📄 শায়খ তাহের জাযায়েরি রহ.-এর সময় সংরক্ষণ ও ইলম অর্জনের জন্য বিচিত্র রুটিন যাপন
আল্লামা মুফাসসির মুহাদ্দিস ফকিহ হানাফি বিভিন্ন বিদ্যায় পারদর্শী শায়খ তাহের জাজায়েরি দামেশকি রহ. (জন্ম: ১২৬৮ হিজরি, মৃত্যু: ১৩৩৮ হিজরি)-এর জীবনীতে আছে, যা তার দুই শিষ্য আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ সাইদ বানি রহ. 'তানবিরুল বাসায়ের' নামক কিতাবে ও আল্লামা মুহাম্মদ কুরদ আলি রহ. 'কুনোজুল আজদাদ' ও 'আল-মুআসিরোন' কিতাবদ্বয়ে বিভিন্ন স্থানে বর্ণনা করেছেন, তিনি ছিলেন আজীবন অবিবাহিত। কখনো বিয়ে করেননি। তিনি বাহ্যিক পোশাক-আশাকের প্রতি তেমন যত্নবান ছিলেন না। সময় বাঁচানো, অধ্যয়ন ও লেখালিখিতে সময় কাজে লাগানোর স্বার্থে তিনি সাদাসিধে ও নিম্নমানের পোশাক পছন্দ করতেন। তিনি সারা রাত জাগ্রত থাকতেন। প্রথম প্রহরে ছাত্রদের সাথে এবং ফজর পর্যন্ত স্বীয় কিতাবাদি রচনায় ও তথ্যানুসন্ধানে। তিনি ফজরের নামাজ পড়েই কেবল ঘুমাতেন। সকল নামাজ তিনি আওয়াল ওয়াক্তে পড়তেন। সফরে, বাড়িতে, মহল্লার মসজিদে, বাজারে, রাস্তায়, দাওয়াতে, লেকচারে, সাধারণ মাহফিলে, বিশেষ বৈঠকে তথা সকল ক্ষেত্রে। নামাজের টাইম হয়ে গেলে তিনি কারও পরোয়া করতেন না, যতক্ষণ আওয়াল ওয়াক্তে নামাজ আদায় না করেছেন।
তার কোনো সময় ইলম অর্জন বা ইলম শিক্ষাদান ব্যতীত অতিক্রান্ত হতো না। তার শিষ্য আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ সাইদ বানি রহ. বলেছেন, যিনি সারা রাত জেগে কাটিয়ে দিতেন, রাত-দিনকে একাকার করে ফেলতেন দরস, গবেষণা, সংকলন ও দাওয়াতের কাজে। তিনি আবার কী করে স্ত্রী-সন্তানদের জন্য জীবিকা উপার্জনের সময় বের করবেন? কখনো কখনো তিনি ছোটো ও লঘুভার কিতাব নিজ আস্তিনে বা পকেটে বহন করতেন, যেন সময়-সুযোগে পড়তে পারেন। তার কোনো সময় অযথা নষ্ট হোক সেটা তিনি চাইতেন না। অনুরূপভাবে তিনি অন্যান্য আবশ্যকীয় জিনিসও সঙ্গে বহন করতেন।
শায়খ তার সময়ের প্রতি অত্যন্ত সজাগ ছিলেন। এর একটা সাধারণ দৃশ্য আমরা তার জীবনে দেখতে পাই। তিনি কফি পানের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তাই বারবার কফি তৈরিতে যেন সময় নষ্ট না হয় এ জন্যে এক সপ্তাহের কফি একসাথে তৈরি করে রেখে দিতেন। যখনই মনে চাইত এক কাপ কফি তিনি পান করে নিতেন। এভাবে বেশ ক'দিন তিনি ঠান্ডা বাসি কফি পান করতেন। যেন তার অধ্যয়নে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। কফি পানটাও তার শুধু উপভোগ করার উদ্দেশ্যে হতো না। বরং রাত্রিজাগরণ ও উদ্যমতা সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি পান করতেন।
কোনো মুহূর্তেই তিনি ইলম চর্চা বন্ধ করতেন না। কখনো লেখালিখি, কখনো তথ্য খোঁজাখুজি, কখনো মুজাকারাহ বা অধ্যয়ন করতেন। কোনো কিতাব তার কাছে ভালো লাগলে সেটা বারবার পড়তেন। এ জন্যেই তার জীবনের সকল কিছুতেই একটা বাস্তববাদিতা ছেয়ে থাকত। কখনো তাকে ঠাট্টা বা রসিকতা করতে দেখা যেত না।
একবার একটি চমৎকার ঘটনা ঘটে গেল। তিনি কিছু কমলালেবু ক্রয় করে ঘরে রেখেছিলেন। পরের দিনই তার সফরে যাবার ইচ্ছা হলো। ঘর থেকে বের হয়ে কয়েক গজ যাওয়ার পরই তার মনে হলো কিছু কমলালেবু সাথে করে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। তার মনে পড়ল গতকাল তিনি কমলালেবু ক্রয় করেছিলেন। তাই ঘরে ফিরে গিয়ে সেগুলো আনলে সময় নষ্ট হবে ভেবে তিনি মনস্থ করলেন পথে কোথাও ক্রয় করে নেবেন। এরপর তিনি ছয় মাস পর বাড়িতে ফিরে আসেন। এসে কমলালেবুগুলো শুকিয়ে গেছে দেখে তিনি অত্যন্ত খুশি হলেন।
📄 হাকিমুল উম্মত থানবি রহ.-এর লিখিত পুস্তকাদির সংখ্যা হাজারেরেও অধিক
ভারতের শায়খ হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলি থানবি রহ.-যিনি আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পূর্বে ১৩৬২ হিজরি সনে একাশি বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন-তার পুস্তকাদির সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এটা আল্লাহর দান, তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে দান করেন। এ সবকিছুই সম্ভব হয় সময়ের সদ্ব্যবহার দ্বারা। সময়ের মূল্য কেবল হাতেগোনা ক'জন আল্লাহর তাওফিকপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই বোঝাতে সক্ষম হয়ে থাকেন। ফলে তারা সামান্য বয়স পেয়েও বিস্ময়কর-সংখ্যক পুস্তকাদি রচনা করে যেতে পারেন।
📄 শায়খ জাহাবি ও শায়খ তক্বাহ রহ. মৃত্যুর অল্পক্ষণ পূর্বেও কিতাব অধ্যয়ন করেছেন
পূর্বোক্ত ইমাম আবু ইউসুফ রহ.-এর ঘটনার মতো দুটি ঘটনা আমি জানতে পেরেছি। ঘটনা দুটি হলো আমার আব্বাজানের দুজন শায়খের। একজন হলেন আমজাদ জাহাবি রহ.। অপরজন হলেন মুহাম্মদ রাগেব তব্বাখ হলবি রহ.।
আমজাদ জাহাবি রহ. (জন্ম: ১৩০০ হিজরি, মৃত্যু: ১৩৮৭ হিজরি)-এর জীবনীতে আছে, তিনি অধিক অধ্যয়নকারী ছিলেন। এমনকি অসুস্থতার সময়ও অধ্যয়ন করতেন। মৃত্যুর এক ঘণ্টা আগেও তিনি অধ্যয়ন করছিলেন।
জনাব আল্লামা মুহাম্মদ রাওয়াস কিলাজি রহ. লিখিত 'হাদিসুর রুহ' নামক কিতাবে তার শায়খ যুগের বিস্ময় মুহাম্মদ রাগেব তব্বাখ রহ. (জন্ম : ১২৯৩ হিজরি, মৃত্যু : ১৩৯০ হিজরি) সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, আমি শায়খের কাছে তার মৃত্যুর দিন গিয়েছিলাম। তাকে তখন বিভিন্ন তোষক গদি ইত্যাদি দ্বারা বেষ্টন করে রাখা হয়েছিল হেলান দেওয়ার জন্য। আমি দেখলাম, তার জিহ্বা ভারি হয়ে গেছে। চোখের পলকগুলো নিচে নেমে এসেছে। চোখ মেলতে তার কষ্ট হচ্ছিল। অনেক বেশি পাওয়ারের চশমা তার চোখে ছিল। তার হাতে ছিল কিতাব। এক-দুই লাইন পড়েই তিনি ক্লান্ত হয়ে যেতেন। কিছুক্ষণ মাথা হেলান দিয়ে বসে থাকতেন। এরপর আবার পড়তে শুরু করতেন। আমি তাকে বললাম, হুজুর! এখন যদি আপনি না পড়তেন এবং কিছুক্ষণ আরাম করতেন, তো ভালো হতো। কারণ, আপনার অনেক কষ্ট হচ্ছে। জবাবে তিনি কিছু কথা বললেন, যা তার মুখের জড়তার কারণে আমি ভালো করে বুঝতে পারিনি। কিন্তু এতটুকু আমার ধারণা হয়েছে যে, একটি মাসআলা আছে যা না জেনে তিনি মরতে চান না। তখন আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করল। আমি তাকে বললাম, আপনার যদি এতই আগ্রহ থাকে তাহলে আমাকে অনুমতি দিন; আমি আপনাকে পড়ে শুনাই। আমি কিতাবটি তার হাত থেকে নিলাম এবং পড়তে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর তার দিকে তাকালাম। তিনি যখন মাথা হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। আমি মনে করলাম, তিনি আমার পড়া শুনছেন। আমি পড়া অব্যাহত রাখলাম। এমন সময় তার ছেলে প্রবেশ করল এবং পিতাকে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখতে পেল। সে আমাকে রুমের বাইরে যেতে অনুরোধ করল। আমি বাইরে চলে গেলাম। অল্পক্ষণ পরেই আমি তার মৃত্যুর সংবাদ শুনতে পেলাম। আল্লাহ তায়ালা এই মনোবল ও শীর্য মনীষীগুলোকে রহম করুন! আমাদেরকে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণের তাওফিক দান করুন! (সালমান)
📄 ইবনে আসাকের রহ.-এর স্রোত হাদিসের কপিগুলো পৌঁছতে বিলম্ব হওয়া ও না পৌঁছা পর্যন্ত এর জন্য তার চরম অস্থিরতা
তার ছেলে হাফেজ আবু মুহাম্মদ কাসেম রহ. বলেন, আমার আব্বা অনেক কিতাব শুনেছিলেন যেগুলোর কপি তিনি তৈরি করেননি। তার সহপাঠী হাফেজ আবু আলি ইবনুল ওয়াজির রহ.-এর কপিগুলোর ওপর নির্ভর করে। ইবনুল ওয়াজির রহ. যেগুলোর কপি তৈরি করতেন আমার আব্বা সেগুলোর কপি নকল করতেন না। আর আমার আব্বা যেগুলোর কপি নকল করতেন ইবনুল ওয়াজির সেগুলোর কপি তৈরি করতেন না।
একদা কোনো এক রাতে তাকে শুনেছি। তিনি জামে মসজিদে চাঁদের আলোতে তার এক বন্ধুর সাথে কথা বলছিলেন। তিনি বলেন, আমি সফর করেছি, কিন্তু যদি না করতাম তা-ই ভালো হতো। অনেক কিতাব পড়েছি, কিন্তু যদি না পড়তাম তা-ই ভালো হতো! আমি ধারণা করেছিলাম আমার সাথি ইবনুল ওয়াজির রহ. আমার শ্রোত কিতাবগুলো নিয়ে আসবে। যেমন: সহিহ বুখারি, মুসলিম, বায়হাকির কিতাবগুলো, উঁচু সনদের আজজাগুলো। কিন্তু ঘটনাচক্রে সে মারু এলাকায় স্থায়ী হয়ে গেছে, সেখানেই সে অবস্থান করবে। আমার কিতাবগুলো আর নিয়ে আসবে না।
আমি আশা করেছিলাম যে, আমার আরেক সাথি হয়তো আসবে। তার নাম ইউসুফ ইবনে ফারওয়া জাইয়ানি রহ.। এবং আমাদের আরেক সাথি আবুল হাসান মুরাদি রহ. আসার কথা ছিল। সে আমাকে বলেছিল, আমি দামেশকে যাব, কিন্তু কই! কেউ তো দামেশকে এলো না। তাই আমার তৃতীয়বার সফর করতে হবে। বড়ো বড়ো কিতাবগুলো ও গুরুত্বপূর্ণ আজজাগুলো আনতে হবে।
অল্প কিছুদিন পরেই তার এক বন্ধু এলো। তার দরজায় কড়া নাড়ল। সে বলল, আবুল হাসান মুরাদি এসেছে। আমার পিতা তার কাছে নেমে গেলেন। তাকে স্বাগত জানিয়ে তার বাড়িতে সসম্মানে অবস্থান করালেন। সে চার বস্তা ভরে তার শ্রোত কিতাবগুলো নিয়ে এলো। আমার পিতা দেখে অত্যন্ত খুশি হলেন। এবং আল্লাহর শুকর আদায় করলেন যে, তিনি অতি সহজে কোনো কষ্ট ছাড়াই তার শ্রোত কিতাবগুলো এনে দিলেন। তার আর সফর করতে হবে না। এরপর তিনি কিতাবগুলোর কপি তৈরি করতে শুরু করলেন। যখনই কোনো একটি জুজের কপি তৈরি করে শেষ করতেন, মনে হতো যেন তিনি সারা দুনিয়া অর্জন করে ফেলেছেন।' (ইবনে আসাকেরের আলোচনা শেষ হলো।)