📄 লেখকের ভূমিকা
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ তাআলার। যিনি একক, পরাক্রমশালী; ক্ষমাশীল, প্রতাপশালী; সবকিছুর পরিকল্পনাকারী ও ব্যবস্থাপক। তিনি দিনের ওপর রাতকে আবর্তিত করেন চক্ষুষ্মান ও বুদ্ধিমানদের শিক্ষাগ্রহণের জন্য।
সৃষ্টিজগতের মাঝে যাকে মনোনীত করেন, তাকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করেন। বান্দাদের মাঝে যাকে নির্বাচন করেন, তাকে নেককারদের দলভুক্ত করেন। তিনি যাকে ভালোবাসেন তাকে দুনিয়া থেকে নিরাসক্ত রাখেন। ফলে তারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভে সর্ব শক্তি ব্যয় করতে সক্ষম হয়। পরকালের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে। আল্লাহর অসন্তুষ্টির বিষয়াশয় থেকে দূরে থাকে; জাহান্নামের শাস্তি থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখে। আল্লাহর আনুগত্যে মনেপ্রাণে চেষ্টা করে। সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর স্মরণে নিয়োজিত থাকে। সর্বাবস্থায় অর্থাৎ রাতদিনের প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর যিকিরে লিপ্ত থাকে। ফলে নুরের রোশনীতে তাদের হৃদয় আলোকিত হয়।
আমি সেই মহান প্রভুর শোকর আদায় করছি; আমি প্রশংসা করছি তাঁর সকল নেয়ামতের। আমি তাঁর কাছে আরো দয়া ও অনুগ্রহ কামনা করছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মহান আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই। তিনি একক, অমুখাপেক্ষী, পরাক্রমশালী ও বিজ্ঞ।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। আল্লাহর প্রিয় হাবিব ও বন্ধু। সৃষ্টিজগতের মাঝে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত। আগে-পরের সকল মাখলুকের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তাআলার শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক তাঁর ওপর ও সকল নবীগণের ওপর। সকলের পরিবারবর্গ ও সকল নেককারদের ওপর।
আম্মা বাদ, পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় মহান আল্লাহ তাআলা বলেন-
فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ
অর্থ: তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করব।'
তিনি আরো বলেন-
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُوْنِ
অর্থ: আমি মানুষ ও জিন জাতিকে কেবল আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি। ২
এদ্বারা বুঝা গেল যে, বান্দার শ্রেষ্ঠ অবস্থা হল, যখন সে আল্লাহর জিকির করে; আল্লাহকে স্মরণ করে এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত জিকির-আজকারে মাশগুল থাকে।
উলামায়ে কেরাম দুআ, যিজকির-আজকার ও দৈনন্দিন আমলের অনেক কিতাব লিখেছেন। কিন্তু সেগুলো সনদ এবং তাকরারের কারণে দীর্ঘ হয়ে গেছে। ফলে সাধারণ পাঠকেরা সেগুলো থেকে উপকৃত হতে পারে না। তাই আমি আগ্রহী পাঠকদের জন্য বিষয়টি সহজ করার ইচ্ছা করলাম।
আগ্রহীদের জন্য সহজকরণার্থে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে আমি সংক্ষিপ্তাকারে কিতাবটি লিখতে শুরু করলাম। সংক্ষিপ্ত করার জন্য বেশিরভাগ জায়গায় সনদ উল্লেখ করিনি। এছাড়াও যেহেতু কিতাবটি ইবাদতকারীদের জন্য লেখা হয়েছে; সনদ অনুসন্ধানকারীদের জন্য লেখা হয়নি, তাই সনদ উল্লেখের কোন প্রয়োজন নেই। বরং ইবাদতকরীদের বেশিরভাগই সনদ উল্লেখকে অপছন্দ করেন। এছাড়াও কিতাবের উদ্দেশ্য যেহেতু জিকির-আজকার ও অজিফা সম্পর্কে জানা এবং সে অনুযায়ী আমল করা; আলোর পথ সন্ধানীদের কাছে অজিফাগুলো স্পষ্ট করা, তাই এখানে সনদ উল্লেখ না করাটাই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছে।
তবে আমি এখানে সনদের পরিবর্তে তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করব, যদ্দারা অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সেটি হল, হাদিসের হুকুম- যে হাদিসটি সহিহ, হাসান, যাঈফ না কি মুনকার। কারণ, এবিষয়টি সকলেরই প্রয়োজন। অবশ্য বিজ্ঞ মুহাদ্দিগণের এগুলোর প্রয়োজন নেই, যাদের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য।
হাদিসের হুকুম জানা অতি প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। ফলে পাঠকের কাছে হাদিস বিশারদ ও অনুসৃত বিজ্ঞ ইমামগণের বক্তব্য জানা হয়ে যাবে।
আমি এর সঙ্গে ইলমুল হাদিসের সুন্দর সুন্দর বিষয়, ইলমুল ফিকহের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়, নিয়ম-নীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আত্মশুদ্ধি ও আদব-কায়দার বিষয়গুলো উল্লেখ করব, যেগুলো জানা হেদায়েতের পথের পথিকের জন্য খুবই জরুরি। এসবই আমি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করব, যাতে সাধারণ মানুষ ও জ্ঞানীদের বুঝা সহজ হয়। সহিহ মুসলিম শরিফে বর্ণিত আছে-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ، صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: " مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنَ الْأَجْرِ مِثْلُ أُجُوْرِ مَنْ تَبِعَهُ، لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَيْئًا.
অর্থ: আবু হুরায়রা রাদি. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি হেদায়েতের পথে মানুষকে ডাকে সে ব্যক্তি তার ডাকে সাড়া দানকারীদের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। এটা অনুসারীদের সওয়াবে কোন কমতি সৃষ্টি করবে না।
তাই আমি আমলকারীদের পথ সহজকরণে ও তাদের পথের দিশা দিয়ে তাদের সহযোগিতা করার ইচ্ছা করেছি। আমি কিতাবের শুরুতে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এনেছি, যেগুলো এ কিতাবের পাঠকসহ সকল আগ্রহী ব্যক্তির জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
অপ্রসিদ্ধ সাহাবির নাম এলে 'সাহাবি' বলে সে বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছি, যেন তাঁর সাহাবি হওয়ার বিষয়ে মানুষের মনে কোন সন্দেহ সৃষ্টি না হয়।
এ কিতাবে আমি প্রসিদ্ধ পাঁচ কিতাব- সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে তিরমিজি এবং সুনানে নাসাঈ থেকেই বেশি হাদিস নিয়েছি। তবে কখনো কখনো অন্যান্য প্রসিদ্ধ ও অপসিদ্ধ কিতাব থেকেও হাদিস নিয়েছি।
হাদিসের জয় ও মুসনাদের কিতাবসমূহ থেকে খুব কমই আমি হাদিস এনেছি। দুর্বল হাদিস উল্লেখ করিনি, করলেও তার দুর্বল হওয়ার বিষয়টি বলে দিয়েছি। এখানে আমি বেশিরভাগই সহিহ হাদিস উল্লেখ করেছি। তাই আমি আশা রাখি, এটি একটি নির্ভরযোগ্য ও মৌলিক কিতাব হবে। প্রত্যেক অধ্যায়ে আমি সেসব হাদিসই এনেছি, যেগুলো সে অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয়কে সুস্পষ্টভাবে বুঝায়।
মহান আল্লাহ তাআলার কাছে তাওফিক ও সাহায্য চাই। হেদায়াত ও সরল পথের দিশা কামনা করি। আমি যে কাজের ইচ্ছা করেছি তার সহজতা চাই। কল্যাণকর কাজে সর্বদা নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাই। জান্নাতে আমার প্রিয় ব্যক্তিদের সঙ্গে থাকতে চাই। আর আমি আল্লাহর কাছে সকল আনন্দের বিষয় কামনা করি।
আল্লাহ তাআলা আমার জন্য যথেষ্ট। তিনি উত্তম কর্মবিধায়ক। পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাবান আল্লাহ তাআলার সাহায্য ছাড়া কোন শক্তি-সামর্থ্য নেই। আমি আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা করছি। আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় কামনা করছি। আল্লাহ তাআলার কাছে সাহায্য চাচ্ছি। আল্লাহ তাআলার কাছে আমার সকল বিষয় ন্যস্ত করছি। আমি আল্লাহ তাআলার কাছে আমানত রাখছি- আমার দ্বীন ও আমার সত্ত্বা, আমার পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও বন্ধু-বান্ধব, আমার সকল শুভাকাঙ্ক্ষী, সকল মুসলমানকে। আর এবং তিনি আমাকে ও তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতের যত কল্যাণ দিয়েছেন এসব কিছুকে। কেননা, তাঁর কাছে কোন কিছু আমানত রাখলে তিনি তা হেফাজত করেন। আর তিনি তো উত্তম হেফাজতকারী।
ইমাম আবু বকর ইয়াহইয়া বিন শারাফ আন-নববি আদ-দিমাশকি রহ.
টিকাঃ
১. সুরা বাকারা: ১৫২।
২. সুরা যারিয়াত: ৫৬।
৩. সহিহ মুসলিম: ৬২৭৪, সুনানে আবু দাউদ: ৪৬০৯, সুনানে তিরমিজি: ২৬৭৬, মুয়াত্তা মালেক ১/২১৮, সুনানে ইবনে মাজাহ: ২০৬।
📄 প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সব কাজে নিয়ত বিশুদ্ধ করা
পবিত্র কুরআন মাজিদে মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ
অর্থ: তাদের তো বিশুদ্ধচিত্তে একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর ইবাদত করতে আদেশ করা হয়েছিলো।
অন্য এক জায়গায় ইরশাদ করেন-
لَنْ يَنَالَ اللَّهَ لُحُوْمُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ
অর্থ: (কুরবানীর পশুর) রক্ত ও গোশত কোনটিই আল্লাহর কাছে পৌছে না। কেবল তোমাদের তাকওয়া (আল্লাহর কাছে) তাঁর কাছে পৌঁছে।
ইবনে আব্বাস রাদি. উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,
مَعْنَاهُ وَلَكِنْ يَنَالُهُ النَّيَّاتُ
অর্থাৎ (বিশুদ্ধ) নিয়তই তাঁর কাছে পৌঁছে।
এ সম্পর্কে সহিহ বুখারি ও মুসলিমে আমিরুল মুমিনিন উমর রাদি. থেকে বর্ণিত আছে-
قَالَ رَسُولُ اللهِ، صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ، وَرَسُولِهِ، فَهِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ، وَرَسُوْلِهِ، وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا أَوِ امْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا، فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ
অর্থ: রাসুল সাল্লাল্লাহু তাআলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সব কাজ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। প্রত্যেকেই তার নিয়ত অনুসারে প্রতিদান পেয়ে থাকে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে পাওয়ার আশায় হিজরত করবে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে পাওয়ার জন্যই হবে। আর যে দুনিয়া পাওয়ার আশায় কিংবা কোন মহিলাকে বিবাহ করার আশায় হিজরত করে, তার হিজরত সে জন্যই হবে, যে উদ্দেশে সে হিজরত করেছে।
এই হাদিসটি সহিহ, সবাই এ ব্যাপারে একমত। এর উঁচু মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে সবাই সম্মতি জ্ঞাপন করেন। যেসব হাদিসের ওপর ইসলামের ভিত্তি, সেগুলোর মধ্যে এ হাদিসটি অন্যতম। সালফে সালেহিন ও তাদের অনুসারীরা তাদের কিতাবকে এ হাদিসের মাধ্যমে সূচনা করতে পছন্দ করতেন। এই লক্ষ্যে যে, শুরুতেই যেন সবাই নিয়তের পরিশুদ্ধির বিষয়ে মনোযোগী ও যত্নশীল হয়।
ইমাম আবু সাঈদ আবদুর রহমান বিন মাহদি রহ. থেকে বর্ণিত: যে ব্যক্তি কোন কিতাব সঙ্কলন করতে চায়, তাঁর উচিত তিনি যেন এই হাদিস দ্বারা তা শুরু করেন।
ইমাম আবু সুলাইমান খাত্তাবি রহ. বলেন, আমাদের পূর্ববর্তী মাশায়েখরা প্রতিটি কাজ বিশেষ করে দ্বীনী বিষয়াদি শুরু করার আগে এই হাদিসকে বর্ণনা করা মুস্তাহাব মনে করতেন। কারণ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত যে, নিয়ত অনুসারে ব্যক্তির বিষয়কে সংরক্ষণ করা হয়।
কোন বিজ্ঞ ব্যক্তি বলেন, মানুষ তার নিয়ত অনুসারেই প্রতিদান পেয়ে থাকে।
ফুযাইল বিন ইয়ায রাদি. থেকে বর্ণিত- মানুষের কারণে আমল ছেড়ে দেয়া হল, রিয়া বা কপটতা। মানুষের জন্য আমল করা হচ্ছে শিরক। আর আল্লাহ তাআলা তোমাকে এদুটো থেকে রক্ষা করার নামই হল এখলাস।'
ইমাম হারিস মুহাসিবি রহ. বলেন, সাদিক বা সত্যবাদী বলা হয় তাকে, সৃষ্টিজগতের সবার মন থেকেও তার মর্যাদা বিলীন হয়ে যায় তারপরও সে আন্তরিক বিশুদ্ধতার জন্য এর কোনই পরোয়া করে না। আর মানুষ তার নেকআমল সম্পর্কে বিন্দু পরিমাণ জানুক, এটা সে পছন্দ করে না। আর মানুষ তার বদ আমল জানাকেও সে অপছন্দ করে না।'
হুজায়ফা মারআশি রহ. থেকে বর্ণিত যে, ইখলাস হল, বান্দার কাছে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সবধরনের কাজ সমান হয়ে যাওয়া।"
উস্তায ইমাম আবুল কাসিম কুশাইরি রহ. বলেন-
ইখলাস হল, স্বেচ্ছায় কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য ইবাদত করা, অর্থাৎ বান্দার ইবাদতের একমাত্র উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা। এছাড়া পার্থিব অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারবে না। যেমন- সৃষ্টিকে খুশি করা, মানুষের প্রশংসা অর্জন করা, মানুষের ভালোবাসা লাভ করা, অথবা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্য করা।
সাহল বিন আবদুল্লাহ তুসতারি রহ. বলেন-
জ্ঞানী ব্যক্তিরা ইখলাসের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, বান্দার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য প্রতিটি উঠাবসা একমাত্র আল্লাহর জন্য হওয়া। নিজের আত্মা, কুপ্রবৃত্তি ও দুনিয়া হাসিলের কোন সংমিশ্রণ না থাকা।১০
উস্তায আবু আলি দাক্কাক রহ. থেকে বর্ণিত-
ইখলাস হল, সৃষ্টিকে লক্ষ করে চলা হতে বেঁচে থাকা। আর 'সিদক' বলা হয়, নিজের ভালো কাজ দেখা হতে নিজেকে দূরে রাখা। (কেননা নিজের ভালো কাজ দেখলে এটাকে নিজের কৃতিত্ব মনে করবে। এটা আত্মগর্ব ও অহঙ্কার সৃষ্টি করবে।) অতএব, কপটতা মুক্ত ব্যক্তিই হলেন প্রকৃত মুখলিস। আর যার কোন আত্মগর্ব নেই, তিনিই হলেন সাদিক তথা সত্যবাদী।
যুন্নুন মিশরি রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইখলাসের তিনটি নিদর্শন-
১. সাধারণ মানুষের প্রশংসা ও নিন্দা সমান হয়ে যাওয়া।
২. নেককাজ করার সময় নিজের এই নেককাজ দেখতে ভুলে যাওয়া। (যেমন, কোন নেককাজ করার সময় এটা না ভাবা যে আমি খুব ভালো করছি।) আর
৩. কেয়ামতে নেককাজের সওয়াব তথা প্রতিদানের দাবিদার না হওয়া।
ইমাম কুশাইরি রহ. বলেন- সিদকের সর্বনিম্ন স্তর হল, ব্যক্তির প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অর্থাৎ সর্বাবস্থা সমান হয়ে যাওয়া।
সাহাল আত-তাসতুরী রহ. বলেন- যে নিজেকে বা অন্যকে তোষামোদ করে চলে, সে কখনও সত্যবাদিতার ঘ্রাণ পায় না।
টিকাঃ
৪. সুরা বাইয়িনাহ: আয়াত: ০৫।
৫. সুরা হজ্জ: আয়াত: ৩৭।
৬. সহিহ বুখারি: ১৯০৭, সুনানে আবু দাউদ: ২২০১, সুনানে তিরমিজি: ১৬৪৭।
৭. আর-রিসালাতুল কুশাইরিয়া: ১৬৩।
৮. আর-রিসালাতুল কুশাইরিয়া: ১৬৩।
৯. শুআবুল ঈমান লিল-বায়হাকি: ৬৮৭৮।
১০. আর-রিসালাতুল কুশাইরিয়া: ১৬২।
📄 ফযিলতের আমল একবার হলেও করা উচিত
কোন আমলের ফাযায়েল সম্পর্কে জানলে উচিত হল, সেটি আমল করা; যদি জীবনে অন্তত একবারও হয়। যাতে সে এর আমলকারীদের দলভুক্ত হয়ে যায়। সেটি একেবারেই আমল না করা সমীচীন নয়, বরং যথাসম্ভব সেটি আমল করা। হাদিস শরিফে ইরশাদ হচ্ছে-
إِذَا أَمَرْتُكُمْ بِأَمْرٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ.
অর্থ: যখন আমি তোমাদের কোন বিষয়ের আদেশ দেই, তখন তোমরা তা সাধ্যানুযায়ী পালন করো।১১
টিকাঃ
১১. সহিহ বুখারি: ৭২৮৮, সহিহ মুসলিম: ১৩৩৭, সুনানে তিরমিজি: ২৬৮১, সুনানে নাসাঈ ৫/১১০, সুনানে ইবনে মাজাহঃ ২।
📄 ফযিলত বিষয়ক দুর্বল হাদিসের ওপর আমল করা
উলামা, ফুকাহা ও মুহাদ্দিসিনে কেরামের মতে ফাযায়েল ও উৎসাহমূলক বিষয়ে দুর্বল হাদিসের ওপর আমল করা জায়েয আছে। এমনকি, আমল করাই উত্তম। যতক্ষণ না ঐ হাদিস মাওজু (জাল) পর্যায়ের না হবে। পক্ষান্তরে আহকামের ক্ষেত্রে যেমন- হালাল, হারাম, ক্রয়-বিক্রয়, বিবাহ-শাদি, তালাক ইত্যাদি বিষয়ে কেবল সহিহ বা হাসান হাদিসের ওপরই আমল করতে হবে। তবে হ্যাঁ, যদি কোন সতর্কতামূলক বিষয় হয়, যেমন- বিবাহ-শাদী বা বেচাকেনা সংক্রান্ত কোন বিষয়ের অপছন্দনীয়তার ক্ষেত্রে দুর্বল হাদিস আসে, তাহলে মুস্তাহাব হল তা থেকে বেঁচে থাকা চাই। তবে এটা ওয়াজিব নয়। বিষয়টি এ কিতাবে এজন্য বর্ণনা করেছি যে, এই কিতাবে সহিহ, হাসান ও যাঈফ (দুর্বল) হাদিসও বর্ণিত হয়েছে। যাতে পাঠকবৃন্দ এ বিষয়ে শুরুতেই অবগত হতে পারেন।