📄 ইমাম শাফেয়ি রহ. রাতকে তিন ভাগ করে নিতেন
ইমাম শাফেয়ি রহ. (জনা: ১৫০ হি., মৃত্যু: ২০ হি.)-এর শিষ্য রবি ইবনে সুলায়মান মুরাদি রহ. থেকে কাজি ইয়াজ রহ. বর্ণনা করে বলেন, শাফেয়ি রহ. রাতটাকে তিনভাগে ভাগ করে নিতেন। প্রথম ভাগে তিনি লিখতেন। দ্বিতীয় ভাগে নামাজ পড়তেন। তৃতীয় ভাগে ঘুমাতেন।
📄 ইবনুল বাগদাদি কেবল অপরাগে হয়েই ঘুমাতেন
খতিব রহ. রচিত 'তারিখে বাগদাদ' গ্রন্থে বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকিহ বুজুর্গ হোসাইন ইবনে আহমদ ইবনে জাফর আবু আব্দিল্লাহ রহ. (মৃত্যু : ৪০৪ হি.)-যিনি ইবনুল বাগদাদি নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন-এর জীবনী আলোচনায় বর্ণিত হয়েছে, তিনি সত্যবাদী, দীনদার, আবেদ, জাহেদ, পরহেজগার ছিলেন। কোনো এক শায়েখকে আমি বলতে শুনেছি, আবু আব্দিল্লাহ ইবনুল বাগদাদি সদা আমাদের কাছে আসতেন এমতাবস্থায় যে, তার মাথা ফাটা ও কপাল আহত থাকত। একবার তাকে বলা হলো, এমনটা কীভাবে হয়? জবাবে তিনি বললেন, তিনি অপারগ না হয়ে ঘুমান না। তার সামনে সদা কালির দোয়াত বা থালা বা অন্য কোনো জিনিস রাখা থাকে। যখন ঘুম চাপে তখন সেই বস্তুটির ওপর পড়ে যান। ফলে সেটা তার মাথা ও কপালকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়।
📄 ইয়াকুব নাজিরামি রহ. হাঁটতে কিতাব পড়তেন
কিফতি রহ. রচিত 'ইম্বাহুর রুয়াত আলা আম্বাইন নুহাত' নামক কitাবে মুহাম্মদ সাইদি ইবনে বারাকাত নাহভি বসরি মিসরি রহ. (জন্ম: ৪২০ হি., মৃত: ৫২০ হি.; ১০০ বছর বয়সে)-এর জীবনী আলোচনায় আছে, 'তিনি বলেন, আমি শৈশবে আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে খুররাযায নাজিরামিকে কারাফার পথে হাঁটতে দেখেছি। তার গায়ের রং ছিল গোধূমবর্ণের, দাড়ি ছিল অনেক বড়, পাগড়িটা ছিল গোল। তার হাতে ছিল একটি কিতাব, হাঁটতে হাঁটতে তিনি তা অধ্যয়ন করছিলেন।
এখানে আনুষঙ্গিকরূপে ফখরুদ্দিন রাযির আরেকটি ঘটনা উদ্ধৃত করছি, যা তার চরম ইলমপ্রীতির সাক্ষ্য বহন করে
ইয়াকুত হামাভি তার 'মুজামুল উবাদা' নামক কিতাবে বংশবিশেষজ্ঞ বিশিষ্ট সাহিত্যিক শরিফ মারওয়াযি আলাভি রহ. (জন্ম: ৫৭২ হি., মৃত্যু: ৬১২ হি. পর)-এর জীবনীতে লিখেছেন, আল্লামা ইয়াকুত হামাভি তার সাথে ৬১৪ হিজরিতে মারু এলাকায় সাক্ষাৎ করেন এবং আখলাক ও ইলমের ওপর প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন, তিনি সদাচার, নম্রতা, ভদ্রতা, লাজুকতা, হাসিমাখা চেহারা ও বহিরাগত শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা ইত্যাদি গুণের সমন্বয়ক ছিলেন। যা আমরা অন্য অনেকের মাঝে বিচ্ছিন্নরূপে দেখতে পাই। এর পাশাপাশি তিনি বংশজ্ঞান, নাহু, অভিধান, কবিতা, উসুল ও জোতিষ্কবিদ্যার সর্বাধিক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি বিশাল জ্ঞানের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও বিনয়ী ও সদাচারী ছিলেন।
তিনি আমাকে বলেছেন, একদা ফখরুদ্দিন রাযি রহ. মারু অঞ্চলে এলেন। তিনি মর্যাদার উচ্চতা, বিশাল ব্যক্তিত্ব ও শ্রদ্ধাজনিত ভিতির কারণে তার কথার কেউ প্রতিবাদ করতে পারত না। তার মহত্ত্বের কারণে তার সামনে শ্বাস ফেলারও সাহস পেত না। যেমনটা সর্বজনবিদিত।
আমি তার সাথে দেখা করলাম। তার কাছে পড়ার জন্য বারবার যাতায়াত করলাম। একদিন তিনি আমাকে বললেন, আমাকে তালেবে ইলমদের বংশলতিকা সম্পর্কে একটি ছোট্ট পুস্তিকা লিখে দাও! আমি তা পড়ব। এ বিষয়ে অজ্ঞ থেকে আমি মরতে চাই না। আমি তাকে বললাম, শাজারাহ আকারে লেখব না বিক্ষিপ্তভাবে? তিনি বললেন, শাজারাহরূপে লিখলে তা সহজে মুখস্থ করা যায় না। আর আমি তা মুখস্থ করতে চাই। আমি বললাম, ঠিক আছে, তেমনটাই হবে।
আমি তার কাছ থেকে উঠে গেলাম। এবং ফখরুদ্দিন রাযির প্রতি ইঙ্গিত করে 'ফখরি' নামে কিতাবটি লিখলাম। এরপর আমি কিতাবটি নিয়ে তার কাছে এলাম। তিনি জানতে পেরে তার পাঠদানের সময়ের আসনটি ছেড়ে নিচে নেমে এলেন। চাটাইয়ে বসলেন। তিনি আমাকে বললেন, তুমি ওই আসনটিতে বসো! আমি ভয়ে কেঁপে উঠলাম। কিন্তু তিনি রাগের স্বরে আমাকে ধমক দিলেন এবং বললেন, আমি যেখানে বসতে বলেছি সেখানে বসো! আমি ভয়ে অস্থির হয়ে গেলাম। কিন্তু করার কিছু ছিল না। তাই নিরুপায় হয়ে আমি তার আদেশমতো বসলাম।
এরপর তিনি আমার সামনে বসে উক্ত কিতাবটি আমাকে পড়ে শোনালেন। যেখানে জটিলতা অনুভব করতেন আমাকে জিজ্ঞেস করতেন। এভাবে তিনি কিতাবটি শেষ করলেন। অতঃপর বললেন, এখন যেখানে মনে চায় বসো। এই বিষয়ে তুমি আমার উস্তাদ। আমি তোমার কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করেছি। আমি তোমার ছাত্র হলাম। আর ছাত্র উস্তাদের সামনে বসবে-এটাই আদব।
আমি আমার স্থান থেকে উঠে গেলাম। তিনি তার স্থানে এসে বসলেন। এরপর আমি আগের স্থানে বসে তার কাছে পড়তে লাগলাম। আমি শপথ করে বলতে পারি, এটা নিঃসন্দেহে একটা সুন্দর শিক্ষণীয় আদব। বিশেষ করে ওই মহান মর্যাদাবান মনীষীর পক্ষ থেকে।
পাঠক। লক্ষ করুন। কীভাবে বিনয় প্রদর্শন করলেন, স্ব-যুগের এই অনন্যসাধারণ ইমাম! নিজ শিষ্যের কাছে আবেদন করলেন তাকে বংশবিদ্যা শিখাতে। আপন শিষ্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ করলেন না। তাকে উস্তাদের স্থানে বসালেন। তিনি ছাত্রের স্থানে বসলেন। এটাই ছিল তার বিনয় ও মহত্ত্বের প্রতীক, যার দ্বারা ইমাম ফখরুদ্দিন রাযি রহ.-এর মর্যাদা বেড়ে গগণচুম্বী হয়ে গেল। এতে তার মর্যাদার হানি ঘটেনি। লক্ষ করুন! ওই ধরনের আলেমদের হৃদয়ে ইলম কত প্রিয় ছিল! তাদের মনে ইলমের মর্যাদা কত উঁচু ছিল! তাদের দৃষ্টিতে ইলম কত প্রিয় ছিল! তাদের দৃষ্টিতে ইলম কত উচ্চাঙ্গের বিষয় ছিল! উত্তরসূরিদের এই মহান পূর্বসূরিদের অনুসরণ কত প্রয়োজন! তারা ইলমের জন্য বিনয়ী হতে দ্বিধাবোধ করেন না। এমনকি তাদের ছাত্রদের কাছ থেকে ইলম অর্জন করেন। তাতে উন্নাসিকতা প্রদর্শন করেন না। কেননা ইলম তাদের হৃদয়ে সকল মান-মর্যাদার ঊর্ধ্বের বিষয় ছিল, সবকিছু থেকে অধিক দামি ছিল।
📄 ইবনে সাইদ আন্দালুসি রহ. মনে করেন, ইলম অর্জনের মধ্যেই তার শান্তি বিরাজমান
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ মাক্কারি রহ. স্বরচিত 'নাফহুত তিব মিন গুসনিল আন্দালুসির রাতিব' গ্রন্থে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আদিব আবুল হাসান আলি ইবনে মুসা ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল মালেক ইবনে সাইদ আন্দালুসি রহ. হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি স্বরচিত 'আল-মুগরিব ফি হুলা আহলিল মাগরিব' গ্রন্থে।
[গ্রন্থটি লেখায় ইবনে সাইদ পরিবারের পাঁচজন মনীষী অংশগ্রহণ করেছেন। আবুল হাসানের দাদা, চাচা, পিতা, আরও একজন; সবশেষে তিনি নিজে কিতাবটি সমাপ্ত করেছেন] তার পিতা বিদগ্ধ আলেম ইতিহাসবিদ আদিব আবু ইমরান মুসা ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সাইদ আন্দালুসি রহ. (জন্ম: ৫৭৩ হি., মৃত্যু : ৬৪০ হি.)-এর জীবনী লেখার সময় বলেছেন, যদি তিনি আমার পিতা না হতেন তাহলে তার বিস্তর আলোচনা করতাম। তার বিবরণ পরিপূর্ণরূপে তুলে ধরতাম। তবে যতটুকু তার জীবনীতে লিখেছি তাকে জানার জন্য ততটুকুই যথেষ্ট।
তিনি বলেছেন, 'তার বিস্ময়কর ব্যাপার যা আমি দেখেছি তা হলো, তিনি ৬৭ বছর বেঁচে ছিলেন। তাকে কোনোদিন দেখিনি কিতাব অধ্যয়ন বা লেখা থেকে বিরত থাকতে। এমনকি ঈদের দিনেও না। আমি একবার ঈদের দিন তার কাছে গেলাম। তখন তিনি অনেক পরিশ্রম করে লিখে যাচ্ছিলেন। আমি তাকে বললাম, আব্বাজান! আজকেও একটু আরাম করবেন না? তিনি রাগের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন এবং বললেন, আমার মনে হয় তুমি কোনোদিন সফল হবে না। তুমি কি মনে করো অন্য কিছুতে আরাম রয়েছে? আল্লাহর শপথ! অন্য কিছুতে এত আরাম আছে বলে আমি মনে করি না। আমি আশা করি আল্লাহ আমার বয়স দ্বিগুণ করে দেবেন, যেন আমি 'আল-মুগরিব' কিতাবটি মনমতো সমাপ্ত করতে পারি।
আবুল হাসান রহ. বলেন, তার সেই উক্তি আমাকে অনেক নাড়া দিলো। ফলে আমি তার মতো হয়ে গেলাম। পড়াশোনা ও লেখালিখিতে যে স্বাদ আমি অনুভব করি এরূপ আর অন্য কোনো নিয়ামতে অনুভব করি না। যদি এমনটা না হতো তাহলে 'আল-মুগরিব' কিতাবটি এ পর্যায়ে পৌঁছুতে পারত না, যা আপনি দেখছেন।
তিনি শহরে শহরে ঘুরে বেড়ানো, জ্ঞানীগুণীদের সাথে সাক্ষাৎ করা, বিভিন্ন বিষয় দেখে ও শুনে উপকৃত হওয়ার প্রতি সর্বাধিক আগ্রহীদের অন্যতম ছিলেন।
এমন মনীষীদের ব্যাপরেই নিম্নে বর্ণিত কবিতাগুলো :
ওহে! আপন জীবন ধ্বংসকারী শরাব ও জুলুম নির্যাতনে
ওহে অন্ধকারে অপেক্ষমাণ, উজ্জ্বল নক্ষত্রের নির্বাপণে
সে কাঁদে এমন বন্ধুর জন্যে যে তার থেকে মুখ টানে
অথবা এমন ব্যক্তির জন্যে যে দৌড়ে চলে যায় সামনে
সে এমন ডালের মতো যার নামকরণ হয়েছে ফুলের নামে
ওহে স্বাদের বিলাসী, যেগুলো মিটে যায় এই জীবনে
যখন ব্যর্থ হয় সে গর্ভময়ী ও ভালো অভ্যাস ধারণে
ওহে। তিরস্কারকারী আমার লেখালিখি ও সংকলনে
যে হতভম্ব হয় আমার ফিকির ও ধৈর্য অবলোকনে
বলে সে, কী হলো? তোমার বয়স খতম কাগজ আর কলমে
যা তৈরি হয়েছে ডাল-পালা আর ছাইয়ের মিশ্রণে
তুমি ক্লান্ত হয়ে ব্যস্ত থাকো রাত্রি জাগরণে
তোমাকে দেখানো হয়নি সদা অস্থির আচরণে
তুমি ছোটো করো এবং জিজ্ঞেস করো সংবাদ আহরণে
আমি জানি কে অগ্রিম আমার মনোবলের অবাধ্যকরণে
তুমি কান পাতো ওই ব্যক্তির প্রশংসা ও গুণকীর্তনে
যিনি মাটি হওয়ার পর, যার আলোচনা হয় সুরা পাঠের ধরনে
যারা ছিল দুনিয়াতে জমিনওয়ালার সৌন্দর্য
মৃত্যুর পর তারা কিতাব ও আদর্শের কারুকার্য।