📄 সময়ের তুলনায় কাজ অনেক বেশি। সময় নিরপেক্ষ হয়ে বসে থাকে না। সে হয়তো খাঁটি বন্ধু নয়তো ভয়ানক শত্রু
ইসলাম তার অনেক নির্দেশাবলি ও নিষেধাজ্ঞাসমূহে সময়ের মূল্যের প্রতি লক্ষ রেখেছে। ইসলাম যখন অনর্থক কাজ থেকে বিরত থাকাকে ইমানের নিদর্শন সাব্যস্ত করেছে, তখন বেকার ও উদাসীন লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণায়ও বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে। যারা একে অপরকে ডাকে আর বলে, এসো বিনোদনের মাধ্যমে সময় কাটাই। অথচ এই বোকাগুলো জানে না যে, এটা হলো জীবন নিয়ে খেলা করা। এভাবে সময় কাটানো ব্যক্তিকে ধ্বংস করার নামান্তর এবং সমাজকে নষ্ট করার উপায়। একটি প্রাজ্ঞ কথা যা মানুষের হৃদয় থেকে উধাও হয়ে যায় তা হলো:
সময়ের তুলনায় কাজ অনেক বেশি। সময় নিরপেক্ষ হয়ে বসে থাকে না। সে হয়তো খাঁটি বন্ধু নয়তো ভয়ানক শত্রু।
হাসান বসরি রহ.-এর একটি অন্যতম বাণী হলো, প্রতিদিন সুবহে সাদেক হওয়ার সাথে সাথে আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ঘোষক ঘোষণা দেয়, হে আদমসন্তান! আমি এক নবীন সৃষ্টি। আমি তোমার আমলের সাক্ষী। কাজেই আমার থেকে সৎকর্মের মাধ্যমে পাথেয় সংগ্রহ করে নাও। কারণ, আমি কিয়ামত পর্যন্ত আর ফিরে আসব না।
এই প্রাজ্ঞ বাণীসমূহ ইসলামের অন্তর্নিহিত উৎস থেকে নির্গত। এবং ইহজীবন থেকে (পরকালের) বৃহৎ জীবনে জন্য উপকার লাভ করার ব্যাপারে ইসলামের মহান শিক্ষা হৃদয়ঙ্গম করা থেকে উৎসারিত। বান্দার অন্তরে তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগানোর ও এক প্রচেষ্টা থেকে আরেক প্রচেষ্টার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করার ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া আল্লাহর বিশেষ দান ও তার তাওফিকের প্রমাণ।
এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, সাধারণ মানুষ তাদের সময়গুলো বেকার নষ্ট করতে দ্বিধাবোধ করে না। এবং এই অপরাধের সাথে আরেকটি অপরাধ করে থাকে। তা হলো, অন্যের সময়ের ওপর আক্রমণ করে সেগুলোকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। তারা কর্মপ্রিয় লোকদের কাছে তাদের একান্ত কাজের সময়ে ঢুকে যায় তাদেরকে মূল্যহীন কাজে জড়িয়ে দেওয়ার জন্য।
📄 দীন ও দুনিয়ার প্রত্যেক কাজে নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করার গুরুত্ব
রাসুল সা. সত্যই বলেছেন যে:
"نعمتان مغبون فيهما كثير من الناس : الصحة والفراغ
দুটি নিয়ামত এমন যাতে অধিকাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি হলো সুস্থতা, আরেকটি হলো মুক্ত সময়। -বুখারি ও মুসলিম
ইসলাম যে সময়কে উত্তম পন্থায় কাজে লাগানোর শিক্ষা দিয়েছে, এর অন্যতম প্রমাণ হলো, সে একটি কাজ সদা করার নির্দেশ দিয়েছে, যদিও কাজটি সামান্য হয়। এবং বিচ্ছিন্নরূপে অধিক কাজ করাকে অপছন্দ করেছে। কেননা, অল্প কাজ সব সময় করা ধারণাতীতরূপে সামান্য কাজকেও পাহাড়সম বানিয়ে দেয়। পক্ষান্তরে হঠাৎ চরম আগ্রহ জাগল আর জানপ্রাণ দিয়ে অধিক পরিমাণে সেটা করতে শুরু করল; কিছুদিন পর ক্লান্ত হয়ে একদম সব ছেড়ে দিয়ে বসে থাকল-ইসলাম এটা পছন্দ করে না।
ইসলাম যে সময় সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্বারোপ করে-এর আরেকটি প্রমাণ হলো, ইসলাম সকাল সকাল কাজ করার জন্য উৎসাহিত করে। ইসলাম চায়, প্রতিটি মুসলিম তার দিনের কাজগুলো শুরু করুক পূর্ণ উদ্যম ও আগ্রহের সাথে, পূর্ণ দৃঢ়তার সাথে। কেননা, দিনের প্রথমভাগ দ্বারা উপকৃত হওয়ার আগ্রহ বাকি দিনটা বেকার নষ্ট না করার প্রচণ্ড আগ্রহ সৃষ্টি করবে।
ইসলামি জীবনব্যবস্থা দিনের শুরুটা নির্ধারণ করে ফজর থেকে। সূর্যোদয়ের আগেই পূর্ণ জাগরণকে ফরজ সাব্যস্ত করে। এমন রাত্রিজাগরণকে অপছন্দ করে, যা ফজরের নামাজকে টাইম ছাড়া করে। হাদিস শরিফে আছে-
اللَّهُمَّ بَارِكْ لِأُمَّتِي فِي بُكُورِهَا
হে আল্লাহ! আমার উম্মতকে দিনের অগ্রভাগে বরকত দান করো।
এটা অত্যন্ত উদাসীনতা ও বঞ্চনার কারণ যে, একদল লোক সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমাবে আর সূর্য উদিত হবে এমতাবস্থায় যে, তারা ঘুমের ঘোরে অচেতন থাকবে। অথচ তখন আরেকটি দল তাদের জীবনোপকরণ ও আখেরাতের কল্যাণ সন্ধানে নিমজ্জিত রয়েছে। হজরত ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-
عَنْ فَاطِمَةَ بِنْتِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَتْ: مَرَّ بِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَنَا مُضْطَجِعَةٌ مُتَصَبِّحَةٌ، فَحَرَّكَنِي بِرِجْلِهِ، ثُمَّ قَالَ: " يَا بُنَيَّةُ قَوْمِي اشْهَدِي رِزْقَ رَبِّكِ، وَلَا تَكُونِي مِنَ الْغَافِلِينَ، فَإِنَّ اللَّهَ يَقْسِمُ أَرْزَاقَ النَّاسِ مَا بَيْنَ طُلُوعِ الْفَجْرِ إِلَى طُلُوعِ الشَّمْسِ
একদা রাসুল সা. আমার পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন, তখন আমি সকাল বেলায় শুয়ে ঘুমাচ্ছিলাম। তিনি স্বীয় পা মুবারক দ্বারা আমাকে নাড়া দিলেন। এরপর বললেন, হে বৎস! উঠো, তোমার রবের রিজিক অবলোকন করো। তুমি উদাসীনদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। কেননা, আল্লাহ তায়ালা সুবহে সাদেক ও সূর্যোদয়ের মধ্যবর্তী সময়ে মানুষের রিজিক বণ্টন করেন। -শুআবুল ইমান লিল-বায়হাকি
তখন অলস ও কর্মঠদের মাঝে পার্থক্য রচনা করা হয়। প্রত্যেক ব্যক্তিকেই তার যোগ্যতা অনুসারে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ প্রদান করা হয়।
জীবনটা অত্যন্ত খাটো। আর বর্তমান কাল-যার আওতায় মানুষ জীবনযাপন করছে-অত্যন্ত সংকীর্ণ। বুখারি ও মুসলিম শরিফে বর্ণিত হাদিসে আছে—
يَا أَيُّهَا النَّاسُ، خُذُوا مِنَ الأَعْمَالِ مَا تُطِيقُونَ، فَإِنَّ اللَّهَ لَا يَمَلُّ حَتَّى تَمَلُّوا، وَإِنَّ أَحَبَّ الْأَعْمَالِ إِلَى اللَّهِ مَا دَامَ وَإِنْ قَلَّ
রাসুল সা. বলেছেন, হে লোকসকল! তোমরা সাধ্যমতো আমল করো। কারণ, আল্লাহ বিরক্ত হন না যতক্ষণ তোমরা বিরক্ত না হও। আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল সেটাই যা সব সময় হয়; যদিও পরিমাণে অল্প হয়। -বুখারি, মুসলিম
যুগ একটি অলৌকিক বিষয়। কোনো মেধা তার আসল তত্ত্ব উদ্ঘাটনে সক্ষম নয়। আমরা কেবল বস্তুর ওপর তার প্রভাব দেখেই তাকে চিনতে পারি। সম্ভবত নশ্বরতা ও অবিনশ্বরতার রহস্য তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে। যিনি যুগ ও কালের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বিষয়াবলি সম্পর্কে অবগত, কেবল তিনিই তাকে ভালো করে চিনেন।
হজরত রহ. বলেন, দুনিয়ার কোনো কাজের মধ্যে যদি বিশৃঙ্খলা এবং অনিয়ম করা হয়, যেমন এক জায়গার জিনিস অন্য জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখে দিলো, খানাপিনার ব্যাপারে সামঞ্জস্যতা ও নিয়মের প্রতি লক্ষ রাখা হলো না, এমনটি যেমন দুনিয়ার বিচারে ক্ষতিকর তেমনইভাবে বিশৃঙ্খলা ও অনিয়ম আত্মিক বা বাতেনি কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রেও ক্ষতিকর।
এক বুজুর্গের ঘটনা, সে বুজুর্গের দরবারের নিয়ম ছিল, যখন কেউ তার কাছে মুরিদ হওয়ার জন্য আসত তখন ওই বুজুর্গ সাথে সাথেই তার সাথে সাক্ষাৎ করতেন না; বরং খানা খাওয়ার সময় হওয়া পর্যন্ত বিলম্ব করতেন। দরবারের খাদেমদের প্রতি হুকুম ছিল, কোনো নতুন আগন্তুকের জন্য খানা নিয়ে যাওয়ার সময় প্রথমে ওই খানা বুজুর্গকে দেখিয়ে নিতে হবে। আবার যখন তার খানা শেষ হবে তখন অবশিষ্ট খানা ফেরত নেওয়ার সময়ও বুজুর্গকে দেখিয়ে নিতে হবে। এ নিয়মে ওই বুজুর্গ অবিশষ্ট খানা দেখে ধারণা নিতেন যে, লোকটির মাঝে নিয়মতান্ত্রিকতা ও শৃঙ্খলাবোধ আছে কি না। যেমন: লোকটি যে পরিমাণ রুটি খেয়েছে সে পরিমাণ ঝোল-তরকারি খেয়েছে কি না। যদি এমনটি হয়ে থাকে তবে বুঝতে হবে সে বিশুদ্ধ মানসিকতাসম্পন্ন লোক। পক্ষান্তরে যদি কমবেশি হয় তবে তা লোকটির বিশৃঙ্খল হওয়ার প্রমাণ।
এরপর যার মাঝে এ ধরনের অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা লক্ষ করতেন তাকে মুরিদ করার ব্যাপারে বুজুর্গ অপারগতা প্রকাশ করে দিয়ে বলতেন, আমার এখানে বাইআত হয়ে তোমার ফায়দা হবে না, তোমার মানসিকতার মাঝে অনিয়ম ও শৃঙ্খলাহীনতা রয়েছে। তুমি অন্য কোনো শাইখের দরবারে গিয়ে বাইআত হও।
📄 নিরর্থক ও বেহুদা আলোচনা মানুষকে বড়ো গোনাহে লিপ্ত করে
হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া রহ.-এর দরবারে একবার দুজন লোক এলো বাইআত হওয়ার জন্য। তারা মসজিদের হাউজে অযু করতে বসে পরস্পর কথা বলতে শুরু করল। একজন বলল, আমাদের হাউজটি এ হাউজ থেকে অনেক বড়ো। হঠাৎ শাইখ এ কথাটি শুনে ফেললেন। এরপর তারা দুজন শাইখের দরবারে উপস্থিত হলো এবং তাদেরকে বাইআত করার আবেদন জানাল। তখন শাইখ প্রশ্ন করলেন, আপনাদের হাউজটি এখানকার হাউজ থেকে কতটুকু বড়ো? একজন জবাব দিলো, তা তো বলতে পারব না। তখন শাইখ বললেন, যান, বাড়ি গিয়ে মাপঝোক করে আসুন। শাইখের কথামতো তাদের পুনরায় সফর করে নিজেদের বাড়িতে পৌঁছতে হলো। তারা বাড়ি পৌঁছে পরিমাপ করে দেখল যে, তাদের হাউজটি মাত্র এক বিঘত বড়ো। এরপর তারা পুনরায় দরবারে ফিরে এলো এবং জানাল যে, হজরত, আমি পরিমাপ করে এসেছি, সে হাউজটি এ হাউজ থেকে মাত্র এক বিঘত বড়ো। এ কথা শুনে শাইখ বললেন, আপনি তো বলেছিলেন অনেক বড়ো, এক বিঘত বড়ো হলে তা তো অনেক বড়ো হয় না।
আপনাদের এ কথার দ্বারা বোঝা যায় যে, আপনাদের মন-মানসিকতায় সত্য-মিথ্যার ব্যাপারে সতর্কতা নেই, সুতরাং আপনারা এ তরিকতের পথে চলবেন কী করে?
ওপরের বিষয়টি থেকে বোঝা যায় যে, বিশিষ্ট বুজুর্গানে দীনের পদ্ধতি এই ছিল যে, তারা মুরিদদেরকে বিভিন্ন ওজিফা ও নফল আমলের সবক দেওয়ার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক শিক্ষাদান শুরু করার পূর্বে তাদের বাহ্যিক আমলকে দুরস্ত করে নিতেন এবং বিভিন্ন খারাপ স্বভাব থেকে বেঁচে থাকার অভ্যাস সৃষ্টি করাতেন। বর্তমানে অনেক মাশাইখ এসব বিষয় লক্ষ করেন না। যার কারণে ফলাফল এই হয় যে, জিকির-আজকার ও ওজিফা তাদের খুব মশক হয় ঠিক, কিন্তু খারাপ অভ্যাসগুলো আগের মতোই ভেতরে থেকে যায়। হালাল-হারামের পার্থক্য, সত্য-মিথ্যার ব্যাপারে সতর্কতা ইত্যাদি ভালো স্বভাবগুলো ভেতরে আসে না, ফলে তারা তরিকতের দুর্নামের কারণ হয়।
📄 লেনদেনের ক্ষেত্রে সতর্কতার শিক্ষা
এক ব্যক্তি হজরত রহ.-এর বরাবরে চিঠি লিখল যে, আমি যুবক বুজুর্গের হাতে বাইআত হয়েছি। এমতাবস্থায় একবার আমি খাবে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জিয়ারত লাভ করেছি। তিনি আমাকে বলেছেন, তুমি যে বুজুর্গের হাতে বাইআত হয়েছ, তার সাথে তোমার লৌকিকতামুক্ত অবস্থা খুব বেশি, তাই তার দ্বারা তোমার উপকার হবে না, বিধায় তুমি মাওলানা আশরাফ আলি সাহেবের কাছে গিয়ে তার থেকে শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ করো।
হজরত হাকিমুল উম্মত রহ. এ পত্রের জবাবে লিখলেন, তুমি তোমার বর্তমান শাইখ থেকে তোমার ব্যাপারে আমার কাছে এ কথা লিখিয়ে পাঠাও যে, 'এ লোকটি নির্ভরযোগ্য, তার কথা নির্ভর করার মতো।' (অর্থাৎ, হজরত বলতে চাচ্ছেন যে, তুমি যে খাবের কথা আমার কাছে লিখেছ, তা যে তুমি ঠিকই লিখছ তা আমি বুঝব কীভাবে, এ ব্যাপারে বর্তমান শাইখ যদি আমাকে এ কথা বলে দেন যে, তুমি যা বলবে তা নির্ভর করার মতো; তবেই আমি তোমার কথা বিশ্বাস করে তোমাকে আমার কাছে বাইআত হওয়ার অনুমতি দিতে পারি।)
অনেক ক্ষেত্রেই এরূপ দেখা গেছে যে, অনেকে বুজুর্গানে দীনের নৈকট্যলাভের জন্য বিভিন্ন অবাস্তব ঘটনা ও স্বপ্নের কথা বর্ণনা করে থাকে, যা তাদের নিজেদের জন্য ফিতনার কারণ আর অন্যদের জন্য পেরিশানি ও অস্থিরতার কারণ হয়। হজরত রহ. নিজে এ পদ্ধতির মাধ্যমে সর্বরকম অনিষ্টতার বিষয়গুলো সমূলে বিদূরিত করে রেখেছেন এবং পূর্বের শাইখের অন্তরকে ব্যথিত করা থেকেও রক্ষা করেছেন।