📘 আকাবিরদের জ্ঞান সাধনার গল্প > 📄 একজন কলেজ ছাত্রের কাহিনি

📄 একজন কলেজ ছাত্রের কাহিনি


সম্ভবত শিমলা নামক অঞ্চলের কোনো কলেজে একবার হজরত থানবি রহ.-এর বয়ান হলো। যার শ্রোতা ছিল কলেজের ছাত্র ও শিক্ষকগণ। সে বয়ানে হজরত থানবি রহ. আধুনিক শিক্ষা দ্বারা সৃষ্ট বিভিন্ন সংশয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন; যা ইসলামের মৌলিক ও শাখা বিষয়সমূহ সম্পর্কে অধিকাংশ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের মনে সৃষ্টি হয়ে থাকে।

হজরত থানবি রহ. বলেন, ওইসব সংশয়-সন্দেহ ও প্রশ্নসমূহ সৃষ্টি হওয়ার জন্য শুধু শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যসূচিই দায়ী নয়; বরং এর একটি অন্যতম বড়ো কারণ হচ্ছে, ওসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বদদীনি পরিবেশ। যে পরিবেশের মধ্যে থেকেই আমাদের নবপ্রজন্ম লালিত-পালিত হয়। যার ফলে তাদের অন্তর থেকে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওই মাহাত্ম্য ও মহব্বত শেষ হয়ে যায়, যা একজন মানুষের ইমানদার হওয়ার জন্য আবশ্যক। আর সে মাহাত্ম্য ও মহব্বত বুজুর্গানে দীনের সংস্পর্শ ও সান্নিধ্যের মাধ্যমে লাভ হতে পারে।

এরপর হজরত থানবি রহ. বলেন, আলহামদুলিল্লাহ বর্তমানে প্রায় সকল জায়গায় কমবেশি বুজুর্গানে দীনের মজলিস হয়ে থাকে। কিছুদিন সে ধরনের মজলিসে কাটানোর অভ্যাস করুন। তাও সম্ভব না হলে অন্তত বন্ধের সময় হতে কিছু সময় সে কাজের জন্য ব্যয় করুন। যদি আধুনিক শিক্ষিতরা এ কাজটি করেন তবে আমি আশা করি তাদের অন্তর থেকে ইসলামের ওপর সৃষ্টি বিভিন্ন সন্দেহ ও প্রশ্ন সমূলে বিদূরিত হয়ে যাবে। এবং নিজের মনেই সে প্রশ্নের সঠিক জবাব এসে যাবে এবং সবকিছু এমনিতেই বুঝে এসে যাবে।

সম্ভবত সে মজলিসে উপস্থিতদের মাঝে একজন ছাত্র প্রশ্ন করল, আমরা শুনেছি আপনার নাকি ইংরেজি শিক্ষিতদের প্রতি চরম ঘৃণা রয়েছে? হজরত থানবি রহ. তখন জবাব দিলেন, কস্মিনকালেও না, ওই লোকদের প্রতি আমার কোনো ঘৃণা নেই; তবে তাদের কিছু আচরণ ও কাজ-কর্মের প্রতি আমার ঘৃণা রয়েছে, যেগুলো শরিয়ত-পরিপন্থি। লোকটি পুনরায় প্রশ্ন করল, সে কাজ-কর্মগুলো কী? হজরত থানবি রহ. জবাব দিলেন, বিভিন্ন লোকের বিভিন্ন কাজ রয়েছে। সকলের কাজ এক রকম নয়। লোকটি ছিল খুবই আজাদ প্রকৃতির। সে আবারও প্রশ্ন করল, যেমন: আমার মধ্যে কী কী কাজ রয়েছে, যা আপনার দৃষ্টিতে অপছন্দ বা ঘৃণার কারণ। বর্তমানকালের ছাত্রদের অবস্থামতে সে লোকটিরও দাড়ি একেবারে পরিষ্কারভাবে মুণ্ডানো ছিল। হজরত থানবি রহ. বললেন, কিছু কিছু বিষয় তো আপনার মাঝে আছে যা পরিষ্কারভাবে প্রকাশিত রয়েছে; কিন্তু এত লোকের মজলিসে তা প্রকাশ করতে আমার শরম হচ্ছে। আর কিছু আছে যা দেখা যায় না, সুতরাং আপনার সামগ্রিক অবস্থা ও আচার-আচরণ সম্পর্কে না জেনে তার ওপর কোনো মন্তব্য করা তো সম্ভব নয়।

এরপর সে মজলিস শেষ হয়ে গেল। হজরত থানবি রহ. থানাভবন ফিরে এলেন। অতঃপর একবার যখন কলেজ বন্ধ হলো তখন একজন ছাত্রের একটা চিঠি এলো। এ কথা আমার (সংকলক) স্মরণ নেই যে, হজরত রহ.-কে যে ছাত্র প্রশ্ন করেছিল এ চিঠি কি সেই পাঠিয়েছিল, না অন্য (কেউ)। চিঠিতে লেখা ছিল, বর্তমানে আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠন বন্ধ, তাই আমি আপনার বলে দেওয়া পদ্ধতি অনুযায়ী কিছুদিন আপনার খেদমতে থাকতে চাই। কিন্তু আমার বাহ্যিক আকার-আকৃতি যেমন শরিয়ত মুতাবিক নেই, তেমনই আমার কাজ-কর্ম ও আমলের মাঝেও অনেক গড়বড় রয়েছে। এ অবস্থায় যদি আমাকে আসার জন্য অনুমতি দেওয়া হয় তবে অবশ্যই আমি উপস্থিত হয়ে যাব।

হজরত থানবি রহ. এ চিঠির জবাবে লিখলেন, যে অবস্থায় আছেন সে অবস্থায়ই চলে আসুন। অন্য কোনো চিন্তা করবেন না। জবাব পেয়ে সে ছাত্র হজরত থানবি রহ.-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে গেল। এবং বলল, আমার অনেক সংশয় ও প্রশ্ন আছে, বিষয়গুলো সম্পর্কে আমি আপনার কাছ থেকে জেনে নিতে চাই। হজরত থানবি রহ. তার এ কথার জবাবে বললেন, হাঁ, বিষয়গুলো ঠিকই জেনে নেওয়া দরকার, তবে সে জন্য পদ্ধতি হবে এই যে, আপনার যতগুলো সংশয় ও প্রশ্ন রয়েছে সেগুলো সব একত্রে লিখে নিতে হবে। এরপর আপনি আমার মজলিসে বসে নিশ্চুপভাবে আমার কথা শুনতে থাকবেন। কোনো প্রশ্ন করবেন না। এরপর আপনার এখান থেকে বিদায় নেওয়ার যখন তিন দিন বাকি থাকবে তখন আপনি আপনার প্রশ্নের বিষয়টি আমাকে স্মরণ করিয়ে দেবেন, আমি আপনাকে প্রশ্ন করে উত্তর জেনে নেওয়ার জন্য স্বতন্ত্রভাবে সময় দেব। হজরত থানবি রহ. তাকে এ কথাও বলে দিলেন যে, এখন আপনি যে প্রশ্নগুলো লিখে আপনার কাছে রাখবেন, আমার এখানে অবস্থানকালীন এমনিতেই যদি কোনো প্রশ্নের উত্তর আপনি পেয়ে যান বা বিষয়টি যদি আপনার বুঝে এসে যায়, তবে সে প্রশ্নটি ওই তালিকা থেকে কেটে দেবেন।

হজরত থানবি রহ.-এর কথামতো ছাত্রটি সেভাবেই সবকিছু করল। এরপর বিদায়ের তিন দিন পূর্বে হজরত থানবি রহ. যখন তাকে প্রশ্ন করার সময় দিলেন তখন ওই ছাত্রটি হজরত থানবি রহ.-কে জানাল যে, আমার প্রশ্নসমূহের তালিকা অনেক দীর্ঘ ছিল, কিন্তু হজরতের দরবারে অবস্থানকালীন বিভিন্ন মজলিসে হজরতের বয়ান ও বক্তব্য শুনে শুনে তার মধ্যকার অনেক প্রশ্নের জবাব আমি এমনিতেই পেয়ে গেছি। যখন যে প্রশ্নের জবাব বুঝতে পেরেছি তখন সেটা কেটে দিয়েছি। এভাবে কাটতে কাটতে এখন মাত্র অল্প কয়েকটা প্রশ্ন বাকি আছে। সে হজরত থানবি রহ.-এর খেদমতে সে প্রশ্নগুলো পেশ করল এবং খুব সহজভাবেই হজরত থানবি রহ. তাকে তার উত্তর বুঝিয়ে দিলেন। এবং লোকটি তার প্রশ্নসমূহের সন্তোষজনক উত্তর পেয়ে পরিপূর্ণ আত্মতৃপ্তি নিয়ে সেখান থেকে বিদায় নিলো।

📘 আকাবিরদের জ্ঞান সাধনার গল্প > 📄 অপর এক ছাত্রের ঘটনা

📄 অপর এক ছাত্রের ঘটনা


সম্ভবত আলিগড়ের একজন ছাত্র হজরত থানবি রহ.-এর বরাবরে পত্র লিখল যে, আমি আপনার খেদমতে হাজির হতে চাই, কিন্তু আমার সুরত এবং লেবাস-পোশাক ইত্যাদি সবই শরিয়ত পরিপন্থি। এ ছাড়া আমার আমল তো শরিয়তের খেলাফ আছেই। আপনি যদি আমাকে অনুমতি দেন তাহলে আমি আপনার দরবারে আসতে চাই।

ছাত্রটির এ পত্রের জবাবে হজরত থানবি রহ. তাকে জানালেন, আপনার চিঠি পেয়ে জানলাম যে, আমলের বিবেচনায় আপনার জাহির বা বাহ্যিক অবস্থা খারাপ। আর আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে এ কথা জানি যে, আমার বাতেন বা ভেতরগত হালত খারাপ, সুতরাং আমাদের দুজনের রোগই ভিন্ন। যদি আমাদের উভয়ের রোগ একই রকম হতো তবে আমরা মিলতে পারতাম, সুতরাং এমতাবস্থায় আপনাকে কষ্ট দেওয়া আমি উচিত মনে করি না।

এ দুটি ঘটনাই হজরত থানবি রহ. নিজেই আমাদেরকে শোনালেন এবং বললেন যে, প্রথম ছাত্রের চিঠি পাওয়ার পর আল্লাহ পাক আমার মনে এমন একটি খেয়াল ও ভাব সৃষ্টি করে দিলেন, যা থেকে আমার মনে হলো, এ লোকটি আমার কাছে এলে সে উপকৃত হবে এবং আশা করা যায় যে, তার মধ্যে সংশোধনী আসবে, তাই তাকে আসার অনুমতি দিয়েছি। আর দ্বিতীয় ছাত্রের চিঠি পাওয়ার পর মনে খেয়াল হলো যে, এখানে আসলে লোকটির কোনো ফায়দা বা উপকার হবে এমনটি আশা করা যায় না, এ জন্য তাকে নিষেধ করে দিয়েছি। তবে এখানে এ কথাটি বিশেষভাবে লক্ষ করা ও স্মরণ রাখার মতো যে, লোকটিকে হজরত হাকিমুল উম্মত রহ.-এর দরবারে আসতে নিষেধ করার ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি এবং ধারা তিনি অবলম্বন করেছেন সেখানে ওই লোকটির সম্মানের প্রতিও লক্ষ রাখা হয়েছে। যাতে তার মন না ভাঙে এবং তার প্রতি যাতে কোনো দোষারোপ করা না হয়। সাথে সাথে নিজের নফসেরও কিছুটা ইসলাহের দিক এতে নিহিত রয়েছে। কারণ, এখানে নিজের খুব পবিত্রতা বা নিজে খুব নেককার হওয়ার দাবিও করা হয়নি। হজরত থানবি রহ.-এর প্রায় কথাতেই এ ধরনের সূক্ষ্ম দিকগুলোকে লক্ষ রাখার বিষয়টি পরিলক্ষিত হতো, যা সকলের পক্ষে সহজ নয়।

📘 আকাবিরদের জ্ঞান সাধনার গল্প > 📄 আল্লামা শিবলি নুমানি রহ.-এর কথা

📄 আল্লামা শিবলি নুমানি রহ.-এর কথা


হজরত থানবি রহ. বলেন, হজরত উবাইদুল্লাহ সিন্ধি রহ. যখন দিল্লিতে 'নিজারাতুল মাআরিফ' নামক প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন তিনি একবার থানাভবন এসেছিলেন। তিনি বলেন, আমি আল্লামা শিবলি নুমানির সাথে সাক্ষাৎ করেছি এবং তার সাথে ব্যাপকভাবে মুসলমানদের পথভ্রষ্টতা, তাদের অস্থিরতা এবং বিভিন্ন বিপদাপদে লিপ্ত হয়ে পড়ার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। আমি (মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধি) তাকে জিজ্ঞাসা করেছি, আপনার দৃষ্টিতে জাতির ইসলাহ বা সংশোধনের উপায় কী?

আল্লামা শিবলি নুমানি জবাবে বললেন, জাতির সংশোধন শুধু তারাই করতে পারেন জাতির ওপর যাদের পরিপূর্ণ প্রভাব রয়েছে এবং যাদের প্রতি জাতির প্রতিটি নাগরিকের শ্রদ্ধা বিদ্যমান আছে। আর এই প্রভাব এবং শ্রদ্ধা প্রতিষ্ঠা করা নিজের মধ্যে সার্বিক পরিচ্ছন্নতা ছাড়া সম্ভব নয়। আর এ সার্বিক পরিচ্ছন্নতা তাকওয়া, অধিক পরিমাণে ইবাদত এবং আল্লাহর জিকির ছাড়া সৃষ্টি হতে পারে না।

📘 আকাবিরদের জ্ঞান সাধনার গল্প > 📄 হজরত জুনাইদ বাগদাদি রহ.-এর ঘটনা

📄 হজরত জুনাইদ বাগদাদি রহ.-এর ঘটনা


একবার হজরত জুনাইদ বাগদাদি রহ. দেখতে পেলেন যে, এক ব্যক্তিকে শূলীর ওপর চড়ানো হয়েছে। তিনি লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, সে কী অপরাধ করেছে? লোকেরা জবাব দিলো, এ ব্যক্তি ডাকাত। প্রথমবার চুরি করার পর সে অপরাধে তার ডান হাত কাটা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও সে চুরি করা থেকে বিরত হয়নি। ফলে পুনরায় চুরি করে ধরা পড়ায় তার বাম পা কেটে দেওয়া হয়েছে। এর পরও যখন সে চুরি করা থেকে বিরত হয়নি; বরং পুনরায় চুরি করে ধরা পড়েছে, সুতরাং এবার নিয়মমতে তার শূলীতে চড়ার পালা, তাই তাকে শূলীতে চড়ানো হয়েছে।

এ কথা শুনে হজরত জুনাইদ রহ. সামনে বাড়লেন এবং তার পা নিজের চোখের সাথে লাগিয়ে চুমু খেলেন। এ দৃশ্য দেখে লোকেরা অস্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করল, হজরত, আপনি এ কী করছেন? হজরত জুনাইদ রহ. তখন জবাব দিলেন যে, আমি তার পা চুম্বন করিনি, বরং তার অবিচলতা ও দৃঢ়তাকেই চুম্বন করেছি, যা তার অভ্যন্তরে রয়েছে। যদিও এ অজ্ঞ লোকটি তার সে দৃঢ়তাকে অপরাধ ও গুনাহের কাজে ব্যয় করেছে এবং সেমতে সে শাস্তিও পেয়ে গেছে; কিন্তু আমি চিন্তা করছি যে, কতই-না সুন্দর হতো যদি ভালো ও সওয়াবের কাজে আমারও এ ধরনের দৃঢ়তা ও অবিচলতা নসিব হতো।

সুবহানাল্লাহ! ওই সকল বুজুর্গানে দীনের দৃষ্টি কত গভীর ছিল। যার ফলে তারা প্রত্যেক বিষয়ের সীমা সর্বাবস্থায় জানতে পারতেন। যার সারকথা এই দাঁড়ায় যে, মানুষের অভ্যন্তরে যেসব যোগ্যতা ও চাহিদা দিয়ে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তার প্রত্যেকটাই যোগ্যতা হিসেবে প্রশংসনীয় হলেও তাকে অন্যায় পথে কিংবা অপরাধ বা গুনাহের কাজে ব্যবহার করা হলে তা গুনাহের কারণ হয়ে যায়। ঠিক সে যোগ্যতাকেই যদি ভালো কাজে এবং ভালো পথে ব্যবহার করা হয়, তবে তা মানুষের উন্নতি ও অগ্রগতির মাধ্যম হতে পারে। দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ফারুক রাদি.-এর একটি কথার দ্বারাও এ কথার পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়।

লিঙ্ক শেয়ার করুন
close

লিঙ্ক কপি করুন