📄 ইবনে সাইদ আন্দালুসি রহ. মনে করেন, ইলম অর্জনের মধ্যেই তার শান্তি বিরাজমান
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ মাক্কারি রহ. স্বরচিত 'নাফহুত তিব মিন গুসনিল আন্দালুসির রাতিব' গ্রন্থে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আদিব আবুল হাসান আলি ইবনে মুসা ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল মালেক ইবনে সাইদ আন্দালুসি রহ. হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি স্বরচিত 'আল-মুগরিব ফি হুলা আহলিল মাগরিব' গ্রন্থে।
[গ্রন্থটি লেখায় ইবনে সাইদ পরিবারের পাঁচজন মনীষী অংশগ্রহণ করেছেন। আবুল হাসানের দাদা, চাচা, পিতা, আরও একজন; সবশেষে তিনি নিজে কিতাবটি সমাপ্ত করেছেন] তার পিতা বিদগ্ধ আলেম ইতিহাসবিদ আদিব আবু ইমরান মুসা ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সাইদ আন্দালুসি রহ. (জন্ম: ৫৭৩ হি., মৃত্যু : ৬৪০ হি.)-এর জীবনী লেখার সময় বলেছেন, যদি তিনি আমার পিতা না হতেন তাহলে তার বিস্তর আলোচনা করতাম। তার বিবরণ পরিপূর্ণরূপে তুলে ধরতাম। তবে যতটুকু তার জীবনীতে লিখেছি তাকে জানার জন্য ততটুকুই যথেষ্ট।
তিনি বলেছেন, 'তার বিস্ময়কর ব্যাপার যা আমি দেখেছি তা হলো, তিনি ৬৭ বছর বেঁচে ছিলেন। তাকে কোনোদিন দেখিনি কিতাব অধ্যয়ন বা লেখা থেকে বিরত থাকতে। এমনকি ঈদের দিনেও না। আমি একবার ঈদের দিন তার কাছে গেলাম। তখন তিনি অনেক পরিশ্রম করে লিখে যাচ্ছিলেন। আমি তাকে বললাম, আব্বাজান! আজকেও একটু আরাম করবেন না? তিনি রাগের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন এবং বললেন, আমার মনে হয় তুমি কোনোদিন সফল হবে না। তুমি কি মনে করো অন্য কিছুতে আরাম রয়েছে? আল্লাহর শপথ! অন্য কিছুতে এত আরাম আছে বলে আমি মনে করি না। আমি আশা করি আল্লাহ আমার বয়স দ্বিগুণ করে দেবেন, যেন আমি 'আল-মুগরিব' কিতাবটি মনমতো সমাপ্ত করতে পারি।
আবুল হাসান রহ. বলেন, তার সেই উক্তি আমাকে অনেক নাড়া দিলো। ফলে আমি তার মতো হয়ে গেলাম। পড়াশোনা ও লেখালিখিতে যে স্বাদ আমি অনুভব করি এরূপ আর অন্য কোনো নিয়ামতে অনুভব করি না। যদি এমনটা না হতো তাহলে 'আল-মুগরিব' কিতাবটি এ পর্যায়ে পৌঁছুতে পারত না, যা আপনি দেখছেন।
তিনি শহরে শহরে ঘুরে বেড়ানো, জ্ঞানীগুণীদের সাথে সাক্ষাৎ করা, বিভিন্ন বিষয় দেখে ও শুনে উপকৃত হওয়ার প্রতি সর্বাধিক আগ্রহীদের অন্যতম ছিলেন।
এমন মনীষীদের ব্যাপরেই নিম্নে বর্ণিত কবিতাগুলো :
ওহে! আপন জীবন ধ্বংসকারী শরাব ও জুলুম নির্যাতনে
ওহে অন্ধকারে অপেক্ষমাণ, উজ্জ্বল নক্ষত্রের নির্বাপণে
সে কাঁদে এমন বন্ধুর জন্যে যে তার থেকে মুখ টানে
অথবা এমন ব্যক্তির জন্যে যে দৌড়ে চলে যায় সামনে
সে এমন ডালের মতো যার নামকরণ হয়েছে ফুলের নামে
ওহে স্বাদের বিলাসী, যেগুলো মিটে যায় এই জীবনে
যখন ব্যর্থ হয় সে গর্ভময়ী ও ভালো অভ্যাস ধারণে
ওহে। তিরস্কারকারী আমার লেখালিখি ও সংকলনে
যে হতভম্ব হয় আমার ফিকির ও ধৈর্য অবলোকনে
বলে সে, কী হলো? তোমার বয়স খতম কাগজ আর কলমে
যা তৈরি হয়েছে ডাল-পালা আর ছাইয়ের মিশ্রণে
তুমি ক্লান্ত হয়ে ব্যস্ত থাকো রাত্রি জাগরণে
তোমাকে দেখানো হয়নি সদা অস্থির আচরণে
তুমি ছোটো করো এবং জিজ্ঞেস করো সংবাদ আহরণে
আমি জানি কে অগ্রিম আমার মনোবলের অবাধ্যকরণে
তুমি কান পাতো ওই ব্যক্তির প্রশংসা ও গুণকীর্তনে
যিনি মাটি হওয়ার পর, যার আলোচনা হয় সুরা পাঠের ধরনে
যারা ছিল দুনিয়াতে জমিনওয়ালার সৌন্দর্য
মৃত্যুর পর তারা কিতাব ও আদর্শের কারুকার্য।
📄 ইবনে মালেক রহ. মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে কবিতার আটটি চরণ শুনে শুনে মুখস্থ করেছেন
বড়ো বড়ো ইমাম যারা ঘণ্টা ও মুহূর্তগুলোর হেফাজত করেছেন; এমনকি মৃত্যুমুখে পতিত হয়েও শেষ বিদায়ের সময়ও, এবং মৃত্যুর সামান্য পূর্বেও ইলম অর্জন করেছেন, তাদের অন্যতম আলফিয়া ইত্যাদি কিতাবের লেখক ইমাম ইবনে মালেক নাহবি রহ.। যার নাম মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ, (জন্ম: ৬০০ হি., মৃত্যু: ৬৭২ হি.) মাক্কারি রহ. রচিত 'নাফহুত তিব' নামক কিতাবে তার জীবনী আলোচনায় আছে, তিনি ছিলেন অধিক অধ্যয়নকারী, দ্রুত পুনঃপাঠকারী। নিজ মুখস্থবিদ্যা পুনরায় কিতাবের স্ব-স্থানে না দেখে তিনি লিখতেন না। এটাই ছিল নির্ভরযোগ্য মাশায়েখ ও উলামাদের অবস্থা। তাকে শুধু নামাজ বা তিলাওয়াত বা লেখালিখি বা পড়তে দেখা যেত।
বর্ণিত আছে যে, একদিন তিনি দামেশকে তার ছাত্রদের নিয়ে বিনোদনে বের হলেন। গন্তব্যে পৌঁছার পর তারা সামান্য সময়ের জন্য তার ব্যাপারে একটু উদাসীন হলেন। এরপর তালাশ করে আর তাকে পাচ্ছিলেন না। কিছুক্ষণ পর তাকে খুঁজে পেলেন তো দেখলেন তিনি কয়েকটি কাগজে উপুড় হয়ে আছেন।
তার ইলমচর্চার এর চেয়েও অধিক বিস্ময়কর বিষয় হলো যা ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে। তিনি মৃত্যুর দিন কবিতার কয়েকটি চরণ মুখস্থ করেছেন। যার পরিমাণ কেউ কেউ আটটি বলেছেন। তার ছেলে তাকে সেগুলো শিখিয়ে দিয়েছিল। এ ঘটনাটি সেই বিখ্যাত উক্তিটির সত্যতা প্রমাণ করে: 'পরিশ্রম অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য অর্জিত হয়'। আল্লাহ তায়ালা তাকে সেই উচ্চাঙ্গের মনোবলের জন্য উত্তম বদলা দান করুন। তিনি ৬৭২ হি. সনে দামেশকে মৃত্যুবরণ করেন। এবং কাসিউন পর্বতের পাদদেশে তাকে দাফন করা হয়। তার কবরটি এখনো সুপরিচিত।
📄 ইমাম নববি রহ. দু-বছর পর্যন্ত বিছানায় পিঠ লাগাননি
হাফেজ যাহাবি রহ. 'তাযকিরাতুল হুজফায' নামক গ্রন্থে ও ইবনে কাজি শুহবাহ 'তাবাকাতুশ শাফেইয়্যা' গ্রন্থে ইমাম নববি ইয়াহইয়া ইবনে শরফ হাউরানি রহ. সম্পর্কে বলেছেন, তিনি হলেন ওলিকুল শিরোমণি, অনন্য হাফেজে হাদিস ও শায়খুল ইসলাম মুহিউদ্দিন আবু জাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনে শরফ ইবনে মুররি হিযামি হাউরানি শাফেয়ি। যিনি বহু উপকারী গ্রন্থের রচয়িতা।
তিনি ৬৩১ হি. সনে হাউরানের অন্তর্গত নাওয়া শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ৬৪৯ হি. সনে দামেশকে আসেন। সেখানে রাওয়াহিয়া মাদরাসায় অবস্থান করেন। তিনি মাদরাসার রুটি খেতেন। তিনি বলেছেন, আমি দু-বছর যাবৎ মাটিতে পিঠ লাগাইনি। তিনি মাত্র সাড়ে চার মাসে 'আত-তাম্বিহ' কিতাবটি মুখস্থ করেন। বাকি বছরে শায়খ কামাল ইসহাক ইবনে আহমদের নিকট 'আল-মুহাযযাব' কিতাবটির এক-চতুর্থাংশ মুখস্থ করে পড়েন।
তার ছাত্র আবুল হাসান ইবনুল আত্তার রহ. বলেছেন, শায়খ মুহিউদ্দিন রহ. তাকে বলেছেন, তিনি তার মাশায়েখদের নিকট ব্যাখ্যা ও সংশোধনসহ দৈনিক বারোটি সবক পড়তেন। ফেকাহ-সংক্রান্ত 'ওয়াসিত' কিতাবে দুইটি সবক, এ সংক্রান্তই 'মুহাযযাব' কিতাবে একটি সবক, হাদিস-সংক্রান্ত 'আল-জামউ বাইনাস সহিহাইন' কিতাবে একটি সবক, সহিহ মুসলিম শরিফে একটি সবক, নাহু-সংক্রান্ত ইবনে জিন্নির লেখা 'আল-লুমা' কিতাবে একটি সবক, অভিধান- সংক্রান্ত ইবনুস সিক্কিতের লেখা 'ইসলাহুল মানতিক' কিতাবে একটি সবক, সরফ বিষয়ে একটি সবক, উসুলে ফেকাহ সম্পর্কে একটি সবক, কখনো আবু ইসহাক লিখিত 'আল-লুমা' কিতাবে আবার কখনো ফখরুদ্দিন রাযি লিখিত 'আল-মুন্তাখাব' কিতাবে। আসমাউর রিজাল বিষয়ে একটি সবক, উসুলে দীন সম্পর্কে একটি সবক। নববি বলেন, আমি উক্ত পাঠ-সংক্রান্ত সব বিষয় লিখে রাখতাম। যেমন : জটিল বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা, ইবারত সুস্পষ্টকরণ, শব্দের সঠিক উচ্চারণ লিপিবদ্ধকরণ। আল্লাহ তায়ালা আমার সময়ে বরকত দান করেছেন।
📄 ইমাম নববি রহ. রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র একবার খেতেন
আবু হাসান ইবনুল আত্তাব রহ. বলেন, আমার শায়খ আমাকে বলেছেন, তিনি কোনো মুহূর্ত নষ্ট করতেন না। রাতেও না, দিনেও না। তিনি সদা ইলম চর্চায় ব্যস্ত থাকতেন। এমনকি রাস্তায় পথচলার সময়ও তাকরার ও মুতালাআ করতেন। পুরো ছটি বছর তিনি এভাবে কাটিয়ে দেন। এরপর তিনি লেখালিখি, অধ্যাপনা, উপদেশ প্রদান ও সত্যকথন শুরু করেন। তিনি দিন-রাত মিলিয়ে মাত্র একবার খেতেন, এশার নামাজের পর। আর সেহেরির সময় একবার পানি পান করতেন। তিনি ফলফলাদি ও ক্ষিরা খেতেন না। তিনি বলতেন, আমার আশঙ্কা হয় এগুলো আমার শরীরকে আর্দ্র করে দেবে এবং আমার ঘুম বৃদ্ধি করবে। তিনি সারা জীবন বিয়ে করেননি। একদা শায়খ বুরহানুদ্দিন এস্কেন্দারানি তার কাছে ইফতার করার জন্য পীড়াপীড়ি করলেন। তিনি বললেন, খাবার এখানে নিয়ে আসুন! একসঙ্গে খাব। এরপর তিনি খেয়েছেন। খাবার ছিল দু-পদের।