📄 দরসের প্রতি আগ্রহের অনন্য দৃষ্টান্ত
হজরত মাওলানা খায়ের মুহাম্মদ জলন্ধরি রহ.১১ একবার হাদিসের দরসদানকালে এক ছাত্র প্রশ্ন করল। যে প্রশ্নের উত্তর তখন তার মাথায় আসছিল না। আমাদের যদি এমন অবস্থা হয়, তাহলে আমরা তো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। এখানে যে আসলেই সূক্ষ্ম কিছু বিষয় আছে তা ছাত্রদের বুঝতেই দিই না। তখন ছাত্ররা আর কী করবে?
কিন্তু তিনি ছিলেন কঠিন আমানতদার। তিনি মনে করতেন যে, ছাত্ররা যদি উস্তাদকে কোনো প্রশ্ন করে, আর সে প্রশ্নের সমাধান উস্তাদের মাথায় তখন না আসার কারণে তিনি যদি তা এড়িয়ে যান, তাহলে এটা খিয়ানতের নামান্তর। তাই তিনি খোলাখুলি বলে দিলেন, এ প্রশ্নের সঠিক সমাধান এখন আমার মাথায় আসছে না। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ছাত্ররা চুপ করে বসে থাকল। আর তিনি বারবার এটা পড়ছিলেন। কখনো পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছেন, কখনো পড়ছেন। কিন্তু সঠিক কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তখন তিনি বললেন, এ প্রশ্নের সমাধান এখন আমি দিতে পারছি না। আমি অমুক আলেমের কাছে গিয়ে এর সঠিক সমাধান জেনে নেবো। যার কথা তিনি তার ছাত্রদের সামনে বললেন, তিনি ছিলেন তারই প্রাক্তন ছাত্র। এ কথা শুনে এক ছাত্র সেই আলেমের কাছে দৌড়ে গিয়ে বলল, হুজুর আপনার কাছে এ ব্যাপারে আসছেন। মাওলানা সাহেব তৎক্ষণাৎ কিতাব বন্ধ করে হজরতের কাছে দৌড়ে গেলেন। বললেন, হজরত! আপনি কি আমায় স্মরণ করেছিলেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ! মাওলানা, এ সবক আমার বুঝে আসছে না। দেখো তো এর সমাধান কী? মাওলানা সাহেব পড়ে বুঝতে পারলেন। কিন্তু তিনি কথা ঘুরিয়ে বললেন, হজরত। আপনি যখন আমাদের পড়িয়েছিলেন তখন এভাবে বলেছিলেন।
দেখুন! তিনি কীভাবে ঘুরিয়ে কথা বললেন। নিজের দিকে নিসবত করে এটা বোঝাননি যে, আমার অনেক ইলম ও জ্ঞান আছে। আপনি আমার উস্তাদ হওয়া সত্ত্বেও আমার কাছে বুঝতে এসেছেন।
তাদের পক্ষে এমন মনোভাব দেখানো ছিল খুবই সহজ। কারণ, তারা ছিলেন সংস্রবপ্রাপ্ত। তরবিয়তপ্রাপ্ত। এটাকেই বলে তাসাউফ। এটাই হলো নিজেকে বিলীন করে দেওয়া।
টিকাঃ
১১. ১৩১২ হিজরি মুতাবিক ১৮৯৫ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৩৯০ হিজরি সনের ২০ শাবান মুতাবিক ১৯৭০ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন।
📄 নেতৃত্বের ভুল জাতির ধ্বংসের কারণ
ওলামায়ে কেরামের জন্য সতর্কতার সাথে জীবন-যাপন করা অপরিহার্য। হজরত হাসান বসরি রহ. বলেন, একবার ছোট্ট একটি মেয়ে আমাকে উপদেশ দিয়েছিল। কেউ বলল, কী সেই উপদেশ? তিনি বললেন, একবার আমি মসজিদে নামাজ পড়তে যাচ্ছিলাম। তখন ছিল বৃষ্টির মৌসুম। সতর্কতার সাথে না হাঁটলে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল। আমার পাশ দিয়ে এক বালিকা যাচ্ছিল। তখন আমি তাকে বললাম, বেটি! সাবধানে যেয়ো, দেখো যেন পা পিছলে না যায়। মেয়েটি বলল, জনাব! আমি তো সতর্কতা অবলম্বন করবই। তবে আপনি আরও বেশি সতর্ক থাকবেন। কেননা, আমি পিছলে পড়ে গেলে শুধু আমিই ক্ষতিগ্রস্ত হব। পক্ষান্তরে আপনি পড়ে গেলে গোটা উম্মত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আমাদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ। আপনারা দৃঢ়তার সাথে শরিয়ত ও সুন্নাতের ওপর আমল করবেন। আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মান দান করবেন।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ.-কে 'কুরআন সৃষ্ট কি না'-এ মাসআলার ক্ষেত্রে এমনভাবে বেত্রাঘাত করা হতো যে, সে বেত্রাঘাত যদি কোনো হাতির গায়ে করা হতো, তাহলে হাতিও লাফিয়ে উঠত। তার শরীরে যে জায়গায় বেত্রাঘাত করা হতো, সে স্থানটুকু অবশ হয়ে যেত। তারপর সে অংশের গোশত কেটে মলম ও পট্টি বেঁধে দেওয়া হতো। দীনের জন্য তিনি কী পরিমাণ দৃঢ়তা অবলম্বন করেছিলেন।
📄 হজরত আবু হুরায়রা রাদি. মুখস্থশক্তি কোথায় পেলেন?
হজরত আবু হুরায়রা রাদি, মুসলমান হওয়ার পর তার বৃদ্ধকাল শুরু হয়েছিল। অধিকাংশ সময় তিনি ভুলে যেতেন। কিছু মনে রাখতে পারতেন না।
একদিন তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হয়ে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার কিছু মনে থাকে না। আমি আপনার বাণী যা শুনি ভুলে যাই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার চাদরখানা মেলে ধরো। তিনি যখন চাদর মেলে ধরলেন, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনভাবে হাতের ইশারা করলেন, যেন তিনি হাত ভরে চাদরে কিছু রাখছেন। এরপর বললেন, আবু হুরায়রা! চাদর বেঁধে নাও। এরপর থেকে আল্লাহ তাআলা তাকে এমন ধী-শক্তিসম্পন্ন করলেন যে, তিনি আর কিছুই ভুলতেন না।
সুবহানাল্লাহ! তিনি ইলম অর্জনের জন্য অগ্রসর হয়েছেন। আর উস্তাদ দোয়া করে দিয়েছেন। অপরদিকে আল্লাহ তাআলা বরকত দান করলেন। ফলে তিনি এমন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন যে, তার ব্যাপারে মুফতি শফি রহ.১২ বলেন যে, আবু হুরায়রা রাদি. 'মৌলবি' ধরনের সাহাবি ছিলেন। কারণ, তিনি অধিকাংশ সময় হাদিস সংকলনের চিন্তায় গভীরভাবে নিমগ্ন থাকতেন। এ জন্যই তিনি সকল সাহাবির চেয়ে অধিক হাদিস বর্ণনা করতে সক্ষম হয়েছেন। সুবহানাল্লাহ!
টিকাঃ
১২. তিনি ১৩১৪ হিজরিতে দেওবন্দে জন্মগ্রহণ করেন। নয় বছর বয়সে পিতার সাথে তিনি হজরত থানবি রহ.-এর খেদমতে হাজির হন। ১৩৪৯ হিজরিতে তিনি খেলাফতপ্রাপ্ত হন। ১৩৯২ হিজরির শাওয়াল মাসে ৮৩ বছর বয়সে করাচিতে ইন্তেকাল করেন।بزم اشرف چراغ
📄 মুখস্থ তো এমনই হওয়া চাই
একবার খলিফা আবদুল মালেক রহ. চিন্তা করলেন, হজরত আবু হুরায়রা রাদি. তো অধিক হাদিস বর্ণনাকারী। কিন্তু তিনি কি আসলে হুবহু হাদিসই বর্ণনা করছেন, নাকি রিওয়ায়াত বিল মানা তথা মর্ম ঠিক রেখে অন্য শব্দের মাধ্যমে বর্ণনা করছেন?
এ সন্দেহ দূর করার জন্য তিনি একটি মাহফিলের আয়োজন করেন। মাহফিলে হজরত আবু হুরায়রা রাদি.-কে দাওয়াত দেন। এদিকে খলিফা মজলিসের একপাশে পর্দার আড়ালে দুজন কাতেব নিয়োজিত করলেন। যাদেরকে আদেশ করলেন, হজরত আবু হুরায়রা রাদি. যা বলবেন, আপনারা তা সুন্দরভাবে হুবহু লিপিবদ্ধ করবেন। মাহফিল শুরু হলে খলিফা হজরত আবদুল মালেক রহ. বললেন, হজরত! আপনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অনেক হাদিস শুনেছেন। সেখান থেকে কিছু হাদিস শুনিয়ে আমাদেরকেও ধন্য করুন।
খলিফার অনুরোধে হজরত আবু হুরায়রা রাদি. একশ হাদিস শুনিয়ে দিলেন। কাতেবদ্বয় একশ হাদিসই লিপিবদ্ধ করে রাখলেন।
এরপর এক বছর পর খলিফা পুনরায় একটি মাহফিলের আয়োজন করলেন। গত বছরের মতো এবারও হজরত আবু হুরায়রা রাদি.-কে দাওয়াত করলেন। আর সেই কাতেবদ্বয়কে বললেন, আপনারা গত বছরের নোটটা বের করে রাখবেন। আবু হুরায়রা রাদি. যা বলবেন, তার সাথে এ নোট মেলাবেন। এরপর খলিফা হজরত আবু হুরায়রা রাদি.-কে বললেন, হজরত! আপনি গত বছর যে হাদিসগুলো আমাদের শুনিয়েছিলেন, তা আমাদের বেশ ভালো লেগেছিল। আমরা উপকৃত হয়েছি। এবারও যদি সেই হাদিসগুলো আমাদের শুনাতেন, তাহলে আমাদের উপকার হতো। খলিফার অনুরোধে হজরত আবু হুরায়রা রাদি. সেই হাদিসগুলো শোনালেন। কাতেবদ্বয় অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। একশ হাদিসের মধ্যে কোথাও একটি অক্ষরের মধ্যেও পরিবর্তন হয়নি। আল্লাহ তাআলা তাকে এমন মুখস্থশক্তি দান করেছিলেন।