📄 যে পথের পথিক আমরা
হজরত বায়েজিদ বোস্তামি রহ.-এর ব্যাপারে হজরত জুনাইদ বাগদাদি রহ. বলেন, আল্লাহ তাআলা হজরত জিবরাইল আলাইহিস সালামকে যেমন অন্য সকল ফেরেশতাদের ওপর মর্যাদাবান করেছেন, তদ্রূপ হজরত বায়েজিদ বোস্তামি রহ.-কেও আওলিয়ায়ে কেরামের ওপর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করেছেন।
হজরত জুনাইদ বাগদাদি রহ. আরও বলেন, বোস্তামি রহ. যখন শৈশবে পিতাকে হারান, তখন তার মা তাকে মাদরাসায় ভর্তি করেন এবং শিক্ষককে বলেন, আমার সন্তানকে আপনার নিকটেই রাখবেন। বাড়িতে বেশি যেতে দেবেন না। কারণ, এর দ্বারা তার ইলম থেকে বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বোস্তামি রহ. এভাবে মাদরাসায় থাকতে লাগলেন। একদিন হঠাৎ মায়ের কথা খুব মনে হলো। মাকে দেখতে ইচ্ছা হলো। তিনি শিক্ষকের নিকট বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। শিক্ষক বললেন, যদি তুমি এ পরিমাণ সবক শোনাতে পারো, তাহলে ছুটি পাবে। তিনি ছিলেন প্রখর মেধার অধিকারী। শিক্ষকের নির্ধারিত পরিমাণ সবক শুনিয়ে দিয়ে ছুটি পেলেন। বাড়িতে গিয়ে দরজায় নক করলেন। তখন তার মা অযু করছিলেন। মা জিজ্ঞাসা করলেন, কে। তিনি বললেন, আমি বায়েজিদ। মা বললেন, আমারও একটি ছেলে আছে। তার নামও বায়েজিদ। আমি তাকে আল্লাহর রাস্তায় অর্পণ করেছি। তাহলে তুমি কোন বায়েজিদ? বালক বায়েজিদ রহ.-এর বুঝতে আর বাকি রইল না যে, আমি দরজায় কোনো শব্দ করি, এটা মা চান না। বরং মা চান আমি মাদরাসায় ফিরে গিয়ে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করি। তিনি সোজা মাদরাসায় ফিরে গেলেন। এরপর তিনি 'বায়েজিদ বোস্তামি' হওয়ার আগ পর্যন্ত মাদরাসা থেকে আর কোথাও যাননি। আল্লাহ তাআলা তাকে জমানার বায়েজিদ বানিয়েছিলেন।
📄 ইলমের তৃষ্ণায় জেলখানায় অবস্থান
হজরত ইমাম তাইমিয়া রহ.-এর জীবনীতে পাওয়া যায়। একবার তৎকালীন সময়ের বাদশাহ তার নিকট কোনো বিষয়ের ফতওয়া চাইলেন। কিন্তু তিনি ফতওয়া দেননি। ফলে বাদশাহ তাকে জেলখানায় বন্দি করেন।
এরপর জেলখানায় কেটে গেল টানা তিনটি দিন। একদিন বাদশাহ সিংহাসনে বসে আছেন। এমন সময় রাজদরবারে কাঁদতে কাঁদতে প্রবেশ করল এক তালিবে ইলম। সে ছিল সুন্দর, সুদর্শন যুবক। তার চেহারায় ছিল মায়াবি ছাপ। তাকে দেখামাত্র রাজদরবারে উপস্থিত সকলেরই মায়ার উদ্রেক হলো। এমনকি রাজার মনেও তার প্রতি মায়া জন্মাল। রাজা তাকে অভয় দিয়ে বললেন, হে যুবক! তুমি কাঁদছ কেন? তুমি এভাবে কেঁদো না। এখানে তোমার কোনো ভয় নেই। তুমি কী চাও বলো, আমি তোমার মনোবাসনা পূর্ণ করব।
বাদশাহর অভয়বাণী শুনে যুবক বলল, বাদশাহ সালামত! আপনি আমাকে জেলখানায় বন্দি করুন। তার কথা শুনে বাদশাহ আশ্চর্য হয়ে গেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, জেলখানায় যাওয়ার জন্য তুমি এমন উৎসুক কেন? যুবক বলল, আজ তিন দিন হলো আপনি আমার উস্তাদকে জেলখানায় বন্দি করে রেখেছেন। যার ফলে আমি আমার উস্তাদের নিকট থেকে সবক পড়তে পারছি না। আপনি যদি আমাকে জেলখানায় বন্দি করেন, তাহলে আমি সেখানে আমার উস্তাদের নিকট থেকে সবক পড়তে পারব। কারাবরণ করার কষ্ট আমার কাছে কোনো কষ্টই মনে হবে না।
এ তালিবুল ইলম ছিল হজরত তাইমিয়া রহ.-এর ছাত্র। কিন্তু আফসোস! বর্তমানে এমন দৃশ্য দেখা যায় না। এমন চরিত্র আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছে। আমাদের সম্পর্ক বর্তমানে টিভি ও ছবির সঙ্গে। কুরআনের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। কুরআন খুলে দেখার সময়ও আমাদের নেই। কিছু পরিবার তো এমন রয়েছে, যাদের কুরআন শরিফ খুলে দেখার সময়ই হয় না।
📄 ইলমের পিপাসা এখনও হয়?
হজরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি রহ. যখন শেষ বয়সে উপনীত হলেন, তখন একদিন তার ছেলে হজরত শাহ আবদুল আজিজ রহ. ক্লাসে পাঠদান করা অবস্থায় পানি চাইলেন। এক ছাত্র দৌড়ে তার ঘরে গিয়ে বলল, শাহ সাহেব পানি চেয়েছেন। তখন শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. বললেন, আফসোস! আমার বংশ থেকে ইলম উঠে গেছে। তখন তার স্ত্রী বললেন, আপনি এ কথা বলার ব্যাপারে এত ত্বরা করবেন না। আগে বাস্তব অবস্থা পরীক্ষা করে দেখি। এরপর তিনি পানির গ্লাসে কিছু সিরকা মিশিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। সিরকা সাধারণত তিক্ত ও ভিন্ন স্বাদের হয়ে থাকে। যা পানির স্বাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। পানির গ্লাস শাহ আবদুল আজিজ রহ.-এর হাতে দেওয়ার পর তিনি তা পান করলেন। তারপর ক্লাস শেষ হওয়ার পর যখন ঘরে এলেন, তখন তার মা জিজ্ঞাসা করলেন, বেটা! তুমি যে পানি পান করেছ, তার স্বাদ কেমন ছিল? তিনি বললেন, মা! তা তো বলতে পারব না। তখন মা বাবার কাছে গিয়ে বললেন, দেখলেন তো! আবদুল আজিজ ইলমের প্রতি গাফলতির কারণে পানি পান করেনি; বরং সে তীব্র পানির পিপাসার কারণেই পানি পান করেছে। যা তার আসলেই প্রয়োজন ছিল। অন্যথায় হয়তো সে ক্লাস করাতে পারত না। সুতরাং আমাদের বংশ থেকে এখনো ইলমের আদব উঠে যায়নি। তখন শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি রহ. একটি তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললেন এবং দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! তুমি আমার বংশে সর্বদা ইলম ও ইলমের আদব জারি রেখো।
📄 ফতওয়া পড়তে পড়তে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে গেলেন
দারুল উলুম দেওবন্দের এক মুফতি সাহেবের জীবনালেখ্য পাওয়া যায় যে, তার মৃত্যুর পর তার বুকের ওপর একটি ফতওয়ার কাগজ পাওয়া গিয়েছিল। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ফতওয়া পড়তে ছিলেন। ফতওয়া পড়া অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আর ফতওয়ার কাগজটি তার হাত থেকে বুকের ওপর পড়ে যায়।
আমাদের আকাবিরে দীন এভাবেই সময়কে গনিমত মনে করতেন। ইবাদতের মাধ্যমে সময়কে ব্যয় করতেন।