নিষেধকারী এবং প্রত্যেক শিষ্টাচার শিক্ষাদানকারীর জন্য জায়েজ আছে যে, সে আদেশ-নিষেধ করতে গিয়ে তার সম্বোধিত ব্যক্তিকে বলতে পারবে- তোমার ধ্বংস হোক বা হে দুর্বল অবস্থার অধিকারী অথবা হে বেপরোয়া! কিংবা হে নিজের ওপর জুলুমকারী ইত্যাদি। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন তার কথাটা মিথ্যা না হয় এবং তাতে স্পষ্ট বা ইশারা ইঙ্গিতে কোনো অপবাদের শব্দ না থাকে, যদিও সেক্ষেত্রে সত্যবাদীই হয়। পূর্বোক্ত বিষয়গুলো জায়েজ হয়েছে কেবল আদব শিক্ষাদান বা ধমকিপ্রদানের উদ্দেশ্যে, যাতে কথাটা অন্তরে বদ্ধমূল হয়।
(৯২৭) হজরত আনাস রাদি. থেকে বর্ণিত-
أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَأَى رَجُلًا يَسُوقُ بَدَنَةً ، فَقَالَ: ارْكَبُهَا. فَقَالَ: إِنَّهَا بَدَنَةٌ. فَقَالَ : ارْكَبُهَا. قَالَ: إِنَّهَا بَدَنَةٌ. قَالَ: ارْكَبُهَا، وَيْلَكَ.
অর্থ: নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার এক ব্যক্তিকে দেখলেন সে কুরবানির উট হাকিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এতে আরোহন কর। সে বলল, এটা তো কুরবানির উট। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার বললেন, তুমি আরোহন কর। সে আবারো বলল, এটা তো কুরবানির উট। তৃতীয়বার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধমকি দিয়ে বললেন, তোমার ধ্বংস হোক, তুমি এতে আরোহন কর。
টিকাঃ
১৩২৫. হজ্জ: ৩০।
১৩২৬. ইসরা: ৩৬
১৩২৭. সহিহ বুখারি: ২৬৫৪, সহিহ মুসলিম: ৮৭।
১৩২৮. বাকারা: ২৬৪।
১৩২৯. সহিহ মুসলিম: ১০৬, সুনানে নাসাঈ ৫/৮৬, মু. আহমাদ ২/৪৮০।
১৩৩০. সহিহ বুখারি: ৬১০৫, সহিহ মুসলিম: ১১০, সুনানে আবু দাউদ: ৩২৫৭, সুনানে তিরমিজি: ২৬৩৮, সুনানে নাসাঈ ৭/৫।
১৩৩১. সহিহ মুসলিম: ২৫৯৭, সুনানে আবু দাউদ: ৪৯০৭, মু. আহমাদ ৬/৪৪৮।
১৩৩২. সহিহ মুসলিম: ২৫৯৮, সুনানে আবু দাউদ: ৪৯০৭, মু. আহমাদ ৬/৪৪৮।
১৩৩৩. সুনানে আবু দাউদ: ৪৯০৬, সুনানে তিরমিজি: ১৯৭৭, মু. আহমাদ ৫/১৫।
১৩৩৪. সুনানে তিরমিজি: ১৯৭৮, মু. আহমাদ ১/৪০৫, ইবনে হিব্বান: ৪৮, আদাব: ৩১২, মু. হাকেম ১/১২।
১৩৩৫. সুনানে আবু দাউদ: ৪৯০৫, মু. আহমাদ ১/৪৪৮।
১৩৩৬. সুনানে আবু দাউদ: ৪৯০৮, সুনানে তিরমিজি: ১৯৭৯, ইবনে হিব্বান: ১৯৮৮।
১৩৩৭. সহিহ মুসলিম: ২৫৯৫, আবু দাউদ: ২৫৬১, মু. আহমাদ ৪/৪২৯, সুনানে দারিমি: ২৬৮০।
১৩৩৮. সহিহ বুখারি: ৫৯৩৭, সহিহ মুসলিম: ২১২৪।
১৩৩৯. সহিহ মুসলিম: ১৫৯৭, সুনানে আবু দাউদ: ৩৩৩৩, সুনানে ইবনে মাজাহ: ২২৭৭।
১৩৪০. সহিহ বুখারি: ৫৩৪৭।
১৩৪১. সহিহ মুসলিম: ১৭৭৮।
১৩৪২. সহিহ বুখারি: ৬৬৮৩, সহিহ মুসলিম: ১৬৮৭।
১৩৪৩. সহিহ মুসলিম: ১৯৭৮, সহিহ ইবনে হিব্বান: ৬৬০৪।
১৩৪৪. সহিহ বুখারি: ১৭৮০, সহিহ মুসলিম: ১৩৬৬।
১৩৪৫. সহিহ মুসলিম: ৬৭৫।
১৩৪৬. সহিহ বুখারি: ৩৪৬০, সহিহ মুসলিম: ১৫৮২।
১৩৪৭. সহিহ বুখারি: ১৩৩০, সহিহ মুসলিম: ৫২৯।
১৩৪৮. সহিহ মুসলিম: ২১১৭।
১৩৪৯. সহিহ বুখারি: ৫৫১৫, সহিহ মুসলিম: ১৯৭৮, মুসনাদে আহমাদ ২/৮২।
১৩৫০. অভিসম্পাতের সম্বন্ধ মানুষের দিকে হলে বদদুআ অভিষ্ট। আল্লাহর দিকে হলে রহমত (জান্নাত) থেকে বিতাড়ন করা অভিষ্ট। -উ.
১৩৫১. ইহয়াউ উলুমিদ্দিন ৩/১২৩-১২৬।
১৩৫২. সহিহ বুখারি: ৬১৫৯, সহিহ মুসলিম: ১৩২৩, সুনানে তিরমিজি: ৯১১, সুনানে নাসাঈ ৫/১৭৬, সুনানে ইবনে মাজাহঃ ৩১০৪।
মিথ্যা সাক্ষ্যপ্রদান অত্যন্ত হারাম কাজ
আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَاجْتَنِبُوا قَوْلَ الزُّوْرِ.
অর্থ: তোমরা মিথ্যা সাক্ষ্যপ্রদান থেকে বিরত থাক。
আরো বলেন-
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا.
অর্থ: যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার পিছনে তুমি পড় না। নিশ্চয় কান, চোখ এবং অন্তর সবগুলো (নিজ কৃতকর্ম সম্পর্কে) জিজ্ঞাসিত হবে。
(৯১৪) হজরত আবু বাকরা নুফাই বিন হারিস রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনবার এ কথাটি বলেছেন-
أَلَا أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ ، قَالُوا : بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ، قَالَ: الْإِشْرَاكُ بِاللَّهِ، ، وَعُقُوْقُ الْوَالِدَيْنِ وَجَلَسَ وَكَانَ مُتَّكِنًا فَقَالَ: أَلَا وَقَوْلُ الزُّوْرِ. قَالَ : فَمَا زَالَ يُكَرِّرُهَا حَتَّى قُلْنَا: لَيْتَهُ سَكَتَ.
অর্থ: আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় গুনাহ সম্বন্ধে অবহিত করব না? আমরা বললাম, অবশ্যই ইয়া রাসুলুল্লাহ! বললেন, আল্লাহর সাথে শরিক করা এবং মা-বাবার অবাধ্যতা করা। তিনি হেলান দিয়ে বসে ছিলেন, উঠে বললেন, সাবধান! মিথ্যা কথা ও মিথ্যা সাক্ষ্যপ্রদান থেকে বেঁচে থাকবে। এ কথা এতবার বলছিলেন যে, এক পর্যায়ে আমরা মনে মনে বলেছিলাম, তিনি চুপ করেন না কেন?
ইমাম নববি রহ. বলেন, এ অধ্যায়ে অনেক হাদিস আছে, যা উল্লেখ করেছি তাই যথেষ্ট। এ ব্যাপারে উম্মাহর ঐক্য সংঘটিত হয়েছে।
দান বা অনুগ্রহ করে খোটা দেয়া নিষেধ
আল্লাহ তাআলা বলেন-
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُبْطِلُوا صَدَقْتِكُمْ بِالْمَنِ وَالْأَذَى كَالَّذِي يُنْفِقُ مَالَهُ رِئَاءَ النَّاسِ.
অর্থ: হে ঈমানদারগণ! অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান-খয়রাতকে বরবাদ কর না। - মুফাসসিরিনে কেরাম বলেন, অর্থাৎ এর সওয়াব বিনষ্ট কর না।
(৯১৫) হজরত আবু জর রাদি. থেকে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
ثَلَاثَةٌ لَا يُكَلِّمُهُمُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ، وَلَا يُزَكِّيهِمْ، وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ. قَالَ : فَقَرَأَهَا رَسُولُ اللهِ، صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثَلَاثَ مِرَارًا. قَالَ أَبُو ذَرٍّ: خَابُوا وَخَسِرُوا مَنْ هُمْ يَا رَسُوْلَ اللهِ ؟ قَالَ: الْمُسْبِلُ ، وَالْمَنَّانُ، وَالْمُنَفِّقُ سِلْعَتَهُ بِالْحَلِفِ الْكَاذِبِ.
অর্থ: আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তিন শ্রেণীর লোকের সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না এবং তাকে পবিত্রও করবেন না। বরং তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। বর্ণনাকারী বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা তিনবার বলেছেন। আবু জর রাদি. বললেন, তাহলে তো তারা ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যর্থ; কিন্তু তারা কারা ইয়া রাসুলুল্লাহ! রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে লোক পায়ের গোছার নিচে ঝুলিয়ে কাপড় পরিধান করে। যে ব্যক্তি দান করে খোটা দেয়। যে মিথ্যা শপথ দ্বারা পণ্য বিক্রয় করে。
অভিসম্পাত করা নিষেধ
(৯১৬) হজরত সাবেত বিন দাহহাক রাদি. (তিনি বায়আতে রিদওয়ানের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَعْنُ الْمُؤْمِنِ كَقَتْلِهِ.
অর্থ: মুমিনকে অভিসম্পাত করা তাকে হত্যার সমতুল্য。
(৯১৭) হজরত আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَا يَنْبَغِي لِصِدِّيْقٍ أَنْ يَكُوْنَ لَعَانًا.
অর্থ: সিদ্দিকের পক্ষে কাউকে লানত করা উচিত না。
(৯১৮) হজরত আবু দারদা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَا يَكُونُ اللَّعَانُونَ شُفَعَاءَ وَلَا شُهَدَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.
অর্থ: অভিসম্পাতকারীরা কেয়ামতের দিন কোনো সুপারিশকারী বা সাক্ষী হবে না。
(৯১৯) হজরত সামুরা বিন জুনদুব রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَا تَلَاعَنُوْا بِلَعْنَةِ اللهِ، ، وَلَا بِغَضَبِهِ، وَلَا بِالنَّارِ.
অর্থ: তোমরা একে অপরের জন্য আল্লাহর লানত, ক্রোধ এবং জাহান্নামের বদদুআ কর না। -তিরমিজি রহ. বলেন, হাদিসটি হাসান সহিহ。
(৯২০) হজরত ইবনে মাসউদ রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَيْسَ الْمُؤْمِنُ بِالطَّعَانِ، وَلَا اللَّعَانِ، وَلَا الْفَاحِشِ، وَلَا الْبَدِيءِ.
অর্থ: মুমিন কখনো দোষারোপকারী ও নিন্দাকারী হতে পারে না। অভিসম্পাতকারী হতে পারে না। অশ্লীল কাজ করতে পারে না। কটুভাষীও হতে পারে না। -তিরমিজি রহ. বলেন, হাদিসটি হাসান。
(৯২১) হজরত আবু দারদা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا لَعَنَ شَيْئًا صَعِدَتِ اللَّعْنَةُ إِلَى السَّمَاءِ فَتُغْلَقُ أَبْوَابُ السَّمَاءِ دُونَهَا، ثُمَّ تَهْبِطُ إِلَى الْأَرْضِ فَتُغْلَقُ أَبْوَابُهَا دُوْنَهَا، ثُمَّ تَأْخُذُ يَمِينًا وَشِمَالًا، فَإِذَا لَمْ تَجِدْ مَسَانًا رَجَعَتْ إِلَى الَّذِي لُعِنَ، فَإِنْ كَانَ لِذَلِكَ أَهْلًا وَإِلَّا رَجَعَتْ إِلَى قَائِلِهَا.
অর্থ: বান্দা যখন কোনো বস্তুকে অভিশাপ দেয়, তখন ঐ অভিশাপ আকাশের দিকে অগ্রসর হয়। অতঃপর সেই অভিশাপের আকাশে ওঠার পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর ঐ অভিশাপ দুনিয়ার দিকে অগ্রসর হয়, তখন ঐ অভিশাপের দুনিয়াতে ফেরার পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর সেটা ডানে-বামে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অবশেষে অন্য কোনো পথ না পেয়ে যাকে অভিশাপ দেয়া হয়েছে তার দিকেই ফিরে আসে। যদি সে তার যোগ্য হয় তো তার উপর পতিত হয়, অন্যথায় অভিশাপকারীর দিকেই ফিরে আসে。
(৯২২) হজরত ইবনে আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ لَعَنَ شَيْئًا لَيْسَ لَهُ بِأَهْلِ رَجَعَتِ اللَّعْنَةُ عَلَيْهِ.
অর্থ: যে ব্যক্তি এমন কোনো বস্তুকে অভিসম্পাত করল যা এর যোগ্য নয়, ঐ অভিশাপ তার দিকেই ফিরে আসে。
(৯২৩) হজরত ইমরান বিন হুসাইন থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
بَيْنَمَا رَسُوْلُ اللهِ، صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي بَعْضِ أَسْفَارِهِ، وَامْرَأَةٌ مِنَ الْأَنْصَارِ عَلَى نَاقَةٍ، فَضَجِرَتْ، فَلَعَنَتْهَا، فَسَمِعَ ذَلِكَ رَسُوْلُ اللَّهِ، صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: خُذُوا مَا عَلَيْهَا وَدَعُوهَا؛ فَإِنَّهَا مَلْعُونَةٌ. قَالَ عِمْرَانُ: فَكَأَنِّي أَرَاهَا الْآنَ تَمْشِي فِي النَّاسِ مَا يَعْرِضُ لَهَا أَحَدٌ.
অর্থ: একবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সফরে ছিলেন, সে সময় এক আনসারি মহিলা উষ্ট্রীর পিঠে আরোহী ছিলেন। তিনি তার আচরণে বিরক্ত হয়ে তাকে অভিসম্পাত করলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটা শুনে বললেন, এর উপর যা আছে তা নিয়ে নাও এবং একে ছেড়ে দাও। কারণ, এটা তো অভিশপ্ত হয়ে গেছে। ইমরান বলেন, আমি যেন সেই উষ্ট্রীকে এখনো দেখতে পাচ্ছি যে, মানুষের মাঝে ঘুরছে, কিন্তু কেউ তার দিকে ভ্রুক্ষেপও করছে না。
ফায়দা: হজরত ইমরানের বাবা হুসাইনের ইসলাম গ্রহণ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্য নিয়ে উলামায়ে কেরামের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। সহিহ মত হল, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যও পেয়েছেন। তাই আমি রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছি।
(৯২৪) হজরত আবু বারজা রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
بَيْنَمَا جَارِيَةٌ عَلَى نَاقَةٍ عَلَيْهَا بَعْضُ مَتَاعِ الْقَوْمِ إِذْ بَصُرَتْ بِالنَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَتَضَايَقَ بِهِمُ الْجَبَلُ ، فَقَالَتْ: حَلِ ، اللَّهُمَّ الْعَنْهَا. قَالَ : فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا تُصَاحِبْنَا نَاقَةُ عَلَيْهَا لَعْنَةٌ. وَفِي رِوَايَةٍ: لَا تُصَاحِبْنَا رَاحِلَةُ عَلَيْهَا لَعْنَةُ مِنَ اللهِ .
অর্থ: একবার এক মেয়ে উষ্ট্রীর উপর আরোহী ছিল। উষ্ট্রীর উপর তার সম্প্রদায়ের কিছু মাল-সামানাও ছিল। হঠাৎ সে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে পেল, আর পাহাড়ের কারণে রাস্তা সঙ্কীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তখন সে আরবিতে উট তাড়ানোর একটা শব্দ উচ্চারণ করল, পরে বলল, হে আল্লাহ! আপনি এর উপর লানত করুন। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা শুনে বললেন, আমাদের সাথে এমন উষ্ট্রী যেন না থাকে, যার উপর অভিশাপ রয়েছে। অন্য এক বর্ণনায় আছে, আমাদের সাথে এমন বাহন থাকবে না যার উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে অভিশাপ রয়েছে।
অনির্দিষ্ট ও অপ্রসিদ্ধ পাপীষ্ঠকে লানত করা বৈধ
একাধিক সহিহ প্রসিদ্ধ হাদিসে প্রমাণিত যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَعَنَ اللهُ الْوَاصِلَةَ وَالْمُسْتَوْصِلَةَ.
অর্থ: আল্লাহ ঐ সব নারীদের উপর লানত করুক, যারা নিজেরা পরচুলা লাগায় এবং অন্যকে লাগিয়ে দেয়...।
আরো বলেছেন-
لَعَنَ اللهُ آكِلَ الرِّبَا.
অর্থ: আল্লাহ পাক সুদখোরের ওপর লানত করুক...।
আরো বলেছেন-
لَعَنَ اللهُ المُصَوِّرِينَ.
অর্থ: আল্লাহ চিত্রাঙ্কনকারীদের (রহমত থেকে) বিতাড়িত করুক。
আরো বলেন-
لَعَنَ اللَّهُ مَنْ غَيَّرَ مَنَارَ الْأَرْضِ.
অর্থ: আল্লাহ পাক ঐ ব্যক্তিকে অভিশাপ দিক, যে অন্যায়ভাবে জমির (সীমানার) চিহ্ন পরিবর্তন করে。
আরো বলেছেন-
لَعَنَ اللهُ السَّارِقَ يَسْرِقُ البَيْضَةَ.
অর্থ: আল্লাহ এমন চোরের উপর লানত করুক, যে ডিম চুরি করে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
لَعَنَ اللهُ مَنْ لَعَنَ وَالِدَيْهِ، وَلَعَنَ اللَّهُ مَنْ ذَبَحَ لِغَيْرِ الله.
অর্থ: যে ব্যক্তি নিজের মা-বাবার ওপর অভিসম্পাত করে, আল্লাহ তার প্রতি অভিশম্পাত করুক। যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে যবেহ করে, তার ওপর আল্লাহ লানত করুক。
আরো বলেছেন-
مَنْ أَحْدَثَ فِينَا حَدَثاً، أَوْ آوَى مُحْدِثاً، فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ.
অর্থ: যে ব্যক্তি মদিনায় কোনো বিদআত সৃষ্টি করবে অথবা কোনো বিদআতিকে আশ্রয় দিবে, তার ওপর আল্লাহ, ফেরেশতা এবং সমগ্র মানবজাতির অভিশাপ。
তিনি আরো বলেন-
اللَّهُمَّ الْعَنْ رِعْلاً وَذَكْوَانَ وَعُصَيَّةً عَصَتِ اللَّهَ وَرَسُوْلَهُ.
অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি রিয়িল, জাকওয়ান ও উসাইয়াহ গোত্রগুলোর ওপর লানত করুন। তারা আল্লাহ ও রাসুলের অবাধ্যতা করেছে। এরা হল আরবের তিনটি গোত্র।
আরো বলেন-
لَعَنَ اللهُ الْيَهُودَ حُرِّمَتْ عَلَيْهِمُ الشُّحُوْمُ فَجَمَلُوْهَا فَبَاعُوْهَا.
অর্থ: আল্লাহ তাআলা ইহুদিদের ওপর লানত করুক: তাদের ওপর চর্বি হারাম করা হয়েছিল, কিন্তু তারা সেটা বিক্রি করা শুরু করেছিল。
তিনি আরো বলেছেন-
لَعَنَ اللهُ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ.
অর্থ: আল্লাহ পাক ইহুদি-খ্রীস্টানের ওপর অভিসম্পাত করুক। কারণ, তারা নিজেদের নবিদের কবরকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে。
তিনি আরো বলেছেন-
لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمُتَشَبِّهِينَ مِنَ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ، وَالْمُتَشَبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ.
অর্থ: পুরুষদের মধ্য থেকে মহিলাদের সাদৃশ্য গ্রহণকারী ও মহিলাদের মধ্য থেকে পুরুষদের সাদৃশ্য গ্রহণকারিণীদের ওপর লানত।
এ সমস্ত হাদিসের কিছু تو সহিহ বুখারি ও মুসলিমের উভয়টাতে আছে, কিছু যে কোনো একটিতে। সংক্ষিপ্ততার স্বার্থে সবগুলো সনদসহ উল্লেখ না করে শুধু ইঙ্গিত দিলাম।
(৯২৫) হজরত জাবের রাদি. থেকে বর্ণিত-
أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّ عَلَيْهِ حِمَارُ قَدْ وُسِمَ فِي وَجْهِهِ، فَقَالَ: لَعَنَ اللهُ الَّذِي وَسَمَهُ.
অর্থ: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখলেন এক গাধাকে তার চেহারায় দাগ দেয়া হয়েছে। বললেন, আল্লাহ তাআলা ঐ ব্যক্তির ওপর লানত করুক যে এর চেহারায় দাগ দিয়েছে。
(৯২৬) সহিহ বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত আছে-
أَنَّ ابْنَ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا مَرَّ بِفِتْيَانٍ مِنْ قُرَيْشٍ قَدْ نَصَبُوْا طَيْرًا وَهُمْ يَرْمُوْنَهُ، فَقَالَ ابْنُ عُمَرَ: لَعَنَ اللهُ مَنْ فَعَلَ هَذَا؛ إِنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَعَنَ مَنِ اتَّخَذَ شَيْئًا فِيْهِ الرُّوْحُ غَرَضًا.
অর্থ: হজরত ইবনে উমর রাদি. কিছু কুরাইশি যুবকদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যারা একটি পাখিকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে তীরন্দাজি করছিল। তিনি বললেন, যে এ কাজ করে তার ওপর আল্লাহর অভিশাপ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ঐ ব্যক্তির ওপর আল্লাহ তাআলার অভিশাপ, যে কোনো প্রাণীকে তীরন্দাজির লক্ষ্যবস্তু বানায়。
বৈধ-অবৈধ অভিশাপ
গুনাহ থেকে পবিত্র মুসলিমকে অভিশাপ দেয়া মুসলিমদের ঐক্যমতে হারাম। খারাপ গুণাবলী সম্পন্ন ব্যক্তিদের লানত করা বৈধ আছে। যেমন এভাবে বলা- আল্লাহ পাক অত্যাচারীদের ওপর লানত বর্ষণ করুক, কাফেরদের ওপর আল্লাহর লানত বর্ষণ হোক, ইহুদি-খ্রীস্টানের ওপর আল্লাহর লানত, ফাসেকদের ওপর আল্লাহ লানত বর্ষণ করুক। ছবি অঙ্কনকারীদের ওপর আল্লাহর লানত বর্ষণ হোক। এ ধরনের অন্যান্য শব্দ বলা, যা পূর্বের পরিচ্ছেদে অতীত হয়েছে।
কোনো গুনাহে লিপ্ত নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে লানত করাও হাদিসের বাহ্যিক অর্থ অনুযায়ী হারাম নয়। যেমন এভাবে বলা- ইহুদি, খ্রীস্টান অথবা ঐ অত্যাচারী, ব্যভিচারী, ছবি অঙ্কনকারী, চোর কিংবা সুদখোরের ওপর আল্লাহ লানত বর্ষণ করুক। কিন্তু ইমাম গাজালি রহ. এও হারাম হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তবে যাদের ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত জানি যে, তারা কুফরের ওপর মারা গেছে। যেমন- আবু লাহাব, আবু জাহেল, ফেরাউন, হামান। এ জাতীয় লোকদের ওপর অভিশাপ দেয়া যাবে। ইমাম গাজালি নির্দিষ্ট গুনাহগারকে লানত করাকে বৈধ বলেন না এ জন্য যে, লানত হল আল্লাহর রহমত থেকে বিতাড়ন করা। অথচ এই কাফের বা ফাসেকের শেষ পরিণতি কী হবে তা আমরা জানি না। আরো বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদের নির্দিষ্ট নাম নিয়ে লানত করেছেন, সেটা জায়েজ ছিল। কারণ, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের মৃত্যু কুফরের ওপর হবে বলে জানতেন। তিনি আরো বলেন, মানুষের প্রতি বদদুআ করা এমনকি জালেমের জন্যও বদদুআ করা লানতের কাছাকাছি। যেমন- কোনো ব্যক্তি দুআ করল, আল্লাহ তার শরীর সুস্থ না করুক, তাকে নিরাপত্তা না দিক। অথবা এ জাতীয় কিছু। এ সবই নিন্দনীয়। এমনিভাবে সকল প্রাণী ও জড় পদার্থকে লানত করাও নিন্দনীয়。
অনুপযুক্ত ব্যক্তিকে অভিসম্পাত করলে প্রতিকার কীভাবে
জনৈক আলেম থেকে আবু জাফর বর্ণনা করেন- যখন কেউ এমন কোনো বস্তুকে লানত করে ফেলে যে এর উপযুক্ত নয়, সে যেন তাড়াতাড়ি এ কথা বলে, তবে সে যদি উপযুক্ত না হয় (তাহলে তার ওপর লানত নয়)
সৎকাজের আদেশ প্রদান ও অসৎকাজে নিষেধ করার সময় যা বলা যাবে
সৎকাজের আদেশকারী ও অসৎকাজ থেকে নিষেধকারী এবং প্রত্যেক শিষ্টাচার শিক্ষাদানকারীর জন্য জায়েজ আছে যে, সে আদেশ-নিষেধ করতে গিয়ে তার সম্বোধিত ব্যক্তিকে বলতে পারবে- তোমার ধ্বংস হোক বা হে দুর্বল অবস্থার অধিকারী অথবা হে বেপরোয়া! কিংবা হে নিজের ওপর জুলুমকারী ইত্যাদি। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন তার কথাটা মিথ্যা না হয় এবং তাতে স্পষ্ট বা ইশারা ইঙ্গিতে কোনো অপবাদের শব্দ না থাকে, যদিও সেক্ষেত্রে সত্যবাদীই হয়। পূর্বোক্ত বিষয়গুলো জায়েজ হয়েছে কেবল আদব শিক্ষাদান বা ধমকিপ্রদানের উদ্দেশ্যে, যাতে কথাটা অন্তরে বদ্ধমূল হয়।
(৯২৭) হজরত আনাস রাদি. থেকে বর্ণিত-
أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَأَى رَجُلًا يَسُوقُ بَدَنَةً ، فَقَالَ: ارْكَبُهَا. فَقَالَ: إِنَّهَا بَدَنَةٌ. فَقَالَ : ارْكَبُهَا. قَالَ: إِنَّهَا بَدَنَةٌ. قَالَ: ارْكَبُهَا، وَيْلَكَ.
অর্থ: নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার এক ব্যক্তিকে দেখলেন সে কুরবানির উট হাকিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এতে আরোহন কর। সে বলল, এটা তো কুরবানির উট। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার বললেন, তুমি আরোহন কর। সে আবারো বলল, এটা তো কুরবানির উট। তৃতীয়বার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধমকি দিয়ে বললেন, তোমার ধ্বংস হোক, তুমি এতে আরোহন কর。
টিকাঃ
১৩২৫. হজ্জ: ৩০।
১৩২৬. ইসরা: ৩৬
১৩২৭. সহিহ বুখারি: ২৬৫৪, সহিহ মুসলিম: ৮৭।
১৩২৮. বাকারা: ২৬৪।
১৩২৯. সহিহ মুসলিম: ১০৬, সুনানে নাসাঈ ৫/৮৬, মু. আহমাদ ২/৪৮০।
১৩৩০. সহিহ বুখারি: ৬১০৫, সহিহ মুসলিম: ১১০, সুনানে আবু দাউদ: ৩২৫৭, সুনানে তিরমিজি: ২৬৩৮, সুনানে নাসাঈ ৭/৫।
১৩৩১. সহিহ মুসলিম: ২৫৯৭, সুনানে আবু দাউদ: ৪৯০৭, মু. আহমাদ ৬/৪৪৮।
১৩৩২. সহিহ মুসলিম: ২৫৯৮, সুনানে আবু দাউদ: ৪৯০৭, মু. আহমাদ ৬/৪৪৮।
১৩৩৩. সুনানে আবু দাউদ: ৪৯০৬, সুনানে তিরমিজি: ১৯৭৭, মু. আহমাদ ৫/১৫।
১৩৩৪. সুনানে তিরমিজি: ১৯৭৮, মু. আহমাদ ১/৪০৫, ইবনে হিব্বান: ৪৮, আদাব: ৩১২, মু. হাকেম ১/১২।
১৩৩৫. সুনানে আবু দাউদ: ৪৯০৫, মু. আহমাদ ১/৪৪৮।
১৩৩৬. সুনানে আবু দাউদ: ৪৯০৮, সুনানে তিরমিজি: ১৯৭৯, ইবনে হিব্বান: ১৯৮৮।
১৩৩৭. সহিহ মুসলিম: ২৫৯৫, আবু দাউদ: ২৫৬১, মু. আহমাদ ৪/৪২৯, সুনানে দারিমি: ২৬৮০।
১৩৩৮. সহিহ বুখারি: ৫৯৩৭, সহিহ মুসলিম: ২১২৪।
১৩৩৯. সহিহ মুসলিম: ১৫৯৭, সুনানে আবু দাউদ: ৩৩৩৩, সুনানে ইবনে মাজাহ: ২২৭৭।
১৩৪০. সহিহ বুখারি: ৫৩৪৭।
১৩৪১. সহিহ মুসলিম: ১৭৭৮।
১৩৪২. সহিহ বুখারি: ৬৬৮৩, সহিহ মুসলিম: ১৬৮৭।
১৩৪৩. সহিহ মুসলিম: ১৯৭৮, সহিহ ইবনে হিব্বান: ৬৬০৪।
১৩৪৪. সহিহ বুখারি: ১৭৮০, সহিহ মুসলিম: ১৩৬৬।
১৩৪৫. সহিহ মুসলিম: ৬৭৫।
১৩৪৬. সহিহ বুখারি: ৩৪৬০, সহিহ মুসলিম: ১৫৮২।
১৩৪৭. সহিহ বুখারি: ১৩৩০, সহিহ মুসলিম: ৫২৯।
১৩৪৮. সহিহ মুসলিম: ২১১৭।
১৩৪৯. সহিহ বুখারি: ৫৫১৫, সহিহ মুসলিম: ১৯৭৮, মুসনাদে আহমাদ ২/৮২।
১৩৫০. অভিসম্পাতের সম্বন্ধ মানুষের দিকে হলে বদদুআ অভিষ্ট। আল্লাহর দিকে হলে রহমত (জান্নাত) থেকে বিতাড়ন করা অভিষ্ট। -উ.
১৩৫১. ইহয়াউ উলুমিদ্দিন ৩/১২৩-১২৬।
১৩৫২. সহিহ বুখারি: ৬১৫৯, সহিহ মুসলিম: ১৩২৩, সুনানে তিরমিজি: ৯১১, সুনানে নাসাঈ ৫/১৭৬, সুনানে ইবনে মাজাহঃ ৩১০৪।