📄 ইমাম মুহাম্মদ আবেদ সিন্ধি রহ. সফরব্যবস্থায়ও লিখতেন এবং নুসখা তৈরি করতেন
ইমাম মুহাদ্দিস ফকিহ মুহাম্মদ আবেদ সিন্ধি আনসারি রহ., (জন্ম: ১১৯০ হিজরি, মৃত্যু: ১২৫৭ হিজরি) তিনি ইমাম শাফেয়ির মুসনাদটির বিন্যাস, সংক্ষেপায়ন ও যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি করেছেন সফরাবস্থায়। আরাম ও পানাহারের জন্য বিরতির সময়। তিনি 'তারতিবু মুসনাদিল ইমামিশ শাফেয়ি' কিতাবটির সমাপ্তিতে বলেছেন, সংকলনটি শুরু করেছিলাম ১২২৯ হিজরি সনের জিলকদ মাসে হজের সফরের জন্য পশুবাহিত গাড়িতে চড়ার পর। আর তা সমাপ্ত হলো ১২৩০ হিজরি সনের রবিউল আওয়াল মাসের বিশ তারিখ রোজ বুধবার আসরের পর। হারামাইন শরিফাইন থেকে ফিরে আসার সময় কুনফুজা জামে মসজিদে। আমি শুধু পানি পান করার জন্য সামান্য বিরতি ও আরামের জন্য সফর বিরতির সময়ই কেবল লিখতে সক্ষম হতাম। এটা কেবল আল্লাহর দেওয়া নিয়ামত। তিনি আমাকে এমন সময় রাসুল সা.-এর সুন্নাহর সেবা করার তাওফিক দিয়েছেন, যখন সাধারণত এ ধরনের কাজ করা আদৌ সম্ভব হয় না।
অনুরূপভাবে তিনি 'লিসানুল মিজান' কিতাবটির অর্ধেক নকল করেছেন ওমরার জন্য মদিনা থেকে মক্কা যাওয়ার পথে। এ সময় মাহমুদিয়া লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত তার নিজ হাতে লেখা প্রথম খণ্ডটির শেষে লেখা আছে—
১২৫১ হিজরি সনের শাবান মাসের আটাশ তারিখে প্রথম খণ্ডটি সমাপ্ত হলো। আমরা এখন রমজান মাসে ওমরা করার উদ্দেশ্যে যাবার পথে রাবেগ নামক স্থানের নিকটে শাদোন নামক স্থানে অবস্থান করছি। এরপর দ্বিতীয় খণ্ডটি শুরু হবে ইনশাআল্লাহ।
সে সময়কার যুগে সফরের অবস্থা, যানবাহন ও আরামের স্থানগুলোর অবস্থা সকলেরই জানা। যদি তিনি মনে না করতেন যে, কিতাব নকল করা ও রচনা অন্যতম একটি মহান ইবাদত, তাহলে সফরে আরামের সময়টা তিনি আদৌ এ কাজে ব্যয় করতেন না।
📄 আল্লামা আব্দুল্লাহ বাশরি রহ. বাসর রাতেও কিতাব অধ্যয়নে মগ্ন ছিলেন, নববধূর প্রতি আদৌ তাকিয়ে দেখেননি
আল্লামা মুহাম্মদ আহমদ উমর শাতেরি এ কিতাবটির (কিমাতুজ জামান) পঞ্চম সংস্করণটি পড়ার পর আমার পিতার নিকট প্রেরিত একটি চিঠিতে বলেছেন, কিতাবটি পড়ার পর আমার মনে পড়ছে আল্লামা মুফতি হাবিব আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ইবনে ইয়াহইয়া বালাবি রহ. (মৃত্যু: হাজরামওতে ১২৬৫ হিজরি সনে)- এর কথা। তার কাছে তার নববিবাহিতা স্ত্রীকে পাঠানো হলো। তিনি বাসর ঘরে প্রবেশ করে দেখেন সেখানে কয়েকজন মহিলা রয়েছে। ঘটনাটি মধ্যরাতের। তাই তিনি শায়খ ইসমাইল ইবনে মুকরি ইয়ামানি শাফেয়ি (মৃত্যু: ৮৩৭ হিজরি)-এর লেখা 'আল-ইরশাদ' কিতাবটি হাতে নিলেন। ইতিমধ্যে মহিলারা চলে গেল। কিন্তু তিনি ফজর পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টা যাবৎ কিতাবটি অধ্যয়নে তন্ময় হয়ে থাকলেন। নববধূ হেলান দিয়ে বসে রইল। তিনি উক্ত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তার দিকে চোখ তুলে তাকানোর কথাও ভুলে গেলেন। কারণ, তিনি ওই ইলমের অধ্যয়নে লিপ্ত ছিলেন যা তার কাছে নববধূর চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। (সালমান)
আল্লাহর জন্যে আল্লামা জামাখশারির সকল মঙ্গল,
তিনি বলেন—
গায়িকার সাথে কোলাকুলি ও দৈহিক মিলন করা যেমন প্রিয়
ইলম চর্চার জন্য বিনিদ্র রজনি আমার তদপেক্ষা অধিক প্রিয়
তরুণীর বাদ্যের ধ্বনির চেয়ে বিদ্যাচর্চা বেশি প্রিয়
কিতাব, কাগজ ও পাণ্ডুলিপির আবর্জনা সরানো আমার প্রিয়।
📄 আব্দুল হাই লখনোবি রহ. মাত্র ৩৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন অথচ তাঁর লিখিত কিতাবের সংখ্যা ১১০ ছাড়িয়ে গেছে
আমাদের বেশি দূরে যেতে হবে না। আব্দুল হাই লখনোবি হিন্দি-যিনি মাত্র একশ কয়েক বছর পূর্বে ১৩০৪ হিজরি সনে ৩৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। তার লিখিত পুস্তকাদির সংখ্যা একশ দশেরও অধিক। যার মাঝে কয়েক খণ্ডের কিতাবও আছে, আবার কয়েক পৃষ্ঠার ছোট্ট পুস্তিকাও আছে। তার সবগুলো কিতাবই অত্যন্ত উপকারী ও দুর্বোধ্য জটিল বিষয়-সংবলিত।
📄 জামালুদ্দিন কাশিমি রহ. মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন, অথচ রেখে গেছেন একশরও অধিক রচনাবলি
এটা নিঃসন্দেহে সময়কে কাজে লাগানো ও সময়ের প্রতি অত্যধিক যত্নবান হওয়ার কারণেই সম্ভব হয়েছে।
আল্লামা মুফাসসির মুহাদ্দিস ফকিহ শায়খ মুহাম্মদ জামালুদ্দিন ইবনে মুহাম্মদ সাইদ কাসেমি দামেশকি রহ. (জন্ম: ১২৮৩ হিজরি, মৃত্যু: ১৩৩২ হিজরি) মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৪৯ বছর। তিনি সময়ের প্রতি চরম যত্ন নিয়েছেন। সময়কে কাজে লাগিয়ে ফলবান করেছেন। উচ্চ মনোবলে সুসজ্জিত হয়েছেন। এর সোনালি ফসল হলো একশরও অধিক রচনা। যার মধ্যে ছোটো-বড়ো সব ধরনের পুস্তকাদি রয়েছে।
জনাব আসেম বাইতার রহ. শায়খ কাসেমির লেখা 'আল-ফজলুল মুবিন' নামক কিতাবের সূচনায় সন্নিবেশিত তার জীবনীতে বলেন, শায়খ নিজ বয়সের স্বল্পতা ও কর্মের আধিক্যতা সত্ত্বেও একশরও অধিক কিতাব ও পুস্তিকা রেখে গেছেন। তিনি চৌদ্দ বছর বয়স থেকে শিক্ষকতা শুরু করেন। মৃত্যু পর্যন্ত তা ত্যাগ করেননি। তার বহু ছাত্রদের জন্য পড়ার সময় নির্ধারিত ছিল। মসজিদে, ঘরে, দিনে, রাতে। এতকিছু করেও তিনি লেখালিখি করেছেন, সংক্ষেপায়ন করেছেন, সংকলন তৈরি করেছেন। সময়ের প্রতিটি মুহূর্তকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন।
একদা তিনি খালি মাথায় একটি কফি হাউজের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হাউজটি কর্মহীন লোক দ্বারা ঠাসা ছিল। যারা বিনোদনে ও আনন্দ-উল্লাসে সময় কাটাচ্ছিল। তখন তার একজন ভক্তকে বললেন, আফসোস! আমি কত কামনা করেছি, সময়টা বিক্রির বস্তু হোক-যেন তাদের কাছে থেকে আমি তাদের সময়গুলো কিনে নিতে পারি।
কাসেমি রহ. নিজের ব্যাপারে বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা ছোটো বেলা থেকেই আমার মধ্যে পড়া, অধ্যয়ন, কিতাবের নুসখা তৈরি ও পুস্তক রচনার আগ্রহ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা স্বীয় রহমতে তার এই ক্ষুদ্র বান্দা থেকে বেকার ঘুরে বেড়ানো ও অর্থহীন কাজে সময় ব্যয় করার মানসিকতা দূরীভূত করে দিয়েছেন। ফলে সাহিত্য ও ইতিহাসের অসংখ্য কিতাব অধ্যয়ন করেছি।
তিনি 'আল-ফজলুল মুবিন'-এর ভূমিকায় বলেছেন, আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে আমার সুযোগ হয়েছে পুরো মুসলিম শরিফ চল্লিশ দিনে পড়ার। সুনানে ইবনে মাজাহ একুশ দিনে পড়ার সুযোগ হয়েছে। 'মুয়াত্তা' উনিশ দিনে এবং 'তাকরিবুত তাহজিব' কারেকশন ও টীকা লেখাসহ দশ দিনে পড়ার সুযোগ হয়েছে। কাজেই হে তিরস্কারকারী! অলসতা ঝেরে ফেলো, ইলম অধ্যয়ন ও সৎকর্মের দ্বারা স্বীয় মূল্যবান সময়কে রক্ষা করার উদ্যোগ গ্রহণ করো।
তার ছেলে প্রফেসর জাফের কাসেমি তার পিতা সম্পর্কে লেখা কিতাবে বলেছেন, আব্বার প্রাচীনতম কিতাব যা আমি পেয়েছি, তা হলো একটি ছোট্ট সংকলন। যার নাম রেখেছেন 'সাফিনাহ'। ১২৯৯ হিজরি সনে তা সংকলন করেছেন। তখন তার বয়স ছিল ষোলো। কিছু তথ্য সন্নিবেশিত করেছেন। এরপর তিনি অব্যাহতভাবে লিখে গেছেন-দিনে, রাতে, রেলে, আনন্দভ্রমণে, গাড়িতে, মসজিদে, মসজিদের সিঁড়িতে, ঘরে। আমার মনে হয় কেবল রাস্তাটাই তার কলমের অভিযান থেকে রেহাই পেয়েছিল। তার পকেটে সদা একটি কলম ও ছোট্ট একটি খাতা থাকত, যখনই কোনো ভাবনা মাথায় আসত সাথে সাথে লিখে ফেলতেন, তিনি যেখানেই থাকুন না কেন।