📄 প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সব কাজে নিয়ত বিশুদ্ধ করা
পবিত্র কুরআন মাজিদে মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ
অর্থ: তাদের তো বিশুদ্ধচিত্তে একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর ইবাদত করতে আদেশ করা হয়েছিলো।
অন্য এক জায়গায় ইরশাদ করেন-
لَنْ يَنَالَ اللَّهَ لُحُوْمُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ
অর্থ: (কুরবানীর পশুর) রক্ত ও গোশত কোনটিই আল্লাহর কাছে পৌছে না। কেবল তোমাদের তাকওয়া (আল্লাহর কাছে) তাঁর কাছে পৌঁছে।
ইবনে আব্বাস রাদি. উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,
مَعْنَاهُ وَلَكِنْ يَنَالُهُ النَّيَّاتُ
অর্থাৎ (বিশুদ্ধ) নিয়তই তাঁর কাছে পৌঁছে।
এ সম্পর্কে সহিহ বুখারি ও মুসলিমে আমিরুল মুমিনিন উমর রাদি. থেকে বর্ণিত আছে-
قَالَ رَسُولُ اللهِ، صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ، وَرَسُولِهِ، فَهِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ، وَرَسُوْلِهِ، وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا أَوِ امْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا، فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ
অর্থ: রাসুল সাল্লাল্লাহু তাআলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সব কাজ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। প্রত্যেকেই তার নিয়ত অনুসারে প্রতিদান পেয়ে থাকে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে পাওয়ার আশায় হিজরত করবে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে পাওয়ার জন্যই হবে। আর যে দুনিয়া পাওয়ার আশায় কিংবা কোন মহিলাকে বিবাহ করার আশায় হিজরত করে, তার হিজরত সে জন্যই হবে, যে উদ্দেশে সে হিজরত করেছে।
এই হাদিসটি সহিহ, সবাই এ ব্যাপারে একমত। এর উঁচু মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে সবাই সম্মতি জ্ঞাপন করেন। যেসব হাদিসের ওপর ইসলামের ভিত্তি, সেগুলোর মধ্যে এ হাদিসটি অন্যতম। সালফে সালেহিন ও তাদের অনুসারীরা তাদের কিতাবকে এ হাদিসের মাধ্যমে সূচনা করতে পছন্দ করতেন। এই লক্ষ্যে যে, শুরুতেই যেন সবাই নিয়তের পরিশুদ্ধির বিষয়ে মনোযোগী ও যত্নশীল হয়।
ইমাম আবু সাঈদ আবদুর রহমান বিন মাহদি রহ. থেকে বর্ণিত: যে ব্যক্তি কোন কিতাব সঙ্কলন করতে চায়, তাঁর উচিত তিনি যেন এই হাদিস দ্বারা তা শুরু করেন।
ইমাম আবু সুলাইমান খাত্তাবি রহ. বলেন, আমাদের পূর্ববর্তী মাশায়েখরা প্রতিটি কাজ বিশেষ করে দ্বীনী বিষয়াদি শুরু করার আগে এই হাদিসকে বর্ণনা করা মুস্তাহাব মনে করতেন। কারণ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত যে, নিয়ত অনুসারে ব্যক্তির বিষয়কে সংরক্ষণ করা হয়।
কোন বিজ্ঞ ব্যক্তি বলেন, মানুষ তার নিয়ত অনুসারেই প্রতিদান পেয়ে থাকে।
ফুযাইল বিন ইয়ায রাদি. থেকে বর্ণিত- মানুষের কারণে আমল ছেড়ে দেয়া হল, রিয়া বা কপটতা। মানুষের জন্য আমল করা হচ্ছে শিরক। আর আল্লাহ তাআলা তোমাকে এদুটো থেকে রক্ষা করার নামই হল এখলাস।'
ইমাম হারিস মুহাসিবি রহ. বলেন, সাদিক বা সত্যবাদী বলা হয় তাকে, সৃষ্টিজগতের সবার মন থেকেও তার মর্যাদা বিলীন হয়ে যায় তারপরও সে আন্তরিক বিশুদ্ধতার জন্য এর কোনই পরোয়া করে না। আর মানুষ তার নেকআমল সম্পর্কে বিন্দু পরিমাণ জানুক, এটা সে পছন্দ করে না। আর মানুষ তার বদ আমল জানাকেও সে অপছন্দ করে না।'
হুজায়ফা মারআশি রহ. থেকে বর্ণিত যে, ইখলাস হল, বান্দার কাছে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সবধরনের কাজ সমান হয়ে যাওয়া।"
উস্তায ইমাম আবুল কাসিম কুশাইরি রহ. বলেন-
ইখলাস হল, স্বেচ্ছায় কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য ইবাদত করা, অর্থাৎ বান্দার ইবাদতের একমাত্র উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা। এছাড়া পার্থিব অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারবে না। যেমন- সৃষ্টিকে খুশি করা, মানুষের প্রশংসা অর্জন করা, মানুষের ভালোবাসা লাভ করা, অথবা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্য করা।
সাহল বিন আবদুল্লাহ তুসতারি রহ. বলেন-
জ্ঞানী ব্যক্তিরা ইখলাসের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, বান্দার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য প্রতিটি উঠাবসা একমাত্র আল্লাহর জন্য হওয়া। নিজের আত্মা, কুপ্রবৃত্তি ও দুনিয়া হাসিলের কোন সংমিশ্রণ না থাকা।১০
উস্তায আবু আলি দাক্কাক রহ. থেকে বর্ণিত-
ইখলাস হল, সৃষ্টিকে লক্ষ করে চলা হতে বেঁচে থাকা। আর 'সিদক' বলা হয়, নিজের ভালো কাজ দেখা হতে নিজেকে দূরে রাখা। (কেননা নিজের ভালো কাজ দেখলে এটাকে নিজের কৃতিত্ব মনে করবে। এটা আত্মগর্ব ও অহঙ্কার সৃষ্টি করবে।) অতএব, কপটতা মুক্ত ব্যক্তিই হলেন প্রকৃত মুখলিস। আর যার কোন আত্মগর্ব নেই, তিনিই হলেন সাদিক তথা সত্যবাদী।
যুন্নুন মিশরি রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইখলাসের তিনটি নিদর্শন-
১. সাধারণ মানুষের প্রশংসা ও নিন্দা সমান হয়ে যাওয়া।
২. নেককাজ করার সময় নিজের এই নেককাজ দেখতে ভুলে যাওয়া। (যেমন, কোন নেককাজ করার সময় এটা না ভাবা যে আমি খুব ভালো করছি।) আর
৩. কেয়ামতে নেককাজের সওয়াব তথা প্রতিদানের দাবিদার না হওয়া।
ইমাম কুশাইরি রহ. বলেন- সিদকের সর্বনিম্ন স্তর হল, ব্যক্তির প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অর্থাৎ সর্বাবস্থা সমান হয়ে যাওয়া।
সাহাল আত-তাসতুরী রহ. বলেন- যে নিজেকে বা অন্যকে তোষামোদ করে চলে, সে কখনও সত্যবাদিতার ঘ্রাণ পায় না।
টিকাঃ
৪. সুরা বাইয়িনাহ: আয়াত: ০৫।
৫. সুরা হজ্জ: আয়াত: ৩৭।
৬. সহিহ বুখারি: ১৯০৭, সুনানে আবু দাউদ: ২২০১, সুনানে তিরমিজি: ১৬৪৭।
৭. আর-রিসালাতুল কুশাইরিয়া: ১৬৩।
৮. আর-রিসালাতুল কুশাইরিয়া: ১৬৩।
৯. শুআবুল ঈমান লিল-বায়হাকি: ৬৮৭৮।
১০. আর-রিসালাতুল কুশাইরিয়া: ১৬২।
📄 ফযিলতের আমল একবার হলেও করা উচিত
কোন আমলের ফাযায়েল সম্পর্কে জানলে উচিত হল, সেটি আমল করা; যদি জীবনে অন্তত একবারও হয়। যাতে সে এর আমলকারীদের দলভুক্ত হয়ে যায়। সেটি একেবারেই আমল না করা সমীচীন নয়, বরং যথাসম্ভব সেটি আমল করা। হাদিস শরিফে ইরশাদ হচ্ছে-
إِذَا أَمَرْتُكُمْ بِأَمْرٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ.
অর্থ: যখন আমি তোমাদের কোন বিষয়ের আদেশ দেই, তখন তোমরা তা সাধ্যানুযায়ী পালন করো।১১
টিকাঃ
১১. সহিহ বুখারি: ৭২৮৮, সহিহ মুসলিম: ১৩৩৭, সুনানে তিরমিজি: ২৬৮১, সুনানে নাসাঈ ৫/১১০, সুনানে ইবনে মাজাহঃ ২।
📄 ফযিলত বিষয়ক দুর্বল হাদিসের ওপর আমল করা
উলামা, ফুকাহা ও মুহাদ্দিসিনে কেরামের মতে ফাযায়েল ও উৎসাহমূলক বিষয়ে দুর্বল হাদিসের ওপর আমল করা জায়েয আছে। এমনকি, আমল করাই উত্তম। যতক্ষণ না ঐ হাদিস মাওজু (জাল) পর্যায়ের না হবে। পক্ষান্তরে আহকামের ক্ষেত্রে যেমন- হালাল, হারাম, ক্রয়-বিক্রয়, বিবাহ-শাদি, তালাক ইত্যাদি বিষয়ে কেবল সহিহ বা হাসান হাদিসের ওপরই আমল করতে হবে। তবে হ্যাঁ, যদি কোন সতর্কতামূলক বিষয় হয়, যেমন- বিবাহ-শাদী বা বেচাকেনা সংক্রান্ত কোন বিষয়ের অপছন্দনীয়তার ক্ষেত্রে দুর্বল হাদিস আসে, তাহলে মুস্তাহাব হল তা থেকে বেঁচে থাকা চাই। তবে এটা ওয়াজিব নয়। বিষয়টি এ কিতাবে এজন্য বর্ণনা করেছি যে, এই কিতাবে সহিহ, হাসান ও যাঈফ (দুর্বল) হাদিসও বর্ণিত হয়েছে। যাতে পাঠকবৃন্দ এ বিষয়ে শুরুতেই অবগত হতে পারেন।
📄 জিকিরের মজলিসে বসা মুস্তাহাব
জিকির করা যেমন মুস্তাহাব, তেমনিভাবে জিকিরের মজলিসে বসাও মুস্তাহাব। এ ব্যাপারে দলিল-প্রমাণ সুস্পষ্ট। এগুলো যথাস্থানে আলোচনা করা হবে। এ ব্যাপারে আবদুল্লাহ বিন উমর রাদি. থেকে বর্ণিত হাদিসই যথেষ্ট। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
إِذَا مَرَرْتُمْ بِرِيَاضِ الْجَنَّةِ فَارْتَعُوْا قَالُوا : يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَا رِيَاضُ الْجَنَّةِ؟ قَالَ: حِلَقُ الذِّكْرِ قَالَ: إِنَّ لِلَّهِ سَيَّارَةً مِنَ الْمَلَائِكَةِ يَطْلُبُوْنَ حِلَقَ الذِّكْرِ فَإِذَا أَتَوْا عَلَيْهِمْ حَفُوْا بِهِمْ.
অর্থ: যখন তোমরা জান্নাতের বাগানের কাছ দিয়ে যাবে, তখন তোমরা বাগানের ফল খাবে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ, জান্নাতের বাগান কী? তিনি বললেন, জিকিরের মজলিস।
আল্লাহর পক্ষ থেকে এক দল ফেরেশতা জমিনে বিচরণ করে জিকিরের মজলিস খুঁজতে থাকে। ফেরেশতারা যখন জিকিরকারীদের কাছে আসেন তখন তাদেরকে বেষ্টন করে রাখেন।১২
মুআবিয়া রাদি. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন-
إِنَّ رَسُوْلَ اللهِ، صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَرَجَ عَلَى حَلْقَةٍ مِنْ أَصْحَابِهِ، فَقَالَ: مَا أَجْلَسَكُمْ ؟ قَالُوا : جَلَسْنَا نَذْكُرُ اللهَ وَنَحْمَدُهُ عَلَى مَا هَدَانَا لِلْإِسْلَامِ، وَمَنَّ بِهِ عَلَيْنَا. قَالَ : اللَّهِ، مَا أَجْلَسَكُمْ إِلَّا ذَاكَ ؟ قَالُوا : وَاللَّهِ، مَا أَجْلَسَنَا إِلَّا ذَاكَ. قَالَ : أَمَا إِنِّي لَمْ أَسْتَحْلِفْكُمْ تُهْمَةً لَكُمْ، وَلَكِنَّهُ أَتَانِي جِبْرِيلُ فَأَخْبَرَنِي أَنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يُبَاهِيْ بِكُمُ الْمَلَائِكَةَ.
অর্থ: একবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবিদের একটি মজলিসে গমন করে বললেন, তোমরা এখানে কেন বসেছো? তাঁরা বললেন, আমরা বসেছি আল্লাহর জিকির এবং তাঁর প্রশংসা করতে। কারণ, তিনি আমাদের ইসলামের পথে এনেছেন; ইসলামের মাধ্যমে আমাদের প্রতি বড় অনুগ্রহ করেছেন। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, তোমরা কি শুধু এ উদ্দেশ্যেই বসেছো? তাঁরা উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, আল্লাহর কসম, আমরা কেবল এ উদ্দেশ্যেই বসেছি।
তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে দোষী ভেবে শপথ দিয়ে জিজ্ঞাসা করিনি (বরং তোমাদেরকে এক মহা সুসংবাদ কোনানোর জন্য কসম করে বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করেছি।) মাত্র জিবরিল আমার কাছে এসে জানিয়েছেন যে, তোমাদের নিয়ে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের সাথে গর্ব করছেন। ১৩
মুসলিম শরিফে আবু সাঈদ খুদরি এবং আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, তারা উভয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত ছিলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
لَا يَقْعُدُ قَوْمٌ يَذْكُرُونَ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ إِلَّا حَقَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ، وَنَزَلَتْ عَلَيْهِمِ السَّكِينَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ فِيْمَنْ عِنْدَهُ.
অর্থ: যারা বসে বসে আল্লাহর জিকির করে, ফেরেশতারা তাদের বেষ্টন করে নেয়। আল্লাহর রহমত তাদের ঢেকে নেয়। তাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হয়। আল্লাহ তাআলা তাঁর কাছের ফেরেশতাদের সঙ্গে জিকিরকারীদের বিষয়ে আলোচনা করেন। ১৪
টিকাঃ
১২. হিলইয়াতুল আউলিয়া: ৬/৩৫৪, আবু নুআইম আসফাহানি।
১৩. সহিহ মুসলিম: ২৭০১, সুনানে তিরমিজি: ৩৩৭৬, সুনানে নাসাঈ ৮/২৪৯।
১৪. সহিহ মুসলিম: ২৭০০, সুনানে তিরমিজি: ৩৫৮৭।