📘 আকাবিরদের জ্ঞান সাধনার গল্প > 📄 নিরর্থক ও বেহুদা আলোচনা মানুষকে বড়ো গোনাহে লিপ্ত করে

📄 নিরর্থক ও বেহুদা আলোচনা মানুষকে বড়ো গোনাহে লিপ্ত করে


হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া রহ.-এর দরবারে একবার দুজন লোক এলো বাইআত হওয়ার জন্য। তারা মসজিদের হাউজে অযু করতে বসে পরস্পর কথা বলতে শুরু করল। একজন বলল, আমাদের হাউজটি এ হাউজ থেকে অনেক বড়ো। হঠাৎ শাইখ এ কথাটি শুনে ফেললেন। এরপর তারা দুজন শাইখের দরবারে উপস্থিত হলো এবং তাদেরকে বাইআত করার আবেদন জানাল। তখন শাইখ প্রশ্ন করলেন, আপনাদের হাউজটি এখানকার হাউজ থেকে কতটুকু বড়ো? একজন জবাব দিলো, তা তো বলতে পারব না। তখন শাইখ বললেন, যান, বাড়ি গিয়ে মাপঝোক করে আসুন। শাইখের কথামতো তাদের পুনরায় সফর করে নিজেদের বাড়িতে পৌঁছতে হলো। তারা বাড়ি পৌঁছে পরিমাপ করে দেখল যে, তাদের হাউজটি মাত্র এক বিঘত বড়ো। এরপর তারা পুনরায় দরবারে ফিরে এলো এবং জানাল যে, হজরত, আমি পরিমাপ করে এসেছি, সে হাউজটি এ হাউজ থেকে মাত্র এক বিঘত বড়ো। এ কথা শুনে শাইখ বললেন, আপনি তো বলেছিলেন অনেক বড়ো, এক বিঘত বড়ো হলে তা তো অনেক বড়ো হয় না।

আপনাদের এ কথার দ্বারা বোঝা যায় যে, আপনাদের মন-মানসিকতায় সত্য-মিথ্যার ব্যাপারে সতর্কতা নেই, সুতরাং আপনারা এ তরিকতের পথে চলবেন কী করে?

ওপরের বিষয়টি থেকে বোঝা যায় যে, বিশিষ্ট বুজুর্গানে দীনের পদ্ধতি এই ছিল যে, তারা মুরিদদেরকে বিভিন্ন ওজিফা ও নফল আমলের সবক দেওয়ার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক শিক্ষাদান শুরু করার পূর্বে তাদের বাহ্যিক আমলকে দুরস্ত করে নিতেন এবং বিভিন্ন খারাপ স্বভাব থেকে বেঁচে থাকার অভ্যাস সৃষ্টি করাতেন। বর্তমানে অনেক মাশাইখ এসব বিষয় লক্ষ করেন না। যার কারণে ফলাফল এই হয় যে, জিকির-আজকার ও ওজিফা তাদের খুব মশক হয় ঠিক, কিন্তু খারাপ অভ্যাসগুলো আগের মতোই ভেতরে থেকে যায়। হালাল-হারামের পার্থক্য, সত্য-মিথ্যার ব্যাপারে সতর্কতা ইত্যাদি ভালো স্বভাবগুলো ভেতরে আসে না, ফলে তারা তরিকতের দুর্নামের কারণ হয়।

📘 আকাবিরদের জ্ঞান সাধনার গল্প > 📄 লেনদেনের ক্ষেত্রে সতর্কতার শিক্ষা

📄 লেনদেনের ক্ষেত্রে সতর্কতার শিক্ষা


এক ব্যক্তি হজরত রহ.-এর বরাবরে চিঠি লিখল যে, আমি যুবক বুজুর্গের হাতে বাইআত হয়েছি। এমতাবস্থায় একবার আমি খাবে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জিয়ারত লাভ করেছি। তিনি আমাকে বলেছেন, তুমি যে বুজুর্গের হাতে বাইআত হয়েছ, তার সাথে তোমার লৌকিকতামুক্ত অবস্থা খুব বেশি, তাই তার দ্বারা তোমার উপকার হবে না, বিধায় তুমি মাওলানা আশরাফ আলি সাহেবের কাছে গিয়ে তার থেকে শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ করো।

হজরত হাকিমুল উম্মত রহ. এ পত্রের জবাবে লিখলেন, তুমি তোমার বর্তমান শাইখ থেকে তোমার ব্যাপারে আমার কাছে এ কথা লিখিয়ে পাঠাও যে, 'এ লোকটি নির্ভরযোগ্য, তার কথা নির্ভর করার মতো।' (অর্থাৎ, হজরত বলতে চাচ্ছেন যে, তুমি যে খাবের কথা আমার কাছে লিখেছ, তা যে তুমি ঠিকই লিখছ তা আমি বুঝব কীভাবে, এ ব্যাপারে বর্তমান শাইখ যদি আমাকে এ কথা বলে দেন যে, তুমি যা বলবে তা নির্ভর করার মতো; তবেই আমি তোমার কথা বিশ্বাস করে তোমাকে আমার কাছে বাইআত হওয়ার অনুমতি দিতে পারি।)

অনেক ক্ষেত্রেই এরূপ দেখা গেছে যে, অনেকে বুজুর্গানে দীনের নৈকট্যলাভের জন্য বিভিন্ন অবাস্তব ঘটনা ও স্বপ্নের কথা বর্ণনা করে থাকে, যা তাদের নিজেদের জন্য ফিতনার কারণ আর অন্যদের জন্য পেরিশানি ও অস্থিরতার কারণ হয়। হজরত রহ. নিজে এ পদ্ধতির মাধ্যমে সর্বরকম অনিষ্টতার বিষয়গুলো সমূলে বিদূরিত করে রেখেছেন এবং পূর্বের শাইখের অন্তরকে ব্যথিত করা থেকেও রক্ষা করেছেন।

📘 আকাবিরদের জ্ঞান সাধনার গল্প > 📄 প্রত্যেক কাজ সীমার মধ্যে থেকে করার প্রয়োজনীয়তা

📄 প্রত্যেক কাজ সীমার মধ্যে থেকে করার প্রয়োজনীয়তা


হজরত রহ. বলেন, আল্লাহ পাকের খাশিয়্যত ও ভয়ই হলো সকল সৌন্দর্য ও মঙ্গলের উৎসমূল এবং এর ফজিলতও বিরাট। এর পরেও যদি সীমা অতিক্রম করে তবে তা মানুষকে অকর্মণ্য ও বেকার করে দেয়। এ জন্য হাদিসে পাকে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে খাশিয়্যতুল্লাহ বা আল্লাহর ভয় জাগ্রত করার জন্য যে দুআর কথা বর্ণিত হয়েছে, তার মধ্যে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাও বলেছেন—

اللهم اقسم لي من خشيتك ما تحول به بینی و بین معاصيك
আয় আল্লাহ! আপনি আমাকে আপনার খাশিয়্যত ও ভয় এ পরিমাণ দান করুন; যা আমার গুনাহ করার পথে অন্তরায় এ প্রতিবন্ধক হতে পারে।

ওপরের আলোচনায় 'আপনার ভয় এই পরিমাণ দান করুন যা আমার গুনাহ করার ক্ষেত্রে অন্তরায় হতে পারে' বলে যে কথাটি বলা হয়েছে, তা থেকে বোঝা যায় যে, যদি মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায় তবে তা মানুষের সহ্যসীমার ভেতরে থাকে না, ফলে তা মানুষকে বেকার ও অথর্ব বানিয়ে দেয়।

এর মোকাবিলায় আল্লাহ পাকের সাক্ষাৎ লাভ দর্শনাকাঙ্ক্ষাও অনেক বড়ো নিয়ামত। তবে সে ক্ষেত্রে দুআ করার জন্যও হাদিস শরিফের বাক্য নিম্নরূপ :
وضوقا الى لقائك في غير ضراء مضرة ولا فتنة مضلة

অর্থাৎ, আয় আল্লাহ! আমাকে আপনার সাক্ষাৎ লাভ ও দর্শনাকাঙ্ক্ষা দান করুন এবং তা যেন এমন কঠিন রোগ কিংবা কঠিন বিপদ ও ফিতনার কারণ না হয়, যে রোগ বা বিপদের কারণে আমি মওতের আকাঙ্ক্ষা করতে বাধ্য হই।

মহান আল্লাহর সাক্ষাৎ ও দর্শন লাভের পথ তো পরিষ্কার; আর তা হলো ইন্তেকাল। ইন্তেকাল করা ছাড়া এমনটি সম্ভব নয়। এ কারণে মওতকে আল্লাহ পাকের সাক্ষাৎ ও দর্শন লাভের জন্য প্রিয় মনে করাটাও একটা বড়ো নিয়ামত। কিন্তু কোনো কোনো সময় মানুষ কোনো অসহ্য কষ্ট কিংবা বিপদের কারণে মওতের আকাঙ্ক্ষা করতে বাধ্য হয়। সে ধরনের মুসিবত তো প্রশংসনীয় নয়। এ কারণে আল্লাহ পাকের সাক্ষাৎ লাভের আগ্রহের বিষয়টিকেও এ কথাটির সাথে সংশ্লিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।

📘 আকাবিরদের জ্ঞান সাধনার গল্প > 📄 দেওবন্দের বিশিষ্ট মুরব্বিশেষর মাঝে আল্লাহ পাকের ভয় ও বিরোধীদের সাথে আচরণ

📄 দেওবন্দের বিশিষ্ট মুরব্বিশেষর মাঝে আল্লাহ পাকের ভয় ও বিরোধীদের সাথে আচরণ


সাইয়্যেদুত তায়েফাহ বা আধ্যাত্মিক কাফেলার সরদার হজরত মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি রহ. যখন বিদআতি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে খণ্ডনমূলক কিছু পুস্তক লিখলেন, তখন বিদআতি সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে গালিগালাজের ঝড় বইতে লাগল। দু-একজন কট্টর ও প্রসিদ্ধ বিদআতি হজরত গাঙ্গুহি রহ.-এর বিরুদ্ধে বেশ কিছু বইপত্রও লিখল। যার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হজরত গাঙ্গুহি রহ.-এর প্রতি বিভিন্ন কটূক্তি ও গালমন্দে পূর্ণ ছিল। সেসব বইপত্র তারা একের পর এক ধারাবাহিকভাবে প্রচার করে যাচ্ছিল। হজরত গাঙ্গুহি রহ. তখন দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। তখন (হজরত শাইখুল হাদিস মাওলানা মুহাম্মদ জাকারিয়া রহ.-এর পিতা মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া সাহেব কান্ধলভি রহ. হজরত রহ.-এর বিশেষ খাদেম ও হজরতের বিশ্বস্ত ব্যক্তি ছিলেন। যেসব চিঠি হজরত গাঙ্গুহি রহ.-এর বরাবরে আসত সেগুলো তিনি হজরত রহ.-কে পাঠ করে শুনাতেন এবং জবাব লেখার দায়িত্বও তার ওপরই ন্যস্ত ছিল। ওই সব চিঠির সাথে ওই বিদআতিদের লেখা বইপত্রও থাকত। (হজরত রহ.-কে সেগুলো পড়েও শুনানো হতো)। হঠাৎ বেশ কিছুদিন যাবৎ হজরত মাওলানা ইয়াহইয়া সাহেব ওই ধরনের কোনো বইপত্র হজরত রহ.-কে পড়ে শুনাচ্ছেন না দেখে হজরত গাঙ্গুহি রহ. জিজ্ঞাসা করলেন, 'মৌলভী ইয়াহইয়া! আমার বন্ধুরা কি এখন আমাকে স্মরণ করা ছেড়ে দিয়েছে? অনেক দিন হলো তাদের কোনো চিঠিপত্র আসছে না যে? তখন মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া সাহেব আরজ করলেন যে, ওদের বই তো বেশ কয়েকটাই এসেছে, কিন্তু সেগুলো আমার পড়তে ইচ্ছে করে না। হজরত রহ. জানতে চাইলেন, কেন? তখন মাওলানা ইয়াহইয়া সাহেব বললেন, এগুলো তো গালিগালাজে পূর্ণ। এ কথা শুনে প্রথমে হজরত রহ. বললেন, আরে মিয়া, দূর থেকে গালি দিলে তাও কি মানুষের গায়ে লাগে নাকি? এরপর তিনি বললেন, সে বই ও চিঠিগুলো আমাকে অবশ্যই পাঠ করে শোনাও। আমরা তো এ নিয়তে শুনব যে, তার মধ্যে কোনো কথা যদি গ্রহণযোগ্য হয় তবে তা গ্রহণ করব; আর সঠিক অর্থেই যদি তারা আমারেদ কোনো ভুলের ব্যাপারে সতর্ক করে থাকে তবে সেমতে আমরা নিজেদের সংশোধন করে নেব।

এরাই হলেন সত্যসন্ধানী, আল্লাহভীরু আলেম। যাদের কারও সাথে কোনো মতপার্থক্যের সৃষ্টি হলে তাও হতো একমাত্র আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির জন্য এবং যারা বিরুদ্ধবাদীদের গালমন্দের সময়ও প্রতিশোধস্পৃহা এবং নিজের পক্ষ থেকে প্রতিরোধ ও বিভিন্ন তাবিল বা ব্যাখ্যা খোঁজ করার পরিবর্তে নিজের শুদ্ধি ও সত্যানুসন্ধানের পথ খুঁজে নেন।

ওইসব লোক কত বড়ো জালিম, যারা এ সকল বুজুর্গানে দীনের ওপর বিভিন্ন অপবাদ লাগিয়ে তাদের দুর্নাম ছড়িয়েছে এবং সাধারণ লোকদেরকে তাদের লেখা বইপত্র পড়তে এবং তাদের সান্নিধ্যে গমন করতে বারণ করছে। একটা বাস্তব কথা হচ্ছে, যারা শুধু দূরে বসে বুজুর্গানে দীনের প্রতি বদনাম-দুর্নাম ও কুধারণা করে বসে থাকেনি, বরং তাদের কাছে এসে তাদের সংস্পর্শ লাভ করেছে, তাদের লেখা বইপত্র ইনসাফের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পাঠ করেছে, তারা এমনিতেই তাদের সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে। তাদের ভুল ধারণাও ভেঙে গেছে। বিভিন্ন মতপার্থক্যের ক্ষেত্রে যদি এ পন্থা অবলম্বন করা হয়, তবে মুসলমানদের মধ্যকার পারস্পারিক লড়াই-ঝগড়ার ফিতনা-ফ্যাসাদ আর বাকি থাকতে পারে না। মতপার্থক্যও তার নির্ধারিত সীমার মধ্যে সীমিত থাকতে পারে। কিন্তু এ জন্য প্রয়োজন আল্লাহ পাকের ভয় ও অহংকারমুক্ত হৃদয়। বর্তমানে যার ব্যাপক অভাব ও দুর্ভিক্ষ লক্ষ করা যাচ্ছে।

লিঙ্ক শেয়ার করুন
close

লিঙ্ক কপি করুন