📄 আল্লামা শিবলি নুমানি রহ.-এর কথা
হজরত থানবি রহ. বলেন, হজরত উবাইদুল্লাহ সিন্ধি রহ. যখন দিল্লিতে 'নিজারাতুল মাআরিফ' নামক প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন তিনি একবার থানাভবন এসেছিলেন। তিনি বলেন, আমি আল্লামা শিবলি নুমানির সাথে সাক্ষাৎ করেছি এবং তার সাথে ব্যাপকভাবে মুসলমানদের পথভ্রষ্টতা, তাদের অস্থিরতা এবং বিভিন্ন বিপদাপদে লিপ্ত হয়ে পড়ার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। আমি (মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধি) তাকে জিজ্ঞাসা করেছি, আপনার দৃষ্টিতে জাতির ইসলাহ বা সংশোধনের উপায় কী?
আল্লামা শিবলি নুমানি জবাবে বললেন, জাতির সংশোধন শুধু তারাই করতে পারেন জাতির ওপর যাদের পরিপূর্ণ প্রভাব রয়েছে এবং যাদের প্রতি জাতির প্রতিটি নাগরিকের শ্রদ্ধা বিদ্যমান আছে। আর এই প্রভাব এবং শ্রদ্ধা প্রতিষ্ঠা করা নিজের মধ্যে সার্বিক পরিচ্ছন্নতা ছাড়া সম্ভব নয়। আর এ সার্বিক পরিচ্ছন্নতা তাকওয়া, অধিক পরিমাণে ইবাদত এবং আল্লাহর জিকির ছাড়া সৃষ্টি হতে পারে না।
📄 হজরত জুনাইদ বাগদাদি রহ.-এর ঘটনা
একবার হজরত জুনাইদ বাগদাদি রহ. দেখতে পেলেন যে, এক ব্যক্তিকে শূলীর ওপর চড়ানো হয়েছে। তিনি লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, সে কী অপরাধ করেছে? লোকেরা জবাব দিলো, এ ব্যক্তি ডাকাত। প্রথমবার চুরি করার পর সে অপরাধে তার ডান হাত কাটা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও সে চুরি করা থেকে বিরত হয়নি। ফলে পুনরায় চুরি করে ধরা পড়ায় তার বাম পা কেটে দেওয়া হয়েছে। এর পরও যখন সে চুরি করা থেকে বিরত হয়নি; বরং পুনরায় চুরি করে ধরা পড়েছে, সুতরাং এবার নিয়মমতে তার শূলীতে চড়ার পালা, তাই তাকে শূলীতে চড়ানো হয়েছে।
এ কথা শুনে হজরত জুনাইদ রহ. সামনে বাড়লেন এবং তার পা নিজের চোখের সাথে লাগিয়ে চুমু খেলেন। এ দৃশ্য দেখে লোকেরা অস্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করল, হজরত, আপনি এ কী করছেন? হজরত জুনাইদ রহ. তখন জবাব দিলেন যে, আমি তার পা চুম্বন করিনি, বরং তার অবিচলতা ও দৃঢ়তাকেই চুম্বন করেছি, যা তার অভ্যন্তরে রয়েছে। যদিও এ অজ্ঞ লোকটি তার সে দৃঢ়তাকে অপরাধ ও গুনাহের কাজে ব্যয় করেছে এবং সেমতে সে শাস্তিও পেয়ে গেছে; কিন্তু আমি চিন্তা করছি যে, কতই-না সুন্দর হতো যদি ভালো ও সওয়াবের কাজে আমারও এ ধরনের দৃঢ়তা ও অবিচলতা নসিব হতো।
সুবহানাল্লাহ! ওই সকল বুজুর্গানে দীনের দৃষ্টি কত গভীর ছিল। যার ফলে তারা প্রত্যেক বিষয়ের সীমা সর্বাবস্থায় জানতে পারতেন। যার সারকথা এই দাঁড়ায় যে, মানুষের অভ্যন্তরে যেসব যোগ্যতা ও চাহিদা দিয়ে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তার প্রত্যেকটাই যোগ্যতা হিসেবে প্রশংসনীয় হলেও তাকে অন্যায় পথে কিংবা অপরাধ বা গুনাহের কাজে ব্যবহার করা হলে তা গুনাহের কারণ হয়ে যায়। ঠিক সে যোগ্যতাকেই যদি ভালো কাজে এবং ভালো পথে ব্যবহার করা হয়, তবে তা মানুষের উন্নতি ও অগ্রগতির মাধ্যম হতে পারে। দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ফারুক রাদি.-এর একটি কথার দ্বারাও এ কথার পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়।
📄 সম্পদের দ্বারা আত্মশুদ্ধি
হজরত থানবি রহ. ইরশাদ করেন, আমার বিশেষ দোস্তগণের একজন তার মধ্যকার কিছু খারাপ অভ্যাস দমন করার জন্য বারবার চেষ্টা করেও যখন ব্যর্থ হলেন তখন তিনি বিরক্ত হয়ে প্রবৃত্তির প্রতি শাস্তি হিসেবে প্রতি মাসে একটা বড়ো অঙ্ক সাদকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। এ কথাটি যখন আমি জানতে পারলাম তখন আমি তাকে এমনটি করতে নিষেধ করলাম। বললাম, আপনার একটি পয়সাও খরচ করার অনুমতি নেই। কারণ, আমি জানতাম সে যদি এভাবে সাদকা করতে থাকে তবে সে বড়ো সমস্যায় পড়ে যাবে এবং স্ত্রী-পুত্রের যেসব হক তার দায়িত্বে রয়েছে তাদের সেসব দায়িত্ব আদায়ের ব্যাপারে শিথিলতা এসে যাবে।৭
টিকাঃ
৩. ২৬ শে রবি. সানি, ১৩৫৯ হি.।
📄 একটি উপদেশমূলক ঘটনা
হজরত থানবি রহ. বলেন যে, আমাদের এক মামু যিনি স্বাধীন চিন্তার অধিকারী একজন দরবেশ ছিলেন। তিনি ১৮৫৭ সালের আজাদি আন্দোলনের সময়ের একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। ঘটনাটি হলো নিম্নরূপ :
এক জায়গায় অনেকগুলো লাশ পড়ে ছিল। লোভী প্রকৃতির এক হিন্দু লোক (বানিয়া) দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিল। ওই লাশগুলোর মধ্যে একজন লোক আহত হয়ে মরার মতো পড়ে ছিল। সে ওই হিন্দু লোকটিকে দেখে বলল, ওহে ভাই, একটু এখানে এসো! লোকটি এ কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল। সে ভাবল মরা লাশ আমাকে ডাকছে। সে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে ভেগে পালাতে উদ্যত হলো। ইতিমধ্যে সে আহত লোকটি আবার বলে উঠল, ওহে ভাই, তুমি ভয় পেয়ো না, আমি মরা লাশ নই, আহত হয়েছি মাত্র। আমার তো আর বাঁচার কোনো আশা নেই। আমার কোমরে বাঁধা থলের মধ্যে অনেকগুলো টাকা আছে। আমার ইচ্ছা হলো, এ টাকা তো আমার কোনো কাজে আসবে না; কারণ, আমি তো কিছুক্ষণের মধ্যেই মরে যাব। সুতরাং টাকাগুলো তোমাকে দিয়ে দেবো। তুমি এগুলো কাজে লাগাতে পারবে।
টাকার কথা শুনে লোকটি গলে গেল এবং ভয়ে ভয়ে সে ওই আহত লোকটির কাছে গেল। সে যখন আহত লোকটির কাছে এসে গেল তখন আহত লোকটি দ্রুত তরবারি হাতে নিয়ে এক আঘাতে ওই লোকটির একটা ঠ্যাং কেটে ফেলল। সাথে সাথে লোকটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু মাটিতে পড়েও লোকটি ওই আহত লোকটির কোমর হাতাতে লাগল। তার ইচ্ছা হলো, টাকাগুলো তো আগে হাতে নিয়ে নিই। এবার আহত লোকটি বলল, আরে মশাই, তুমি তো দেখছি একটা বদ্ধ পাগল, যুদ্ধের ময়দানে কি কেউ কোমরে টাকা বেঁধে নিয়ে আসে!
আসল কথা হলো, আমার আশেপাশে যারা পড়ে আছে তারা সবাই মরা লাশ, আমিই শুধু একা জীবিত আছি, রাত হয়ে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম, যদি আলাপ-আলোচনা করার জন্য একজন লোক আমার সাথে থাকত তবে রাতটা কাটানো অনেক সহজ হয়ে যেত। আমি যদি তোমাকে এমনিতেই বলতাম যে, ভাই আমার সাথে তুমি রাতে এখানে থাকো, তাহলে তুমি তো ধেয়ে কুল পেতে না। আমি একটু মানসিক প্রশান্তির জন্য তোমাকে আমার সাথি বানিয়ে নিলাম। হিন্দু লোকটি রেগে কটমটিয়ে বলল, বেটা বজ্জাত কোথাকার! নিজেও চলতে পারবে না, অন্যকেও চলতে দেবে না।
মামুজান এ ঘটনার বর্ণনা করে বললেন, বর্তমানে আল্লাহ পাকের রাস্তার ব্যাপারে মানুষের অবস্থা এরূপই হয়ে গেছে যে, সে নিজে তো আল্লাহর পথে চলবেই না, অন্য কেউ চলতে চাইলে তার পথেও বাধা সৃষ্টি করে দেবে।