📘 আকাবিরদের জ্ঞান সাধনার গল্প > 📄 চিঠির প্রতি ভ্রূক্ষেপ করতাম না

📄 চিঠির প্রতি ভ্রূক্ষেপ করতাম না


শাহ আবদুল কাদের রায়পুরি রহ.-এর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ছাত্রজীবনে যখন বাড়ি থেকে কোনো চিঠি আসত, তখন তা খুলতাম না। কারণ, ভাবতাম যদি চিঠিতে কোনো খুশির খবর থাকে তাহলে বাড়ি যেতে মন চাইবে। পক্ষান্তরে যদি কোনো দুঃখের খবর থাকে তাহলে পড়ালেখায় মন বসবে না। ফলে আমি ইলম থেকে বঞ্চিত হবো।

এভাবে সারা বছরের চিঠিগুলো জমা করে রাখতাম। অবশেষে শাবান মাসে বার্ষিক পরীক্ষার পর যখন অবসর হতাম, তখন সব চিঠিগুলো খুলে পড়তাম এবং এর একটা ফিরিস্তি তৈরি করতাম। যখন বাড়িতে যেতাম তখন খুশির সংবাদদাতাকে অভিনন্দন জানাতাম আর দুঃখের সংবাদদাতাকে সান্ত্বনা দিতাম। ফলে সবাই আমার ওপর খুশি হয়ে যেতেন। কিন্তু তাদের তো আর এটা জানা ছিল না যে, আমি তাদের চিঠি সবেমাত্র পড়েছি।

পৃথিবীতে যারা খ্যাতি অর্জন করেছেন তারা ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে এমনই ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কিন্তু বর্তমানে ছাত্রদের তো পড়াশোনার চেয়ে বাইরের কথাবার্তা শোনার প্রতি আগ্রহ বেশি। তাকরার করতে বসলে তাকরারের কথা শোনার চেয়ে বাইরের কথা বেশি শোনে। এমনকি তাকরারে বসে তো দেশের রাজনীতির সব ফয়সালাও হয়ে যায়। এর কারণ হলো, অনর্থক কথাবার্তার মাধ্যমে শয়তান তাদেরকে ইলম থেকে বঞ্চিত করতে চায়।

📘 আকাবিরদের জ্ঞান সাধনার গল্প > 📄 যে কলমের বিশ্রাম নেই

📄 যে কলমের বিশ্রাম নেই


এক মুহাদ্দিস সাহেবের জীবনীতে পাওয়া যায়, তিনি তার জীবনে এ পরিমাণ কিতাব লিপিবদ্ধ করেছেন যে, যদি তার গোটা জীবনের দিনগুলো হিসাব করা হয়, আর তার রচিত কিতাবগুলোর পৃষ্ঠা গণনা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, প্রতিদিন গড়ে দশ পৃষ্ঠা করে লেখা হয়েছে। অথচ এটা কোনো মামুলি বিষয় ছিল না।

জন্মের পর থেকেই তো আর মানুষ লেখতে পারে না। বরং বারো/তেরো বছর জ্ঞানার্জনের পর থেকে হয়তো লেখেন। সুতরাং জ্ঞানার্জনের এ বছরগুলো যদি বাদ দেওয়া হয় তাহলে দেখা যাবে, দশের পরিবর্তে প্রতিদিন বিশ পৃষ্ঠা হয়ে যাবে। আমাদের দ্বারা বিশ পৃষ্ঠা লেখা তো দূরের কথা, বিশ পৃষ্ঠা ভালোভাবে বুঝে পড়াই তো অসম্ভব। যারা লেখক তারা হয়তো জানেন যে, দিনে এক পৃষ্ঠা লেখা কত কঠিন। সুতরাং চিন্তা করুন, তারা কী পরিমাণ পরিশ্রম করেছেন।

📘 আকাবিরদের জ্ঞান সাধনার গল্প > 📄 সফরের প্রবল আগ্রহ অসম্ভবকে সম্ভব করেছে

📄 সফরের প্রবল আগ্রহ অসম্ভবকে সম্ভব করেছে


মুহাম্মদ ইবনে কাসিম১০ সতেরো বছরের যুবক। এখনকার সময়ের সতেরো বছরের কোনো যুবককে যদি ঘরের দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়, তাহলে সে হয়তো তা ঠিকমতো পালন করতে পারবে না, অথচ সতেরো বছরের যুবক মুহাম্মদ ইবনে কাসিম ছিলেন প্রধান সেনাপতি।

আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, রাজা দাহিরের মতো প্রতাপশালী শাসকের বিরুদ্ধে তিনি সৈন্যসামন্ত নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। আমি সিন্ধু এলাকায় সেই স্থান দেখেছি যেখানে মুহাম্মদ ইবনে কাসিম ও রাজা দাহির যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। যুদ্ধের ময়দান এতটাই বিস্তৃত যে, ময়দান দেখে আমি বিস্মিত হই। আমি চিন্তা করলাম, এ নওজোয়ান কীভাবে এখানে এসেছিলেন? তার সাথে তো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তেমন কোনো সৈন্যদলও ছিল না।

যখন হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ বললেন, এখন আমাদের সকল সৈন্যরা বিভিন্ন অভিযানে ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ আমার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে যে, আমাদের কিছুসংখ্যক মহিলা সমুদ্রপথে আসছিল। পথিমধ্যে রাজা দাহিরের জলদস্যুবাহিনী তাদের সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছে। তারা চিৎকার করে বলছিল, মুহাম্মদ ইবনে কাসিম 'আমাদের বাচাঁও', 'আমাদের বাচাঁও'-এ বাক্যগুলো শুনে "Cornernee lings"-এর নওজোয়ানদের একত্র করলেন। তারা যদিও যুদ্ধে পরিপক্ব ছিলেন না, কিন্তু ইমানি বলে বলীয়ান ছিলেন। তাই তারা ইমানের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বললেন, হে মুহাম্মদ ইবনে কাসিম! আমরা আপনার সঙ্গে আছি। আমরা যাব। ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে যে, মুসলিম বোনদের আকুতির এ বাক্যগুলো মুহাম্মদ ইবনে কাসিমের মাথায় এমনভাবে বিদ্ধ ছিল যে, তিনি হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার করে বলতেন—
لبيك يا اختى لبيك يا اختى

'আমার বোন! আমি উপস্থিত। আমার বোন! আমি উপস্থিত।'

একপর্যায়ে তিনি মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়ে রাজা দাহিরের এলাকায় পৌঁছেন এবং রাজা দাহিরের সুসজ্জিত সৈন্যদের ছিন্নভিন্ন করে দেন। তিনি রাজা দাহিরকে পরাস্ত করেই ক্ষান্ত হননি; বরং নিজের আস্থাভাজনকে সেখানকার স্থলাভিষিক্ত করে সামনে অগ্রসর হতে থাকেন। এমনকি তিনি সিন্ধু থেকে মুলতান পর্যন্ত ইসলামের বিজয়কেতন উড্ডীন করেন।

আজ আমাদের যুবকদের মধ্যে যদি এমন চেতনা বিরাজ করত, তাহলে পৃথিবীর কোনো অপশক্তিই আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস পেত না। সুতরাং আমাদের শ্রম ও মেহনতকে কাজে লাগাতে হবে। আরাম-আয়েশের জীবন মূলত সফলতার জীবন নয়; বরং সফল জীবন তো হলো চেষ্টা-মুজাহাদা ও কর্মময় জীবন।

টিকাঃ
১০. মুহাম্মদ ইবনে কাসিম ছিলেন সিন্ধু-বিজেতা। ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিকের ইন্তেকালের পর তিনি জুলুমের শিকার হন। এবং সুলাইমান ইবনে আবদুল মালিকের জমানায় তাঁকে শহিদ করে দেওয়া হয়। -তারিখে মিল্লাত: ১/৬৩৮।

📘 আকাবিরদের জ্ঞান সাধনার গল্প > 📄 দরসের প্রতি আগ্রহের অনন্য দৃষ্টান্ত

📄 দরসের প্রতি আগ্রহের অনন্য দৃষ্টান্ত


হজরত মাওলানা খায়ের মুহাম্মদ জলন্ধরি রহ.১১ একবার হাদিসের দরসদানকালে এক ছাত্র প্রশ্ন করল। যে প্রশ্নের উত্তর তখন তার মাথায় আসছিল না। আমাদের যদি এমন অবস্থা হয়, তাহলে আমরা তো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। এখানে যে আসলেই সূক্ষ্ম কিছু বিষয় আছে তা ছাত্রদের বুঝতেই দিই না। তখন ছাত্ররা আর কী করবে?

কিন্তু তিনি ছিলেন কঠিন আমানতদার। তিনি মনে করতেন যে, ছাত্ররা যদি উস্তাদকে কোনো প্রশ্ন করে, আর সে প্রশ্নের সমাধান উস্তাদের মাথায় তখন না আসার কারণে তিনি যদি তা এড়িয়ে যান, তাহলে এটা খিয়ানতের নামান্তর। তাই তিনি খোলাখুলি বলে দিলেন, এ প্রশ্নের সঠিক সমাধান এখন আমার মাথায় আসছে না। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ছাত্ররা চুপ করে বসে থাকল। আর তিনি বারবার এটা পড়ছিলেন। কখনো পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছেন, কখনো পড়ছেন। কিন্তু সঠিক কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তখন তিনি বললেন, এ প্রশ্নের সমাধান এখন আমি দিতে পারছি না। আমি অমুক আলেমের কাছে গিয়ে এর সঠিক সমাধান জেনে নেবো। যার কথা তিনি তার ছাত্রদের সামনে বললেন, তিনি ছিলেন তারই প্রাক্তন ছাত্র। এ কথা শুনে এক ছাত্র সেই আলেমের কাছে দৌড়ে গিয়ে বলল, হুজুর আপনার কাছে এ ব্যাপারে আসছেন। মাওলানা সাহেব তৎক্ষণাৎ কিতাব বন্ধ করে হজরতের কাছে দৌড়ে গেলেন। বললেন, হজরত! আপনি কি আমায় স্মরণ করেছিলেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ! মাওলানা, এ সবক আমার বুঝে আসছে না। দেখো তো এর সমাধান কী? মাওলানা সাহেব পড়ে বুঝতে পারলেন। কিন্তু তিনি কথা ঘুরিয়ে বললেন, হজরত। আপনি যখন আমাদের পড়িয়েছিলেন তখন এভাবে বলেছিলেন।

দেখুন! তিনি কীভাবে ঘুরিয়ে কথা বললেন। নিজের দিকে নিসবত করে এটা বোঝাননি যে, আমার অনেক ইলম ও জ্ঞান আছে। আপনি আমার উস্তাদ হওয়া সত্ত্বেও আমার কাছে বুঝতে এসেছেন।

তাদের পক্ষে এমন মনোভাব দেখানো ছিল খুবই সহজ। কারণ, তারা ছিলেন সংস্রবপ্রাপ্ত। তরবিয়তপ্রাপ্ত। এটাকেই বলে তাসাউফ। এটাই হলো নিজেকে বিলীন করে দেওয়া।

টিকাঃ
১১. ১৩১২ হিজরি মুতাবিক ১৮৯৫ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৩৯০ হিজরি সনের ২০ শাবান মুতাবিক ১৯৭০ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন।

লিঙ্ক শেয়ার করুন
close

লিঙ্ক কপি করুন