📄 অপর এক ছাত্রের ঘটনা
সম্ভবত আলিগড়ের একজন ছাত্র হজরত থানবি রহ.-এর বরাবরে পত্র লিখল যে, আমি আপনার খেদমতে হাজির হতে চাই, কিন্তু আমার সুরত এবং লেবাস-পোশাক ইত্যাদি সবই শরিয়ত পরিপন্থি। এ ছাড়া আমার আমল তো শরিয়তের খেলাফ আছেই। আপনি যদি আমাকে অনুমতি দেন তাহলে আমি আপনার দরবারে আসতে চাই।
ছাত্রটির এ পত্রের জবাবে হজরত থানবি রহ. তাকে জানালেন, আপনার চিঠি পেয়ে জানলাম যে, আমলের বিবেচনায় আপনার জাহির বা বাহ্যিক অবস্থা খারাপ। আর আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে এ কথা জানি যে, আমার বাতেন বা ভেতরগত হালত খারাপ, সুতরাং আমাদের দুজনের রোগই ভিন্ন। যদি আমাদের উভয়ের রোগ একই রকম হতো তবে আমরা মিলতে পারতাম, সুতরাং এমতাবস্থায় আপনাকে কষ্ট দেওয়া আমি উচিত মনে করি না।
এ দুটি ঘটনাই হজরত থানবি রহ. নিজেই আমাদেরকে শোনালেন এবং বললেন যে, প্রথম ছাত্রের চিঠি পাওয়ার পর আল্লাহ পাক আমার মনে এমন একটি খেয়াল ও ভাব সৃষ্টি করে দিলেন, যা থেকে আমার মনে হলো, এ লোকটি আমার কাছে এলে সে উপকৃত হবে এবং আশা করা যায় যে, তার মধ্যে সংশোধনী আসবে, তাই তাকে আসার অনুমতি দিয়েছি। আর দ্বিতীয় ছাত্রের চিঠি পাওয়ার পর মনে খেয়াল হলো যে, এখানে আসলে লোকটির কোনো ফায়দা বা উপকার হবে এমনটি আশা করা যায় না, এ জন্য তাকে নিষেধ করে দিয়েছি। তবে এখানে এ কথাটি বিশেষভাবে লক্ষ করা ও স্মরণ রাখার মতো যে, লোকটিকে হজরত হাকিমুল উম্মত রহ.-এর দরবারে আসতে নিষেধ করার ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি এবং ধারা তিনি অবলম্বন করেছেন সেখানে ওই লোকটির সম্মানের প্রতিও লক্ষ রাখা হয়েছে। যাতে তার মন না ভাঙে এবং তার প্রতি যাতে কোনো দোষারোপ করা না হয়। সাথে সাথে নিজের নফসেরও কিছুটা ইসলাহের দিক এতে নিহিত রয়েছে। কারণ, এখানে নিজের খুব পবিত্রতা বা নিজে খুব নেককার হওয়ার দাবিও করা হয়নি। হজরত থানবি রহ.-এর প্রায় কথাতেই এ ধরনের সূক্ষ্ম দিকগুলোকে লক্ষ রাখার বিষয়টি পরিলক্ষিত হতো, যা সকলের পক্ষে সহজ নয়।
📄 আল্লামা শিবলি নুমানি রহ.-এর কথা
হজরত থানবি রহ. বলেন, হজরত উবাইদুল্লাহ সিন্ধি রহ. যখন দিল্লিতে 'নিজারাতুল মাআরিফ' নামক প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন তিনি একবার থানাভবন এসেছিলেন। তিনি বলেন, আমি আল্লামা শিবলি নুমানির সাথে সাক্ষাৎ করেছি এবং তার সাথে ব্যাপকভাবে মুসলমানদের পথভ্রষ্টতা, তাদের অস্থিরতা এবং বিভিন্ন বিপদাপদে লিপ্ত হয়ে পড়ার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। আমি (মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধি) তাকে জিজ্ঞাসা করেছি, আপনার দৃষ্টিতে জাতির ইসলাহ বা সংশোধনের উপায় কী?
আল্লামা শিবলি নুমানি জবাবে বললেন, জাতির সংশোধন শুধু তারাই করতে পারেন জাতির ওপর যাদের পরিপূর্ণ প্রভাব রয়েছে এবং যাদের প্রতি জাতির প্রতিটি নাগরিকের শ্রদ্ধা বিদ্যমান আছে। আর এই প্রভাব এবং শ্রদ্ধা প্রতিষ্ঠা করা নিজের মধ্যে সার্বিক পরিচ্ছন্নতা ছাড়া সম্ভব নয়। আর এ সার্বিক পরিচ্ছন্নতা তাকওয়া, অধিক পরিমাণে ইবাদত এবং আল্লাহর জিকির ছাড়া সৃষ্টি হতে পারে না।
📄 হজরত জুনাইদ বাগদাদি রহ.-এর ঘটনা
একবার হজরত জুনাইদ বাগদাদি রহ. দেখতে পেলেন যে, এক ব্যক্তিকে শূলীর ওপর চড়ানো হয়েছে। তিনি লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, সে কী অপরাধ করেছে? লোকেরা জবাব দিলো, এ ব্যক্তি ডাকাত। প্রথমবার চুরি করার পর সে অপরাধে তার ডান হাত কাটা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও সে চুরি করা থেকে বিরত হয়নি। ফলে পুনরায় চুরি করে ধরা পড়ায় তার বাম পা কেটে দেওয়া হয়েছে। এর পরও যখন সে চুরি করা থেকে বিরত হয়নি; বরং পুনরায় চুরি করে ধরা পড়েছে, সুতরাং এবার নিয়মমতে তার শূলীতে চড়ার পালা, তাই তাকে শূলীতে চড়ানো হয়েছে।
এ কথা শুনে হজরত জুনাইদ রহ. সামনে বাড়লেন এবং তার পা নিজের চোখের সাথে লাগিয়ে চুমু খেলেন। এ দৃশ্য দেখে লোকেরা অস্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করল, হজরত, আপনি এ কী করছেন? হজরত জুনাইদ রহ. তখন জবাব দিলেন যে, আমি তার পা চুম্বন করিনি, বরং তার অবিচলতা ও দৃঢ়তাকেই চুম্বন করেছি, যা তার অভ্যন্তরে রয়েছে। যদিও এ অজ্ঞ লোকটি তার সে দৃঢ়তাকে অপরাধ ও গুনাহের কাজে ব্যয় করেছে এবং সেমতে সে শাস্তিও পেয়ে গেছে; কিন্তু আমি চিন্তা করছি যে, কতই-না সুন্দর হতো যদি ভালো ও সওয়াবের কাজে আমারও এ ধরনের দৃঢ়তা ও অবিচলতা নসিব হতো।
সুবহানাল্লাহ! ওই সকল বুজুর্গানে দীনের দৃষ্টি কত গভীর ছিল। যার ফলে তারা প্রত্যেক বিষয়ের সীমা সর্বাবস্থায় জানতে পারতেন। যার সারকথা এই দাঁড়ায় যে, মানুষের অভ্যন্তরে যেসব যোগ্যতা ও চাহিদা দিয়ে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তার প্রত্যেকটাই যোগ্যতা হিসেবে প্রশংসনীয় হলেও তাকে অন্যায় পথে কিংবা অপরাধ বা গুনাহের কাজে ব্যবহার করা হলে তা গুনাহের কারণ হয়ে যায়। ঠিক সে যোগ্যতাকেই যদি ভালো কাজে এবং ভালো পথে ব্যবহার করা হয়, তবে তা মানুষের উন্নতি ও অগ্রগতির মাধ্যম হতে পারে। দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ফারুক রাদি.-এর একটি কথার দ্বারাও এ কথার পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়।
📄 সম্পদের দ্বারা আত্মশুদ্ধি
হজরত থানবি রহ. ইরশাদ করেন, আমার বিশেষ দোস্তগণের একজন তার মধ্যকার কিছু খারাপ অভ্যাস দমন করার জন্য বারবার চেষ্টা করেও যখন ব্যর্থ হলেন তখন তিনি বিরক্ত হয়ে প্রবৃত্তির প্রতি শাস্তি হিসেবে প্রতি মাসে একটা বড়ো অঙ্ক সাদকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। এ কথাটি যখন আমি জানতে পারলাম তখন আমি তাকে এমনটি করতে নিষেধ করলাম। বললাম, আপনার একটি পয়সাও খরচ করার অনুমতি নেই। কারণ, আমি জানতাম সে যদি এভাবে সাদকা করতে থাকে তবে সে বড়ো সমস্যায় পড়ে যাবে এবং স্ত্রী-পুত্রের যেসব হক তার দায়িত্বে রয়েছে তাদের সেসব দায়িত্ব আদায়ের ব্যাপারে শিথিলতা এসে যাবে।৭
টিকাঃ
৩. ২৬ শে রবি. সানি, ১৩৫৯ হি.।