📄 একটি উপদেশমূলক ঘটনা
হজরত থানবি রহ. বলেন যে, আমাদের এক মামু যিনি স্বাধীন চিন্তার অধিকারী একজন দরবেশ ছিলেন। তিনি ১৮৫৭ সালের আজাদি আন্দোলনের সময়ের একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। ঘটনাটি হলো নিম্নরূপ :
এক জায়গায় অনেকগুলো লাশ পড়ে ছিল। লোভী প্রকৃতির এক হিন্দু লোক (বানিয়া) দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিল। ওই লাশগুলোর মধ্যে একজন লোক আহত হয়ে মরার মতো পড়ে ছিল। সে ওই হিন্দু লোকটিকে দেখে বলল, ওহে ভাই, একটু এখানে এসো! লোকটি এ কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল। সে ভাবল মরা লাশ আমাকে ডাকছে। সে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে ভেগে পালাতে উদ্যত হলো। ইতিমধ্যে সে আহত লোকটি আবার বলে উঠল, ওহে ভাই, তুমি ভয় পেয়ো না, আমি মরা লাশ নই, আহত হয়েছি মাত্র। আমার তো আর বাঁচার কোনো আশা নেই। আমার কোমরে বাঁধা থলের মধ্যে অনেকগুলো টাকা আছে। আমার ইচ্ছা হলো, এ টাকা তো আমার কোনো কাজে আসবে না; কারণ, আমি তো কিছুক্ষণের মধ্যেই মরে যাব। সুতরাং টাকাগুলো তোমাকে দিয়ে দেবো। তুমি এগুলো কাজে লাগাতে পারবে।
টাকার কথা শুনে লোকটি গলে গেল এবং ভয়ে ভয়ে সে ওই আহত লোকটির কাছে গেল। সে যখন আহত লোকটির কাছে এসে গেল তখন আহত লোকটি দ্রুত তরবারি হাতে নিয়ে এক আঘাতে ওই লোকটির একটা ঠ্যাং কেটে ফেলল। সাথে সাথে লোকটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু মাটিতে পড়েও লোকটি ওই আহত লোকটির কোমর হাতাতে লাগল। তার ইচ্ছা হলো, টাকাগুলো তো আগে হাতে নিয়ে নিই। এবার আহত লোকটি বলল, আরে মশাই, তুমি তো দেখছি একটা বদ্ধ পাগল, যুদ্ধের ময়দানে কি কেউ কোমরে টাকা বেঁধে নিয়ে আসে!
আসল কথা হলো, আমার আশেপাশে যারা পড়ে আছে তারা সবাই মরা লাশ, আমিই শুধু একা জীবিত আছি, রাত হয়ে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম, যদি আলাপ-আলোচনা করার জন্য একজন লোক আমার সাথে থাকত তবে রাতটা কাটানো অনেক সহজ হয়ে যেত। আমি যদি তোমাকে এমনিতেই বলতাম যে, ভাই আমার সাথে তুমি রাতে এখানে থাকো, তাহলে তুমি তো ধেয়ে কুল পেতে না। আমি একটু মানসিক প্রশান্তির জন্য তোমাকে আমার সাথি বানিয়ে নিলাম। হিন্দু লোকটি রেগে কটমটিয়ে বলল, বেটা বজ্জাত কোথাকার! নিজেও চলতে পারবে না, অন্যকেও চলতে দেবে না।
মামুজান এ ঘটনার বর্ণনা করে বললেন, বর্তমানে আল্লাহ পাকের রাস্তার ব্যাপারে মানুষের অবস্থা এরূপই হয়ে গেছে যে, সে নিজে তো আল্লাহর পথে চলবেই না, অন্য কেউ চলতে চাইলে তার পথেও বাধা সৃষ্টি করে দেবে।
📄 পূর্ববর্তী মাশাইখগণের প্রতি আদব
হজরত থানবি রহ. বলেন যে, ইলমি তাহকিক এবং গবেষণার চাইতে বেশি প্রয়োজন হলো আদব। বরং বুজুর্গানে দীনের প্রতি আদব রক্ষা করে চলার দ্বারা মহান আল্লাহ তাআলা ইলমি ব্যাপারে তাহকিক ও গবেষণা করার যোগ্যতা দিয়ে দেন। পূর্বসূরি বুজুর্গানে দীনের প্রতি আদব ও শিষ্টাচার পরিহার করে যে গবেষণা করা হয়, সেখানে ভ্রষ্টতা ও পদস্থলনের সমূহ আশঙ্কা বিরাজমান থাকে।
📄 শাহ ইসহাক সাহেব রহ.-এর একটি আশ্চর্য ঘটনা
হজরত আমির শাহ খান সাহেব রহ.-যিনি হজরত মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবি রহ.-এর বিশেষ ও খাস মুরিদ ছিলেন-তিনি দিল্লির বুজুর্গানে দীনের ঘটনাবলি সনদসহ বর্ণনা করতেন। তিনি বলেছেন যে, হজরত শাহ ইসহাক সাহেব রহ. নিজ বংশে মেধাবী নয় বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন। কারণ, সে বংশ ছিল সব বড়ো বড়ো উলামায়ে কেরামের বংশ। একজনের থেকে আরেকজন বড়ো ছিলেন। যদিও সেই বুজুর্গের-যিনি ওই বংশের মেধাবী নয় বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন-তার একটি ঘটনা শুনলে বড়োই আশ্চর্য হতে হয়। ঘটনাটি হলো :
একদিন একজন তালিবে ইলমকে অস্থির অবস্থায় দেখে শাহ সাহেব তার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। কিন্তু প্রথমে সে অহংকারীসুলভ ভঙ্গীতে চোখ ও ঠোঁট দিয়ে একটু ইশারা করে বোঝাল যে, কিছুই হয়নি। এরপর তাকে বারবার জিজ্ঞাসা করায় সে বলল, 'শামসে বাজেগাঁ' (দর্শন শাস্ত্রের দরসি কিতাব)-এর একটি জায়গা বুঝে আসছে না। এবং সে ব্যাপারে আমার উস্তাদের সাথে আমার মতবিরোধ হয়ে গেছে। তিন দিন যাবৎ আমি সেটা নিয়েই আটকে আছি।
হজরত শাহ সাহেব স্নেহ ও শফকতের দৃষ্টিতে বললেন, জায়গাটি আমাকে একটু দেখাও না। ওই তালিবে ইলম ভাবল, ইনি হলেন একজন মুহাদ্দিস। তিনি ইলমে হাদিসের ব্যাপারে হয়তো অভিজ্ঞ হবেন। দর্শনের কিতাবের সাথে তার সম্পর্কই-বা কী আছে। এই ভেবে সে অত্যন্ত অনীহা ও অনাগ্রহ সহকারে কিতাবখানা শুধু তার সামনে রেখে দিলো। হজরত শাহ সাহেব রহ. সে জায়গাটি মুতালাআ করে তার এমন পরিষ্কার মর্ম বয়ান করে দিলেন যার ফলে যে তালিবে ইলমের সংশয় দূরীভূত হয়ে গেল।
এবার এই তালিবে ইলম তো হজরত শাহ সাহেব রহ.-এর পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। হজরত শাহ সাহেব তখন বললেন, মিয়া, আমরা সবই পড়েছি, তবে এগুলো (দর্শন ও মানতিক)-কে নিষ্প্রয়োজনীয় ও বেহুদা মনে করে ছেড়ে রেখেছি।
📄 ইমাম আবু ইউসুফ রহ. মৃত্যুর সময়ও একটি ফেকহি মাসআলা নিয়ে আলোচনা করেছেন
হাম্মাদ ইবনে সালামা রহ. সদা ইবাদতে ব্যস্ত থাকতেন, হয় হাদিস পড়াতেন বা নিজে পড়তেন বা তাসবিহ পাঠ করতেন বা নামাজ পড়তেন; অন্য কিছু নয়
(হাফেজ জাহাবি রহ. বলেন, তিনি ইমাম, মুহাদ্দিস, নাহভি, শায়খুল ইসলাম, যার মৃত্যু ১৬৮ হি.। পাশাপাশি তিনি একজন ফকিহ, সুন্নাতের অনুসারী আবেদ ছিলেন।)
তার ছাত্র আব্দুর রহমান ইবনে মাহদি রহ. বলেন, হাম্মাদ ইবনে সালামাকে যদি বলা হয় আপনি আগামীকাল মারা যাবেন, তাহলে তিনি তার আমল বাড়াতে পারবেন না। মুসা ইবনে ইসমাইল তাবোজাকি রহ. বলেন, আমি যদি তোমাদেরকে বলি, আমি হাম্মাদ ইবনে সালামাকে কখনো হাসতে দেখিনি তাহলে আমি সত্যবাদী হব। তিনি সব সময় ব্যস্ত থাকতেন। হয় হাদিস পড়াতেন অথবা নিজে পড়তেন কিংবা তাসবিহ পড়তেন অথবা নামাজ পড়তেন। তিনি দিনটাকে এভাবে ভাগ করে নিয়েছিলেন। ইউনুস ইবনে মুআদ্দিব রহ. বলেন, হাম্মাদ ইবনে সালামা নামাজরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। আল্লাহ তাকে রহম করুন!
ইয়াকুব ইবনে ইবরাহিম আনসারি কুফি অতঃপর বাগদাদি (জন্ম: ১১৩ হি., মৃত্যু: ১৮২ হি.) যিনি ফিকাহ ও ইজতিহাদের জগতে ইমাম আবু ইউসুফ নামে পরিচিত। যিনি ইমাম আবু হানিফার শাগরিদ এবং তার ইলম ও মাসলাকের মুখপাত্র। বাদশাহত্রয় মাহদি, হাদি ও হারুন রশিদ আব্বাসির কাজি ছিলেন। যাকে সর্বপ্রধান কাজি উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বরং পৃথিবীর প্রথম চিফজাস্টিস উপাধিতে তাকে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি মুমূর্ষ অবস্থায়ও তাকে দেখতে আসা একজনের সাথে ফিকাহর একটি মাসআলা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। হয়তো তাতে কোনো ইলম পিপাসুর পরিতৃপ্তি হওয়ার উপকরণ তৈরি হবে। এবং জীবনের শেষ মুহূর্তটাও যেন ইলমি আলোচনা ও ইফাদা-ইস্তিফাদা থেকে শূন্য না থাকে।
তার শাগরিদ কাজি ইবরাহিম ইবনে জাররাহ কুফি অতঃপর মিসরি রহ. বলেন, ইমাম আবু ইউসুফ রহ. অসুস্থ ছিলেন। আমি তাকে দেখতে গেলাম। তো দেখলাম, তিনি অজ্ঞান অবস্থায় আছেন। যখন জ্ঞান ফিরল তিনি আমাকে বললেন, এই মাসআলায় তোমার কী অভিমত? আমি বললাম, হজরত, এই অবস্থাতেও? তিনি বললেন, কোনো সমস্যা নেই। একটু চিন্তাভাবনা করে নিই না? হয়তো এর দ্বারা কারও উপকার হবে। এরপর বললেন, হজের বিধিবিধানে জামারাতের পাথর মারা পায়ে হেঁটে উত্তম না সওয়ার হয়ে করা উত্তম? আমি বললাম, আরোহণ করে করা উত্তম। তিনি বললেন, তুমি ভুল বলছ। অতঃপর আমি বললাম, পায়ে হেঁটে করা উত্তম। তিনি বললেন, এটাও ভুল। আমি বললাম, তাহলে আপনিই বলে দিন, কোনটা সঠিক। তিনি বললেন, যে রমির পরে আরও রমি আছে সেটা পায়ে হেঁটে করা উত্তম। পক্ষান্তরে যে রমির পর আর রমি নেই সেটা আরোহণ করে করা উত্তম। এরপর আমি তার কাছ থেকে উঠে চলে এলাম। দরজার কাছে যেতেই তার ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। বুঝতে পারলাম কাজি সাহেব তার প্রকৃত মালিকের নিকট পৌঁছে গেছেন।
লেখক বলেন, এটাই ছিল ওলামা ও মাশায়েখদের নীতি। তারা বলেছেন, দোলনা থেকে সমাধি পর্যন্ত ইলম অন্বেষণ করো। (কিন্তু এ কথাটা হাদিস নয়। যদিও একটা চরম সত্য কথা। -আব্দুল ফাত্তাহ রহ.)