📄 এমনও জ্ঞানপিপাসু ছিল তখন
হজরত শাহ আবদুল কাদের রায়পুরি রহ.৯ বলেন, আমি ভর্তির জন্য দারুল উলুম দেওবন্দে গেলাম। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর নাজেমে তালিমাত সাহেবের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে, ভর্তি বন্ধ হয়ে গেছে। আমি হজরতকে খুব বিনয়ের সাথে জিজ্ঞাসা করলাম, হজরত। আমি কি জানতে পারি ভর্তি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ কী? নাজেম সাহেব আমাকে বললেন, আসলে আমাদের এখানে ছাত্রদের কোনো বোডিংয়ের ব্যবস্থা নেই। গ্রামবাসী যে কজন ছাত্রের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে পারে, সে কজন ছাত্রকেই ভর্তি করি। অন্যদের ফিরিয়ে দিই। তখন আমি বললাম, হজরত! আমার খাবারের দায়িত্ব যদি আমার নিজের ওপর থাকে, তাহলে কি আমি ভর্তি হতে পারব? তিনি বললেন, তাহলে ঠিক আছে। অবশেষে আমি ভর্তি হলাম। আর আমি সারা দিন ক্লাস করতাম, রাতে তকরার করতাম। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ত, তখন আমি পাশের বস্তিতে অবস্থিত বাজারে যেতাম। বাজারের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সেখানে আমের খোসা, তরমুজের খোসা পাওয়া যেত। আমি সেগুলো কুড়িয়ে এনে ভালো করে পরিষ্কার করে খেয়ে ফেলতাম। এরপর সারা দিন ক্লাস করতাম। এটাই ছিল আমার সারা দিনের খাবার। এভাবে আমি সারা বছর অতিবাহিত করলাম। কিন্তু কোনো দিন ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতাম না।
📄 চিঠির প্রতি ভ্রূক্ষেপ করতাম না
শাহ আবদুল কাদের রায়পুরি রহ.-এর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ছাত্রজীবনে যখন বাড়ি থেকে কোনো চিঠি আসত, তখন তা খুলতাম না। কারণ, ভাবতাম যদি চিঠিতে কোনো খুশির খবর থাকে তাহলে বাড়ি যেতে মন চাইবে। পক্ষান্তরে যদি কোনো দুঃখের খবর থাকে তাহলে পড়ালেখায় মন বসবে না। ফলে আমি ইলম থেকে বঞ্চিত হবো।
এভাবে সারা বছরের চিঠিগুলো জমা করে রাখতাম। অবশেষে শাবান মাসে বার্ষিক পরীক্ষার পর যখন অবসর হতাম, তখন সব চিঠিগুলো খুলে পড়তাম এবং এর একটা ফিরিস্তি তৈরি করতাম। যখন বাড়িতে যেতাম তখন খুশির সংবাদদাতাকে অভিনন্দন জানাতাম আর দুঃখের সংবাদদাতাকে সান্ত্বনা দিতাম। ফলে সবাই আমার ওপর খুশি হয়ে যেতেন। কিন্তু তাদের তো আর এটা জানা ছিল না যে, আমি তাদের চিঠি সবেমাত্র পড়েছি।
পৃথিবীতে যারা খ্যাতি অর্জন করেছেন তারা ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে এমনই ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কিন্তু বর্তমানে ছাত্রদের তো পড়াশোনার চেয়ে বাইরের কথাবার্তা শোনার প্রতি আগ্রহ বেশি। তাকরার করতে বসলে তাকরারের কথা শোনার চেয়ে বাইরের কথা বেশি শোনে। এমনকি তাকরারে বসে তো দেশের রাজনীতির সব ফয়সালাও হয়ে যায়। এর কারণ হলো, অনর্থক কথাবার্তার মাধ্যমে শয়তান তাদেরকে ইলম থেকে বঞ্চিত করতে চায়।
📄 যে কলমের বিশ্রাম নেই
এক মুহাদ্দিস সাহেবের জীবনীতে পাওয়া যায়, তিনি তার জীবনে এ পরিমাণ কিতাব লিপিবদ্ধ করেছেন যে, যদি তার গোটা জীবনের দিনগুলো হিসাব করা হয়, আর তার রচিত কিতাবগুলোর পৃষ্ঠা গণনা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, প্রতিদিন গড়ে দশ পৃষ্ঠা করে লেখা হয়েছে। অথচ এটা কোনো মামুলি বিষয় ছিল না।
জন্মের পর থেকেই তো আর মানুষ লেখতে পারে না। বরং বারো/তেরো বছর জ্ঞানার্জনের পর থেকে হয়তো লেখেন। সুতরাং জ্ঞানার্জনের এ বছরগুলো যদি বাদ দেওয়া হয় তাহলে দেখা যাবে, দশের পরিবর্তে প্রতিদিন বিশ পৃষ্ঠা হয়ে যাবে। আমাদের দ্বারা বিশ পৃষ্ঠা লেখা তো দূরের কথা, বিশ পৃষ্ঠা ভালোভাবে বুঝে পড়াই তো অসম্ভব। যারা লেখক তারা হয়তো জানেন যে, দিনে এক পৃষ্ঠা লেখা কত কঠিন। সুতরাং চিন্তা করুন, তারা কী পরিমাণ পরিশ্রম করেছেন।
📄 সফরের প্রবল আগ্রহ অসম্ভবকে সম্ভব করেছে
মুহাম্মদ ইবনে কাসিম১০ সতেরো বছরের যুবক। এখনকার সময়ের সতেরো বছরের কোনো যুবককে যদি ঘরের দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়, তাহলে সে হয়তো তা ঠিকমতো পালন করতে পারবে না, অথচ সতেরো বছরের যুবক মুহাম্মদ ইবনে কাসিম ছিলেন প্রধান সেনাপতি।
আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, রাজা দাহিরের মতো প্রতাপশালী শাসকের বিরুদ্ধে তিনি সৈন্যসামন্ত নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। আমি সিন্ধু এলাকায় সেই স্থান দেখেছি যেখানে মুহাম্মদ ইবনে কাসিম ও রাজা দাহির যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। যুদ্ধের ময়দান এতটাই বিস্তৃত যে, ময়দান দেখে আমি বিস্মিত হই। আমি চিন্তা করলাম, এ নওজোয়ান কীভাবে এখানে এসেছিলেন? তার সাথে তো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তেমন কোনো সৈন্যদলও ছিল না।
যখন হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ বললেন, এখন আমাদের সকল সৈন্যরা বিভিন্ন অভিযানে ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ আমার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে যে, আমাদের কিছুসংখ্যক মহিলা সমুদ্রপথে আসছিল। পথিমধ্যে রাজা দাহিরের জলদস্যুবাহিনী তাদের সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছে। তারা চিৎকার করে বলছিল, মুহাম্মদ ইবনে কাসিম 'আমাদের বাচাঁও', 'আমাদের বাচাঁও'-এ বাক্যগুলো শুনে "Cornernee lings"-এর নওজোয়ানদের একত্র করলেন। তারা যদিও যুদ্ধে পরিপক্ব ছিলেন না, কিন্তু ইমানি বলে বলীয়ান ছিলেন। তাই তারা ইমানের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বললেন, হে মুহাম্মদ ইবনে কাসিম! আমরা আপনার সঙ্গে আছি। আমরা যাব। ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে যে, মুসলিম বোনদের আকুতির এ বাক্যগুলো মুহাম্মদ ইবনে কাসিমের মাথায় এমনভাবে বিদ্ধ ছিল যে, তিনি হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার করে বলতেন—
لبيك يا اختى لبيك يا اختى
'আমার বোন! আমি উপস্থিত। আমার বোন! আমি উপস্থিত।'
একপর্যায়ে তিনি মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়ে রাজা দাহিরের এলাকায় পৌঁছেন এবং রাজা দাহিরের সুসজ্জিত সৈন্যদের ছিন্নভিন্ন করে দেন। তিনি রাজা দাহিরকে পরাস্ত করেই ক্ষান্ত হননি; বরং নিজের আস্থাভাজনকে সেখানকার স্থলাভিষিক্ত করে সামনে অগ্রসর হতে থাকেন। এমনকি তিনি সিন্ধু থেকে মুলতান পর্যন্ত ইসলামের বিজয়কেতন উড্ডীন করেন।
আজ আমাদের যুবকদের মধ্যে যদি এমন চেতনা বিরাজ করত, তাহলে পৃথিবীর কোনো অপশক্তিই আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস পেত না। সুতরাং আমাদের শ্রম ও মেহনতকে কাজে লাগাতে হবে। আরাম-আয়েশের জীবন মূলত সফলতার জীবন নয়; বরং সফল জীবন তো হলো চেষ্টা-মুজাহাদা ও কর্মময় জীবন।
টিকাঃ
১০. মুহাম্মদ ইবনে কাসিম ছিলেন সিন্ধু-বিজেতা। ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিকের ইন্তেকালের পর তিনি জুলুমের শিকার হন। এবং সুলাইমান ইবনে আবদুল মালিকের জমানায় তাঁকে শহিদ করে দেওয়া হয়। -তারিখে মিল্লাত: ১/৬৩৮।