📘 কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা > 📄 কিয়ামতের আলামত বা পূর্বাভাস

📄 কিয়ামতের আলামত বা পূর্বাভাস


কিয়ামতের সময় আল্লাহ মানুষকে জানান নি, তবে কিয়ামতের বিষয়ে কিছু পূর্বাভাস তিনি জানিয়েছেন। কুরআন কারীমে বলা হয়েছে:
فَهَلْ يَنْظُرُونَ إِلَّا السَّاعَةَ أَنْ تَأْتِيَهُمْ بَغْتَةً فَقَدْ جَاءَ أَشْرَاطُهَا فَأَنَّى لَهُمْ إِذَا جَاءَتْهُمْ ذِكْرَاهُمْ "তারা কি কেবল এজন্য অপেক্ষা করছে যে, কিয়ামত তাদের নিকট এসে পড়ুক আকস্মিকভাবে? কিয়ামতের লক্ষণসমূহ তো
এভাবেই ঘটবে! কিয়ামত এসে পড়লে তারা উপদেশ গ্রহণ করবে কেমন করে?"
কিয়ামতের বিষয়ে কুরআন কারীমে ও হাদীস শরীফে বিভিন্ন পূর্বাভাস উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলি মুমিন সরল অন্তঃকরণে সহজভাবে বিশ্বাস করেন। কুরআন ও হাদীসের আলোকে অধিকাংশ ওলামা এগুলি থেকে কিছু বিষয়কে ‘আলামাতুস সুগরা’ (علامات الصغرى) অর্থাৎ ‘ক্ষুদ্রতর আলামত’ বা ‘সাধারণ আলামত’ এবং কিছু বিষয়কে ‘আলামাতুল কুবরা’ (العلامات الكبرى) অর্থাৎ ‘বৃহত্তর আলামত’ বা বিশেষ আলামত বলে উল্লেখ করেছেন।

📘 কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা > 📄 আলামাত সুগরা

📄 আলামাত সুগরা


উপরের আয়াতে বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের পূর্বাভাসসমূহ প্রকাশিত হয়েছে। এ সকল পূর্বাভাসের অন্যতম সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (ﷺ)-এর আগমন। সাহেব ইবনু সায়িদ আস সায়িদী বলেন:
بُعِثْتُ أَنَا وَالسَّاعَةُ كَهَذِهِ مِنْ هَذِهِ أَوْ كَهَاتَيْنِ وَقَرَنَ بَيْنَ السَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى “রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর হাতের তর্জনী ও মধ্যমা অঙ্গুলী একত্রিত করে বলেন: “আমি প্রেরিত হয়েছি কিয়ামতের সাথে এভাবে পাশাপাশি।"
এভাবে আমরা দেখছি যে, খাতমুন নবুওয়্যাত বা নবুওয়্যাতের ধারার পরিসমাপ্তি কিয়ামতের অন্যতম পূর্বাভাস। বিভিন্ন হাদীসে কিয়ামতের আরো অনেক পূর্বাভাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ সকল হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, কিয়ামতের পূর্বে আরব উপদ্বীপে নদনদী প্রবাহিত হবে এবং এক খণ্ড ফাৎ-খাৎমার ছড়িয়ে পড়বে। ইরাকের ফোরাত নদীর তলদেশ থেকে স্বর্ণ বা সম্পদ প্রকাশিত হবে, যা সামাজিকভাবে মানুষের জাগতিক উন্নতি ঘটাবে, জীবনযাত্রা উন্নত হবে, অল্প সময়ে মানুষ অনেক সময়ের কাজ করবে, অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যাপক হবে, অধিকাংশ মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ও স্বাবলম্বী হয়ে যাবে। তবে মানুষের বিশ্বাস ও ধার্মিকতা কমে যাবে, নৈতিক মূল্যবোধের ব্যাপক অবক্ষয় ঘটবে, পাপ, অনাচার ইত্যাদি ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করবে, মিথ্যা ও শুভ নবাবিগণের আবির্ভাব ঘটবে, হত্যা, সন্ত্রাস, ও বৃহৎ পরিসরে যুদ্ধ হতে থাকবে। এ সকল আলামত প্রকাশের এক পর্যায়ে বিশেষ আলামতগুলি প্রকাশিত হবে।

📘 কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা > 📄 আলামাত কুবরা

📄 আলামাত কুবরা


সাহাবী হুযাইফা ইবনু আসীদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আরাফাতের মাঠে (বিদায় হজের সময়ে) অবস্থান করছিলেন। আমরা তাঁর দিকে নিজ দেহে অবনয়ন করছিলাম। তিনি আমাদের দিকে দৃষ্টিপাত করে বলেন, তোমরা কি বিষয়ের আলোচনা করছ? আমরা বললাম: আমরা কিয়ামতের আলোচনা করছি। তিনি বলেন:
إِنَّ السَّاعَةَ لَا تَكُونُ حَتَّى تَرَوْنَ عَشْرَ آيَاتٍ خَسْفٌ بِالْمَشْرِقِ وَخَسْفٌ بِالْمَغْرِبِ وَخَسْفٌ فِي جَزِيرَةِ الْعَرَبِ وَالدُّخَانُ وَالدَّجَّالُ وَدَابَّةُ الْأَرْضِ وَيَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَطُلُوعُ الشَّمْسِ مِنْ مَغْرِبِهَا وَنَارٌ تَخْرُجُ مِنْ قُعْرَةِ عَدَنَ تَرْحَلُ النَّاسَ. وَنُزُولُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ... "দশটি আয়াত বা নিদর্শন না ঘটা পর্যন্ত কিয়ামত হবে না: (১) পূর্ব দিকে ভূমিধস বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় (ভূ-পৃষ্ঠে যমীনের মধ্যে দেবে যাওয়া), (২) পশ্চিমদিকে ভূমিধস বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, (৩) আরব উপদ্বীপে ভূমিধস বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, (৪) ধুয়া, (৫) দাজ্জাল, (৬) ভূমির প্রাণী, (৭) ইয়াজুজ-মাজুজ, (৮) পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়, (৯) এদেনের ভূগর্ভ থেকে অগ্নি নির্গত হয়ে মানুষদেরকে তাড়িয়ে নেওয়া এবং (১০) ঈসা ইবনু মরিয়ম (আ)-এর অবতরণ।"
এ সকল আলামত সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ সহ অনেক সহীহ হাদীস বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে সংকলন করা হয়েছে। কুরআন কারীমে কোনো আলামতের বিষয়ে ইঙ্গিত বা উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ বলেন:
وَإِذَا وَقَعَ الْقَوْلُ عَلَيْهِمْ أَخْرَجْنَا لَهُمْ دَابَّةً مِنَ الْأَرْضِ تُكَلِّمُهُمْ أَنَّ النَّاسَ كَانُوا بِآيَاتِنَا لَا يُوقِنُونَ "যখন ঘোষিত শান্তি উহাদিগের নিকট আসবে তখন আমি মৃত্তিকা-গর্ভ হতে বাহির করব এক জীব, যা তাদের সাথে কথা বলবে, এই জন্য যে, মানুষ আমার নির্দর্শনে অবিশ্বাসী।" অন্যত্র তিনি বলেন:
وَقَوْلِهِمْ إِنَّا قَتَلْنَا الْمَسِيحَ عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ رَسُولَ اللَّهِ وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَكِنْ شُبِّهَ لَهُمْ وَإِنَّ الَّذِينَ اخْتَلَفُوا فِيهِ لَفِي شَكٍّ مِنْهُ مَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ إِلَّا اتِّبَاعَ الظَّنِّ وَمَا قَتَلُوهُ يَقِينًا * بَلْ رَفَعَهُ اللَّهُ إِلَيْهِ وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا وَإِنْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ إِلَّا لَيُؤْمِنَنَّ بِهِ قَبْلَ مَوْتِهِ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكُونُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا "আর ‘আমরা আল্লাহর রসূল মরিয়ম-তনয় ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি!’ তাদের (ইহুদীদের) এ উক্তির জন্য। অথচ তারা তাকে হত্যা করে নি, ক্রুশবিদ্ধও করে নি; কিন্তু তাদের তরে একরূপ বিভ্রম হয়েছিল। যারা তার সম্বন্ধে মতভেদ করেছিল তারা নিশ্চয়ই এ সম্বন্ধে সংশয়যুক্ত ছিল; এ সম্পর্কে অনুমানের অনুসরণ ব্যতীত কোন জ্ঞানই ছিল না। নিশ্চিত যে তারা তাকে হত্যা করে নি। বরং আল্লাহ তাকে তাঁর নিকট তুলে নিয়েছেন এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। কিতাবীদের মধ্যে প্রত্যেকে তার মৃত্যুর পূর্বে তাকে বিশ্বাস করবেই।
এবং কিয়ামতের দিন সে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে।" এ আয়াতে ঈসা (আ)-এর পুনরাগমনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাঁর পুনরাগমনের পরে তাঁর মৃত্যুর আগে সকল কিতাবীই তার বিষয়ে সঠিক জ্ঞান লাভ করবে এবং ঈমান আনয়ন করবে।
ইয়াজুজ মাজুজের বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন:
حَتَّى إِذَا فُتِحَتْ يَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَهُمْ مِنْ كُلِّ حَدَبٍ يَنْسِلُونَ وَاقْتَرَبَ الْوَعْدُ الْحَقُّ فَإِذَا هِيَ شَاخِصَةٌ أَبْصَارُ الَّذِينَ كَفَرُوا يَا وَيْلَنَا قَدْ كُنَّا فِي غَفْلَةٍ مِنْ هَذَا بَلْ كُنَّا ظَالِمِينَ "এমন কি যখন য়া'জুজ ও মা'জুজকে মুক্তি দেওয়া হবে এবং তারা প্রতি উচ্চভূমি হতে ছুটে আসবে। অমোঘ প্রতিশ্রুতকাল আসন্ন হলে অকস্মাৎ কাফিরদিগের চক্ষু স্থির হয়ে যাবে, তারা বলবে 'হায়, দুর্ভোগ আমাদিগের! আমরা তো ছিলাম এ বিষয়ে উদাসীন; না, আমরা সীমালংঘনকারীই ছিলাম'।" ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেন:
وَخُرُوجُ الدَّجَّالِ وَيَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ وَطُلُوعُ الشَّمْسِ مِنْ مَغْرِبِهَا وَنُزُولُ عِيسَى عَلَيْهِ السَّلَامُ مِنَ السَّمَاءِ وَسَائِرُ عَلَامَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ عَلَى مَا وَرَدَتْ بِهِ الْأَخْبَارُ الصَّحِيحَةُ حَقٌّ كَائِنٌ "দাজ্জালের বহির্গমন, ইয়াজুজ ও মাজুজের বহির্গমন, অস্তগমনের স্থান থেকে সূর্যের উদয় হওয়া, আকাশ থেকে ঈসা (আ)-এর অবতরণ এবং কিয়ামতের অন্যান্য সকল পূর্বাভাস, যা সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তা সবই সত্য এবং ঘটবেই। মহান আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সরল পথে পরিচালিত করেন।" এখানে ইমাম আবূ হানীফ (রাহ) কিছু আলামতের কথা উল্লেখ করে এ বিষয়ে আহলুস সুন্নাতের মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। তা হলো 'সহীহ হাদীসে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে তা বিশ্বাস করা মেনে নেওয়া।' ইমাম তাহাবী (রাহ) বলেন: "আমরা কিয়ামতের নিদর্শনসমূহ বিশ্বাস করি, যেমন, দাজ্জালের আবির্ভাব, ঈসা (আ)-এর অবতরণ, পশ্চিম আকাশ দিয়ে সূর্যোদয় এবং দাব্বাতুল আরয (যমীনের জীব) নামে পরিচিত এক বিশেষ জন্তুর স্বীয় স্থান থেকে বহির্গত হওয়া। আমরা কোনো গণক, জ্যোতিষী বা ভবিষ্যদ্বক্তার কথা বিশ্বাস করি না। অনুরূপভাবে এমন কোনো ব্যক্তির কথা বিশ্বাস করি না যে, আল্লাহর কিতাব, নবীর সুন্নাত ও উম্মতে ইসলামীর ঐক্যমত্যের বিপরীত কিছু দাবী করে।"

লিঙ্ক শেয়ার করুন
close

লিঙ্ক কপি করুন